যতনে রাখিবো পর্ব-২+৩

0
131

#যতনে_রাখিবো

গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে একঝাঁক তরুণীরা এসে অভয়কে ঘিরে ধরলো। ওদের চিৎকারে কান তব্দা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। প্রেস মিডিয়া, মেয়ে ভক্তদের চিৎকার চেচামেচি, ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ সব মিলিয়ে অভয়ের মাথা ধরিয়ে দেওয়ার উপক্রম। এত বছরে এসব তার অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা। অভ্যাস হয়েও গেছে। মনে মনে হাজার বিরক্তি চেপে রেখেও মুখে আন্তরিকতার সঙ্গে হাসি টেনে ক্যামেরার সাথে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রেসদের বিরক্তিকর সব প্রশ্নের বেশ সাবলীল ও গ্রহনযোগ্য উত্তর দিয়েছে। অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে এলেও কোন ভক্তকেই ফিরিয়ে দেয়নি। যতক্ষণ সে বাহিরের দুনিয়ায় থেকেছে ততক্ষণই চেহারায় একটা সুখী সুখী হাসি ধরে রেখেছে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। আজ শত চেষ্টা করেও মেজাজটা ঠিক রাখতে পারছে না। অল্পতেই বিরক্তি এসে যাচ্ছে। তার অল্পবয়সী ম্যানেজার নোমান কানের কাছে এসে বলল,

“স্যার, আপনার কপাল কুঁচকে আছে। প্লিজ স্যার কপালের ভাঁজ গুলো সহজ করে তুলুন। নইলে এটা নিয়েও নিউজ হবে। তখন আরও ঝামেলা।”

অভয় ম্যানেজারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেও নোমান দমলো না। বিনীত হেসে বলল,

“আপনার ভালোর জন্যই তো বলছি স্যার। গতবারের কথা মনে নেই? আপনি একটা হাঁচি দিলেও তো ব্রেকিং নিউজ হয়ে যায়।”

অভয় দাঁতে দাঁত চেপে রেগে কথা বললেও মুখ থেকে হাসি সরল না। দূর থেকে কেউ দেখলে বোঝার ক্ষমতা নেই সে ম্যানেজারের উপর রাগ ঝাড়ছে। মানুষ মনে করবে দু’জন কানে কানে ইন্টারেস্টিং কোন কথা বলছে।

“তুমি এখন পুরোপুরি বোবা না হলে আমার সামনে যে রিপোর্টারটা আছে, ঠাস করে ওর গালে একটা চড় দিয়ে বলবো, দুঃখিত ভাই সাহেব আপনার গালে মশা বসেছিল। আমি মেরে দিয়েছি। তুমি কি চাও আমি এমনটা করি?”

স্যার এমনটা করতেই পারেন। নোমান এতদিনে এটা জেনে গেছে তার স্যার কিছুটা পাগলাটে। মাঝে মাঝে এমনসব পাগলামি করেন স্যার। আজও করে ফেলবেন। ভয় পেয়ে নোমান সত্যি সত্যিই বোবা হয়ে গেল। আজকে আর সে একটা কথাও মুখ দিয়ে বের করবে না। অভয়ের বিরক্তি ভাব ক্রমশ বাড়ছে। আজকের দিনে কোন মিটিং, প্রোগ্রাম রাখতে চায়নি। শুটিংও ক্যান্সেল করেছে। আজকের তারিখে তার জীবন থেকে সবথেকে মূল্যবান জিনিসটা হারিয়ে গিয়েছিল। এই দিনটা একান্তই তার। তার দুঃখ বিলাস করার দিন এটা। অভয় নোমানকে বলেছিল আজ যেন কোন প্রোগ্রাম না রাখে। আর রাখলেও ওই প্রোগ্রামে সে উপস্থিত হবে না।নোমান স্যারের কথা মতোই সব মিটিং প্রোগ্রাম পিছিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অভয় যে বাচ্চাগুলোর চোখের অপারেশনের দায়িত্ব নিয়েছিল ওদের অপারেশন আজই হবে। আর তাকে পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও হসপিটালে আসতে হবে।
অভয় ম্যানেজারের উদ্দেশ্যে বলল,

“পাঁচ মিনিট সময় দেওয়ার কথা ছিল। এখন কত মিনিট হয়েছে?”

স্যার তাকে বোবা হয়ে যেতে বলেছিল। বোবারা কথা বলতে পারে না। তাই নোমান এখন চাইলেও উত্তর দিতে পারবে না। অভয় মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না। এখানে মিডিয়াদের কে ডেকেছে? সে কি এই কাজটা লোক দেখানোর জন্য করছে? এজন্যই অভয় মিডিয়াদের সহ্য করতে পারে না। এই মুহূর্তে তার সব রাগ নোমানের উপর গিয়ে পড়ছে।

“ত্রিশ মিনিটের ভেতর যেন সবকিছু শেষ হয়। আর এখানে কি আমি অটোগ্রাফ দিতে এসেছি?”

নোমান এবারও কোন জবাব দিচ্ছে না। অভয় জবাব না পেয়ে কটমট করে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“কথা বলছো না কেন গাধা?”

“স্যার আপনার ভক্ত সংখ্যাই এত বিশাল! কাউকে এলাউ না করলেও ঠেলেঠুলে এরা এসেই পড়েছে।”

অবশেষে অভয় ফ্যানেদের ভীড় পেরিয়ে হসপিটালের ভেতরে ঢুকতে পেরেছে। ভেতরে এসে বাচ্চা গুলোকে দেখে ওর খিটখিটে মেজাজ মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেল। ফুলের মতো ফুটফুটে, নিষ্পাপ বাচ্চা গুলো দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবে। এই সুন্দর পৃথিবীর সব রঙ দেখতে পাবে। নিজের চোখে সৃষ্টিকর্তার তৈরি সৌন্দর্য উপভোগ করবে। এর থেকে সুখের আর কী হতে পারে? অভয় ডাক্তারদের সাথে কথা বলল। অপারেশন কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে। নোমান ততক্ষণে তার বেরোনোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে। স্যার এখান থেকে সোজা ফ্যামিলি প্রোগ্রামে যাবে এই মিথ্যাটা বলে নোমান অভয়কে হসপিটাল থেকে বের করে আনলো। চলে আসার সময়ও ভক্তদের সাথে হাসি মুখে কয়েকটা পোজ দিতে হয়েছে। অভয় গাড়িতে উঠতেই যাবে এমন সময় কোত্থেকে একটা মেয়ে এসে ওর হাত ধরে ফেলল। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে অভয় নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারল না। নোমান চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে আছে। আজ তার চাকরি যাবে। সে থাকতেও একটা মেয়ে কীভাবে স্যার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে? কেউ কিছু বোঝার বা করার আগেই মেয়েটা চেঁচিয়ে বলতে লাগল,

“মিস্টার অভয় খান, আপনি কেন আমার সাথে এমনটা করলেন? কেন আমাকে এত বড়ো ধোঁকা দিলেন? কেন এভাবে আমার জীবন নষ্ট করলেন? আমি আপনার বিচার চাই। আপনি এত সহজে পার পেয়ে যেতে পারেন না।”

সিনেমার দৃশ্যের মতোই কয়েক মুহূর্তের জন্য সবকিছু থেমে গেল যেন। সমস্ত হৈচৈ থেমে গিয়ে সব নিরব হয়ে গেল। মেয়েটার কথা শুনে অভয়ের কপাল কুঞ্চিত হলো। কে এই মেয়ে? আজকের আগে এই মেয়েকে কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। তাহলে একে ধোঁকা কীভাবে দিবে? আর কী ধোঁকাই বা দিবে?
ভক্তদের মাঝে প্রায় হাতাহাতি লেগে গেছে কে কাকে ঠেলে আগে আসবে। প্রেস মিডিয়া একের পর এক ছবি তুলে নিচ্ছে। অভয়ের হতভম্ব ভাব এখনও কাটছে না। নোমানের ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে। আবার আরেকটা নতুন স্ক্যান্ডাল! এই স্ক্যান্ডাল এত সহজে মেটানো যাবে না। এই জল অনেকদূর গড়াবে। স্যারের ক্যারিয়ার সংকটে এসে যেতে পারে। এমনিতেই ইন্ডাস্ট্রিতে স্যারের শত্রুর অভাব নেই।

তাথৈ অর্ধেকটা কথা বলেছে। তার কথা আরও বাকি আছে। এখনও তো সবটা বলে শেষ করতে পারেনি। আপনার মুভি দেখে আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। আপনাকে ছাড়া এখন অন্য কিছু ভাবতে পারি না। আপনি আমার রাতের ঘুম, এমনকি দিনের ঘুমও কেড়ে নিয়েছেন। আমি যেখানেই যাই আপনাকে দেখি। সবজি ওয়ালা, ভ্যান ওয়ালা, ময়লা ওয়ালা সবার মাঝেই আপনাকে দেখতে পাই। ক্লাসের পড়ায় আমার মন বসে না। কারণ স্যারের মাঝেও যে আমি আপনাকেই দেখি। আমার এই অবস্থার জন্য আপনার বিচার হওয়া উচিত। আপনি আমার সুখ শান্তি কেড়ে নিয়ে এত সহজে পার পেতে পারেন না।
কিন্তু তাথৈ এসব কথার একটাও বলতে পারল না। তার আগেই গার্ডরা ওকে একপ্রকার চেংদোলা করে ওখান থেকে নিয়ে যাচ্ছে। অভয়ের ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কোঁচকানো। সে অদ্ভুত চোখে এখনও মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাথৈ কোনোভাবেই শক্তপোক্ত গার্ডদের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। সে বুঝতে পারছে অঘটন একটা ঘটিয়ে ফেলেছে। এরা তাকে পুরো কথা বলতে দেয়নি। সে একজন ফ্যান হিসেবে এসব কথা বলেছে। তার অর্ধেক কথা শুনে এখন নিশ্চয় কেউ এই কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই লোকটার চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে। এই বিষয়ে তাকে জড়াতেও এতটুকু ছাড় দিবে না। হায় আল্লাহ! সবকিছু তো গণ্ডগোল বেঁধে গেল।
প্রেসের হাজারটা প্রশ্ন, ভক্তদের পাগলামি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ সবকিছুকে এড়িয়ে নোমান অভয়কে গাড়িতে বসিয়ে দিল। গার্ডরা ভীড় সরিয়ে পথ করে দিলে গাড়ি ছুটতে লাগল। পেছনে ফেলে গেল তার ক্রেজি ফ্যানস আর মাথা খারাপ মিডিয়া। রিপোর্টার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিউজ করে যাচ্ছে।

“দর্শক কিছুক্ষণ আগেই আপনারা দেখেছেন এখানে কী ঘটে গেছে। কে এই মেয়ে? এই মেয়ের সাথে অভয় খানের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? মেয়েটা কি অভয় খানের গার্লফ্রেন্ড? নাকি শুধুই উনার পাগল ভক্ত? এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাবার পরও অভয় খান নিজের দিক থেকে কোনকিছু পরিষ্কার না করে একটু আগেই চলে গেছেন। এই ব্যাপারে কোন কথাই তিনি বলেননি। চলুন দেখা যাক এই বিষয়টা নিয়ে উনার ভক্তদের মাঝে কেমন প্রতিক্রিয়া ঘটেছে।”

ক্যামেরা এবার রিপোর্টারের উপর থেকে সরে গিয়ে একটি মেয়ের উপর পড়েছে। মেয়েটা রীতিমতো থরথর করে কাঁপছে আর কাঁদছে। বারবার চোখ মুছছে সে। রিপোর্টার প্রশ্ন করল,

“জি আপনার নাম?”

মেয়েটা কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। তারপরও কাঁপা গলায় উত্তর দিল,

“মাইশা সরকার।”

“মিস মাইশা, এই পুরো ঘটনাটা আপনি কীভাবে দেখছেন? ওই মেয়েটা কে হতে পারে? অভয় খানের ফ্যান? গার্লফ্রেন্ড? নাকি তার থেকেও বেশি কিছু?”

“ওই মেয়ে যে-ই হোক আমি জানি না। কিন্তু অভয় তুমি যদি এই মেয়েটাকে বিয়ে করো তাহলে আমি মরে যাব।”

রিপোর্টার একে ওকে ধরে আরও অনেক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। মেয়ে গুলোও আবেগ ধরে রাখতে না পেরে মনে যা আসছে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। অভয় গাড়িতে বসে ট্যাবে এসব নিউজ লাইভ দেখছে। নোমান অস্থির হয়ে উঠেছে। অলরেডি ডিরেক্টর, প্রডিউসারদের ফোনকল আসতে শুরু করেছে। সবাইকে কী জবাব দিবে সে!

“স্যার এবার কী হবে? সবকিছু তো হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।”

নোমান যতটা চিন্তিত হচ্ছে তার এক ভাগও অভয়ের মাঝে দেখা যাচ্ছে না। সে নিরুত্তাপ। ট্যাব রেখে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসেছে। নোমান উত্তেজিত গলায় বলল,

“স্যার আপনি বুঝতে পারছেন না

এই ঘটনা এখন কতদূর গড়াবে! প্রডিউসার, হিরোইন ম্যাম কল করে পাগল করে দিচ্ছে। সকলে একটা কথাই জানতে চাচ্ছে, ওই মেয়েটা কে। আপনার সাথে ওই মেয়ের কোন সম্পর্ক আছে কি-না।

অভয় চোখ বন্ধ রেখে উদ্বেগহীন গলায় বলল,

“মেয়েটা কে সেটা আমিও জানতে চাই নোমান। এটা তুমি বের করবে আসলেই মেয়েটার পরিচয় কী।”

অভয়ের কথার মাঝেই নোমানের ফোন বেজে উঠল। নোমান স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে করুণ মুখ করে বলল,

“স্যার, আর কে স্যারের কল। কী করবো?”

“কথা বলো।”

নোমান ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে রাদিদ খানের গম্ভীর কন্ঠ শোনা গেল।

“ফোন অভয়কে দাও।”

নোমান অভয়ের দিকে তাকিয়ে ফোনের স্পিকার চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,

“আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।”

অভয় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“দাও।”

চলবে
Jerin Akter ণিপা

#যতনে_রাখিবো

রাদিদ খান। ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সফল পরিচালক। স্টার কিড হলেও বাবা মায়ের পথ অনুসরণ না করে সে পরিচালনাকে বেচে নিয়েছে। অল্প বয়সে তার এত খ্যাতি অনেকেই সহ্য করতে পারে না। নিন্দুকেরা তাকে ছোট করতে সবখানেই বলে থাকে রাদিদ খান যা কিছু পেয়েছে তা তার বাবা মা’র বদৌলতে। কিন্তু কথাটা মোটেও সত্য না। এই অল্প বয়সী পরিচালক নিজের বুদ্ধি, মেধা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে আজকের এই অবস্থান অর্জন করে নিয়েছে। নিন্দুকদের কথা শোনার সময় তার নেই। রাদিদ খানের ক্ষেত্রে এই কথা বললেও ভুল হবে না, তার হাত ধরেই অনেকটা ইন্ডাস্ট্রি আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছে। নিজের (আর কে প্রোডাকশন হাউজ) থেকে একের পর এক ব্লকবাস্টার মুভি দর্শকদের উপহার দিয়ে যাচ্ছে। কাজের সূত্রের বাইরেও রাদিদ খানের সাথে অভয়ের অন্য একটা সম্পর্ক আছে। আর সেই সম্পর্কটা হলো শালা দুলাভাইয়ের। রাদিদ খান অভয়ের ছোট বোন মিমের স্বামী।
ফোন কানে নিয়ে অভয় সহজ গলায় বলল,

“হ্যাঁ বলো।”

“কোথায় আছো?”

“আপাতত গাড়িতে।”

“তোমার বোন তোমার ওখানে গেছে।”

“জানি। এজন্যই বাসায় ফিরছি না।”

“আর আজকের ঘটনাটা নিয়ে কী বলবে?”

“তুমি জানো।”

“ইদানিং এসবে তুমি খুব বেশি জড়িয়ে যাচ্ছ।”

“এতে আমার কোন হাত নেই।”

“হাত না থাকলেও তোমার ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করেই এসব স্ক্যান্ডাল এড়িয়ে চলা উচিত। সবসময় ভাগ্য মানুষের সঙ্গ দেয় না।”

“হুম।”

“আচ্ছা এখন এসব নিয়ে এত ভেবো না। যা হবার হয়ে গেছে। তোমার নেক্সট মুভির কাজ কবে থেকে শুরু হচ্ছে?”

“হাতে এক মাস সময় আছে। ক্যারেক্টারে কিছু চেঞ্জ এসেছে। সেগুলো নিয়েই কাজ করতে হবে।”

“ঠিক আছে। তোমার সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন তোমার ক্যারেক্টার, স্ক্রিপ্টে দেওয়া উচিত। আর বোনদের সাফাই দেওয়ার জন্য এবার কী স্টোরি বানিয়েছ?”

কথা বলা শেষে নোমানকে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে অভয় বলল,

“এক ঘন্টার ভেতরে ওই মেয়ের সমস্ত ইনফরমেশন বের করো নোমান। মেয়েটাকে কে কত টাকা খাইয়েছে। কার হয়ে কাজ করেছে, সব আমার জানা চাই।”

“তা তো বের করা যাবে স্যার। কিন্তু মিডিয়াকে কী বলে বোঝ দেব? ওরা অলরেডি মেয়েটাকে আপনার গার্লফ্রেন্ড বা লুকিয়ে বিয়ে করা বউ বানিয়ে ফেলেছে।”

“মাস শেষে মোটা টাকা বেতন দিয়ে তোমাকে কেন রেখেছি? মাথাটাকে একটু খাটাও। মিডিয়াকে হ্যান্ডেল করার দায়িত্ব তোমার।”

একটু আগের একটা ঘটনা নিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাকে নিয়ে মুভি পাড়ায় রীতিমতো ঝড় শুরু হয়ে গেছে। প্রত্যেকটা নিউজপেপারে তাকে নিয়ে রঙচঙ মাখিয়ে রসালো সব হেডলাইন দেওয়া হচ্ছে। তবুও যেন তার কোন ভাবনা নেই। অভয় চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে কোন গানের লাইন আওড়াচ্ছে। এদিকে নোমান কল তুলতে তুলতে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। সবাইকে একটা কথাই বোঝাচ্ছে সে, ওই মেয়ের সাথে স্যারের কোনোরকম সম্পর্ক নেই। মেয়েটাকে কেউ বা কারা টাকা খাইয়ে এই কাজ করিয়েছে। নোমান ছেলেটার বয়স অল্প। অভয়ের সাথে আছে দু’বছরও হয়নি। কিন্তু এই কম সময়ের মাঝেই নিজের কাজের দক্ষতা দেখিয়ে অভয়ের মন জয় করে নিয়েছে। অভয় মুখে স্বীকার না করলেও এই ছেলেকে ছাড়া এখন তার চলে না। সে কী খাবে থেকে শুরু করে কী পরবে এটা পর্যন্ত নোমান ঠিক করে দেয়। তার মুভি লন্সিং, প্রোগ্রাম, মিটিং, অ্যাওয়ার্ড ফাংশন সবকিছু এই ছেলে হ্যান্ডেল করে। তাকে শুধু সময় জানিয়ে দেয় কবে কখন কোথায় যেতে হবে। পারলে ওখানে গিয়ে তাকে কী কী বলতে হবে এটারও একটা স্ক্রিপ্ট লিখে দিত। ছেলেটার দায়িত্বজ্ঞান দেখে অভয় মুগ্ধ হয়।

“স্যার নিউজ চ্যানেল গুলো সহ যত টিভি চ্যানেল আছে সব জায়গায় এখন আপনাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। আপনার সাথে কোন হিরোইনকে দেখা গেলেও যেখানে ব্রেকিং নিউজ হয়, সেখানে তো এটা বোমা ফাটানোর মত একটা ঘটনা। না জানি এই স্ক্যান্ডাল মুছতে কতদিন সময় লাগে। অবশ্য আপনার ভক্তরা মেয়েটাকেই দুষছে। একশোতে দু’জনও বিশ্বাস করছে না আপনি মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু করেছেন। এটা অনেকটা রিলিফ দিচ্ছে।”

“এখন কি আমরা বাসায় ফিরছি?”

“জি স্যার।”

“উঁহু, ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে বড় আপুর ওখানে যেতে বলো।”

“স্যার আরেকটা কথা, আপনার দুই বোনই কম হলেও একশোটা কল দিয়েছে। আমি তুলিনি। আপনার বোনদের আমার ভয় লাগে। বড় আপু তো সারাক্ষণই আমাকে ধমকা ধমকি করে যাচ্ছে আমি নাকি কোন কাজের না। ছোট আপু অবশ্য ধমকায় না। কিন্তু উনারও মনে হয় আমাকে দিয়ে আপনার কোন উপকার হচ্ছে না।”

বোনদের কথা শুনে অভয় নিঃশব্দে সামান্য হাসল। তার দুই বোনই তাকে নিয়ে ওভার পজেসিভ। মা মারা যাবার পর থেকে বড় আপুই যেন মায়ের ভূমিকা পালন করছে। তার ছোট বোনটাও এতদিনে পাক্কা সংসারী হয়ে গেছে। এখন ভাইয়ের সংসার পাতানোর ধান্দায় আছে সে। প্রতি সপ্তাহেই অসংখ্য মেয়ের ছবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। কিন্তু কোন মেয়েই ভাইয়ের পছন্দ মতো হচ্ছে না। তাই বলে সে হাল ছেড়ে দেয়নি। বরং দ্বিগুণ উদ্দামে ভাবী খোঁজার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

“বড় আপুর বাড়িতে যাওয়ার আগে নূরের জন্য…

“আমার মাথায় আছে স্যার।”

বড় আপুর মেয়ের বয়স পাঁচ বছর। চকলেট খেতে ভীষণ পছন্দ করে। দুনিয়ায় তার পছন্দের জিনিস দুইটাই। চকলেট ও তার মামা। তবে সে চকলেটের থেকেও বেশি মামাকে ভালোবাসে।


তাথৈ দূর থেকেই দেখতে পেলো তার বাড়ির সামনে কত মানুষের ভীড়! এরা যে মিডিয়ার লোক তার চিনতে ভুল হলো না। বেচারির কলিজায় পানি রইল না। সে বাড়ি পৌঁছানোর আগে মিডিয়া তার বাড়ি পৌঁছে গেছে! আপু দুলাভাই কি এতক্ষণে খবরটা জেনে গেছে? কেউ কি বাইরে বেরিয়েছিল? সামনের রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ঢোকা অসম্ভব। তাকে এখানে দেখলেই এরা ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলবে। তাথৈ ঘুরে গিয়ে পেছনের গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। আজ তার কপালে শনি নাচছে। টিভিতে যদি তার ওই কাণ্ড দেখিয়ে থাকে তাহলে আপুর হাতে আজই তার শেষ দিন। তাথৈর বড় বোনের নাম তানিয়া। টিভিতে যখন তাথৈকে দেখাচ্ছিল তখন তানিয়া রান্নাঘরে ছিল। তার সাত বছরের ছেলে খালামনিকে টিভিতে দেখে চিৎকার করে মা’কে ডেকে আনে।

“আম্মু! আম্মু খালামনিকে টিভিতে দেখাচ্ছে। আম্মু তাড়াতাড়ি আসো…

অভয়কে নিয়ে তাথৈর ওই কথাগুলো শুনে তানিয়ার নিজেরই রাগ উঠে যাচ্ছে। এই মেয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কাকে নিয়ে কী বলছে ও! অভয় খান ওর সাথে কী করেছে! কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলে নায়ক ও নিজের জীবনে সেধে কালবৈশাখী ঝড় নিয়ে এলো।

“আম্মু খালামনি টিভির ভেতর কীভাবে গেছে? খালামনি কি নায়িকা হয়ে গেছে?”

তানিয়া ধমক দিয়ে ছেলেকে টিভি অফ করে বই নিয়ে বসতে বলল। অভয় খানের মেয়ে ভক্তের অভাব নেই। ওর মেয়ে ভক্ত গুলো অভয় খান বলতে পাগল। এই নিউজ দেখার পর তাথৈকে পেলে ওরা কী করবে আল্লাহ মাবুদ জানেন। একটু পরেই তানিয়া বুঝতে পারল তাদের বাড়ির সামনে দুই তিনটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়ার লোকেরা তাদের সাথে কথা বলতে চায়। তানিয়া দিশেহারা হয়ে স্বামীকে কল করে অফিস থেকে আসতে বলল। হারুন কিছুই জানতো না। সে সামনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় রিপোর্টাররা ওকে ঘিরে ধরলো। নানান প্রশ্ন করতে লাগল। এসবের কিছুই হারুনের মাথায় ঢুকছে না। বেচারা চিন্তিত হয়ে পড়ল। তানিয়া, বাবাই, তাথৈ ঠিক আছে তো? কোনমতে রিপোর্টারদের ঠেলে ভেতরে এসে হারুন আসল ঘটনা জানতে পারল। তারপর থেকেই আর কেউ বাইরে বেরোনোর সাহস করল না।
তানিয়া খু’ন্তি হাতে বোনের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছে। আজ শুধু বাড়ি ফিরুক ও। সব জায়গায় কেন ওর ঝামেলা কুড়াতে হবে? হারুন শালিকা বাড়ি ফেরার আগে স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

“তুমি শুধু শুধু রাগ করছো। তাথৈ বাড়ি ফিরুক। ওর কাছে শুনে নিই কী ঘটেছিল। তারপর নাহয়…

“শোনা শুনির আর কী বাকি আছে? টিভিতে দেখোনি তুমি? না দেখে থাকলে এখন একবার টিভি খুলো। সব চ্যানেলে তোমার গুণধর শালিকেই দেখাচ্ছে। ওই বেচারা অপারেশন হওয়া বাচ্চা গুলোকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। হাসি মুখে ফ্যানেদর সাথে ছবিও তুলছিল। মাঝ থেকে তোমার একমাত্র আদরের শালি গিয়ে পাগলের মতো ওসব বলতে লাগল। ফিরুক না ও। শুধু এটাই জিজ্ঞেস করব, অভয় খান তোর সাথে কোন অন্যায়টা করেছে? তোর জীবন ওই নায়ক কীভাবে নষ্ট করেছে?

তাথৈ ঠুকঠুক করে পেছনের দরজায় শব্দ করছে। নিচু গলায় ডাকছে,

“আপু। আপু, বাবাই দরজা খোলো।”

কেউ কি তার ডাক শুনছে না? জোরে ডাকারও উপায় নেই। বাইরেই মিডিয়া। তাথৈ ধৈর্য ধরে দরজায় ঠকঠক করে যাচ্ছে। বাবাই দরজায় শব্দ শুনেই লাফিয়ে উঠল,

“বাবা খালামনি এসেছে।”

চলবে
Jerin Akter Nipa