নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-১২

0
6169

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_১২||
;
;
;

সন্ধ্যার পর থেকে শনশন করে ঝড়ো হাওয়া বয়ে চলা শুরু হয়েছে। আকাশ জুড়ে কালো কালো মেঘের আনাগোনা পরিবেশটাকে আরো বেশি ছমছমে করে তুলেছে। কিছুক্ষণ পর পর মেঘের গুড়ু গুড়ু ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কালো আকাশ চিরচির করে ফেটে আলোর ছটা দেখা দিচ্ছে।

একটা অন্ধকার ঘরের ফ্লোরে হাত-পা বাধা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে হিমকে। ডাঙায় থাকা মাছের মতো ছটফট করছে সে। হঠাৎ মাথার ওপর থাকা হিটেড বাল্বটা জ্বলে ওঠে হলুদ আভা ছড়াতে লাগলো। দরজা-জানালা পুরোপুরি বন্ধ থাকায় হিটেড বাল্বের তাপে সারাশরীর দরদর করে ঘামছে হিমের। ঘরের ভেতরে তিনজন ব্যক্তি ঢুকে দরজাটা আবার লাগিয়ে দিলো। তিনজনেরই সারা শরীর কালো পোশাকে আবৃত। দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা লিডার গোছের ব্যক্তিটা হিমের সামনে হাটু মুড়ে বসে ওর চোয়াল চেপে ধরে মুখ উঠিয়ে বললো,
—“হোয়াট’স আপ, ম্যান? আমার ডার্ক হাউসের ওয়ার্ম হসপিটালিটি কেমন লাগছে, ব্রো?”

হিম জোরে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
—“কে আপনি? আমার সাথে আপনার কিসের শত্রুতা? কী বিগড়েছি আমি আপনার?”

লোকটা সারাঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হাসতে লাগলো। সেই ভয়ংকর হাসি হিমের কলিজায় যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে কঠিন গলায় বললো,
—“আমার প্রোপার্টিতে হাত লাগিয়ে বলছিস কী বিগড়েছিস? তোর খাতিরযত্ন তো দেখা যায় ভালোভাবেই করতে হবে। ”

হিম অবাক হয়ে বললো,
—“প্রোপার্টি? কিসের প্রোপার্টি? ”

—“ফাহমিদা আহমেদ মুন। শি ইজ ওয়ান এন্ড ওনলি মাই প্রোপার্টি। আর ওর দিকেই তুই হাত বাড়িয়েছিস। শুধু হাত বাড়িয়েই ক্ষান্ত হসনি, তুই ওকে স্পর্শ করেছিস!!”
বলেই হিমের চোয়াল জোরে চেপে ধরে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেললো। উঠে দাঁড়িয়ে জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
—“তোমরা দুজন, ওকে ভালো করে খাতিরদারি করবে আর মাথার ডান ও বাম সাইডে এমনভাবে আঘাত করবে যেন আগের কোনো স্মৃতি মনে না থাকে।”

পেছনে থাকা দুই ব্যক্তি একসাথে বলে উঠলো,
—“ওকে স্যার। ”

লোকটা দরজা বাইরে পা রাখতে যাবে, এমন সময় আবার ওয়ার্নিং দিয়ে বললো,
—“বি কেয়ারফুল। ও যাতে মরে না যায়। জাস্ট কোমায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবে।”
বলেই আর উত্তরের আশা না করে হনহন করে বেড়িয়ে গেল।
____________________

রাদিফ ফোন দেওয়ার পর থেকেই মনের ভেতর চাপা ভয় আর উত্তেজনা দুটো একসাথে কাজ করছে। অনিতা, রুহি, অর্ণবও ফোন করেছে। সবাই শুধু বলছে দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে, কোনো খারাপ কিছু ঘটার আর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার মনে এখন শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। হিমকে গুম করলো কে? উপরমহল থেকে কেউ একজন হিমকে ছাড়িয়েছে বুঝলাম। কিন্তু যা ঘটেছে তা তো আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের বাইরে কেউ জানে না! তাহলে কে আছে এর পেছনে? কেউ কি আমায় ফলো করছে? সবকিছু কেন যেন একদমই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। অনেক বড় রহস্য লুকিয়ে আছে; আমার আড়ালে এমন কিছু ব্যাপার আছে যা আমার অজানা।

—“এতো চিন্তা করে লাভ নেই। তোমার ঐ ছোট মাথায় এতো প্রেশারাইজ করার কোনো যৌক্তিকতা আপাতত খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”

আমি হকচকিয়ে গিয়ে পেছনে ঘুরে তাকালাম। জয় আমার পাশে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“এই অসময়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানেই হয় না। দেখেছো আকাশের কী অবস্থা? ভালোই ঝড়-বৃষ্টি হবে আজ।”

ওনার কথা আমার কান পর্যন্ত গেলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত গেল না। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
—“আপনি একটু আগে কী বললেন? আমি কিছু নিয়ে চিন্তা করছি এটা আপনি কীভাবে বুঝলেন? ”

জয় অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বললো,
—“একজন মানুষ কখন চিন্তার মধ্যে থাকে, কখন কষ্টে থাকে বা কখন আনন্দে থাকে ; এটা বোঝার জন্য আমার সিক্সথ সেন্সই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। তুমি কী নিয়ে এতো চিন্তা করছো তা আমি জানি না। তবে এটা জানি, তোমায় জিজ্ঞেস করলেও আমাকে কিছু বলবে না।”

আমি অন্ধকারে ঘেরা নিঃস্ব আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“সবকথা সবাইকে বলা যায় না। কিছু কথা এমন হয়, যা শুধু তাদেরই বলা যায় যাদেরকে নিজের খুব আপন বলে মনে হয়, যাদেরকে বিশ্বাস করা যায়। আমাদেরকে এটা মনে রাখতে হবে যে, একবছর পর আমাদের সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। তখন না আমি আপনাকে চিনবো, না আপনি আমাকে। তাই অযথা আপন বানিয়ে, বিশ্বাস করে এবং মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। এসবে শুধু কষ্টই পেতে হয়।”

মুনের বলা কথাগুলো যেন জয়ের মনে তীরের মতো বিঁধছে। কী ভয়ংকর শোনালো কথাগুলো! তার মানে কি ও আমার থেকে মুভ অন করার চেষ্টা করছে? হুম সেটা করলেই ভালো। তবে আমার কেন এমন মনে হচ্ছে যে, আমি কিছু হারিয়ে ফেলছি? আমার মাথায় সবকিছু কেন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে?

—“চলো ভেতরে! এখানে দাঁড়িয়ে আর কাজ নেই। ”

—“আপনি যান, আমি একটু পরে আসছি।”

—“আমি বলছি এখন যেতে। সো, এখনি চলো।”

—“আজিব তো! আপনি ভেতরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে এমন জোর করছেন কেন? ”

—“বুঝেছি, সোজা আঙুর ঘি উঠবে না।”

বলেই জয় আমাকে কোলে তুলে নিল। আমি অক্ষিগোলক ইয়া বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বললাম,
—“আরে, আপনি আমায় কোলে কেন নিলেন? নামান বলছি।”

জয় আমার মুখের কাছে মুখ রেখে বললো,
—“তোমায়ই কতো বার বললাম, শুনলে না। আর আমি নামানোর জন্য তো কোলে তুলিনি! ”
বলেই বাঁকা হাসলো।

আমি হাত-পা ছুটোছুটি করতে করতে বললাম,
—“তাই বলে কোলে কেন নিলেন? নামান আমায়। আপনার কোনো অধিকার নেই আমায় কোলে নেওয়ার।”

—“বললেই হলো নাকি! আমি তোমায় বৈধভাবে, ধর্মীয়ভাবে ও আইনগতভাবে বিয়ে করেছি। তাই তোমার ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকার আমার। আজ ওয়েদারটা দারুণ, তাই না? সব কাপলরা এখন এটার ফায়দা লুটছে। তাই আমি ভাবছি, আমরাও স্পেশাল মোমেন্ট স্পেন্ড করবো।”

—“এই না না। এমনটা তো কথা ছিল না। আমি আপনার নামে মামলা করবো।”

জয় হাসতে হাসতে আমায় রুমে নিয়ে গিয়ে বেডে বসালো ও খাবারের ট্রলিটা আমার সামনে রেখে নিজেও একটা নিয়ে আমার অপজিটে বসলো।
তারপর প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বললো,
—“কী মামলা করবে আমার নামে শুনি? তোমার কি মনে হয় আমি এতোটাই খারাপ যে বিয়ের অধিকার দেখিয়ে এডভান্টেজ নিবো?”

আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
—“আপনি যেভাবে বলছিলেন, আমি তো সেটাই মনে করেছিলাম।”

—“হুম, আর মনে করা লাগবে না। খাও এবার।”

ডিনার শেষে আমি সোফায় শুয়ে আছি আর জয় বেডে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় দুটো বাজে। কালতো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুম দিয়েছিলাম কিন্তু আজ তো খাইনি। এতো রাত হয়ে গেছে আমার একটুও ঘুম আসছে না।

—“আচ্ছা মুন, একটা কথা বলি?”

আমি কেঁপে ওঠে জয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি ওনি শুয়ে শুয়েই আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে।

—“আপনি এখনো ঘুমাননি?”

জয় বিরক্ত হয়ে বললো,
—“আমি তোমায় আগে প্রশ্ন করেছি, রাইট? তুমি আনসার না দিয়ে উল্টো আমায় প্রশ্ন করছো? বলো, তোমায় একটা কোয়শ্চন করতে চাই, আনসার দিবে কি না?

—“আমার উত্তর জানা থাকলে অবশ্যই আনসার দিবো। বলুন কী জানতে চান?”

—“তুমি কাকে ভালোবাসো?”
ওনার প্রশ্ন শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। এটা কোনো প্রশ্ন হলো। কাউকে ভালোবাসি কি না এটা জিজ্ঞেস না করেই ডিরেক্ট কাকে ভালোবাসি!
—“দিস ইজ আ ভেরি উইয়ার্ড কোয়শ্চন, জয়। আমি কাউকে ভালোবাসি কি না সেটা আপনার আগে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। ”

আমায় অবাক করে দিয়ে ওনি বললেন,
—“আমি জানি, তুমি একজনকে ভালোবাসো। তাই ডিরেক্টলিই নাম জানতে চাইলাম।”

আমি উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে পড়ে বললাম,
—“আমি কাউকে ভালো-টালো বাসি না। তাই এসব আজাইরা প্যাচাল বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।”

জয় মনে মনে বললো,
—“তার মানে আমি ধরে নিব যে, আমার ধারণাই ঠিক? তুমি কি তাহলে সত্যি সত্যিই মুভ অন করছো?”

-চলবে………..