#আরশি
#Part_17
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
অফিসে জয়েন করেছি আজ ১ মাস হতে চললো। চাকরিটা আমার পার্মানেন্টলি কনফার্ম হয়ে গিয়েছে। আমার কাজের কোয়ালিটি ভালো ও নিখুঁত হওয়ায় চাকরিটা অবশেষে হয়েই গেল। এরই মধ্যে জেসমিনের সাথে আমার বেশ খাতির হয়েছে বটে। এতদিনে যতটুকু ওর সম্পর্কে জেনেছি তাতে এতটুকু বুঝেছি, মেয়েটা ক্রিশ্চিয়ান হলেও স্বভাবে ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে। তার ভিতরে কোন প্যাঁচ গোঁজ নেই। সরল মনের মানুষ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে নিজের গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। এই অফিসে প্রায় ৩ বছর ধরে আছে। ৬ মাস হলো বিয়েও করেছে৷ বিবাহিত জীবনে নাকি বেশ সুখীও। জেসমিনের পাশাপাশি এই কয়েকদিনে অফিসের সকলের সাথে মোটামুটি একটা ভাব হয়ে গিয়েছে৷ এইখানের সকলেই বেশ ভালো আর মিশুক। শুধু দুই একজন বাদে। বস্তুত, দশজনের মধ্যে নয়জন ভালো হলে একজন খারাপ অবশ্যই হবে। এইটাই প্রকৃতির নিয়ম।
নিজের ডেস্কে বসে কিছু কাজ করছি। এমন সময় জেসমিন এসে হাজির হয় আমার সামনে। মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
— হেই আরশি! কি করছ?
আমি মাথা তুলে জেসমিনকে দেখে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,
— এইতো ফাইলগুলো দেখছিলাম। কেন কোন দরকার?
— দরকার তেমন কিছুই না। লাঞ্চ টাইমে কাজ করছ তাই বললাম। লাঞ্চ করবে না?
জেসমিনের কথা শুনার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি টেবিলের উপর রাখা টেবিল ঘড়ির দিকে তাকাই। হ্যাঁ ঠিকই লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে গিয়েছে অথচ আমি টেরই পাই নি৷ জেসমিন না বললে হয়তো খেয়ালও করতাম না। আমি জেসমিনের দিকে মিষ্টি হেসে বলি,
— ফাইলটা চেক করছিলাম বিধায় সময়ের দিকে খেয়াল ছিল না। তুমি না বললে হয়তো আজকে লাঞ্চটা স্কিপ হয়ে যেত।
— মেনশন নট! বাট লাঞ্চে কি খাবে?
— আমি বাসা থেকে লাঞ্চ এনেছি। ডোন্ট ওয়ারি।
কথাটা বলতেই বলতে আমি ব্যাগ থেকে মিডিয়াম সাইজের এয়ারটাইট বক্সটা বের করে নিলাম। টেবিলের উপর বক্সটা রেখে জেসমিনকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
— তুমি দাঁড়াও আসছি আমি৷
এই বলেই আমি ওয়াশরুমের দিকে চলে যাই। হাত ধুয়ে নেই। নিকাবটা খুলে চোখে মুখেও একটু পানি দিয়ে নেই। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে দেখি জেসমিন একটা চেয়ার টেনে আমার ডেস্কের সামনেই বসেছে। আমি এইবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখি এই মূহুর্তে অফিসে মানুষ তেমন একটা নেই। লাঞ্চ টাইম বিধায় সকলে গিয়েছে নাইন্থ ফ্লোরের ক্যান্টিনে আড্ডা জমাতে। আর যারা আড্ডায় যেতে চায় নি তারা কয়েকজন একত্রিত হয়ে এইখানেই খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে। আমি আর কোনদিকে না তাকিয়ে চলে যাই নিজের ডেস্কে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে জেসমিনকে উদ্দেশ্য করে বলি,
— তুমি লাঞ্চ করবে না?
জেসমিন স্মিত হেসে বলে,
— আজকে আনতে ভুলে গিয়েছি। নুহাস আমার লাঞ্চ প্যাক করে টেবিলেই রেখেছিল কিন্তু আজ লেট হয়ে যাওয়ায় তারাহুরো করে বেরিয়ে পড়ি আমি। যার ফল আজ লাঞ্চ নেই আমার ভাগ্যে।
আমি কৌতূহলবসত জিজ্ঞাস করি,
— ভাইয়া রান্না করে?
— হ্যাঁ! সকালের নাস্তাটা ও বানায় আর রাতেরটা আমি। সকালে আমি উঠতে পারি না তাই সকালে নাস্তাটা ও করে। বাকি অবশ্য সকল কাজেই ভাগাভাগি করি আমরা।
কথাটার প্রত্যুত্তরে কি বলা যায় তা খুঁজে পেলাম না। তাই ছোট করে ‘ও’ বললাম। বাইরে দিয়ে কিছু প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে কথাটা শুনে বেশ ভালো লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, ” যাক সবাই এক না।” এরই মাঝে জেসমিন বলে উঠে,
— কিন্তু এর মধ্যে আমার একটাই কষ্ট। নুহাস কাপড় ধুতে চায় না। গর্ধবটা নাকি উগান্ডা যেতে রাজি কিন্তু কাপড় ধুতে না। অতঃপর আমাকেই উকেন্ডে সব কাপড় ধুতে হয়। কি কষ্ট আমার।
আমি জেসমিনের কথা শুনে ঠোঁট টিপে হেসে বলি,
— ইশ! কত কষ্ট।
জেসমিন আমার কথায় সাই দিয়ে বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
— হ্যাঁ বহুত কষ্ট। জীবনটাই বেদনার।
আমি এইবার হাসিটা দুই ঠোঁটের মাঝে পিষে রাখতে পারলাম। ঠোঁটের দুইপাশ প্রসারিত হয়ে বেড়িয়ে স্বচ্ছ হাসি৷ সেই হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখেই আমি বলি,
— আজ আমার সাথেই খাও। আর না করার কিন্তু সুযোগ নেই। তুমি আর আমি আজ একসাথেই লাঞ্চ করবো।
জেসমিন তাও সৌজন্যতার খাতিরে বলে উঠলো,
— না না তার কোন দরকার নেই৷ আমি এইভাবেও ক্যান্টিনে যাচ্ছিলাম ওখান থেকে কিছু খেয়ে নিব নে৷
— তো আমার সাথে খাওয়ার পর আবার ক্যান্টিনে গিয়ে খেয়েও। কেউ ধরে রাখবে না তোমাকে।
— আমাকে দেখে কি রাক্ষসী মনে হয়?
আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,
— না তো! তোমাকে তো একদম পুতুল লাগে।
— এই যাহ!
আমি কিছু না বলে হাল্কা হাসি। খাবারের বক্সটা হাতে নিয়ে ঢাকনা খুলতেই চারদিকে বিরিয়ানির ঘ্রাণটা ছড়িয়ে পড়ে। জেসমিন ঘ্রাণ পেয়ে বলে,
— বাহ! চিকেন বিরিয়ানি এনেছিস?
আমি মুখে কিছু না বলে মাথা দুলালাম করলাম। যার অর্থ হ্যাঁ। তারপর বক্সের ঢাকনায় নিজের জন্য একটু বিরিয়ানি নিয়ে বাকিটা জেসমিনকে দিয়ে দিলাম। সাথে একটা চামচ। জেসমিন চামচটা নিয়েই খাওয়া শুরু করে। এক চামচ খেয়ে বলে,
— বিরিয়ানি কে বানিয়েছে?
কথা শুনে আমি সরু চোখে জেসমিনের দিকে তাকালাম। বুঝার চেষ্টা করলাম বিরিয়ানি খারাপ হয়নি তো। সকালে তারাহুরো করে অহনার জন্যই চিকেন বিরিয়ানি করেছিলাম। বিরিয়ানিটা আবার অহনা ভীষণ পছন্দ করে। গতকাল রাতেই বেশ জিদ ধরেছিল বিরিয়ানি খাবে। তাই আজকে সকালে আসার আগে সে রান্না করে দিয়ে আসে৷ আর নিজের জন্য একটু নিয়ে আসে কিন্তু টেস্ট করা হয়নি এখনো। আমি জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে হাল্কা হাসির রেখা ঠোঁটের কোনে ফুটিয়ে তুলে বলি,
— আমি রেঁধেছি। কেন ভালো হয়নি বুঝি?
— ভালো হয়নি মানে একদম ফাস্ট ক্লাস হয়েছে। এত সুস্বাদু বিরিয়ানি আমি আর কোথাও খাই নি। মানতে হবে তোমার হাতে জাদু আছে।
— তুমি এখন একটু বেশি বলছো।
— একদম না। আমার বরং মনে হচ্ছে কমিয়ে বলছি। সত্যি অসাধারণ হয়েছে। এন্ড তুমি কিন্তু আমাকে এইটার রেসিপি দিবে। আমি ট্রায় করবো।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাই যে রেসিপি দিব। জেসমিন মুখে তৃপ্তির হাসি ঝুলিয়ে বলে,
— সরি ব্রো বাট এখন থেকে তোমার খাবারে আমি ভাগ বসাচ্ছি। তুমি দিতে না চাইলেও আমার কিছু করার নেই।
— আচ্ছা আচ্ছা ভাগ বসিও।
কথাটা বলে একগাল হাসলাম।
___________________________________________
কৃষ্ণ মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে বিষন্ন আকাশ। ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। সূর্যদেব তার তেজি রশ্মি নিয়ে লুকিয়ে পড়েছে পশ্চিম আকাশে গহীনে। তীব্রগতিতে বাতাস বইছে৷ ঝড় আসার পূর্বাভাস। আমি বাস স্টেন্ডে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ মুখে বিরক্তির রেশ লেগে আছে। আজও বাস আসতে লেট করছে৷ এইদিকে আকাশের অবস্থা ক্ষণে ক্ষণে খারাপ হচ্ছে। আজ বাসায় পৌঁছাতেও পারবো কি না কে জানে। আমি যখন এইসব ভাবছি তখন হর্ণের আওয়াজ কর্ণধারে এসে বারি খায়। সাথে সাথে আমার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে দেখি একটা কালো রঙের বাইক আমার থেকে এক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। তার উপর একজন হেলমেট পরিহিত মানব। গায়ে ফরমাল ড্রেস। আমি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে বাইকওয়ালার দিকে তাকাতেই সে নিজের হেলমেট খুলে নেমে পড়ে। তাকে দেখা মাত্র আমি হকচকিয়ে যাই৷ এই মানবটিকে এই মুহূর্তে আমি এইখানে মোটেও আশা করি নি। আমি চোখ নামিয়ে নেই। এরই মাঝেই সেই জলজ্যান্ত মানবটি আমার সামনে এসে মিষ্টি কন্ঠে বলে,
— মিস দর্পণ কি বাসের জন্য অপেক্ষা করছে?
আমি সাদের কথা শুনে চোখ তুলে তাকাই। আমি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,
— তা নয়তো দেখে কি মনে হচ্ছে?
— মনে তো হচ্ছে যে, কোন এক বিষাদী কন্যা বিষাদের সাগর হতে উঠে এসে তার আপেক্ষিক দৃষ্টি আকাশে পানে স্থির করেছে। নয়নে বিষাদে আকাশকে করে তুলছে বিষন্ন।
আমি কটমট দৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকিয়ে বলি,
— আপনাকে মেনেজার না হয়ে কাব্যিক হওয়া উচিৎ ছিল।
সাদ এক গাল হেসে বলে,
— আমার বউও একই কথা বলে। আমাকে নাকি কাব্যিক হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কথাটা তো সেটা না কথাটা হচ্ছে, তোমাদের দুইজনের কথা মিললো কিভাবে? এই তুমি আমার বউকে স্টক করছো না তো?
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকাতেই সে ফিক করে হেসে দেয়। অতঃপর স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
— ওকে কুল ডাউন! আই ওয়াস কিডিং। তুমি সব বিষয় এত সিরিয়াস নাও কেন বুঝি না ভাই।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রই। কথাটা সত্যি যে আমি সকল কথা সিরিয়াসলি নিয়ে নেই। কেন যেন আমি সকলের সাথে ফ্রি হতে পারি না। মিশা আর ফ্রি হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। সকলের সাথে মিশা গেলেও ফ্রি হওয়া যায় না। সাদের বেলায়ও তাই। ভেবেই আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। এর মধ্যেই সাদ বলে উঠে,
— বাসের জন্য অপেক্ষা করছো?
আমি শীতল কন্ঠে বলি,
— হুম।
সাদ কিছু চিন্তা করে বলে,
— কিন্তু বাস আজ পাবে বলে মনে হচ্ছে না। সামনের বড় রাস্তার দিকে পুলিশ নাকি সিল করে রেখেছে। একটু পর কোন এক মন্ত্রি যাবে তাই এই ব্যবস্থা। আপাতত সেই রাস্তা দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ। সো এইসময়ে বাস আসার কোন চান্স নেই।
— আর ইউ সিরিয়াস?
— ইয়েস!
আমি এইবার চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এখন বাসায় যাব কিভাবে তাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রিকশায় গেলে বেশ টাকা লাগবে। তার উপর আমি আজ বেশি টাকা আনিও নেই৷ স্বল্প পরিমাণ টাকা এনেছি। এখন কি করবো তাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমন সময় সাদ বলে উঠে,
— তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমায় ড্রপ করে দেই?
#চলবে