হোম পলিটিক্স পর্ব-৬+৭

0
263

#হোম_পলিটিক্স

#পর্ব_৬

#আফসানানীতু

ক্লাস শেষে কলেজ থেকে বের হওয়ার পথে পিয়াকে নিজের হাতটা তার বগলের নিচে চেপে ধরতে দেখে নাফিসার সন্দেহ হয়। সে সন্ধিগ্ন কন্ঠে জানতে চায়,
– তুই আমার হাত বগল দাবা করে ঘুরতেছিস কেন? বাড়ি যা!
– হ্যাঁ ,যাচ্ছি তো। তোর বাড়ি।
– মানে?
– কি আশ্চর্য! বাংলায় বললাম, আমি তোর বাড়িতে যাব। তাও তুই বুঝিস না? গাধা নাকি তুই?
– গাধা আমি না তুই! আর খচ্চর হইতেছে তোর ওই বয়ফ্রেন্ড জাফর! তুই যে দুইদিন ধইরা আমার বাসায় রাত কাটাইতেছিস সেটা তোর মাথায় আছে? আজকেও যদি বাসায় যাস আম্মা নির্ঘাত সন্দেহ করবে আমাদের নিয়ে।
– কেন সন্দেহ করার কি আছে? খালাম্মা জিজ্ঞেস করলে বলবি গ্রুপ স্টাডি করতেছি।
– ঘোড়ার আন্ডা! তুই আমাকে স্টাডি করতে দিস কই যে ওই কাজের আবার নামকরণ হবে? আম্মা ঘাস খায় না, প্রতিদিন দুই বেলা প্লেট ভরে ভাত খায়। আজকে যদি তুই আমাদের বাসায় যাস আম্মা অবশ্যই এই নিয়ে সন্দেহ করবে।
– দোস্ত, তোর দুইটা পায়ে পড়ি। প্লিজ তুই আমারে বাড়ি যাইতে বলিস না। বাড়ি গেলে মাথার মধ্যে নানান রকম ফালতু চিন্তা আসে।
– তার মানে কি? পনের দিন টাইম নিলাম যে,তুই কি এই পনের দিন পুরা আমার বাড়িতে কাটাবি?
– আমি কি তাই বলছি? এতটা নির্লজ্জ তুই আমারে ভাবলি কেমনে?
– তাইতো, বন্ধুর সঙ্গে ইমুতে ছবি চালাচালি করা তুই এক অদ্ভূত লজ্জাবতী নারী!
নাফিসা খেদ প্রকাশ করে বলে।
– আচ্ছা, এই যে তুই আমার বাড়িতে পড়ে আছিস খালাম্মা খালু কিছু বলে না?
– আম্মুকে বলছি গ্রুপ স্টাডি করতেছি, আম্মু তাতেই খুশি!
– হবেই তো! তোর যা অবস্থা, বছরে একবার মুখ দিয়ে স্টাডি শব্দটা বের করলেই খালাম্মার খুশি হওয়ার কথা। সেইটা সমবেত হোক আর একক!
– আমারে তুই এই কথা বলিস? তুই নিজেই তো পরীক্ষা দেবার ভয়ে বিয়ে করতে চাইতেছিস! তুই সেই তখন থেকে আমারে খোঁচাখুঁচি করতেছিস! বন্ধু হয়ে বন্ধুর বিপদে খোঁচাখুঁচি করিস, তুই কেমন মানুষ?
পিয়ার চোখ ছলছল করতে দেখে নাফিসার মনটা এবার নরম হয়ে যায়। সে পিয়ার কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বলে,
– দেখ, আমি শুধু তোরে বুঝাইতে চাইতেছি যে তুই এভাবে আমার বাসায় থাকলে আমার আম্মা তোর আম্মা সবাই সন্দেহ করবে। কেন, খালাম্মা কিছু বলে নাই তুই আজকে রাত্রেও আমার বাসায় থাকবি শুনে?
– বলছে দুই দিন ধরে ওদের বাসায় খাওয়া দাওয়া করিস ওদের জন্য আজকে কিছু কিনে নিয়ে যাস। এই দেখ বিকাশে এক হাজার টাকাও পাঠাইছে। চল একটা পিজ্জা নিয়ে যাই।
নাফিসা এবার কাধ ঝাঁকিয়ে হাল ছেড়ে দেয়, বোঝে যে পিয়াকে বোঝানো অসম্ভব!
– একটা পিজ্জায় আমাদের বাড়িতে কিচ্ছু হবে না। দুইটা হাভাতি আছে জানিস না? কমসে কম দুইটা ফ্যামিলি সাইজের পিজ্জা লাগবে, নইলে এক টুকরাও ভাগে পাবি না।
তাই শুনে পিয়া শুকনো মুখে বলে,
– দোস্ত দুইটার পয়সা তো আমার হবে না, আম্মা শুধু এক হাজার টাকা দিছে।
– তো তুই কি আমারে তোর মতো নির্লজ্জ ভাবছিস যে আমি বলব, খালাম্মারে ফোন দিয়া বল আরো পাঁচশো পাঠাইতে! আমার কাছেও টাকা আছে। চল দুইটা বড় পিজ্জা নিয়া যাই, রু খুশি হবে দেখলে।

***
সালেহা বেগমের দিনটা আজকে বেজায় ব্যস্ততায় কেটেছে। একটা নারী সংগঠনের সভায় উপস্থিত থেকে তাকে ছোট্ট একটা স্পিচ দিতে হয়েছিল, তার জন্য গতকাল রাত জেগে প্রিপারেশন নিতে হয়েছে। তবে স্পিচ বোধহয় খারাপ দেননি কেননা ভালোই হাততালি কুড়িয়েছেন বক্তব্যের শেষে। তিনি সেজন্য একটু দেরি হয়ে গেলেও হৃষ্ট চিত্তে বাড়িতে পা রাখেন। আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হতে পারে ভেবে দুপুরেই রান্না সেরে রেখেছিলেন। এখন নাফিসা বুদ্ধি করে একটু ভাত চড়িয়ে দিলে বেঁচে যান। এমনসব সাংসারিক হিসাব কেতাব করতে করতে ঘরের ভেতর ঢুকে সালেহা থমকে দাঁড়ান। ডাইনিং এ তার তিন ছেলে মেয়ে আর পিয়া তার শাশুড়িসহ বসে পিজ্জা খাচ্ছে। সালেহা সবচেয়ে বেশি অবাক হলেন তার শাশুড়িকেও প্লেটে এক টুকরো পিজ্জা নিয়ে বসে থাকতে দেখে। ঐদিন তিনি ঘরে পিজ্জা করেছিলেন, তার শাশুড়িকে সাধতেই তিনি স্পষ্ট না করে দিয়েছিলেন এই বলে যে “এইসব মাংস রুটি হুদা হুদা শুকনা খাইতে আমার ভালো লাগেনা!” আর আজকে কি সুন্দর বাচ্চাদের সাথে চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে পিজ্জা খাচ্ছেন! সালেহাকে দেখে রুমন আনন্দে চিৎকার করে বলে,
– আম্মা দেখছো পিয়া আপু আমাদের জন্য পিজ্জা নিয়ে আসছে।
সালেহা কিছু বলেন না, তার চোখ তখনও তার শাশুড়ির দিকে। খোদেজা বেগম বুদ্ধিমতী মহিলা, ব্যাপারটা ধরতে পেরে কাষ্ঠ হেসে বললেন,
– পোলাপান খাইতাছে দেইখা ভালো লাগলো, মনে হইল দেখি একটু টেস্ট কইরা!
সালেহা কাঠ কাঠ গলায় জানতে চাইলেন,
– টেস্ট কেমন আম্মা? শুকনা শুকনা লাগে নাই তো? খোদেজা ফোকলা দাঁতে হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করলেন। সালেহা এবার অভিব্যক্তি বদলে পিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন,
– তোমাকে এসব আনতে কে বলেছে মা? তুমি আমাদের বাসায় এসে আমার মেয়ের মতনই থাকবে, খাবে এখানে কখনো মেহমানের মত বিহ্যাভ করতে হবে না তোমার।
– না আন্টি আম্মু বলল রুমন রিফাতের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেতে আর শুনলাম রিফাত নাকি পিজ্জা খুব পছন্দ করে তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।
পিয়া রুমন বলতে গিয়ে ভুলে রিফাতের নাম নিয়ে নেয়। আর তাই শুনে রুমন চিৎকার করে প্রতিবাদ করে,
– এহ পিজ্জা তো আমি বেশি পছন্দ করি। নিশ্চয়ই নাফুদি আমার নাম বলে নাই তোমার কাছে!
রিফাত হেসে বলে,
– তোর তো পুরো পৃথিবীর সব খানাই পছন্দ। কোনটা বাদ দেস তুই? তাও ভালো গরুর ঘাসের দিকে নজর দেস নাই, নইলে তো তোদের স্কুলের মাঠ উজার হয়ে যেত! সব ঘাস দেখা যাইতো তোর পেটে!
– আম্মা দেখছো, রিফাতদা চান্স পাইলেই আমারে কি সব উল্টাপাল্টা বলে! নাফুদি, ওর মুখে স্টেপলার মাইরা দাও তো!
সালেহা এবার ধমকে বলেন,
– তোরা তিন ভাইবোন এক জায়গায় হলেই এত আলতু ফালতু বকিস কেন বলতো?
তারপর নাফিসার দিকে তাকিয়ে জানতে চান,
– একটু ভাত রান্না করে রেখেছিলি?
নাফিসা মাথা নেড়ে বলে,
– হ্যা আম্মা, ভাত রান্না করছি।
– যাক বুদ্ধি হয়েছে তাহলে! খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একটু আমার ঘরে আসিস তো নাফিসা, তোর সঙ্গে কথা আছে।
এই ভয়টাই নাফিসা পাচ্ছিল। সে জানে তার মা খুব বুদ্ধিমতী মহিলা, তাকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব! তাই আজকে যে পিয়া এখানে রাত কাটালে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এটা নাফিসা জানতো। আর সেজন্যই মাকে ভুলাতে ভাত টাত রান্না করে, ফ্রিজে রাখা যত তরকারি আছে সব গরম করে সুন্দর করে হটপটে ভরে রেডি করে রেখেছিল যাতে সালেহা কিছু বলার সুযোগ না পায়। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না!

***
খাওয়া-দাওয়া শেষে নাফিসা বারবার ঘড়ির দিকে চাইতে লাগলো। ইস্, অন্যান্য দিন তার বাবা নয়টায় বাড়ি চলে আসে। আজ সাড়ে নটা বেজে গেছে এখনো তার বাবা বাড়ি ফেরেনি দেখে তার মনটা আকুলিবিকুলি করে। বাবা এলেই তো ঝামেলা মিটে যেত, তার মা আর তার সঙ্গে কিছু বলার সুযোগ পেত না। সে ঘরে বসে বসে সময় জ্ঞাপনের চেষ্টা করে, কিন্তু লাভ হয় না! সালেহা শোবার ঘর থেকে চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকেন। ডাক শুনে নাফিসা পিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায়। পিয়া কিছু না বলে নিজের কপালে দু আঙ্গুল ঠেকিয়ে গুলি করার মত ভঙ্গি করে, তারপরে ঢিস্কাও বলে আওয়াজ করে বিছানায় চিৎপাত হয়ে পড়ে যায়। তাই দেখে রুমন হাসতে থাকে। জবাবে বান্ধবীকে জিভ বের করে একটু ভেঙচে দিয়ে মার ঘরে যেয়ে ঢোকে নাফিসা।
– কি রে, তোকে না বললাম খাওয়া শেষে আমার কাছে আসতে? এদিকে এসে বস।
নাফিসা অস্বস্তি সহকারে বিছানার এক কোনায় বসে। তারপর ইচ্ছে করে কথা ঘুরাবার জন্য বলে,
– আম্মা আব্বার আজকে এত দেরি হচ্ছে যে?
– কি জানি, হয়তো কোন কাজে আটকা পড়েছে।
– আব্বাকে একটা ফোন দিয়ে দেখবো?
– দরকার নেই! দরকার পড়লে সে’ই ফোন দেবে। রাত এগারোটা পর্যন্ত তার ডেড লাইন। সবে তো দশটা বাজতে চলেছে। এই নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। নাফিসা লক্ষী মেয়ের মত মাথা নাড়ে। তাই দেখে সন্দেহ আরো জমাট বাঁধে সালেহার মনে। তিনি এবার আসল কথায় আসেন।
– তোদের কি কোন সমস্যা হয়েছে নাফিসা?
– সমস্যা? না তো আম্মা! কি সমস্যা হবে?
– পিয়ার সঙ্গে তোর বন্ধুত্ব তো এক দুই দিনের না, সেই ক্লাস থ্রি থেকে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি পিয়াকে কখনো পরপর তিনদিন এই বাড়িতে থাকতে দেখিনি।
– ও সেই জন্য! আরে আম্মা, পরীক্ষার আর মাত্র চার মাস বাকি তো এই জন্য আমরা গ্রুপ স্টাডি করতে একসঙ্গে আছি। তুমি তো জানোই পিয়া ম্যাথে একটু কাঁচা, ওরে তাই দুই একটা ম্যাথ দেখায় দিতেছি।
– ম্যাথ দেখায় দিতেছিস, তাও তুই?
– কেন, আমি কি ম্যাথ পারিনা?
– যে নিজের পড়াই ঠিক মতো সারে না সে অন্যকে পড়া দেখিয়ে দিতেছে এটাও তুই আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস?
– আম্মা শোনো, তুমি সব সময় সুযোগ পেলে আমারে ছোট করো। একদিন দেখবা আমি কত বড়লোক হই।
– বড়লোক হবি! তা কেমনে হবি শুনি? বড়লোক কোন ছেলেকে বিয়ে করে?
নাফিসা মুচকি হেসে বলে,
– হতেও পারে, সেটা কি আমি জানি নাকি!
– কথা ঘুরাবি না নাফিসা, তুই ইদানিং খুব বেশি চালাকি করার চেষ্টা করছিস! শুধু ভুলে যাচ্ছিস তুই আমার পেটে হয়েছিস। আমি তোদের তিন ভাই বোনকে পয়দা করেছি সুতরাং আমার সঙ্গে চালাকি করে পোষাতে পারবি না।
– আমি আবার কই চালাকি করলাম!
নাফিসা যেন আকাশ থেকে পড়ে।
– আলবৎ করছিস! এই যে তুই বললি গত তিন দিন ধরে তোরা গ্রুপ স্টাডি করছিস, গ্রুপ স্টাডির কোন কারবার তো আমি তোদের মধ্যে দেখলাম না। এমনকি ঘরে ঢুকে কখনো তোদের আশেপাশে কোন বইও দেখিনি আমি একবারের জন্যও। রুমনকেও তোরা রাত ছাড়া ঘরে জায়গা দেস না, দুজন সারাদিন ফিসফাঁস করিস। সবচেয়ে বড় কথা আমি পিয়ার চোখ ভেজা আর ফোলা দেখেছি। ওর নাক আর চোখ বেশীরভাগ সময় লাল হয়ে থাকে, দেখে বোঝাই যায় কাঁদছে। তাই বেশি চালাকি না করে সমস্যা কি বল?
সালেহা তার মেয়েকে ভালো করেই চেনেন। নাফিসা ডানপিটে হলেও সাহসী এবং বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে। সে এত সহজে কোন উল্টোপাল্টা বিপদে বা ঝামেলায় জড়াবে না এটা সালেহার বিশ্বাস। তবে পিয়াকেও তিনি খুব ছোটবেলা থেকে চেনেন। মেয়েটা বাবা মার আদরের ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ডে বসবাসকারী আজকালকার আর দশটা মেয়ের মতই। তাই সমস্যাটা যে নাফিসার না এতটুকু তিনি আন্দাজ করতে পারছেন দুজনের কারবার দেখে। এখন নাফিসা স্বিকার গেলেই হয়।
– আম্মা, তুমি না একটু বেশি বোঝো! তুমি জানো না ওর সাইনোসাইটিক প্রবলেম আছে? সারাক্ষণ তো শুধু নাক মুছে আর ফ্যাচ ফ্যাচ করে। ও কাঁদলে তুমি বুঝবে কেমনে? ওর কান্না তুমি দেখছো কখনো? হাত পা ছড়ায় বসে কাঁদে।
– নাফিসা তুই মিথ্যা কথা বলছিস, আর এজন্যই তুই আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছিস না। কথা বলার সময় তুই এদিক সেদিক তাকাচ্ছিস। আমি তোকে খুব ভালো করে চিনি।
নাফিসা এইবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
– যদি বুঝতেই পারো মিথ্যা বলছি তাহলে বুঝে নিও তোমার সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করতে পারতেছি না দেখেই মিথ্যা বলতেছি, ইচ্ছা করে তো মিথ্যা বলতেছি না।
সালেহা মেয়ের উত্তরে থ হয়ে যান। বিস্মিত কন্ঠে বলেন,
– তাহলে আমার সন্দেহ ঠিক? সমস্যা হয়েছে যখন আমাকে বলবি না সমস্যাটা কি?
– আম্মা সমস্যাটা সত্যি আমি তোমার সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছি কিন্তু পিয়া চাইছে না বলে শেয়ার করতে পারতেছি না। তবে কথা দিচ্ছি আগামী দু’এক দিনের মধ্যে যদি ম্যানেজ করতে না পারি তাহলে ব্যাপারটা আমি তোমাকেই আগে জানাবো।
– কি হয়েছে তোদের? কোন উল্টাপাল্টা ঝামেলায় পড়িস নি তো?
সালেহার কণ্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগের ছোঁয়া।
– আম্মা সত্যি আমি এখন এই ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলতে পারব না। আ’ম সরি, ভেরি ভেরি সরি!
নাফিসা মাথা নিচু করে জামার খুটে আঙ্গুল পেঁচায়। সালেহা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়েন। তিনি ভাল করেই জানেন নাফিসা খুব একরোখা স্বভাবের। একবার যদি মেয়েটা না বলেছে তো পেটে বোমা মারলেও তার মেয়ে একটা শব্দ করবে না। তাই যতক্ষণ না সে কিছু বলছে ততক্ষণ চুপ থাকাই ভালো। সালেহা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন,
– ঠিক আছে যেমনটা তুই ভালো বুঝিস! তবে যতবড় ঝামেলাই হোক না কেন, মনে রাখিস আমি তোর পক্ষে আছি।
নাফিসা মুখ তুলে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলে,
– আমি জানি আম্মা, ইউ আর মাই পাওয়ার হাউস। আমি অবশ্যই তোমাকে জানাবো, তবে তুমিও কথা দাও এই ব্যাপারে পিয়ার আম্মা কিংবা আব্বার সাথে এখন কোন আলাপ করবে না। সময় হোক তখন।
বলে নাফিসা উঠে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সালেহা সেদিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকেন। পিয়া কি ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে সে ব্যাপারে নানান রকম আজেবাজে চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে তার, সেইসঙ্গে বুক কাঁপে। সমাজসেবার নানান সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে অনেক রকম বাজে বাজে ঘটনা তিনি প্রায়ই জানতে পারেন, আর তাই এই উঠতি বয়সের মেয়েরা বিপদে পড়েছে শুনে তার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। কিন্তু কিছু করার নেই, নাফিসা না বলা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষায় থাকতেই হবে।

**”
রুচিতা বিকেল থেকে একটা অন্যরকম উৎকণ্ঠার ভেতর আছে। বিকেল পাঁচটায় শফিকে ফিরতে না দেখে কল করেছিল সে। আর কল করতে গিয়েই প্রথম হোঁচটটা খায় রুচিতা। শফির ফোন বন্ধ। শফির মোবাইল সাধারণত বন্ধ থাকে না, রাতভর সে চার্জে রেখে দেয় আর সারাদিন সেটা অন থাকে। যদিও তার মোবাইলের ব্যাটারি খুব একটা খরচ হয় না কারণ ফোনে এক কথা বলা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন কাজে ওটা ব্যবহার হয়না। এমনকি ছবি তুলতে হলেও সে রুচিতাকে বলে। ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম কিছুতেই তার কোন আগ্রহ নাই, ফোন শুধুই তার কাছে কথা বলার যন্ত্র মাত্র। সে এমনই রুটিন বাঁধা মানুষ যে তার তেমন কোন বন্ধু বান্ধবও নেই যাদের সঙ্গে অফিসের পরে আড্ডা দেবে। বিয়ের পর থেকে বাড়ি টু অফিস আর অফিস টু বাড়ি করতেই দেখেছে তাকে রুচিতা। যদি কখনো কোন প্রয়োজনে বের হয় অবশ্যই রুচিতা কিংবা তার শাশুড়িকে সেটা জানিয়ে রাখে। তাই তার ফোন বন্ধ দেখে প্রথমটায় একটু চিন্তিত বোধ করলেও ভেবে নেয় হয়তো মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গেছে কিংবা মোবাইলে কোন সমস্যা হচ্ছে দেখে বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যখন সাতটার ওপারে চলে গেল তখন রুচিতার চিন্তা হওয়া শুরু করে। শফি যদি দেরি করে বাড়ি ফিরে তাহলে নিজের ফোন থেকে না হলেও অন্যের ফোন থেকে হলেও তাকে জানাত। সে এর মাঝে দুইবার তার শাশুড়িকে ব্যাপারটা বলেছে। আনোয়ারা অবশ্য তাতে তেমন একটা গা করেননি। মোবাইল বন্ধ শুনে একটু চিন্তিত বোধ করলেও পরক্ষণেই উনি সেটা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন,
– সব সময় জামাই জামাই করবা না তো রুচিতা! পুরুষ মানুষের কত জায়গায় কত রকমের কাজ থাকে। হয়তো প্রজেক্টের কোন কাজে সাইটে গেছে যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নাই। আর তুমি ভাবছো সে মোবাইল বন্ধ করে বসে আছে কিংবা হাত থেকে পড়ে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষরে খুঁটে বাঁধতে নাই বুঝছো? খুঁটে বাঁধলে পুরুষমানুষ ছাগল হয়ে যায়, স্বামীরে বাঘ বানাতে চাইলে ছেড়ে দিবা।
রুচিতা তাই স্বামীকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বানাবার আশায় আরো কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু নয়টা বেজে যাবার পর তার শাশুড়ির কপালেও চিন্তার রেখাগুলো গভীর হয়। তিনি অভির কাছে গিয়ে বলেন,
– অভি তোর ভাই তো এখনো এলোনা!
– কি বলো, নয়টা বাজে! ভাইয়া এখনো বাড়ি ফেরেনি? ভাইয়া তো সাধারণত এত দেরি করে না।
– সেটাই তো! রুচিতাও খুব চিন্তা করছে। বলল ওর মোবাইল নাকি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
অভি সঙ্গে সঙ্গে নিজের মোবাইলটা টেনে নিয়ে ভাইয়ের মোবাইলে কল করে এবং রুচিতার কথা মতন সেও মোবাইলটি বন্ধ পায়।
– হ্যাঁ, ভাইয়ার মোবাইল তো দেখছি সুইচ অফ করা। কিন্তু ভাইয়ার মোবাইল তো কখনো সুইচ অফ থাকে না।
– তাছাড়া ওর তো কখনো কোথাও দেরী হলে আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়। আজকে ফোনও দেয়নি। রুচিতা বলল ওর সঙ্গে নাকি বিকেলে বাইরে যাবার কথা ছিল অথচ ছেলেটা ফোন করে এটাও বলেনি যে সে আসতে পারবে না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে রে। কথার মাঝে রুচিতা এসে দাঁড়ায় তার শাশুড়ির পাশে। অভি তার দিকে তাকিয়ে বলে,
– ভাবী তোমার কাছে কি ভাইয়ার অফিসের কোন কলিগের ফোন নাম্বার আছে?
– কেন, তাদের ফোন নাম্বার দিয়ে কি হবে?
– যেহেতু ভাইয়ার সঙ্গে কন্টাক্ট করা যাচ্ছে না, তার কলিগদের ফোন দিয়ে জানি ব্যাপারটা কি।
নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই চড় মারতে মন চায় রুচির। তার মাথায় এটা আসেনি কেন আগে? শফির ফোন বন্ধ তাই বলে তো তার অফিসের সবার ফোন বন্ধ না। অন্য কারো কাছে ফোন করে খোঁজ নিলেই তো হতো! তাছাড়া যখন শফির ফোন বন্ধ পাচ্ছিল তখন অফিসে ফোন দিলেও হত, সেটাও সে করেনি!
রুচিতা তার মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট ঘেঁটে আসিফ নামে শফির এক কলিগের নাম্বার খুঁজে পায়। কল দিতেই ওপাশে আসিফের স্ত্রী মিলি কল রিসিভ করে। রুচিতার পরিচয় পেয়ে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলে,
– ওমা ভাবী, হঠাৎ কি মনে করে? সেই যে পিকনিকে দেখা হল তারপর তো একটা দিন কল করে জানতেও চাইলেন না আমি কেমন আছি।
রুচিতা একটু থমকে যায়। ব্যাপারটা সত্যি লজ্জা জনক! মিলি পিকনিকের পরে আরো দুইদিন তাকে কল দিয়েছে, রুচিতারই কখনো তাকে কল দেওয়া হয়নি। তাই আজকে কল দিয়ে সরাসরি তাকে শফির কথা জিজ্ঞেস করতে কেমন লজ্জা করে তার, তবু স্বামীর জন্য উৎকণ্ঠা তার আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিতে বাধ্য করে। একটু অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলে,
– হ্যাঁ ভাবী আসলে ব্যস্ত থাকি তো তাই করবো করবো করেও করা হয়নি! আপনি ভালো আছেন?
আসিফ সাহেব কাছে পিঠেই ছিলেন। অভি তার সঙ্গে কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে চিন্তিত মুখে বলে,
– মা উনি তো বলছেন ভাইয়া নাকি পাঁচটার সময় অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যদিও তখনও অফিসে কাজ আরো বাকি ছিল কিন্তু ভাইয়াকে নাকি কেমন অস্থির অস্থির দেখাচ্ছিল। শরীরটা বোধহয় ভালো লাগছিল না তার, ভীষণ অসুস্থ দেখা যাচ্ছিল নাকি। উনি বললেন সেই তখন তখনই ভাইয়া বেরিয়ে গেছে এরপরে কোথায় গেছে বলতে পারবেনা। আনোয়ারা এবার চিন্তিত কন্ঠে বলেন,
– কি বলিস এইসব! তুমিও বৌমা, সারাদিন এত উল্টোপাল্টা চিন্তা করতে পারো আর ছেলেটার কলিগের কাছে ফোন দিয়ে খোঁজ নেওয়া যায় সেটা ভাবতে পারলে না একবারও? অভি আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছেরে।
অভিও চিন্তিত কন্ঠে বলে,
– তার উপর গেছে তো বাইক নিয়ে। ভাইয়াকে এত করে বলি আমি বাইকটা নেই তুমি গাড়ি নিয়ে যাও, সে কিছুতেই রাজি হয় না! এখন যদি সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে থাকে, আর এই অবস্থায় বাইক চালাতে গিয়ে কোন সমস্যায় পড়ে!
বলেই অভি বুঝতে পারে তার এই কথাটা বলা উচিত হয়নি, কেননা তার এই কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারা আর রুচিতা একসঙ্গে চমকে উঠে। আনোয়ারা আর্তনাদ করে ওঠেন,
– আল্লাহ মাফ করুক, এমনটা যেন না হয়! অভি তোর আল্লাহর দোহাই লাগে তুই এসব উল্টোপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে একটু খোঁজ নিয়ে দেখ ছেলেটা কোথায় গেল। আমার তো খুব চিন্তা লাগছে।
রুচিতা কিছু না বলে নিজের আঙ্গুল কামড়ায়। আনোয়ারা তার দিকে তাকিয়ে রাগত কন্ঠে বলেন,
– এখন এখানে দাঁড়িয়ে তোমাকে আর আঙ্গুল চুষতে হবে না, ঘরে গিয়ে জায়নামাজে বস।
অভি এই সময় রুচিতার সঙ্গে তার মায়ের এমন ব্যবহারে ভীষণ বিরক্ত বোধ করে। বলে,
– মা , এই সময় অন্তত সিনক্রিয়েট করো না। ভাবী তুমি চিন্তা করো না, ভাইয়ার কিচ্ছু হয়নি। আমি ওটা একটা শুধু পসিবিলিটির কথা বলেছি। ভাইয়া নিশ্চয়ই ভালো আছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি। ভাইয়ার অফিসের যে রুট সেই রুট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলেই জানা যাবে।

অভি ঘরের পোশাকেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। মা আর ভাবীকে চিন্তা করতে মানা করলেও তার মনের মাঝে নানান কুচিন্তা ঘুরপাক খায়। তার এমন সাদাসিধে রুটিন মানা ভাইটা কোথায় আছে কে জানে! অসুস্থ অবস্থায় বাইক চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেনি তো? কিংবা অন্য কোন বিপদ?

#আফসানানীতু

#হোম_পলিটিক্স

#আফসানানীতু

#পর্ব_৭

চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করে শফি। সামনে দুটো চেয়ারে তার খালাতো ভাই ইয়ামিন আর অভিকে বসে থাকতে দেখে অস্ফুটস্বরে অভিকে ডাকে। ডাক শুনে দুজনেই স্প্রিং দেয়া পুতুলের মত লাফিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে আসে। অভি তার এক হাতে হাত রেখে বলে,
– ভাইয়া, কেমন আছো এখন?
শফি জবাবে মুখ বিকৃত করে, কেননা তার পুরো শরীরে প্রচন্ড ব্যথা, যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাবার মতো অবস্থা হচ্ছে। সে জানতে চায়,
– আমি এখানে কিভাবে?
ইয়ামিন বলে,
– আমি বাড়ি ফিরছিলাম দেখলাম রাস্তার এক পাশে কিছু লোক জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। শুনলাম একসিডেন্ট হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি, ও মা ভাইজান যে! হসপিটালে আনার পর অভিকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাই।
– আমরা তো ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমার ফোন বন্ধ দেখে। আমি বেরিয়ে ছিলামও তোমাকে খুঁজতে, সেই সময় ইয়ামিন ফোন দিয়ে জানালো যে ও নাকি তোমাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছে। কি সব উল্টাপাল্টা কাজ যে তুমি করো না ভাইয়া! শরীর ভালো না তো আমাকে একটা কল দিলেই তো পারতে! আমি অফিস থেকে ফেরার পথে তোমাকে নিয়ে আসতাম। অসুস্থ অবস্থায় বাইক চালাতে গিয়েছিলে কেন?
– আমি অসুস্থ ছিলাম এইটা তোকে কে বললো?
– তোমাদের অফিস কলিগ আসিফ সাহেব বললেন। তোমার খোঁজ নিতে তাকে ফোন দিয়েছিলাম, উনি বললেন তুমি নাকি ভীষণ অস্থির অস্থির অবস্থায় অফিস থেকে পাঁচটায় বেরিয়ে গিয়েছিলে। তোমাকে দেখে ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছিল তখন।
– হ্যাঁ, হঠাৎ করে ভীষণ ঘাম দিচ্ছিল শরীরে। ভাবলাম বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু কিছুটা পথ বাইক চালাবার পরেই হঠাৎ চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এল। তারপর আর কিছু মনে করতে পারছি না।
– যখন হসপিটালে নিয়ে আসি তখন ডাক্তার বলেছিল আপনার প্রেসার অনেক হাই ।
– থাক ভাইয়া, তুমি আর এখন কথা বলো না। তোমার পুরো শরীরে অনেক ইনজুরি হয়েছে, বিশেষ করে মাথায়। তুমি এখন বিশ্রাম নাও, এসব ব্যাপারে পরে কথা বললেও চলবে। এখন বলো শরীর কি ব্যথা করছে খুব? ডাক্তারকে ডাকবো?
শফি তার জবাব দেয় না। মনে মনে বলে, শরীরের ব্যথা তো তেমন কিছু না ওষুধ দিলেই সেরে যাবে। কিন্তু তার মনের ব্যথা কোন ওষুধে যাবে কে জানে! নিজের অজান্তেই তার চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে,

রুচিতা খুব সকাল সকাল উঠে বাড়ির সবার জন্য নাস্তা তৈরি করে শফির নাস্তাটা সুন্দর করে প্যাক করে নেয়। অভির নাস্তা খাওয়া শেষ হতেই সে রুচিতাকে ডেকে বলে,
– ভাবী, আমি গাড়ি বের করতে যাচ্ছি তুমি সব গোছগাছ করে নিয়ে আসো।
অভি সারারাত হসপিটালেই ছিল, সকাল পাঁচটায় বাড়ি ফিরেছে। কাল রাতে যখন রুচিতা জেনেছিল শফি এক্সিডেন্ট করেছে সে তখন তখনই যেতে চেয়েছিল কিন্তু অভি তাকে না করে। তাছাড়া অতো রাতে তাকে হসপিটালে নিয়েই বা আসবে কে? অভিতো তখন হসপিটালেই। যতই সবাই না না করুক তার মনটা তো পড়ে আছে শফির কাছে। মনে হচ্ছে কতক্ষণে ছুটে গিয়ে শফির মাথার পাশে বসবে সে। অভি নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তাই সে নিজেও খাবারের ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে আসে। অভি তখনো গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করেনি দেখে রুচিতা গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় আর তখন নাফিসাকে দেখতে পায়। নাফিসাও তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে।
– আরে আপু! এত সকালে বাক্স পেট্রা নিয়ে কই যাচ্ছেন?
রুচিতা শুকনো মুখে জবাব দেয়,
– আর বোলো না! তোমার ভাই কাল রাতে অ্যাক্সিডেন্ট করে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে, তার জন্য নাস্তা নিয়ে যাচ্ছি।
– ওমা, বলেন কি! কিভাবে হল?
– শরীর নাকি অসুস্থ ছিল তাই হঠাৎ করে বাইক চালাতে চালাতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
– মাই গড! সিরিয়াস কিছু হয়নি তো?
– ব্যথা পেয়েছে অনেক তবে ডাক্তার বলেছে তেমন সিরিয়াস কিছু না। রেস্ট নিলে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে।
– তাও ভালো!
– তা তুমি কোথায় যাচ্ছ ছুটির দিনে সকাল সকাল?
– আর বলবেন না, বেকারদের জন্য ছুটির দিন সবচেয়ে খারাপ!
– মানে?
– মানে ছুটির দিন যে একটু সকাল সকাল ঘুমাবো তাও না, আম্মা নাকি আজ কি স্পেশাল খাবার রান্না করবে তার জন্য আমাকে কিছু জিনিস আনতে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যেতে হবে। তাই আর কি করা! বের হলাম আরামের ঘুম বর্জন করে। বেকারদের চাকরি বেশি বুঝেন না?
রুচিতা নাফিসার কথার ধরনে হেসে ফেলে।
– বেকার কোথায়, তুমি না ছাত্রী?
– যাক তবু তো আপনি স্বীকার গেলেন আমি ছাত্রী। আমার আম্মা তো আমাকে দিনের দশবার মনে করিয়ে দেয় যে আমি বেকার।
আলাপের মাঝেই গাড়ি এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। অভি দরজা খুলে বেরিয়ে বলে,
– হ্যাই নাফিসা, কেমন আছেন আপনি?
– জ্বী ভালো, আপনি ভালো আছেন?
– আর ভালো! শুনেছেন নিশ্চয়ই ভাবীর কাছে? তা যাচ্ছেন কোথায়?
– এই তো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যাব।
– তা চলুন না হয় আমাদের সঙ্গে আপনাকে নামিয়ে দেবো। আমাদের যাওয়ার পথেই তো পড়বে।
– আরে না না, দরকার নাই। আপনি কি আমাকে সিন্দাবাদের ভূত ভেবেছেন যে যখন তখন আপনার কারে চড়ে বসবো?
অভি হেসে ফেলে।
– আরে না না তা ভাববো কেন? তাছাড়া আপনি চাইলেই তো আর ভূত হতে পারবেন না তবে সিন্দাবাদের পেত্নী বলে কিছু থাকলে হতে পারেন। মহিলা ভূতকে পেত্নী বলে জানেন নিশ্চয়ই?
নাফিসা জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রুচিতা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
– হয়েছে আর ভদ্রতা করতে হবে না। চলো তো! আমাদের যাওয়ার পথেই তো পড়বে, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।
অগত্যা নাফিসা তাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসে। কিন্তু কাঙ্খিত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে দেখে সেটা বন্ধ।
– দেখছেন আম্মার কারবার? আমাকে সকাল সকাল খুঁচিয়ে তুলে বাসা থেকে বের করে দিল অথচ এদিকে এই স্টোরটা যে বন্ধ এটা তো তার জানার কথা সেটা আমাকে একবার বলবে না? তাহলে আমি অন্য দিকে যেতাম।
– আন্টির দোষ নেই, আমিও তো জানতাম না যে স্টোরটা বন্ধ।
অভিরূপ এবার বলে,
– যাই হোক, কার দোষ সেটা পরে দেখা যাবে। আপনাকে একটা অফার দিচ্ছি, আমি হসপিটালে ভাবীকে রেখে আবার ফিরব। আপনি চাইলে ততটা সময় আমাদের সঙ্গে থাকুন, ফেরার পথে আপনাকে অন্য একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে নিয়ে যাব।
রুচিতা চট করে চোখ তুলে দেবরের দিকে তাকায়, তারপর ঠোঁট টিপে হাসে। নাফিসাও হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারে তাই বলে,
– কোন দরকার নাই। আমি মানুষকে ডিস্টার্ব করি এটা সত্য, তাই বলে এতটাও না!
রুচিতা হেসে বলে,
– আমি কিন্তু এমন অফার পেলে ছাড়তাম না, কেউ যদি আমাকে এমন পঙ্খীরাজে বসিয়ে স্টোর টু স্টোর ঘুরে বেড়াতে চাইতো আমি সেই অফার লুফে নিতাম।
– সেই জন্যই তো আপনি রুচিতা আর আমি নাফিসা।
– ধুর চলো তো! তোমার তো এখন তেমন কোন কাজ নেই তাই না? তোমার ভাইকেও না হয় এই ফাঁকে একটু দেখে এলে।
নাফিসা এবার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
– এটা ঠিক বলেছেন। ভাইয়ার সাথে তো আমার পরিচয় হয়নি, এই সুযোগে না হয় উনার সঙ্গে পরিচয় পর্বটাও সেরে নেয়া যাবে।
নাফিসার কথায় অভি গাড়িতে আবার স্টার্ট দেয়।

***

হসপিটালের কেবিনে ঢোকার মুখে ইয়ামিনকে দেখতে পায় তারা। তাদের দেখেই ইয়ামিন এগিয়ে আসে।
– এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন! ভাইয়া বোধহয় এখনো ঘুমাচ্ছে।
– সে কি, এখনো ঘুম ভাঙ্গে নাই?
অভি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে নয়টা বাজে।
– অবশ্য ঘুম ভাঙেনি বললে ভুল বলা হবে। তুমি যাওয়ার পর সাড়ে সাতটা পৌনে আটটার দিকে একবার ঘুম ভেঙেছিল, ঘুম ভেঙেই সে তার ফোনের জন্য অস্থির অস্থির করা শুরু করেছিল। আমি যখন বললাম ফোন আমি কাল অভি ভাইয়ের কাছে দিয়েছি তখন তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গিয়েছিল। একেবারে কাল রাতের মত শুরু করে দিয়েছিল। বারবার আমাকে বলতে লাগলো যেন তোমাকে ফোন দিয়ে বলি ফোনটা নিয়ে আসতে। ডাক্তার তখন এসে ধমকে তাকে ঘুমাতে বলেছে বলে ভাইয়া আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন।
– ফোন আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
রুচিতা একটু অবাক হয়ে বলে,
– কিন্তু শফি কবে থেকে এত ফোন পাগল হলো? ওতো ফোনের ব্যাপারে কখনোই এত সিরিয়াস না!
ইয়ামিন ঠোঁট উল্টে বলে,
– কিভাবে বলব ভাবী, আমিও একটু অবাক হয়েছি।

সবাই মিলে ক্যাবিনে ঢুকে। শফির অবস্থা দেখে রুচিতার বুকটা মুচড়ে ওঠে। হাতের খাবারের ব্যাগটা পাশে রেখে শফির মাথার কাছে গিয়ে বসে রুচিতা, তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় পরম যত্নে। হাতের স্পর্শে শফি চোখ খুলে তাকায়, কিন্তু রুচিতাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে প্রচন্ড রাগ ফুটে ওঠে।
– তুমি? তুমি কখন এসেছ?
– এইতো মাত্র এলাম।
– কেন এসেছ তুমি?
রুচিতা শফির প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারে না। থমকে গিয়ে অপ্রস্তুত গলায় জবাব দেয়,
– কাল রাতেই আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু অভি আগেই হসপিটালে ছিল, কেউ সঙ্গে আসার ছিল না তাই আসতে পারিনি। তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছি, উঠে খাও।
– নাস্তা খাওয়ার জন্য তোমাকে লাগবে কেন? আমি কি ছোট খোকা? যাও, বাড়ি যাও!
– শফি, কী হয়েছে তোমার?
শফির এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ অবাক হয়ে রুচিতা। শফি এবার প্রায় চিৎকার করে ওঠে,
– বললাম না তুমি আমার সামনে থেকে যাও! এক্ষুনি বেরিয়ে যাও কেবিন থেকে! তোমাকে এখানে আদিখ্যেতা করতে আসতে বলেছে কে? আমার খাবার আমি খেতে পারি, নিজেরটা নিজেই দেখতে পারবো আমি। লাগবে না আমার তোমাকে।
অভি এবার দৌড়ে এসে শফির কাঁধে হাত রাখে।
– ভাইয়া, কি হচ্ছে এসব?
এতসবের মাঝে নাফিসা সবচেয়ে বেশি অপ্রস্তুত বোধ করে। সে বুঝে পায় না তার এখন কি করা উচিত। এখানে তারা সবাই ফ্যামিলি মেম্বার, তাদের সামনে রোগী যেমন খুশি চিৎকার করতে পারে। কিন্তু এই পরিবেশে সে একেবারেই বেমানান, সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন।
– অভি আমি কিছু জানি না, তুই প্লিজ ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়।আর আমি যতদিন হসপিটালে আছি দয়া করে ওকে আসতে দিবি না এখানে। প্লিজ!!
এমন সময় নার্স আর ডিউটিরত ডাক্তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনেই হয়তো কেবিনে এসে ঢোকেন।
– কি হচ্ছে এখানে? এত চিৎকার চেঁচামেচি কিসের? অভি আমতা আমতা করে বলে,
– না তেমন কিছু না…
ডাক্তার এবার শফির দিকে তাকিয়ে বলে,
– বাইরে থেকে চিৎকার শুনলাম। আপনি চিৎকার করছিলেন?
শফি কিছু বলে না। ডাক্তার আরো এগিয়ে এসে বলেন,
– দেখুন আপনার প্রেসার কিন্তু খুব ফ্ল্যাকচুয়েট করছে। এমনিতেই আপনি মাথায় ব্যথা পেয়েছেন, তার ওপর এভাবে প্রেসার উঠানামা করলে কিন্তু আপনি সমস্যায় পড়ে যাবেন। আর আপনাদেরও বলছি, যতক্ষণ রোগী হসপিটালে আছেন ততক্ষণ একটু ধৈর্য ধরুন। পুরো বাড়ির সবাইকে নিয়ে মিছিল করে দেখতে আসার কি দরকার? একজনের বেশি বড়জোর দুইজন আসবেন। এতজন এসেছেন কি মনে করে? কেবিন তো লোকজন দিয়ে ভরে ফেলেছেন!
অভি বলে,
– না, আমাদের দুজনই থাকবে আর দুজন চলে যাবে।
– দুজন নয়, রোগীর কাছে একজন থাকলেই হবে। বাদবাকি সবাই বিদায় হন।
ডাক্তার এ কথা বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়, যাবার সময় নার্সকে বলে,
– উনার প্রেশারটা খাবার পরে আরো একবার চেক করে দেখবেন।
ডাক্তার আর নার্স বেরিয়ে যেতেই শফি আবার বলে,
– অভি, আমি তোকে বলেছি ওকে এক্ষুনি বাড়ি নিয়ে যা।
অভি রুচিতার দিকে তাকিয়ে দেখে সে ব্যথাতুর নয়নে তাকিয়ে আছে শফির দিকে। সে এবার বেডের পাশে রাখা টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ফিসফিস করে শফিকে বলে,
– শফি প্লিজ, তুমি উত্তেজিত হইও না, আমি এখনই চলে যাচ্ছি।
অভি ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ইয়ামিন তুই এখানে একটু থাক না হয়, আমি ভাবীকে দিয়ে আসছি।
– লাগবেনা! ইয়ামিন বেচারা গতকাল থেকে পরিশ্রম করছে, ওরও ফেরা দরকার। তুমি বরং থাকো, আমি একটা সিএনজি বা রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো। নাফিসাতো সঙ্গে আছেই।
রুচিতার অবস্থা দেখে নাফিসার ভীষণ মায়া হচ্ছিল। কিন্তু এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে তার কি করা উচিত বুঝে পাচ্ছিল না। এতক্ষণে রুচিতা তার নাম মুখে নিতে সে তড়িঘড়ি বলে,
– হ্যাঁ, আপনারা ভাববেন না আমি আপুকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।
শফি আবার গলা চড়িয়ে বলে,
– হ্যাঁ যাও, এখুনি যাও।
শফির ব্যবহারে রুচিতার কান্না চলে আসে। সে নিজের অশ্রু লুকাতে প্রায় দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় একাই, তারপর কেবিনের বাইরে রাখা একটা চেয়ারে বসে অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করে। নাফিসা এসে তার পাশে বসে, তার কাঁধে হাত রাখে। রুচিতা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– বিশ্বাস কর নাফিসা, কালকে যখন ও বাড়ি থেকে বের হয় তখনও আমার সঙ্গে কত ভালো ব্যবহার করেছে! বলেছিল বাড়ি ফিরে আমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে। অথচ এই এক রাতে কি এমন হলো যে ও আমার সাথে এমন আচরণ করছে? আমাদের বিয়ের এত দিনে একবারও ও আমার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করেনি। বিশ্বাস কর… বিশ্বাস কর তুমি!
নাফিসা বুঝতে পারে শফির ব্যবহারে রুচিতা যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার থেকে বেশি অপমানিত আর লজ্জিত বোধ করছে। সে রুচিতাকে আশ্বস্ত করতে তার কাঁধে হাতের চাপ বাড়ায়। নরম কন্ঠে বলে,
– মানুষের শরীর খারাপ থাকলে মানুষের মেজাজ একটু খিটখিটে হয়ে যায় আপু। আমার তো জ্বর আসলে আমি বাড়ির সবাইকে ধমকের উপরেই রাখি। এগুলো ধরতে হয় না। আপনি বাসায় চলেন, ভাইয়ার শরীর একটু ভালো হয়ে এলে দেখবেন তিনি নিজেই আপনাকে ডেকে পাঠাবেন।
রুচিতা জবাবে চুপ করে থাকে। চোখের জল ফেলে মনে মনে ভাবে… দুই এক দিনে হয়তো সবই ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু বাড়ি ফেরার পর আজ তার শাশুড়ির কাছে যে কড়া কথাগুলো তাকে শুনতে হবে সেটা সে কিভাবে সামলাবে? এই বাড়িতে তার ওপর দিয়ে যত ঝঞ্ঝাট যেত, পুরো দিনে তার শাশুড়ি তাকে যতই কটু কথা বলুক সন্ধ্যায় শফি বাড়ি ফিরে যখন তার পাশে হাসিমুখে বসতো সঙ্গে সঙ্গে তার সব কষ্ট ফিকে মনে হতো। আজ সেই শফিই যখন তাকে দূর দূর করছে তখন তার শাশুড়ির কটু কথার ভার সে একা কিভাবে বহন করবে? রুচিতার মনে হয় তার বাবা-মা তার সঙ্গে অন্যায় করেছে, এ সময় তাকে ছেড়ে তাদের যাওয়াটা উচিত হয়নি একদম! হঠাৎ করে তার পৃথিবীতে নিজেকে খুব একা লাগে!সে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।

চলবে।