“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৯
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেদী পাশের রুমে এলো নাহিদার কথায়। নাহিদা এলো তার বাবার নতুন লুঙ্গি নিয়ে। মেহেদীর দিকে এগিয়ে দিলে মেহেদী বললো,
– এটা দিয়ে কি করবো?
– কি করবে আবার! পড়বে। এই জিন্স পড়ে কি ঘুমাতে পারবে!
– আমি এই লুঙ্গিফুঙ্গি পড়তে পারি না! সরাও!
– এতো বড় ছেলের মুখে এই কথা শুনলে মানুষ হাসতে হাসতে জ্ঞান হারাবে! বাঙালি ছেলেরা আবার লুঙ্গি পড়তে না জানে!
– আমি পারি না।
– না পারলে নেই। এভাবেই ঘুমিয়ে থাকো।
– এভাবে ঘুমানো যায়! অন্য কোনো ব্যবস্থা করো।
– অন্য কি ব্যবস্থা করবো! আমার তো দুএকটা ভাই নেই যে তার স্ট্রিং প্যান্ট অথবা ট্রাউজার এনে দিবো! বাসা থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে এলে না!
– আমি কি জানতাম এখানে আসবো!
নাহিদা বিছানা ঠিক করতে করতে বললো,
– তাহলে আমি জানতাম, তাই না?
মেহেদী আর কিছু বললো না। শার্ট খুলে সাদা সেন্টু গেঞ্জিটা দেহে রেখে বিছানায় উঠে পড়লো। নাহিদা কম্বল এনে দিলো। মেহেদী কম্বল জড়িয়ে নিলো। নাহিদাও কম্বল টেনে খাটের একপাশে শুয়ে পড়লো। মেহেদী একবার এপাশ করছে তো আরেকবার ওপাশ! এই প্যান্ট পড়ে ঘুমানো সম্ভব না! আরেকটু ঢিলেঢালা হলে চালিয়ে নেওয়া যেতো! অত:পর উঠে লাইট জ্বালিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো। নাহিদা মাথা উঠিয়ে তাকিয়ে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?
– লুঙ্গি পড়া শিখতে।
নাহিদা মৃদু হেসে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লো। মেহেদী শক্ত করে গিট দিয়ে লুঙ্গি পড়ে নিলো। অত:পর কম্বলের নিচে এসে বললো,
– সকাল পর্যন্ত থাকলেই হয়!
তার কথা শুনে নাহিদা শব্দ করেই হেসে উঠলো। মেহেদী তার হাতটা টেনে এনে দেখলো। কি দেখছে তা বুঝতে না পেরে নাহিদা বললো,
– কি?
ঠোঁটের কোনায় দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে মেহেদী বললো,
– বলেছিলাম না, রঙ উঠার আগেই চুলকানি উঠবে!
সাথে সাথেই দৃষ্টি নত হয়ে নাহিদার মুখে লজ্জাময়ী রশ্মি ভেসে উঠলো! মেহেদী লাইট অফ করে নাহিদাকে কোলবালিশ ন্যায় জড়িয়ে ধরে বললো,
– ভয় পাচ্ছো? ওকে যাও, চুলকানি পড়ে উঠাবো।
– কতোগুলো কল করেছি, একটাও রিসিভ করার সময় হলো না!
– ফোন সাইলেন্টে ছিলো। রায়ানের শপিং করতে করতে আর ফোন ধরা হয়নি!
– আপু বলছিলো আয়াতের হাসব্যান্ড এর নাম নাকি তুর্য! তোমরা ডাকো রায়ান!
– ওর নিক নেম তুর্য। আমরা ফ্রেন্ডরা ও টিচাররা ডাকি রায়ান। বাকি সবাই তুর্য নামেই চেনে।
– খাট থেকে পড়ে নাকি সত্যিই কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছো?
– কালকেই তো বললাম!
– আমি ভেবেছিলাম ফান করছো। মায়ের কাছ থেকে আজ জানলাম।
– তুমি কি জানো, তুমি একটা চুন্নি!
– হোয়াট!
– ছেলেরা চোর হলে মেয়েরা তো চুন্নিই হয়! তাই না?
– আমি শুধু শুধু চুন্নি হতে যাবো কেন! কি চুরি করেছি!
– আমার কোলবালিশ চুরি করেছো! একদিকে কোমড় ব্যাথা অন্যদিকে কোলবালিশ নিখোঁজ! দুয়ের যন্ত্রণায় আমি ঘুমাতে পারিনি সারারাত! আর তুমি চুরি করে এখানে নিয়ে এসে পড়েছো! আজ যে ধরা পড়েছো এবার কি হবে তোমার!
নাহিদা মৃদু হেসে লজ্জাময়ী কণ্ঠে বললো,
– ব্যাথা কি এখনো আছে?
– ওষুধ দিবে?
– প্রয়োজন হলে দিব।
– থাক, আর প্রয়োজন নেই। ডাক্তারের কাছে গিয়ে পেইন রিমোভাল স্প্রে করেছি। আপাতত ঘুমাতে দাও।
নাহিদা আর কোনো কথা বললো না। মেহেদী তার ওষ্ঠ দ্বারা গালে কোমল স্পর্শ দিয়ে গালের সাথে গাল লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। অতি খুশিতে নাহিদার চোখে পানি এসে গেছে! মেহেদীর এসব কর্মকাণ্ড একটুও অভিনয় মনে হচ্ছে না। এসব বাস্তব। গড়িয়ে পড়ার আগেই সে আঙুল দিয়ে মুছে নিলো আনন্দের অশ্রু।
সকালে প্রথমে নাহিদার ঘুম ভেঙেছে। মেহেদী তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে৷ মৃদুস্বরে নাহিদা ডাকলো মেহেদীকে। “এই শুনছো? এই, ওঠো না?”
মেহেদী ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,
– হু?
– সকাল হয়ে গেছে। সূর্য উঠে পড়বে তো! নামাজ পড়বে না!
– প্রতিদিনই পড়তে হবে!
– হ্যাঁ। প্রতি দিন কেন, প্রতি ওয়াক্তে পড়তে হবে। উঠো।
মেহেদী এবার চোখ খুলে হাত পা মেলে আড়মোড়া ভাঙল। নাহিদা উঠতে যাবে হঠাৎ মেহেদী চমকে উঠলো এবং নাহিদাকে টেনে শুয়িয়ে দিলো! নাহিদা বিষ্ময়ের সাথে বললো,
– আরে! কি হলো!
– তুমি কিছু দেখেছো?
– কি?
– আমার সামথিং মিসিং!
– সামথিং মিসিং! কি মিসিং?
– লুঙ্গিফুঙ্গি!
নাহিদা লজ্জায় পড়ে গেছে তার কথা শুনে! ভাবছে এই ছেলেটার কি একটুও লজ্জা নেই, কিভাবে এমন আজব কথাবার্তা বলে ফেলে! নাহিদা অন্যদিকে ফিরে চুপচাপ উঠে যেতে চাইলে মেহেদী আবার তাকে টেন বাধা দিয়ে বললো,
– উঠবে না তুমি এখন! আমি আগে ঠিক হয়ে নেই। তারপর।
– আরে! লজ্জা লাগছে যেহেতু, আমি চলে যাই। আমার সামনে ঠিক হবে কিভাবে!
– তুমি উঠলেই তো কম্বল ফাঁক হয়ে যাবে!
– কি আজব ব্যাপারস্যাপার! এতো বড় ছেলে হয়ে একটা লুঙ্গি সামলাতে পারে না!
বিড়বিড় করে কথাটা বলে নাহিদা খিলখিল করে হেসে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে রইলো। মেহেদী ঠিকঠাক হয়ে তার আগে উঠে পড়লো। পুরো কম্বলটা টেনে দু’হাতে দলা করে নাহিদার উপর ঢিল দিয়ে বললো,
– আর কত ঘুমাবা! উঠো!
নাহিদা উঠে কম্বল ভাজ করে নিলো। এতোক্ষণে মেহেদী প্যান্ট পড়ে নিলো। একটু-আধটু অসুবিধা হলেও লুঙ্গি পড়ে সে নামাজ পড়তে পারবে না! নাহিদা চুল খোপা করে কাটা আটকে নিলো। দরজা খুলে দুজন ওযু করতে বের হলো। আজ দেড়ি হয়ে গেছে উঠতে। যথাসম্ভব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ওযু করে দুজনেই ঘরে নামাজ আদায় করলো।
রুমানা বেগম ঘুম থেকে উঠেই রান্নার আয়োজন শুরু করেছে। রাতে মেয়ের জামাইকে কিছুই খেতে দেয়নি অথচ জামাই প্রথম এলো বাড়িতে। সেই ভেবে তড়িঘড়ি করে কাজ করছেন তিনি। নাফিসা এসে হাত লাগালো মায়ের সাথে। নামাজ পড়ে মেহেদী নিয়াজ উদ্দিনের সাথে একটু বেরিয়েছে বাসা থেকে। হয়তো বাজারের দিকেই যাচ্ছে তারা। আরাফ এলেও নিয়াজ উদ্দিন নানান জায়গায় ঘুরতে যায় আরাফকে নিয়ে। তাদের দেখলে মনেই হয় না তারা জামাই শ্বশুর! মনে হয় যেন বাবা ছেলের মতো বন্ধুত্ব তাদের মাঝে! আরাফের ন্যায় মেহেদীর সাথে নিয়াজ উদ্দিন বন্ধুত্বের ভাব জমিয়ে ফেলার জন্য প্রত্যাশিত। এদিকে মা মেয়েরা বাসার কাজ সেড়ে নিয়েছে। গতকাল নাজিয়া ব্যস্ত থাকায় কথা হয়নি তাদের সাথে। তাই আজ সকাল সকাল ভিডিও কল দিয়েছে। এদিকে তারা কিচেনে, ওদিকে নাজিয়াও কিচেনে। মা ও মেয়েরা রান্না করতে করতে জমিয়েছে খুশগল্প!
মেহেদী বাড়ি ফিরে নাহিদাকে রুমে একা ডেকে বললো,
– বাসায় যাবে না?
– আজ!
– আজ না, এখন।
– আরও দুদিন থাকি?
– কত বেলা খাবার মিস হয়েছে মনে আছে তোমার! দুজনের দশ বেলা মিসড!
– কি ধরনের কথাবার্তা এসব! এতো হিসাবী হয় মানুষ!
– এতোসব বুঝি না, দ্রুত রেডি হও। বাসায় গিয়ে অফিস যাবো। আর না হলে অফিস যাবো না।
– আর দুইটা দিন থাকি?
– মাস শেষে আবার আসতে পারবে না?
নাহিদা মুখটা মলিন করে বললো,
– ওকে, খাবার নিয়ে আসছি। নাস্তা তো করবে?
– যাও।
বাবা মা কে বলে নাস্তা করার পরপরই নাহিদা রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো মেহেদীর সাথে। বাসায় ফিরতেই মেহেরুন দেখে বললো,
– কিরে, এতো তারাতাড়ি চলে এলি যে! তাও আবার সকাল সকাল!
মেহেদী রুমের দিকে যেতে যেতে জবাব দিলো,
– অফিস যাবো না! তাই এসে পড়েছি।
পেছন থেকে নাহিদা বিড়বিড় করে বললো,
– আসছে অফিস ওয়ালা! কিপটে হিসেবী লোক একটা! সেটা আর বলে না!
মেহেরুন তার বিড়বিড় শুনে বললো,
– কি হয়েছে?
– চেয়েছিলাম আরও দুদিন থাকবো, উনার নাকি এদিকে খাবারের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে! সেইজন্য সকাল সকাল চলে আসার তাড়া দেওয়া শুরু করেছে!
মেহেরুন হেসে বললো,
– সেটা হয়তো দুষ্টুমি করে বলেছে। কারো বাড়িতে থাকার অভ্যাস নেই তার। আমি আমার বাবার বাড়ি গিয়েও শান্তি পাইনি আগে তার জন্য। এখন তো সে একাই থাকতে পারে তাই একটু শান্তিতে বেড়াতে পারি। তবুও মন আকুপাকু করে ছেলেটা কখন কি করছে। তবে তোকে না আনলেও পারতো। কে জানে মাথায় কি ঘুরে! মন খারাপ করিস না। কিছুদিন পর না হয় আবার গিয়ে থাকিস মায়ের কাছে। বোরকা খুলে নে।
– মা, ভাবছিলাম ভার্সিটি যাবো।
– তাহলে যা। নাস্তা করেছিস?
– হ্যাঁ। করে এসেছি। বাবা চলে গেছে?
– না, যাবে এখন।
নাহিদা রুমে এসে ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় নামিয়ে রাখলো। মেহেদী ঝটপট গোসল সেড়ে নিয়েছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাহিদাকে এখনো বোরকা হিজাবে কাজ করতে দেখে বললো,
– এখনো বোরকা পড়ে বসে আছো কেন?
– বসে আছি কোথায়? আমি তো দাড়িয়ে কাজ করছি!
– সেটাই বা বোরকা পড়ে কেন?
– ইচ্ছে হলো তাই।
– ইচ্ছেগুলো একপাশে রেখে আমাকে রেডি করো আগে।
– ওহ্! স্কুলে যাবে? টিফিন রেডি করবো? তারপর কি আঙুল ধরে রাস্তা পাড়াপাড় করে স্কুলে দিয়ে আসবো?
মেহেদী মাথা মুছতে মুছতে ঠোঁটের কোনায় দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে বললো,
– ওটা বাচ্চাকাচ্চার জন্য জমা রাখো। আপাতত শুধু আমাকে রেডি করো। আর শুনো, এজন্যই তোমাকে এতো তারাতাড়ি বাড়িতে নিয়ে আসা।
নাহিদার খুব বেশি না হলেও একটু-আধটু রাগ হচ্ছে মেহেদীর উপর! রেডি করার জন্য আর দুদিন থাকতে দিলো না তাকে! সে মনে মনে ফুসতে ফুসতে শার্ট এনে ধরলো এবং মেহেদী পড়ে নিলো। একে একে সবকিছু নাহিদার হাতে করালো। সবশেষে বডি স্প্রে টাও নাহিদাকেই করতে বললো। বডি স্প্রে দেখে সেদিনের কথা মনে হতেই নাহিদা বডি স্প্রে করার পর মেহেদীর মুখেও স্প্রে করে হাসতে হাসতে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪০
(নূর নাফিসা)
.
.
বডি স্প্রে দেখে সেদিনের কথা মনে হতেই নাহিদা বডি স্প্রে করার পর মেহেদীর মুখেও স্প্রে করে হাসতে হাসতে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নাহিদাকে দৌড়ে বের হতে দেখে মেহেরুন বললো,
– আরে, কি হয়েছে!
নাহিদা স্প্রে হাতের মুঠোয় লুকিয়ে বললো,
– কিছু না, মা।
নাহিদা রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখ মুছতে মুছতে মেহেদী বেরিয়ে এসেছে। নাহিদার দিকে তাকিয়েই হাটছে কিন্তু কিছু বললো না। সে সোজা বেসিনে এসে কুলি করতে লাগলো। জহিরুল ইসলাম রুম থেকে বেরিয়ে বললেন,
– নাহিদা, ভার্সিটিতে যাবে?
– হ্যাঁ, বাবা।
– বই কিনেছো?
– না।
– বিকেলে মেহেদীর সাথে গিয়ে বই কিনে এনো। আর নিয়মিত ক্লাস করো। কেমন?
– আচ্ছা, বাবা।
– মেহেরুন, মেহেদীর কাছে টাকা দিয়ে নাহিদাকেসহ বিকেলে পাঠিয়ে দিও।
নাহিদা মনে মনে ভাবলো, ভালোই হয়েছে। তার শেষ সম্বলটুকু বেচে যাবে!
মেহেদী কুলি করে ফ্রিজ থেকে আপেল নিয়েও আবার রেখে দিলো। কাটা কমলালেবু থেকে এক টুকরো নিয়ে খেতে খেতে বেরিয়ে আসছিলো কিচেন থেকে। নাহিদাকে বলা বাবার কথা শুনে মেহেদী বললো,
– বই কিনতে চৌদ্দ জন যেতে হয়! বুক লিস্ট দিলে একাই আনা যায়!
জহিরুল ইসলাম বললেন,
– নিজের জিনিস দেখেশুনে নিজে আনা-ই ভালো। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে যাও। তবে একা গেলে বই ঠিকঠাক মতো এনে দিও। চলো অফিস যাবো। নাহিদাও চলো, ভার্সিটির সামনে নামিয়ে যাই।
– আচ্ছা।
নাহিদা যেতে রাজি হলেও মেহেদী বললো,
– আমি যাবো না কারো গাড়িতে! নিজের পা আছে। পকেটে রিকশা ভাড়াও আছে। নিজে নিজেই চলতে সক্ষম! কারো উপর নির্ভর করি না।
– তাই নাকি! পরশু যে আমার গাড়ি নিয়ে বের হলে?
– সেটা তো তোমার প্রয়োজনেই গিয়েছি! আমার কোনো প্রয়োজন ছিলো নাকি!
– রাত দশটা পর্যন্ত আমার প্রয়োজন ছিলো?
– পথ ভুলে গেলে এমনই!
– শেখাও আমাকে! শ্বশুর বাড়ি যেতে যেতে এইটুকু সময়ে তুমি বাবার বাড়ির পথ ভুলে গেছো! নাহিদা, ও না যাক। তুমি এসো গাড়িতে।
– পার্স নিয়ে আসছি, বাবা।
– এসো।
জহিরুল ইসলাম বেরিয়ে গেলেন। নাহিদা রুমের দিকে পা বাড়ালে মেহেরুন তার হাতে পাচশো টাকার নোট দিলে নাহিদা বললো,
– মা, এটা কিসের টাকা?
– ভার্সিটি যাবি, আসার সময় ভাড়া লাগবে না!
– আছে তো আমার কাছে।
– রাখ এটা। আর যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ছোট একটা সংকেত দিবি। চুপচাপ বসে থাকলে তো আর প্রয়োজন মিটবে না। মনে থাকে যেন।
নাহিদা মুচকি একটা হাসি দিয়ে রুমে চলে গেলো। হাত থেকে স্প্রেটা রেখে পার্স নিয়ে বের হতে যাবে, এমন সময় মেহেদী দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। নাহিদার কাছে এসে বললো,
– খুব চতুর সেজে গেছো না? রাতে শোধ নেবো মিসেস!
কথাটা বলার পরপরই মেহেদী তার খাওয়া কমলালেবুর খোসাটা নাহিদার ঠোঁটে ঠেসে দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। নাহিদা ঠোঁট মুছে থু থু ফেলতে লাগলো! তার মুখ এখন তেতো লাগছে! তার মতে এই মেহেদী একটা জঘন্য খাটাশ লোক! ডেঞ্জারাস পিশাচও বটে! মনে মনে বকতে বকতে নাহিদা ঠোঁট ঘষে মুছে পানি খেয়ে ভ্যাজলিন লাগিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। মেহেদী আগে চলে গেছে। জহিরুল ইসলাম ড্রাইভারের সাথে গাড়িতে বসে আছে। নাহিদা গাড়িতে উঠে বসলো। তাকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে জহিরুল ইসলাম অফিসে চলে গেলো।
প্রায় অনেক দিন পর বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হলো। কিন্তু আশিকের সাথে দেখা হয়নি। ক্লাস করেছে মাত্র দুইটা, বাকি সময় নোট সংগ্রহ ও আড্ডায়ই কাটলো। নাফিসার সাথে দেখা হয়েছে ভার্সিটিতে। দুইবোন কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসার সময় নাহিদা বললো,
– কি খাবি?
নাফিসা ঘনঘন চোখের পলক ফেলে বললো,
– তুমি বলেছো এই কথা! বিশ্বাস হচ্ছে না আমার! যার কাছ থেকে পাচ টাকা নেয়ার জন্য পঞ্চাশ মিনিট যুদ্ধ করতে হয়, আজ সে নিজ থেকে বলছে কি খাবো আমি!
– কি করবো বল! অনেক দিন ধরে ছ্যাচড়াটা পাচ টাকার জন্য পঞ্চাশ মিনিট যুদ্ধ করে না। তাই ভাবলাম, ভদ্রানীটাকে নিজ থেকেই অফার করি!
– কি! আমি ছ্যাচড়া!
– আরে না, তুই তো আমার ভদ্রানী কিউটিপাই। হিহিহি… ক্যান্টিনে চল। সকাল সকাল এতো দৌড়াদৌড়ি করে এখন আমারও ক্ষুধা লেগে গেছে!
– ক্যান্টিনে খাবো না। ফুচকা খাবো।
– ওকে।
দুজনেই গেইটের ধারে লোকের কাছে ফুচকা অর্ডার করলো। প্রতিযোগিতা চলছে তাদের মাঝে। বরাবরই নাফিসার মুখ নড়েচড়ে বেশি! আজও তার ব্যাতিক্রম না। ফুচকা খেয়ে জ্বিভে ঝাল আটকে গেছে! ঝালের প্রখরতা আরও বাড়িয়ে দিতে নাফিসা অফার করলো ঝালমুড়ি। নাহিদাও উৎফুল্ল হয়ে অফার এক্সেপ্ট করলো। ঝালমুড়ি খাওয়ার সময় নাহিদার একজন বান্ধবী যুক্ত হয়েছে তাদের সাথে। সম্পূর্ণ বিল নাহিদা ই পরিশোধ করেছে। ঝালমুড়ি খেতে খেতে তিনজন গেইটের বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছে। হঠাৎ তাদের থেকে একটু সামনে একটা রিকশা থেমে পরিচিত কন্ঠে ভেসে এলো, “এখানে দাড়িয়ে আছো কেন? বাসায় যাবে?”
সবাই তাকিয়ে দেখতে পেল রিকশায় বসে আছে মেহেদী। নাহিদা বললো,
– হ্যাঁ, বাসায়ই যাবো।
– তাহলে চলে এসো। বাসায়ই যাচ্ছি।
নাফিসা বললো,
– ভাইয়া, ঝালমুড়ি খেলে নেমে আসুন?
– না, কাজ আছে আমার। তুমি খাও।
নাফিসাকে জবাব দিয়ে আবার নাহিদাকে বললো,
– যাবে নাকি তুমি?
– হ্যাঁ, আসছি।
নাহিদা নাফিসার হাতে তার ঝালমুড়ির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– নে, তুই খা। আমি চলি। সাবধানে বাসায় যাবি। আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।
নাহিদা রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশা আবার চলতে শুরু করলো। প্রচুর ঝাল লাগছে জ্বিভে! একটু পানি পানেরও সময় হলো না। ঝাল কমাতে মুখে শ্বাস কাটছে নাহিদা। মেহেদী বললো,
– ঝাল খেতে পারো না তবে খেতে যাও কেন?
– খেতে পারি। তবে আজ একটু বেশি হয়ে গেছে! ঝাল ফুচকা খাওয়ার পর আবার ঝালমুড়ি।
– ফুচকা আবার ঝালমুড়িও! একসাথে এতোকিছু খেয়েছো! বাসায় তো এমন ভাব দেখাও যেন খেতেই জানো না!
নাহিদা তার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে আবার সামনে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বললো, “আমি এইটুকু খাওয়াতে এতো কিছু খেয়ে ফেলেছি আর উনি যে পুরো রেস্টুরেন্ট খেয়ে ফেললেও বলে খাওয়া হয়নি তার, সেটা কিছু না!”
মাথায় কিছু নাড়া দিতেই সে বললো,
– এতো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাচ্ছো যে?
– চব্বিশ ঘন্টার কাজ মেহেদী এক ঘন্টায় সম্পাদন করতে পারে। ট্যালেন্টেড লোকদের সারাদিন কাজে পড়ে থাকতে হয় না। বুঝতে পেরেছো?
নাহিদা মনে মনে বললো, “হুহ্, যাকে ঠেলে ঠেলে কাজে পাঠাতে হয়, সে নাকি আবার ট্যালেন্টেড! ফাকিবাজের নানা একটা! ফাকিবাজের কাজই তো ফুটানি করা!”
মেহেদী একটা দোকানের সামনে রিকশা থামিয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে এলো এবং বোতলের মুখ খুলে নাহিদার হাতে দিলো। নাহিদা মনে মনে খুশি হলেও বাইরে প্রকাশ করলো না। চুপচাপ পানি পান করে নিলো। মেহেদী এবার তার পেছন দিকে এক হাত রেখে বসেছে। মুহুর্তেই নাহিদার মনে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে! সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার পর দুজন এই প্রথম রিকশায় একসাথে বসেছে। তার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে তারা সদ্য প্রেমিক-প্রেমিকা! ভাবতেই নাহিদার চেহারার ভঙ্গিতে চমৎকার উজ্জ্বলতা ছাড়িয়েছে! বিরতিহীন ছুটে চলেছে রিকশা। বাতাসের গতিতেও মিশে আছে তীব্রতা! পরিবেশের মাধুর্যে মুখরিত হয়ে উঠেছে দুটি প্রান আর পাশাপাশি বসে আছে দুটি দেহ।
“পাচশো টাকা কি ঝালমুড়ি আর ফুচকা খেয়েই শেষ করে দিয়েছো নাকি রিকশা ভাড়ার জন্য কিছু রেখেছো?”
নাহিদা এতোক্ষণ কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো তার জানা নেই। মেহেদীর কথায় এতোক্ষণে তার ধ্যান ভাঙলো! তাকিয়ে দেখলো মেহেদী তার পার্স খুলছে। কখন যে তার পার্স মেহেদীর কাছে চলে গেছে সে খেয়ালই করেনি! মেহেদী টাকা বের করে দেখলো পাচশো টাকার নোটের সাথে আরও কিছু খুচরা আছে। সেখান থেকে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে তার কাছে পার্স ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
– এতো টাকা তোমার কাছে! এতো টাকা নিয়ে ভার্সিটি যেতে হয়! আসা যাওয়ায় রিকশাভাড়া মাত্র চল্লিশ টাকা!
– আমার টাকা..
– তো কি হয়েছে? রিকশায় কি আমি একা এসেছি! তুমিও তো এসেছো সাথে! ভাড়া দিবে না! এতো ঠেকা পড়েছে নাকি তোমাকে ফ্রীতে ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসার!
নাহিদার এখন অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু কিছুই করলো না। কোনো একটা শব্দ পর্যন্ত করলো না রিকশাওয়ালা সামনে থাকায়। বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই চুপচাপ রিকশা থেকে নেমে সে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। মেহেদী তার মুখভঙ্গি দেখে নিশব্দে হাসলো। ভাড়া প্রদান করে সেও বাড়িতে প্রবেশ করলো।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪১
(নূর নাফিসা)
.
.
নাহিদা কলিং বেল বাজালে দরজা খুলতে দেখলো আয়াশকে। সে অবাক হয়ে আয়াশের থুতনি ধরে বললো,
– আয়াশ! তুমি কখন এলে?
– একটু আগেই তো এসেছি।
– আম্মু এসেছে?
– হ্যাঁ, আমি আম্মু আর আরিশা এসেছি।
– আব্বুকে নিয়ে আসোনি!
– আব্বু অফিস গেছে তো তাই আব্বুকে রেখেই চলে এসেছি।
– অহ, আচ্ছা। দরজা লাগিও না। তোমার মামা আসছে।
– মামাও এসে পড়েছে?
– হ্যাঁ।
– মামী, তোমার ভার্সিটি কি অনেক বড়?
– হ্যাঁ।
– আমার স্কুল থেকেও বড়?
নাহিদা তার মাথার চুল এলোমেলো করে বললো,
– হ্যাঁ, বাবা। ভার্সিটি স্কুল থেকে বড়ই হয়।
মেহেদীকে দেখতেই আয়াশ “মামা” বলে দৌড়ে দরজার ওপরে চলে গেলো। মেহেদীও হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে কথা বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করলো। মেহতাজের সাথে দেখা হতেই নাহিদা সালাম দিয়ে কথা বললো। আরিশাকে কোলে নিয়ে সে রুমে এলো। ফ্রেশ হয়ে সবাই একসাথে নাস্তা করে নেওয়ার পর নাহিদা জানতে পারলো, আগামী পরশুদিন তাদের বাড়িতে নাহিদার পরিবারকে দাওয়াত করা হয়েছে। আগামীকাল অফিসে মিটিং আছে তাই বাজার করার জন্য মেহেদীকে আজ বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। অবশ্য মেহেদীও জানতো না তাকে কেন পাঠানো হয়েছে। জহিরুল ইসলাম শুধু এটুকু বলেছেন যে, বাসায় তার প্রয়োজন আছে সেজন্য ছুটি। প্রয়োজনটা বাড়িতে ফিরে জানতে পেরেছে মেহেরুনের কাছে! আর মাথায় যেন তার মস্ত বড় বোঝা চেপে গেছে! এখন না গিয়েও উপায় নেই! না গেলে আবার পুরো অফিস তাকে সামলাতে হবে, জহিরুল ইসলাম বাড়িতে ফিরে আসবে!
মেহেদী তার বন্ধুদের কল করে একজনকে ম্যানেজ করতে পারলো। বাকিরা ব্যস্ত। জিহাদকে নিয়ে সে বেরিয়ে গেছে বাজার করার উদ্দেশ্যে। সাথে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে নাহিদার বুক লিস্ট!
সমস্ত কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যায়! আজ তার চেহারা দেখে প্রকৃত অর্থে মনে হচ্ছে সে একজন পরিশ্রমী লোক! বাড়িতে ফিরে সে আবার গোসল করেছে কেননা এই ঠান্ডার মধ্যে ঘেমে একাকার! এই প্রথম নিজেকে নিজের কাছে ক্ষেত মনে হচ্ছে! “মানুষ কি এভাবেই বাচে!” এটা মেহেদীর নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন! উত্তরদাতা কেউ নেই! মেহেদীর ক্লান্তি নাশ করতে এবং শীতের সন্ধ্যা জমিয়ে দিতে নাহিদা তার জন্য কফি নিয়ে এলো। পিছু পিছু আরিশাও এসেছে। আরিশার সাথে বেশ ভাব জমে উঠেছে নাহিদার। সারাদিন আরিশা তার পিছু পিছুই ঘুরছে। মেহেদী মাত্রই টিশার্ট পড়েছে, ভেজা চুলগুলো তার এলোমেলো হয়ে আছে! অন্যরকম ভালো লাগছে এখন তাকে দেখতে। তার সামনে কফির কাপ ধরে বললো,
– ধরো সাহেব। শীতের সন্ধ্যায় এক কাপ গরম কফি দেহমন সবটা ফুরফুরে করে দিবে।
– ফুরফুরে করে দিবে নাকি আমাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে!
নাহিদা হেসে বললো,
– শীতে কেউ পুড়ে যায়! আমি তো জানতাম সবাই জমে বরফ হয়ে যায়!
মেহেদী কফি কাপ হাতে নিয়ে বললো,
– জানবে কিভাবে! বাজার করেছো কোনোদিন! দুই টুকরো বরফ নিয়ে এসো।
– বরফ কেন!
– আমার হট হট লাগছে, সো কুল কুল হবো বরফ খেয়ে। যাও এবার। হারি-আপ…
নাহিদা তার কথামতো কিচেনে চলে গেলো। কাপ রেখে আরিশাকে কোলে নিলো মেহেদী। নাহিদা আবার রুমে এলে আরিশাকে নামিয়ে সে বরফ নিয়ে কফি কাপে দিলো এবং কফি নেড়েচেড়ে রুমে পায়চারি করতে লাগলো। নাহিদা আরিশাকে সাথে নিয়ে তার বইপত্র দেখতে লাগলো। মাঝে মাঝে দৃষ্টি উঁকি দিচ্ছে এলোমেলো চুল ওয়ালা লোকটার দিকে। যে কিনা, এক হাতে ফোন নিয়ে অন্য হাতে কফি কাপ নিয়ে রুমে পায়চারি করছে আর কোল্ড কফিতে চুমুক দিচ্ছে। মেহেরুন ও মেহতাজের সাথে গল্পগুজব শেষে ঘুমানোর সময় মেহেদীকে চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দেখে নাহিদার মনে হলো সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর এই ভেবে খুশি হলো যে সারাদিনের কাজের চাপে সকালের ঘটনা ভুলে গেছে। কিন্তু ঘটলো তার উল্টো কিছু! লাইট অফ করে সে বিছানায় শুয়ে পড়তেই মেহেদীর রিয়েকশন! সুড়সুড়িতে চুলকানি উঠিয়েছে মেহেদী! যতক্ষণ পর্যন্ত না নাহিদা হাপিয়ে উঠেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কার্য চলামান ছিলো। নাহিদাকে হাসতে হাসতে হাপাতে দেখে মেহেদী হাসতে লাগলো এবং পানি এগিয়ে দিলো! নাহিদা পানি পান করে যেন হাফ ছেড়ে বাচলো! মেহেদী বললো,
– কেমন লাগলো?
– হুহ্! উনি সারাদিন কত কিছু করে সেটা কিছু না, আমি কিছু করলেই শোধ নিতে আসে! দুপুরে রিকশা ভাড়াটাও সম্পূর্ণ আমার পার্স থেকেই নিলো!
এতোক্ষণ হাসলেও এখন নাহিদা গোমড়া মুখু হয়ে বিড়বিড় করতে করতে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। হবেই না কেন! কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিলো এই বুঝি সে দম আটকে মরে যাচ্ছে! সে বলে এখনো বেচে আছে। নাফিসার সাথে এমন কিছু ঘটলে এতোক্ষণে নির্ঘাত কোনো না কোনো অঘটন ঘটে যেতো!
লাইট অফ করে মেহদি তাকে কোলবালিশ ন্যায় ঝাপটে ধরে বললো,
– হু, নেবোই তো!
.
নাহিদার পরিবারসহ নাজিয়ার পরিবারকেও দাওয়াত করেছে জহিরুল ইসলাম। নাজিয়া ও আরাফ এলেও বাকিরা আসেনি। এদিকে মেহতাজের পরিবারকেও দাওয়াত করা হয়েছে, সাথে দাওয়াত করা হয়েছে মেহেদীর বন্ধুদের। তুর্যের সাথে আয়াতও এসেছে এখানে। মোটামুটি বড়সড় আয়োজনই করা হয়েছে বাসায়। সারাদিন ভালো কাটার পরেও একটুখানি ত্রুটি ছিলো! অন্যদের অনুপস্থিতিতে কথায় কথায় খোচা মেরে আয়াত নাহিদাকে বলেছিলো,
“ভালোই তো শ্বশুর বাড়ি পেয়েছো আপু! একেবারে রাজমহল! কুড়েঘর থেকে এতো বড় প্রাসাদ জুটে গেলো কিভাবে, ভাববার বিষয়!”
উপযুক্ত জবাব দিতে গেলে ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে এই ভেবে নাহিদা কোনো প্রতুত্তর করতে না চাইলেও দুর্ভাগ্যবশত সেটা রুমের দরজার পাশ থেকে মেহেদী শুনে ফেলেছে! যার ফলে মেহেদীর জবাব ছিলো, “সবাইকে নিজের মতো ভেবো না আয়াত! ও তোমার মতো দু চার বছর প্রেম করে সংসার বাধেনি, সংসার বাধার পর সংসারের প্রেমে আসক্ত হয়েছে। ছোট মানুষ ছোটদের মতোই থাকো। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরো না।”
নাহিদা ভয়ে ছিলো না জানি মেহেদীর কথায় প্যাচ লাগিয়ে আয়াত তুর্যকে জানিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে! কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। আয়াতকে অনেকটা ভয়ার্ত দেখেছিলো মেহেদীর সামনে। নাহিদার ধারণা, তাকে এমন কথা শুনাতে পারলেও মেয়েটা মেহেদীকে ভয় পেয়েছে ঠিকই। কেননা সে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেনি সেখানে! মেহেদী নাহিদাকে কিছু বলেনি, যদিও আয়াতের কথায় জবাব না দেওয়ায় সামান্য বিরক্তি নিয়েই তাকিয়েছিলো নাহিদার দিকে। যেটা নাহিদাও বুঝতে পেরেছে। তবে সে এটাও বুঝতে পেরেছে, মেহেদীর কথাগুলো যদি সে বলতো তাহলে নিশ্চিত কোনো না কোনো ঝামেলার সৃষ্টি করতো আয়াত! তাকে একটু হলেও চেনে নাহিদা। আয়াত সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক তার মায়ের স্বভাবের!
উক্ত ঘটনার পর মনের অজান্তেই মেহেদীর প্রতি সম্মানটা বহুগুণ বেড়ে গেছে নাহিদার কাছে! হয়তো সে এতোটা সম্মানের যোগ্য বলেই বেড়ে গেছে!
মেহতাজ বাদে সন্ধ্যায় সবাই-ই চলে গেছে। মেহেদীর বন্ধুরা একটু দেড়ি করেই গেছে। ছাদে তারা আড্ডা দিয়েছিলো। আয়াত আরাফের সাথে সন্ধ্যায় চলে গেছে কারণ সে বেড়াতে যাবে বাবার বাড়ি। তুর্যও একটু সুযোগ পেলো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার। তারা চলে যাওয়ার পর রাতের খাবার খেয়ে মেহেদী আয়াশকে সাথে নিয়ে রুমে চলে গেছে। নাহিদা মেহেরুন ও মেহতাজের সাথে গোছগাছ করে ঘুমানোর জন্য রুমে এসে দেখলো মামা ভাগিনা গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। দেখতে খুবই ভালো লাগছে নাহিদার কাছে। এই ক’দিনে নাহিদা বুঝতে পেরেছে মেহেদী বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে। কেননা, আয়াশ আরিশা এলে সে বাসা থেকে কমই বের হয়। আর বাচ্চাদের মতো দুষ্টুমি, খেলাধুলা তো আছেই!
সে বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে এলে দেখলো আয়াশকে ডাকতে ডাকতে মেহতাজ এসেছে রুমে। তাদের দেখে বললো,
– বারে! কি সুন্দর ঘুমিয়ে পড়েছে দুজন! আয়াশ…
নাহিদা বাধা দিয়ে বললো,
– থাক না, আপু। ঘুম ভেঙো না শুধু শুধু। আজ এখানেই থাকুক।
– না, ও ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করে বেশি। আবার রাতে তুলতে হয় বাথরুমে যাওয়ার জন্য।
– থাকুক। সমস্যা নেই। আমি না হয়, তার মামা উঠাবে।
মেহতাজ চলে গেলো। নাহিদা দরজা লাগিয়ে এসে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লো একপাশে। যতক্ষণ জেগে ছিলো ততক্ষণ শুধু ওদের দুজনকেই দেখছিলো সে!
সকালে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো নাহিদার। হাত-পা বাধা, কাধে পড়ছে উষ্ণতার ছোয়া, কানে ভেসে আসছে লম্বাটে শ্বাসপ্রশাসের শব্দ, নড়াচড়া যেন তার একদম নিষিদ্ধ! চোখ খুলে তাকিয়ে দেখতে পেল তার এক হাত ঝাপটে ধরে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে আয়াশ আর পেছন থেকে হাত পা সব তুলে দিয়ে ঝাপটে ধরে শুয়ে আছে মেহেদী! মামা ভাগিনার মাঝে যেন সে চাপা পড়ে আছে! সে তো একপাশে ছিলো, তাহলে দুজনের মাঝে এলো কিভাবে! হয়তো রাতে ঘুম থেকে উঠে মেহেদী এপাশে চলে এসেছে। কিন্তু এখন উঠবে কিভাবে এখান থেকে! এলার্মও বেজে চলেছে বিরতিহীন! নাহিদা ঘাড় ঘুরিয়ে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ডাকলো তাকে। ডাকে সাড়া দিয়ে মেহেদী আরও জড়ো হয়ে গেছে। নাহিদা আয়াশের কাছ থেকে তার হাত মুক্ত করে এবার ঠেলতে শুরু করলো মেহেদীকে। এতেই অবশেষে মেহেদীর ঘুম ভাঙলো। দুজনেই উঠে চলে গেলো নামাজ আদায় করতে।
.
ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে বলতে ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে নাফিসা। তাদের থেকে কিছুটা দূরে মাঠের মধ্যে তিনটা কুকুর হঠাৎ করেই ঝগড়া লেগে ঘেউঘেউ করে উঠলো! তারা উভয়েই ভয় পেয়ে ছোটখাটো চিৎকার করে উঠলো এবং ঝাপাঝাপি করে দৌড় দিতে চাইলো। দুর্ভাগ্যবশত নাফিসা আশিকের উপর হেলে পড়ে পায়ে পাড়া দিলো! আশিক ব্যাথা পেয়ে “আউচ!” শব্দ করে উঠলো এবং নাফিসাকে ধরে সোজা করে বললো, “আরে, আস্তে! কুকুর আসবে না এদিকে!”
– সরি, সরি, সরি…
আশিকের সাথে থাকা দুজন ঢিল মেরে কুকুরকে তাড়া করলো। নাফিসা সোজা হয়ে দাড়িয়ে তার ফ্রেন্ডের কাধে একটা থাপ্পড় মারলো। কেননা তার ফ্রেন্ডের অসাবধানতার সাথে ধাক্কায়ই সে পড়ে গেছে! আর পাড়া লেগেছে আশিকের পায়ে! ফ্রেন্ডকে থাপ্পড় দেওয়ার পর নাফিসা আশিককে আবার বললো,
– সরি ভাইয়া। আমি দেখিনি! ব্যাথা পেয়েছেন নিশ্চয়ই।
– না, ঠিক আছে।
– ব্যাথা পেয়েছেন, আবার ঠিক থাকে কিভাবে! সরি, আমি একদমই খেয়াল করিনি!
– ইট’স ওকে।
– এক মিনিট দাড়ান, আমি পানি নিয়ে আসছি।
– আরে, তেমন কিছুই হয়নি! নাফিসা…
নাফিসা তার কথায় কোনো পাত্তা দিলো না। সে নিজের কাজ করতে ব্যস্ত। দ্রুত ক্যান্টিনে এসে ঠান্ডা পানি কিনে আবার বেরিয়ে এলো। আশিকের দিকে বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,
– জুতা খুলে পানি দিন। ঠান্ডা পানি।
আশিক বোতল হাতে নিয়ে মুচকি হেসে বললো,
– ভালোই হয়েছে, পিপাসা লেগেছে আমার। তৃষার্ত দুপুরে ঠান্ডা পানির জন্য থ্যাংকস।
কথাটুকু বলতে বলতে বোতলের মুখ খুলে নিলো। অত:পর পায়ে না ঢেলে পানি পান করতে করতে হাটতে লাগলো আশিক। নিজেকে অনুতপ্ত মুক্ত করতে পেরে নাফিসা মৃদু হেসে তার ফ্রেন্ডকে বললো,
– স্টুপিড, ইদুরে বাদুর! চল!
– তুই কি! তুইও তো ভীতুর ডিম!
দুজন দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া করতে করতে তাদের গন্তব্যে অগ্রসর হলো। এদিকে হাটতে হাটতে আশিকের এক ফ্রেন্ডের উক্তি,
– কিরে দোস্ত, বড় বেয়াইনকে হারিয়ে এখন আবার ছোটজনের সাথে নতুন করে শুরু করলি নাকি! যাক, বেমানান না। এবার সবদিক থেকেই পারফেক্ট।
– ধ্যাৎ! ওসব বলিস না কখনো। ভালো লাগতে হলে প্রকৃত অর্থে এককভাবে একজনকেই ভালো লাগে।
– তাহলে কি এখনো নাহিদাকে নিয়ে ভাবিস?
– মোটেও না। যে ভাগ্যে নেই, তাকে নিয়ে ভাবারও কোনো প্রশ্নই আসে না। যার যার মতো ভালো থাকুক সবাই। আমিও আমার মতো ভালো আছি।
চলবে।