বাবুই পাখি পর্ব-৪৪+৪৫

0
1025

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪৪
Writer-Afnan Lara
.
-‘সেরভেনটিস একটা উত্তম কথা বলেছিলেন’
“মেয়েদের চরিত্রই হচ্ছে তাই,যখন আমরা ভালোবাসতে যাই তখন তারা ভালোবাসে না,যখন তারা প্রেম জানাতে আসে তখন আমরা তাদের ভালোবাসি না”

পুতুল রেগে আরেকটা বালিশ ছুঁড়ে মারলো ইমাদের মুখের দিকে
ইমাদ আর কি করবে।তার হাতে এখন একটাই কাজ।আর তা হলো পুতুলকে শান্ত করা।এভাবে হলে তো হবেনা।ওর এমন পাগলামো দেখলে, দেখা গেলো কাল কুমিল্লা যাওয়াটাই বরবাদ হয়ে যাবে।
ইমাদ তাই পুতুলের হাতটা টেনে ধরে ওকে নিয়ে আসলো ডাইনিংয়ের কাছে।পুতুল খাবারের দিকে তাকিয়ে আরেক ধাপ কেঁদে নিয়েছে।ইমাদের গলা দিয়ে খাবার নামছে ন। পুতুলের কান্না দেখে।তাও কোনোরকমে দু চার লোকমা সে খেয়েছে।পুতুল তো তার চেয়েও কম খেয়ে চলে গেছে গেস্ট রুমের দিকে।সে ইমাদের সাথে রাগ নাকি অন্যকিছু ইমাদ তার কিছুই বুঝছে না।ঠিক সেসময়ে মা ও এসে হাজির।ইমাদ মাকে জানালো সে কুমিল্লা চলে যাবে কাল।কথাটা শুনে মিসেস রওনকের মুখের ভাবগতি পালটে গেছে।চিন্তিত হয়ে সবার আগে জিজ্ঞেস করলেন একা যাবে নাকি পুতুল ও যাবে।ইমাদ তার জামাকাপড় ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,’তাকে বলেছি কিন্তু সে যাবেনা তোমাদের একা রেখে’

-‘এই দুমাসই তো।এ আর এমন কি?এদিক থেকে ওদিক তাকালেই মাস শেষ হয়ে যাবে’

পুতুল চৌকাঠটা ধরে ইমাদের ব্যাগ গোছানো দেখছে।-‘ইমাদকে আজ এত সুন্দর লাগছে কেন?চলে যাবে বলে?আজ তার প্রতি এত টান বেড়ে যাচ্ছে কেন?পাগল হয়ে যাচ্ছি কেন?আমাকে তো নিজেকে সামলে নিতে হবে,আমিই তো জোর গলায় বললাম আমি যাব না।তাহলে কেন এমন করছি?আমার তো শক্ত হতে হবে।’

এসব ভেবে পুতুল চোখ মুছে নিয়েছে।মিসেস রওনক তার রুমে গেছেন ফ্রেশ হতে।এরপর খেতে আসবেন।বিকালের আসার কথা কিন্তু তিনি দুপুরেই ফিরে এসেছেন কারণ পপি চলে গেছে সকালে।রান্না করবে কে?
ইমাদ টি শার্ট গুছাতে গিয়ে পুতুলকে দেখতে পেলো।পুতুল মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে ওদের রুমের দরজার চৌকাঠের পাশে।ইমাদ টি শার্ট রেখে এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরে ভেতরে নিয়ে আসলো।পুতুল আবেগে ওকে জড়িয়ে ধরে ফেলেছে ততক্ষণে।ইমাদ ওর পিঠে হাত রেখে বললো,’জামাকাপড় গুছাও।আমি তোমাকে নিয়ে যাব’

-‘না তা হয়না।আপনি এত স্বার্থপর কেন বলুন তো?বাবা মাকে এভাবে একা রেখে যাওয়ার কথা বলতে আপনার বুকে লাগেনা?’

ইমাদ পুতুলকে দূরে সরিয়ে ফেলে কিঞ্চিত রেগে বললো,’এত ধাঁচের কথা বলবে না।সব তুমিই করতেছো।আমি দর্শক হয়ে রিয়েক্ট করছি।বাবা মাকে ফেলে যাবেনা,আবার সেই তুমি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরো,বোঝাও তোমার কষ্ট হয়!প্রচুর কষ্ট হয়।আমি কি বললে তোমার ভাল্লাগবে?’

পুতুল চোখ নামিয়ে আস্তে করে বিছানার কোণায় বসে বললো,’জানি চলে যাবেন, এটা আটকাবে না।আমি কাঁদছি তার মানে এই নয় যপ আমি বোঝাতে চাই আমাকে সহ নিয়ে যান।ভুল বুঝবেন না।আমার কাছে আপনার সাথে আপনার পরিবারের দুজন সদস্য ও অনেক জরুরি।শুধু নিজের কথা ভাবলে চলবে না।উনাদের আর ছেলেমেয়ে নেই।আমি একমাত্র পুত্রবধু হবার পরেও তাদের নিয়ে ভাববো না?এদিক দিয়ে আপনার জন্য ও কষ্ট হয়।আমি কোনদিকে যাব?আপনি আপনার জায়গা থেকে দেখছেন।একবার আমার জায়গা থেকে দেখুন’

ইমাদ ব্যাগটা ঠিক করে রেখে দিয়ে বললো,’চাকরি ছেড়ে দিই?’

-‘আপনি মাথা ঠাণ্ডা করুন।কাঁদার শখ মিটছে আমার।আর কাঁদবো না।পারলে এখনই যান’

-‘নাহ এখন কেন যাব?
হাতে এখনও ১৯ঘন্টা আছে।কাল সকালে রওনা হবো।আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’
———
ইমাদ বারান্দায় এসে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।পুতুল ইমাদের ব্যাগে আর যা যা প্রয়োজন সেসব রাখছে এক এক করে।ইমাদ মিনিট পাঁচেক পর যখন পেছনে তাকালো দেখতে পেলো পুতুল দিব্যি শান্ত মনে ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে আঁচল কোমড়ে গুজে।অথচ কিছু সময় আগেও চৌকাঠ ধরে ড্যাবড্যাব করে আমার প্যাক করা দেখছিল।আর তার অশ্রুতে বন্যা বয়ে যাচ্ছিলো সাদা টাইলেসের উপর দিয়ে।টাইলসে পা রেখেই টের পেয়েছিলাম ঠিক কত সময় ধরে সে ওখানে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিল।আর সে মেয়েটা এখন কাঁদা ভুলে আমাকে বিদায় করার শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে।আহারে বধু রে!!কাল রাতে আমার বিরহে ওর কি হাল হবে তাই ভেবে গায়ের পশম খাঁড়া হয়ে আসছে আমার।মন দিচ্ছেনা আমাকে তাও যেতে হবে’

-‘নিন আপনার ব্যাগ ভালোমতন গুছিয়ে দিলাম।ব্রাশ নিতে ভুলে গিয়েছিলেন সেটা ঢুকিয়ে দিয়েছি।তোয়ালেও দিয়েছি’

-“ব্রাশ আমি ইচ্ছে করেই নিই নাই।কাল সকালে ও তো ব্রাশ করতে হবে।ভাবলাম তখনই ভরে নেবো’

-‘ওহ হ্যাঁ!তাই তো।সরি সরি।আবার বের করছি তাহলে’

ইমাদ পুতুলের কাছাকাছি এসে ওর মুখটা দুহাত দিয়ে ধরে নিজের দিকে তাক করলো।পুতুলের হাতে একটা টিশার্ট ঝুলছে।এটা সে নিজের জন্য রেখে দিবে।ইমাদের সব চাইতে প্রিয় এই টিশার্টটা।ওদের প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন ইমাদের গায়ে এই টিশার্টটাই ছিল।এটাতে ইমাদের গায়ের গন্ধ লেপটে আছে নিদারুণ ভাবে।ইমাদ ফিসফিস করে বললো,’ভালোবাসতে পারি?নাকি পরে কষ্ট পাবে বলে বাসতাম না?’

পুতুল চোখ নামিয়ে ফেললো।তারপর কি ভেবে ইমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না।মিসেস রওনকের ডাক পড়েছে।ভাত বেড়ে দেওয়ার জন্য।পুতুল ইমাদের হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে সেখানে।ইমাদ বিছানার উপর তার টিশার্টটা দেখে গুছিয়ে ব্যাগে পুরে নিয়েছে।ভেবেছে এটা সে ভুলের কারণে ঢুকায়নি ব্যাগে।পুতুল মিসেস রওনককে খাবারটা সার্ভ করে দিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো।উনি মাছের কাঁটা বেছে যাচ্ছেন দশ মিনিটের জায়গায় বিশ মিনিট ধরে।পুতুল আস্তে করে বললো,’আর কিছু লাগবে?’

-“নাহ।তোমার যেতে মন চাইলে যেতে পারো।’

তাই পুতুল চুপচাপ চলে আসলো ওখান থেকে।
-‘কবে যে এই মানুষটা আমাকে বুঝবে!কত কেয়ার করি তাও লাভ হয়না।’

ইমাদ তখন রুম থেকে বের হচ্ছিল পুতুলকে ডাকবে বলে।সেসময়ে পুতুলরে সঙ্গে আগের মতন একটা ধাক্কা খেয়ে গেলো।ইমাদ বুক ঘষতে ঘষতে বললো,’আমার বুক শেষ’

পুতুল তার কপালে হাত দিয়ে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।ইমাদ মাথা উঁচু করে বললো,’বলতে আসলাম মা মাছের কাঁটা অনেক ধীর গতিতে বাছে, তুমি আবার দাঁড়িয়ে থাকতে যেওনা।পরে দেখি তুমি আসছো না তার মানে ভালো বউয়ের মতন দাঁড়িয়ে ছিলে’

-‘হুম।পরে বুঝলাম আমি ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে কঙ্কাল হয়ে গেলেও মায়ের পাতের মাছের কাঁটা শেষ হবে না’

ইমাদ ফিক করে হেসে দিয়ে আবার মুখ হাত দিয়ে ফেললো।আস্তে করে পুতুলের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো সে।পুতুলকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা বক্স বের করলো ইমাদ।কখন কিনেছে পুতুল জানেনা।ইমাদ বক্সটা খুলে একটা লকেট পরিয়ে দিলো পুতুলের গলায়।পুতুল লকেটটা ধরে এপিঠওপিঠ দেখে জিজ্ঞেস করলো এটা কখন কিনেছিল।
ইমাদ বললো কদিন আগেই।দেওয়া হয়নি।ভুলে গিয়েছিল।এখন সব গুছাতে গিয়ে মনে পড়ে গেলো।এটা এই পকেটেই ছিল।পুতুল লকেটটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে।একটা বড় করে নীল পাথরের একটা লকেট।বাকিটা সিলবারের আবরণ।চিকচিক করছে।পুতুল মুচকি হেসে বললো,’টাইটানিকের সেই লকেটটার কথা মনে পড়ে গেলো’

ইমাদ ওয়ারড্রবের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে পুতুলের দিকে।পুতুল লকেটটাকে রেখে ইমাদের এমন উদ্ভট চাহনি দেখে বললো,’হাসছেন কেন এতো?’

-‘টাইটানিকের লকেটের সিনটাই মনে আসলো তোমার?আর কিছু মনে আসেনি?’

পুতুল ব্রু কুঁচকে এবার সে নিজেও দাঁত কেলালো।ইমাদ ওর খুব কাছে এসে বসেছে।ওর হাত দুটো ও ধরে ফেলেছে।এরপর ফিসফিস করে বললো,’কি মনে পড়েছে বলো।উচ্চারণ করো ভাষাতে।আমি শুনতে চাই।অনুভব করতে চাই ‘

-“পানিতে চুবানি খাওয়ানোর কথা’

-‘ধুরু মাইয়া!!এখন আমি বলবো তুমি একটা আনরোমান্টিক বউ’

মিসেস রওনকের কাঁটা বেছে মাছ সমেত ভাত খাওয়া হয়ে গেছে।ভেবেছিলেন পুতুলকে ডেকে বকা দিবেন পরে কি মনে করে রুমে চলে এসে দুম করে বিছানায় শুয়ে ভাতঘুম দিয়েছেন তিনি।
——
ইমাদ পুতুলের লিপস্টিক বিহীন ঐ হালকা গোলাপি রঙের ঠোঁটজোড়াতে সজীবতা এনে দিয়ে ফেললেও ওর মনে আরও বেশি করে কষ্ট জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে।ইমাদের স্পর্শে তার লজ্জায় লাল হয়ে যাবার কথা আর সেই মেয়েটা এখন ইমাদের ডান হাতটা মুঠো করে ধরে বাচ্চাদের মতন কেঁদে চলেছে।ইমাদ নিজের ঠোঁটকে নিজেই বকছে মনে মনে।পুতুলকে কেন কাঁদালো সেটা বলে বকছে।পুতুল শক্ত হয়ে বসে বললো,’আমি আর কাঁদবো না’
-‘এই কথা দু’শো বার বলেছো।আমি তো তোমাকে কাঁদতে মানা করছিনা।কাঁদো আরও।তাতে মন হালকা হবে’

পুতুল উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’চা বানাবো।চা খেলে আমার কান্না কমবে হয়ত’

ইমাদ পুতুলকে আটকে পুনরায় বসিয়ে দিয়ে বললো,’আমি বানিয়ে আনছি।তুমি বোসো”

ইমাদ চলে গেছে।পুতুল আবারও লকেটটা ধরে দেখতে লাগলো।এরপর কি মনে করে ইমাদের পিছু পিছু এসে হাজির রান্নাঘরে।মাকে ঘুমাতে দেখে নিশ্চিন্তে পুতুল তাকের উপর বসেছে পা দুলিয়ে।ইমাদ চা পাতা হাতে নিয়ে ওর পাশে বসে বললো,’যদি মনে হয় আমাকে ছাড়া আর থাকতে পারছো না তখন কল দিবে, আমি তোমাকে এসে নিয়ে যাবো’

পুতুল ভেংচি কেটে বললো’দিতাম না কল।থাকিয়েন একা একা’

ইমাদ পুতুলকে নিজের দিকে ফিরিয়ে রাগী সুরে বললো,’মেরে ফেলবো’

-‘মারেন।’

-“না থাক।আমার অবুঝ বউ।মারবো না।ভালোবাসবো তারে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে।আমার ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে সে কাঁদবে।ভাববে তাকে আমি ইচ্ছে করে সুখের দেখা দেখিয়ে মাঝপথে ছেড়ে যাচ্ছি তাকে কাতর করে।সে অস্থিরতায় ভুগবে।’

-‘আমি অনেক স্ট্রং।কাঁদবো না হুহ।’দেখিয়েন আমি সব ভুলে বেশ থাকতে পারবো।’

-‘এই হাত দিয়ে তোমার গালে সামান্য স্পর্শ করলেই তুমি আবারও কেঁদে ফেলবে।কিন্তু আমি তোমাকে কাঁদাতে চাই না এই মূহুর্তে।চা খাও,একটু হাসো,একটু গল্প করো।কিছুক্ষণ পরে কাঁদাবো আবার’

পুতুল ইমাদের গায়ে একটা কিল মেরে তাক থেকে নেমে গেলো।ইমাদ চায়ের কাপ রেডি করছে।পুতুল উঁকি মেরে একবার মিসেস রওনককে দেখে এসেছে।উনি গভীর ঘুমে।এটা দেখে এত খুশি লাগলো পুতুলের।যেন ইমাদ দু মাস পরে ফেরত এসে।সেরকম একটা খুশি তার চোখে মুখে ভাসছে।আকাশে বাতাসে উড়তে ইচ্ছে করছে তার।এত খুশির তোড়ে পাশের মিনি টেবিলটার উপর থাকা ফুলের টবটাই ফেলে দিয়েছে পুতুল।জিভে কামড় দিয়ে মিসেস রওনকের দিকে তাকালো সে।উনি জেগে যাওয়া মানে ইমাদ এখন গেলেও কি আর কাল সকালে গেলেও কি,ভয়ে পুতুলের গলা শুকিয়ে গেছে।মিসেস রওনক এপাশ থেকে ওপাশ করে শুয়ে ঘুমের ঘোরে বললেন,’দেখলে ইমাদের বাবা?ঐ মেয়ে ঘর চুরমার করে ফেললো’
চলবে”’

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_৪৫
Writer-Afnan Lara
.
পুতুল আস্তে করে নিচে বসে এক এক করে টবের ভাঙ্গা টুকরো গুলো নিয়ে ফেলে দিয়ে আসলো।টব একটা কিনে এনে আগের জায়গায় রাখতে হবে তা নাহলে সত্যি সত্যি বকা খেতে হবে।
ইমাদ চায়ের কাপের ট্রেটা হাতে এগিয়ে এসে বললো,’টব ভেঙ্গেছে?হাত লাগাচ্ছো কেন?ছাড়ো আমি করবো’

-‘না।আমি পারবো।আপনি রুমে যান।হয়ে গেছে সব।’

ইমাদ ট্রে নিয়ে দেখতে দেখতে চলে গেছে।পুতুল সব আগের মত করে দম ফেলে গেলো ইমাদের কাছে।ইমাদ চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে পুতুল আসলে চায়ে চুমুক দেবে।পুতুল ওর ঠিক সামনে বসে বললো,’আজ সন্ধ্যায় বের হলে আসার পথে একটা টব নিয়ে আসবেন। আগেরটা যেমন ছিল ঠিক সেরকম।’

-“হুমমম।’
—–
ইমাদ আর পুতুলকে দেখে মনে হয় তাদের বিয়ের কথা চলছে।পরিবার তাদের আলাদা ঘরে কথা বলার সময় দিয়েছে মাত্র।দুজন দু কিণারায় বসে হ্যাঁ হু তে কথা বলে চলেছে।অথচ তারা একে অপরকে এত কাছ থেকে জেনে গেছে তার পরেও কিন্তু তাদের মাঝে যে নতুনত্ব লজ্জাবোধটুকু থাকার কথা তা একেবারেই বিদ্যমান।পুতুল উঠে চলে যেতে চাইলো ঠিক সেসময়ে ইমাদ ওকে থামিয়ে বললো,’আমার পাশে ঘেঁষে বসবে?’

পুতুল ইমাদের মুখে এমন উদ্ভট কথা শুনে চমকিত চোখে তাকিয়ে থাকলো।এরপর ভাবহীনের মতন হেঁটে এসে ইমাদের পাশে বসলো সে।ওর কথামতন গা ঘেঁষেই বসেছে।ইমাদের দেখাদেখি দুপাকে সোজা করে বিছিয়ে রাখলো সে।ইমাদ হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা মুঠো করে ধরে রেখেছে।তার বেশ কিছুক্ষন পর বললো,’কুমিল্লা গিয়ে বাসা খুঁজতে হবে।বিবাহিত হয়েও ব্যাচেলরের মতন বাসা নিতে হবে।কত প্যারা।প্যারার কেনো শেষ নাই।মা বললো এদিক থেকে ওদিকে ফিরলেই নাকি দু মাস কেটে যাবে।কিন্তু আমার কাছে তো মনে হয় তা দু বছরের চাইতেও দীর্ঘ হবে।পারলে বাবা মাকেও নিয়ে যেতাম কিন্তু কথা হলো তারা দুজনেই চাকরিরত।আমি দোটানা নয় চৌদ্দ টানায় পড়েছি।বিপদ আসতে দু সেকেন্ড সময় নেয় না।সকালটা কত ভালো ছিল তারপর থেকে শুরু হয়ে গেলো চড়াই উতরাই।’

পুতুল ইমাদের ঘাড়ে নাক রেখে চুপ করে বারান্দা দিয়ে সামনে যে দালান দেখা যায় ওটা দেখছে আর কান দিয়ে ইমাদের কথা শুনছে।ইমাদ পুতুলের হাতটাকে নিজের হাতের আয়ত্তে এনে আঙ্গুল একটা একটা করে আকার মাপছে আর যত কথা মনে চাপা আছে সেসব বলছে।
——
বিকালে মিসেস রওনক ঘুম থেকে একটু জলদিই উঠে পড়েছিলেন।মোট কথা দুপুরে ঘুমানো তার কম সময় ধরে ছিল।ইমাদ আর পুুতুলের কথা শেষ হতে না হতেই তার ডাক পড়েছে।তবে এই ডাকটা ভালো বলা চলে।কারণ তার বাসার চাবি নিতে মালিক ডাকছেন।যেহেতু উনি আর ঐ বাসায় থাকবেন না সেহেতু সব ফার্নিচার যেন তিনি নিয়ে আসেন।বাসা খালি চাই।মা ইমাদকে নিয়েই যাওয়া ধরলেন সেসময়ে বাবা এসে গেলো অফিস থেকে।ইমাদের বাবা ফোনে কথা বলে জানতে পেরেছিলেন ইমাদ কাল চলে যাবে তাই তিনি ইমাদকে রেখে মিসেস রওনকের সঙ্গে গেলেন সব ফার্নিচার নিয়ে আসার জন্য।ইমাদকে আর পুতুলকে আলাদা সময় করে দিলেন।পুতুল খুব খুশি হয়েছিল তার এই কাজে।
বাসা আবারও ফাঁকা।ইমাদ ঘুমে।এবার মন চাচ্ছে তাকে মেরে চচ্চড়ি বানাতে।যাই হোক রাগটাকে সামলে পুতুল ইমাদের দিকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল।এরপর আর কি করবে ভেবে ওর পাশেই শুয়ে পড়ে।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ঘটলো ইমাদ ঠিক সেময়ে চোখ খুলে তাকিয়েছে ওর দিকে।পুতুল ভয় পেয়ে শেষে নিজের চোখই বন্ধ করে ফেললো।ইমাদ দুম করে তার একটা হাত পুতুলের গায়ের উপর ফেলে বললো,’আবার কাঁদাবো’

-“কাঁদবো না।আমি শক্ত মনের মানুষ।এত সহজে কাঁদবো না।ভাববো আপনি কাল গিয়ে পরশু চলে আসবেন।তাহলে আর কান্না পাবে না।’

-“দারুণ বুদ্ধি! কাজে দিলেই হয়।’

ইমাদ পুতুলের নাকটা টেনে ধরে মুচকি হেসে দিলো।মায়ের কল এসেছে ঠিক সেসময়ে।পুতুল তার কপালে একটা চড় মেরে আরেকদিকে ফিরে শুয়ে পড়েছে।ইমাদ ফোন কানো ধরতেই মা জানালেন ফার্নিচার সব বাসায় আঁটবে না।কি করা যায় বুদ্ধি দিতে।ইমাদ বললো বেচাকেনা ডট কমে বেচে দিতে।টাকাও আসবে তাহলে।ঝামেলাও কমলো।বাবা ইমাদের কথা শুনে বললেন,’আমি এতক্ষণ তোর মাকে এসবই বলে যাচ্ছিলাম। কে শোনে কার কথা।তার ছেলে যেটা বলবে সেটাই করবেন।এখন হলো তো?ছেলেও আমার মতো কথা বলেছে’

মা লাইনটা কেটে দিয়েছেন।ইমাদ ফোন রেখে পুতুলের কানের কাছে মুখ এনে বললো,’ঘুমাচ্ছো?’

-‘উহু!সন্ধ্যাবেলায় আবার কিসের ঘুম?আপনি পারেন ঘুমাতে।আমি পারিনা’

-‘তাহলে চলো’

-“কই?”

-“আমার একটা জগৎয়ে।যেখানে তুমি প্রতি স্পর্শে ভালোলাগা আর ভালোবাসা দুটোই খুঁজে পাবে, জাস্ট একটা স্পর্শেই। তাহলে ভাবো কতবার তোমাকে আমি ভালোলাগা আর ভালোবাসা একসাথে দিয়ে দেবো!”

পুতুল ইমাদের দিকে ঘুরে বললো,’আমার জগৎয়ে এসে দেখুন।স্পর্শ না করতেই ভালোবাসা খুঁজে পাবেন।’

-‘কিন্তু আমি যে স্পর্শে তোমাকে ভালোবাসতে চাই পুতুল।জানি না আবার কবে ছুঁতে পারবো।মুখটা দুহাত দিয়ে ধরে দেখতে পাবো।আদরে মুড়িয়ে নিতে পারবো।ভাবতেই আরও বেশি খারাপ লাগছে’

-“ভবিষ্যত নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিন।খারাপ লাগা আসবে না।এসব ভেবেই আমি কান্নাকে দমিয়ে রেখেছি।আপনি ও ট্রাই করে দেখতে পারেন’

পুতুলের কথার তোয়াক্কা না করে ইমাদ তার হাত দিয়ে পুতুলের কানের হালকা পাতলা দুলটাকে দুলিয়ে দিচ্ছে সুক্ষ্ম ভাবে।পুতুল এক দৃষ্টিতে ইমাদকে দেখছে।বরাবরের মতন ইমাদের দাঁড়ির কাটটা পুতুলের অসাধারণ লাগে।ইমাদের চুল আগে খুব ভাল্লাগতো কিন্তু এর পরপরই ভালো লাগা শুরু হয় ওর দাঁড়ির প্রতি।কিন সুন্দর করে সে কাটিং করায়।ভাবতে ভাবতে পুতুল তার দুহাত দিয়ে দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো।
ইমাদ মাথাটা নিচু করে বললো,’তোমার প্রেম আমাকে আজ শেষ করে দেবে’
——-
মিসেস রওনক সব কাজ সেরে বাসায় আসতে চাইলেও বাধা হয়ে দাঁড়ালেন বাবা।তিনি জানেন মিসেস রওনক বাসায় যাওয়া মানে ইমাদ আর পুতুলর মাঝে দূরত্ব থাকবে ত্রিশ মিটারের।
তাই বললেন,’শুনো রওনক।চলো আমরা চটপটি খাব’

মিসেস রওনক কপাল কুঁচকে বললেন,’তোমার কি শরীর ঠিক আছে?হঠাৎ আমাকে চটপটি খাওয়াবে বলছো?’

-“ভুলে যাও সব।আর যাই হোক আমরা তো হাসবেন্ড ওয়াইফ তাই না?চটপটি কেন?তুমি যা বলবা তোমাকে আমি তাই খাওয়াবো’

-“তোমার মাথা খাব।দিবা?’

-“ওটা বাদে’

মিসেস রওনক ইমাদের বাবাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে হাঁটা ধরেছেন।কিছু একটা গণ্ডগোল আছে তা বেশ বুঝতে পারছেন।কিন্তু সেটা কি তাই বুঝতে পারছেন না।
——
সিনথিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে অন্তিক নামের একটা ছেলের সঙ্গে।রওনক আন্টির সঙ্গে দেখা করার জন্য অন্তিককে সাথে করে সে এসেছে ইমাদদের বাসায়।বেশ কয়েকবার কলিংবেল চাপলো।তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বাজে।ইমাদ টি- শার্ট পরতে পরতে এসে দরজাটা খুলে দিলো।সিনথিয়াকে দেখে মুচকি হেসে বললো,’তুমি??কেমন আছো?’

-“ভালো।জানতাম না তুমি এখানে।আন্টি আঙ্কেল কোথায়?’

-‘বাবা মা একটা কাজে বাহিরে গেছে।এখনই চলে আসবে।আসো ভেতরে আসো”

সিনথিয়া অন্তিককে নিয়ে সোফায় এসে বসলো।অন্তিকের দিকে তাকিয়ে বললো,’ও ইমাদ।বলেছিলাম তো তোমাকে’

-“হুম।কেমন আছো ইমাদ?’

-“অন্তিক আহসান না তুমি??সাংবাদিক রাইট?’

-“ইয়েস।চিনতে পারছো তাহলে’

-‘ওর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।আন্টিকে জানাতে আসলাম সে কারণে’

-“ওহ তাই।গ্রেট নিউজ!!!’

সিনথিয়া এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,’পুতুল নেই?’

-‘হ্যাঁ।এই তো আসবে।’

-‘আমি গিয়ে কথা বলবো?ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড?

-“মাইন্ড করবো কেন?যেতে পারো।আমি বরং অন্তিকের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিই’

সিনথিয়া উঠে চলে গেলো ভেতরের রুমে।পুতুল গোসল করে বেরিয়েছে বাথরুম থেকে।সিনথিয়াকে হঠাৎ দেখে থেমে গেলো সে।
সিনথিয়ার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো পুতুলকে দেখে।হাসি মুখেই এসেছিল কিন্তু কেন যেন মন ভীষণ ভাবে খারাপ হয়ে গেলো তার।তাও এক প্রকার জোর করেই মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’কেমন আছো?’

-“ভালো।আপনি? ‘

-“ভালো।’

সিনথিয়া বিছানায় বসে বললো,’তা দিনকাল কেমন চলে?’

পুতুল জবাবে কিছু না বলে সিনথিয়ার পাশে বসলো মুচকি হেসে।সিনথিয়া পুরো রুমটা দেখে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,”আমার উড বির সঙ্গে এসেছি।বিয়ের কার্ড দিতে।রওনক আন্টি নাকি বাসায় নেই, তাই অপেক্ষা করছি”

-“ওহহ।অভিনন্দন ‘

সিনথিয়া পুতুলের গলার লকেটটার দিকে তাকিয়ে বললো,’ইমাদ দিয়েছে বুঝি?”

-“হুম।আজকে দিলো’

-“সুন্দর।আমি ভাবতাম ইমাদ নিরামিষ টাইপের।কিন্তু ওর বিয়ের পর থেকে এতসব দেখে বুঝলাম ও শুধু আমার সঙ্গে নিরামিষ থাকতো।তোমার বেলায় পাকা আমিষ’
পুতুল সিনথিয়ার কথার উত্তরে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ভুলভাল কিছু বললে যদি ইমাদের মায়ের কাছে গিয়ে বিচার দেয়। সে ভয়ে চুপসে গেছে সে।সিনথিয়া ইমাদের রুমের আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে গুছিয়ে রাখা চুড়িগুলো হাতে নিয়ে বললো,’মানুষ তার আশেপাশে এমন অনেক মানুষ দেখে যারা তাকে ভালোবাসতে চায়,অথচ তারা শুধু একজনকেই ভালোবাসে।সেই একজন ঐ ভীড়ের মাঝের থেকে না।সম্পূর্ন আলাদা জগৎয়ের হয়।যারা কিনা ঐ মানুষটা ভালোবাসার পর ভালোবাসতে শেখে।
আমি ইমাদকে খুব করে চেয়েছিলাম।ভাগ্য দিল না।আজও চাই।কিন্তু আমার হাতে কিছুই নেই।’

পুতুল ভেজা তোয়ালেটা বারান্দায় শুকাতে দিয়ে এসে আবার সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো বোকার মতন।সিনথিয়া আর সইতে না পেরে চলে গেছে।পুতুল এর আগামাথা কিছুই বুঝলো না।তবে একটুখানি হয়ত বোঝা হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে আর কি।আর তা হলে সিনথিয়া জ্বলে ছাই ছাই হয়ে যাচ্ছে।
-‘ইমাদ না বলেছিলেন তিনি ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।এই তার নমুনা?কেমন কাঁচা চিবিয়ে খাওয়ার মতন লুক নিয়ে আমাকে দেখছিল।ইমাদ না থাকলে আমাকে একা পেয়ে উত্তম মধ্যম দিয়ে দিতো, আমি একেবারে সিওর।’

ভয় কে টাটা বাই বাই করে চুল ঝেড়ে নিয়েছে পুতুল।এরপর রুম থেকে বের হলো।সোফায় বসে আছে এক সুদর্শন পুরুষ।তাও কেন যেন ইমাদকেই একটু বেশি ভাল্লাগলো।
-“শুধু যে আমার হাসবেন্ড সে কারণে নয়!বরং তার মুখের সেই দুষ্টু হাসিটা নজর কেড়েছে।সে হেসে বুঝিয়ে দিতে চাইছে কিছুক্ষন আগের ঘটনাটা এখনও সে ভোলেনি।’

পুতুল হেসে এগিয়ে গিয়ে ইমাদের পাশে বসলো।সিনথিয়া রোবটের নতন অন্তিকের পাশে বসে আছে।পুতুল আবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো সে নাস্তা আনতে যাচ্ছে।ইমাদ ও উঠে গেলো ওর সাথে সাথে।
রান্নাঘরে এসে সে পুতুলের ভেজা চুলগুলোতে হাত দিয়ে জট ছাড়াচ্ছে এখন,পুতুল প্যাকেট থেকে বিসকিট নিয়ে সাজিয়ে রাখছে বাটিতে।সিনথিয়া শুধু একবার ওদিকে তাকিয়েছিল।ইমাদের মুখে হাসি আর ওর চাহনি পুতুলের দিকে দেখে সে চোখটা নামিয়ে নিয়েছে।
চলবে””