গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ
৬.
শ্যামলকে প্রশ্ন করে, ‘ এই পীর সাহেব কে? আর উনি ই বা কি করেছেন? সবকিছু বিস্তারিত বলুন।’
শ্যামল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বুঝাই যাচ্ছে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে সে অনিচ্ছুক। কিন্তু অনিহা থাকলে কি হবে তাকে তো বলতে হবে। প্রায়ই দৈনন্দিন জীবনে অনিচ্ছুক জিনিস নিয়েও চর্চা করতে হয়। সেসব হয় বাধ্যতামূলক। শ্যামলের জন্যও বাধ্যতামূলক। কিছু সময় চুপ থাকলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ পীর সাহেব, এক কলুষিত ব্যক্তির নাম। যার দখলে আমার পরিবার। আমরা হলাম তার হাতের পুতুল, তিনি যেমন চান তেমন নাচান। আমরাও তালে তালে নাচি। কদিন পর তুমিও নাচবে।’
রিপা ভ্রু কুচকে তাকালো। সে ও নাচবে মানে? তার কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই অন্যের কথায় চলবে? সে রিপা, তার নিজের যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। সে কখনো অন্যের কথা ধরে চলবে না। দরকার পড়লে দুনিয়া উল্টে ফেলবে। তাতে কার কি?
শ্যামল গলা নামালো। ধীর আওয়াজে বললো,
‘ নাচতে না চাইলেও তিনি নাচাবেন। আমার মা পীর ভক্ত। ভক্ত নয়, অন্ধভক্ত। অন্ধ ভক্ত চিনো? যারা সম্পূর্ণ স্বরবর্ণ না জেনে শুধুমাত্র অ,আ জেনে লাফায়, হুদাই চিল্লাফাল্লা করে তাদেরকেই অন্ধভক্ত বলে। উনার মতে পীর সাহেব যদি হাঁচি দেন সেটারও কারণ থাকে। তিনি যদি বলে পানিতে ডুব দিয়ে নিঃশ্বাস আটকে বসে থাকতে তাহলে মা সঙ্গে সঙ্গে তা করে ফেলবেন। জানেন, আমার মা এবং ভাবীর সমস্ত গয়নাগাটি উনার দখলে, এমনকি আমাদের বাড়ী টাও। ‘
রিপা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। এ যুগেও এমন মানুষ হয়? হয়, হয় নাহলে তার শাশুড়ির দেখা কি পেতো? কিন্তু মানুষ এ লেভেলেরও অন্ধ ভক্ত হয়? কৌতুহলের সুরে প্রশ্ন করে,
‘ আপনার মা কি এত অবুঝ? ঘরবাড়ী অন্যের নামে লিখে দিয়েছেন? কিন্তু কেনো? নিশ্চই কোনো কারণ আছে, তাই না?’
রিপার মতে, কারো অন্ধ বিশ্বাসের পেছনে জোরালো কারণ থাকে। এমনি এমনি কেউ কাউকে এত বিশ্বাস করে না। নিশ্চই হৃদয় নিঙড়ানো কিছু করেছে সেজন্যই হয়তো তার মায়ের এত ভরসা। তাবিজ-তুমারে তার বিলকুল বিশ্বাস নেই। তো এটা স্বাভাবিক যে কোনো তাবিজ-ফাবিজ করে বশ করে নি। বরং তার মায়ের মনে বিশাল জায়গা করে নিয়েছে যার জন্য এত বিশ্বাস।
শ্যামলের মুখে অন্ধকার নেমে এলো। নিশ্চই কোনো দূর্বিষহ স্মৃতি মনে পড়েছে। স্মৃতিগুলো হয় বজ্জাত। যখনই কারো চোখে ভাসবে তখনই তার চোখ মুখ অন্ধকার করে তুলবে। কদাচিৎ হাসালেও পরক্ষণেই তার জন্য মনকে কাঁদিয়ে তুলে। শ্যামল বিষন্ন কন্ঠে বলে,
‘ আমার জন্মের পূর্ব থেকেই মায়ের এ ভক্তি। উনার এ ভক্তি জন্ম নেওয়ার কারণ হলো আমার ভাই। একদা আমার মা বন্ধা ছিলেন, তার কোনো সন্তান হতো না। তখন শরণাপন্ন হন এই পীরবাবার। উনার বিধিনিষেধ মেনে চলার পরের বছর ই জন্ম হয় আমার ভাইয়ের। এরপর, একে একে আসি আমি আর আমার বোন। তখন থেকে যে উনার ভক্তি তা আজ পর্যন্ত বিদ্যমান।’
-‘বলেন কি? উনার এত ক্ষমতা? ‘
-‘আরে দূর! বালের ক্ষমতা। মায়ের তখন ডাক্তারি চিকিৎসা ও চলছিলো। ডাক্তারের ঔষধ ও খেতেন। কিন্তু উনি মানেন পীরের কারণে বাচ্চা হয়েছে। কারণ ঔষধ তো এর পূর্বেও খেয়েছেন তখন সারে নি কেনো? আরে ভাই, ঔষধ কি সাথে সাথে কাজ করে? এসব ঔষধের সময় লাগে। অনেক ঔষধ আছে যেসব ধীরে ধীরে কাজ করে,আবার অনেক ঔষধ দ্রুত। কিন্তু আমার মা কে তা বুঝানো কারো কি সাধ্যে পড়ে?’
শ্যামলের চোখ লাল টকটক হয়ে গিয়েছে। শ্যামল যখন রেগে যায় তখন চোখ লাল হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের রাগ প্রকাশের আলাদা আলাদা ভঙ্গিমা রয়েছে। শ্যামলের রাগ প্রকাশের ভঙ্গিমা এমন। সে শান্ত থাকে, চোখমুখ লাল হয়ে যায়। কখনো ভাংচুর করে না বা অন্যের উপর রাগ দেখায় না। নিজের ভেতর চেপে রেখে খুবই সহজ ভঙ্গিমায় অন্যের সহিত কথা বলবে।
রিপা কথা ঘুরালো। এ প্রসঙ্গ থেকে তার ভেতর নুহার প্রসঙ্গের কথা বলা জরুরী মনে হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে তার কৌতুহল কম নয় তবুও ওই বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরী। তাছাড়া শ্যামলের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে যেয়ে যদি দেখা যায় শ্যামল উত্তেজিত হয়ে গিয়েছে। তখন না থাকবে বাঁশি আর না বাজবে বাঁশুরী। বুঝা’ ই যাচ্ছে শ্যামল রেগে আছে। থাক এ নিয়ে পরে জানবে। রিপার উড়ো স্বভাব। সে একটা বিষয় নিয়ে স্থির থাকতে পারে না। এ যেমন, ভাত খাওয়ার সময় যদি মিষ্টি আনা হয়। তখন সে ভাত রেখে মিষ্টি খেতে যাবে। এখনও সে পীরের কথা বাদ দিয়ে, নুহার কথা শুনবে। শ্যামল না বলতে চাইলেও জোর করে শুনবে। এমন বিচিত্র স্বভাব সে বাচ্চাকাল থেকেই পেয়েছে। শ্যামলের মুখোমুখি হয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘ আপনি আগে বলুন, নুহা কে? তার বিষয়ে কোনো ক্লারিফিকেশন পাই নি? ‘
শ্যামল স্বাভাবিক হলো। রাগ সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে। হুটহাট যেমন রেগে যায় ঠিক তেমন হুটহাট শান্ত হয়ে যায়। গণণা করলে দেখা যাবে এমন লোকের সংখ্যা বেশি। খুবই কম লোক হয়,যাদের রাগ দীর্ঘস্থায়ী হয়। শ্যামল তাদের কাতারে পড়ে না, সে অন্যদের মতো। রিপার কৌতুহল আর সন্দেহ দেখে তার চোখেমুখে পরিবর্তন এলো না। বরং না দেখলে পরিবর্তন আসতো। নারীজাত নিজের স্বামীর সাথে পর নারীর সহিত হালকা দেখা পেলেও তা নিয়ে কখনোই কথা বলতে ছাড়ে না, সেখানে তার সাথে নুহাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছে। কাজেই এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন না করাটা আশা করা বোকামি। শ্যামল গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিলো। নিচু কন্ঠে বলে,
‘ নুহা সম্পর্কে আমার কাজিন। আপন নয়,দূরসম্পর্কের। পেশায় সে একজন নার্স। মূলত আমার ভাইয়ের খেয়াল রাখার জন্য তাকে বাসায় আনা হয়েছে।’
‘ আচ্ছা। তাহলে আপনার কথার অর্থ হলো, সেদিন ওসব আমাকে দেখানোর জন্য নাটক ছিলো। আপনার কি মনে হয় না সে অবস্থা খুবই বেশি হয়ে গিয়েছিলো?’
‘হু। এতটা খারাপ অবস্থা তৈরী করার কথা ছিলো না। আমি কিছু বলার পূর্বেই আপনি চলে এসেছিলেন,তাই আমি অভিনয় চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম।’
‘ আমার মোটেও তেমন মনে হচ্ছে না। কোনো মেয়ে কখনোই কারণবিহীন নিজের ইজ্জত নিয়ে এতটা কাহিনী করে না। জোরালো কোনো কারন থাকে। তাছাড়া তার চোখে আর কন্ঠে আমি স্পষ্ট জোর দেখেছি। এত তুচ্ছ সম্পর্কে কেউ এমন করে না।’
শ্যামল কয়েক সেকেন্ড মৌনতা পালন করলো। তারপর খুবই ধীর স্বরে বলে,
‘তার আরো একটা পরিচয় আছে।’
‘সেটা কি?’
‘ সে আমার হবু বউ। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তার সাথে। যেখানে আমার ইচ্ছা বিন্দু পরিমাণ নেই। মা’কে কি জাদু করেছে সে, কে জানে? তিনি মোমের মতো গলে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। আমি সাথে সাথে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, কিন্তু উনারা সেটা গ্রাহ্য করেন নি। তাই আমিও উনাদের গ্রাহ্য করে নি, উনাদের চাল উনাদের উপর দিয়ে দিলাম। বিয়ে করে নিলাম আপনাকে। উনি আমাকে না জিজ্ঞেস করে যেমন বিয়ে ঠিক করেছেন, ঠিক তেমন আমিও বিয়ে করে নিয়েছি।’
রিপা চুপ রইলো। কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। শ্যামলের যুক্তি তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। সম্পর্ক টা ঘুরেফিরে প্রতারণার হয়ে যাচ্ছে। এ কেমন বন্ধন? স্বাভাবিক কোনোরকম সম্পর্ক ই নেই। রিপা ঠোঁট নাড়লো,
‘ আপনি জেদের বসে আমাকে বিয়ে করেছেন? এ সম্পর্ক টা কি শুধুই একটা জেদ? আপনার পরিবার জেনে যাওয়ার পর যদি না মানে তাহলে কে ভেঙ্গে যাবে “সম্পর্কের বন্ধন”? ছেড়ে দিবেন আমাকে?’
শ্যামল চুপ থেকে এক দৃষ্টিতে রিপার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে তো এ কথা ভাবে নি,নির্মলা বেগম যদি না মানে তখন সে কি করবে? ভাবা উচিত ছিলো। এত বড় বিষয় কীভাবে ভাবলো না। এর জন্য নিশ্চই তার বড় ধরনের শাস্তি পাওয়া উচিত। শাস্তি টা কঠিন হলে ঠিক হবে। তখন দ্বিতীয়বার কিছু করবার পূর্বে মনে পড়বে। পরক্ষণে চিন্তা করলো, মা না মানলে কী হবে? সে মানিয়ে নিবে। মানতে না চাইলে জোর করে মানাবে। দরকার পড়লে দুনিয়া উল্টিয়ে ফেলবে। হু কেয়ার’স? রিপার মতো মিষ্টি মেয়েকে মানবে না কেনো? ভাইয়ের জন্য যদি মেনে থাকে নিশ্চই তার জন্যও মানবে। সে পছন্দ করে এত সহজে হেরে যাবে না। হু হু…
রিপা ঝুঁকে তাকালো শ্যামলের দিকে। কৌতুহলী হয়ে বলে,
-‘ কি বিরবির করছেন? উত্তর দেন। আপনি কি জেদের কারণে বিয়ে করেছেন?’
শ্যামল কঠিন গলায় জবাব দিলো,
‘ না।’
রিপা চেয়ে রইলো। শ্যামল লজ্জিত মুখে বললো,
‘আপনাকে আমার ভালো লাগে। আপনি যখন হাসেন তখন আরো ভালো লাগে। ওই যে সেদিন গোলাপি রঙ এর গোল ফ্রকের সাথে সাদা ওড়না পরে হাসতে হাসতে সিড়ি লিফ্টে নামছিলেন তখন খুব মিষ্টি লাগছিলো আপনাকে।’
কথাটা বলেই জিভ কাটলো। শিট! এটা কি করলো? লজ্জা ভাব নিয়ে কথা বলেছে? সে কি মেয়ে? মেয়েরা এমন ইনিয়ে-বিনিয়ে মুখ লাল করে কথা বলে। সে তো পুরুষ, তার উচিত ছিলো গম্ভীর গলায়, মোটা মোটা স্বরে কথা বলার। এত বড় ভুল সে কীভাবে করলো? হয়েছে টা কি? আজ ভুলের উপর ভুল করেই যাচ্ছে। মুহূর্তেই মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারন করে নিলো। তার এভাবে কথা বলা একদম উচিত হয় নি। এ ঘোর অন্যায়। রিপার দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই দেখবে মেয়েটা তার উপর উপহাস করছে। কি দরকার যেচে যেচে লজ্জা পাওয়ার? সে মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
#চলবে…
®সোনালী আহমেদ