তার শহরের মায়া পর্ব-০৩

0
1289

#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_৩
#Writer_Liza_moni

অনু মোবাইল হাতে নিয়ে মাহির এর ফোনে একটা মেসেজ লিখে পাঠালো।
আপনার সাথে আমার কথা আছে মাহির।বউ ভাতের ব্যাস্ততা কাটিয়ে আমার সাথে একান্ত দেখা করবেন। আমার এই আশা আপনি নিরাশা করবেন না দয়া করে।

অনু মেসেজ টা পাঠিয়ে দিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। সারা রাত জেগে কান্না করার ফলে চোখ জ্বালা করছে এবং মাথা ও ব্যাথা করছে প্রচুর।

মাহিরের ফোনে টুং করে মেসেজের শব্দ পেয়ে তনু মাহিরের ফোনটা যেই হাতে নিতে যাবে মাহির ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে দ্রুত তনুকে নিজের দিকে টেনে নেয়। বিছানার উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপরে রেখে তনু কে জড়িয়ে ধরে।

আবার শুরু হয়ে গেছে আপনার দুষ্টুমি।

বউয়ের সাথে দুষ্টুমি করবো না তো কি অন্য কারো সাথে দুষ্টুমি করবো?

না আমি তা বলিনি।

তাহলে?

কিছুই বলিনি হয়েছে?

মাহির মুচকি হেসে তনুর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
দরজায় টোকা পড়তেই মাহির তনুকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিল।

সকাল নয় টা বাজে তোদের কী এখন ও ঘুম ভাঙ্গে নাই মাহির?

তনু মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনে মুচকি হেসে দরজা খুলে দিতে এগিয়ে গেল। মাহির মোবাইল হাতে নিয়ে অনুর মেসেজ টা পড়ে
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তনু দরজা খুলে দিলে ছেলেটা মুচকি হেসে বললো
গুড মর্নিং ভাবী।

তনু মুচকি হেসে বললো মর্নিং। আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না ভাইয়া।

ও তুর্য, আমার ফুফুর একমাত্র ছেলে।যাদের বাড়িতে আছো তাকেই চিনতে পারছো না তনু?
কথা টা বলতে বলতে দরজার কাছে এগিয়ে যায় মাহির।

আসলে তোদের বিরক্ত করতে চাই নি।মামি বললো তোদের ডেকে নিয়ে যেতে নাস্তা করার জন্য।

হুম চল।

তুর্য মাহিরদের আগেই চলে গেল।

ছেলেটা আপনাকে তুই করে বললো কেনো?

আমরা সম বয়সী তাই তুই করে বলেছে। ছোট থেকেই আমরা একে অপরকে তুই করে বলে আসছি।

.
অনু কে সোফায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকালো সকালের সেই ছেলেটা।

অনুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই অনু চোখ মেলে তাকায়। পাশে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো অনুর। ছেলেদেরকে দেখলেই এখন ভীষণ রাগ হয় অনুর।

বেয়াইন সাহেবা আপনি এখানে বসে ঘুমাচ্ছেন কেন? রাতে কী আপনাকে রুম দেখিয়ে দেওয়া হয়নি?

আপনার সমস্যা কি?আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুমাবো।
বলেছি না আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য।

আরে আপনি এই ভাবে রেগে যাচ্ছেন কেন বলুন তো ? আমি কী আপনাকে খারাপ কিছু বলেছি?বিয়ে বাড়ীতে আপনি যেখানে সেখানে ঘুমাতে পারেন না।আর এটা আপনার নিজের বাড়ি ও না।তাই সব জায়গায় সব কিছু হজম হয় না।আর আমি কি আপনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি? দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলছেন যে আপনি? কোথায় কী বলতে হয় সেই বোধ বুদ্ধি ও তো নেই আপনার।

কথা গুলো বলে ছেলেটা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। মাহির এতক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সব কিছুই দেখছিলো।

আমার মনের ভেতরের কষ্ট টা শুধু আমিই দেখতে পারছি।অনুভব করতে পারছি।এরা তো যে যার মতো করে ভেবে নিয়ে আমাকে কথা শুনাচ্ছে। হায়রে মানুষ।

অনু আশে পাশে তাকাতেই চোখ পড়লো মাহিরের উপর।অনু কে দেখে বুকের মাঝে ধক করে উঠে তার।এক রাতে কি অবস্থা করেছে নিজের।

তনুকে আসতে দেখে মাহির খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। তনু অনুর কাছে এসে অনুর চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায়।

ব্যাথিত কন্ঠে বলে উঠে

একি অবস্থা হয়েছে তোর অনু? চোখ মুখ ফুলে আছে কেন? চোখ গুলো লাল হয়ে আছে কেন?

অনু বোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরে বললো
তুই তো জানিস আপু নতুন জায়গায় আমার ঘুম আসে না সহজে।আর গত কাল রাতে এতো মানুষের ভিড়ে আমার একটু ও ঘুম হয়নি।

ইসস আমার বোনটা কতো কষ্ট করেছে ‌।আয় আমার সাথে আমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবি।

তনু অনুর হাত ধরে রুমে নিয়ে গেল।
অনু রুমটাতে আসতেই মাহিরের পারফিউমের গন্ধ পেল। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো তার। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওয়াস রুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

অনু যে তনুকে সত্যি কথা বলেনি সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তনু।অনুর যে অনেক বড় কিছু একটা হয়েছে সেটা তনুর বুঝতে অসুবিধা হয় নি।যতোই হোক নিজের মায়ের পেটের বোন।

অনু ওয়াস রুম থেকে বের হলে তাকে সাথে করে নাস্তার টেবিলে নিয়ে যায় তনু।

অনু কে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে তনু মাহিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

মাহিরের ফুফু আর মা নাস্তা পরিবেশন করতে গেলে তনু ও তাদের কাজে হাত মিলায়।

নতুন বউ তোমাকে আজ কোনো কাজ করতে হবে না। তুমি মাহিরের পাশে বসে খাওয়া শুরু করে দাও।

সেকি ফুফু মনি আপনারা বসুন আমি বরং আপনাদের সবাইকে পরিবেশন করে দি।

শুনেছো মেয়ের কথা তুমি আর মাহির সবার আগে নাস্তা করে বউ ভাতের অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হয়ে নাও।যাও মাহিরের পাশে বসে খাওয়া শুরু করো।

তনু মাহিরের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।

অনু খাবার টেবিলে বসে তনু আর মাহির কে দেখে যাচ্ছে। মাহির অনুর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়।
মাহির অনুর চোখে তার জন্য স্পষ্ট ঘৃণা দেখতে পেল।

অনুর গলা দিয়ে খাবার নামছে না। তবু ও জোর করে কিছুটা খেয়ে মোবাইলে কল আসায় উঠে চলে গেল।

অনু মাহির ভাইয়া নাকি বিয়ে করে ফেলেছে? সত্যি?

তুই সব কিছু জানার পর ও কেন আমার কাছে জানতে চাচ্ছিস রিফা?

বিশ্বাস কর দোস্ত আমি সত্যিই জানতাম না যে মাহির ভাইয়া বিয়ে করে ফেলেছে।ও আমাকে একটা বারের জন্য ও বলেনি। এমনকি আমার পরিবার কে ও না।

কি জন্য বলেনি জানিস যদি আমি জেনে তাই। তুই যদি আমাকে বলে দিস সেই ভয়ে। কিন্তু কার সাথে বিয়ে হয়েছে জানিস? আমার আপন বড় বোনের সাথে।

তোর বোনই তাহলে মাহির ভাইয়ের প্রথম দেখায় ভালোবাসার মানুষ।

মানে?

মানে মাহির ভাইয়া তার বন্ধু,আর আমার ভাইয়ের সাথে বাজি ধরে তোর সাথে রিলেশনে গিয়েছিল। তোকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে তার কখোনো ছিল না।

রিফার কথায় অনুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।সে মনে করেছিল মাহির হয়তো কোনো একটা অজানা কারণে বিয়েটা করেছে। কিন্তু মাহির এতোটা নিচ ছি।

তুই সব জানার পর ও আমাকে কিছু বলিসনি রিফা?

আমাকে বলতে দিতো না মাহির ভাইয়া।তোদের রিলেশন যখন ১ বছর পার হয়ে যায় আমি ভেবেছিলাম মাহির ভাইয়া সত্যি তোকে ভালোবাসতে শুরু করে। কিন্তু আমি জানতাম না রে মাহির ভাইয়া এমন কিছু করবেন।

তোরা সবাই মিলে আমাকে এই ভাবে ঠকালি? হায়রে মানুষ জাতি।
অনুর চোখ বেয়ে আবার পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। কাছের মানুষ গুলোর প্রতারনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অনু।

.
পার্লার থেকে মেয়েরা এসে তনু কে সাজিয়ে দিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। মাহির হালকা আকাশি রঙের একটা পাঞ্জাবী পরেছে।

অনু একটা চুরিদার পড়ে তনুর কাছে গেলো।
বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো মাশাআল্লাহ। আমার বোনটা আস্ত একটা পরী। কারো নজর না লাগুক।

মাহির কে রুমে আসতে দেখে অনু তনুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
আমি এখন যাই। দুলাভাইয়ের সাথে রোমান্স কর।
অনু রুম থেকে বের হবার সময় মাহিরের দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে গেল।

মাহিরের ফুফুদের বাড়িতে এখন মেহমানদের ভীড়।অনুর মন ভালো নেই। এতো মানুষের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।তাই অনু ছাদে চলে গেল। ফুফুর বাড়ীর উঠানে ডেকোরেশন করা হয়েছে বিধায় ছাদ এখন খালি থাকবে।

অনু ছাদে গিয়ে রেলিংয়ের সাথে দাঁড়িয়ে নিচের সব আয়োজন দেখছে। একটু পর নিজের মা বাবা সহ কিছু আত্মীয় স্বজনদের গাড়ি থেকে নামতে দেখে ও নিচে গেলো না অনু।

তখনকার সেই ব্যবহারের জন্য আমি মন থেকে দুঃখিত।

কারো বলা কথাটা শুনে অনু পাশ ফিরে তাকায়।এক নজর তাকিয়ে সেই ছেলেটা কে দেখে অনু চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার নিচের দিকে তাকালো।

ছেলেটা একবার অনুর দিকে তাকিয়ে আবার বললো
Sorry,I am really sorry for this behaviour….

সরি বললেই সব সমাধান হয়ে যায়? নিচের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল অনু।

তা হয় তো হয় না। কিন্তু ক্ষমা তো চাইতেই পারি ভুল যখন করেছি।

অনু কিছু বললো না। নিচের দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

বাই দা ওয়ে আমি আপনার দুলাভাইয়ের ফুফাতো ভাই তুর্য।

অনু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল আমাকে একটু একা থাকতে দিবেন প্লিজ?

আপনি তো সরির উত্তর দিলেন না 😒।

আপনার কথায় আমি কিছুই মনে করিনি।আর আপনি যা বলছেন ঠিক বলেছেন।এতে সরি বলার কিছু নেই।এর থেকেও বেশি কষ্ট নিয়ে সবার সাথে হেসে হেসে ভালো আছি বলে যাচ্ছি।আর তখন আমি ঘুমাইনি। চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম মাথা ব্যথা করছিল বলে।

আমি সত্যি সরি।

আমাকে একা থাকতে দিলেই আপনার সরির উত্তর পেয়ে যাবেন। একটু একা থাকতে দিন।

তুর্য আর কিছুই বললো না।ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলো।অনু আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।

নিচ থেকেই অনুকে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মাহির। তনু এখন তার মা বাবা আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত।

তাই মাহির ছাদে আসলো অনুর সাথে কথা বলতে। মাহির ছাদে এসে ছাদের দরজা বন্ধ করতে লাগলো।যেন তাদের কথার মাঝে কেউ আসতে না পারে।

দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেয়ে সে দিকে তাকায় অনু।মাহির কে আসতে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো।

বুকের মাঝের অসহ্য যন্ত্রণা টা যেন আরো কয়েক গুণ বেশি বেড়ে গেছে তার।

মাহির ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে অনুর উদ্দেশ্যে বলল
আমি জানি তুমি আমাকে এখন কী বলবে অনু। আমি তোমাকে না জানিয়ে কেন বিয়ে করেছি।তাও কিনা তোমার আপন বড় বোনকে।

অনু মাহিরে দিকে এগিয়ে যায়।

শান্ত কন্ঠে বলল আমাকে ঠকিয়ে আপনি কি পেয়েছেন?

আমি তোমাকে ঠকাতে চাই নি অনু।

ও আচ্ছা। আপনি আমাকে ঠকাতে চাননি কিন্তু আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
মানুষ এতো নিখুঁত অভিনয় কী করে করতে পারে বলেন তো। আচ্ছা আপনি কি আমাকে এই তিন টা বছরে একটু ও ভালোবাসেন নি?

এই তিন বছরের সম্পর্কে আমি তোমাকে একটু ও ভালোবাসিনি বললে তা ভুল হবে। আমি ও তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম।

মাহিরের কথায় অনু তাচ্ছিল্য হাসলো।
এমন করে ভালোবেসে ছিলেন আমায় যেমন ভালো বাসলে অন্যের প্রতি থাকে ঝোঁক ?এটাই আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা ছিল?

মাহির ও অনুকে ভালোবেসে ছিল। তেমন ভালোবেসে ছিল যেমন ভালোবাসলে অন্য কারো প্রতি ঝোঁক থাকে। অন্য কাউকে পাওয়ার ইচ্ছে থাকে।

কেন এই ভাবে ঠকিয়েছেন আপনি আমাকে? আমি আপনাকে নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করতাম বলে এই প্রতিদান দিলেন তার? একটা বাজিতে জিতার জন্য আমার জীবন টা শেষ করে দিলেন আপনি? আমার ইমোশন নিয়ে এই ভাবে খেলতে একটু ও কী খারাপ লাগে নি আপনার? আমি তো আপনার শহরে যেতে চাই নি। আপনিই তো আমাকে আপনার শহরের মায়ায় ফেলেছেন।কী দোষ করেছি আমি?কি ক্ষতি করিছি আপনার? answer me…..

চলবে,,,, 🍁