সূর্য ডোবার আগে পর্ব-২১+২২

0
1054

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২১
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

নিম্নচাপের প্রভাবে বাইরে অঝোরে বৃষ্টি, বন্ধ জানলা ভেদ করেও সেই বৃষ্টির আওয়াজ ঘরে চলে আসছে, ঝড়ের সাথে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে জানলার পাল্লা! মধ্যরাতে প্রকৃতি যেন আজ তাণ্ডবলীলায় মেতেছে, আর তিন্নির পৃথিবী ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো! মাস দুয়েকের উড়ো উড়ো স্বপ্নের রামধনুরঙা ফানুস আজ যেন মুখ থুবড়ে সোজা মাটিতে এসে পড়েছে। অসহ্য যন্ত্রনায় মাথার চুলগুলো দুহাতে সজোরে খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো তিন্নি। কি ভেবেছিলো আর কি হয়ে গেলো?

কেন ? কেন ? কেন? ​
কেন সায়কের হয়ে তরফদারি করতে গেলো তিন্নি? সাজানো বাগান নিজের হাতে তছনছ্ না করলে কি মনে শান্তি হচ্ছিলো না? ভাবতে ভাবতেই ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে আসা নিঃশব্দ নোনতা গরম জলে ভিজে যাচ্ছিলো বিছানা চাদর বালিশ। বুকের পাঁজরগুলো কে যেন ইলেকট্রিক করাত দিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে কাটছে! শেষে অভিমন্যুও ভুল বুঝলো ওকে? ঠোঁট কামড়ে রক্ত বার করে, চোখের নোনতা জল আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় তিন্নি ওর মনকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো “অভিমন্যু ঠিক ফোন করবে, এখন না হোক একটু পর! সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো”! তাও ভেতর থেকে যেন সায় পেলো না! কে যেন মাথা নেড়ে বলছিলো “সুখ সুখ রঙিন স্বপ্নের আজই শেষ রাত, আর সে ফিরে তাকাবে না!”
তারপর বিদ্যুৎচমকের মতো একটা ভাবনা ঝলক দিলো মাথায় ….. অভিমন্যু কি সায়ককে নিয়ে জেলাস?
.
.
.
.
এক একটা মিনিট কাটছে যেন এক একটা ঘন্টা! অবশেষে বহুপ্রতীক্ষিত ফোনের আলো জ্বলে উঠলো। একবার রিং হতেই ফোন ধরলো তিন্নি, কাঁদতে কাঁদতে সোজা চার্জ করলো — “পুরো কথা না শুনে কেন ফোন কেটে দিলে?”

— কাজ ছিল।

— না, ছিল না।

এর উত্তরে কি বলা যায়? মেজর অভিমন্যু সেন যা উত্তর দিলেন সেটা যদিও তিন্নির কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। অনেকদিন আগেকার সেই নিস্পৃহ, গম্ভীর, আবেগহীন গলাটা খুঁজে পেয়েছেন মেজর অভিমন্যু , স্তব্ধ গলায় বললেন —- “সীমন্তিনী, একটা বড়ো ভুল করতে যাচ্ছিলাম, আজ তুমি আমায় বাঁচিয়ে দিলে। ভেবে দেখলাম, আমার জীবনের সাথে তোমাকে জড়ানোর কোন মানে নেই। একটা সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিকভাবে বাঁচার অধিকার সবার আছে, তোমারও। আমার ছন্নছাড়া অনিশ্চিত জীবন তুমি মানাতে পারবে না। সে শক্তি তোমার নেই।”

কাঁদতে কাঁদতে ফুঁসে উঠলো তিন্নি — “সায়কের জন্য, আমাদের দুজনের মধ্যে একটা থার্ড পারসনের জন্য, তুমি এতটা ওভাররিয়াক্ট করছো?আর ইউ জেলাস?”

যেন সিংহের সাথে শেয়ালের তুলনা। বরফঠান্ডা একটা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন মেজর অভিমন্যু সেন, বুকের রক্ত জল করে দেওয়ার মতো।

— আ্যম আই জেলাস?! আর ইউ সিরিয়াস?

তিন্নি হার মানলো না, আগের তেজেই ফুঁসে উঠলো —- “সায়ক আর তুমি, তোমরা দুজনেই একে অপরের নাম শুনলে ক্ষেপে ওঠো কেন? আমি তো বলেছি তোমায়, হি ওয়াজ জাস্ট এ ফ্রেন্ড! এখন বন্ধুও নয়, জাস্ট কলীগ!”

—- এ প্রশ্নটা তুমি নিজেকে করো সীমন্তিনী, কেন তোমার “জাস্ট ফ্রেন্ড” তোমার বয়ফ্রেন্ডের নাম শুনলে ক্ষেপে যায়?

তিনসেকেন্ড চুপ করে থেকে থম মেরে যাওয়া গলায় তিন্নি বললো —- “আমাদের সম্পর্কটার কথা কেউ জানে না অভিমন্যু! তুমি নিজে বারণ করেছো জানাতে!”

—- এক্সাক্টল্যি। আর তারপরও তোমার “জাস্ট ফ্রেন্ড” বা “জাস্ট” কলীগের আমাকে নিয়ে কি রিয়্যাকশন আর তার কারণ কি – সেটা না বোঝার মতো ইমম্যাচিওর তুমি নও! অবভিয়াসলি, হি হ্যাজ এ থিং ফর ইউ !

চাবুকসটান জবাবে মাথার সকল ধোঁয়াশাভাব কেটে গিয়ে টানটান হয়ে বসলো তিন্নি, ধক্ করে উঠলো বুকের ভেতরটা। আর একটা কথাও মুখ দিয়ে বেরোলো না ওর। অভিমন্যুর পোড়খাওয়া ইন্টোরেগেশনের নিস্পৃহ ঠান্ডা স্বর আবারও বেজে উঠলো —- “নাউ টেল মি, ডিড হি অর ডিড হি নট ট্রাই টু টাচ ইউ অন দ্যাট ডে?”

অনেক কষ্টে মুখ ফুটলো তিন্নির —- “তাতে কি যায় আসে অভিমন্যু? এন্ড অফ দ্য ডে আই আ্যম ও.কে! আই হ্যান্ডেলড ইট!”

ভেতর অবধি কাঁপিয়ে দেওয়া বরফের চেয়েও ঠান্ডা ধারালো ছুরির প্রথম আঘাতটা হৃৎপিন্ডে এসে বিঁধলো।
—— এটাই যায় আসে, সবটা জেনেশুনেও তুমি কভারআপ করার চেষ্টা করেছো, আমার কাছে সত্যিটা লুকোনোর চেষ্টা করেছো, এরপরও ওই স্কাউন্ড্রেলটার সাথে কথা বলেছো!

.
.
.
He knows!
কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে একটা একটা করে প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করলো তিন্নি। —- “তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো?”

ততোধিক শীতল স্বরে তার প্রত্যত্তর এলো —- “না সীমন্তিনী। বাট স্যাডলি ইউ ডোন্ট ট্রাস্ট মি! আদারওয়াইজ, আমার কাছে এগুলো লুকোতে না!”

চোখ ফেটে এবার জল বেরিয়ে এলো তিন্নির। বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো অনুশোচনায়। কেঁপে যাওয়া গলায় বললো —- “আই আ্যম সরি! আমি বুঝতে পারছিলাম না সবটা শুনে তোমার কি রিয়্যাকশন হবে! যদি তুমি আমাকে ভুল বোঝো….”

—- আ্যজ আই সেইড….. ইউ ডোন্ট ট্রাস্ট মি এনাফ।

কোন অনুযোগ বা অভিযোগ নয়। যেন একটি পর্বের পরিসমাপ্তি ঘোষনা করলেন মেজর অভিমন্যু সেন। আমূল কেঁপে উঠলো তিন্নি।
—- অভিমন্যু … প্লিজ!

—- যেকোনো রিলেশনশিপের বেস হল ট্রাস্ট, দুজনের ওপর দুজনের বিশ্বাস। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি সীমন্তিনী, আই হ্যাভ নো ডাউট, সেদিন খারাপ কিছু হওয়ার হলেও তুমি ঠিক নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে…. বাট ইজ দ্যাট এনাফ? চেষ্টা করা আর সাকসেসফুল হওয়ার মধ্যে ডিফারেন্স আছে। ফরচুনেটলি, ইউ ওয়ার লাকি দ্যাট ডে! বাট হোয়াট আ্যবাউট টুমোরো? মেনলি, হোয়াই ডিডনট্ ইউ টেল মি? তুমি কি ভয় পাও আমায়?

কেঁদে ফেললো তিন্নি! কাঁদতে কাঁদতেই বললো — “আমি জানি না অভিমন্যু! আমি একটা স্টুপিড, ইডিয়ট….”

—- আমার প্রশ্নের উত্তর এটা নয়!

— আমি জানি না। মে বি … মে বি নট! কিন্তু সায়কের জন্য আমরা কেন নিজেদের মধ্যে আর্গুমেন্টস করছি?

— ইটস নট আ্যবাউট হিম। আজ না হয় কাল, এ প্রসঙ্গটা উঠতোই। তুমি আমাকে ভয় পাও কারণ তুমি জানো, হোয়াট আই আ্যম ক্যাপাবেল অফ ডুয়িং, বিকজ অফ মাই জব! এই সত্যিটা বদলাবে না কোনোদিন। ইউ ডিজার্ভ এ নর্মাল লাইফ, এ নর্মাল রিলেশনশিপ, এ নর্মাল পারসন….. সায়কের মতো। আই আ্যম নট দ্য ওয়ান ফর ইউ।

আবারো কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ নয়, দৃঢ় কনক্লুশন, যেন নড়চড় হবে না। আরএকবার কেঁপে উঠলো তিন্নি। ভেঙে পড়ার আগে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো — “সায়কের মতো?? কি থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছো অভিমন্যু?”

— যেটা সত্যি, যেটা রিয়ালিটি সেটাই বলছি, নাথিং এলস। আমার জীবনে তুমি ঠিক ততোটাই বেমানান, যতটা তোমার জীবনে আমি।

কাঁদতে কাঁদতেই ফুঁসে উঠলো তিন্নি — “কি করে জানলে? আমার জীবনের সিদ্ধান্ত তুমি একাই কি করে নিতে পারো?”

অভিমন্যু নির্বিকার, আজ ওর মন লৌহকঠিন। হিমশীতল কণ্ঠে বললো — “কারণ সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো তুমি মানসিকভাবে পরিণত নও।”

তিন্নি কিছু রিয়াক্ট করার আগেই নিস্পৃহ গলায় বলতে লাগলো অভিমন্যু — “তুমি বড্ডো নরম, বড্ডো সরল। লাইক আ্যন ইনোসেন্ট কিড…. তর্ক করো না, বিকজ ইউ “আর” এ কিড! আর তাই রিয়্যালিটি ইগনোর করছো। আজ না হয় কাল, আচমকা এমন একটাদিন আসবে যেদিন আমার কোনো খবর পাবে না তুমি, কোনো যোগাযোগ করতে পারবে না। যদি ভাগ্য ভালো হয়, হয়তো দশদিন পরে নিউজপেপারে বা টিভিতে দেখবে আমার মৃতদেহ আসছে তেরেঙ্গায় মুড়ে, কফিনবন্দি হয়ে। সেদিনের সেই মানসিক চাপ তুমি নিতে পারবে না তিন্নি, নিজেকে শেষ করে দেবে। আমার মা’কে এভাবে হারিয়েছি, তোমার জীবনটা এরকম কালবৈশাখীর ঝড়ে আমি উড়িয়ে দিতে পারি না। তার চেয়ে এই ভালো, ইউ চুজ এ নর্মাল পারসন, নট “সায়ক” বাট এ ফেলো ইঞ্জিনিয়ার, একজন সিভিলিয়ান…. হোয়াটেভার, লিড এ নর্মাল লাইফ। তুমি সুখী হও জীবনে, ভালো থাকো। আমার একার জীবন, একাই ভালো আছি। আমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে, তুমিও শান্তি পাবে না, আমিও না।”

.

.

.

অভিমন্যুর মা নেই? কত একা এই মানুষটা?

ফোনের এপাশে কখন যে কান্না থমকে গিয়েছিলো তিন্নি নিজেও জানে না। স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছিলো আর দমবন্ধ হয়ে আসছিল ওর। অভিমন্যুর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া প্রতিটি সত্যিকথা ওর হৃদয়ে ছুরির আঘাত হানছিলো, ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত নিঃশব্দ জল হয়ে চোখ দিয়ে পড়ছিলো। অভিমন্যুর কথার স্রোত থামলে, খুব ইচ্ছে করছিলো তিন্নির ছুটে যায় সেই একলা মানুষটার পাশে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মানুষটার হাত। চোখে চোখ রেখে বলতে ইচ্ছে করছিলো “তুমি একলা নও অভিমন্যু, আমি আছি সর্বক্ষণ তোমার পাশে, তোমার সাথে।” কিন্তু এতদূর থেকে কি’ই বা করতে পারে তিন্নি অসহায়ের মতো ফোন হাতে বসে থাকা ছাড়া? নিজের অসহায়তার রাগে ঠোঁট কামড়ে ধরলো ও, রক্তের নোনতা স্বাদটা জিভে লাগতে সম্বিৎ ফিরে এলো ওর! এই মুহূর্তে কিছু একটা বলার খুব দরকার, কিন্তু কি বলবে তিন্নি? কি বললে ও অভিমন্যুকে বিশ্বাস করাতে পারবে, ভালোবাসাতে পারবে?

অনেকক্ষন নিঃশব্দ কান্নার পর গলার স্বর খুঁজে পেলো তিন্নি। চোখের জল মুছে বলতে চেষ্টা করলো – অভিমন্যু…..প্লিজ?

— জেদ করো না সীমন্তিনী! সবকিছু জেদ করে পাওয়া যায় না। লাস্ট ফিউ মান্থস ওয়ার এ মিসটেক। ইটস্ ওভার নাউ!

না!না!না! এ কি বলছে অভিমন্যু?
শরীরের সবকটি কোষ, মস্তিষ্ক্র সবকটি নিউরোন একযোগে বিদ্রোহ ঘোষনা করে দিল, শিউরে উঠলো তিন্নি! বুকের গভীর থেকে ডুকরে উঠে আসা কান্নার আভাসটুকু মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টায় বললো — “জেদ তুমি করছো অভিমন্যু…. আমাদের সম্পর্কটাকে একটাও চান্স না দিয়ে! কেন বুঝছো না…”

—- আমি বুঝি, আর বুঝি বলেই বলছি, তুমি পারবে না আমার জীবনের সাথে মানাতে। আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ টু কম্প্রোমাইজ উইদ ইওয়োর হ্যাপিনেস। ইউ ক্যাননট বী মাইন।

—- বাট আই আ্যম অলরেডি ইওয়োরস অভিমন্যু!শিয়ালদা স্টেশনে যেদিন প্রথমবার আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছিলে, .. কেন বুঝছো না তুমি না চাইতেও আমি তোমার হয়ে গিয়েছি সেই প্রথম দিন থেকে?

তিন্নির ধরে আসা গলার ঘনত্বটা অভিমন্যুর বুকের দুর্বলতম কোণ ছুঁয়ে গেলো, তবুও চোয়াল শক্ত রেখে মনকে কড়া শাসনে বাঁধলো ও। ঠান্ডা গলায় বললো — “ওসব রূপকথার গল্পে বা কবিতায় হয়, সীমন্তিনী। রিয়াললাইফে পয়েন্টলেস।”

বিষমাখানো তীরের ফলার মতো সোজা বুকের ভেতরে গিয়ে ফুটলো অভিমন্যুর কথাটা, বিনা প্রতিবাদে নিঃশব্দ রক্তপাত লুকিয়ে নিয়ে ধরা গলায় বলে যেতে লাগলো তিন্নি
— না অভিমন্যু! বিশ্বাস করো, যেদিন থেকে তুমি আমার জীবনে পা রেখেছো, আমার সাদামাটা জীবনটা একলহমায় বদলে দিয়েছো তুমি। কোনোদিন বলিনি তোমায়, আজ বলছি। সেরাতে ট্রেনে সারাটা রাস্তা যেতে যেতে শুধু তোমার কথা ভেবেছিলাম…. জানো? NGP স্টেশনে নেমেও তোমাকে খুঁজেছিলাম, যদি তোমরাও নেমে থাকো….পাই নি দেখতে। অতজনের সাথে ঘুরতে বেরিয়েও আমি একলা ছিলাম, হোটেলের ঘরে সারা দুপুর রাত কেঁদেছিলাম আর তোমার দেখা পাবো না বলে! … তোমার পোস্টিং কোন রাজ্যে জানতাম না তাও কি এক ব্যর্থ আশায় পরেরদিন ঘুরতে বেরিয়ে নর্থ সিকিমের প্রতিটি আর্মি চেকপয়েন্টে আমার চোখ তাকিয়েছিল সব ইউনিফর্মে, যদি কোনোভাবে দেখা হয়ে যায় আবার। আমার চোখ কেবল তোমাকেই খুঁজছিলো অভিমন্যু, তোমাকে খুঁজে পাবো না তা জেনেও।

তিন্নির কথাগুলো শুনতে শুনতে একটু একটু করে বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে আসছিলো অভিমন্যুর। কি করে স্বীকার করবে ঠিক একই অনুভূতিতে ছেয়েছিল ওর’ও মন? কর্ত্যব্যের দোহাই দিয়ে শেষ জোরটুকুতে মনকে শক্ত করলো অভিমন্যু, যথাসম্ভব নিস্পৃহ স্বরে বললো

— সেটা তোমার পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয় সীমন্তিনী।

একটা ঠান্ডা শিরশিরানি বয়ে গেলো তিন্নির মেরুদন্ড বরাবর। আজ আর কিছু চেপে রাখবে না, আজ আর থামলে চলবে না! মাসদুয়েক আগেকার পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়তে নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো একটু, তারপর কান্নার মধ্যেই ব্যর্থতার হাসি হেসে বললো

— নাহ অভিমন্যু! “পাগলামি” শুরু হলো সিকিম থেকে ফিরে এসে। তুমি কি জানো, এখন আমার সারাদিনের কাজ ফোনের কল লগ খুলে তোমার ফোন নাম্বারটির দিকে তাকিয়ে থাকা? কোনদিন কত মিনিট কত সেকেন্ড কথা হয়েছে তা আমার ঠোঁটস্থ। সারাদিন আমার মনে হয় তুমি যেন ঠিক আমার পাশেই আছো, স্পষ্ট অনুভব করতে পারি। প্রতিমুহূর্ত মনে হয় অদৃশ্যভাবে আমাকে তুমি রক্ষা করে যাচ্ছো, তুমি থাকতে আমার কোনো বিপদ হতে পারে না। অফিস যাওয়াআসার পথে যে’কটি মন্দির চোখে পড়ে, জানো আমি সবকটায় প্রণাম ঠুকি, যাতে ঈশ্বর তোমাকে অক্ষত রাখে। এখন আমার এমন অবস্থা, তুমি যখন আমায় কাঁদতে মানা করো, আপনাআপনি আমার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। তুমি একবার যদি আমায় বল “ভালো থেকো” আমি সত্যি ভালো থাকি সেই দিনটা। ভুল করেও রাস্তায় কারো হাত আমার গায়ে লেগে গেলে সেই জায়গাটা কেমন লাল হয়ে ওঠে, জ্বলুনি শুরু হয়ে যায়! আমার শরীর অন্য কারো ছোঁয়া রিজেক্ট করে দিচ্ছে অভিমন্যু! আমার শরীর,মন, আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সবকিছু তোমার ইচ্ছেতে চলে অভিমন্যু।তুমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেও তারা তোমারই থাকবে। কিছু পেয়েও না পাওয়ার যন্ত্রণা বোঝ? আমি শুধু তোমায় ভালোবাসতে জানি অভিমন্যু। কোনো দাবী ছাড়া, কোনো বাঁধন ছাড়া ভালোবাসা, আমি তোমার শর্তে বাঁচতে চাই, তোমার সাথে থাকতে চাই। এটুকু কি অনেক বেশি কিছু চাওয়া? তোমার কাছে আমার কোনো দাবি নেই, কোনো সম্পর্কের চাহিদা নেই, হয়তো আমাকে ছাড়াও তুমি খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারবে কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না!

কান্নাভেজা গলায় আকুল হাহাকারে মনের কথাগুলো চলছিলো তিন্নি। বলতে বলতে ওর গলা বুজে এলো বারবার, চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া নিঃশব্দ নোনতা জলের স্রোত একবারের জন্যও বন্ধ হয়নি। আর শুনতে শুনতে ফোনের অপর প্রান্তে অভিমন্যুর পাথরকঠিন হৃদয় কেঁপে উঠছিল বারবার। এসব কি বলে যাচ্ছে তিন্নি? এ’ও কি সম্ভব? কেউ কি’করে কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে? তিন্নির কান্নাভেজা গলা শুনতে শুনতে অদ্ভুত একটা মানসিক ক্লান্তি ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছিলো অভিমন্যুকে। যেন অদৃশ্য এক চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে ও, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মুঠোয় ধরে রাখা শুকনো বালিগুলোও বেরিয়ে যাচ্ছে আঙুলের ফাঁক গলে। বুকের ভেতরের উথলপাতাল সাগরঢেউ সামলে অনেকক্ষন চুপ করে থেকে স্তব্ধ গলায় বললো

— কেন জেদ করে চলেছো সীমন্তিনী? এভাবে হয় না! এসব তোমার মনের ভুল। ক’টাদিন সময় নাও, আমার চেয়েও আরো ভালো কেউ নিশ্চয়ই তোমার জীবনে আসবে যার সাথে তুমি খুশি থাকবে, নিরুদ্বেগ জীবন কাটাবে….

থামিয়ে দিলো তিন্নি — “কেন বোঝো না তুমি? আরো কতো স্পষ্ট করে বলতে হবে?”

— বুঝি, সেই জন্যই বলছি! …..

— নিরুদ্বেগ জীবন আমি চাই না অভিমন্যু, অন্য কাউকে আমার চাই না! আমি শুধু তোমাকে চাই। সারাদিনে একবারমাত্র তোমার গলার আওয়াজ শুনে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। যদি সেটাও অনেক বেশি চাওয়া হয় – তাহলে শুধু এইটুকু জানিয়ে দিও প্রতিদিন, পৃথিবীর যে প্রান্তরে, যেখানেই আছো, তুমি বেঁচে আছো! সেই পাওয়াতেই আরেকটি দিন বেঁচে থাকবো আমি।

—- সীমন্তিনী!

— ইউ ইন্টেনডেড টু বি দ্য লাস্ট পারসন আই লাভ! আই আমি অলরেডি ইওরস অভিমন্যু, টুডে-টুমোরো আ্যন্ড ফরএভার। নতুন করে আর অন্য কারো হতে পারবো না। মনটা তো কবেই দিয়ে দিয়েছি তোমায়, এ শরীরটাও তুমি ছাড়া অন্য কেউ পাবে না। যদি এ পৃথিবীতে তোমার জায়গা না হয়, তবে আমারও জায়গা হবে না। যদি তুমি আমার জীবনে না’ই থাকো তবে আমি বেঁচে থেকে কি করবো অভিমন্যু? আমি জানি, তোমাকে যতটাই ভালোবাসি না কেন, তুমি আমাকে ভালোবাসো না!

একটু থেমে মনের গোপনতম চোরাকুঠুরি থেকে টেনেহিঁচড়ে উঠিয়ে আনলো নিজের সকল ইনসিকিউরিটি, শিকড় সমেত। কাঁদতে কাঁদতে বলে যেতে লাগলো তিন্নি —- মাসদুই আগে যখন আমি তোমার জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছি, তখন পরপর দুইদিন দেখা হওয়ার পরও, আমার প্রাণ বাঁচানোর পরও তুমি আমার নামটুকু জানতে চাও নি! মনকে বুঝিয়েছিলাম, হতেই পারে আই ওয়াজ নট “দ্যাট ইম্পরট্যান্ট” টু ইউ। কিন্তু এখন? তুমি বলছো আমি তোমায় বিশ্বাস করি না, কিন্তু তুমি কি আমায় বিশ্বাস করো অভিমন্যু? আজ দুইমাস আমরা ফোনে কথা বলি কিন্তু আমাদের মধ্যে ঠিক কি “সম্পর্ক”, আদৌ তোমার সাথে আমার কন্টাক্ট আছে কিনা,সেটা কোন তৃতীয়ব্যক্তি জানে না! আমি তোমাকে সব বলেছি আর তুমি? আজ অবধি, তোমার নিজের জীবন নিয়ে একটা কথা আমায় বলো নি। আমি এও জানি না তোমার বাড়ি কোথায়, ফ্যামিলিতে কে কে আছে! তোমার পাস্ট, তোমার প্রেজেন্ট নিয়ে আমার জাস্ট কোনো ধারণা নেই অভিমন্যু, তোমার একটা ফোটো অবধি নেই আমার কাছে! আমাদের সম্পর্কটার আদৌ কোনো ফিউচার আছে কিনা তাও জানি না! এমনকি……এমনকি তুমি আমাকে প্রতিদিন আই লাভ ইউ’ও বলো না! হয়তো তোমার কাছে এগুলো খুব সামান্য ব্যাপার, ইমম্যাচিওর কথা কিন্তু আমার কাছে এই ছোট ছোট ইমোশনগুলো খুব দামি অভিমন্যু! এবার বলো, এতে আমার খারাপ লাগে না? কষ্ট হয় না? কান্না পায় না? তাও তো কিচ্ছু বলি না তোমায়! তোমার শর্তে, তোমার সবটা নিয়ে আমি শুধু “তোমাকে” ভালোবেসেছি অভিমন্যু, তোমার পরিচয়কে নয়। মাঝেমাঝে যেটুকু ছিঁটেফোঁটা ভালেবাসা দাও আমায়, তাই নিয়েই খুশি থাকি! যদি ভালো না বাসতে পারো, তবে তোমার বন্ধুত্বটুকু নিয়েও আমি খুশি থাকবো। শুধু আমাকে তোমার থেকে আলাদা করে দিও না প্লিজ।

বর্ষার ঘোলাটে জলে ফুলেফেঁপে ওঠা হুগলি নদীর মতো চেপে রাখা সব আবেগ, সব অভিমান হৃদয় ছাপিয়ে বেরিয়ে এলো আজ। বলতে বলতে অবুঝ বাচ্চার মতো আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লো তিন্নি আর দুইহাজার মাইল দূরে ঝকঝকে তারা ভর্তি পরিষ্কার কালো আকাশের নিচে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অভিমন্যু। কি ভেবেছিলো আর কি হয়ে গেলো!একটা ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝি থেকে এতো কিছু! মনের ভেতরে এতকিছু চেপে রেখেছিলো তিন্নি অভিমন্যু জানতেও পারে নি। সত্যিই তো! মেয়েটা কোনোদিন কিছু চায় নি ওর কাছ থেকে, শুধু একটু ভালোবাসা ছাড়া। অভিমন্যুর পাথর মন যে তিন্নির ফুলের মতন নিষ্পাপ, নরম মনকে নিঃশব্দে প্রতিদিন আঘাত করে চলেছে তাই বা কে জানতো!দুমড়ে মুচড়ে উঠছিলো বুকের ভেতরটা, অসহায় লাগছিলো নিজেকে এতো দূর থেকে কি করে এই কান্না থামাবে ও? অনেকক্ষণ পর যখন অভিমন্যু নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলো তিন্নির কান্না থামে নি তখনও। একটা গভীর নিঃশ্বাস পড়লো ওর, ভালোবেসেও এতো কষ্ট? এই নরম মনটাকে কেন এতো কাঁদাচ্ছে ও? মন স্থির করে নিয়েভারী,শান্ত গলায় প্রায় আদেশ করলো অভিমন্যু — “সীমন্তিনী, calm down, stop crying।”

সেই গলা, যা শুনে তিন্নি মরেছে প্রথম দিন থেকে! যা তিন্নির শিরায় শিরায় মাতুনি ছড়িয়ে দেয় আজও, এত কান্নার মধ্যেও! মুখে চাদর গুঁজে ফোঁপানো বন্ধ করলো তিন্নি। ঠিক যেন একটা পাঁচবছরের শিশুকে বোঝাচ্ছে তেমনি নরম, শান্ত গলায় অভিমন্যু বলে যেতে লাগলো – কেন কাঁদছো? একবারও বলেছি, আমি তোমায় “ভালোবাসি” না? একটা কথা বলো তো, নিয়মকরে প্রতিদিন “আই লাভ ইউ” না বললে ভালোবাসা বোঝানো যায় না? এই যে রাতের পর রাত তোমার সাথে কথা বলছি এতো রিস্ক নিয়ে, কেন বলছি?ভালোবাসি বলেই তো তোমাকে সুখী দেখতে চাই সীমন্তিনী! আমি চাই না তুমি এভাবে কাঁদো আমার জন্য। আমার অনিশ্চিত জীবনে কোনোদিন সুখী হবে না তুমি। আর তুমি সুখী না হলে আমিও যে শান্তি পাবো না!

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জলগুলো মুছে নিতে নিতে ধরাগলায় তিন্নি বললো — “তুমি যদি আমার সাথে না ‘ই থাকলে তবে আমার কিসের সুখ, অভিমন্যু? আমায় কাঁদিয়ে তুমি নিজেও কি সুখ পাচ্ছো? এটা বোঝো না জেদ করে তুমি নিজে আমায় সরিয়ে না দিলে আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না?”

অর্থহীন এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর হয় না! বিশাল বড়ো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইলো অভিমন্যু।এই একটি মানুষের জন্য বারবার দুর্বল হয়ে যায় মন! অবুঝ, জেদী মেয়েটাকে নিজের করে নিতে চায়, সবসময় আগলে রাখতে চায়। এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রবল মরুঝড়ে কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কি উপায়? মস্তিষ্কের সাথে মনের যুদ্ধে অবশেষে আবারো হার মানলো মস্তিষ্ক। প্রকৃতির প্রবল ঝড় থেমে গেছে ততক্ষনে, ছাইধোঁয়া মেঘ কেটে গিয়ে ফিরে এসেছে রাতের নীলিমা, ঝকঝকে চন্দ্রমার ছটা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে! নিজের “প্রিয় মানুষটির” কাছে হার মেনে নিয়ে তিন্নির ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার মাঝে অস্ফুটে ঠোঁট নড়ে উঠলো অভিমন্যুর

— ও.কে।

কাঁদতে কাঁদতে শব্দ করে নাক টানলো তিন্নি — কি ও.কে?

—- যা তুমি বললে। ….. ও.কে।

***********************__******************************
.
.
.
এত্ত ছোট্ট একটা কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো তিন্নির। ও যা ভাবছে সেটাই কি ঠিক? এত ক্যাজুয়ালি এমন ইনটেন্স ঝগড়ার পরিসমাপ্তি? কি বলবে বুঝতে পারলো না তিন্নি। গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা তপ্ত অশ্রুগুলো মুছে নিতে নিতে ধরা গলায় বললো — “সত্যি?”
— হুমম!
– আ-র? আর কিছু বলার নেই তোমার?
—- তুমি খুব জেদী, সীমন্তিনী।

নরম গলায় পরাজয় স্বীকার করে নিলো অভিমন্যু, শুক্লপক্ষের অষ্টমীর বাঁকা চাঁদের মতো একটা হাসি ফুটে উঠলো তিন্নির ঠোঁটের আগায়, কান্নাহাসি মেশানো গলায় বললো ​– তোমার থেকে কম।
ঠিক যেন ডেজা-ভ্যু! নিজের অজান্তেই অভিমন্যুর গলায় হাসি ফুটে উঠলো, মৃদু বকুনি দিলো এবার — “আর কাঁদবে না।”
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে নিলো তিন্নি। — “কাঁদবো না, বাট প্রমিস মি, আর এভাবে আমায় কষ্ট দেবে না?”
শান্ত, অবিচল প্রতিজ্ঞা তার স্বরে — “প্রমিস।”
— কথায় কথায় আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথাও বলবে না?
— বলবো না। আর কিছু ম্যাডাম?
— আর…….আর কখনো এমন করে বকবে না আমাকে?

চাপা হাসির শব্দটা নিঃশ্বাসে লুকিয়ে নিয়ে নরম গলায় অভিমন্যু বললো — আমি তোমাকে বকি না সীমন্তিনী!! কিন্তু তুমি যে বড্ড অবুঝ!

চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বসে রইলো তিন্নি, এই প্রথমবার অনুভব করলো লংডিস্টেন্সের অভিশাপ। উপলব্ধি করলো আজ যদি ওরা ফোনের বদলে সামনাসামনি থাকতো, এতো সামান্য ব্যাপারে হয়তো এতবড়ো মানঅভিমানের পালা চলতো’ই না! পলকের মধ্যে, চোখের ভাষাতেই সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যেত হয়তো। ভৌগোলিক দূরত্ব চুলোয় যাক, খুব ইচ্ছে করছিলো ম্যাগপাই পাখির ডানা লাগিয়ে উড়ে যায় সুদূর সিকিমের সেই শুকনো পাহাড়ি উপত্যকার সেই জংলা সবুজ মিলিটারি তাঁবুতে, সপাটে জড়িয়ে ধরে সপাটে জড়িয়ে ধরে মনের মানুষটিকে, তার পাথরকঠিন বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেও যে সুখ! আর পারলো না তিন্নি! নরম বালিশে মুখ লুকিয়ে ফোনের রিসিভারটা ঠোঁটের খুব কাছে এনে ফিসফিস করে বললো — “আই মিস ইউ। “

গলায় শব্দ করে হাসলো অভিমন্যু — “আমি তো ফোনেই আছি!”

উফফ্!
কিচ্ছু বোঝে না এই আনরোমান্টিক ভূতটা! উথলে ওঠা মিষ্টি মিষ্টি প্রেমসাগরে হতাশার টকটা লুকিয়ে নিয়ে এবার থেমে থেমে বললো তিন্নি
— আই মিস ….”ই-উ” অভিমন্যু। কতোদিন তোমাকে দেখি নি, তোমাকে ছুঁই নি ! বড্ডো ইচ্ছে হয় একবার তোমায় …….

আর না!
ভেতর থেকে ছিটকে আসা মনের কথাগুলো শেষ করার আগেই ঠোঁটে সেলোটেপ লাগিয়ে নিলো তিন্নি, আর কতো খুলে বলবে? গালদুটো ততক্ষনে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো টকটকে লাল, তেমনি গরম। এবার বোধহয় বুঝলো অভিমন্যু! নিঃশ্বাস চেপে রেখে ঘন হয়ে আসা স্বরে তিন্নির অসমাপ্ত কথার রেশ টেনে বললো – “আর মাত্র সাড়ে চারমাস।”

আর একবার ছলাৎ করে উঠলো বুকের রক্ত, তিন্নির সাথে সাথে অভিমন্যুও কি দিন গুনছে? প্রেমসাগরে মজতে মজতে একটু আগের অভিমানী হৃৎপিণ্ড আর একবার নিংড়ে নিলো দুফোঁটা চোখের জল। ভিজে আসা স্বর সরলভাবে বলে উঠলো — “আর কখনো এভাবে আমায় ভুল বুঝো না অভিমন্যু…… খুব কষ্ট হয় আমার কাঁদতে! বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি যে তোমায়!”

আর একটি বড়ো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে অনেকক্ষন চুপ করে রইলো অভিমন্যু, হয়তো মুচড়ে উঠলো হৃৎপিন্ডটা! তারপর কোমল স্বরে বললো —- এত ভালোবাসা ভালো নয় সীমন্তিনী, পরে তুমিই কষ্ট পাবে!

মোমের মতো গলে যাওয়া মন নিয়ে কোনো জবাব দিলো না তিন্নি। অনেকটা কষ্টের সাথে আবেশ মাখা ভালোবাসার জোয়ার উথলে পড়ছিলো সারা শরীরে, এতো কান্নাতেও এটুকুই তো সুখ, অন্তত ভালোবাসার মানুষটি যে বোঝে সে কতটা ভালোবাসা পায়! অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থেকে শুধু ফোনটা সেঁটিয়ে রাখলো কানে, শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো।

—- সীমন্তিনী?
আর একবার ওর নাম ধরে ডাকলো অভিমন্যু, এবারের স্বর আরো গাঢ়। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে যাওয়া আবেগে বুজে আসা গলায় সাড়া দিলো তিন্নি
— উমম্?
— আই আ্যাম সরি। আর কেঁদো না!
— ও.কে।

ছোট্ট করে জবাব দিল তিন্নি। ফোনের বেতারতরঙ্গের মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দ শিরশিরানি ছড়িয়ে গেল দুপ্রান্তে, শ্রীরামপুর আর নর্থসিকিম আবার বেঁধে রইলো তড়িৎচুম্বকীয় প্রবাহে। আসলে, ধিকিধিকি আগুণ জ্বলছিল দুদিকেই বহুদিন ধরে, দুজনেরই মন পুড়ছিলো অভিমানে। প্রেমেপাগল মানুষদুটো শুধু জানতো না, কি করে মনের কথা মুখে আনতে হয়। কখনো কখনো “ঠিক বুঝে যাবে”র থেকে “ঠিক করে বুঝিয়ে বলা”টা যে বড্ড জরুরী! আজ যখন সন্দেহ, সংশয়, মানঅভিমানের তপ্ত গরল লাভাস্রোতের মতো গলগল করে বেরিয়ে এলো দুজনের মনের ভেতর থেকে, চোখের জলের ধারায় আবার শুদ্ধ হল হৃদয়, ফিরে এলো প্রেম। নিঃশব্দ ভালোবাসার জোর কি তবে পাথরও টলিয়ে দেয়? ভৌগলিক দুরত্ব, সামাজিক প্রোটোকল সবকিছু ভেঙে ফেলে দুজনেরই ইচ্ছে করছিলো একবার ছুটে চলে যায় অপরজনের কাছে, একবার মিশিয়ে নেয় শরীরে শরীরে!

আবেগে বিহ্বল হয়ে থেকে কিছুক্ষন পর অভিমন্যু সামলে নিলো নিজেকে, হাতঘড়িতে সময় দেখে নিজের স্বাভাবিক স্বত্বায় ফিরে এসে বললো — “অনেক রাত হলো, রাখছি এবার। বাট রিমেম্বার, আজকেরটা এক্সেপশন! আর কখনো ফোন করবে না, আমি করবো। ও. কে?”

কেন যে সময়গুলো হাতের মুঠোয় বেঁধে রাখা যায় না? আচ্ছন্ন হয়ে আসা মন নিয়ে কোনরকমে সাড়া দিলো তিন্নি
—- হুমম্!
— আর একটা কথা……
— কি?
— সায়কের থেকে সাবধানে থেকো। বিকজ হি হ্যাড এ থিং ফর ইউ… হি মাইট ট্রাই টু হার্ম ইউ নাউ।

প্রেম প্রেম নেশার চটকাটা ভেঙে গেল এবার! সিকিম থেকে ফেরার পর অফিসের কাজে বারেবারে ইচ্ছাকৃতভাবে সায়ক অপদস্ত করতে চেয়েছিলো তিন্নিকে, সেই কথাগুলো ঝলসে উঠলো মাথায়! অভিমন্যুও কি সেটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে? বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠলো, তারপরই মনের প্রশ্নটা অস্ফুটে বাইরে বেড়িয়ে এলো — “তুমি কি করে জানলে?”

অবিচল, স্থির, গম্ভীর কণ্ঠস্বরটা ভেসে এলো — “জানাটা আমার কাজ সীমন্তিনী! ট্রাস্ট মি!”

— কিন্তু ……সায়ক কেন এমন করবে?
তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তিন্নির। মনে চলছে একটাই প্রশ্ন ‘ওর সকল খুঁটিনাটি খবর অভিমন্যু কি করে জানতে পেরে যায়?’ রক্তে শিরশিরানি জাগানো অভিমন্যুর রাশভারী, গম্ভীর কন্ঠে সম্বিৎ ফিরলো ওর — “তুমি বড্ডো ইনোসেন্ট, সবাইকে চট করে বিশ্বাস করে ফেলো আগের ভুলগুলো ওভারলুক করে! যেটা বলছি, শোনো! নো মোর আর্গুমেন্ট অন দিস।”

উফফ্!
আবার সেই জলদগম্ভীর, মনপাগল করে দেওয়া আদেশজড়িত স্বর, হীরের দ্যুতির মতো ঠিকরে আসা প্রবল পুরুষালী ব্যক্তিত্ব! সব কথাগুলো কানে গেলো না তিন্নির! অভিমন্যু আন্তরিকভাবেই ওর জন্য চিন্তা করে, ওর কেয়ার করে এসব ভেবেই অদ্ভুত মিষ্টি মিষ্টি ভালোলাগায় মনব্যঙাচি লাফিয়ে উঠলো হৃৎপিন্ডের প্রকোষ্ঠে, অলিন্দে-নিলয়ে। অভিমন্যু যেন দাউদাউ আগুন, অবুলুপ্ত ডোডোপাখির মতো সেই আগুনে ঝাঁপিয়ে মরাই যেন তিন্নির ডেস্টিনি।সে বলে না তো কি এসে গেল? অনেক সাহস করে আজ সব অভিমান ভুলে, চোখ বন্ধ করে নিয়ে বেড়ালের মতো আদুরে গলায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক শব্দ তিনটি উচ্চারণ করলো তিন্নি — “আই লাভ ইউ।”
তিনসেকেন্ড সব চুপচাপ, তারপর গলায় শব্দ করে হাসলো অভিমন্যু — “কি বলছিলাম আদৌ শুনলে সেটা?”

— ন নাহ্, ….. বাট আই লাভ ইউ!!
পরপর দুইবার! এখনো কি বলবে না সে?
এমনি কিশোরীচপল পাগল মেয়েকে কি করে কিছু বোঝাবেন মেজর অভিমন্যু সেন? হাল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন একটা, নিজের অজান্তেই ভালোবাসার নরম হাসিতে মুখ ভরে উঠলো ওনার। যে হাসিটা অভিমন্যুকে পুড়িয়ে দেয় প্রতিবার, ছারখার করে দেয় ওর সকল প্রতিরোধ। সেই হাসি মাখিয়ে তিন্নির সকল ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয় দেওয়া মেজর অভিমন্যু সেন নেশা লাগিয়ে দেওয়া ঘন স্বরে বললেন — “আই লাভ ইউ টু। নাউ, গুডনাইট…. কাল কথা হবে।”

অবশেষে তবে মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ হলো।
ছলছলে চোখে কান এঁটো করা হাসি নিয়ে বসে রইলো তিন্নি।কোনোদিন ফোনে ও “বাই” বলে না ও অভিমন্যুকে, আজও বললো না; অন্যদিনগুলোয় “রাখলাম” বলে তিনসেকেন্ড অপেক্ষা করে অভিমন্যু কেটে দেয় কলটা। আজ আরএকটা ব্যতিক্রম হলো, সত্যি বলতে আজ দু-দুটো ব্যতিক্রম অলরেডি হয়ে গেছে! তবে কথায় বলে “বার বার তিনবার”, সাহস জুটিয়ে আজ রাতের তৃতীয় ব্যতিক্রমটাও তিন্নি করেই ফেললো! অভিমন্যু ফোন কেটে দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ওর কান ছুঁয়ে গেলো একটা সুস্পষ্ট, ভেজা চুম্বনের শব্দ।

এক,দুই সেকেন্ডের অপার নিস্তব্ধতা ওপ্রান্তে। তিন্নির কেমন একটা সন্দেহ হলো ~ সে কি শুনতে পেল আদৌ?
তারপর
.
.
তারপর
হালকা হেসে, তিন্নির শরীরের সকল রক্তকনিকাকে তা থৈ তালে নাচিয়ে তোলা হাস্কি ঘনগলায় অভিমন্যু বললো — “প্লেটোনিক ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না ম্যাডাম। যেদিন দেখা হবে, সুদেআসলে এগুলো মিটিয়ে নেবো। “
.
.
.

হায়! কেন যে এই দূরত্বের অভিশাপ!
ফোন রেখে দেওয়ার পর প্রতিটি রোমকূপ খাড়া হয়ে থাকলো তিন্নির, পেটের মধ্যে ফুরফুরে প্রজাপতি উড়ে বেড়াতে লাগলো। সেই রাতে ওর আর ঘুম এলো না। ডিসেম্বর আসতে আর কতো দেরি যেন?

***********************__******************************

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২২
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.

সপ্তাহের মাঝামাঝি, কাজের দিন। শুভ আর তিন্নি দুজনেই নিজের মতো যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে সকাল সকাল। শুভ আজকাল বারীনদার জিমে রিসেপশনে বসছে, তাতে ওর মাসমাইনে তেমন বিশেষকিছু না পেলেও, ফ্রি’তে জিমের যন্ত্রপাতিগুলো নাড়াচাড়া করে, টুকটাক ভিডিও বানিয়ে ইন্সটা,ফেসবুকে দেয়। বারীনদার কথায়, মার্কেট ধরতে এখন জিম করা হট বডি, খোলামেলা চেহারা প্রদর্শন, চুলের কেত, একটু বিতর্কিত টপিক আর হালকা খিস্তিই যথেষ্ট। শুভও তাই করছে….. যদিও এখনো কিছু ভাইরাল হয় নি, কিন্তু হতে কতক্ষন? দুপুরদিকে শুভ বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে একটা ভাতঘুম দেয়, তারপর আবার বিকেল পাঁচটা বাজলো তো বেরিয়ে পড়ে। ফাঁকা বাড়িতে ভাস্বতীদেবী আর রঞ্জনবাবু সেই রাত্রি আটটা নয়টা অবধি। আজ বৃহস্পতিবার – বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ রঞ্জনবাবুও ব্যস্ত, বারান্দায় টেবিলের ওপর আধখাওযা চায়ের কাপ আর দুই তিনটে খবরের কাগজ ছড়ানোছেটানো। বিগত কয়েক সপ্তাহের রোববারের “পাত্রী চাই” কলামে লাল গোল ঢ্যাঁড়া দেওয়া, এগুলো ভাস্বতীদেবীর পছন্দ করে দেওয়া লিস্ট। রঞ্জনবাবুর ওপর দায়িত্ব পড়েছে রাশি রাশি এই বিজ্ঞাপনের ভিড় থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফাইনাল ক্যান্ডিডেটদের বেছে নেওয়া যাদের সাথে বিয়ের কথা অবধি এগোনো যায়, শ্রীরামপুরের ফিরিঙ্গিডাঙার আচার্য্যবাড়ির বড়োমেয়ে সীমন্তিনী আচারিয়ার জন্য। চশমা চোখে “কোনো দাবি নেই” ব্রাহ্মণ পাত্রদের লিস্ট দেখতে দেখতে রঞ্জনবাবু গলা তুললেন

—তিন্নি জানে? ওর যদি আবার কাউকে পছন্দটছন্দ হয়ে থাকে ?

— ওর আবার কিসের পছন্দ? নিজের মেয়েকে তো চেনো! সাত চড়ে রা করবে না, যা করার সব আমাদেরই দেখেশুনে দিতে হবে।

— তাও, একবার অন্তত জিজ্ঞেস করে দেখো! ট্রেনে-বাসে, অফিসে টফিস যাওয়া আসা করে, যদি কাউকে ওর ভালো লেগে থাকে?

— সে ভালো লেগে থাকলে লাগবে! তাই বলে যার তার সাথে তো আর বিয়ে দিতে পারি না।

তিন্নি অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর রঞ্জনবাবুকে জলখাবার দিতে দিতে ভাস্বতীদেবী আরএকবার তিন্নির বিয়ের কথা পেড়েছিলেন। দেখতে দেখতে বছরদুই হয়ে গেল মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরি করছে, সামনের জানুয়ারিতে পঁচিশে পা! এখনই গা না করলে আর কবে বিয়ে দেবেন? ছোট থেকেই কড়া শাসনে রেখেছেন মেয়েকে, যারতার সাথে যাতে প্রেম না করে বসে! বড্ড ভয় করতো ভাস্বতীদেবীর , তিন্নি যা নরমসরম মেয়ে আর বাস্তবজ্ঞানহীন! যদি ভুল কারো সাথে জড়িয়ে পড়ে আর না বুঝেই অনেকটা এগিয়ে যায়? একটু বয়স বাড়তেই তিন্নির আগেপিছে পাড়ার দু চারজন বা কলেজেও যে বেশ কিছু মৌমাছি ঘোরাঘুরি করেনি তা তো নয়, শুভর কাছ থেকে সব খবরই রাখতেন উনি! মায়ের চোখ, তাও স্বীকার করেন মেয়ে ওনার যথেষ্ট সুন্দরী, তার সাথে মেধাবী তো বটেই! পর পর দু-দুটো বোর্ডপরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে স্ট্যান্ড করা মুখের কথা নয়! নেহাত রঞ্জনবাবুর আ্যকসিডেন্টটা হয়েছিল, উনি সুস্থ থাকলে মেয়েকে কি আর ঘরের কাছের বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে স্কলারশিপে পড়তে পাঠাতেন? কিন্তু পাড়া/কলেজে মৌমাছিদের ঘোরাঘুরিই সার, মেয়ে যে মায়ের ভয়ে কারো দিকে চোখ তুলেও তাকাতো না, তাই বেশিদূর এগোয়নি একটাও। এইজন্য মনে মনে একটু প্রচ্ছন্ন গর্ববোধও করেন ভাস্বতীদেবী! আজকালকার দিনে যেখানে এক একটা মেয়ের এই বয়সে তিনটে চারটে করে বয়ফ্রেন্ড আর কথায় কথায় ছাড়াছাড়ি, তিন্নি সেখানে নির্ভেজাল ভালোমানুষ! পাত্রপক্ষের কাছে কি এর ডিমান্ড নেই? তবে ইদানিং মাস দুয়েক, তিনেক মেয়ে যে কারো সাথে অনেক রাত অবধি ফোন কথা বলে, তা টের পেয়েছেন ভাস্বতীদেবী। এইজন্যই এতো তাগিদ ওঁনার, তিন্নি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই বিয়ের কথাবার্তা সেরে রাখতে চান উনি। নয়নয় করে অনেকদিন হয়ে গেছে, রঞ্জনবাবুর কোনো তাপউত্তাপ নেই দেখে নিজেই গত কয়েকসপ্তাহের কাগজে খুঁজে খুঁজে পছন্দের পাত্রের লিস্ট বানিয়েছেন। বেশি কিছু চাহিদা তো নেই ওঁনাদের – একটু অবস্থাসম্পন্ন বনেদী পরিবার, তিন্নির থেকে বেশি বেতনের কোনো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশে সেটেল্ড হলে ভালো আর দাবিহীন পাত্রই খুঁজছেন উনি, সাথে ব্রাহ্মণ, পাল্টি ঘর হতেই হবে – সেটা তো অলিখিত শর্ত। আজ সকাল থেকে মেজাজে রঞ্জনবাবুকে বসিয়ে দিয়েছেন ওনার লিস্ট থেকে দেওয়া ফাইনাল সিলেকশন করে রাখতে, এরপর বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নাম্বার দেখে যোগাযোগ করার কথা, সে হবে না হয় আরএকদিন।
পাড়ার মহিলাদের কাছেও খোঁজখবর লাগিয়েছেন, এখন তো আর ঘটকের অত চল নেই। কারো এক জনের চেনা সূত্রে একটি পাল্টি ঘরের খোঁজও পেয়েছেন – ওঁনারাও একমাত্র ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন তবে একটু তাড়া আছে ওঁনাদের, সামনের মাঘেই ছেলের বিয়ে দিতে চান! সেটা আবার ভাস্বতীদেবীর না পসন্দ। তবে সম্বন্ধটা ভালোই, বলতে গেলে একেবারে ওঁনার মনের মতোই! ছেলে অর্থোপেডিক সার্জন, বিদেশে সেটেল্ড, আদিবাড়ি শ্রীরামপুরেই , লতায় পাতায় অনেক আত্মীয়স্বজন ছড়ানো ছেটানো আশেপাশে। তবে পাত্রের বয়স একটু বেশি, বছর তেত্রিশ-চৌত্রিশ হবে।সে হোক, পুরুষমানুষের আবার বয়স কি? মাসখানেক আগে ছুটিতে দেশে ফিরে ছেলে নাকি কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিলো শ্রীরামপুর, তিন্নিকে দেখেছে দু একবার, যাতায়াতের পথে। তারপর দিনকয়েক আগে ছেলের মা নিজে থেকেই ফোন নাম্বার জোগাড় করে কথা বলেন ভাস্বতীদেবীর সাথে। এখন ওঁনারা বাড়ি এসে তিন্নিকে দেখে যেতে চান একবার – সেই কথাই রঞ্জনবাবুকে বলছিলেন ভাস্বতীদেবী।

নিমরাজি হয়ে সবটা শুনে যাচ্ছিলেন রঞ্জনবাবু। তারপর জিজ্ঞেস করলেন — “তুমি কি করে চিনলে এঁনাদের?”

— “স্টেশনমোড়ে যার কাছে ব্লাউজ বানাতে যাই, তার পাশের বাড়ির – আশালতা, ওর পিসতুতো ননদের ছেলে। “চ্যাটার্জী”, পাল্টি ঘর। ছেলে তো বাইরে থাকে! ছুটিতে পিসির বাড়িতে এসেই নাকি প্রথমবার তিন্নিকে দেখে তারপর অফিস যাতায়াতের পথেও দু একবার দেখেছে। মেয়ে তো আমাদের দেখতে খারাপ নয়! ছেলের নাকি খুব পছন্দ হয়েছে তিন্নিকে। আমাদের পরিবারের কথাও সব জানে ছেলেটি, মানে তোমার অবস্থা আর কি!”

আড়চোখে একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবান্তরটা বুঝতে চাইলেন। কোনো অভিব্যক্তি না দেখে আবার বলতে শুরু করলেন ভাস্বতীদেবী – “ছেলের মা তাই ছেলের কথামতো একবার তিন্নিকে দেখতে চান। তুমি হ্যাঁ বললে সামনের রোববার সকালের দিকেএকাই আসবেন….. সব ঠিকঠাক এগোলে ছেলেটি এই জানুয়ারী নাগাদ আবার আসবে হয়তো তিন্নির সাথে কথা বলতে।“

— ছেলের মা একা আসবেন মানে?

রঞ্জনবাবু মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন দেখে উৎসাহ পেয়ে ভাস্বতীদেবী বলতে লাগলেন – “আসলে ওঁনারা তিন্নিকে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে চান তাই একদম ঘরোয়া ভাবে দেখতে ইচ্ছুক। এর আগে যতবার ওঁনারা ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গেছেন, সবাই নাকি পার্লার থেকে সেজেগুজে, মুখে রংচং মেখে পড়া মুখস্থের মতো করে …… ওই কি বলে গো? তোমরা চাকরিতে দিতে যাও?”

কথাটা পেটে আসছে মুখে আসছে না ভাস্বতীদেবীর।

— ইন্টারভিউ?
স্ত্রীর মুখের ভাবভঙ্গি দেখে আন্দাজেই বললেন রঞ্জনবাবু।

— হ্যাঁ “ইন্টারভিউ”!
স্বস্তির হাসি হাসলেন ভাস্বতীদেবী। — “এর আগে যতবার ওঁনারা ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে গেছেন, সবাই নাকি মুখে রংচং মেখে পড়া মুখস্থের মতো করে ইন্টারভিউ দিয়েছে, বিদেশে যাওয়ার জন্য সবাই তো ছোঁক ছোঁক করছে! ওঁনারা তাই তিন্নিকে সাবলীলভাবে ঘরের মেয়ের মতো দেখতে চান, ওকে না জানিয়ে!”

স্বল্প উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রঞ্জনবাবু — “এটা কি দোকানের শাড়ি কেনা হচ্ছে ভাস্বতী? আট-দশটা শাড়ি বেছে, দাম দেখে কিনবে? একটা শিক্ষিত, ভালো চাকরি করা মেয়ে – তাকে না জানিয়ে ওমন হঠাৎ করে দেখতে চলে আসবে আর তুমি তাতে রাজিও হয়ে গেলে?”

গলা চড়লো ভাস্বতীদেবীর — “আহ্! ব্যপারটা ওমন করে ভাবছো কেন? ধরে নাও না, উনি আমাদের পুর্বপরিচিত, অনেককাল আসেননি, এবারে বাড়িতে এসে হঠাৎ করে তিন্নিকে দেখে গেলেন। এমন ভান করছো যেন তিন্নি পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে যাকে ছেলেরবাড়ি থেকে দেখতে আসছে। তোমার বাড়ির লোকে আমায় দেখতে যান নি?”

— সেটা সাতাশ বছর আগের কথা ভাস্বতী। তখনকার সময় আলাদা ছিল, লোকজন আলাদা ছিল। অনেককাল আগে একটা ভুল হয়েছে বলেই আজকেও সেই একই ভুল করতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই! তিন্নি আজকালকার মেয়ে, চাকরি করছে…. ওর তো সম্মানে লাগতে পারে!

রেগে উঠলেন ভাস্বতীদেবী — “বলছো এমনভাবে যেন আমি তোমাদের জন্মশত্রু! মেয়েকে তো আমি পেটে ধরি নি, তুমি একাই মানুষ করেছো। নেহাত চাকরিটাই করি নি কোনোদিন, সেই জন্য এ বাড়িতে আমার কোনো সম্মানও জুটলো না!”

বলতে বলতে চট করে গলাটা নরম করে নিলেন ভাস্বতীদেবী। অফ টপিকের কথা তুলে এখন ঝগড়া অশান্তির সময় নয়, ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা সামলাতে হবে। রঞ্জনবাবু মুখ খুলতে যেতেই নরম করে বললেন —- “ভেবে দেখো, যদি এখানে বিয়ের কথা ফাইনাল হয়েই যায় তবে তো তিন্নিকে আর গাধার খাটুনি এই চাকরি করতে হবে না! ছেলে বাইরে থাকে, তিন্নিকেও ওখানেই নিয়ে যাবে, সারাজীবন পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবে। তাই তো বলছি, এমন হাতের লক্ষী ঠেলে দিও না। আর তাছাড়া……. “
একটু দম নিলেন ভাস্বতীদেবী, তারপর মনের শঙ্কাটা মুখে প্রকাশ করে ফেললেন। —- “দেখতে এলেই যে ব্যপারটা বিয়ে অবধি গড়াবে তা তো নয়!”

রন্জনবাবু তখনও নিমরাজি দেখে তুণ থেকে শেষ অস্ত্র বার করলেন ভাস্বতীদেবী, একটু জোরেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন —- “তোমার আর কি! সারাজীবন হুইলচেয়ারে বসেই কাটিয়ে দেবে। জ্বালা তো আমার, এরপরে বয়স বেড়ে গেলে একা হাতে মেয়ের বিয়ে দেব কি করে সে খেয়াল আছে?”

বিষন্ন হয়ে গেলেন রঞ্জনবাবু, হাতের কাগজগুলো মুড়ে রেখে বললেন –“তিন্নিকে না জানিয়ে বাড়িতে ডেকো না। ওকে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করো।“

— তোমার সাথে সকাল বিকেল মেয়ের অত কথা, তুমিই জিজ্ঞেস করো। তবে এখন একদম না, আগে ওঁনারা দেখে যাক, তারপর! নয়তো তোমার জেদি মেয়ে সামনেও আসবে না।

হাল ছেড়ে দিলেন রঞ্জনবাবু — দেখো! যা ভালো বোঝো করো তবে!

আবার উৎসাহে টগবগ করে উঠলেন ভাস্বতীদেবী। — “সামনের রোববার এঁনাদের আসতে বলছি?।“

ভাস্বতীদেবী চলে গেলে বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো রঞ্জনবাবুর। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে সবাই জানে, তাও মনটা খারাপ লাগছে। মেয়ের বাবাদের বোধহয় আঁতুড়ঘরের দিন থেকেই শুনে আসতে হয় “মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, এখন থেকে সামলে চল”। একদিন না একদিন তিন্নি এবাড়ি ছেড়ে “নিজের বাড়ি”, শ্বশুরবাড়ি চলে যেতই সে তো সেই মেয়ের জন্মেরদিন থেকেই মনকে প্রস্তুত করে এসেছেন রঞ্জনবাবু। কিন্তু আর কটা’দিন অপেক্ষা করে গেলে হতো না? মেয়েটা বড্ডো অবুঝ, বড্ডো জেদি আর বড্ডো চাপা মন, কাউকে মুখ খুলে কিচ্ছু জানায় না! নতুন পরিবার, নতুন পরিবেশ কি করে মানিয়ে নেবে? তারা যদি তিন্নির গভীর মনটাকে না বুঝে সেটাকে উন্নাসিকতা বলে ভুল বোঝে? যে ছেলেকেই ওঁনারা তিন্নির জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করুন না কেন, সে যদি তিন্নির নরম মন, ওর কবিতা, ওর হঠাৎ হটাৎ হারিয়ে যাওয়াগুলোকে অবহেলা করে? তিন্নি তো কষ্ট পেলেও জানাবে না ওঁনাদের! সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার, তিন্নি ছাড়া ওঁনার রোজের দিনগুলো কিভাবে কাটবে এবার? চোখের কোণ ভিজে এলো রঞ্জনবাবুর।

**************************__****************************

নির্মল নীল আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, রেল লাইনের ধারে কাশফুলের সারি আর বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। সবে বিশ্বকর্মাপুজো শেষ হলো, আর সপ্তাহদুই পরই “মাঁ” আসছেন বাপের বাড়ি। তবে তাতে তিন্নির আর কি, ঝাঁচকচকে আই.টি কর্পোরেট অফিসের চাকরি দুর থেকে দেখতে যতই গ্ল্যামারাস লাগুক না কেন, ভেতর ভেতর তো ঠুনকো ফোঁপলা! মাত্র দুইদিন ছুটি! তার ওপর এবছরের ষষ্ঠী থেকে নবমী উইকডে। অন্যন্যবার পুজোর দিনক’টা ছুটি নিয়ে নেয় কিন্তু এবারের সব ছুটি তিন্নি বাঁচিয়ে রাখছে ডিসেম্বরের জন্য। শরতে অকালবোধনে পুরো বাংলা, সবাই মেতে উঠবে মাতুক না, তিন্নির কাছে অকালবোধন না হয় অভিমন্যু ফিরলে পৌষের ক্রিসমাসেই হলো?

তবে আজকাল তিন্নির কাজে খুব ভুলচুক হচ্ছে। এই তো গত পরশুই অনসাইট ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিল একটা, প্রেজেন্টেশনের দায়িত্ব ছিল তিন্নির ওপর। ভিডিও কনফারেন্সে কল চলছে, প্রজেক্ট ম্যানেজার, ক্লায়েন্ট ম্যানেজার বাঘা বাঘা লোকজনসব বসে, মাঝ প্রেজেন্টেশনে তিন্নি দেখে মাঝের তিনটে স্লাইড মিসিং! কি ভাগ্যিস, একটা ছোট্ট পেনড্রাইভে সব ব্যাকআপ ফোল্ডার রাখা থাকে তিন্নির কাছে! নিজের মনগড়া কিছু কথা বলতে বলতে চট করে পেনড্রাইভে থেকে কম্পিউটারে প্রেজেন্টেশনটা লোড করে নিয়েছিল তিন্নি! ভিডিওকলে মিটিং উৎরে গিয়েছিলো কিন্তু মিথিলেশ ঠিকই নজর করেছিল, পরে তিন্নিকে ডেকে একটু ঝাড়ও দিয়েছিলো যে আগে থেকে চেক না করে কেন মিটিংয়ে এসেছিলো তিন্নি। লজ্জায় মুখ খুলতে পারে নি তিন্নি, নিজের ওপর বড্ড রাগ হচ্ছিল ওর। এই প্রথম বোধহয় এমন কোনো ভুল হলো, সারাদিন কলকাতায় বসে সিকিমের কথা ভাবলে যা হয় আর কি! সায়কও পরে এসে বলেছিলো ওকে, সারাদিন ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এমনি হয়। মজা করেই বলেছিলো হয়তো! তিন্নিও জবাব দিতে ছাড়ে নি অবশ্য, এই মিটিংটার দায়িত্ব ওদের দুজনের ওপরই ছিল, সায়ককে লাস্ট মোমেন্টে তিন্নি পাঠিয়েছিলো প্রেজেন্টেশনটা, ওরও তো দেখে নেওয়া উচিত! অবশ্য সায়কের এক্সকিউজও ফেলনা নয়। ও’ই বা কি করে জানবে তিন্নির ফাইলে ঠিক ক’টা স্লাইড থাকার কথা! তাই চুপ করে গিয়েছিলো তিন্নি, কথা বাড়ায় নি আর! মনে মনে নিজেকে চার পাঁচটা লাথি মেরে শাষিয়েছিলো তিন্নি – যে করেই হোক, মনকে লাগাম পড়িয়ে প্রফেশনাল আর পার্সোনাল জীবনের মধ্যে সীমারেখা টানতেই হবে এবার। সকাল নয়টা থেকে বিকেল সাড়ে ছয়টা অবধি আর একদম অভিমন্যুর কথা ভাববে না তিন্নি! কিন্তু মন কি শোনে মনের কথা? সে তো ফড়িং ডানা মেলে বারবার উড়ে যায় উত্তর সিকিমে, সেই মনের মানুষটির কাছে যার গাঢ় বাদামি চোখ তাড়িয়ে বেড়ায় তিন্নিকে – স্বপ্নে কি বাস্তবে।

অভিমন্যুর কথা মতো সায়ককে একটু এড়িয়েই চলছিল তিন্নি কিন্তু ঠিক এড়ানোও যাচ্ছিলো না। সত্যি বলতে এক অফিসে, এক প্রজেক্টে কাজ করে কতদিন কাউকে এড়ানো যায়? বিশেষ করে সায়ক ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর থেকে আবার আগের মতো স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে আসে তাইতেই তিন্নি আরো কেমন জানি একটা অপরাধবোধে ভুগছে। না শোনার থেকে “না” বলতে আরো বেশি মনের জোর লাগে। এটা তো অস্বীকার করা যায় না, পরিস্থিতির চাপে এক’একজন এক’একরকম রিআ্যক্ট করে! তিন্নি নিজে কি পারফেক্ট? মোটেও না! অভিমন্যু ওকে গ্যাংটকের হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার পর তিন্নিও তো মেঘা, পিয়াসা, সবার ওপর রাগ করেছিল, রূঢ় ভাষায় কথা বলেছিলো। মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে অভিমন্যুও হয়তো একটু বেশিই পজেসিভ তিন্নিকে নিয়ে।

আর্মি অফিসার অভিমন্যু সেন আর পজেসিভনেস? তাও আবার তিন্নিকে নিয়ে?
কথাটা ভাবলেই পেট থেকে গুলগুলিয়ে হাসি বেরিয়ে আসে তিন্নির, আবার একটা শিশিরভেজা কুয়াশাচ্ছন্ন ভালোলাগাতেও মনটা ভরে যায়!মানুষটা কম কথা বলে, হয়তো মন খুলে সব ইমোশন প্রকাশ করে না কিন্তু ওর আপাত পাথরকঠিন বুকের ভেতর তিন্নির জন্য যে নরম ভালোবাসা আর প্রবল অধিকারবোধ লুকিয়ে আছে, সেটা খুব ভালো করেই টের পায় তিন্নি। অজানা ভালোবাসায় শিরশিরিয়ে ওঠে তখন বুকের ভেতরটা। তাই আর ব্যতিব্যস্ত করে তোলে না মানুষটাকে নিত্যনতুন চাহিদা নিয়ে। বহতাকালের সাথে তাল মিলিয়ে, সময়ের সাথে সাথে পরিণত এবং গভীর হয়ে উঠছে ওদের সম্পর্ক আর মানিয়ে নিচ্ছে তিন্নি – সম্পর্কে কম্প্রোমাইজ যদি করতেই হয়, তবে ও’ই করুক না হয়! সেই মানুষটার ওপর তো আরো গুরুদায়িত্ব রয়েছে, ১৩৩ কোটি দেশবাসীর মধ্যে একজন অতিসাধারণ আই.টি ইঞ্জিনিয়ার মিস সীমন্তিনী আচারিয়ার হঠাৎ হঠাৎ মনখারাপ সামলানোর থেকে মেজর অভিমন্যু সেনের চওড়া কাঁধে চাপানো দায়িত্ব যে আরো বেশি ইম্পরট্যান্ট।

একা একা ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করছিলো তিন্নি, কি করা উচিত, কি করা উচিত নয় এসব নিয়ে মনের মধ্যে কাটাছেঁড়া চলছিল ওর, সায়ক এসে বসলো ঠিক ওর পাশটিতে – “কি রে? তুই কি এখনো আমার ওপর রাগ করে আছিস?”

চমকে উঠে ধরা পরে যাওয়ার অস্বস্তির হাসি হাসলো তিন্নি — “খামোকা রাগ করবো কেন?”

—- এই যে, নিজে থেকে আমার সাথে কথাই বলিস না!

কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না তিন্নি। সায়ক ওর দিকে আরএকটু ঝুঁকে পড়ে গলা নামিয়ে বললো
— এক মাসের ওপর হয়ে গেছে তোর কাছে ক্ষমা চাইলাম! তারপরও আমার সাথে আর আগের মতো কথা বলছিস না, সবসময় ছাড়া ছাড়া ভাব !.. রাগ ছাড়া আর কি?

একদৃষ্টিতে সায়ক দেখে যাচ্ছিল তিন্নিকে – আজ ও পড়েছে একটা নেভিব্লু কুর্তি, চুলগুলো চুড়ো করে মাথার ওপর ক্লাচার গিয়ে আটকানো, এপাশ ওপাশ থেকে এক দুগাছা চুল আলগোছে মুখের আশেপাশে ছড়িয়ে। চাবুকসটান চেহারা, অলঙ্কার বলতে একহাতে ঘড়ি, ব্যস আর কিচ্ছু নেই। তাতেও যেন ঝলসে যাচ্ছিল সায়কের চোখ, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে আঠার মতো এঁটে রইলো তিন্নির দিকে। সায়কের অদ্ভুত জ্বলজ্বলে দৃষ্টি কেমন যেন একটা অন্য সিগন্যাল পাঠাচ্ছিল তিন্নির মাথায়। কেন জানি মনে হচ্ছে সায়ক মুখে অন্য কথা বললেও ওর চোখ অন্য কথা বলছে। ভাবনাটা বেশি পাত্তা না দিয়ে তিন্নি চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল — “নতুন ডেলিভারেবলগুলো দেখলি?”

— কাজ ছাড়া কি আমার সাথে আর অন্য কোনো ব্যাপারে কথা বলা যায় না?

—আর কি নিয়ে কথা বলবো অফিসে?

চুপ করে গেলো সায়ক, তারপর একটু ইতস্তত করে বললো — “সীমন্তিনী, আজ বিকেলে আমার সাথে কফি খেতে যাবি?”

মনের ভেতরে কে একজন সাবধান করে দিলো সাথে সাথে। অভিমন্যুকে বললে আবার রাগ করবে না তো? ভুরু কুঁচকে সটান দাঁড়িয়ে পড়লো তিন্নি — “হঠাৎ চা ছেড়ে কফি?”

— কিছু কথা বলার ছিল রে তোর সাথে, একটু সিক্রেটে, অফিসে বলতে চাই না। বেশি দূরে যেতে হবে না, আমাদের অফিসের দুটো বিল্ডিং পরেই সিসিডি, ওখানেই চল? বিকেল চারটে? মাই ট্রিট।

— কারণটা কি বল তো! কেমন একটা অন্যরকম… অডবিহেভ করছিস যেন??

ভাঙা ভাঙা গলায় সায়ক বললো — “এ অফিসটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি রে, আজ পাতা ফেলে দিলাম। দুই মাসের নোটিশ পিরিয়ড।”

— সে কি? কেন???
এবার জেনুইনল্যি অবাক হলো তিন্নি।

— “এভাবে নয়! আজ বিকেলে কফি খেতে চল, সব বলবো। অফিসে সবার সামনে এসব ডিসকাস করা উচিত নয়।”

নিচু গলায় কথাক’টা বলে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে গেলো সায়ক, তিন্নিকে হ্যাঁ/না কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই।

দূরের দেওয়ালে ঝোলানো হলিডে ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়লো তিন্নির, সেপ্টেম্বরের প্রায় শেষ এখন। আর সপ্তাহদুই পরেই পুজো। হঠাৎ করে চাকরি ছাড়ছে কেন সায়ক? ও ই তো একসময় তিন্নিকে বারণ করেছিল এই অফিসের চাকরিটা ছাড়তে। মনের চোরাগোপনের অস্বস্তিটা সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল তিন্নির, আজকাল সায়ক কেমন যেন একটু “অন্যরকম ভাবে” তাকিয়ে থাকে না ওর দিকে?
ধুর!
অভিমন্যুর কথা শুনে ওর’ও মাথা খারাপ হয়ে গেছে! বিকেলে কথা বললেই তো সবটা ক্লিয়ার হবে।

আনমনা হয়ে নেভিব্লু আনারকলি কুর্তির হিল্লোল তুলে ক্যাফেটেরিয়া থেকে ওডিসির দিকে পা বাড়ালো তিন্নি। ইতিউতি মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকা আরো দুইতিনজন সহকর্মীর বুক থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এলো চাপা দীর্ঘশ্বাস, সীমন্তিনী আচারিয়া ওই দুদিনের ফচকে ছোকরা সায়কের সাথেও কথা বলে কিন্তু ওদের সাথে বলে না? কি আছে সায়কের মধ্যে যা ওদের মধ্যে নেই?

**************************__****************************

বিকেল চারটে বেজেছে। দুপুরের ভাতঘুম জড়ানো কলকাতা শহর একটু একটু করে আড়মোড়া ভাঙছে, সেক্টরফাইভের সিসিডির ঠান্ডাঘরে ম ম করছে রোস্টেড কফি আর চকোলেট সসের অনুপম সুবাস, তিন্নির সবচেয়ে প্রিয় দুইটি জিনিসের কম্বিনেশন। ছড়ানো ছেটানো বেতের চেয়ারে দুই তিনজন কাপল বা বন্ধুর দল , অফিস কেটে পুজোর প্ল্যানিং করতে এসেছে বোধহয়। নিজের জন্য একটা ক্যাপুচিনো আর তিন্নির জন্য একটা এক্সট্রা ডার্ক চকলেট “ডেভিল’স অন” অর্ডার করে বেতের সোফায় শরীর এলিয়ে দিলো সায়ক। মিনিট কয়েকের মধ্যেই অর্ডার এসে গেলো টেবিলে, মুখোমুখি বসে তিন্নি ওর দিকে ভুরু উঁচিয়ে তাকিয়ে সায়ক কি বলবে শোনার জন্য।

বেশ কিছুক্ষন সময় কেটে যাওয়ার পর গলা খাঁকড়ি দিলো সায়ক — “আজ কিন্তু তোকে ফাটাফাটি লাগছে দেখতে! নীল রঙে দারুন মানায় যাই বলিস!”

সায়কের এই পুরোনো স্বভাব, মসকা চড়ানোগুলোতে তিন্নি খুব পরিচিত, পাত্তা না দিয়ে শুকনো গলায় বললো — “হঠাৎ করে পাতা ফেললি কেন? কোথায় জয়েন করছিস? কলকাতা না বাইরে?”

একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলো না সায়ক। একদৃষ্টিতে তিন্নিকে দেখতে দেখতে বললো — “তুই কিন্তু এ কয়েকমাসে অনেকটা বদলে গেছিস!”

অবাক চোখে তাকালো তিন্নি — “হুহ্? কি বদলে গেলাম?”

“দেখতে আগের চেয়ে সুন্দরী হয়েছিস, চেহারায় চটক এসেছে, কনফিডেন্স লেভেল হাজারগুণ বেড়ে গেছে, আরো আ্যট্রাকটিভ হয়েছিস”~ কথাগুলো জিভের আগায় চলে এলেও নিজেকে আটকালো সায়ক। মুখে বললো
— না…. মানে আগে তুই কেমন চুপচাপ থাকতিস, দুঃখী দুঃখী ভাব। এখন সবসময় বেশ হাসিখুশি, সেজেগুজে অফিস আসিস, শার্প উত্তর দিস! আগে তো ফোন ছুঁয়েও দেখতিস না, এখন বোধহয় তোর হাতের সাথে আঠা দিয়ে আটকানো!

হেসে ফেললো তিন্নি — “ভালো! তোর কি আর কোনো কাজ নেই যে সবসময় আমি কি করছি দেখে যাচ্ছিস?”

—- আমি একা নয়, সবাই নোটিস করছে, এই তো সেদিন প্রবালদা’ই বলছিল যে …..

হাত তুলে থামিয়ে দিলো তিন্নি, আর ভালো লাগে না ওর, সবসময় এ কি বলেছে সে কি বলেছে শুনতে! –“যেজন্য এখানে ডাকলি, সেটা বল এবার। কি এমন কথা যে অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায় বলা যাবে না?”

দমে গেল সায়ক। প্রশংসা করলেও খুশি হয় না এমন মেয়েকে আর কি বলে নরম করা যায়! চুপ করে মনেমনে পরপর কথাগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলো আর তিন্নি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো সিসিডির ইন্টেরিয়র, মনে মনে ভাবছিলো, অভিমন্যু কলকাতায় ফিরলে এইরকম একটা জায়গা খুঁজে কফিডেটে গেলে কেমন হয়? আচ্ছা, অভিমন্যু কি কফি পছন্দ করে? আজই জিজ্ঞেস করতে হবে তো!মনেমনে ডিসেম্বরে শীতের ওম মাখা মিষ্টি মিষ্টি কফিডেটের দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে আনমনা তিন্নি ধীরেসুস্থে টলগ্লাসের হুইপক্রিমটা সরিয়ে শীতল ক্যাফিনে সবে একটা চুমুক দিতে যাচ্ছিলো, সায়কের প্রশ্নটায় বিষম খেলো আচমকা।

— তোর বয়ফ্রেন্ড আছে?
মন না আয়না? আজকাল কি সবাই ওর মনের কথা পড়ে ফেলছে নাকি? সায়ক ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে নিজেকে সামলে নিলো তিন্নি। হাতের গ্লাসটা সামনের কাঁচের নামিয়ে রেখে বললো – “হঠাৎ এ কথা?”

চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন বদলে গেল সায়কের। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা চেটে নিয়ে বললো – “তোকে একটা কথা বলার ছিল সীমন্তিনী।“

এক ঝটকায় মিষ্টি মিষ্টি প্রেমপ্রেমভাব উবে গিয়ে সতর্ক হয়ে উঠলো মন, চারমাসের পুরোনো ফ্লাশব্যাকগুলো ফিরে এলো হঠাৎ। সায়কের চোখের এই দৃষ্টি, গলার স্বর তিন্নির খুব পরিচিত। দমকলের লালঘন্টি তখন ঘন ঘন বেজে ওর মাথায় আবার যেন বিপদসঙ্কেত পাঠাচ্ছে, সিকিমের হোটেলের ঠিক সেই দিনটার মতো। মনেমনে অলরেডি নিজেকে গালি দিচ্ছিলো তিন্নি, ইডিয়টের মতো কি মরতে সায়কের কথায় এখানে আসতে রাজি হলো ও! তবে আর যাই হোক, এটা তো আর সিকিমের বন্ধ হোটেলরুম নয়, পাবলিক প্লেস! এখানে নিশ্চয়ই সায়ক সিন্ ক্রিয়েট করতে সাহস পাবে না! সেই ভরসাতেই মনের ভাব মুখে প্রকাশ না করে তিন্নি গলা শক্ত রেখে বললো – “বল! আই আ্যম অল ইয়ারস।“

— ঠিক বুঝতে পারছি না কি করে বলবো!

স্পষ্টতই বিরক্তি ফুটে উঠলো এবার তিন্নির মুখে — “মুখ দিয়ে বলবি, আবার কি?”

কিছুক্ষন সব চুপচাপ, সায়ক যেন মুখ তুলতেই পারছে না! তারপর ঠান্ডা হয়ে আসা ক্যাপুচিনোর কাপে চোখ আটকে রেখে তিনটে শব্দ তারপর ছিটকে এলো সায়কের মুখ দিয়ে
—- আমি তোকে লাইক করি, মানে ভালোবাসি।

হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলো তিন্নি, নিজের ওপর রাগে আর উত্তেজনায় কানের ডগা লাল হয়ে উঠলো ওর। সায়ককে কি রেসপন্স করবে তিন্নি, তারও আগে ওর মাথায় ঘুরছিলো একবারও সায়ককে না দেখে, শুধুমাত্র তিন্নির মুখের কথা শুনেই “অভিমন্যু” কি করে সায়কের দুর্বলতা জেনে গেলো, তাও আবার অতদিন আগেই? প্রথম চমকটা সামলে নিয়ে সায়কের চোখের দিকে সরাসরি তাকালো তিন্নি — “পাগলামো করিস না সায়ক। তোর মাথার ঠিক আছে? কি যা তা বলছিস তুই?”

— পাগলামো নয় সীমন্তিনী, আমি সত্যি তোকে ভালোবাসি! অনেক দিন ধরে…… বলবো বলবো করেও বলে উঠতে পারি নি, ভেবেছিলাম তুইও জানিস।

তিন্নির কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো এবার, তেতে উঠে বললো — “আমি? আমি কি করে জানবো সায়ক? তুই শুধুই আমার কলীগ……”

— শুধুই কলীগ?
চোয়াল শক্ত হয়ে গলা চড়ালো সায়ক – “সারা অফিসে একমাত্র আমার সাথেই তুই হেসে হেসে কথা বলিস না? একমাত্র “আমার” সাথেই নিচের ফুটে চা খেতে নামিস, আমার কথায় ঘুরতে এলি সিকিম, আমাকে লিফটে জীবনানন্দের কবিতা শুনিয়েছিলিস…. তোর মনে পরে না, সীমন্তিনী?”

শেষের দিকে সায়কের গলাটা কেমন যেন হাহাকারের মতো শোনালো। হততম্বের মতো চেয়ে রইলো তিন্নি, কি থেকে কোথায় চলে গেছে সায়ক!
ব্যাপারটা হাতের বাইরে বেরোনোর আগে, সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো

– “সায়ক, তুই কিন্তু ভুল ভাবছিস!”

— কিসের ভুল? কোনটা ভুল? এতদিন ধরে লিডঅন করিস নি তুই আমাকে? টানা দুইবছর তোকে লাইন মেরে গেলাম আর তুই “বুঝতে পারিস নি”? ওদিকে যেই আর্মির ওই হাঙ্কিপাঙ্কি লোকটাকে দেখলি অমনি একঘন্টার আলাপে ওর প্রেমে গলে গেলি? ওর সাথে যদি তোর ট্রেনে দেখা না হতো, তাহলে তো আজ আমার প্রেমেই হাবুডুবু খেতিস! ভুল বলছি কিছু?

—- সায়ক!!
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো তিন্নির, চেঁচিয়ে উঠলো প্রায় — “এবার কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস তুই!”

আশেপাশের লোকজন ওদের দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে দেখে গলা নামিয়ে নিলো তিন্নি। নিচু অথচ স্পষ্ট গলায় বললো — “একটা কথা শুনে রাখ, আমি কোনোদিন তোর প্রেমে হাবুডুব খাই নি, ভবিষ্যতেও খেতাম না। হ্যাঁ, এই প্রজেক্টে তোর সাথে আমি হেসে কথা বলেছি কারণ বাকিরা কেউ “তোর মতো” দিনের পর দিন আমার সাথে কথা বলতে আসে নি, তোর মতো প্রতিদিন আমাকে “চা খেতে যাওয়ার” জন্য সাধাসাধি করে নি। নর্থবেঙ্গল ট্রিপটাও তুই টানা তিনমাস ধরে আমাকে সেধে গিয়েছিলি সায়ক! আমারও তো একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে হয় মাঝে মাঝে – সেটা ভুল? আর কবিতা? কবিতা আমার প্রাণ! আমার দুঃখ হলে কবিতা বলি, আনন্দ হলে কবিতা বলি, আবেগে কবিতা বলি! You happened to be in that place on that day! তোর বদলে অন্য কেউ সেদিন লিফটে থাকলে সেও কবিতা শুনতো সায়ক।“

অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো সায়ক. অনেকপরে গলায় শব্দ খুঁজে পেলো — “তুই আমার সাথে আর সবার তুলনা করতে পারলি?”

তিন্নি চুপ করে রইলো। সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না,তা সে যতই সত্যি হোক না কেন। যে সত্যি অন্যকে নির্মম আঘাত করে, সেই সত্যিকে মৌনতায় বদলে নিলো তিন্নি। কিন্তু ওর ঠান্ডা চোখের দিকে তাকিয়ে সায়ক উত্তর পেয়ে গেল, কাতর গলায় বলে উঠলো — “একবার বল না সীমন্তিনী, তুই এসব মিথ্যা কথা বলছিস!”

তিন্নির মনটা ভরে যাচ্ছিলো অনেকটা খারাপলাগায়, কিন্তু কিভাবে সায়ককে বোঝাবে ও, তিন্নির দিক থেকে সায়ক ছিল শুধুই বন্ধু, তার একটুও বেশি না? নরম গলায় বললো — “কেন মিথ্যে বলবো সায়ক?”

দুজনের মাঝে বেতের মোড়া সরু কাঁচের টেবিল। লম্বা হাত বাড়িয়ে তিন্নির ডানহাতটা জোর করে সায়ক নিজের হাতে জড়িয়ে নিতে, এক মুহূর্তে শিউরে উঠলো তিন্নি! এ কি করছে সায়ক, এতো লোকজনের সামনে? সায়কের সেদিকে খেয়াল নেই, সব হারানোর গলায় বলে উঠলো —“তাহলে…… তাহলে আমার কি হবে? আমি যে তোকে ভালোবাসি?“

— কিন্তু আমি তো তোকে ভালোবাসি না!

সায়কের ঘামে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে হাত আরো জোরে এবার চেপে ধরলো তিন্নিকে, শক্ত আঙুলে ওর নরম চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে যেন, কটকট করে বাজছে হাড়গুলো। হিংস্রভাবে মুখচোখ কুঁচকে সায়ক বলে উঠলো — “তবে এতদিন ধরে আমায় নাচালি কেন?”

বারুদের স্তুপে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি পড়লো এবার। বিদ্যুত্স্পৃষ্টের মতো ছিটকে উঠে নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে সায়কের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো তিন্নি। মাথার মধ্যে দপদপ্ করে জ্বলে ওঠে বারুদটা একটু শান্ত হলে স্থির চোখে তাকিয়ে বললো
— “ মাইন্ড ইওয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ সায়ক, লিমিট ক্রস করিস না। আই আ্যম সরি…. কথাটা বলতে আমার খারাপ লাগছে, শুনতে তোর আরো খারাপ লাগবে! বাট ট্রুথ ইজ, আমার জীবনে তুই “স্পেশাল” কেউ নোস, তুই শুধুই আমার কলীগ! আগে বন্ধু ছিলিস, কিন্তু এখন…. শুধুই “কলীগ”। আই আ্যম সরি, যদি তোর মনে হয় এতদিন তোকে “নাচিয়েছি” বা, লিডঅন করেছি! বিশ্বাস কর, সেগুলো জেনেবুঝে করিনি। তোর বলা হাজারটা কথার মধ্যে আমি হয়তো দশটি কথায় “হ্যাঁ” বলেছি! সেটা যদি তোকে নাচানো হয়, আমি জানি না আর কি করা উচিত ছিল। আমার জীবনে একজনই আছে, অভিমন্যু।“

বাহ্! অসাধারণ!
মুখ ফস্কে অভিমন্যুর নাম বেরিয়ে যেতেই মনে মনে নিজেকে একটা চড় মেরে ঠোঁটে অদৃশ্য সেলোটেপ লাগিয়ে নিলো তিন্নি!

সায়কের চোখ ছোট হয়ে এলো — “মানে, ওই লোকটার সাথে তোর এখনো কন্টাক্ট আছে?”

নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করার ব্যর্থ প্রয়াস করলো তিন্নি — না!

— মিথ্যে বলিস না সীমন্তিনী, আমাকে লোকাতে পারবি না তুই।

কখনো কখনো নম্রতা, ভদ্রতার সীমারেখা টানাটা খুব জরুরি। কফির দামটা মনেমনে হিসেবে করে পার্স থেকে টাকা’কটা বার করে টেবিলের ওপর রেখে সটান উঠে দাঁড়ালো তিন্নি, যেন মেজর অভিমন্যু সেনের কঠিন হিমশীতল গলা প্রতিফলিত হলো ওর স্বরে – “শেষবারের মতো সাবধান করছি সায়ক, আমার পার্সোনাল ব্যাপারে নাক গলাস না। নিজের চরকায় তেল দে।“

বিকেলের কমলা আলোয় নেভিব্লু আনারকলি কুর্তির অতুলন হিল্লোল তুলে সেক্টর ফাইভের সিসিডির স্বয়ংচালিত দরজা দিয়ে দৃপ্ত পায়ে বেরিয়ে গেল তিন্নি। ভাঙাচোরা মুখ নিয়ে সায়ক বসে রইলো পিছনে। ঠান্ডা হয়ে আসা না ছোঁওয়া ক্যাপুচিনো কাপ আর একটু একটু করে ঘরের তাপমাত্রায় ফিরে আসা কোল্ডকফির গ্লাস পড়ে রইলো কফিটেবিলে, পাশাপাশি থেকেও যেন ওরা হাজার আলোকবর্ষ দুরে।

——————————————————-

***********************__*****************************