তৃ-তনয়া পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
787

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৬
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেদী চলে গেলো আর নাহিদা গালে হাত রেখে দাড়িয়েই রইলো! তার মুখে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা, মনে জানান দিয়েছে অন্যরকম এক ভালো লাগা! মানুষটা কোন প্রকৃতির, সেটা বুঝা মুশকিল! কখনো মনে হয় পাগল, কখনো বাজে লোক, কখনো জোকার আবার কখনো মনে হয় একজন আদর্শ স্বামী হওয়ার চেষ্টা করছে! তা যদি হয় তাহলে তো জীবনটাকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলার স্বপ্নটা দেখতে শুরু করবে সে। দু’হাতে আঁকড়ে ধরবে নতুন পৃথিবী!
আনন্দে বিমোহিত মনে নাহিদা রুমটা গুছিয়ে নিলো। মেহেদীর জামাকাপড় ধুয়ে সে নাস্তা করতে বসলো মেহেরুনের সাথে। মেহেরুন ইসলাম বললো,
– ভার্সিটি যাস না কেন? ক্লাস চলে না?
– হ্যাঁ, চলে।
– তাহলে?
– এমনি।
– এমনি বললে হবে না! পড়াশোনা চলমান রাখতে হবে। তোর বাবাকে বলে এনেছি আমি, পড়াশোনা যতদূর করতে পারিস সব ব্যবস্থা আমি করে দিব। নিয়মিত ক্লাস কর। আজও তো যেতে পারবি। ক্লাস করে আয়। সংসারের কাজে মন না বসিয়ে পড়াশোনায় মনযোগ দে। আর গাধাটাকে একটু আঁচলে বেধে রাখ। আমি যতদিন বেচে আছি, এছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোর।
– আজ যাবো না। শনিবার থেকে দেখি।
– আচ্ছা।
নাস্তা করে দুজনেই মেহতাজের সাথে ভিডিও কলে কথা বললো এবং আয়াশ ও আরিশার সাথেও কথা বললো। দুপুরে জহিরুল ইসলাম বাড়ি ফিরেছেন সাথে নিয়াজ উদ্দিনকে নিয়ে। অফিস যাওয়ার সময় মেহেদী রিকশায় গেলেও আসার সময় গাড়িতে এসেছে নিয়াজ উদ্দিন তাদের বাড়িতে আসছে বলে। এতোদিন পর বাবাকে দেখতে পেয়ে নাহিদা খুব খুশি। দুপুরে খাওয়াদাওয়া হলো একসাথে। নাহিদার খুব ইচ্ছে করছে বাবার সাথে বাড়িতে যেতে। নিয়াজ উদ্দিন জহিরুল ইসলামের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলার সময় নাহিদা মেহেরুনের রুমে এলো।
– মা?
– হ্যাঁ, আয়। কিছু বলবি?
– অনেকদিন হলো মায়ের সাথে দেখা হয় না। একদিনের জন্য যাই বাবার সাথে?
মেহেরুন ইসলাম মুচকি হেসে বললেন,
– ছেলের বউ করে এনেছি বলে কি ঘরবন্দী করে রাখবো! যখন ইচ্ছে মায়ের সাথে দেখা করে আসবি। যতদিন ইচ্ছে থেকে আয়। তবে আবার মাস পাড় করে দিস না! আমারও যে একা থাকতে ভালো লাগে না!
– তাহলে আপনিও চলুন।
– আমি গেলে কালকেই তোকে চলে আসতে হবে। তার চেয়ে একাই যা। থেকে আয় দুচারদিন। মেহেদীকে বলে দেখ যায় কি-না।
– আচ্ছা।
নাহিদা তার বাবাকে বলে খুশি মনে রুমে এলো। মেহেদী টিশার্ট জিন্স পড়ে রেডি। কোথাও যাওয়ার জন্য বের হবে মনে হচ্ছে! নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
– কোথাও যাবে?
– হ্যাঁ। কেন?
– বাড়িতে যাবো।
– এখন কি রাস্তায় দাড়িয়ে আছো?
– বাবার বাড়িতে যাবো। মাকে বলেছি। মা বলেছে যেতে। যাবে না?
– মাথা খারাপ তোমার! সকালে মাত্র কন্ট্রাক্ট পেপার সাইন করিয়েছি আর তুমি এখনই চলে যাবে! মাস শেষে পুরো পাচ হাজার টাকা দিতে হবে! তুমি চলে গেলে কিভাবে! খেয়ে খেয়ে টাকার উশুল তুলতে হবে না!
– কি আযব কথাবার্তা বলছো! বাবার খরচ বাচবে এতেও হিংসে করতে হবে! আমি কতদিন হলো এসেছি, মায়ের সাথে দেখা হয় না! যাই একটু? চারদিন থেকে চলে আসবো।
– চারদিন! বারো বেলার খাবার লস!
মেহেদীর এই তামাশা মোটেও ভালো লাগছে না। নাহিদা গোমড়া মুখু হয়ে তাকিয়ে রইলো! মেহেদী তাকে আয়না দেখে বডি স্প্রে করতে করতে বললো,
– বাবার সাথে তুমি যাও। আমার কারো বাড়িতে যেতে ভালো লাগে না।
– প্রথম বার বেড়াতে যাবো, তা-ও একা?
– তো কি হয়েছে! গেলে যাও, না গেলে নেই!
– গেলে কি হয়!
– আমি বেইলি রোড যাবো এখন।
নাহিদা মুখটা মলিন করে তার ব্যাগ গুছাতে লাগলো। মেহেদী তৈরি হয়ে বসে আছে। নাহিদাকে এতো ধীরে ধীরে গোছগাছ করতে দেখে বললো,
– এতোক্ষন লাগে ব্যাগ গুছাতে! ঝটপট করো।
– আপনার এতো তাড়া কেন! আপনি কি যাবেন সাথে!
– ক্ষনে তুমি আবার ক্ষনে আপনি! এটা কেমন ভাষা! বারবার এমন ভাষা চেঞ্জ করো না তো! আপনি করে বললে নিজেকে বুড়ো বুড়ো লাগে! আর মনে হয় সত্যিই আমি তোমার নানা! কেননা সবাইকে তুমি করে বললেও নানাকে আপনি করে বলতাম! এনিওয়ে, তোমরা বের হলে আমি বাসা থেকে বের হবো। তাই তাড়া দিচ্ছি। তারাতাড়ি করো, নয়তো বলো আমি গুছিয়ে দেই।
নাহিদা কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। সে তার কাজ করেই যাচ্ছে। বাথরুমে জামা পাল্টে এসে বোরকা হাতে নিয়েছে। মেহেদী পেছনের দিকে দুহাত রেখে খাটে ভর দিয়ে হেলে বসে আছে আর পা নাড়াচ্ছে! দৃষ্টি নাহিদার দিকেই। তাই নাহিদা বোরকা পড়তেও যেন লজ্জা পাচ্ছে। সে বাথরুমে গিয়েই বোরকা পড়ে এলো। যতক্ষণ পর্যন্ত হিজাব পড়লো ততক্ষণ পর্যন্ত আয়নায় তাকে দেখছিলো মেহেদী। নাহিদার তখনও খুব অসস্তি লাগছিলো! কি দেখছে সে এমন করে! এভাবে কারো দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়! এতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকলে একটা মানুষের ভেতর কতোটা অসস্তির সৃষ্টি হতে পারে তার কি জানা নেই! জানবে কি করে, তার মাঝে তো কোনোরকম অনুভূতিই নেই!
ভাবতে ভাবতে নাহিদা তার হিজাব গাথা শেষ করলো। মেহেদীর এমন দৃষ্টান্ত দেখে সে তারাতাড়ি করতে গিয়ে উল্টাপাল্টা লাগিয়ে আরও দেড়ি করে ফেলেছে। জুতা পড়ে সে লাগেজ হাতে নিলে মেহেদী উঠে এসে লাগেজ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাহিদা তার পিছু পিছু বেরিয়ে মেহেরুনের কাছে বিদায় নিয়ে বের হলো। জহিরুল ইসলামের কাছ থেকে মেহেদী গাড়ির চাবি নিয়ে নিয়াজ উদ্দিন ও নাহিদাকে গাড়িতে উঠতে বললো। মেহেদীর হাবভাব দেখে নাহিদার মনে হচ্ছে মেহেদী যাচ্ছে তাদের সাথে। আবারও মনে হচ্ছে যদি সে যায় তাহলে ড্রাইভারকে নিলো না কেন!
বাড়িতে এসে মেহেদী নাহিদার লাগেজ ঘরে দিয়ে নাফিসা ও রুমানা বেগমের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করলো। তখনই নাহিদা জানতে পারলো মেহেদী চলে যাবে! তাদের পৌছে দেওয়ার জন্য এসেছে সে! রুমানা থাকতে বললো কিন্তু সে কাজের তাড়া দিলো। বেরিয়ে আসার সময় নাহিদাকে বললো,
– চলে যাচ্ছি আমি।
নাহিদা মালিন মুখে বললো,
– শুধু শুধু আসার কি দরকার ছিল! অন্য গাড়ি করে বাবা আর আমি আসতে পারতাম!
মেহেদী ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– না এলে যে গাড়িটা নিতে পারতাম না আব্বুর কাছ থেকে! এসেছি আর রাত পর্যন্ত লং ড্রাইভের একটা সুযোগ পেয়েছি! আল্লাহ হাফেজ।
– সাবধানে যেও, আর রাতে বাইরে থাকার প্রয়োজন নেই। কাল ছুটির দিন। সারাদিন গাড়ি ও মানুষ দুজনেই ফ্রী।
– তোমার শ্বশুর মশাই ফ্রী না।
বলতে বলতে মেহেদী বেরিয়ে গেলো। নাফিসা লাফিয়ে এসে নাহিদার দুকাধ ঝাপটে ধরে বললো,
– ভাইয়া কি বলেছে কানে কানে?
– তোর জানার কি প্রয়োজন!
– হুহ্! ঢং! আমি কিন্তু শুনে ফেলেছি!
– তাহলে তো শুনেছিস ই! জিজ্ঞেস করার কি আছে! সর!
– হিহিহি… শুনিনি! যাইহোক কিউটিপাই, ভাইয়া কিন্তু ওভার স্মার্ট! চলাফেরা, হেয়ার স্টাইল, ড্রেস আপ, হ্যান্ড ওয়াচ প্লাস ব্রেসলেট! ওফ্ফ! জাস্ট পারফেক্ট!
নাহিদা হিজাব খুলতে খুলতে বললো,
– ব্রেসলেট! অন্যের হাতে দেখলে বলেন রিকশার টায়ার পড়ছে! আর নিজ ভাইয়ার হাতে দেখে এখন সেটা ব্রেসলেট হয়ে গেছে!
নাফিসা খিলখিল করে হেসে উঠলো এবং বললো,
– সেজন্যই তো বললাম ওভার স্মার্ট! তবে আরাফ ভাইয়ার স্মার্টনেস কিন্তু সবদিক থেকেই পারফেক্ট!
– হুম।
– মেহেদী ভাইয়াকেও মানায়! দেখতে একেবারে হলিউড হিরো! আজ শুধু সানগ্লাসটার অভাব ছিলো!
– সানগ্লাসটা পকেটে ছিল! বাবাকে দেখে পড়েনি তখন!
– অহ! আমি তো ভাবলাম সানগ্লাস আনেইনি! ইশ! নাজিয়া আপু এলেও খুব ভালো হতো!
– আপু কি এখন আসবে! মাত্র ক’দিন হলো গিয়েছে।
– সেটাই তো! ক’দিন থাকবে তুমি?
– দু-চার দিনের মতো।
– ভার্সিটি যাও না কেন? যাবে না আর?
– হ্যাঁ যাবো আগামী সপ্তাহ থেকে। চল, মায়ের কাছে যাই।
কিচেনে এসে নাহিদা বললো,
– মা, তুমি কি সারাদিন রান্নাঘরেই পড়ে থাকো!
– রাতের জন্য রান্না বসাবো না!
– দাও, আমি কেটেকুটে দেই।
– তোর শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিয়ে এলি না!
– বাড়ি ফাকা রেখে কি উনারা আসবে! তাছাড়া আমি দুচারদিন এখানে থাকবো, উনারা কি থাকবে! যাওয়ার সময় বললে আসবে।
– মেহেদীও তো তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো! কিছু একটা খেতেও দিতে পারলাম না!
– সুযোগ দিলে তো খাওয়াবে! তাছাড়া মাত্র খেয়ে এসেছে। কি যেন কাজে বেইলি রোড যাবে।
– রাতে আসবে?
– না।
মা ও বোনের সাথে গল্প করে কিছুক্ষণ মেহেদীকে ভুলে থাকলেও সন্ধ্যার সাথে সাথে নাহিদার মনেও ভয়ের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে! মেহেদীকে নিয়ে তার যতসব ভয়! সে যে লং ড্রাইভের কথা বলে গেলো, সে কি কোনো পার্টিতে জয়েন করবে! তাদের তো অভ্যাস খারাপ! বন্ধুবান্ধব একসাথে হলেই পার্টি করে আর মাদক দ্রব্য সেবন চলে! এমন যেন না হয়, সেই প্রার্থনাই করে যাচ্ছে মনে মনে! মাগরিবের নামাজ আদায় করে সে মেহেদীর ফোনে কল করলো,
– আসসালামু আলাইকুম?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
– কে?
– নাহিদা বলছি।
– অহ! বলো…
– কোথায় আছো?
– বেইলি রোড।
– এখনো সেখানে!
– এলামই মাত্র!
– নামাজ পড়নি?
মেহেদী দুষ্টুমি মাখা কন্ঠে বললো,
– ইশারের আযান দেয়নি তো এখনো!
– মাগরিবেরটার কথা জিজ্ঞেস করেছি।
– মাগরিব উল্লেখ্য ছিল না!
– ওফ্ফ! এতো প্যাচাতে পারে কথা!
– হাহাহা… পড়েছি।
– বাসায় ফিরবে কখন?
– জানিনা।
– একটা কথা রাখবে?
– সম্ভব হলে।
– চাইলেই সম্ভব হবে।
– বলো।
– ফ্রেন্ডরা আছে সাথে?
– তাদের নামে বদনাম বলবে নাকি!
– ধুর!
মেহেদী আরও একবার হাহা.. করে হেসে বললো,
– কি যেন বলবে, বলো।
– তুমি কি আজও…
– কি আজও?
– মেসেজ করি, দেখে কেটে দিবে।
– ঠিকানা দেই, কানে কানে এসে বলে যাও।
– আমি মেসেজ দিচ্ছি কিন্তু…
কল কেটে নাহিদা দ্রুত মেসেজ করলো, “ড্রিংকস করো না প্লিজ! হারাম এসব! বাবা-মা জানতে পারলেও খুব কষ্ট পাবে। প্লিজ, রাখো এই কথাটা। ওসব বাজে অভ্যাস ছেড়ে দাও প্লিজ!”
মেসেজ সেন্ট করে তা ডিলিট করে নাহিদা রিপ্লাইয়ের আশায় বসে রইলো ফোন হাতে নিয়ে। কলেই বলতো কিন্তু নাফিসা অথবা তার মা যাতে শুনতে বা আন্দাজ করতে না পারে সেজন্য মেসেজ করে দিলো। কিন্তু মেহেদীর যে কোনো রিপ্লাই আসছে না! সে কি মেসেজ দেখেনি! নাকি দেখে তার অনুরোধ মানতে পারছে না বলে রিপ্লাই করছে না!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৭
(নূর নাফিসা)
.
.
বিষয়টা ভীষণ ভাবাচ্ছে নাহিদাকে! মেহেদীর রিপ্লাই না পেয়ে সে মন খারাপ করে অনলাইনে ঢুকলো। ফ্রেন্ডের কাছ থেকে ফোর্থ ইয়ার বুক লিস্ট সংগ্রহ করে নিলো। অনলাইনেও মন টিকছে না। তাই কিছু সময় পর আবার অফলাইনে চলে এলো। নাফিসা রুমে এসে পড়তে বসেছে। নাহিদা উঠে তার ছোট্ট ব্যাংকটা হাতে নিলো। প্রায় তিন হাজারের মতো জমা আছে। আরও কিছু ছিলো যেটা কক্সবাজার খরচ করে ফেলেছে। এগুলো দিয়ে বই কেনা হবে কিনা কে জানে! না হলেও কিছু করার নেই। এখন সে বিবাহিতা, বাবার কাছে বইয়ের কথা বলতে পারবে না। শ্বশুর শ্বাশুড়ির কাছে তো আরও আগে বলতে পারবে না! আর স্বামী! তাকে কিভাবে বলবে! বললেই সে দিবে কিভাবে! সে নিজেই তো বউয়ের পার্স ফাকা করে চলাচল করছে! আপাতত নিজের এই সম্বলটুকু কাজে লাগানো যাক। যেগুলো কেনা যায় সেগুলোই পড়া যাক।
ইশার নামাজ আদায় করে দুই মেয়ে ও পিতামাতা একসাথে খেতে বসলো। খাওয়ার পরপর আবার নাজিয়া ও আরাফের সাথে ফোনে কথা বললো তারা। শতদিকে ব্যস্ত থাকার পরও নাহিদার মাথায় মেহেদী ঘুরপাক খাচ্ছে! এতটা সময়ে সে নিশ্চিত হয়ে গেছে, আজ নিশ্চয়ই সে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় জমে গেছে! সে কি মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরবে! নাকি বাড়িতেই ফিরবে না! রাত দশটার পর মেহেদীর ফোন থেকে কল এলো। নাহিদা ফোন সাইলেন্ট এ রেখে শুয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। ফোনের স্ক্রিন জ্বেলে উঠায় হাতে নিলো। নাফিসা এ রুমে পড়ছে তাই সে ফোন নিয়ে পাশের ফাকা রুমটাতে চলে এলো। একবার কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বার কল আসতেই নাহিদা রিসিভ করলো। কিছু না বলে কানে ধরলো মেহেদীর কথা শুনার জন্য।
– হ্যালো?
-….
– হ্যালো? শুনতে পারছো না?
-…..
– নাহিদা? হ্যালো? আরে, ফোন রিসিভ করলো কে! নাহিদা? নাকি নাফিসা? কথা বলছো না কেন?
– জ্বি?
– ফোন রিসিভ করে কোথায় চলে গেলে! এখন যে আমার ব্যালেন্স কতটা কেটে গেলো? জরিমানা দাও।
– কত টাকা?
– একটা কোলবালিশ।
– ঠিক আছো? আমার কন্ঠ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে!
– টেনশন হচ্ছিলো?
নাহিদার চোখে পানি এসে গেছে! সে কাপানো কণ্ঠে বললো,
– খুব! খুব টেনশন হচ্ছিলো আমার! এখনো হচ্ছে! বুঝতে পারছি না আমি কিছু! ফোনে তো আর প্রকৃত কণ্ঠ ভেসে আসে না! তাছাড়া আজ প্রথম কথা হচ্ছে ফোনে। ফোন কলে এই কণ্ঠটা কেমন হতে পারে সেটা আমার মুখুস্ত নয়! একটুও মুখুস্ত নয়!
– রিলেক্স! যখন মেসেজ দিয়েছিলে তখন আমি গাড়িতেই ছিলাম বেইলি রোডে। সাথে ফ্রেন্ডস ছিলো। একের পর একজন বেশ কিছুক্ষণ ড্রাইভিং-এ ছিলাম! ইশার আযান পড়তেই একত্রে নামাজ পড়েছি। অত:পর রেস্টুরেন্টে ডিনার চললো। ডিনারে ছিলো চিকেন ফ্রাই, রাইস, মাটন কারি এন্ড কুল্ফি। এর বাইরে কিছুই ছিলো না! ডিনারে আমার পকেট থেকে এক টাকাও খরচ হয়নি। সেখান থেকে চলে গেলাম ব্যাডমিন্টন ক্লাবে। মাত্র ত্রিশ মিনিট খেলেছি। সেখান থেকে বাসার দিকে রওনা দিয়েছি, সাথে নিয়েছি….. কি যেন বলে! ওই যে আচারের সাথে মিক্স করে, ঝোল টাইপ, ঝাল টক মিষ্টি স্বাদ! কি যেনো…
– টনিক?
– অহ হ্যাঁ, টনিক! ওটা খেতে খেতে রাস্তা পাড় করে বাসায় ফিরে এখন বেড রুমে বেডে আছি। বিশ্বাস না হলে ইমোতে কল দিয়ে দেখো। না হয় তোমার ইমো নম্বর দাও। আমি তোমার এই নম্বরে ট্রাই করে পেলাম না!
– এটা ইমোতে নেই।
– তাহলে যেটা আছে সেটা সেন্ট করো।
– লাগবে না।
– টেনশন কমেছে?
– হুম।
– আমার যে খুব টেনশন হচ্ছে! আমি ঘুমাবো কি করে! আমার এখন ঘুমই আসবে না!
– কেন?
– আমার কোলবালিশটা খুজে পাচ্ছি না! দেখেছো তুমি?
– কোনটা? আমি তো কোনো কোলবালিশ ইউজ করতে দেখলাম না এই কদিনে!
– দেখোনি তুমি!
– না।
– দেখবে কিভাবে! তুমি তো শোয়া মাত্র ঘুমে তলিয়ে যাও!
– ওহ! কিন্তু ঘুম ভাঙলেও তো দেখলাম না কখনো! মেহতাজ আপুর রুমে তিনটা দেখেছিলাম। দুইটা বড় একটা ছোট। সেগুলোর মধ্যে কি একটা?
– আরে না! গত রাতে যেটা নিয়েছিলাম সেটা। ভুলে গেছো?
এবার নাহিদার মাথায় ধরা দিলো! সে সত্যিই ভুলে গিয়েছিলো গত রাতের কথা! এখন যে বড্ড হাসি পাচ্ছে! সে কি করবে! পাশের রুমে নাফিসা! তাকে হাসতে শুনলে দৌড়ে এসে পড়বে! কিন্তু হাসি চেপেও রাখতে পারছে না! মুখে হাত রেখে নিচু শব্দে সে ফিক করে হেসেই দিলো! মেহেদী তার হাসির শব্দ শুনে বললো,
– আমার ঘুম নষ্ট করে হাসো! ভুলে যাও কেন, আমি যে মেহেদী! তোমার হাতের রাঙা মেহেদী! গাঢ় রঙ আমার! রঙ উঠার আগেই চুলকানি উঠবে দেখো!
হঠাৎই ভেসে এলো নাফিসার কণ্ঠ!
“ভাইয়া! রঙ উঠার আগেই চুলকানি উঠবে মানে? বুঝলাম না ব্যাপারটা! বাট বুঝার জন্য ইন্টারেস্টেড!”
নাহিদা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে নাফিসা তার হাসির শব্দ শুনে হঠাৎ এসে ফোন টেনে নিয়ে যাওয়ায়! অন্যদিকে আবার হাসিও পাচ্ছে খুব! এই ভেবে যে নাফিসার কন্ঠ শুনার পর মেহেদীর আর কোনো শব্দ শুনা যাচ্ছে না! সে কি শকড!
নাফিসা জবাব না পেয়ে বললো,
– হ্যালো, ভাইয়া? শুনতে পাচ্ছেন?
– হ্যাঁ?
– মিনিংটা বুঝান?
– কিসের মিনিং?
– ওই যে, রঙ উঠার আগেই চুলকানি উঠবে…!
– এতোক্ষণ ধরে কি তুমি আমার সব কথা শুনছিলে?
– না, আপুর হাসি শুনে এসে এটুকুই শুনলাম। কিন্তু বুঝলাম না কিছুই?
– তাহলে আর বুঝতে হবে না। অর্ধবচন বুঝতে নেই! রাত অনেক হয়েছে তো! ঘুমিয়ে থাকো তোমরা।
– ধুর! আপুর মতো, কথা খুব চাপানো রাখতে পারেন আপনিও! হাসতে ভালো লাগে তাই ভাবলাম আমিও একটু হাসি। তা আর হলো না। নাও, ধরো তোমার ফোন!
নাহিদার হাতে ফোন দিয়ে নাফিসা চলে গেলো। মেহেদী তার প্রতুত্তরে বললো,
– আমার যে এখন হাসি আসছে না!
– নাফিসা চলে গেছে। কিন্তু হাসি আসছে না কেন? শকড হয়েছো?
– শুধু কি শকড হয়েছি! বেড থেকে সোজা ফ্লোরে চলে গেছি!
নাহিদা আবারও হেসে উঠলো এবং বললো,
– আচ্ছা! এই ঠান্ডার মধ্যে ফ্লোরে বসার প্রয়োজন নেই। বিছানাটা বেশ আরামের। সেখানে থাকলেই ভালো হয়!
– তুমি তো আছো মজে! তোমার মজা এদিকে আমার সাজা! রাত অনেক হয়েছে, ঘুমাও গিয়ে।
– ওকে। গুড নাইট। আল্লাহ হাফেজ।
– হু, গুড নাইট ফর ইউ! বেড নাইট ফর মি! আল্লাহ হাফেজ।
মেহেদী কল কেটে দিলো। নাহিদা হাসলো তার কথায়। অত:পর ঘুমানোর জন্য বিছানায় চলে গেলো। নাফিসাও শুয়ে পড়েছে। নাহিদার মনটা খুব খুশি খুশি লাগছে। অন্ধকার রুমে শুয়ে শুয়ে সে মেহেদীর কথাগুলোই স্মরণ করছে! কলটা রিসিভ করার সময় ভয়ে ভেতরটা কাপছিলো আর এখন হাসিয়ে তারপর কল কাটলো লোকটা! অদ্ভুত একটা মানুষ! কে বলেছে সে বজ্জাত! সে তো তার পরিবার সহজাত! সে সম্পূর্ণ তার বাবামায়ের মতোই রসিক ও ফুরফুরে মনমানসিকতার মানুষ! যেটা সে অতি দ্রুতই প্রমাণ করে দিচ্ছে! খুব অল্প সময়ে সে যে কতটা ডেবে গেছে এই মনের কাদায় সে কি জানে সেটা! সে জানবে কোথা থেকে! এই মনের মালিক ই তো মাত্র জানলো! কিন্তু এতো দ্রুত এমনটা হওয়ার কারণ কি! এটা কি সেই বিয়ে নামক অটুট বন্ধনের মোহনীয় জাদু! হবেই না কেন! পবিত্র একটা সম্পর্কে যে আবদ্ধ হয়েছে তারা! এটা খুব শক্তিশালী বন্ধন! এর মাঝে অনেক জাদু আছে! মানুষের চামড়া থেকে শুরু করে হাড়ের ভেতর পর্যন্ত আক্রমণ করে ফেলে এবং বিপুল পরিমাণে বদলে দেয় মানুষ ও তার জীবনধারণ!
কিন্তু মেহেদীকে দেখে কখনো এমনটা মনে হয়নি যে, সে এতো তারাতাড়ি নিজেকে এভাবে বদলে নিবে! যতই থাকুক মা-বাবা আর স্ত্রীর প্রচেষ্টা, নিজেকে নিজে শুধরাতে না চাইলে কারো সাধ্য নেই তাকে শোধরানোর! নিজের ভেতর প্রচেষ্টা থাকলেই না অন্যের ধাক্কায় মাঝি আটকে যাওয়া নৌকা ভাসাতে পারে! কিন্তু মেহেদীর ক্ষেত্রে এতো তারাতাড়ি এটা কিভাবে সম্ভব হলো! এর কেন্দ্রীয় কোনো কারণ ধরা পড়ছে না নাহিদার চোখে! যতই অদৃশ্যমান হোক, এর মূলে নিশ্চয়ই কিছু আছে! কিন্তু সেটা কি!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৮
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে শিথি এসেছে নাহিদার সাথে দেখা করতে। দুজন সমবয়সী। কিন্তু শিথির পড়াশোনা বন্ধ আছে। তিন বোন মিলে আড্ডা দিলো, একসাথে নাস্তা করলো। শিথি আবার জোর করেই তাদের বাসায় নিয়ে গেলো। মা বোনের সাথে বাড়িতে ভালোই কাটছে তার সময়। সারাদিন মেহেদীর সাথে কথা না হলেও বিকেলে মেহেরুন ইসলাম কল করেছে নাহিদার কাছে। তার কাছে জানতে পারলো মেহেদী নাকি রাতে খাট থেকে পড়ে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে! এবার বুঝতে পারলো নাহিদা, কাল তাহলে মেহেদী সত্যিই খাট থেকে পড়ে গেছে! সে তো ভেবেছিলো মেহেদী দুষ্টুমি করে বলেছে! বিষয়টা জানার পর এখন খারাপ লাগছে নাহিদার কাছে! আবার রাগও হচ্ছে মেহেদীর উপর! মানুষটা এমন যে, সবসময় মজায় মজে থাকে! কখন সিরিয়াস কথা বলে আর কখন ফান করে বুঝাই যায় না! নাহিদার সাথে কথা বলার পর মেহেরুন রুমানার সাথে গল্প করেছে! ফোন কল কাটার পর মেহেদীকে কল করেছিলো নাহিদা কিন্তু ওয়েটিংয়ে পেয়েছে। সন্ধ্যায় বেশ কয়েকবার কল করেছে তখনও ফোন রিসিভ হয়নি। কোথায় আছে, কি করছে, কে জানে! যেখানেই থাকুক, ভালো থাকলেই হয়!
.
তুর্যের বাড়ির লোকজন এসেছে আজ আরাফের বাড়িতে। নাজিয়া সকাল থেকেই লেগে পড়েছে রান্নাবান্না নিয়ে। আয়েশা বেগম সেদিনের পর থেকে কথা বলে না বললেই চলে। তবে আজ বলে বলে এটা সেটা করাচ্ছে তাকে দিয়ে। কথামতো না হলে মাঝে মাঝে দু একটা ঝাড়িও দিচ্ছে, যেটা তার চিরাগত স্বভাব! দুপুরের শেষ ভাগে এসেছে মেহমান। তুর্য আসেনি তাদের সাথে। এসেছে তুর্যের মা বাবা, দুই চাচা, এক চাচি ও বড় বোন আর দুলাভাই। তারা আসার পরপরই নাজিয়া খাবার রেডি করে দিলো। আশিক আরাফ সবাই বাড়িতে আছে আজ। তারাই সব কিছু আনানেওয়া করছে। খাওয়াদাওয়ার শেষে তুর্যের মা আয়াতের হাতে আংটি পড়িয়ে দিলো। পরক্ষণেই বসলো বিয়ের দিন পাকা করার জন্য এক বৈঠক। দু পরিবারেরই মতামত, ছোটখাটো অনুষ্ঠান করবে তারা। দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে তুর্যের নিষেধ আছে তাই তারা কিছু দাবি করেনি। বাকিটা তাদের ইচ্ছে। এতে যেন আয়েশা বেগম মহা খুশি! অথচ, নিজের ছেলের বেলায় উল্টো মনোভাব! বিয়ের দিন ঠিক করলো দু সপ্তাহ পরে। কিন্তু তুর্যের ভাগিনা-ভগিনীদের পরীক্ষা! এরপর দিলো একমাস পরে! তখন আবার তুর্যের বাবা-মা হজ্জে যাবে! এর পর হজ্জ থেকে ফিরে দিতে গেলে অনেক দেড়ি! তখন আবার আয়াতের পরীক্ষা! এতো দেড়ি আয়েশা বেগম কিছুতেই করবে না! সৃষ্টি হয়েছে প্রকট ঝামেলা! সকল বিষয় বিবেচনায় এনে এক পর্যায়ে তুর্যের বাবার প্রস্তাব আজই বিয়ে হোক। কোনো অনুষ্ঠানের প্রয়োজন নেই! ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হবে, বউ নিয়ে চলে যাবে তারা। এতে কোনো ঝামেলা বাধবে না! এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় দেখছে না। আলফাজ সাহেব আর নিষেধ করলো না। কিছু দিন আগে এক ঝড় গেলো, পরিবারে এখন এমনিতেই টানা পোড়েন লেগে আছে! মেয়ের বিয়েতে খরচ করার কথা ভাবতে বসলেও বারবার ভাবতে হবে! হাতে দু পয়সাও নেই, সেখানে ভেবে কি হবে! তাই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আয়াতের মনটা খারাপ হয়ে গেছে! কেননা তার বিয়েতে জাকজমাক কিছু হবে না! এমনকি ফ্রেন্ডদেরও দাওয়াত করতে পারলো না! তবে মন খারাপের অগ্রভাগে খুশি লেগে আছে। পরিবার যে তুর্যকে মেনে নিয়েছে সেটাই অনেক!
.
বিকেলে মেহেদী তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে বুড়িগঙ্গার তীরে ঘুরছিলো। রায়ানের ফোনে তার বাবার কল এলো। রায়ান সালাম দিয়ে রিসিভ করলো,
– আসসালামু আলাইকুম, বাবা। বলো?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কোথায় তুই?
– ঘুরতে বেরিয়েছি একটু।
– ঢাকাতেই আছিস?
– হ্যাঁ।
– বাসায় গিয়ে পাঞ্জাবী পড়ে কাজীকে সাথে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি আয়।
– কাজীকে সাথে নিয়ে মানে!
রায়ানের বাবার কথা না শুনতে পারলেও রায়ানের মুখের শেষ উক্তি শুনে বাকিরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে! অপর পাশ থেকে তার বাবা আবার বললো,
– বিয়ে পড়াবে এখন। তারাতাড়ি আয়, আমরা এখানেই আছি।
– বাবা, এখন বিয়ে! আমি বুঝতে পারছি না কিছু!
অত:পর মেহেদী তার হাত থেকে ফোন নিয়ে রায়ানের বাবাকে সালাম দিয়ে কথা বললো। কল কেটে উল্লাসিত হয়ে রায়ানের পিঠ চাপড়ে বললো,
– তুর্য মশাই, চলেন আপনাকে বর সাজাই! দোস্ত আয়, তুর্যের বিয়ে খেয়ে আসি! এমন হঠাৎ হঠাৎ দু একটা দাওয়াত পড়লে কি যে আনন্দ লাগে রে!
জিহাদ বললো,
– মানে কি?
– মানে হচ্ছে, রায়ানের বিয়ে আজ এবং এখন। বিয়ের দিন পাকা করতে গিয়ে উপযুক্ত কোনো দিন ঠিক করতে পারছে না তারা তাই আজই বিয়ে! চল এবার বরকে সাজিয়ে দাত মাজতে মাজতে বিয়েতে যাই।
তুর্য বাদে বাকিরা হেসে উঠলো! মেহেদী তুর্যকে নিয়ে শপিংমলের দিকে ছুটলো আর বাকি দুজনকে কাজী অফিসে পাঠিয়ে দিলো। তুর্যের বোন ও দুলাভাই এসেছে শপিংমলে। সব ব্যবস্থা করে তারা সন্ধ্যার পর আলফাজ সাহেবের বাড়িতে এলো। সন্ধ্যার আগেই নাজিয়া আবার রান্নার আয়োজন শুরু করেছে। আলফাজ সাহেব নিয়াজ উদ্দিনকে গুরুতর ডেকেছে এখানে আসার জন্য। নাজিয়া ও আয়েশা বেগমের কাছে রান্নার আয়োজন সামলানো দায় হয়ে পড়ছে! তাছাড়া নাজিয়াকে আবার আয়াতকেও তৈরি করতে হবে। তাই আয়েশা বেগম আশিককে পাঠিয়ে দিয়েছে তার ছোট বোনকে আনতে যেতে। আশিক তার খালাকে নিয়ে আসার পূর্ব পর্যন্ত নাজিয়া কিচেনে কাজ করেছে। পরবর্তীতে আয়াতকে তৈরি করতে চলে গেছে। তুর্যের বোন ও নাজিয়া আয়াতকে প্রস্তুত করে দিলো। মেহেদী হৈ-হুল্লোড় স্বভাবের হলেও এখানে এসে চুপচাপ হয়ে গেছে! সে জানতো না সে আরাফের বাড়িতে আসছে! এমনকি এটাও জানতো না আরাফের বোন আয়াত! জানবে কি করে, কখনো জানার ইচ্ছেও ছিলো না কারো সমন্ধে! একে তো বউয়ের বোনের শ্বশুর বাড়ি, তার উপর তার শ্বশুর এখানে উপস্থিত! আগে জানলে তো আসতোই না সে! ছোটখাটো ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে সম্পন্ন হলো। কনে বিদায়ের পরপর নিয়াজ উদ্দিন বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। মেহেদী এগিয়ে দেওয়ার জন্য আসতে চেয়েছিলো কিন্তু নিয়াজ উদ্দিন তাকে ছাড়লো না। মেহেদীকে আজ তাদের বাসায় থাকতে হবে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারপর সাথে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পথে মেহেদী তার বাবার কাছে কল করে বলে দিলো সে নাহিদাদের বাড়িতে যাচ্ছে। অত:পর বাবার কথায় মেহেদী মিষ্টি কিনে নিলো প্রথমবার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে বলে। নিয়াজ উদ্দিন সাথেই ছিলো। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও শুনলো না। রাত এগারোটার দিকে জামাই-শ্বশুর বাসায় ফিরেছে। দরজা খুলেছে নাহিদা। বাবার পিছু পিছু মেহেদীকে প্রবেশ করতে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহেদী নাহিদার চোখের সামনে মিষ্টির প্যাকেট তুলে ধরলো। নাহিদা পেছনে হেলে মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– আজ আসবে, সেটা আগে জানালে না!
– আমি নিজেই জানি না, আসবো। তোমাকে জানাবো কি করে!
ওদিকে নিয়াজ উদ্দিন হাক ছাড়লেন,
– রুমানা, দেখো কে এসেছে।
রুমানা এ রুমে এসে মেহেদীকে দেখে বললো,
– মেহেদী! নাহিদা, তুই তো কিছু বললি না আজ আসবে!
– মা, আমি জানতাম না! আমাকে এমন কিছু বলে নি!
– ধুর! জানিয়ে দিবে না তুমি! আগে জানালে তো আমি রান্নাবান্না করে রাখতাম!
মেহেদী জবাব দিলো,
– না, মা। আমি এখন খাবো না কিছু! খেয়ে এসেছি বিয়ে বাড়িতে।
– কার বিয়ে?
নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– আয়াতের বিয়ে ছিলো আজ। মেহেদীর বন্ধু আয়াতের বর। সেখানেই দেখা হলো মেহেদীর সাথে। তাই জোর করে নিয়ে এলাম সাথে।
– এজন্যই বেয়াই জরুরি তলব করেছে?
– হ্যাঁ।
– এমন চুপিচুপি বিয়ে কেন!
– তারিখ নির্ধারণ করতে পারছিলো না। কোনো না কোনো পক্ষের সমস্যা তৈরি! তাই আজই বিয়ে হয়ে গেলো।
– যাক, ভালো হয়েছে। মেহেদী, হাতমুখ ধুয়ে নাও। মিষ্টি এনেছো কেন শুধু শুধু! মিষ্টি খাদক এই ঘরে নেই! সবাই টকের পোকা! এক কেজি তেতুল আনলেও দুদিনে খাওয়া হয়ে যেতো!
– শ্বশুর বাড়িতে কেউ তেতুল নিয়ে আসে, জানতাম না তো আমি! আগে জানলে তেতুলই নিয়ে আসতাম!
জামাই শ্বাশুড়ির কথা শুনে একজোটে সবাই হেসে উঠলো! তাদের কথাবার্তা ও হাসির শব্দ শুনে নাফিসার কাচা ঘুম ভেঙে গেছে! চোখ ঢলতে ঢলতে সে এ রুমে এসে বললো,
– কি হয়েছে তোমাদের?
মেহেদী তাকে বললো,
– ঘুমে হাটছো নাকি তুমি! চোখ খুলে দেখো, তোমার জন্য তেতুল এনেছি। তারাতাড়ি খাও।
– ধুর! স্বপ্নে আমি খাই না!
তার কথাবার্তায় সবাই মজা পাচ্ছে! সবাই বুঝতে পারছে সে এখনো ঘোরে আছে! হাই তুলতে তুলতে নাফিসা আবার তার রুমের দিকে পা বাড়াতেই নাহিদা তার হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– স্বপ্ন না। সত্যিই এনেছে। নে খা।
নাহিদা হাসতে হাসতে তোয়ালে হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মেহেদীও বেরিয়ে এলো। বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে আবার ঘরে এলো। নাহিদা আগে আর মেহেদী পিছে। নাফিসা মিষ্টির বাক্স হাতে নিয়েই বসে আছে! নাহিদাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– আপু, ভাইয়া এসেছে?
নাহিদা কিছু বলার আগেই মেহেদী পেছন থেকে জবাব দিলো,
– না, আমার প্রেতাত্মা এসেছে!
– বহু দিনের ইচ্ছে, প্রেতাত্মার সাথে বন্ধুত্ব করবো আর দোয়াদরুদ পড়ে ফুক দিয়ে তাকে শুন্যে মিশিয়ে দিবো! হা হা হা….
মেহেদী আর নাহিদা হেসে উঠলো। নাফিসা মেহেদীর হাতে জোরপূর্বক একটা মিষ্টি ধরিয়ে দিয়ে প্যাকেট ফ্রিজে রেখে দিলো। অত:পর সে আবার ঘুমাতে চলে গেলো।

চলবে।