হোম পলিটিক্স পর্ব-০২

0
405

#হোম_পলিটিক্স

#পর্ব_২

#আফসানানীতু

আসর নামাজ পড়ে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসেন আনোয়ারা, তারপর উচ্চকণ্ঠে ডাকেন…
– রুচিতা, রুচিতা!
রুচিতা তার বড় ছেলের বউ। আনোয়ারার দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম শফিকুল আর ছোট ছেলের নাম অভিরূপ। বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন সবে সাত-আট মাস হয়। ছোট ছেলেটা চাকরিতে ঢুকেছে খুব বেশিদিন হয়নি। তার স্বামী মনিরুল ইসলাম সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বাড়িতে স্কুল-কলেজের পাট চুকে গেছে, আর নাতি-নাতনি নাই বলে খুব তাড়াতাড়ি তার সম্ভাবনাও কম। সবদিক মিলিয়ে মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার বলা যায় আপাতত। তবে কিছু মানুষ আছেন নির্ঝঞ্ঝাটের মাঝেও ঝঞ্ঝাট খুঁজে বেড়ানো তাদের অভ্যাস। শান্তিতে তৃপ্তির সঙ্গে বাঁচতে তাদের ভালো লাগেনা। আনোয়ারা তাদের দলেরই একজন, যিনি খুঁজে খুঁজে জীবনে ঝামেলা বের করেন এবং সেই ঝামেলা নিজের গলায় ঝুলিয়ে হাঁটতে ভালোবাসেন। এই যেমন সাত মাস আগেও আসর নামাজের পর নিজের চাটুকু তিনি নিজেই করে খেতেন। কিন্তু ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার পর আর নিজের জন্য চা করে খেতে পারেন না তিনি। সব ক্ষেত্রে তার বয়স না বাড়লেও রান্নাঘরে যাবার ক্ষেত্রে তার বয়স ভালোই বেড়েছে! তাই বিকেলের চাটা ছেলের বউ তৈরি করে মুখের সামনে না ধরলে তার চা খাওয়াও হয় না।
রুচিতার আজ ভাত খেতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল, তাই বিছানায় গড়াগড়ি দিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। শাশুড়ির ডাকে সে হকচকিয়ে বিছানায় উঠে বসে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে যায়। ওমা, পাঁচটা বেজে গেছে! তড়িঘড়ি রান্না ঘরে গিয়ে আগে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দেয় রুচিতা, তারপর শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।
– মা ডাকছিলেন?
– না ডেকে কি করব বল? আমার ডাকাডাকি ছাড়া তো এই সংসারে কোন কাজ কমপ্লিট হয় না। আচ্ছা, বিকেলে শুধু এক কাপ চায়ই তো খাই আমি। সেটাও তুমি একদিন সময় মতো দিতে পারো না! সেটাও কি আমি ডাকাডাকি ছাড়া পাব না?
– মা, চা বসিয়েছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে হয়ে যাবে।
– তা এই পাঁচ মিনিট আর দশ মিনিট আগে শুরু হলেই তো চাটা আমার হাতে থাকতো এতক্ষণে। তুমি জানো এসময় চা না খেলে আমার মাথা ধরে যায়, সেই মাথা ধরা পুরো রাতে আমাকে যন্ত্রণা দেয়। আমার ঘুম হয় না। এসব কথা আর কতবার তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে ?
রুচিতা মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো জবাব দেয়,
– সরি মা!
– বাবা মা পড়ালেখা শিখিয়েছেন এক গাদা! আর তাই শিখে একটা জিনিস ভালোই শিখেছো… সরি বলা! ওই একটা কাজই ভালোমতো পারো।

রুচিতা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ততক্ষণে চা হয়ে গেছে। আনোয়ারা লিভিং রুমে তার প্রিয় ইজি চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছিলেন। রুচিতার বাড়িয়ে ধরা হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে তাতে একটা চুমুক দেন। নিজের ঘরের দিকে যাবার জন্য সবে পা বাড়িয়েছে রুচিতা।ওমনি তিনি অহংকার দিয়ে উঠেন,
– বৌমা! তোমাকে আমি কতবার বলেছি আমার চায়ে চিনি দেবে। চিনি ছাড়া চা আমি মুখে দিতে পারি না।
এবাড়ির সবাই চায়ে এক চামচ চিনি খায়, শুধু তার শাশুড়ির চায়ে একটু বেশি দিতে হয়। তাই সবার জন্য এক চামচ চিনি হিসেবে চা বানাবার পর তার শাশুড়ির চায়ের কাপে এক চামচ চিনি বেশি দিতে হয়। আজ তাড়াহুড়োতে সেটা দিতে মনে ছিল না রুচিতার। সে কি আবার সরি বলবে নাকি তার জন্য আবার তাকে কথা শুনতে হবে? রুচি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা চেয়ে বলে,
– দিন মা, আমি আর একটু চিনি মিলিয়ে আনছি। আনোয়ারা রাগত স্বরে বলেন,
– লাগবে না তোমার আর চিনি দেয়া। তোমার চা’ই আমি আর খাব না!
রেগে মেগে চায়ের কাপটা ঠকাস করে টি টেবিলে নামিয়ে রাখেন তিনি। অসাবধানে রাখবার কারণেই হয়তো টি টেবিল থেকে চায়ের কাপটা ফসকে মেঝেতে পড়ে শত শত টুকরো হয়ে যায়। রুচিতা চমকে সরে যায়। এদিকে তার শাশুড়ি আর্তনাদ করে ওঠে,
– ইস্ রে! আমার হাতটাই পুড়ে গেলরে!
মাটিতে পরা কাপের চায়ের ছিটা রুচিতার পায়েও এসেছে তবে তার অতটা গরম বোধ হয়নি। সে বুঝে পায়না তার শাশুড়ির হাতে এতটা চা পড়লো কোথা থেকে যে একেবারে পুড়েই গেল!
রুচিতা জড়োসড় কণ্ঠে বলে,
– মা, ব্যথা পেয়েছেন?
– সেটা জেনে আর কি করবে তুমি? এক কাপ চা আমার কপালে নাই! হাত পুড়লেই কি? আমার কপালই যেখানে পোড়া সেখানে হাত পুড়লে আর কি আসে যায়!
রুচিতা কোন জবাব দেয় না, রান্নাঘরে এসে অশ্রু সজল চোখে শাশুড়ির জন্য দ্বিতীয়বারের মতো দু চামচ চিনির চা রেডি করে।

অভিরূপ সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা কাঁচের টুকরো দেখে অবাক হয়। রুচিতা সেগুলো পরিষ্কার করছে।
– কী হয়েছে ভাবী? এত কাঁচের টুকরো, কিছু ভেঙেছে নাকি?
রুচিতা তার জবাব দেয় না। কেননা তার চোখে জল, এখন জবাব দিতে গেলে হয়তো অভিরূপ টের পেয়ে যাবে যে সে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিল। সে তাই চোখের জল লুকাতে তড়িঘড়ি রান্না ঘরের দিকে চলে যায় ময়লা তোলার বেলচা আর ব্রাশ আনতে।
আনোয়ারা ছেলেকে ঘরে ঢুকতে দেখে ডাক দেন,
– অভিরূপ, খালি পায়ে হাঁটতে যাসনে বাবা। স্পঞ্জগুলো পরে এদিকে আয়, ওইদিকে কাঁচের টুকরোতে ভরা।
সেন্ডেল পায়ে এসে মায়ের পাশে বসে অভিরূপ।
– কি ভেঙেছে মা?
– তেমন কিছু না। একটা চায়ের কাপ হাত ফসকে পড়ে ভেঙে গেল।
– ও আচ্ছা!
যদিও অভিরূপ বুঝতে পারে আনোয়ারা যত সহজ ভাবে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন ঘটনাটা তত সহজ ভাবে ঘটেনি। কেননা ভাবী যেভাবে মুখ লুকিয়ে তড়িঘড়ি রান্না ঘরের দিকে চলে গেল তাতেই বোঝা যায় তার উপর দিয়ে কিছুক্ষণ আগে ঝড় বয়ে গেছে ছোটখাটো।
– তুই চা খাবি বাবা? নাকি শরবত করে দিতে বলব?
– না মা, এখন কিছুই খাবো না। আগে ফ্রেশ হই তারপর দেখা যাবে।
অভিরূপ যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়। আনোয়ারা ছেলের হাতটা ধরে কন্ঠে মধু ঢেলে বলেন,
– বাবা, তোর কাছে একটা আবদার ছিল।
– বল মা।
– না মানে… তোর বাবা যে হৃদিতার সঙ্গে তোর বিয়ের কথা বলছে ওই ব্যাপারে তুই কিছু ভেবেছিস?
– এখনো কিছু ভাবিনি মা।
– না ভাবাই ভালো! যদিও আমার ননদের মেয়ে তবুও বলি, ওর সাথে তোকে মানায় না বাবা। তোর বাবা যদি এই ব্যাপারে কিছু জানতে চায় বলবি তুই এ ব্যাপারে আপাতত কিছু ভাবছিস না।
অভি ক্লান্ত কন্ঠে জানতে চায়,
– এটাই কি তোমার আবদার?
– তা বলতে পারিস।
– মানে হৃদিতার সঙ্গে বিয়ে হোক এটা তুমি চাও না, তাই তো? ঠিক আছে মা, তাই হবে।
অভিরূপ আর দাঁড়ায় না ,ফ্রেশ হবার জন্য নিজের রুমে চলে যায়। অভির মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। প্রথম কারণ তার ভাবীর সঙ্গে তার মায়ের আচরণ যে খুব একটা মধুর হয় না সেটা অভিরূপ প্রায়ই খেয়াল করে আর দ্বিতীয়টা তার বিয়ে নিয়ে বাড়িতে যে পলিটিক্স শুরু হয়েছে সেটা। প্রথম কারণ নিয়ে সে তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবে বলে ঠিক করে। তবে দ্বিতীয়টার ব্যাপারে তার কিছুই করার নেই। বড় কথা হচ্ছে তার মা রাজি না থাকলে সেই মেয়েকে বাড়ি না আনাই ভালো, কেননা বড় ভাইয়ের বউয়ের অবস্থা সে নিজেই দেখতে পাচ্ছে। একটা মেয়েকে বাড়ি বয়ে এনে দিনরাত অপমান করার কোন মানে হয় না। তার ওপর হৃদিতা তার ফুপাতো বোন, ছোটবেলা থেকে তারা একসঙ্গে বড় হয়েছে। তাই তার জন্য ওর মায়াটা একটু বেশি। এখন হৃদিতাকে বিয়ে করলে হয়তো তার ঝামেলা আরো বাড়বে। সবচেয়ে ভালো হয় অভি যদি কোনদিন বিয়েই না করে। কেননা সে তার মাকে খুব ভালবাসে, তাই বউয়ের জন্য সে কখনোই তার মাকে কিছু বলতে পারবেনা। এদিকে যদি বউয়ের অবস্থাও তার ভাবীর মত হয় তখন সেটাও সে মেনে নিতে পারবে কিনা সন্দেহ। তাই এত ঝামেলার চাইতে সে তার জীবনটাকে সহজ স্বাভাবিক রাখতে বিয়ে করবে না বলেই ঠিক করে।
***
রুচিতা ছাদে কাপড় তুলতে এসে খানিকক্ষণ খোলা ছাদে বসে থাকে। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। অন্য সময় মন খারাপ থাকলে সে তার মাকে ফোন দেয়। সে কিছু না বললেও মা বুঝতে পারে তার মন খারাপ, তখন দুজনে নানান রকম গল্প করে। এ কথা সে কথায় মনটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এখন তার বাবা মা দেশে নেই, সপ্তাহখানেক হয় ওমরাহ পালন করতে গেছেন। রুচিতার আর ভাই বোনও নেই যাকে ফোন দিয়ে দুটো কথা বলে সে তার মনের ভার হাল্কা করবে।

রুচিতা ছাদের দোলনায় বসে আপন মনে দোল খেতে খেতে চোখের জল মুছে। এমন সময় একটা কর্ক তার সামনে উড়ে এসে পড়ে। রুচিতা সেটা হাতে তুলে নেয়।শুনতে পায় একটা মেয়ে কন্ঠ চিৎকার করে বলছে,
– শুনছেন, ওইটা আমার। একটু এই ছাদের দিকে ছুঁড়ে মারবেন প্লিজ।
রুচিতা তাকিয়ে দেখে পাশের বাড়িতে কোমরে ওড়না জড়িয়ে একটা সতের আঠারো বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে রেকেট দেখে বুঝতে পারে তারা ব্যাডমিন্টন খেলছিল। রুচিতা এগিয়ে আসে।
– নাও ভাই, হাতে হাতে নাও। ছুঁড়ে মারলে যদি আবার নিচে পড়ে যায়।
জবাবে মেয়েটা হেসে বলে,
– ব্যাডমিন্টন খেলবেন?
– ওমা তুমি এক ছাদে আর আমি এক ছাদে, ব্যাডমিন্টন কিভাবে খেলি?
– খুব হয়! আগে এই বাড়িতে যারা থাকতো তার বড় মেয়ের সঙ্গেও আমি ব্যাডমিন্টন খেলতাম এভাবেই। কর্ক নিচে পড়লে সমস্যা নেই। আমার ভাই রুমন আছে না? ওকে বললেই নিচ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসে।
– বল কি! বারবার পড়ে গেলে, কয়বার আনবে ছেলেটা?
– যতবার বলবো ততবারই আনবে! ছোট ভাই না, বড় বোনের কথা শুনতে বাধ্য। তাছাড়া বাচ্চা শ্রমিক হিসাবে ও খুব লো পেইড আইটেম। মাত্র একটা আইসক্রিমের বদলে ওকে আপনি চারবার উপর-নিচ ওঠানামা করাতে পারবেন। সো ইজি!
মেয়েটার কথা শুনে হেসে ফেলে রুচিতা।
– তোমার নাম কী ভাই?
– আমার নাম নাফিসা। আপনারা বুঝি এই বাড়িতে নতুন ভাড়া এসেছেন?
– ভাড়া না। আমার শ্বশুরের নিজের বাড়ি এটা। এতদিন ভাড়া দিয়ে রেখেছিলাম, এখন নিজেরাই চলে এসেছি।
– তার মানে এখন থেকে আপনারা এখানেই থাকবেন? ভালোই হলো! অনেকদিন খালি ছিল বাড়িটা, ছাদে উঠে একা একা লাগতো। আগে আপনাদের বাড়িতে উর্মি নামে একটা মেয়ে ছিল ওর সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। দুজনে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলতাম, আচার খেতাম। ও চলে যাওয়ার পর ছাদে আসতে ভালোই লাগত না! এখন বেশ মজা হবে!
– কিভাবে বুঝলে যে মজা হবে?
নাফিসা এবার আলাপ জমাবার জন্য রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে।
– ওমা, কি করছো? পড়ে যাবে তো?
– আরে না, আমার এসব অভ্যাস আছে। আপনিও বসতে পারেন। আমরা তো মেন্টালি স্টেবল পার্সন, ধাক্কা টাক্কা না দিলে পড়ে যাব কেন?
নাফিসার কথা বলার ধরনে খুব মজা পায় রুচিতা।
– তাও ঠিক! তুমি কিসে পড়ো?
– আমি কলেজে পড়ছি। চার মাস পরে আমার পরীক্ষা। – ও হ্যাঁ, তাইতো! এইচএসসির তো আর মাত্র চার মাস বাকি। তা তোমার প্রিপারেশন কেমন?
– খুব ভালো! আমি আবার পড়াশুনায় ভীষণ ভালো! নাফিসা ঠোঁট টিপে হাসে। তাই দেখে রুচিতার বেশ লাগে।
– আপনার কি পড়াশোনা শেষ?
– না, শেষ আর কোথায়? বিবিএটা কমপ্লিট করেছি, এমবিএ তে ভর্তি হব ভাবছি। সবে বিয়ে হলো তো তাই ভাবছি একটা বছর একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই।
– বিয়ে তো হয়েই গেছে, আর পড়ে কি করবেন? নাফিসা সরল কন্ঠে জানতে চায়।
– ও মা, তাই বলে আর পড়বো না?
– শুনুন… ছেলেরা পড়াশোনা করে কেন? তাদের চাকরি করা লাগবে সংসার পালা লাগবে সেইজন্য। আর মেয়েরা পড়াশোনা করে শুধু বাচ্চাকে পড়াশোনা শেখানোর জন্য, তাই মেয়েদের অত না পড়লেও চলে! নাফিসার কথা শুনে রুচিতা হেসে ফেলে।
– মোটেই না! একটা মেয়ের জন্য পড়াশোনাটা খুব জরুরী। আজকে তোমার ফ্যামিলিতে তোমার বাবা কিংবা বড় ভাই আছেন তোমাদের সংসার চালাবার জন্য। ধরো যদি কোন কারণে তাদের দ্বারা সেটা সম্ভব না হয় তখন সংসারের হাল তো তোমাকে ধরতে হতে পারে। তখন?
– সব সময় তো আর এমনটা হয় না, তাই তখন এখন নিয়ে এত না ভাবলেও চলে! আচ্ছা বাদ দিন! ফুচকা খাবেন?
– এখন ফুচকা কই পাবে?
– আপনি বলেই দেখেন, আমি আনিয়ে দিচ্ছি। চলেন ঝাল ঝাল চটপটি কিংবা ফুচকা খাই।
– তুমি বুঝি খুব ঝাল খেতে ভালোবাসো?
-উহু, আমি ঝাল খুব একটা পছন্দ করি না। ঝালটা শুধু আপনার জন্য খেতে চাইছি।
– কেন? আমি খুব ঝাল খাই এটা তোমাকে কে বললো?
– না মানে… আমার মনে হল আপনার খুব কাঁদার শখ। তাই ভাবলাম আপনাকে একটু ঝাল খাইয়ে কাঁদাই। অনেক অনেক ঝাল খেয়ে যখন আপনার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়বে তখন বুঝবেন চোখের পানির কত দাম! সবার জন্য সব সময় চোখের পানি ফেলতে হয় না, বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
রুচিতা এবার চমকে তাকায় নাফিসার দিকে। নাফিসা অবশ্য এ বিষয়ে বেশি কথা বাড়ায় না। বলে,
– আপনি এখানটায় বসুন আমি দশ মিনিটের মধ্যে আপনার জন্য নিয়ে আসছি। ও ভালো কথা, ফুচকা খাবেন না চটপটি?
রুচিতা স্মিত হেসে বলে,
– তোমার যেটা পছন্দ।
নাফিসা দাঁড়ায় না ছুটে ছাদ থেকে নিচে নেমে যায় দুরদার পায়ে।
***
রাতের খাবারের পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের তৃষ্ণা কাটাতে পারবে কি পারবে না সেটা নিয়ে মনো যুদ্ধে লিপ্ত শফি দরজায় কারো পদ শব্দ শুনে ফিরে তাকায়।
– ভাইয়া, একটু কথা ছিল। তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসতে পারি?
– অবশ্যই পারিস। তার জন্য আবার অনুমতি লাগে তোর, গাধা কোথাকার!
অভিরূপ একটা চায়ের কাপ ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে,
– তোমার জন্য কফি করে এনেছি। খেয়ে বলতো ঠিক ঠাক হয়েছে কিনা সবকিছু।
– ও বাবা! তুই কফি বানাতেও পারিস?
– আমি অনেক কিছুই পারি ভাইয়া, বড় হয়েছি না?
শফি হাসে। কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
– বাহ, বেশ হয়েছে!
অভিরূপকে চুপচাপ কাপে চুমুক দিতে দেখে শফি জিজ্ঞাসা করে,
-কিছু বলবি?
অভিরূপ খানিকক্ষণ চুপ থেকে মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেয়।
– ভাইয়া, আমি যেমন অনেক কিছুই পারি তেমনি অনেক কিছু বুঝতেও পারি আজকাল।
– তা তো পারবি, বড় হয়েছিস না!
– ভাইয়া, বড় হলে যদি সব বোঝার ক্ষমতাই হয় তাহলে তোমার তো আমার আগে বোঝা উচিত।
– কী?
শফি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকায়।
– ভাইয়া, আমি জানি মা আমাদের ভালো চায়। কিন্তু এই ভালো চাইতে গিয়ে মা মাঝে মাঝে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে সেটা কি তুমি ধরতে পারো?
– তা পারি। কিন্তু মায়েরা এমন একটু আধটু বাড়াবাড়ি করেই। সবকিছু ধরতে হয় না।
– তা বাড়াবাড়িটুকু আমাদের সাথে হয় হোক, কিন্তু ভাবীর সঙ্গে যে হচ্ছে সেটা কি তুমি দেখতে পাচ্ছ?
শফি এবার চুপ করে থাকে।
– ভাইয়া আমি আজকে ভাবীকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি। তুমি দেখেছো কিনা জানিনা কিন্তু তার কারণ যে মা সেটুকু আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তাই ভাবলাম তোমাকে বলি।
– রুচিতা কাঁদছিল?
– হ্যাঁ ভাইয়া। বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখি ঘর ভর্তি কাঁচ ভাঙ্গা। ভাবী সেগুলো পরিষ্কার করছে আর চুপি চুপি কাঁদছে।
শফি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
– এখানে আমি কি করতে পারি বল? তুই কি আমাকে মার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলতে বলছিস?
– মার সঙ্গে তুমি কি বলবে সেটা তোমার ব্যাপার। তবে ভাবী তোমার স্ত্রী হিসেবে কিছুটা মনোযোগ তার প্রাপ্য, সেটুকু তাকে দিও।
– সমস্যাটা হচ্ছে… মা কখনো আমার কাছে রুচির নামে কোন অভিযোগ করেনি। রুচিকেও কখনো মুখ ফুটে মায়ের নামে কিছু বলতে শুনিনি। তো এখানে আমি কি করতে পারি বল? মাঝে মাঝে বাসায় ঝামেলা হচ্ছে দেখলে মাকে যদি জিজ্ঞাসা করি কোন সমস্যা হয়েছে কিনা, মা জবাব দেয় কিছু হয়নি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি এখানে কোন গন্ডগোল হয়েছে অথচ মা নির্দ্বিধায় শাক দিয়ে মাছ ঢাকে। তখন আমার কি করার থাকে? আমি কি মাকে বলতে পারি যে, মা তুমি মিথ্যা বলছো। বল, পারি?
অভিরূপ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
– না, পারো না। তবে সে সময় তুমি তোমার স্ত্রীর পাশে থাকতে পারো। অন্তত খেয়াল করতে পারো তার মন খারাপ না ভালো। আসি ভাইয়া, ছোট হিসেবে বোধহয় তোমাকে খুব বেশি বলে ফেললাম। মাইন্ড করোনা।

শফি অভিরূপের চলে যাওয়ার দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকে। আশ্চর্য, তার ছোট্ট ভাইটা কবে এত বড় হয়ে গেল সে ধরতেই পারে না! যেতে যেতে অভি কিন্তু খুব সত্যি একটা বলে গেছে। সে তার মায়ের সঙ্গে হয়তো এ ব্যাপারে আলাপ করতে দ্বিধাবোধ করতে পারে তবে তার স্ত্রীকে দেখার দায়িত্ব তো তার। তার মন খারাপ না ভালো সেটুকু জেনে অন্তত তার পাশে তো থাকতে পারে সে। এই যেমন আজ অভি ঠিকই খেয়াল করেছে তার ভাবীর মন খারাপ কিন্তু শফি বুঝতে পারেনি, এটাতো তারই ব্যর্থতা। এর দায়ভার শুধু তার। এখানে তার মা কিংবা তার ভাইয়ের কোন ভূমিকা নেই।

শফি উচ্চকণ্ঠে রুচিতাকে ডাকে,
– রুচি, এই রুচি!
রুচিতা সব কাজ সেরে শোবার আগে চুল আঁচড়াতে বসেছিল। শফির ডাক শুনে খোলা চুল নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
– ডাকছিলে?
– কী করছো?
– চুলে বেনী করছিলাম। ঘুমাতে যাবো তো।
– এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হয় বুঝি?
শফির প্রশ্ন শুনে রুচিতা হাসে।
– হাসছো কেন?
– বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত তোমাকে ঠিক এগারোটায় বিছানায় যেতে দেখেছি। আর আজ তুমি আমাকে বলছো এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হয় নাকি?
শফি কাচুমাচু মুখ করে বলে,
– তা ঠিক! সকাল-সকাল অফিসে যেতে হয়, সেজন্য ঘুমিয়ে পরি তাড়াতাড়ি। কিন্তু তাই বলে দুই একদিন রুটিন তো ব্রেক করাই যায়, তাই না?
– তা যায়।
শফি রুচিতার দিকে কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
– দেখো অভি কফি বানিয়ে এনেছে আমার জন্য। ভালো হয়েছে কিন্তু!
– ওমা তাই!
– এক চুমুক খেয়েই দেখো।
রুচি মুচকি হেসে কাপ থেকে একটু কফি চুমুক দিয়ে বলে,
– বাহ্, বেশ ভালো হয়েছে তো!
– রুচি, চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
– এখন!
রুচিতা বিস্মিত কন্ঠে জানতে চায়।
– হ্যাঁ, এখন। সমস্যা কোথায়?
– এগারোটা কিন্তু বাজে প্রায়।
– বাজুক না! আজ না হয় একটু দেরিতে ঘুমাবো।
– কিন্তু মা যদি রাগ করে?
– মা শুয়ে পড়েছে না?
– হ্যাঁ, তা তো অনেক আগেই বাবা-মা দুজন শুয়ে পড়েছেন।
– তাহলে আর সমস্যা কোথায়? অভিকে বলছি, ও তো অনেক রাত অব্দি জেগে থাকে। ও দরজা আটকে দেবে আবার আমরা এলে ওকে ফোন দিব ও খুলে দেবে।
রুচির মুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। সে তার সাত মাসের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম রুটিন ভেঙ্গে কিছু একটা করতে যাচ্ছে, তার ভীষণ আনন্দ হয়। সে তার পিঠময় ছড়ানো চুলগুলো হাত খোপা করতে করতে বলে,
– তুমি তাহলে বসো, আমি চট করে শাড়িটা বদলে আসি।
– আরে ধুর! শাড়ি বদলাতে হবে কেন? তোমাকে এমনিতেই সুন্দর লাগছে খুব!
শফি তার হাতের মুঠোয় রুচিতার হাত দুটোকে ভালোবেসে বন্দী করে নেয়। রুচিতা আনন্দে আবেগে একটু যেন কেঁপে ওঠে। বারান্দার ফিকে আলোয় তার সেই লজ্জাবনত মুখ বড় সুন্দর দেখায়!

চলবে।