বাবুই পাখি পর্ব-৪০+৪১

0
952

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪০
Writer-Afnan Lara
.
ডাইনিং টেবিলটাকে মনের মতন করে সাজাচ্ছে পুুতুল।শো কেসের সব সুন্দর বাটি সে বের করে ধুয়ে ওগুলোতে মাংস,ডাল,ভাত,পোলাও,সবজি,সব নিয়ে নিয়ে টেবিলে আনছে এক হাতে।মা আর খালা যোহরের নামাজ পড়তে গেছেন।
বাবা,ভাইয়া আর ইমাদের বাবা একসাথে গেছেন মসজিদে নামাজ পড়তে।বাকি রইলো ইমাদের মা।উনি নামাজ পড়বেন বলে হয়ত অজু করতে গেছেন।পুতুল সব টেবিলে সাজিয়ে এবার সালাদ কাটছে।মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।দুপুর দুটো বাজে।
-‘ইমাদ কি আজ দেরি করে আসবে?তাহলে কখন আসবে?সবার সাথে বসে কি লাঞ্চ করবে না?সে আসলে খুব ভালো হতো।মনে আনন্দ হতো।খেয়ে তৃপ্তি পেতাম।তাকে দেখলে মনটা এমনি এমনি ভালো হয়ে যায় আর কোনো উপাদানের প্রয়োজন হয় না।’

সালাদের সব সবজি এক এক করে কেটে বাটিতে সাজিয়ে সরষে তেল ঢাললো পুতুল।এরপর তেল একটু ছিঁটকে শাড়ীতে পড়তেই তা দেখে পুতুলের মনে আসলো সে নিজের নাজেহাল করে রেখেছে।সালাদটা ঢেকে রেখে পুতুল ছুটে গেলো রুমের দিকে।একটা লাল রঙের জর্জেটের শাড়ী এক হাতে আর অন্য হাতে তোয়ালে নিয়ে চললো বাথরুমের দিকে।
ইমাদ অফিসের কাজ সেরে রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরছে।মিসেস রওনক নামাজ পড়ে এসে টেবিলের সব খাবারের ঢাকনা সরিয়ে একবার দেখে গেছেন।মা আর খালা নামাজ পড়েছেন গেস্ট রুমে।নামাজ পড়া শেষ করে তারা ওখানে বসেই গল্প করছেন।মিসেস রওনক তাদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক না বলে তারাও আর ডাকেননি ডাইনিংয়ে তাকে দেখতে পেয়েও।মিসেস রওনক সব খাবার দেখে নিয়ে রুমে চলে গেছেন।পুতুল মাথায় তোয়ালে বেঁধে বাথরুম থেকে বের হতেই কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পেলো।সে খুলতে যাবার আগেই ইমাদের মা ছুটে এসে দরজা খুলে দিয়েছেন।ইমাদ মাকে জড়িয়ে ধরে সামনে তাকিয়ে পুতুলকে দেখতে পেলো।পুতুল মুখে হাসি ফুটিয়ে ওকে দেখছে।ইমাদ মাকে ছেড়ে বললো,’বাকি সবাই কই?’

-‘বাবারা আর বড় ভাইয়া মসজিদে গেছেন।মা আর খালা ঐ রুমে।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন’

মিসেস রওনক পুতুলকে দেখে ভ্রু কুঁচকে সোফায় গিয়ে বসলেন চুপচাপ।ইমাদ রুমে এসে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে পুতুলের দিকে তাকিয়ে থাকলো।পুতুল মাথার থেকে তোয়ালেটা খুলে নিয়ে বললো,’এই আপনার আসার সময় হলো?আর একটুর জন্য সবাই খেতে বসে যেতো’

ইমাদ টাইটা ঢিলা করে পুতুলের দু কাঁধের উপর দুই হাত রেখে বললো,’খেতে তো আর বসেনি।ঠিক টাইমেই এলাম।আরেকটু লেট হলে অবশ্য ভালো হতো না।কারণ এই দৃশ্য দেখতে পেতাম না’

-‘কোন দৃশ্য?’

-‘এই যে গোসলের পরে তোমার সিগ্ধতা।’

কথাটা বলে ইমাদ পুতুলের ভেজা চুলে আঙ্গুল দুটো বুলিয়ে নিলো। পুতুল চোখ নামিয়ে মিটমিট করে হাসছে শুধু।ইমাদ ওর মুখটা দুহাত দিয়ে ধরতেই মা এসে বললেন,’ইমাদ শুনছিস?’

ইমাদ আর পুতুল দুজনে সরে দাঁড়ালো।মিসেস রওনক হালকা কেশে বললেন,’লেবু নেই বাসায়।কয়েকটা লেবু কিনে আনবি?তোর বাবাকে বলেছিলাম।নির্ঘাত আসার সময় ভুলে যাবে।তুই তো এখনও চেঞ্জ করিসনি।তাই বলছি’

ইমাদ মাথার চুলগুলোকে এলিয়ে দিয়ে বললো,’হুম যাচ্ছি’

পুতুল লজ্জার কারণে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না।তাকালেও বা কি!তাকিয়ে দেখবে মিসেস রওনক চোখ বড় করে তাকিয়ে আছেন।
ইমাদ এক কাপড়ে আবার চললো লেবু আনবে বলে।পুতুল তোয়ালেটা বারান্দায় শুকাতে দিয়ে গালে হাত দিয়ে বাসার নিচের রোডটার দিকে তাকিয়ে আছে।কারণ সেখানে ইমাদকে দেখা যায়।ভ্যানগাড়ী থেকে সে লেবু কিনছে।পুতুল দূর থেকে ওকে দেখছে তা সে একেবারেই জানত না
যখন লেবু হাতে উপরে তাকালো।পুতুলের চোখে চোখ পড়লো তার।পুতুল সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে পড়েছে।ইমাদ লেবুর থলিটা হাতে ঝুলিয়ে হাঁটা ধরতেই বাবার ডাক শুনে থেমে গেলো। উল্টো পথ থেকে বাবা,শ্বশুর মশাই আর আসাদ ভাই আসছেন।উনারা কাছে আসতেই ইমাদ সালাম দিলো।বাবা ইমাদের ঘাঁড়ে হাত রেখে বললেন,’আমি তো লেবুর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।ভালো করেছিস নিয়ে।চল’

ইমাদ পুুতুলের বাবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ভালো আছো কিনা।উনি বললেন ভালো আছেন।এতক্ষণ ওরই অপেক্ষা করছিলেন তারা সেটা বললেন।এসব বলতে বলতে বাসায় ফিরে আসলো সবাই।এসেই ডাইনিংয়ে একসাথে বসলো খাবে বলে।ইমাদ জলদি করে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে।পুতুল,খালামণি ব্যস্ত খাবার আনা নেওয়া নিয়ে।
সবার খাওয়া শেষ শুধু পুতুল খায়নি।খায়নি বলতে সময় পায়নি।যখন পান হাতে সোফায় বসলো সবাই, তখন পুতুল নিজের খাবার নিয়ে রুমে এসে বসেছে।ইমাদ ব্যস্ত হয়ে মলমটা খু্ঁজছে।এতশত কাজের ফাঁকে পুতুল একবারও তার হাতে মলম লাগায়নি আজ সারাদিনে।তারউপর ঔষুধ তো খায় ও নি।পুতুল মুখে লোকমা দিয়ে বললো, কি খুঁজছেন?’

-‘লাঠি।তোমাকে মারবো বলে’

-“কেন?আমি কি করলাম?’

-‘হাতের খবর আছে?কাল যে সারাদিন আমি খাইয়ে দিয়েছিলাম আর আজ উনি সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছেন।হাত কি চাঙ্গা হয়ে গেছে?’

-‘আসলে ব্যাথা অনুভব করিনি।আমার মাথায় ছিল কি করে সবাইকে নিজের হাতের রান্না খাওয়াবো।বসে বসে ব্যাথা লাগলো কি লাগলো না এত ভাববার সময় ছিল না’

-“এখন তো হয়েছে সময়।ঔষুধ খাবে সাথে মলম লাগাবে।মলমটাই পাচ্ছি না,বিরক্ত সীমা ছাড়িয়ে আসছে।’

-‘আমি সকালে রুম গোছাতে গিয়ে হয়ত অন্য জায়গায় রেখেছি।কোথায় রেখেছি সেটা মনে আসছে না’
——
বাবা মা,আসাদ ভাইয়া আর খালামণি চলে গেছেন বিকালের নাস্তা সেরেই।ইমাদ ঘুমাচ্ছে।পুতুল দরজা লাগিয়ে রুমে আসতে নিতেই ডাক পড়লো মিসেস রওনকের।ঢোক গিলে হাতে পানের বাটুয়া নিয়ে পুতুল তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।উনি ব্রু কুঁচকে বেশ অনেকক্ষণ পুতুলের হাতের বাটুয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।এরপর বড় করে নিশ্বাস ফেলে বললেন,’তুমি জানো আমি পান খাই না?’

-‘ভাবলাম খান।সরি’

-“আমার দাঁত জীবনে লাল দেখেছো?’

-“নাহ’

-‘তো?যাই হোক তোমাকে ডেকেছি অন্য কারণে।আমি মোটেও তোমাকে মন থেকে মানতে পারিনি।এখন পর্যন্ত না।চেয়েছিলাম তোমাকে মেনে নেওয়ার জন্য।কারণ আমার ছেলে তুমি বলতে পাগল।তার মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক চেষ্টা করেও তোমাকে আমার ইমাদের বউ হিসেবে কিছুতেই মানতে পারছি না আমি।শেষে আমার কলিগ আমাকে একটা বুদ্ধি দিলো। সে বললো হয়ত নাতিপুতি আসলে সব মনমালিন্য দূর হয়ে যাবে।তাদের মুখের দিকে চেয়ে হয়ত তোমাকে মনে ধরবে আমার।একজন পুত্রবধূর থেকে শাশুড়ি আর কি বা চাইবে।বাঁচি কদিন জানি না,বলতে পারি না।
আমি সহজে অসুস্থ হই না।তবে যখন অসুস্থ হই তখন মৃত্যুর কথা মনে পড়ে যায়।এত অসুস্থ হই আমি।মানে মনে হয় আর একবার অসুস্থ হওয়া মানে মরে যাবো।আমাদের বাঁচা- মরা সব আল্লাহ জানেন। কখন কি হয় বলতে পারি না।তাছাড়া ইমাদের বাবা তো আমার থেকেও বেশি অসুস্থ।এই বুড়ো বয়সে আমাদের একাকিত্ব কমাতে পারে ঐ নাতিপুতিরা।আমি জানি হয়ত তোমরা এখন এসব ভাববে না তাও বলছি,আমার খুব ইচ্ছে সেই ছোট ছোট হাত ধরে দেখবো।কোলে নিয়ে ঘুরবো।আমাকে দিদুন ডাকবে।ভালোবাসবে আমায়।ছোট্ট ইমাদের কথা খুব করে মনে পড়বে আমার তখন। সেই অতীতে ফিরে যেতে চাই।তোমার থেকে আমার এইটুকুই চাওয়া।’

পুতুল মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।মনে মনে ভাবছে সে বাজিতে হেরে গেছে।এবার ইমাদের চোখে চোখ রেখে সে লজ্জায় লাল হতে পারবে না কিছুতেই।এটাই তো শর্ত ছিল ইমাদের।ওখান থেকে চলে এসে পুতুল তাদের রুমের ভেতর পা রাখলো।ইমাদ ওর বালিশটা বুকে ধরে ঘুমাচ্ছে।
-‘মা যে বাচ্চার কথা বললো এটা যদি আমি উনাকে না জানাই তাহলে উনি জানবেন কি করে?দারুণ বুদ্ধি এটা।হেহে!!আমি আরও হুদাই এত চিন্তা করছিলাম।জিজ্ঞেস করলে বলবো মা আমাকে নাতিপুতির কথা কিছুই বলেন নাই।হুম এটাই ফাইনাল’
—–
ইমাদ ঘুম থেকে উঠার পর থেকে খেয়াল করেছে পুতুল যেই কাজই করুক না কেন ইমাদের দিকে চোরের মতন তাকায় শুধু।মানেটা বুঝলো না সে।মুখটা ধুয়ে এসে চায়ের কাপ হাতে নিয়েও সেম কাহিনী দেখলো পুতুলের হলোটা কি তাই ভাবছে সে।মা ওর পাশে এসে বসলেন।হাসিমুখে বললেন,’জানিস ইমাদ?’

মায়ের কথা শুনে ইমাদ ঘুরে বসে বললো,’হুম বলো’

-‘বিয়েবাড়িতে কত বাবু দেখলাম।আমার না মন ওখানেই রয়ে গেছে’

-‘তুমি তো বিয়ে বাড়ি গেলে একবার একটা দেখে মুগ্ধ হও।তা এবার বাবু দেখে মুগ্ধ হলে?’

মা গালে হাত দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন,’হ্যাঁ।খুব কিউট কিউট।একটার নাম ছিল নিসাদ।দেখতে এত সুন্দর,কথা এত সুন্দর করে বলে।আমার তো মন চেয়েছে ওরে বাসায় নিয়ে আসি।ঐ যে আমার কলিগের ফুফাতো বোনের নাতি।একদম রসগোল্লার মতন গাল ‘

-‘আচ্ছা তারপর?’

-‘তো আমিও পুতুলকে বলেছি।আমার সেরকম নাতিপুতি চাই’

পুতুল কপালে হাত দিয়ে পর্দার আড়াল থেকে চলে গেলো রুমের দিকে।ইমাদ কথাটা শুনে পেছনে তাকালো সঙ্গে সঙ্গে।পুতুল গায়েব।
তার মানে মা পুতুলকে এই কথা বলেছে আর পুতুল ওকে জানায়নি কারণ সে বাজি হেরেছে।
-‘আজ পুতুলের একদিন কি আমার যতদিন লাগে’

-‘কিরে চা খাবি না?উঠে পড়লি কেন?’

-‘খাওয়া শেষ।এবার দাঁত খুঁচবো’

ইমাদ পকেটে হাত ঢুকিয়ে চলে গেছে।মা চায়ের কাপটা নিয়ে রান্নাঘরে রেখে আসলেন।ঐ বাচ্চাটার ছবি চোখের সামনে ভাসছে।তারপর মনে মনে খুশি হলেন এই ভেবে যে কদিন পর তার বাসায় ও এমন সুন্দর বাবু আসবে।একদম ইমাদের মতন দেখতে।’

ইমাদ রুমে এসে দেখলো পুতুল রুমের শেষ প্রান্তে ওয়ারড্রবের উপর উঠে বসে আছে হাঁটু ভাঁজ করে।ইমাদ কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’তোমাকে কি মারতাম আমি?’

-‘মারলে মারেন।তাও আমি চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে পারবো না তাও লজ্জা না পেয়ে।মাফ করেন’

-‘নামো আগে।এসব কি বাচ্চামো?তোমাকে বলছি না ম্যাচিউর হতে?’

-‘বাজির শর্তটা উড্ডয়ন করেন’

-‘ওকে করলাম।নামো এখন’

পুতুল আস্তে আস্তে নামলো।নিচে নেমে ইমাদের সামনে দাঁড়াতেই ইমাদ খপ করে ওর দুহাত ধরে ফেললো।তারপর বললো,’পালাবে কই?বাজি হেরেছো বলে এত বড় একটা কথা তুমি আমায় বললে না?’

-‘বলে কি হতো শুনি?’

-‘কি হতো মানে?তুমি আদৌ বুঝেছো যে মা তোমায় মেনে নিয়েছে?’

-‘না নেয়নি।এত সোজা না।এটা আমি আগেও জানতাম।উনি বলেছেন বাচ্চা আসলে হয়ত মানতে পারবেন।এখনও মানতে পারেন নি।স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন’

ইমাদ পুতুলের হাত ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসে বললো,’সেটাই!মহা ঝামেলা তো!যদি বাবু আসার পরেও না মানে তখন?’

-‘আমার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে আপানর মাকে মানাতে মানাতে।আপনি কি কিছুই করতে পারবেন না?আমি চাই উনি এখনই আমাকে মানুক’

-‘মা অনেক কঠিন মানুষ।সহজে তাকে দিয়ে কিছু করানো যায়না।হয়ত যখন শুনবেন তুমি প্রেগন্যান্ট তখনই মেনে নিতে পারেন।ওসব বাদ দাও।সামনে এসে বসো আমার। চোখে চোখ রেখে লজ্জা পেতে পারবেনা।শর্ত তোমায় পূরণ করতেই হবে’
চলবে”

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪১
Writer-Afnan Lara
.
পুতুল সাহস নিয়ে ইমাদের চোখের দিকে চেয়ে আছে।লজ্জা এতক্ষণ করছিল না একটুও।নিজেকে শক্ত রেখেছিল সে।কিন্তু বিপত্তি ঘটে গেলো অন্য কারণে।আর তা হলো ইমাদ পুতুলের হাত দুটো শক্ত করে ধরেছে।নিমিষেই পুতুলের চোখজোড়াতে লজ্জার মেলা বসে গেলো।চোখদুটো নেশাগ্রস্ত মনে হতে লাগলো সময়ের সাথে সাথে।পুতুল চোখ বন্ধ করে একটুখানি হেসে ফেলেছে।ইমাদ ও হাসছে। সে জানত পুতুলের হাত ধরলেই পুতুল লজ্জায় টইটুম্বর হয়ে যাবে।হলো ও তাই।পুতুল হাত ছাড়িয়ে বললো,’শর্ত কিন্তু হাত ধরা ছিল না।’

-‘হাত না ধরাও ছিল না।আমার ইচ্ছে আমি শর্তটা কিভাবে পূরণ হতে দেখতে চাই।’

পুতুল কপাল কুঁচকে ইমাদের মাথার ঘন চুলগুলোকে হাত দিয়ে মিহিন করে দিয়ে বললো,’শুধু চা খেলেন।নাস্তা তো করলেন না’

-‘না।রিজবি আর চঞ্চলের সঙ্গে একটু দেখা করতে যেতে হবে।ওদের সাথেই খাবো’

কথাটা বলে ইমাদের হাত উল্টো করে ঘড়ি দেখে বললো,’এখনই যেতে হবে, দেরি হয়ে গেলো।ওরা নিশ্চয় আমার অপেক্ষা করছে’

ইমাদ উঠে চলে গেছে।পুতুল বিছানাটা ঠিক করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো যতক্ষণ অবধি ইমাদকে দেখা যায়।
বিকালের সময়টা শুল্ক শুল্ক হারে নামছে।কদিন পর শীতের ক্ষণ শুরু।বিকাল দেখেই টের পাওয়া যায় ভাদ্র মাস শুরু।অনেক দূরে কমলা রঙের মেঘ জমে আছে।যেন সূর্য তার আলো রঙ তুলি দিয়ে গুলিয়ে দিয়েছে নীল আকাশের উপর।কি সুন্দর লাগছে দেখতে।শহরের ইট পাথরের রেশ কাটিয়ে একটু ঘুরতে ইচ্ছে করে, যেখানে কিনা গাছ থাকবে,নদী থাকবে,শান্তিতে শ্বাস নিতে কোনো দ্বিধাবোধ হবে না।কত না ভালো হবে সেসব।ইমাদের মায়ের চিৎকারে পুতুলের হুস ফিরলো।চমকে পেছনে তাকালো সে।ইমাদের মা চেঁচাচ্ছেন সম্ভবত ওর বাবার উপর।পুতুল এগিয়ে এসে শুনার চেষ্টা করলো।উনি বলছেন ইমাদের বাবা কেন ফ্রিজ থেকে নিয়ে মিল্কশেক খেয়েছেন।ওটা তার জন্য নিশ্চয় পুতুল বানিয়ে রেখেছিল।আসলে কিন্তু পুতুল এটা ইমাদের বাবার জন্যই বানিয়েছিলো।জিভে কামড় দিয়ে সে আবার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।তার কারণে বাবা বকা খাচ্ছেন। এখন এই সত্য কথা বলে আসলে আরেক দফা বকা খেতে হবে, তার চেয়ে চুপ করে থাকা শ্রেয়।নিচের রোডটার সামনে পেছনে দেখে নিলো পুতুল।সম্পূর্ন ফাঁকা রাস্তা।অনেকক্ষণ পর কারোর দেখা মেলে।ইমাদ যদি এখানে এসে আড্ডা দিতো।তাহলে কতই না ভালো হতো’
________
পুতুল ইউটিউব দেখে একটা কাঁথা সেলাই করছে।মনে মনে তার বাবু বাবু ফিলিংস লাগছে। ওসব ভেবে কাঁথা সেলাই করতে বসেছে সে আজ।ইমাদের মা টিভি দেখতে এসে একবার এই রুমে উঁকি মেরে দেখলেন বিষয়টা।মুচকি হেসে আবার সরে এসেছেন ওখান থেকে।পুতুল কাঁচা হাতে এলোমেলো করে একটা কাঁথা সেলাই করলো অনেকক্ষণ সময় লাগিয়ে।ইমাদ বাসায় ফিরেছে রাতের সাড়ে দশটায়।বাবা -মাকে খাবার খাইয়ে পুতুল ইমাদের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।শেষে ইমাদ এসে ওকে ঘুম দেখে ওঠালো কলিংবেল বাজিয়ে।পুতুল এসে দরজা খুলে রাগ করে বললো,’আরেকটু থেকে আসতেন’

-‘অনেকদিন পর দেখা হলো তো।প্রচুর আড্ডা দিলাম।কখন সময় কেটে গেলো বুঝতেই পারিনি’

পুতুল গাল ফুলিয়ে ডাইনিংয়ের কাছে এসে ইমাদের জন্য প্লেট সাজাচ্ছে।ইমাদ ওর কাছে এসে কিছু বলতে যাবার আগেই সে মুখ ঘুরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। মনে মনে ইমাদকে বকতে বকতে লেবু কাটছে পুতুল।ইমাদ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,’সরি ম্যাডাম।কি করলে রাগ যাবে তা একটু বলবেন?’

পুতুল মুখ ঘুরিয়ে বললো,’আমি যা বলবো শুনবেন?’

-‘অবশ্যই’

-‘কানে ধরে বলেন,’আমি নিজেই ইমম্যাচিউর তাই পুতুলকে বলি ইমম্যাচিউর’

-‘কিহহহ!এটা মিথ্যে’

-‘বলতে হবে’

ইমাদ কি আর করবে।বাধ্য হয়ে বললো,’আমি নিজেই ইমম্যাচিউর তাই পুতুলকে বলি ইমম্যাচিউর’

পুতুল হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে,হেসে হেসে তাকের সাথে হেলান দিয়ে বললো,’বেশ হয়েছে।হাহা!’

ইমাদ দুষ্টুমি করে কাছে এসে পুতুলকে কোলে তুলে নিয়েছে।পুতুলের হাসি গায়েব।চোখ বড় বড় করে সে ইমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।ইমাদ ওকে নিয়ে হাঁটা ধরলো। মা বাবার রুমের সামনে দিয়ে যাবার সময় পুতুল মুখে হাত দিয়ে ফেললো।তারা ঘুমিয়ে আছেন দুজনেই।ইমাদ ওকে রুমে নিয়ে আসতেই পুতুল বললো,’আপনার জন্য না খেয়ে ছিলাম।আমি ডিনার করবো চলুন ডাইনিংয়ে’

ইমাদ যেন কথাটা শোনেই নাই।পুতুলকে নামিয়ে সে দরজা লাগাতে গেছে।দরজার ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে ইমাদ বললো,’আজ তোমার সেই সকল লজ্জা আমি চিরতরে দূর করবো’

পুতুল খাটের স্ট্যান্ডের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বললো,’কিছু লজ্জা থেকে যেতে হয়।মেয়েদের শোভা পায়।’

-‘লজ্জা দূর করতে চাইলেই যে সেটা দূর হয়ে যাবে তা তো বলিনি।আমি জানি, আজ আমি তোমায় স্পর্শ করার পর তুমি আরও বেশি লজ্জা পাবে।কাল সকালে আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতেও হয়ত তোমার ভাবতে হবে।আমার সামনে আসবে না।দূর থেকে দেখবে’

পুতুল নিশ্চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর মুখ ফুটে বললো,’যদি কাল থেকে সত্যি সত্যি লজ্জাটা পরিমাণে কম হয়ে যায় আমার?’

-‘আমার পুতুলকে আমার চেনা হয়ে গেছে।তার লজ্জা আরও দিগুণ বেড়ে যাবে।গ্যারান্টি দিলাম’

কথাটা বলে ইমাদ আলো নিভিয়ে ফেলেছে।ড্রিম লাইট জ্বালাইয়নি।পাশের দালান গুলো থেকে যে কিঞ্চিত আলো রুমে এসে জায়গা দখল করছে ওগুলো দিয়েই সে আজ পুতুলকে দেখবে।ভালোবাসবে,কাছে টেনে নেবে।লজ্জার শেকড়ের আজ সমাপ্তি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মিসেস রওনক বাহিরের রুমের আলো জ্বলছে দেখে উঠে আসলেন দেখার জন্য।ডাইনিংয়ে প্লেট সাজানো খাবার রাখা কিন্তু কেউ নাই।লাইট জ্বালানো রান্নাঘরেও।
-‘দুজনে এসব রেখে তাহলে গেলো কই?’

মিসেস রওনক কোমড়ে হাত দিয়ে দরজার কাছে এসে বললেন,’অমি??খেয়েছিস?সব ওরকম খোলা রেখে গেছিস কেন?কিরে?’
ধুম ধুম করে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে তিনি ইমাদকে ডেকেই চলেছেন।মনে হয় দরজা ভেঙ্গে ফেলবেন।বাবা ঘুম থেকে উঠে এসে বললেন,’কি হলো?এত রাতে ওমন ষাঁড়ের মতন চেঁচাচ্ছো কেন?লাল জামা দেখলে নাকি?’

-‘আমাকে খোঁচানো ছাড়া তোমার আর কাজ নেই না?যাও ঘুমাতে।আমার ছেলে খেয়েছে কিনা ঐ খবর নিতে এলাম।মনে হয় না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।খাবারগুলো দেখো না কেমন ফেলে রেখেছে?ইমাদ শুনছিস?আমার ইমাদ নাহয় শুনছে না,ঐ মেয়েটাও কি কানে তুলো দিয়ে রেখেছে?’

-‘তুমি চলো আমার সাথে।ওরা কি এত রাতে খায়?হয়ত আরও দেরি করে খাবে’

-‘তাহলে নিশ্চয় জেগে আছে।আমার ডাকের সাড়া দেয়না কেন তাহলে?আমি কি কোনো উল্টা পাল্টা কিছু বলেছি যে ওরা আমার সঙ্গে রাগ করেছে?’

-‘উফ!রওনক তোমাকে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না’

ইমাদ দরজা খুললো ঠিক সেসময়ে।মা সাথে সাথে রুমে ঢুকে বললেন,’ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছিলি নাকি তোরা?’

-‘ননননা মানে হ্যাঁ’

-‘না নাকি হ্যাঁ?কোনটা?আর তোর বউ কই?’

-‘পপপপপুতুল তো ওয়াশরুমে’

-‘আমি যে এত ডাকলাম।ওয়াশরুম থেকে এসে দরজা খুলতে পারলো না?তুই নাহয় ঘুমিয়ে ছিলি’

-‘না।পুতুল ও ঘুমিয়ে ছিল।ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে গেছে’

-‘মানে আমার দরজা না খুলে সে ওয়াশরুমে গেছে?দেখেছো ইমাদের বাবা?’

ইমাদ মাথা চুলকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বাবা মায়ের হাত ধরে বললেন,’তোমাকে বুড়ো মহিলাদের হরলিকস্ খাওয়াতে হবে।বয়সের সাথে সাথে তোমার কমন সেন্স গায়েব হয়ে যাচ্ছে।যাকে বলে ওলড লেডি হরলিকস্ খাওয়ানো দরকার’

ইমাদ ফিক করে হেসে ফেললো।মা ভ্রু কুঁচকে বললেন,’আমি বুড়ো??’

-‘তুমি চলো আমার সঙ্গে।অনেক হয়েছে’

বাবা মায়ের হাত ধরে নিয়ে গেছেন।মা যেতে যেতে বললেন,’কাল তোর বউকে কৈফিয়ত দিতে হবে।সে কেন দরজা না খুলে ওয়াশরুমে গেছে।আর তোরা না খেয়ে ঘুমাতে গেলি বা কেন?’

-‘রওনক থামবে তুমি?’

-‘আমি বুঝলাম না…তুমি…’

-‘কি?কথা থামালে কেন? বলো না!আরও বলো।ইজ্জত আর রাখলে না আমার।’

মিসেস রওনক মাথা চুলকে বললেন,’আসলেই।এত রাতে আমি কেন ওদের ডিস্টার্ব করলাম।আমি তো এতকিছু ভাবিনি।ভাবলাম রাতে খায়নি নিশ্চয় আমার সাথে রাগ করেছে।বা এমন কিছু একটা হবে’

-‘যা গণ্ডগোল করার করে ফেলেছো।এবার দয়া করে ঘুমাতে আসো।’

মিসেস রওনক জিভে কামড় দিয়ে বললেন,’আমার জন্য ঐ যে কি বলে বুড়োদের হরলিকস্ কিনে এনো কালকে।ওটার খুব দরকার।’
——-
পুতুল উঁকি মেরে বললো,’গেছেন?’
ইমাদ হাসতে হাসতে বিছানায় বসে বললো,’গেছেন’

পুতুল বাহিরে বেরিয়ে হাঁপ ছেড়ে বললো,’আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।ভাবলাম না জানি ওয়াশরুমে চলে আসে আমাকে দেখার জন্য’

ইমাদ পুতুলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো,’তোমাকে এই হালে দেখলে মা কি বলতো জানো?’

-‘কি বলতো?’

-‘বলতো,দেখেছো ইমাদের বাবা??এই মেয়ে শাড়ীও পরতে জানে না।যেন সদ্য বিয়ে করা বউ এসেছেন।
মহারাণী।শাড়ীরে উল্টে ড়ীশা পড়েছেন তিনি’

পুতুল ঘুরে ফিরে বললো,’তাহলে যাই দেখিয়ে আসি’

-‘আরে না না।লাগবে না।
বাবা, মাকে বুঝিয়ে নিয়ে গেছে।আগুনে ঘি ঢালতে যেও না।প্রচুর খিধে পেয়েছে। আমি যাচ্ছি।তুমি শাড়ী ঠিক করে পরে আসো। আমার সাথে খেতে বসবে’

শাড়ীর কুচি করতে করতে পুতুল কিছুক্ষন আগের ঘটে যাওয়া সেই স্পর্শের গভীরতা মনে করে কুচি গুলো হাত থেকেই ছেড়ে দিলো।এরপর আবারও কুচি ধরে পেছনে তাকালো।ইমাদ মুখে লোকমা দিয়ে মাথা উঁচু করে বাটির ঢাকনা সরিয়ে দেখছে কোনটাতে কি আছে।জলদি করে শাড়ীটা পরে পুতুল কাছে এসে বসলো ইমাদের।ইমাদ মুচকি হেসে বললো,’শাড়ী পরতে এতক্ষণ লাগে?আমার অর্ধেক ভাত শেষের দিকে।তোমার প্লেট রেডি।খাওয়া শুরু করো’

পুতুল প্লেটে হাত ডুবিয়েছে ঠিক কিন্তু মুখে দিতে পারছে না।এই প্রথম ইমাদের সামনে এসে তার এরকম লাগছে।ইমাদ পুুতুলের এভাবে বসে থাকা দেখে বললো,’জানতাম এমন কিছু হবে।আমি খাইয়ে দেবো?’

-‘নাহ।আমি পারবো’
—–
-‘তোমাকে বললাম না ঘুমাও?’

-‘দেখলে ইমাদের বাবা??ঐ মেয়েটা খেতে বসেও আমার ছেলেটাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমার ছেলেটার হাতে খাওয়ার জন্য যত্তসব নাটক করছে”

-‘বিয়ের পর টানা তিনদিন তুমি আমার হাতে খেয়েছিলা।মনে আছে তোমার?তাও কেনন, কারণ তুমি নতুন পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত না’

-‘সব কিছুতে আমাদের সঙ্গে তুলনা করতে হবে তোমার?’

-‘হ্যাঁ হবে।তোমাকে বুঝতে হবে ওদের ব্যাপারটা।এসব শুনবে নাকি কাল সকালে ওদের তমিজের বাসায় পাঠিয়ে দেবো?সেটা ঠিক হবে?’

মিসেস রওনক দরজাটা লাগিয়ে ফেরত চলে এসেছেন ঘুমাতে।ইমাদ প্লেট নিতে যেতেই পুতুল ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো।নিয়েই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।ইমাদ ওর মাথায় হাত রেখে বললো,’আস্তে খাও।তাড়াহুড়ো নেই’
এরপর নিজের খাবারটা শেষ করে পুতুলের হাতের যে কাজ আছে ওটা করতে গেলো সে।প্লেট ধুতে।
পুতুল নিজের প্লেট নিয়ে ওর পিছু পিছু এসে বললো,’আপনি করছেন কেন?মা দেখলে আমাকে বকবে।এইটুকু কাজ আমি নিজেই করতে পারবো’

মিসেস রওনক আবারও উঁকি দিয়ে বললেন,’দেখলে ইমাদের বাবা?’

-‘না দেখবো না।তুমি বরং আজ বাহিরের রুমেই ঘুমাও।প্রতি পাঁচ মিনিট পর এক ডায়ালগ।দেখলে ইমাদের বাবা!!আমি কি দেখবো?তোমার মতন ওরকম চুরি করে দেখার কারবার নাই আমার।’
চলবে”