বাবুই পাখি পর্ব-২৮+২৯

0
1114

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২৮
Writer-Afnan Lara
.
পুতুল চুপ করে বিছনার শেষ প্রান্তে বসে আছে হাঁটু ভাঁজ করে।চোখ তার ফ্লোরের উপর।চোখের পাতা ফেলছে না।ইমাদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মুখটা গম্ভীর করে ওর পাশে এসে বসলো।লোকমা বানাতে বানাতে বললো,’সকালে হোটেলে নাস্তা করেছিলাম।পরোটা আর মিষ্টি।ভাজি শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে শুধু মিষ্টি দিয়ে খেয়েছিলাম।এরপর থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি আমার।এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছি আমি।তুমি যদি এখন না খাও তাহলে কিন্তু আমিও খাব না’

পুতুল হঠাৎ করে বসা থেকে শুয়ে পড়লো।টান দিয়ে কাঁথাটাও মুড়িয়ে ফেলেছে।মানে সে খুব রেগে আছে।ইমাদ না খেলেও চলবে তার।এটাই বুঝাচ্ছে।
ইমাদ রাগ করে প্লেট হাতে চলে আসলো রুম থেকে।

-‘ঐ দেখো ইমাদ এসেছে।আয় বাবা বোস।মাংস এগুলো তোর’

ইমাদ মাংসের বাটিটার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে চেয়ার টেনে বসলো।প্লেটটা ঠেলে দিয়ে বললো,’পুতুল খায়নি।আমার খাবার আমারই রয়ে গেছে’

ইমাদেী মা ভেংচি কেটে বললেন,’ইমাদের বাবা,তুমি না আরও মাংস খেতে চেয়েছিলে?নাও এসব খাও’

-‘না থাক।তোমার মাংসের বাটি থেকে ঝোল যা নিয়েছিলাম, তাতেই আমার হয়ে গেছে।ভাত শেষ’

মিসেস রওনক চোখদুটো ছোট করে বললেন,’মানেহ্?এত জলদি তোমার খাবার শেষ হয় কি করে?
নিশ্চয় ঝোলের সাথে আলুও নিছিলে।তোমাকে আমি চিনি না?’

-‘ইয়ে মানে আলু এক পিস নিছিলাম আর একটাও নিই নাই।বিশ্বাস করো’

মা -বাবা আবারও ঝগড়ায় লেগে গেছেন।ইমাদ প্লেট ঢেকে রেখে হাত ধুয়ে চলে গেলো আবার রুমের দিকে।
রাত দশটা বেজে গেছে।ইমাদের বাসার ঘড়িটায় সুন্দর টোনটা বাজতে শুরু হয়ে গেছে।ইমাদ রুমের আলো নিভিয়ে পুতুলের পাশে ঘেঁষে বসলো।পুতুল শুয়ে আছে ঠিকই কিন্তু সে ঘুমায়নি।ইমাদ তা জানে।হাতটা ওর ঘাঁড়ের উপর রেখে ইমাদ বললো,’জানি আজ যা হয়েছে ঠিক হয়নি।হয়ত বকাটা মেইন ছিল না।মেইন হলো তোমার জন্মদিনে আমি বকেছি।কষ্ট দিয়েছি তোমায়।এটাই তোমার মনকে আঘাত করেছে।আমার ব্যবহারটা একদমই ভালো ছিল না।তাছাড়া আগে এমনটা করিনি।আজ কেন করলাম সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। অফিসে এত কাজ ছিল আমি ডিপ্রেসড্ ছিলাম।তার উপর এত ফোন-কল।তুমি একবার আমার সঙ্গে কথা বলো।তোমার সাথে মিসবিহেভ করে আমার নিজেরই ভীষণ খারাপ লাগছে।একবার আগের মত করে তাকিয়ে দেখো আমায়।আমি তোমার সেই চাহনি মিস করছি পুতুল।জানি তুমিও কিছু খাওনি।রাগ খাবারের সঙ্গে কেন দেখাবে?খাবার তো দোষ করেনি।মা কত ভালো করে মাংস রেঁধেছে।খেয়ে দেখো।পুতুল শুনছো আমার কথা?’

ইমাদ যখন দেখলো পুতুল নড়ছে না। সে ও শুয়ে পড়লো পুতুলের পাশে।
বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে হুট করে পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো সে পুতুলকে।মুখটা ওর পিঠে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললো,’এই বোকা ছেলেটাকে মাফ করা যায় না?আর জীবনে বকবো না সত্যি।তুমি বকো আমায়।কিল- ঘুষি দাও, তাও কথা বলা অফ দিও না প্লিজ।আমার কিছু ভাল্লাগছে না।এতশতর মাঝে, মা আমাদের দুজনকে মেনে বাসায় ঢুকতে দিয়েছে, থাকতে দিয়েছে, এটা সেলিব্রেট করতেই ভুলে গেছি আমরা।রাগটা এক সাইড করা যায় না পুতুল?’

পুতুল হালকা নড়ে উঠেছে।ইমাদ যখন কথা বলছিল তার ঠোঁটজোড়া পুতুলের পিঠে লাগছিল শুধু।পুতুলের অস্বস্তিবোধ চরম পর্যায় চলে গেছে।ইমাদ আর একটা কথা বললে সে মরে যাবে।এরকম অনুভূতি ভয়ানক হয়।
কাতুকুতু বলে এটাকে।কাতুকুতু একটা মানুষকে হাসাতে হাসাতে পাগল করে দেবার ক্ষমতা রাখে।আর ইমাদ এখন তাই করছে।হয়ত সে জানে না তার এই কাজে পুতুলের কাতুকুতু লাগছে তাও সে বিড়বিড় করে কথা বলেই যাচ্ছে।হাবিজাবি যত কথা আছে সেসব।
পুতুল লাফ দিয়ে উঠে বসলো।ইমাদ চমকে সেও উঠে বসেছে।ল্যাম্পশ্যাড জ্বালানো।সেটার আলোতে পুতুলের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত।ইমাদ হাতটা বাড়িয়ে ওকে ধরতে যেতেই পুতুল একটা ধাক্কা দিলো।ধাক্কাটা জোরে ছিল না,আবার আস্তেও না।মোটামুটি বেগ ছিল।ইমাদ সরে গেছে দূরে।পুতুল তার খোলা চুলগুলোকে হাত দিয়ে মুখের সামনে থেকে সরিয়ে কানের পেছনে নিয়ে বললো,’আমার খালা ঠিক বলেছিল।আপনার থেকে কিছু আশা করা বোকামি।আর আজ আমি সেই বোকামি করলাম।সেই বোকামি না করলে আমার আজকের দিনটা নষ্ট হতো না।থ্যাংকস্!অনেক অনেক থ্যাংকস্!আমার জন্মদিনটা সব চাইতে নিকৃষ্ট বানানোর জন্য,আর এখন আমাকে ছুঁয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি?আমি গলে যাব?পাগল হয়ে যাব?আমাকে কি মনে হয় আপনার?আমি আর পাঁচটা ওয়াইফের মতন না।স্বামী যা নয় তাই বলবে তারপর রাতে এসে কপালে চুমু দিলে সে গলে পানি হয়ে যাবে,ওরকম না আমি।যতদিন না আপনার এই কাজের প্রতি রাগ আমার মাথা থেকে নামছে ততদিন পুতুল আপনার দিকে এভাবে তাকাবে না যেমনটা আগে তাকাতো।’

পুতুল মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো আবার।ইমাদ মূর্তির মতন আগের জায়গায় বসে আছে।পুতুলের এত লম্বা ভাষণে সে হাসবে নাকি কাঁদবে সেটার অংক কষাকষি করছে মাথার ভেতর।
-‘পুতুল বাচ্চা একটা মেয়ে।ওর কথা সিরিয়াস নেওয়াও এক প্রকার বোকামি।তবে সে মাত্র যেসব বললো এগুলোতে তাকে সুঠাম একটা সংসারী মেয়ে মনে হলো।বেশ ভালো।নিজেকে একচুয়াল হাসবেন্ড মনে হলো এই প্রথম।
বিয়ের পরের প্রথম ঝগড়া।আমার বেশ লাগছে।মনে হয় আমি সেই প্রথম পুরুষ যার কাছে স্ত্রীর সঙ্গে হওয়া বিবাদ ভালো লাগছে।’

পুতুল ঘুমানের সব চেষ্টা করেও ব্যর্থ।এপাশ -ওপাশ ও করতে পারছে না কারণ অন্য পাশে ইমাদ।এপাশ -ওপাশ না করলে তো ঘুমই আসবে না।এভাবে এক পাশে শুয়ে থেকে ঘুম হয় নাকি।ইমাদ ও কম না।এখনও গাপটি মেরে বসে আছে।
পুতুল উঠে চলে গেলো বারান্দার দিকে।ইমাদ একটু ফোন বের করেছিল ফেসবুকে যাবে বলে।পুতুলকে ওরকম উঠে চলে যেতে দেখে সেও পিছু পিছু গেলো।পুতুল এক কোণায় আর ইমাদ অন্য কোণায়।পুতুল এবার প্রচুর রেগে গেলো।পেছনে তাকিয়ে বললো,’আপনার সমস্যা কি?’

-‘আমার বারান্দা।আমি আসতেই পারি।সমস্যা হবে কোথা থেকে।এখন আমিও বলতে পারি তোমার সমস্যা কি?’

পুতুল রেগে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো,ইমাদ ছুটে এসে ওর হাত ধরে আটকালো।পুতুল হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,’বেশি হয়ে যাচ্ছে।আমি যেখানে খুশি সেখানে যাব আপনার তাতে কি?’

-‘না যাবে না’

-‘আপনি বলার কে?’

-‘তোমার বিয়ে করা হাসবেন্ড।শুনো আমি সিলিন্ডার দুইটা নিতে পারি একসাথে।আমার আর আরিয়ানদের সিলিন্ডার আমি একসাথে তুলতাম।তোমাকে তুলতে আমার তেমন সমস্যা হবে না।বেশি তালিবালি করলে কোলে তুলে নিয়ে আসবো’

-‘তারপর কি হবে?কোলে তুলে নেওয়া কোন ধরনের ব্ল্যাকমেইল?আশ্চর্য!আপনি একটা পাগল।হাত ছাড়ুন আমার।’

-‘ছাড়লাম।দরজাও লাগালাম।বাহিরে যেতে পারবে না তুমি’

-‘আমি পানি খাব।সরুন’

-‘তুমি এখানে বসো আমি পানি আনছি’

ইমাদ দরজা খুলে ডাইনিংয়ের দিকে গেলো পানি আনতে।পুতুল গাল ফুলিয়ে বিছানায় এসে বসেছে।ইমাদ পানি এনে আবার দরজা লাগিয়ে ফেলেছে।পুতুলের দিকে গ্লাসটা ধরে বললো,’নাও খাও।মাথা ঠাণ্ডা করো একটু’

পুতুল পানি নিয়ে খেয়ে বললো,’আমি এখানে শুবো না।’

-‘এখানেই ঘুমাও আমি বরং সোফায় গিয়ে শুই।কি আর করবো!পোড়া কপাল আমার’

পুতুল চুপচাপ শুয়ে পড়েছে।ইমাদ বালিশ হাতে দরজা ধরে বললো,’আমি যাচ্ছি কিন্তু!সোফার রুমে অনেক মশা আছে কিন্তু!তাছাড়া বাবা-মা দেখে ফেলার চান্সও আছে কিন্তু!’

পুতুল ঘাঁড় ঘুরিয়ে বললো,’থাক যেতে হবে না।ঐপাশে এসে শোন।তবে মুখ ঘুরিয়ে।আমার দিকে তাকাবেন না।আমি ঘুমানোর সময় কেউ তাকিয়ে থাকলে, আমার ঘুম আসে না’

-“যথা আজ্ঞা’

ইমাদ এসে শুয়ে পড়েছে চুপচাপ।দুজনের পেটের ভেতর খিধা লাফা লাফি করছে।রাত ১টা বেজে গেলো অথচ এখনও দুজনের চোখে ঘুম নেই।পেটে খিধে থাকলে কি আর ঘুম আসে?
পুতুল মনে হয় মরেই যাবে।সে খিধে একেবারে সহ্য করতে পারে না আর এখন এতক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে।তার উপর মুরগী রান্না হয়েছে।লোভ সামলানোই যাচ্ছে না কিছুতে।এর ভেতর ইমাদের উপর প্রচণ্ড রাগ।খাবার খেলে ইমাদ ভাববে রাগ শেষ।
‘উফ কি ঝামেলা!’

ইমাদের খিধে পেলেও সে চুপচাপ আছে।নড়াচড়া করছে না।পুতুল খায়নি।এখন সে খেতে বসলেও খাবার তার গলা নিয়ে নামবে না।’জুট ঝামেলা।পুতুল এত রাগী আগে জানা ছিল না।চঞ্চল,কম বয়সী একটা মেয়ের কিনা মনে মনে এত গভীর রাগ চাপা ছিল।’

অনেক কষ্টে শেষে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে।তবে দুজনের পেটের খিধা একটা ভালো কাজ কক্রেছে আর তা হলো দুজনকে কাছে নিয়ে এসেছে।ভোরে ইমাদ চোখ খুলে পুতুলকে তার গায়ের সাথে লেপটে থাকতে দেখে চমকে সরতে গিয়েও সরলো না।মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো।পুতুলকে দেখতে নিষ্পাপ মনে হয়।কত সুন্দর করে সে মুখটা ইমাদের টি-শার্টের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে।আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে আর নিশ্বাস ফেলছে।ইমাদ হাতটা বাড়িয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।কপালে ঠোঁটজোড়া লাগিয়ে চুমু ও এঁকে দিলো।তারপর যখন তার হুস আসলো যে সে কেন এমনটা করছে তখন এক ঝটকায় উঠে বসে পড়লো।পুতুল নড়েচড়ে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়েছে।ইমাদ নিজের কপালে নিজে বাড়ি মেরে উঠে গেলো ফ্রেশ হতে।
পুতুল ঘুম থেকে উঠেছে আরও কিছুক্ষণ পর।ইমাদ ফ্রেশ হয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল ওর উঠার জন্য।মা যদি দেখে ইমাদ আগে উঠেছে আর পুতুল পরে তাহলে শুরু করবে আবার।পুতুল ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে ইমাদের দিকে।চোখটা কিঞ্চিত ডলে বিছানা থেকে নামলো সে।সোজা ওয়াসরুমে চলে গেলো মুখ ধুতে।ইমাদ বারান্দা থেকে ওকে দেখছিল।পুতুল মুখ ধুয়ে বের হতেই ইমাদ বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।পুতুল ও পিছু পিছু গেলো।মা ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে বসে ইয়োগা করছেন।পুতুল এক নজর তাকে দেখে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলো।ইমাদ ডাইনিংয়ের কাছে এসে ঢকঢক করে এক বোতল পানি খেয়ে ফেললো।মা বাম চোখ খুলে বললেন,’খুধা লেগেছে বুঝি?বউ খায়নি তো এখনও তাহলে পানি খাওয়ার কি দরকার তোর?বউ পানি খেলে তারপর তুই খাইস।আদরে ফেটে যায় একদম।’

ইমাদ চুপচাপ সোফায় এসে বসেছে।মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,’ইমাদের বাবা?এত কিসের ঘুম তোমার??সারাদিন ঘুমাতে দাও সেটা পারবে।অকর্মণ্যের ঢেঁকি একটা!’

বাবাকে বকতে বকতে ইমাদের মা রান্নাঘরে পা রাখতেই দেখলেন পুতুল তড়িগড়ি করে রুটি বানাচ্ছে।তিনি আর কিছু না বলে চলে আসলেন ওখান থেকে।ইমাদ এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে হালকা কেশে বললো,’আপেল একটা খাবে?’

পুতুল রাগী চোখে একবার তাকিয়ে রুটি বানানোয় মন দিলো আবার।ইমাদ ফ্রিজ খুলে জুসের বোতল নিলো খাবে বলে।পুতুল ঠাস করে খুন্তি রেখে বললো,’এত যে পানি খাচ্ছেন।পরে রুটি না খেলে তো আপনার আম্মু বলবে আমার দোষে আপনার পেটে সমস্যা হয়েছে।এক রাতে না খেয়ে এখন রুচিই চলে গেছে আপনার’
চলবে”

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২৯
Writer-Afnan Lara
.
ইমাদ অরেঞ্জ ফ্লেভারের জুসটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতন।
-‘বোতলটা ঠাণ্ডা অনেক।খেলে পরাণ জুড়িয়ে যাবে।নাহয় আরও পরে নাস্তা খাওয়া হবে।নতুবা মাকে দেখিয়ে একটা রুটি খেয়েই নেবো।ব্যাপার না।’

এসব ভেবে ইমাদ নড়েচড়ে বললো,’আমার প্রচুর খিধে।এই জুসটা পুরো খেয়ে আবার তোমার হাতের নরম রুটি খাওয়ার ক্ষমতা আর খিধে দুটোই আছে আমার।সুতরাং প্যারা নিও না।শান্তিতে,আরামসে রুটি বানাও’

কথাটা বলে ইমাদ একটা গ্লাস নিয়ে তাতে জুস ঢেলে পুতুলের হাতের পাশে অবধি এগিয়ে দিলো।এরপর নিজের জুসটুকু খেতে খেতে সোফায় এসে বসলো সে।নিজের বাসায় থাকার আনন্দই অন্যরকম।যদিও তমিজ আঙ্কেলের থেকে নেওয়া সেই ফ্ল্যাটটাও দূর্দান্ত তারপরেও কেন যেন এই বাসাটাতে শান্তি পাওয়া গেলো।দুচোখ বন্ধ করে বোতলের শেষ জুসটাও খেয়ে নিয়েছে ইমাদ।ছিপি লাগাতে লাগাতে মুচকি হেসে চোখ খুলতেই দেখলো মা কোমড়ে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ইমাদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঠিক হয়ে বসলো তারপর বললো,’কি হয়েছে?’

-‘খিধে লেগেছে বাবু??তোমার বউ জুস খেয়েছে?তুমি খাচ্ছো যে?আহারে কত আদর!’

ইমাদ ভ্রু কুঁচকে বোতলটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিলো।
-‘হয়ত নিজের শয়তান বন্ধুরাও এমন করে খোঁচায় না যেমনটা মা খোঁচাচ্ছে।হয়ত কি বলছি!জীবনেও আমার কোনো বন্ধু এমন করে খোঁচায়নি আমায়।এসব তো বন্ধুরা করবে।আর আমার কপাল দেখো। মা আমাকে এমন খোঁচায়,উঠতে বসতে!’

-‘কিরে কিছু বলিস না কেন?’

-‘কি বলবো?’

-‘তোর আদরের বউ খেয়েছে?তাকে না দিয়ে তোর জুস গলা দিয়ে নামছে তো?’

ইমাদ বুঝলো মায়ের এমন মজা করা বন্ধ করতে হবে।সে শক্ত হয়ে বসে বললো,’পুতুলের প্রতি তোমার এত টান?আগে জানতাম না তো।ও খেয়েছে নাকি খায়নি তা জানার জন্য তুমি এত উতলা হয়ে পড়েছো।জিও মা!!জিও!!!
তোমার মতন শাশুড়ি যেন ঘরে ঘরে হয়।পুতুলের ভাগ্য ভালো বলতে হবে’

ইমাদের মা তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একটিবার রান্নাঘরের দিকে চেয়ে বললেন,’আশ্চর্য! তোর বউয়ের প্রতি আমার টান হবে কোথা থেকে?আমি তোর কেয়ার করি।আর নয়ত তোর বাপের ও কেয়ার করি না।আমার এত সময় নাই।চোখে শশা লাগিয়ে টাইম পাই না,আবার পূত্রবধুর কেয়ার করতে যাব।’

ইমাদ হাত ভাঁজ করে দাঁত কেলালো।মা চোরের মতন ওর দিকে তাকিয়ে আছেন।ইমাদ দাঁত কেলাতে কেলাতে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কিছু একটা জানে যেটা এখন মা শুনলে তার খুব লজ্জা হবে।
মা তারপরেও লজ্জা পাবার ভয় না করে জিজ্ঞেস করেই বসলেন,’কেন ইমাদ এমন দাঁত কেলাচ্ছে।এর পেছনে রহস্য কি?’

ইমাদ হালকা ভাব নিয়ে টিভিটা অন করে বললো,’কি আবার!শুনলাম কাল পুতুল কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ঢোকার পর তুমি ওকে সান্ত্বনা দিয়েছিলে’

মা ঢোক গিলে অগ্নি দৃষ্টিতে বাবার রুমের দিকে তাকালেন।ইমাদের বাবা যত নষ্টের গোড়া।কি দরকার ছিল এই খবর ছেলেকে দিয়ে দেওয়া?ইজ্জতের এক ফোটা বালি ও রাখলো না।’

-‘কি হলো মা?এবার তুমি চুপ কেন?’

-‘তোর সাথে আজগুবি কথা বলার সময় আমার নেই।একটু জগিং করে আসি।মেদটা ইদানিং বাড়ছে খুব।নিজের শরীরেরও তো যত্ন নিতে হবে তাই না?’

ইমাদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’তাহলে চলো।আমি সহ যাই।আমারও মনে হয় হালকা ভূড়ি বেরিয়েছে।বিয়ের পরে ছেলেদের ভূড়ি বের হয় এটা আমি বিয়ের কদিনের মাথায় টের পেয়ে গেলাম।’

মা হন্তদন্ত করে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,’আমি আর কলোনির বাকি বয়স্ক মহিলারা থাকবে।তুই গিয়ে কি করবি?বসে বসে টিভি দেখ’

ব্যস মা লাপাত্তা।ইমাদ গেলো রান্নাঘরের দিকে।পুতুল রুটি বানানো শেষে এবার ডিম ভাজি করছে।গ্লাস খালি।তার মানে জুসটা খেয়েছে।ইমাদ তাই একটু খানি হেসে বাবার রুমের দিকে গেলো।বাবা চশমা চোখে লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে ফোন দেখছেন।ইমাদ তার পাশে এসে বসলো।বাবা ওকে দেখে বললেন,’কিরে?তোর মা কই?’

-‘জগিংয়ে গেছে’

-‘ভোরে উঠে একবার গেলো না?এখন আবার কি জন্যে গেছে?’

-‘লজ্জায় পড়ে।যাই হোক।তোমার এ কদিন কেমন কেটেছে?মানে আমাকে ছাড়া।এতদিন পর মায়ের সাথে থাকছো’

-‘সব মিলিয়ে নিরামিষ তরকারি উইথ্ বেশি ঝাল।’

-‘হাহাহা!সে যাই বলো না কেন।আমার আজকে পরিবারটা একেবারে সম্পূর্ন মনে হচ্ছে’

-‘সম্পূর্ন হতে এখনও অনেক দেরি।প্রধান হলো তোর মা।সে ঠিক তো সব ঠিক।আচ্ছা,পুতুল কি করছে?’

-‘নাস্তা বানাচ্ছে’

-‘খালি পেটে?বেচারি কাল থেকে না খেয়ে আছে।ইমাদ তুই আজকে হোটেল থেকে খাবার কিনে আনতে পারলি না?’

-‘মা জানলে কি হবে জানো তো?পুতুলকে জুস এক গ্লাস দিয়েছি।আমার কিছু করার ছিল না।জোর করে রুটি খাওয়াতে গেলে এখন উল্টে রাগ ঝাড়বে’

-‘শোন।একটা কথা বলি,তোর মা তোর কাছে যেমন ইম্পর্টেন্ট তেমনই পুতুল ও।তার দিকেও তোর খেয়াল রাখতে হবে।বিয়ের পরে ভুলটা করেই ফেললি।মেয়েটার জন্মদিনে তার সাথে এমন ব্যবহার করলি যে সে বাধ্য হয়ে আমাদের কাছে চলে এসেছে।এটা ঠিক না।মাকে ভালোবাসিস সেটা খুব ভালো,কিন্তু এখন তোর ভালোবাসার খাতায় আরেকটি নাম যোগ হয়েছে।তাকেও ভালোবাসতে হবে।কারণ তার সাথে তোর ভালোবাসার সম্পর্ক।
মাকেও ভালোবাসবি।তোকে কি বলছি!তুই তো অলরেডি তোর মাকে ভালোবাসিস।আমি বলছি পুতুলকেও ভালোবাস।’

-‘হুম।আসলেই যা করেছি ওর সাথে, সেটা ঠিক করিনি।ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না।ওর মাথায় রাগ উঠে বসে আছে। নামার নামই নিচ্ছে না।কি করি বলো?’

-‘কটা দিনের জন্য দূরে কোথাও থেকেও ঘুরে আয়।ভালো লাগবে’

-‘আমিও তাই ভেবেছিলাম।ও আমার কাছে এই আবদারটাই করেছিল সেদিন’

-‘তাহলে তো হয়ে গেলো।গিয়ে ঘুরিয়ে আন।দেখবি মন আগের মতন সতেজ হয়ে গেছে ওর’

-‘ঠিক আছে।তাহলে আজকেই ঘুরতে নিয়ে যাব।তুমি শুধু মায়ের দিকটা সামলিও।’

-‘ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না’
—-
নাস্তা করতে সবাই একসাথে টেবিলের আলাদা আলাদা কিণারায় বসেছে।পুতুল নিচের দিকে তাকিয়ে তার রুটি খাওয়ায় ব্যস্ত। ইমাদ হালকা কেশে নড়েচড়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,’আমার অফিসের কাজের জন্য সীতাকুণ্ড যেতে হবে।তাই আমি চাচ্ছি পুতুলকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব’

মা মুখে রুটি দিয়ে পুতুলের দিকে একবার তাকালেন তারপর চুপচাপ চিবানো শুরু করে দিলেন।ইমাদ উঠে বললো,’চা আমি আনছি।তুমি বসো’

পুতুল ও চুপ করে খাচ্ছে।সবাই নিরবতা পালন করছে এখন।বাবা রেডি হচ্ছে মায়ের সাথে এই টপিক নিয়ে কথা বলার জন্য।কিন্তু হলো তার উল্টো। মা এই ব্যাপারে একটা কথাও বলেননি।তার মাথায় কি ঘুরছে তা বাবাও বুঝছেন না,পুতুল ইমাদ তো দূরে থাক।পুতুলের মন একটু হলেও ভালো হয়েছে ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে।খিধের চোটে কখন যে তার খাবারটা শেষ করে ফেললো বুঝতেই পারেনি।ইমাদ আসতে দেরি করছে বলে পুতুল নিজেই গেলো দেখতে।গিয়ে দেখলো ইমাদ কাপে চা ঢালছে।পুতুল ওর থেকে চায়ের কাপের ট্রেটা নিয়ে ফিরেনআসলো আবার।
মা চা খেয়ে তার রুমে চলে গেছেন।ইমাদ অপেক্ষায় ছিল মায়ের মতামতের।
-‘কিন্তু মা দেখি কিছুই বলছে না।না নেগেটিভ আর না পজিটিভ।
বাবা বললো চিল করতে।মায়ের এমন গম্ভীর লুক দেখে চিল কেমনে করি?
ওদিকে পুতুল বিছানায় বসে এক দৃষ্টিতে আমাকেই দেখছে।আমি যদি বলি ব্যাগ গুছাও তাহলে সে গুছাবে।কালকের রাগের কারণে একটা শব্দ কথাও বলছে না।এমনিতে ঘুরতে যেতে এক পায়ে খাঁড়া।মেয়ে মানুষের মন আসলেই বোঝা দায়!’
.
-‘ওরকম তাকিয়ে আছেন কেন?’

-‘সেম।তুমিও আমার দিকে তাকিয়ে আছো’

-‘আমি তাকিয়ে আছি জানার জন্য যে আমি কি আজকের রান্না করতে রান্নাঘরে ঢুকবে নাকি ঘুরতে যাব বলে ব্যাগ গুছাবো?আপনার তো আবার মাথার থুরি কথার ঠিক নেই’

-‘যাব।ব্যাগ গুছাও।তবে কি দিয়ে গুছাবে শুনি?সব তো তমিজ আঙ্কেলের বাসায়।এক্সাইটেড হয়ে এটাই ভুলে গেছো?’

-‘তাহলে?কি করবো?’

-‘মায়ের সাথে কথা বলে আসছি।বাসায় ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে নেবে’
——
মা বারান্দায় এসে লুকিয়ে- চুরিয়ে দেখছেন ইমাদ আসছে কিনা।ইমাদের একটা অভ্যাস মায়ের রুমে আসার আগে মা বলে ডাকা। এখনও তাই।সে মা বলে ডাকতে ডাকতে আসছে এদিকে।ব্যস উনি কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে রইলেন।ইমাদ এগিয়ে এসে মাকে কাঁদতে দেখে তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।মায়ের হাত ধরে সে বললো,’কি হলো মা?কাঁদছো কেন?’

-‘কি আর বলবো।কাল থেকে প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা।চেয়েছিলাম তোকে বলবো না।কিন্তু তোর দূরে চলে যাওয়ার কথা শুনে আর চেপে রাখতে পারলাম না।’

-‘বসো এই চেয়ারে।ঔষধ খেয়েছো?আর তুমি কাঁদছো কেন?চোখে এত পানি।কতক্ষণ ধরে কাঁদছিলে?আমাকে একবার ডাকতে পারতে’

রুমের এক পাশে জানালা সেই জানালার ওপারে হলো বারান্দা।বাবা জানালা খুলে মাথা বের করে বললেন,’সব সেটিং স্প্রের কামাল’

ইমাদ ব্রু কুঁচকে বললো,’মানেহ্?’

-‘ঐ যে মেয়েরা মুখে হাবিজাবি মেখে পিসপিস করে পানির ছিঁটা দেয় না?ঐ স্প্রে গুলা দিয়ে তোর মা মাত্র স্প্রে করেছে মুখের উপর।আহারে কান্নার ডলাডল’

ইমাদ মায়ের দিকে তাকাতেই মা রেগে বললেন,’আমার কান্না তোমার কাছে ড্রামা মনে হয়?দেখছিস ইমাদ?তোর বাবা আমায় এখনও অবিশ্বাস করে।এতবড় ছেলের সামনে নিজের বউকে অপমান করতে লাগলো না তোমার?’

-‘তুমি যে ক্লাস সেভেনে থাকতে ড্রামা কম্পিটিশানে ফার্স্ট হয়েছিলে সেই খবর আমার শাশুড়ি আমায় দিয়েছে।হুহ!আমি সব জানি’

-‘ভালো।তাই বলে আমি এখন নাটক করছি না একটুও।ইমাদ আমি সত্যি সত্যি কাঁদতেছি দেখ’

-‘ইমাদ আমি কিছুক্ষণ আগে দেখেছি তোর মা স্প্রে বোতলে পানি ভরছিল।যদি সত্যি ওগুলো মিনারেল ওয়াটার না হয়ে চোখের পানি হয়ে থাকে তাহলে তোর মাকে আবার কেঁদে দেখাতে বল’

-‘দেখলি ইমাদ?এই কারণে তোর বাবার সঙ্গে আমি থাকি নাই এতবছর।কি পরিমাণ জ্বালাচ্ছে নিজের চোখেই দেখ’

ইমাদ হাত দিয়ে মায়ের মুখটা মুছে বললো,’কোমড়ে স্প্রে বোতলের মুখ দেখা যাচ্ছে। বের করে ড্রেসিং টেবিলে রেখে দিও।আমি তমিজ আঙ্কেলের বাসায় যাচ্ছি জামাকাপড় আনতে।ওখান থেকে চলে যাব।আচ্ছা!পেট ব্যাথার ঔষুধ কিনে দিয়ে যাব য়াওয়ার সময়’

মা ঢোক গিলে স্প্রে বোতলটা বের করে বললেন,’মাইগ্রেনের আনিস।পেট ব্যাথার না।মাইগ্রেনের ব্যাথা বেড়ে গেছে”

বাবা রুমের ভেতর রেলিং চেয়ারে বসে দুলতে দুলতে নখে ফুঁ দিচ্ছেন।ইমাদ চলে যেতেই মা স্প্রে বোতল নিয়ে এগিয়ে এসে বাবার মুখের উপর স্প্রে করে দিয়ে বললেন,’আমার সাথে তোমার এত কিসের শত্রুতা? ইমাদ শুধু তোমার ছেলে না,সে আমারও ছেলে।’

-‘আমি কি দাবি করেছি যে সে শুধু আমার ছেলে?বেকুবি পেয়েছে তো তোমার থেকে’
চলবে”””