#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫
ড্রয়ারের উপর ফোনটা রাখলাম। হাত-পা অনবরত কাঁপছে। আমি মা হতে চলেছি! সত্যিই? খবরটা শুনে আমি যেন পাথর হয়ে গিয়েছি। এই শরীর খারাপ, বমি পাওয়া, খেতে না পারা এইজন্য যে আমার সন্তান আসতে চলেছে? খুশি হবো নাকি অখুশি বুঝতে পারছিনা। তখন শুধু ধূসরমানবের বলা সেই কথাটাই আমার কানে বাজছিলো বারবার। যেন চিৎকার করে বলছে, আমি তোমার কোনোকিছুই চাইনা৷ আর বাচ্চা? অভিয়াসলি সেটা নয়ই। তোমার থেকে কেউ সন্তান চায়নি। আমার সন্তান শুধু অর্নির হবে, অন্যকারোর নয়। মনে রেখো আরুণী। হ্যাঁ, মনে রেখে দিয়েছি। রাখলাম ও! অভিমান হলো খুব, কেন নিতে এসেছে আমায়? নিষ্ঠুর ধূসরমানবের সাথে আমি কোত্থাও যাবোনা.. কোত্থাওনা!
পেটের ওপর হাত রেখে হু হু করে কান্না পেলো আমার। আমার সন্তানকে তার বাবা চায়না, এটা আমি কীভাবে সহ্য করবো? যাকে চায়না তাকে নিয়ে ওইবাড়িতে ফেরার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। বাবার বাড়ির সবাইও আমাকে বুঝতে পারছেনা। আমি কোথায় যাবো? প্রেগ্ন্যাসির এই খবরটা কী সবাইকে বলা উচিৎ? হ্যাঁ, উচিৎ। আমি কোনো চুরি, ডাকাতি করিনি যে কথাটা লুকাবো। দোষ করলে সেটা ধূসরমানব করেছে। আমার কী! সত্য বলতে আমি ভয় পাইনা। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। অর্নি..তুই কোথায় বোন। এভাবে আমাকে একা করে দিলি! আমার যে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে! আচ্ছা, আমাকে কী ভালোবাসা যায়না? ধূসর কেন ভালোবাসলোনা আমায়? তোর ভালোবাসায় ভাগ বসাতে চাইনি, তোরটা তোরই থাকবে। শুধু তাঁর হৃদয়ের কোণে একটু জায়গা চেয়েছিলাম। দেয়নি রে..তাও মানলাম। কিন্তু যেদিন সে আমাকে জানিয়ে দিলো আমার কিছুই সে চায়না এমনকি বাচ্চাও না, সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি ধূসরের কাছে ফিরবোনা। তবে কেন এখন এতো ঝামেলা ক্রিয়েট হচ্ছে রে বোন। তুই জানিস আমি কতোটা সেল্ফ রেসপেক্টিং ছিলাম আর এখন কতোটা সেলফিশ! আমি, ধূসর দুজনেই পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু এখন কী করবো আমি!
একা একা কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম মনে নেই। ঘুম ভাঙলো একেবারে সকালে। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছেনা। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। হাত-পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো হাতখোঁপা করে গায়ের ওড়না গোছাতে গোছাতে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। কাল রাতে কিছুই খাইনি, ক্ষিধেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। আমার ভেতর একটা প্রাণ আছে, তাঁকেও তো খেতে দিতে হবে! ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। ওর তো মা আছে। নিষ্ঠুর বাবার প্রয়োজন নেই। কাউকে লাগবেনা আমাদের। আমি জানি আমাদের পাশে সবসময় অর্নি আছে, আমার বাচ্চা আছে আমার জন্য। সারা ঘরময় আমার অনাগত সন্তানের সঙ্গে কথা বলে কাটালাম। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। মা হওয়াটা সত্যিই চমৎকার এবং আনন্দদায়ক। বাঁচার ইচ্ছে হাজারগুণ বাড়িয়ে দেয়, সাহসী করে তুলে, শক্তি আর প্রাণ যোগায়!
ঘর থেকে বেরুলাম খুব স্বাভাবিক ভাবেই। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো যেন চিড়িয়াখানার চিড়িয়া আমি। দোতলায় না গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছি। পরিমাণের চেয়ে বেশিই খাওয়ায় মেজোচাচী হেসে বললেন, ‘আজ খাবার বুঝি খুব ভালো হয়েছে?’
-হুম হয়েছে তো।
-তাহলে আরেকটু নে।
-দাও।
ধূসরকে সিঁড়িতে দেখা গেলো। ঘুমুঘুমু চোখে উপর থেকে নামছে। ওমা! ওনি যায়নি? রাতে কি এখানেই থেকেছে? যাকগে আমার কি! এত ঠ্যাকা পড়েনি ওনার কথা ভাবার। খুব করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। ধূসর এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলো। আম্মু খাবার বেড়ে দিচ্ছেন ওনাকে। আর ধূসর ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি খাওয়া সেরে পাতে পানি ঢেলে উঠে পড়লাম। ছাদে উঠে রেলিঙের উপর বসে থাকলাম। পাশের কচুরিপানার ডোবাটায় ঢিল মারি। কেন জানিনা মজা পাচ্ছি এসব করে। আচ্ছা সবাই যখন জানবে আমি মা হতে চলেছি তাঁদের রিয়েকশন কেমন হবে?
হঠাৎই কাঁধে কারোর হাতের ছোঁয়া লাগতেই পেছনে ফিরে তাকালাম। ধূসর! ইতর লোক একটা! আমি কথা না বলে বিরক্ত হয়ে সামনে তাকালাম। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। এখানে কি চায় সে?
-কথা বলবেনা?
-আমাকে একা থাকতে দিন দয়া করে।
-স্যরি। কাল ওভাবে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য।
-এখন কি আরও মারতে ইচ্ছে করছে? তাহলে মেরে দিন। আমি কিচ্ছু মনে করবোনা।
-স্যরি বললাম তো!
আমি কথা না বাড়িয়ে কাঠ কাঠ গলায় বললাম, ‘ইটস ওকে।’
-থ্যাংক ইউ। ওই যে নদীটা দেখা যাচ্ছে সেখানে গিয়েছো কখনো?
-না।
-কেন?
-সাঁতার জানিনা বলে ওদিকে যাওয়া বারণ। আব্বু কখনোই যেতে দেয়নি কাউকে।
-আমি অর্নিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। নৌকো করে ঘুরে বেড়িয়েছি!
-আপনার মনে আছে অর্নিকে?
ওনি অবাক হয়ে বললেন, ‘ভুলে যাবার প্রশ্নই আসেনা।’
-সত্যি বলছেন?
-ডাউট আছে?
-জি।
ধূসর চেহারাটা কালো করে ফেললো। এক নিদারুণ ব্যথা তার চোখমুখে ফুটে উঠে দপ করে নিভে গেলো। তারপর ঢোক গিলে আমাকে প্রশ্ন করলো, ‘আমাকে দেখে খুব রাগ হচ্ছে তোমার তাইনা?’
আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘হুঁ।’
ধূসর মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। টি-শার্টের কলারের বোতামটা খুলে চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো। আমার বাঁ হাতটা টেনে ওনার বুকে ওপর রাখলো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘জানো! অর্নির শূন্যতা কখনো পূরণ হবেনা। আমার প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্ত্রী হিসেবে ওকে কখনো ভুলতে পারবোনা। তবে এটাও মনে রাখো যে ধূসর কখনো তোমাকে ছাড়বেনা। চাই তোমাকে আমার। তবুও আমার আচরণে তুমি কনফিউজড হচ্ছো। আসলে কি বলোতো, মতের বিরুদ্ধে হলেও তোমাকে আমি বিয়ে করেছি। অর্নির মতো তুমিও আমার স্ত্রী। মাঝেমাঝে অর্নি যখন আমার কাছে আসে, শুধু তোমার কথাই বলে। জানি এটা স্বপ্ন, কিন্তু আমার অর্নির কথা তো! তাঁর কথা আমি কীভাবে ফিরিয়ে দিই? তুমি হয়তো ভাবছো এজন্য আমি তোমাকে চাই। কিন্তু না, আমি আসলেও তোমাকে চাই। যে ক’দিন আমার বাড়িতে ছিলে মনে হতো আমার অর্নিই বুঝি সারা বাড়িতে বাচ্চাদের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে, হাসছে, গল্প করছে। বাট যখন চলে এলে তখন আমি আরুণী নামক মেয়েটাকেই মিস করতে লাগলাম। আরুণীর উঁচু গলায় বলা কথাগুলো, ঝগড়া করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকা, নাকের ডগায় চশমা এঁটে আমাকে হুমকি দেওয়া, আরুণীর ঘনকালো চুলের মাতাল করা সুবাস, ওর হেঁটে চলার শব্দ, কিশমিশের আম্মুটা, এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুমানো সেই আরুণীটা। অর্নির সাথে সাথে এবার আরুণীটাকেও বড্ড মিস করতে লাগলাম। ট্রাস্ট মি, এই ফিলিংসটা তুমি কখনো বুঝবেনা। অর্নিকে যেমন আমার প্রয়োজন, তোমাকেও আমার প্রয়োজন। ফিরবে তো?’
-ফিরে যাওয়া কী এতোই সহজ?
বলেই আমি একটু হাসলাম। বাড়তি একটা কথাও বললাম না। ধূসর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছে। আমি নিরুত্তর। নীলাভ আকাশে রুপো রঙা সূর্য। অনেক উঁচুতে চিলেরা উড়ছে। কোথা থেকে ভেসে আসছে রবিবাবুর গানের কথামালা। এক মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার মতো কান পাতলাম আমি।
‘তোমায় গান শোনাব; তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ
ওগো ঘুম- ভাঙানিয়া
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাকে
ওগো দুখজাগানিয়া॥
এল আঁধার ঘিরে, পাখি এল নীড়ে,
তরী এল তীরে
শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো
ওগো দুখজাগানিয়া॥
আমার কাজের মাঝে মাঝে
কান্নাহাসির দোলা তুমি থামতে দিলে না যে।
আমার পরশ ক’রে প্রাণ সুধায় ভ’রে
তুমি যাও যে সরে-
বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাক
ওগো দুখজাগানিয়া॥’
থমথমে হয়ে আছে চারিপাশ। কয়েকটা কাক সেগুন গাছের নিচু ডালটাতে বসে একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে। মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে বিরিয়ানি আর কষা মাংসের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আমার জিভে জল চলে এলো। উঠতে নিলেই আমার হাত ধরে ফেললো ধূসর। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, ‘বসো আরেকটু।’
-ওকে বসলাম। কী বলবেন বলুন।
ওনি রেগে আসা মেজাজটা গিলে খুব শান্তভাবেই বললেন, ‘রেডি হবে কখন? এখন না বিকেলে?’
-আচ্ছা। অর্নির মৃত্যুর সাড়ে পাঁচমাস মাত্র। আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে কয়েকমাস। এতো দ্রুত আপনার মতিগতি পাল্টে গেলো কেন?
-পাল্টানোর কিছু নেই। সব ঠিকই আছে। সুযোগ দিতে চাই সম্পর্কটাকে কারণ তোমাকে আমার চাই।
-অর্নির সাথে অন্যায় করা হলোনা?
-একদমই নয়। সে বরং খুশি হবে।
-আপনি কীভাবে জানলেন?
-আমার মন বলে। অর্নি জানে তাঁকে ছাড়া আমি ভালো নেই, আরুণীকে ছাড়াও না। একচুয়েলি এতো বছরের সম্পর্কে অর্নিকে আমি ভালো করেই বুঝি, সেও বুঝে। একটা কানেকশন আছে আমাদের মধ্যে। তুমি ওসব বুঝবেনা।
তারপর নীরবতায় কেটে গেলো অনেকটা সময়। আমি ভাবলাম, ভাবতে ভাবতে ঘাম ঝড়িয়ে ফেললাম। ধূসরের প্রতি একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করছে। ভালোবাসা, মায়া না করুণা জানিনা। ধূসরমানব যে এতটুকু বুঝতে পেরেছে তাতে কি আমার খুশি হওয়া উচিৎ? অর্নি সত্যিই চায় আমি ওনার কাছে ফিরে যাই? সেও কী আরুণী হিসেবেই আমাকে চায়? অন্য স্বত্ত্বার কাউকে ভেবে নয়? তাঁর হৃদয়ের দ্বিতীয় মোহিনীটার জায়গা কি সত্যিই পেয়ে গেছি! সেদিনের কথা মনে হলো। ছাদে বসে থাকার সময় অর্নির কন্ঠস্বরে বলা কথাটা, ভালোবাসিস ধূসরকে! আমার চোখ ভিজে গাল বেয়ে পানি পড়লো। কিন্তু এতো সহজে যে ধূসরমানবের কাছে ফিরবোনা আমি। আমাকে যে এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো তার জন্য তো তাঁকে শাস্তি দিতে হবে! সেতো বাচ্চা চায়না, আমিও তো ঠিক করেছিলাম কোথাও যাবোনা ওনার সাথে। ধূসরের অভিব্যক্তি পরীক্ষা করার জন্য খুব সহজভাবেই ওনার হাতটা নিয়ে পেটের ওপর রাখলাম আমি। ওনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
-কিছু টের পেলেন? বুঝতে পারছেন কিছু?
-তোমার পেটব্যথা করছে?
-না।
-তাহলে?
-গেস করুন।
কিছুক্ষণ পর ওনি ভূত দেখার মতো চমকে বললেন, ‘আর ইউ প্রেগন্যান্ট আরুণী?’
আমি মিষ্টি হেসে বললাম, ‘জি। এখন অবশ্যই বুঝতে পারছেন আমি কেন আপনার কাছে ফিরবোনা।’
আপনারা মতামত জানাবেন। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!