#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–13
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
এয়ারপোর্টের ভেতরের কাচ ভেদ করে আলোক রশ্মি মুহিবের গায়ে এসে পড়ছে। তার পা দুটি যেন অচল হয়ে পড়েছে। গলা পিপাসায় কাঠ। তার চোখ যেন আটকে গেছে। সময় থমকে গেছে যেন! ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ডের কাটা থেমে গেছে আর নড়ছে না। সব স্তব্ধ! সব নিশ্চুপ!
পাচ-ছয় হাত দূরে একটা ফুটফুটে বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে কাচুমাচু হয়ে। পরনে হাফ প্যান্ট আর একটা লাল গেঞ্জি। পিঠে ব্যাগ আর গলায় ওয়াটার পট ঝুলানো৷
ছোট্ট বাচ্চাটা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় চারপাশে তাকাচ্ছে ভয়ে ভয়ে। যেন কোন রাক্ষস তাকে এক্ষুনি এসে খেয়ে নিবে। সেই সাথে সে পানির পটের ফিতা হাতের আঙুলে ধরে গুটাচ্ছে। ফর্সা চেহারায় অসহায়ত্বের ছাপ! বারবার ভীত চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সে।ভরসাবান কেউ নেই তার পাশে। এই ভীত চোখ কোন ভরসার হাত না পাওয়ার জন্য হয়েছে৷
মুহিবের রুহ কেপে উঠে। সে ধপাস করে মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। হাত-পা কাপছে তার। ঠোঁট কাপছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না তার। নিজের চুল টেনে ধরে সে।
সে বড় বড় করে অবিশ্বাস্য চোখে সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখছে।
একজন বিদেশী লম্বা চওড়া লোক অভিকের হাত ধরে মুহিবের সামনে এসে দাড় করিয়ে দিয়ে ইংরেজিতে কিছু বলছে।
যার কোনটাই মুহিবের মাথায় ঢুকছে না। সে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বেশ শব্দ বা আর্তনাদ করে বলে ,জুই,,,,
অভিক তার মায়ের নাম শুনে চোখ তুলে তাকালো সামনে হাটু গেড়ে বসে থাকা লোকটার দিকে৷ এর আগে কোন দিন অভিক তাকে সরাসরি দেখেনি। কিন্তু তাকে চেনে। মাম্মার রুমে ওনার একটা ছবি আছে। মাম্মা তাকে বলেছে, উনি তার পাপা হয়৷কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকে না। অভিক চেনে তাকে।
অভিককে নিয়ে আসা ভদ্রলোক মুহিবের কানের কাছে গিয়ে ফটাফট ইংরেজিতে বলল, জুই আর নেই। এখন থেকে তোমাদের সন্তানের দায়িত্ব কেবল তোমার। টেক কেয়ার অফ হিম। গুডবাই মিস্টার সারওয়ার।
মুহিব মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছু উৎসুক জনতা মুহিবের আশেপাশে দাঁড়িয়ে গেছে।কি হচ্ছে তারাও জানতে চায়!
মুহিবের চোখ ফেটে কান্না আসতে চাচ্ছে৷দিশেহারা অবস্থা তার। অভিক গুটি গুটি পায়ে তার সামনে এলো।
ভদ্রলোক মুচকি হেসে দ্রুত পা চালিয়ে চলে যান।
মুহিব যেন থমকে গেছে। তার চারপাশ ঘুরছে। জুইয়ের চেহারা ভেসে ওঠে মাথার ভেতরে। সে খামোশ হয়ে বসে থাকে। ওঠার শক্তি নেই তার। কথা বলার শক্তি ও নেই তার।
অভিক দারুণ বিষ্ময় নিয়ে বাবাকে দেখে যাচ্ছে। এলবার্ট আংকেল তাকে বলেছেন, সে বাবার কাছে ঘুরতে যাচ্ছে৷ মাম্মা অনেক ক্লান্ত। এইজন্য অনেকদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছে। ঘুম ভাংলেই সে আবার চলে যাবে৷ ভ্যাকেশনে এসেছে সে।কিন্তু অভিক বুঝে পায় না, মাম্মা তো বেশীক্ষণ ধরে ঘুমায় না! সারা দিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে! সারাদিন কাজ করে জন্যই কি সে ক্লান্ত?
অভিক বেশ ভয় পাওয়া গলায় করুন ভাবে পাপা বলে ডাক দিলো৷
ওমনি মুহিব সব ভুলে গিয়ে অভিককে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে। কেমন যেন অস্থির-অস্থির লাগছে তার।
মুহিব বেসামাল পায়ে অভিককে নিয়ে বের হলো। ড্রাইভিং সিটে বসে কাপা হাতে গাড়ি স্টার্স্ট দেয়। হাত কাপছে তার। পা কাপছে, বুক কাপছে। বারবার জুইয়ের হাসিমুখ তার চোখে ভাসছে! তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না, জুই আর নেই!
মুহিব ভুলভাল ড্রাইভিং করতে লাগে৷ হুট করে বিকট শব্দে সামনে থাকা প্রাইভেট কারের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়। মূহুর্তের মধ্যে হৈচৈ পড়ে যায়।
ঢাকাবাসী রাস্তায় হওয়া যতো ধরনের ঝামেলা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে আনন্দ পায়, এক গাড়ি আরেক গাড়িকে মেরে দিলে।
সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ আসলো। মুহিব ফোস করে একটা দম নিয়ে বের হলো।
যে গাড়িতে সে হিট করছে, সেই গাড়ির মালিক ঝগড়া শুরু করে তাকে দেখেই। মুহিব যেন থেকেও নেই! কি হচ্ছে, কি বলা হচ্ছে কিছুই তার আয়ত্ত্বে নেই। সে ঘোরের মধ্যে আছে।
হুট করে মুহিব রাস্তায় বসে পড়ে৷ এতে অনেকেই অবাক হয়। এবারে সকলের মধ্যে একটা নরম অনুভূতি জাগ্রত হলো৷
একজন বলে উঠে, অসুস্থ নাকি ভাই?
মুহিব ঠায় মাথা নিচু করে বসে আছে। তার চোখে সেজুতির চেহারা ভাসছে। অদূর ভবিষ্যতে কি হবে তার? সব পেয়েও সবই হারাতে হবে কি তাকে? নিয়তি এ কোন খেলায় মেতেছে তাকে নিয়ে?
ট্রাফিক পুলিশ ফাইনের কাগজ মুহিবের হাতে দিয়ে দিলো। তিন হাজার টাকা ফাইন কষেছেন। অন্য দিন হলে কৈফত চাওয়া হত কেন এতো টাকা ফাইন দিবে। কিন্তু আজ নিরব সে।
সে একবার চোখ বুলিয়ে চারপাশে তাকালো। ভীড় জমে গেছে।
মুহিব উঠে দাড়ালো। তাকে তো উঠতেই হবে। এটা কেবল এক ঘূর্ণিঝড় ছিলো। এখনো মহাপ্রলয় বাকি আছে।
কাপা হাতে আবারো ড্রাইভিং করতে লাগলো।।
অভিক ভারী অবাক হচ্ছে৷ কাচের জানাল দিয়ে যাই দেখে তাতেই অবাক৷ একটা জায়গা এমন ও হতে পারে?
যেখানে-সেখানে ময়লার স্তুপ। এতো গাড়ি, বাস। বাস গুলো দেখতে একদম ই সুন্দর না! ছোট ছোট খুপরির মতো সবুজ রঙের গাড়ি। কেমন জানি সবকিছু! আবার তিন চাকার কি যেন একটা করে মানুষ যাচ্ছে। নাম কি এই যানের? আর এতো ময়লা কেন চারিপাশে? এতো মানুষ ই বা কি করছে এখানে? আকাশের দিকে তাকালো সে আকাশের আগে কারেন্টের তার নজরে এলো। বিল্ডিংগুলো দেখতে মোটেও সুন্দর না! পাপা থেকে থেকে গাড়ি থামাচ্ছে। তার সঙ্গে সবাই গাড়ি থামাচ্ছে।
অভিকের মনে প্রশ্ন জাগল , একটু পর পর সবাই গাড়ি থামাচ্ছে কেন? আর এতো মানুষ কোথা থেকে এলো? আজকে কি এই শহরে কোন প্রোগ্রাম হতে চলেছে?
সে পানির ফ্ল্যাক্স থেকে পানি ঢক ঢক করে খেয়ে নিলো।
★★★
সেজুতি একমনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজের জেদের সাথে আর পারেনি। শ্বশুড়বাড়িতে আসতে হয়েছে তাকে। আপা আর দুলাভাই আজকে ঢাকা যাচ্ছে।সেজুতির সঙ্গে আপার দেখা করতে আসার কথা দুপুরের পর পর। সেজুতি আপার জন্য রান্না করে অপেক্ষা করছিলো। একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটে গেল। আপার সঙ্গে মনোয়ার আক্তার ও এলো। উনি এর আগে শেষ বোধহয় আপার বিয়ের পর পর এসেছিল। এরপর আর আসেনি। আজ কি এমন হলো যে মনোয়ার আক্তার স্বয়ং এসেছেন।
পরবর্তীতে বোঝা গেল, উনি এসেছেন সেজুতিকে সাথে নিয়ে যেতে। এবারে আর জেদ দেখাতে পারল না সে। ফিরে এসেছে। মুহিব কি জানে সে এই বাড়িতে ফিরে এসেছে?
ভর সন্ধ্যা এখন। আযান শেষ হয়ে গেছে৷ নামাজ পড়েই বারান্দায় দাঁড়িয়েছে সে।হুহু করে বাতাস বইছে। আজকে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। রাত এগারোটা অব্দি জেগে থাকতে হবে। আপাকে বিদাই জানাতে হবে৷ আপারা এখান থেকে ঢাকা যাবে। এরপর পর দিন চেন্নাইয়ের জন্য ফ্লাইট।
সেজুতি রুমে আসতেই ইমা রুমে হুড়মুড় করে ঢুকে। সে মৃদ্যু হাসলো। এই বাসায় কারো সঙ্গে যদি মন খুলে কথা বলা যায় তাহলো ইমা। খুব হাসি-খুশি মেয়ে সে। কথায় কথায় হাসে। সাজতে বড্ড পছন্দ করে। সেদিন বৌভাতে তার চেয়ে বেশি সেজেগুজে হাজির হয় সে!
সেজুতি বলে উঠে, কেমন আছো ইমা?
ইমা এক গাল হেসে বলে, খুব ভালো আছি।
বড় ভাবীকে একগাদা লিস্ট ধরায় দিলাম।
সেজুতি হাসল। ইমা নাকি খুব আদুরে। এই কথা শুনেছে সে লোকমুখে। কিন্তু সেজুতির মনে হয় তার শ্বাশুড়ি মুহিবকে বেশী ভালোবাসে। সারা দিন আব্বা আব্বা করে!
রাত বাড়তেই সকলে একসাথে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফেলে। আপাকে বেশ খুশিই লাগছে। আপা, দুলাভাই রেডি হয়ে সবার কাছ থেকে বিদাই নিচ্ছে৷
মনোয়ারা আক্তার ছেলের মাথায় হাত বুলালো। যাওয়ার আগে আপা শ্বাশুড়ি মাকে সালাম দিয়ে একটু কান্না করল। বিদায় বেলা কান্না করা আপার স্বভাব৷
আপা সেজুতির কাছে এসে নাক টেনে বলে উঠে, যাই রে সেজু৷
সেজুতি হাসি মুখ করে আপা কে জড়িয়ে ধরে বলে, কেন যেন মনে হচ্ছে এবার আল্লাহ সহায় হবে৷
শোভা আপা বলে উঠে, আল্লাহ ভরসা।
চলবে।