আঠারো বছর বয়স পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
5016

#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩২

সারা বাড়িতে হৈচৈ। নাদিরা, ইভা এদিকওদিক ছুটাছুটি করছেন। সবাই ব্যস্ত। রুহিকে সাজিয়ে দিয়ে পার্লারের মেয়েরা ওর কয়েকটা শুট নিলো। আত্মীয়স্বজনরা বিভিন্ন কথাবার্তা বলে হাসাহাসি করছে। লজ্জ্বায় মাঝেমধ্যে রুহি নুইয়ে যাচ্ছে। অফ হোয়াইট রঙের শাড়ি, সোনার গহনা আর ব্রাইডাল সাজে ওকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। একসময় বর এলো। রুহির সাথে মিল রেখে বিভোরের পরণেও অফ হোয়াইট শেরওয়ানি। চোখে মাঝারি পাওয়ারের চশমা। পেছনে বাবর চৌধুরী আর নাসিমাকেও দেখা যাচ্ছে। বরযাত্রীদের মাঝে রতনকেও দেখা যাচ্ছে৷ খুবই পরিচ্ছন্ন পোশাক ওর,নীল রঙের সানগ্লাস চোখে।

রুহিকে ইভা আর কয়েকটা মেয়ে নিয়ে এলো। বিভোর ওর রক্তজবার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। এত সুন্দর দেখাচ্ছে কেন ওর জবাটাকে? হাউ কি…
রুহিকে ওর পাশের চেয়ারে বসানো হলো। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুহি লজ্জ্বা পেয়ে গেলো। তার ডাক্তারবাবুকে রাজপুত্রের চেয়ে কম কিছু লাগছেনা। লোকটা এতো ফর্সা কেন? আর বিয়ের দিন অন্তত চশমাটা না পরাই ভালো ছিল। অবশ্য এতেই ওকে দারুণ লাগছে। চারদিক থেকে হাততালি আর ফটোশুটের শব্দ কানে আসছে। বিভোরের ধ্যান কাটতেই সবার আগে জিজ্ঞেস করল,

‘খেয়েছ?’

রুহি এই সময়ে এ কথা বলায় অবাক হয়ে গেলো। বলল,

‘না।’

‘না মানে?’

‘খাইনি!’

বিভোর রাগী গলায় বলল,

‘না খাইয়েই পাঠিয়ে দিলো? ওরা জানেনা তুমি অসুস্থ?’

‘ওফ। এখন কি খাবার সময় নাকি?

‘অদ্ভুত তো।’

রুহি মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। খাবারের কথা শুনতে ওর প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। বিয়ের সময় কেউ কি এই কথা বলে? আর শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গেলে না জানি এই চাশমিশ ডাক্তার ওকে খাইয়ে খাইয়ে মেরেই ফেলবে। বাবর চৌধুরী আর নাসিমা রুহির কাছে এলেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ভালো লাগছে তো? নাকি শরীর দুর্বল?’

‘না না। আমি ঠিক আছি।’

‘আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। বেশি দেরি করবোনা। ঘরের মেয়ে এবার ঘরেই ফিরে যাবে।’

বাবর চৌধুরীর কথায় আলতো হাসলো রুহি। তারপর রতন, দারোয়ান একে একে সবাই এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলো। ছবিটবি তোলা শেষে সবার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। অতঃপর
ধীরেসুস্থে খুব ভালোভাবেই ওদের বিয়ের কার্য সম্পন্ন হলো। বিভোর সবার মাঝখানেই চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘আব্বু, আমার একটা বউ আছে।’

ওর কথায় উপস্থিত সবাই হেসে ফেললো। বিদায়ের সময় রুহিকে নানান উপদেশ দিলো নাদিরা। রুহি কেঁদে ফেললো। বিভোর বলল,

‘কাঁদার কি আছে?’

বাবর চৌধুরীর চোখেও পানি। ছেলেকে ধমকে বললেন,

‘তুই কী মেয়ে? তুই হলি গোরু। তুই মেয়ে আর মায়ের কষ্ট বুঝবিনা। তাই চুপ থাক।’

বিভোর মুখ কালো করে বলল,

‘তুমি কী বোঝ?’

‘একদম চুপ। সিরিয়াস মোমেন্টে আমার মেজাজ খারাপ করাবিনা, এখানেই রেখে যাব বলে দিলাম।’

সবাই চুপ। এবার গাড়িতে উঠার পালা। রুহি একবার তার প্রিয় মানুষগুলো আর বাড়িটার দিকে তাকালো। নিরবকেও দেখতে পেলো ভিড়ের মাঝে। হাত নাড়িয়ে হাসিমুখে বিদায় দিলো। এই সাদাসিধা দোতলা বাড়িটা, গেইটের কাছে বাগানবিলাস আর লনের শতশত ফুলেরা সবাই রুহির যেন কত আপন। নিজের আত্মীয়-পরিজন কেউ আজ পাশে নেই। অথচ একদল অচেনা – অজানা মানুষ ওকে কতটা ভালোবাসে, নিজেদের মধ্যে ওর একটা অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে। বাবা-মায়ের কথা মনে হতেই ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। দশ দশটা বছর আগে ওরা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছে। ওরা থাকলে আজ কতোটা খুশি হতো বলার বাইরে। খুব ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে, আহারে! ওর মা রুপসা। কত কষ্ট পেয়েছিলো বিয়ের পর, সুখে পড়ার পরে সেটা আর টিকলোনা। রুহি একবুক কষ্ট আর নতুন জীবনের স্বাদ নিতে আজ অন্য একটা ঘরে চলে যাচ্ছে। জানেনা, কতটুকু দিয়ে সবাইকে আগলে রাখতে পারবে। তবে বিভোরের বাবা-মা যে ওকে প্রচন্ড ভালোবাসে সেটা ওদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। বিভোর রুহির হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে নিজের মুঠোয়। এই একটা মানুষ, যাকে সে কিশোরী বয়স থেকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে!

তখন এক ক্লান্ত সন্ধ্যে। রাস্তাঘাটে তেমন গাড়ি নেই। খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলো বিভোরদের বাড়িতে। নাসিমা বরণ করলো ওদের। নতুন সংসারে পা রাখতেই রুহির মনে হচ্ছে এটা এখন থেকে ওর সংসার। ড্রয়িংরুমে বসে সবাই আড্ডা দিলো। বয়স্ক মহিলারা বিভিন্নধরনের কথা বললো। কীভাবে সবার সাথে চলতে হয়, সবকিছু। নাসিমা বললেন,

‘আমার মেয়েকে এসব শেখাতে হবেনা, সবই জানে ও।’

একজন বলল,

‘তবুও বলে রাখলাম। শ্বশুরশ্বাশুড়িকে আজকাল ছেলের বউয়েরা দেখতেই পারেনা।’

আরেকজন ফোড়ন কাটলো,

‘প্রথম ক’দিন সব বউই ভালো। ধীরেধীরে আসল রুপ দেখা যায়। সুন্দরী বউ থাকলে ছেলেরাও বাপ-মা ভুলে বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকে।’

ফ্রেশ হয়ে এসেই বাবর চৌধুরী কথাটা শুনতে পেলো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমার গোরুটা এতবছর হয়েছে বিয়ে করেছে, বুঝলেন? কোনোদিন মনে হয়েছে ও বউয়ের জন্য পাগল? বউ তো সুন্দরই।’

‘না দেখিনি। আপনার ছেলে তো লুকিয়ে রেখেছিলো বউকে।’

‘লুকিয়ে রাখেনি৷ সে অনেক কথা আস্তেধীরে জানতে পারবে। বলি কী আমার মেয়েটা ওমন নয়। তাই ওকে প্লিজ এসব বলোনা। বেচারি বিব্রতবোধ করছে।’

‘এসব জানাতো দরকার। আমাদেরই তো শিখাতে হবে।’

‘ভুল করলে শিখাবে একশোবার। এখন ছেড়ে দাও, বেচারি ভাববে কি আমাদের!’

রুহি ক্ষীণকন্ঠে আলতো হেসে বলল,

‘আমি কিছু মনে করিনি। আমাদের গ্রামেতো নতুন বউদেরকে আরও বেশি করে সব বলা হয়। যাতে সেসব মেনে চলে।’

নাসিমা বললেন,

‘আচ্ছা থাক৷ সবাই ফ্রেশ হয়ে নাও। রুহিমা আমার সাথে এসো!’

‘জি আম্মু!’

_____

রজনীগন্ধার উষ্ণ সুবাসে চারদিকে মাদকতা ছড়িয়ে পড়েছে। একটা শুভ্র সাদা শাড়িতে বাসর ঘরে বসে আছে রুহি। মুখে কোনো প্রসাধন না থাকা স্বত্ত্বেও ওকে দেখতে ভীষণ মায়াবী লাগছে। লম্বা চুলগুলো খোঁপা করা। সেই খোঁপায় বেলীফুলের মালা জড়ানো। ঘরটাতে রুহি ছাড়া কেউ নেই। ওকে বসিয়ে দিয়ে সবাই চলে গিয়েছে। আসার পর বিভোরকে একবারও দেখেনি ও। ঘড়ির কাঁটা বারোটায় পৌঁছোতেই ঘরে এলো বিভোর। দরজা লাগানোর শব্দে রুহি চমকে উঠলো। বিভোরের গায়ে সাদা পাঞ্জাবী। কি চমৎকার দেখাচ্ছে ওর ডাক্তারবাবুকে। সোজা ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

‘খাওয়া হয়েছে?’

রুহি বিরক্ত গলায় বলল,

‘হুম।’

‘আম্মু বললো ভালো করে খাওনি, তাই এটা পাঠিয়েছে।’

রুহি অবাক হয়ে বলল,

‘এটা কী?’

‘সুপ। চলো হা করো, আমি খাইয়ে দিই।’

রুহি মনে মনে ভাবলো দুইপ্লেট বিরিয়ানি খাওয়ানোর পরেও কীভাবে ও খায়নি? হাউ? বিভোরের ধমক শোনার ইচ্ছে নেই বিধায় চুপচাপ খেয়ে নিলো। অর্ধেকটা শেষ করে বলল, ‘আর না প্লিজ। আমি এবার মরেই যাবো।’

আর জোর করলোনা বিভোর। হাফ ছেড়ে বাঁচলো রুহি। হাতমুখ ধুয়ে সবকিছু গুছিয়ে বিভোর রুহির দিকে তাকালো। আরে, রুহানিকে শুভ্র শাড়িতে পরীদের মতো দেখাচ্ছে৷ ডানা থাকলেই চলতো। রুহি বলল, ‘কী?’

‘কিছুনা। ঘুম পেয়েছে?’

‘না, আপনার?’

‘উহু, আমার ঘুমাতে দেরি হয়। মানে অভ্যাস নেই আরকি, প্রতিরাতেই কাজ করি যে।’

‘ওহহ।’

এভাবেই বিভিন্ন কথা বলে গল্প করতে থাকে দুজন। একপর্যায়ে রুহি খেয়াল করলো বিভোর ওকে রুহানি বলেই ডাকছে। তাই জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনি আমাকে রুহানি ডাকছেন?’

‘হুঁ। কেন?’

‘আপনি তো আমার নাম ধরে ডাকেন না!’

‘ডাকলাম আরকি।’

‘আপনি আমায় রক্তজবা বলেই ডাকুন। মনে আছে আমাদের বিয়ের পর গ্রাম থেকে ফেরার পথে আপনি কতগুলো ফুল দিয়ে আমার খোঁপা সাজিয়ে দিয়েছিলেন? অদ্ভুত… ‘

বিভোর উঠে রুহির খোঁপা খুলে দিতেই পিঠ ভাসিয়ে এলো চুল ছড়িয়ে পড়লো। হেসে বলল,

‘আজও সাজিয়ে দেবো!’

রুহির চুলে কোথা থেকে নিয়ে আসা কয়েকটা জবাফুল লাগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আহা। দারুণ।’

‘বুঝলাম। রক্তজবা বলে ডাকবেন না?’

বিভোর রুহির জোড়াজুড়িতে একসময় বলতে বাধ্য হলো যে কেন এই নামে সে আর ডাকেনা। রুহি হেসে ফেললো ওর বোকা কান্ডকীর্তিতে। আচমকাই
বিভোর রুহির কোলে মাথা রাখলো। কোনো এক অপরাধবোধ তার চোখেমুখে ফুটে উঠে। গাল বেয়ে নামে অশ্রু। অন্যরকম কন্ঠে বলে উঠে,

‘অনেক আগে থেকেই তুমি শুধু আমার। শুধু আমি তোমাকে কাছে টেনে নিইনি। আমাকে ক্ষমা করে দিও, অনেক কষ্ট পেয়েছো এতদিন তাইনা? এখনো এসব মনে পড়লে নিজের প্রতি রাগ হয় আমার। ক্ষমা করে দিয়েছো তো মন থেকে আমায়? সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে তুমি তো আমাকে পাগলই বানিয়ে দিয়েছিলে। বলো, আর কক্ষণো ছেড়ে যাবেনা? বলো রক্তজবা….’

রুহি মাথা নাড়ায়। বিভোর আলতো করে হাসলো। রুহির লাল হওয়া গালদুটো টেনে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

‘এই রক্তজবার লাল নাকটাকে আমায় দিয়ে দাও। ওর হৃদয়টাও। চোখমুখ,হাত-পা সবকিছু! আমি সারাজীবন আগলে রাখবো রক্তজবাটাকে। কী দেবে তো?’

এমন মর্মস্পর্শী আবেদন আর এতো আকুলতামাখা কন্ঠ শুনে অজান্তেই রুহির বুকে তোলপাড় শুরু করলো। দু’চোখে নেমে এলো এক সমুদ্র অশ্রুধারা। বিভোর অপলক নেত্রে পর্যবেক্ষণ করছে তার রক্তজবাকে। দীর্ঘক্ষণ নিরবেই কেটে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিভোর গম্ভীর অসহায় চোখে তাকালো রুহির দিকে। নির্বিকার নয়নে চেয়ে থেকে বলে,

‘রক্তজবা..তোমাকে আমার করে নিতে দেবে? চিরদিনের জন্য? চিরকালের জন্য…..’

নোনা জলে সিক্ত রুহির গাল। বিভোর তা মুছে দিলো। কোনো মানুষের কথায় এতো প্রাণশক্তি থাকতে পারে? এতো গভীর হয় কোনো আবেদন? রুহির মনে বহুদিনের এক অতৃপ্ত তৃষ্ণা শীতল হয়ে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে। বিভোর ওর রক্তজবাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। আজ আর কোনো বাঁধা নেই। নেই কোনো অভিযোগ, অভিমান। এক নিদারুণ স্নিগ্ধ নিরবতা। দুটো হৃদয়ের এক হওয়ার সময়। রুহির গলায় আলতো চুমু দেয়, ঠোঁট ছোঁয়ায় রুহির অধরজোড়ায়। চারদিকে তখন নেমে আসে ঝাপসা আঁধার। কোথা থেকে যেন ভেসে আসে সুললিত মায়াময় সুরের মূর্ছনা। সেই সুর যেন রুহির খুব চেনা, বারবার প্রতিধ্বনিত হতে হতে শূন্যে মিলিয়ে যায়। কানে বাজে বাতাসের গান।
অদৃশ্য ইঙ্গিত সকল সংশয় দূর করে বিভোরকে বুঝিয়ে দিলো ওর রক্তজবা শুধুই তাঁর। পুরোটাই তাঁর….

অসমাপ্ত…..সমাপ্ত

ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। আমি জানি খুব অগোছালো হয়েছে, আসলে অনেক কাঁচা হাতের লেখা তাই। অনেক কিছুই হয়তো বাকি রয়ে গিয়েছে….সমাপ্ত