হোম পলিটিক্স পর্ব-০৫

0
273

#হোম_পলিটিক্স

#পর্ব_৫

#আফসানানীতু

শফি আর রুচিতা বারান্দায় বসে গল্প করছে। বাসার সামনে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে শফি জানতে চায়,
– অভি এলো নাকি?
রুচিতা রেলিংয়ের ওপারে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে বলে,
– তাই তো দেখছি।
– বাবা, আজ এত তাড়াতাড়ি?
– সেটাই তো! প্রতি মঙ্গলবার ওদের বন্ধুদের আড্ডা জমে না? ও তো কখনো এইদিনে নয়টার আগে বাড়ি ফেরেনা।
বলে থমকে যায় রুচিতা। ল্যাম্পপোস্টের ফ্যাকাশে আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় না বলে সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে। তারপর হেসে বলে,
– আচ্ছা তো এই ব্যাপার!
যদিও তাদের গাড়ি থেকে নাফিসাকে নামতে দেখে একটু অবাক হয় সে মনে মনে। তবে স্বামীর সামনে সেটা খোলাসা করে না।
– কী ব্যাপার?
– কিছু না, আজকাল আমাদের অভি সাহেব অফিসের সঙ্গে সঙ্গে কলেজ টাইমের সঙ্গেও তাল মিলাচ্ছেন বোধহয়।
– মানে?
– তুমি এত মানে মানে করো কেন বলতো?
– তুমিই বা এত হেঁয়ালি কর কেন?
রুচিতা এবার হেসে ফেলে।
– দাঁড়াও, এসে বলছি।

***
অভিরূপ বাড়িতে ঢুকে সবার প্রথমে তার মার কাছে যায়। আনোয়ারা তখন শোবার ঘরে খাটে শুয়ে বই পড়ছিলেন। অভিকে দেখে বেশ অবাক হন তিনি।
– ওমা তুই আজ এত তাড়াতাড়ি?
– আজ আর অফিস থেকে আড্ডায় যাইনি, সোজা চলে এলাম তোমার কাছে।
– বেশ করেছিস, রাত করে বাড়ি ফেরাটা আমার একদম পছন্দ না! এমন ছটা সাতটার মধ্যেই আসার চেষ্টা করবি।
– তুমি এমন ভাবে বলছো যেন আমি প্রতিদিন রাত করে ফিরি? শুধু সপ্তাহের দুটো দিনই তো।
– শোন, ওইসব আড্ডাবাজি কখনো কারো উপকারে লাগেনা বুঝলি? তার চেয়ে বাসায় এসে খেয়েদেয়ে রেস্ট নিবি তাতে শরীরের উপকার হবে।
অভি বুঝতে পারে এ ব্যাপারে মায়ের সঙ্গে তর্ক করে বিশেষ একটা লাভ নেই। তাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে স্বইচ্ছায় নিজের পরাজয় বরণ করে নেয়। মার জন্য কিনে আনা শাড়ির প্যাকেটটা তার দিকে এগিয়ে ধরে বলে,
– দেখতো মা, পছন্দ হয় কিনা।
– কী এটা?
– তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনে আনলাম। আনোয়ারা ছেলের আনা শাড়ি দেখার জন্য অতি উৎসাহের সঙ্গে প্যাকেটটা হাতে নেন আর ঠিক তখনই অভিরূপ বলে,
– হঠাৎ কিছু টাকা পেলাম তো তাই তোমার আর ভাবীর জন্য দুটো শাড়ি কিনে নিয়ে আসলাম।
ভাবীর জন্য শাড়ি কেনা হয়েছে শুনে তার হাতটা থমকে যায়। সেই সঙ্গে নিজের শাড়ি দেখার আগ্রহটাও মরে যায় আনোয়ারার। তিনি বুঝে পান না তার এই ছেলেটা এত সহজ সরল কেন? হাতে টাকা পেলে মা’র জন্য শাড়ি কেনাটা স্বাভাবিক কিন্তু ভাইয়ের বউয়ের জন্যও শাড়ি কিনতে হবে, এ কেমন কথা? তিনি মনের তিক্ততা মনে ধরে রাখতে পারলেন না মুখ ফস্কে বলেই ফেললেন,
– ভাবীর জন্যও এনেছিস।
– বাড়িতে মোটে তোমরা দুজন মেয়েমানুষ, তোমার জন্য আনলে ভাবীর জন্য আনবো না? এবার তোমারটা দেখে বলতো কেমন হলো?
ক্রিম কালারের খুব সুন্দর একটা সিল্ক কাতান। দেখেই পছন্দ হয় আনোয়ারার। কিন্তু মনের ভেতরে ওই যে একটা অযাচিত বিষ কাঁটা ঢুকেছে সেটাই তাকে খচখচিয়ে জ্বালায়। নিজের শাড়ির সৌন্দর্যের চাইতে রুচিতার শাড়িটা কেমন সেটা জানবার আগ্রহ তার বেশি। তিনি দায়সারাভাবে উত্তর দেন,
– সুন্দর হয়েছে, অভি। কত দিয়ে কিনলি?
– মা, গিফটের দাম জানতে হয় না।
– তোর ভাবীরটা?
– আছে , ব্যাগের ভেতর।
অভি তার ব্যাকপ্যাকটা চাপড় দিয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় রুচিতার শাড়িটা তার ব্যাগের ভেতর আছে। এতে আনোয়ারার মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়। ছেলে তো পারতো শাড়িটা খুলে তাকে দেখাতে, কিন্তু তা না করে ব্যাগে ভরে রেখেছে। আচ্ছা, ওই শাড়িটা কি আরো বেশি দামি বা সুন্দর? হতেও পারে! তার বয়স হয়েছে, ছেলে হয়তো ভেবেছে তাকে অত দামি শাড়ি না দিলেও চলে। সেজন্য হয়তো তারটা একটু কম দামে এনে ভাবীর জন্য রংচঙে দামি শাড়ি এনেছে। আনোয়ারা শাড়ি দেখার ইচ্ছেটা জাহির না করে কৌশল অবলম্বন করেন,
– আমারটা না হয় নাই বললি, তোর ভাবীরটার দাম বল।
– উঁহু,একদম বলা যাবে না! ওটাও তো গিফট তাই না? আনোয়ারার একবার ইচ্ছে হয় বলে, “দাম না হয় না’ই বললি, একবার রুচিতার শাড়িটা দেখা” কিন্তু ছেলে ব্যাগের ভিতর ভাবীর শাড়ি ভরে রাখার ব্যাপারটা তার মনকে এতই ব্যথিত করে যে আর বলবার ইচ্ছে হয় না। অভি অবশ্য এসব ঘরোয়া রাজনীতি ততটা বোঝেনা, তাই তার মায়ের না খোশ চেহারার রহস্যও ধরতে পারে না। উল্টো জিজ্ঞেস করে বসে,
– ভাবী কোথায় মা?
– কোথায় আর! শফি চলে এসেছে তাই স্বামীকে নিয়ে কুতুব মিনারে গিয়ে বসে আছে। আজ আবার তোর বাবা ঘোষণা দিয়ে গেছে রাতে সবার জন্য কাচ্চি বিরিয়ানি কিনে আনবেন, তাই শুনে সে তো আরো পেখম মেলে দিয়েছে। সে কি আর এখন তার মমতাজ মহল থেকে বের হবে রাতের খাবারের আগে?
অভি মায়ের খেদের কারণ ধরতে পারেনা, তাই এই নিয়ে আর কথা বাড়ায় না। পকেট থেকে দশ হাজার টাকা বের করে মার হাতে দিয়ে বলে,
– এটা রাখ মা।
– আবার টাকা কেন? শাড়ি তো দিলি!
– এটা রাখো। কিছু টাকা হাতে পেয়েছি যখন তাই তোমাকে দিলাম।
আনোয়ারা তার দুই ছেলের এই ব্যবহারে সবসময় খুব গর্বিত বোধ করেন। তার ছেলেরা যখনই হাতে টাকা পায় এনে মার হাতে অল্প হলেও তুলে দেয়। যদিও আনোয়ারার টাকার প্রয়োজন পড়লে সেটা তার স্বামী পূরণ করেন, তবু তার দুই ছেলে তাকে সব সময় এটা ওটা এনে দেবেই। হিসাবের ক্ষেত্রে আনোয়ারাও কম যান না, শফির টাকাটা তিনি সংসার খরচের সাথে যোগ করলেও অভির টাকা তিনি কখনোই খরচ করেন না। ওটা আলাদাভাবে তুলে রাখেন। সামনে অভির বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা তার, সে সময় টাকাটা লাগবে। অভির বিয়ে তিনি অনেক ধুমধাম করে দেবেন। শফির বিয়ের সময় ওদের বাবা বাম হাত ঢুকিয়ে দেয়াতে তিনি তার মনের মতো বিয়ে দিতে পারেননি ছেলেকে। কিন্তু এবার তিনি আর কারো কোন কথাই শুনবেন না। অভির বিয়েটা তিনি নিজের পছন্দমতন পাত্রীর সঙ্গে হইচই করে দেবেন এবং সেটা হৃদিতার সঙ্গে তো অবশ্যই না।
আনোয়ারা অভির টাকাটা যত্ন করে তুলে রাখেন।

অভি মায়ের ঘর থেকে বেরোতেই রুচিতার দেখা পায়। – এই যে ভাবী, আমি তোমার কাছেই আসছিলাম।
– তাই নাকি? আমিও তো তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম!
– তবে যে শুনলাম ভাইয়া এসেছে?
– হ্যাঁ, সেই কখন!
– ও বাবা, ভাইয়া আসার পরও তাকে রেখে আমার খোঁজ নিতে চলে এসেছো? আমার তো নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে!
– ঢং করো না তো! আমি বুঝি অফিস থেকে এলে তোমার খোঁজ নেই না?
– তা নাও, তবে ভাইয়া বাসায় থাকলে আমার খাতির যত্নটা একটু কম হয় আর কি।
– খুব হলো! আমি অবশ্য এখন তোমার খাতির যত্নের জন্য আসিনি, এসেছি অন্য কাজে।
অভি বসে ব্যাগ খুলে শাড়ির প্যাকেটটা রুচিতার দিকে এগিয়ে ধরে বলে,
– সব কাজ হবে। তার আগে দেখে বলো পছন্দ হয়েছে কিনা?
– ওমা, কি সুন্দর! তা দেবরজি, হঠাৎ শাড়ি? কোন সুখবর আছে নাকি?
– অবশ্যই আছে। সুখবর হচ্ছে হঠাৎ করেই তোমার দেবর বেশ কিছু টাকা হাতে পেয়েছে তাই সে তার জীবনের অতি প্রিয় দুই রমণীর জন্য দুটো শাড়ি কিনে এনেছে।
– ইস্, আর তিন নাম্বার জনের জন্য কি রেখেছে শুনি? – তিন নাম্বারের জন্য মানে? তিন নাম্বারের খবর এত সহজে হচ্ছে না। তুমি যতদিন খুশি মহারানীর মত রাজত্ব করতে পারো এই বাড়িতে।
– তাই বুঝি বাড়ি আসার সময় বান্ধবীকে সঙ্গে করে না এনে তাকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এসেছো? তা তার সঙ্গে কি বোঝাপড়া হয়েছে? বান্ধবীর পড়ালেখা পুরো শেষ হলে বিয়ে করবে নাকি এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলেই?
– কি সব উল্টাপাল্টা বকছো!
– শোনো, সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আমারটা পারবে না। আমি কিন্তু ঠিকই দেখেছি নাফিসাকে।
রুচিতা সবজান্তার হাসি হাসে।
– তুমি কিভাবে চেনো ওকে? আর কী দেখেছো তুমি?
– দেখলাম যে ফার্মগেট থেকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত তোমার আর নাফিসার রাস্তা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে!
ভাবির হেয়ালিপূর্ন সব কথার মানে এতক্ষণে খুঁজে পায় অভি। হেসে বলে,
– ওই পাগল মেয়েটার কথা বলছ?
– পাগল তা ঠিক, কিন্তু ওই পাগল মেয়েকে তুমি চেনো কি করে?
– সে অনেক বড় কাহিনী ভাবী, তোমাকে অন্য একদিন বসে মজা করে শোনাবো। শুনলে তুমি হাসতে হাসতে বিষম খাবে। মানুষ নামের অদ্ভুত এক প্রাণী এই নাফিসা!
– আমার কিন্তু মেয়েটাকে বেশ লাগে! একটু চঞ্চল হলেও মেয়েটা খুব ভালো।
– বাবা! আসতে না আসতে ওই মেয়ের সঙ্গে এতটাই ভালো পরিচয় হয়ে গেছে তোমার?
– তা হয়েছে বৈকি! আর তুমি চাইলে পরিচয় আরো বেশি বাড়ানো সম্ভব।
অভি এবার রুচির নাক চিপে ধরে হেসে বলে,
– ব্যাপারটা পরিচয় হওয়া পর্যন্তই রাখো, এর বেশি বাড়াবার কোন প্রয়োজন নাই। ঘরে এমনিতেই একজন মাথা গরম নারী বিদ্যমান, এর মাঝে আরো এক পাগলকে ডেকে এনে গৃহ শান্তি নষ্ট করবার কোন ইচ্ছা বা আগ্রহ আমার আপাতত নেই।
অভি ইশারায় তার মায়ের রুমের দিকে দেখিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে ঘরে চলে যায়।

***
সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপে চুমুক না দিলে শফির মাথা ধরে যায়। ঘুম থেকে উঠে বাসিমুখে এক কাপ চা খাওয়ার বিশ্রী অভ্যাস তার অনেক দিনের। বিয়ের পরেও এই নিয়মের কোন হেরফের হয়নি। রুচিতা বিয়ের দুদিন পর থেকেই তাকে এই চা দেবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে খুশিমনে।
পায়ে সুড়সুড়ি অনুভূত হওয়াতে চোখ খুলে তাকায় শফি। তাকিয়ে দেখে তার মাথার কাছে টেবিলে চা রাখছে রুচিতা। রুচিতা কখনো তাকে নাম ধরে ডেকে তোলে না, সব সময় পায়ে আলতো করে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম থেকে জাগায়। ব্যাপারটা শফির কাছে বেশ উপভোগ্য লাগে। সদ্য গোসল করা ভেজা রুচিতাকে বৃষ্টি ভেজা বেলি ফুলের মত স্নিগ্ধ আর সুন্দর দেখাচ্ছে। শীত কিংবা গ্রীষ্ম, মেয়েটা সকালে ঘুম থেকে উঠেই গোসল সেরে ফেলে। তারপর খুব সুন্দর করে পাট পাট করে শাড়ি পরে তৈরি হয়ে রান্নাঘরের কাজে যায়। ব্যাপারটার মধ্যে বেশ বউ বউ একটা ব্যাপার আছে, যা শফির ভীষণ পছন্দ।
– ওঠো।
রুচিতা চা দিয়ে যাবার জন্য রেডি হতেই শফি তার হাতটা ধরে ফেলে বলে,
– সকাল সকাল তোমার এত তাড়া কিসের? আমার সঙ্গে বসে এক কাপ চা খেলেও তো পারো।
– ধুর, খালি পেটে চা খেতে আমার একেবারেই ভালো লাগেনা! তাছাড়া সকাল সকাল আপনার কাজ নেই, কিন্তু আমার বহুত কাজ আছে। নাস্তা রেডি করতে হবে, তোমার লাঞ্চ রেডি করতে হবে।
– হোক, তুমি পনের মিনিট এখানে বসলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে না। বস বলছি!
রুচিতা স্মিত হেসে শফির পাশে বসে।
শফি চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,
– চা টা বেশ হয়েছে রুচিতা!
– থ্যাঙ্ক ইউ। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে?
– কেন?
– কিছু টুকটাক কেনাকাটা ছিল। তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যেতাম।
– কটা নাগাদ ফিরতে হবে?
– পাঁচটা।
রুচিতা ভেবে জবাব দেয়।
– চেষ্টা করব। জানই তো, অফিসে নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে। এখন প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে আমার দায়িত্বটা একটু বেশি।
জবাবে রুচিতা লক্ষী মেয়ের মত মাথা নেড়ে বোঝায় সে জানে। দেখে শফিকের মনটা আরো ভালো হয়ে যায়। মেয়েটা কখনো তার সঙ্গে তর্ক করে না, সবকিছুই কেমন সহজভাবে মেনে নেয়।
রুচিতা আজ একটা নতুন শাড়ি পরেছে। তাই দেখে শফি জানতে চায়,
– এই শাড়িটা বুঝি কাল অভি তোমাকে দিয়েছে?
– আরে না, এটা তো ঘরে পরার এমনি সুতির শাড়ি। অভি কাল বেশ সুন্দর একটা হাতের কাজ করা শাড়ি দিয়েছে। তোমাকে তো দেখানো হয়নি, বললে আজ তোমার সাথে বাইরে যাওয়ার সময় ওটা পরে যাব।
– নাহ, রেখে দাও। যেদিন অভিকে নিয়ে বাইরে কোথাও যাব, তখন পরো। ও খুশি হবে। তা কালকে কি একটা ব্যাপার যেন অভির কাছে জেনে এসে তারপর আমাকে জানাবে বলেছিলে?
– ও বাবা, তোমার তো দেখি পুরাই মেয়েলি অভ্যাস! একটা কিছু বললেই সেটা পেটের ভিতর গিয়ে গুড় গুড় করে নাচে, তাই না?
শফি হাসে।
– পাশের বাসার একটা মেয়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়েছে। মেয়েটার নাম নাফিসা। সেই নাফিসার কলেজের আর অভির অফিসের রাস্তা কেমন করে যেনো এক হয়ে গেছে। সেজন্যই তোমার ভাই কলেজের সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ি ফিরেছে কাল।
– কলেজ বুঝি এত দেরিতে ছুটি হয়?
– হয়তো কোচিং টোচিং ছিল। আমি জানবো কি করে! – আমার কিন্তু ব্যাপারটা বেশ মজা লাগলো! অভির মত মুখচোরা গোছের ছেলে আসতে না আসতেই পাশের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে খাতির জমালো কি করে?
– সেটা তো আমারও প্রশ্ন এবং কথাবার্তায় মনে হল আমার আগে থেকেই ও নাফিসাকে চেনে।
– বাহ, ভাই আমার বেশ সামাজিক হয়ে উঠেছে আজকাল।
– সে তোমাদের বাড়ির সবাই। বাবা তো সবচেয়ে বেশি! আসার পর থেকেই প্রতিদিন নামাজ থেকে ফেরার সময় মসজিদ থেকে দুই একজনকে ধরে আনে চা খাওয়াতে আর আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।
– বুঝলাম, এই বাড়িতে তাহলে একমাত্র অসামাজিক প্রাণী আমি।
– বিলক্ষণ! সেটা কি আর বলতে! এবার উঠে পড়ো। বাদবাকি গল্প বিকেলে ফিরলে করব,আমার হাতে এখন অনেক কাজ।
শফির আসলে আজকে অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তার এই রুটিন বাঁধা জীবনে রুটিনের হের ফের করা অসম্ভব। তবু রুচিতাকে ছাড়তে ইচ্ছে হয় না তার। তাই বাহানা খোঁজে।
– রুচি, আমার আকাশী রঙের রুমালটা বের করে দেবে?
শফি জানে ওই রুমালটা বেশ কিছুদিন ধরে ব্যবহার করছে না বলে হয়তো ড্রয়ারের পেছনের দিকে পড়ে আছে। তাই রুচিতাকে ঘরে আটকে রাখার জন্য রুমালের খোঁজ করে। সে এমনই, সহজ ভাষায় সে তার স্ত্রীকে বলতেই পারে “রুচিতা প্লিজ আর একটু সময় পাশে বসো। আমার তোমার চুলের আর গায়ের গন্ধ আরো কিছুক্ষণ নিতে ইচ্ছা করছে” কিন্তু মুখ ফুটে তা বলতে পারে না বলেই নানান বাহানা করে।
রুচিতা মন দিয়ে কাবার্ডের ড্রয়ারে রুমাল খুঁজছে। তার পিঠময় ছড়ানো ভেজা চুলগুলো শফির মনটাকে আরো তরল করে দেয়। সে উঠে এসে রচিতার পিছে দাঁড়িয়ে তার ভেজা চুলে আলতো করে নাচ ছুঁয়ে বুক ভরে মিষ্টি গন্ধ টেনে নেয়। তবে রুচিতাকে ফাঁকি দেয়া অসম্ভব! সে ব্যাপারটা বুঝে যায়। মুচকি হেসে বলে,
– আমি আমার জীবনে কোন মানুষকে এভাবে চুপি চুপি নিজের বউয়ের চুলের গন্ধ নিতে দেখিনি।
শফি না বোঝার ভান করে বলে,
– রুমালটা পেলে?
– না পেলে খুশি হবে বুঝি?
শফি তার জবাব দেয় না, স্মিত হেসে আরো একবার রুচিতার ভেজা চুলে নাক ডোবায়। তবে এবার চুপি চুপি না, সরবেই।

***

যে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে অফিসে ঢুকেছিল শফি, তা খানিক বাদেই উবে যায় কাজের চাপে। একটু পরেই তার অফিসটাকে অফিস মনে না হয়ে মাছের বাজার মনে হতে থাকে। কাজের এতই চাপ যে লাঞ্চটা পর্যন্ত ঠিক করে করার সময় পায়না। এর মাঝে রুচিতা দুইবার ফোন করে তাকে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছে। দ্বিতীয়বারের সময় লজ্জায় সে মিথ্যে বলেছে, খেয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে চারটা বেজে যাবার পরও এখন পর্যন্ত সে লাঞ্চ বক্স খোলারই সময় পাইনি।

অবশেষে খানিকটা ফুরসত পেয়ে চেয়ারে যথাসম্ভব গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নেয় শফি। আর তখনই তার মোবাইলের মেসেজ টোন বেজে ওঠে। শফি ভাবে রুচিতা মেসেজ করেছে হয়তো। মনে করিয়ে দিতে চাইছে তাকে পাঁচটার সময় বেরোতে হবে। কি করে বলবে যে এখনো তার লাঞ্চ করাও হয়নি। আরো কিছু কাজ বাকি, সাতটার আগে বাড়ি ফেরা সম্ভব হবে না।
শফি মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করতে গিয়ে দেখে হোয়াটসঅ্যাপে আননোন নাম্বার থেকে একটা ভিডিও আর একটা ভয়েজ মেসেজ পাঠানো হয়েছে। আনমনে ভিডিওটা চালু করে শফি। কিন্তু ভিডিওটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি তার মন থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এসি রুমে বসেও ঘামতে থাকে শফি। কেন এমনটা হলো?

#আফসানানীতু