যতনে রাখিবো পর্ব-০১

0
98

#যতনে_রাখিবো


যতনে_রাখিবো
‘এটাই হবে আমাদের শেষ দেখা। আগামীকালের পর থেকে আমি আর তোমার প্রেমিকা থাকব না। তখন আমি অন্য কারো অর্ধাঙ্গিনী হবো। তোমাকে এক পলকের জন্য একটু দেখাও তখন আমার ভাগ্যে জুটবে না। আমি হয়তো তোমাকে দেখতেও চাইব না। তোমাকে দেখলে আমি অন্য কারো সাথে ঘর করতে পারব না। আমার মন বারংবার তোমার কাছেই ছুটে আসতে চাইবে। তাই আজই তোমাকে মন ভরে দেখে নিতে দাও। এই জন্মে আমার আর তোমাকে পাওয়া হলো না।’

সামিরের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলার সময় মিতুর গাল বেয়ে টুপটুপ করে অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়ে। মেয়েটার মুখে প্রিয় মানুষকে হারানোর বেদনা মাখানো হাসি। সামির মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার চোখও লালবর্ণ ধারণ করে জলে টলমল করছে। তাদের এক বছর সাত মাসের সম্পর্কে ইতি টানতে হচ্ছে আজ। কেউ কাউকে ঠকাচ্ছে না। দু’জনই নির্মম বাস্তবতার স্বীকার হয়েছে। ওরা এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল প্রথম বছরের শেষের দিকে। ভার্সিটির একটা অনুষ্ঠানে সব মেয়েরা শাড়ি পরে এসেছিল। সেদিনই প্রথম লক্ষ্য করা। এর আগে ক্লাসে হয়তো দেখা হয়েছে। কিন্তু কেউ কাউকে তেমনভাবে লক্ষ্য করেনি। তারপর কীভাবে কীভাবে দু’জনের মধ্যে মিষ্টি একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এটা তারাও বলতে পারবে না। একটা বছর দু’জন আদর্শ প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে রিকশায় ঘুরেছে। বৃষ্টিতে ভিজেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভেলপুরি খেয়েছে। টং দোকানে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে ঠোঁট ডুবিয়েছে। ক্যাম্পাসে ওরা অন্যান্য জুগলদের আদর্শ ছিল। ওদের কথা কে না জানতো! সবার মুখে মুখে ছিল তারা।
এক বছর যেতে না যেতেই মিতুর বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসতে লাগল। তারপরও মিতু ম্যানেজ করে নিয়েছিল। কিন্তু তারই একটা ক্লাসমেটের সাথে সম্পর্কের কথা জানতে পেরে মিতুর পরিবার আর দেরি করল না। মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজায় নেমে পড়ল। মাস তিনেকের মধ্যে উপযুক্ত পাত্র পেয়েও গেল। ছেলে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। পরিবারের অবস্থানও সামিরদের থেকে অনেক উপরে। এদিকে সামির মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ঘরে এখনও বিবাহ উপযোগ্য বড় বোন আছে। ছোট বোনটাও এবার এসএসসি দিচ্ছে। গতবছরই বাবার ছায়া মাথার উপর থেকে সরে গেছে। মা এখন তিনটি সন্তানের জন্যই যেন জীবনের বোঝা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার এখনও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি। ঠিকঠাক একটা জব পেতে এখনও অনেক দেরি। বলা যায় এখন একপ্রকার বেকার জীবনই কাটাচ্ছে সে। এই মুহূর্তে মিতুকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব না। বোনদের বিয়ে না দিয়ে ভাই বিয়ে করলে ওই ভাই সমাজের চোখে অকর্মা, অপদার্থ। মিতু সবই জানে। তাকে বুঝেও। এইজন্যই হয়তো তাকে জোর করেনি। মিতু জোর করলে বিয়েটা তাকে করতেই হতো। মিতু আড়ালে চোখের জল মুছলো। অশ্রুসিক্ত মুখে হাসি এনে বলল,

“কই আমার দিকে তাকাও। মন না ভরলেও দু-চোখ ভরে তোমাকে দেখে নিই। আজকের পর তো তোমাকে আর দেখতে পাব না।”

মিতু বারবার চোখ মুছছে। ছোট বোনকে নিয়ে পার্লারের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। নইলে বাবা মা তাকে নজরবন্দি করে রেখেছে বলা যায়। এক ঘণ্টার উপরে হবে এসেছে। আর দেরি করা যাবে না। বাড়ি ফিরতে হবে।

“তাকাও আমার দিকে। সে কী! তুমি কাঁদছো নাকি! ইশ পুরুষ মানুষকে কাঁদতে দেখলে আমার একদম ভালো লাগে না।”

সামির চোখ মুছে নিল। আজকের আগে নিজেকে কখনও এতটা অসহায় মনে হয়নি। নিজের প্রেমিকাকে চোখের সামনে অন্য কারো হতে দেখেও কিছুই করতে পারছে না। এতটা অপদার্থ কেন সে?

“শোনো আজকের পর আর কোনোদিনও কাঁদবে না তুমি। আমি ছাড়া আর কেউ যেন তোমাকে কাঁদতে না দেখে। তুমি জানো এখন আমার কী করতে ইচ্ছে করছে? তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।”

“আপু! এই আপু, তাড়াতাড়ি করো। মা বারবার কল দিচ্ছে।”

ওদের থেকে একটু দূরে মিতুর বোন দাঁড়িয়ে আছে। আপুকে পাহারা দিচ্ছে সে। মা কড়াভাবে বলে দিয়েছে এক সেকেন্ডের জন্য যেন বোনকে চোখের আড়াল হতে না দেয়। মিতু বোনকে বলল,

“আর একটু অপেক্ষা কর। আসছি আমি।”

মিতু সামিরের দিকে ফিরে বলল,

“যেতে হবে। তুমি কি এখনও কিছুই বলবে না? শেষ বার অন্তত ওই কথাটা বলো।”

শেষ বার! এরপর ওই কথাটা আর কোনদিনও বলা হবে না! না, ওই কথাটা আর কাউকেই কোনদিনও বলতে পারবে না সে। সামিরের বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এই অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে বাকি জীবনটা কীভাবে বাঁচবে সে? এই যন্ত্রণা যে সহ্য করার মতো না। মিতু অধীর আগ্রহে কথাটা শোনার জন্য সামিরের দিকে তাকিয়ে আছে। সামির গলায় জোর এনে বলল,

“আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।”

মিতু ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। বুকের ভেতরটা যে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তবুও মুখে বলল,

“ইশ, এই কথা শুনতে চেয়েছি আমি?”

“আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি মিতু। সারাজীবন তোমাকেই ভালোবেসে যাব। তোমার পর আর কেউ আমার জীবনে আসবে না। তুমি আমার প্রথম প্রেম, তুমিই শেষ। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমাকে আমি নিজের করে নিতে পারলাম না। তোমাকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারলাম না।”

“উঁহু। আমি যেন তোমার শেষ প্রেম না হই। আমাকে প্রথমই রেখো। আমার পরেও তোমার জীবনে এমন একজন আসবে যাকে তুমি আমার থেকেও বেশি ভালোবাসবে। যাকে পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে। তুমি তখন এটা ভাববে, যা হয়েছে তা আমাদের ভাগ্যে লেখা ছিল। তুমি সেই মেয়েটাকে তোমার জীবন সুন্দর করে দেওয়ার অধিকার দিবে। তোমাকে ভালোবাসার অনুমতি দিবে। কথা দাও। কথা দাও, আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে তুমি আমাকে এমনটা মনে করতে দিবে না। তুমি দ্বিতীয় বার ভালোবাসবে। এবং সেই ভালোবাসাটা সারাজীবনের জন্য হবে। কথা দাও।”

মিতু বোনের পাশে সিএনজিতে বসে খুব কাঁদল। নিতু আপুর কান্না কোনোভাবেই থামাতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে মিতুর নিঃশ্বাস আটকে আসছে। এই কান্না তার শেষ কান্না না।
মিতু চলে যাবার পর সামির ওই জায়গাটাতেই বসে রইল। কোথাও যাওয়ার নেই তার। কোন ব্যস্ততা নেই। তার কিছুই করার নেই। সামিরের মনে হচ্ছে কোনোভাবে দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে গেলেই হয়তো তার এই কষ্ট কমবে। এছাড়া আর অন্য কোন পথ খোলা নেই।

চলবে
Jerin Akter Nipa