তৃ-তনয়া পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
802

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪২
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসার ট্রেইনিং ক্লাস শেষ হয়েছে। বাসায় ফিরে সে মায়ের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে যেন বাবাকে বলে তাদের ফাকা উঠুনটায় একটা পোল্ট্রি ফার্ম তৈরি করতে! সন্ধ্যায় নিয়াজ উদ্দিন বাড়িতে ফিরলে আবার বাবার কাছেও আকুল আবদার! নিয়াজ উদ্দিন বলেছেন, আগে পড়াশোনা শেষ করে তারপর যেন জীবিকার কথা চিন্তা করে। কিন্তু নাফিসা মোটেও তাতে রাজি না। সে আত্মকর্মসংস্থানী হতে চায়। এজন্যই ট্রেইনিং টা করেছে। পড়াশোনাও করবে সাথে কর্মসংস্থানেও নিয়োজিত থাকবে। তাছাড়া তার কর্মসংস্থান বাড়িতেই হবে, এতে তার মা-ও সাহায্য করতে পারবে। অন্যরা দেখেও অনুপ্রাণিত হবে। এতে তার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। বরং নিজেকে স্বাবলম্বী মনে করবে।
মেয়েদের ইচ্ছে কখনো অপূর্ণ রাখে না নিয়াজ উদ্দিন। অন্যথায়, মেয়েরা এমন কোনো আবদার রাখেও না যেটা বাবার কাছে অসম্ভব! কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাফিসার জোরাজোরিতে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। যদিও বাড়ির সৌন্দর্যের কথা ভেবে তার মা নিষেধ করেছিলো। কিন্তু তার বাবা রাজি তো সব প্ল্যান কনফার্ম সেই ভেবে নাফিসাও মহা খুশি! সেই খুশিতে, সকালে সম্পূর্ণ নাস্তা সে তৈরি করলো। অথচ এমনিতে তাকে চুলার কাছেও নিয়ে যেতে পারে না! সবরান্না হয় মায়ের হাতে খাবে, নতুবা আপুদের হাতে। কেটেকুটে কাজ এগিয়ে দিতে আবার প্রস্তুত থাকে।
তার পরিকল্পনার কথা আপুদের কাছে জানিয়ে আবার কল করলো ট্রেইনারের কাছে। প্রক্রিয়া কার্য সম্পাদন করতে তারা সাহায্য করবে নাফিসাকে।
ছুটির দিনে নিয়াজ উদ্দিন বাশ, কাঠ ও টিন সংগ্রহ করে লোক লাগিয়েছে ফার্ম তৈরির জন্য। দু তিন সপ্তাহের মধ্যে সকল ব্যবস্থা হয়ে গেলে ট্রেইনাররা দেখতে এসেছে নাফিসার বাসা। ট্রেইনিং প্রাপ্তদের মধ্যে সুইং বাদে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নাফিসাই প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কার্য সম্পাদন করার। তা-ও কেবল তার বাবার সাপোর্টে।
.
প্রথম প্রথম দিনগুলো ভালো চললেও শেষ সময়ে হাত টান পড়ে গেছে! নাহিদার কাছ থেকে দুশো এবং তার মায়ের কাছ থেকে একহাজার টাকা ধার নিয়ে তারপর যাতায়াত ভাড়া মেটাতে হয়েছে। গত একমাসে অতিরিক্ত কোনো টাকা খরচ করেনি মেহেদী। এমনকি রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত যায়নি! যে কিনা, ত্রিশ দিনের মধ্যে পঁচিশ দিনই অন্তত একবেলা রেস্টুরেন্ট খায়! অফিসের লাঞ্চ টাইমেও মাঝে মাঝে বাড়িতে চলে এসেছে খাওয়ার জন্য আবার কখনো ইচ্ছে হয়নি বিধায় খায়ওনি! বাকিরা তাকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে! নিজের মাঝে এমন অমূল পরিবর্তন দেখে নিজেরই হতবাক হওয়ার কথা, যদিও সে এতোটা গভীরে ভাবে না! আজ তার জীবনের প্রথম উপার্জনের প্রথম বেতন পেয়েছে। কতটা উৎফুল্ল সে, তা নিজে পরিমাপ করতে না পারলেও যারা তার চেহারা দেখেছে তারা পরিমাপ করতে পেরেছে তার উৎফুল্লতা। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রুমেও যায়নি, সবার আগে সে তার বাবার কাছেই এসেছে। জহিরুল ইসলাম মাগরিবের নামাজ পড়ে টিভিতে খবর দেখছিলেন। মেহেদী তার বাবার পাশে বসে গণে গণে পাঁচ হাজার টাকা তার বাবার হাত ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– নাও, ধরো তোমার টাকা। বলেছি না, মাস শেষে খাবারের বিল বাবদ পাঁচ হাজার টাকা পাবে। পুরো পাঁচ হাজার আছে এখানে।
– লাগবে না, তোমার কাছে রেখে দাও।
– না, না, না, বাবা! তা হবে না। মেহেদী যা বলে করেই ছাড়ে! অকর্মক না আমি! স্বনির্ভরও বটে! অন্যের উপর নির্ভর করা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
কথাটা বলার পরপরই সে তার মায়ের কাছে গেলো কিচেনে। এক হাজার টাকা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না মেহেরুনকে। সে নাহিদাকে ডেকে চলে গেলো রুমে। মেহেরুন তাকে ডাকলে সে বললো, ফ্রেশ হয়ে আসছে।
মেহেদী ডাকায় নাহিদা হাতের কাজটা সেড়ে রুমে এলো। শার্ট খুলে খাটে রেখে দিয়েছে। নাহিদা সেটা তুলে এঙ্গেলে ঝুলিয়ে রাখলো। হাতমুখ ধুয়ে মেহেদী বাথরুম থেকে বেরিয়েছে মাত্র। নাহিদাকে রুমে দেখে ওয়ালেট থেকে দুই হাজার সাতশো টাকা পঞ্চাশ টাকা নিয়ে খণ্ডিত ভাবে প্রথমে আড়াই হাজার টাকা তার হাতে দিয়ে বললো,
– এটা, ওইযে পাঁচ হাজারের ফিফটি পার্সেন্ট। বুঝতে পেরেছো।
অত:পর পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললো,
– এটা, ওই যে রিকশাভাড়া নিয়েছিলাম। পুরোটাই রিটার্ন করলাম।
অবশেষে দুইশো টাকা দিয়ে বললো,
– এটা ধার নিয়েছিলাম যে, সেই দুশো। ক্লিয়ার?
নাহিদা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় টোকা পড়লো। দরজা পুরো খোলা থাকা সত্ত্বেও জহিরুল ইসলাম নক করেছেন মেহেদীর দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য। সাথে মেহেরুন ইসলামও এসে দাড়িয়েছে। মেহেরুন রুমে প্রবেশ করতে চাইলো কিন্তু জহিরুল ইসলাম বাধা দিলো। মেহেদী তাদের দিকে তাকাতেই জহিরুল ইসলাম বললেন,
– স্যার, খাবারের বিল তো পেলাম। এবার বাসা ভাড়াটা পরিশোধ করুন।
মেহেদী বিস্মিত হয়ে বললো,
– হোয়াট!
– জ্বি, স্যার! এটা যেমন সত্য, আপনি আমার বাড়িতে গত একমাস খেয়েছেন! সেটাও তেমনই সত্য, আপনি গত একমাস আমার বাড়িতেই থেকেছেন।
মেহেদী বিষন্ন ভঙ্গিতে তার ওয়ালেটে তাকিয়ে দেখলো ইতোমধ্যে বেশি অর্ধেক ফাকা হয়ে গেছে! এখান থেকে বাড়ি ভাড়া কি দিবে! তবুও জিজ্ঞেস করলো,
– বাড়ি ভাড়া কত?
– গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলসহ পাচ হাজার দিলেই হবে।
– এ!
– হ্যাঁ।
– এ মাসে পারবো না। আগামী মাসে দিব।
– তখন তো দুই মাসে দশ হাজার হয়ে যাবে! পারবেন তো দিতে!
– আম্মু, তুমি কিছু বলবে! আব্বু, আমি কিন্তু খাবারের জন্য চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছি। সেখানে কোনো বাড়ি ভাড়ার কথা উল্লেখ ছিলো না। সুতরাং এ মাসের ভাড়া আউট! সামনের মাস থেকে নতুন করে শুরু হবে ব্যাস! এ মাসেরটা দিবো না।
নাহিদা ও মেহেরুন তাদের বাবা ছেলের কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে! জহিরুল ইসলাম হেসে রুমে প্রবেশ করলো। মেহেদীর ডান হাতের মুঠোয় টাকা রেখে হাতটি নিজের দুহাত দ্বারা মুঠোয় ধরে বললেন,
– আব্বু, তুমি যতই বড় সাজার চেষ্টা করো না কেন! তোমার জন্মদাতা পিতা আমি। তোমার আগে এ পৃথিবীতে আমার আগমন। সেই সূত্রে এক ধাপ হলেও বেশি বুঝার ক্ষমতা আছে আমার। অশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও আমার বাবাও আমার থেকে এক ধাপ বেশি বুঝতেন, এমনকি তুমিও তোমার সন্তান থেকে এক ধাপ বেশি বুঝবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সন্তান যতই বড় হোক না কেন, পিতামাতার সমতুল্য বুঝ সে কখনোই ধারণ করতে পারবে না। তুমি আমার আসনে আসতে আসতে আমি দাদার আসনে পদার্পণ করবো। সকল পিতামাতাই চায় তার সন্তানরা ভালো হোক, পরিশ্রম করতে জানুক, নিজেকে স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হোক। আমিও এর ব্যতিক্রম নয়। তুমিও একসময় তোমার সন্তানের জন্য চাইবে সেটা। গত দিনগুলোতে যখনই তোমাকে মনযোগ সহকারে কাজ করতে দেখেছি তখনই গর্ববোধ করেছি। হ্যাঁ, তার আগে কটু কথা বলেছি। কিন্তু কেন বলেছি, সেটা তুমি জানো? তুমি যাতে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে জানো, নিজের জীবনটাকে পরিপূর্ণভাবে গুছিয়ে নিতে জানো সেজন্যই। আমি আর ক’দিন বাঁচবো! মেয়ের ভার তো অন্যের উপর তুলে দিতে পেরেছি কিন্তু তোমার ভার আমি কার উপর তুলে দিব! আমার সকল চিন্তা এখন তোমাকে নিয়ে। তোমার আম্মুরও তোমাকে নিয়েই চিন্তা। তাছাড়া তোমার উপর নির্ভর করেই কিন্তু নাহিদাকে ঘরে এনেছি। তুমি নিজেকে কর্মঠ না করলে নাহিদার খেয়াল রাখবে কে! তার বাবাও তো তোমার উপর নির্ভর করেই মেয়েকে ছেড়েছে। আমার এই টাকার প্রয়োজন নেই। তুমি স্বনির্ভর হতে শিখেছো এতেই আমি মহাখুশি! এই বাড়ি গাড়ি অফিস সকল প্রচেষ্টাই আমার শুধুমাত্র তোমার জন্য। তুমিও চাইবে তোমার সকল প্রচেষ্টা যেন তোমার সন্তানদের জন্য হয়। তোমার হাতে সবটা তুলে দিতে পারলেই আমি দায়মুক্ত হতে পারবো বাবা। নিজের কাছেই রাখো এটা। যতদিন বেচে আছি, তোমার সকল নেক কাজের সাপোর্টার হয়ে থাকবো আমি।
জহিরুল ইসলাম তার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মেহেরুন এগিয়ে এসে একহাজার টাকা তার মুঠোয় ঠেলে দিয়ে বললেন,
– আমি আর কি বলবো! তোর আব্বু ই তো সব বলে চলে গেলো! আমারও এই টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। মায়ের কাছে সন্তান কখনো ঋণি হয় না। তুই উপার্জন করতে শিখেছিস, এতেই আমি মহা খুশি।
কথাটা বলার পরপরই দু’হাতে মেহেদীর মাথা টেনে নিচু করে কপালে চুমু দিলেন তিনি। এবং বললেন,
– টাকা রেখে খেতে আয়। রুটি বানিয়েছি।
মেহেরুন ইসলাম চলে গেলে মেহেদী তার হাতের টাকা থেকে আরও আড়াই হাজার টাকা নিয়ে নাহিদার হাতে দিয়ে বললো,
– যাও, তোমার পুরো পাঁঁচ হাজারই ফিরিয়ে দিলাম।
নাহিদার হাতে টাকা দেওয়ার সময় নাহিদা মেহেদীর হাত ধরে ফেলেছে। এবং নিজ হাত উল্টে উপর করে মেহেদীর হাত তলায় রেখে বললো,
– আমি টাকা দিয়ে কি করবো! আমার প্রয়োজন তো তুমি আর বাবা মা-ই মিটিয়ে দিচ্ছো। আমার আর এর কোনোই প্রয়োজন নেই। বরং তোমার প্রয়োজন আছে নিজেকে সহ নিজের পরিবারকে সচ্ছল রাখার। আমার আবদার একটাই, তুমি সর্বদা নিজেকে নিয়ে ভাবো, অসৎ পথে যেও না কখনো। এবং পরিবারকে হেলা করো না কভু।
জহিরুল ইসলামের কথা শুনার পরই নাহিদার চোখ ছলছল করছিলো আর এখন নিজে কিছু শব্দ উচ্চারণ করার পর চোখের কোটরে পানি টলমল করছে। গড়িয়ে পড়বে বলে যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে অশ্রু বিন্দু। নাহিদা সেটা অতি দ্রুতই ওড়নার আঁচল দ্বারা মুছে নিলো। মেহেদী উপহাস স্বরূপ বললো,
– বাহ! ভালোই তো! মেহেদী, তোর তো কপাল খুলে গেছে! বাবামায়ের সাথে বউয়েরও কোনো প্রয়োজন নেই টাকার! সব প্রয়োজন কি তোর একারই হয়ে থাকে!
নাহিদা মুচকি হেসে ওয়ারড্রব খুলে টিশার্ট এনে দিয়ে বললো,
– কখন থেকে খালি গায়ে আছো। ঠান্ডা লাগছে না?
মেহেদী টাকা ওয়ালেটে রেখে টি-শার্ট নিয়ে বললো,
– না, আমি তো দুনিয়ার উল্টো নীতিতে চলি। সবার ঠান্ডা লাগলে আমার আবার গরম লাগে!
কথা বলতে বলতে টি-শার্ট পড়ে নিলো মেহেদী। এদিকে নাহিদা আবার জ্যাকেট এনে দিলে মেহেদী হাত বাড়িয়ে দিলো পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। নাহিদা মুচকি হেসে পড়িয়ে দিলো। এই ভেবে তার আরও খুশি লাগছে যে, যে মানুষটার এক সপ্তাহ চলেনি ত্রিশ হাজার টাকায় সে মাস শেষে পনেরো হাজার টাকা পেয়ে মহা খুশি। যেটা তার চেহারায়ই ভেসে উঠেছে! হবেই না কেন! এটা যে তার প্রথম উপার্জন!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৩
(নূর নাফিসা)
.
.
খাওয়াদাওয়ার পর ইশার নামাজ পড়তে গেছে। বাড়ি ফিরেছে একটু দেড়িতেই। নাহিদা ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত। মেহেদী ফ্রেশ হয়ে জ্যাকেট খুলে অতি শীতে কাপানো ভঙ্গিতে খাটে উঠতে উঠতে বললো,
– সরো! সরো! ওফ্ফ! কি শীতরে বাবা!
বলতে বলতে সে কম্বল টেনে নাহিদার সাথে জড়ো হয়ে শুয়ে পড়েছে। নাহিদা বললো,
– আরে! লাইট অফ করবে কে!
– তুমি করো। আমার ঠান্ডা লাগছে প্রচুর! উফফোফো…!
– ইশ! এতোক্ষণ ধরে বাইরে ছিলো ঠান্ডা লাগেনি! আর এখন বাথরুম থেকে বের হতে হতে উনাকে ঠান্ডায় আক্রমণ করে ফেলেছে!
– উহু! বাথরুম না, কম্বলের নিচে আইসকুল!
কথাটা বলেই শরীর কাপিয়ে হেসে উঠলো মেহেদী। নাহিদা লাইট অফ করার জন্য উঠতে গেলেও মেহেদী উঠতে দিলো না। হাত পা দ্বারা আটকে দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বললো,
– আব্বুআম্মু কি চাইতো বলোতো?
– মানে?
– আব্বু আম্মু তো এটাই চাইতো যে, তাদের ছেলে আড্ডা ছাড়বে, উপার্জন করবে, ছেলের সুন্দর একটা সংসার হবে, বাচ্চাকাচ্চা আসবে আর পুরো বাড়িতে তাদের চিৎকার চেচামেচিতে গমগম করবে! তাই না?
– হু!
– তাহলে, এখন তো আমি আড্ডা ছেড়েছি, উপার্জন করছি, সংসারও সাজাচ্ছি। রাইট?
– হ্যাঁ।
– তাহলে আর কি বাকি?
– কি বাকি?
– একটা আয়াশ আরেকটা আরিশা বাকি!
নাহিদা পরিষ্কার বুঝতে পারছে মেহেদী কি চাইছে। তাই সে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে! অজানা এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে তার মনে! মেহেদী তার রিয়েকশন দেখার অপেক্ষায় পলকহীন তাকিয়ে আছে তাই নাহিদা দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেই দুষ্টুমি ছলে বললো,
– একটা আয়াশ আর একটা আরিশা তো আছেই মেহতাজ আপুর কাছে!
মেহেদী তার থুতনি ধরে মুখটা একটু উপর দিকে তুলে বললো,
– কথা পেচিয়ে নিচ্ছো কেন! আমার সহজ উক্তি বুঝো না?
নাহিদা তার চোখের দিকে তাকাতেই মেহেদীর হাসিমাখা মুখটা মলিন হয়ে গেছে! সে থুতনি ছেড়ে দিয়ে বললো,
– কাদছো কেন! আমি মজা করছিলাম! তোমার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাইছি না আমি।
কথাটা বলে মেহেদী সরে যেতে চাইলো। নাহিদা একহাতে তার টিশার্টের কলার মুঠোয় ধরে টেনে কাছে এনে, অন্যহাতে মেহেদীর ঠোঁটে স্পর্শ করে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
– কথা দাও, কখনো এই মুখে মদ্যপান করবে না। কখনো এই ঠোঁটে মাদক স্পর্শ করবে না। আমার খুব কষ্ট লেগেছিলো বিয়ের প্রথম রাতে তোমাকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখে! একটুও সহ্য হচ্ছিলো না! কোনো মেয়েরই সহ্য হবে না স্বামীকে এমন অবস্থায় দেখলে! সবাই সুন্দর জীবন গড়তে প্রত্যাশিত! বাবা মা জানলেও খুব কষ্ট পাবে। এসবে হাত লাগিও না কোনোদিন! বিশ্বাস করো, একজন স্ত্রী হিসেবে আমার এইটুকু ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই তোমার কাছে। সব কিছু তোমার ইচ্ছাতেই হবে। এসবে আর হাত লাগিও না প্লিজ।
কথা বলতে বলতে চোখের দুই ধার গড়িয়ে অনবরত ঝরে পড়ছে অশ্রু! মেহেদী নাহিদার চোখের দুই ধার মুছে দিতে দিতে বললো,
– খাবো না।
নাহিদা খুশিতে পুলকিত! মেহেদী তার মুখ থেকে নাহিদার হাত সরিয়ে ওষ্ঠ দ্বারা আঁকড়ে ধরলো আকুল আবেদনকারীর ওষ্ঠ জোড়া! আজ প্রথম যেন মনে মনে মনকথন উপলব্ধি করতে পারছে নাহিদা! মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময়ের কাজ খুব অল্প সময়ে হয়ে গেছে! মেহেদীকে দেখার পর সজ্জিত জীবন নিয়ে তার ভাবনা জীবনের বহুদূর পর্যন্ত ছুটে চলে গিয়েছিল! আজ মনে হচ্ছে অতি দ্রুতই সেটা জীবনের সূচনায় চলে এসেছে!
.
প্রতিদিনই সকালে রুলস অনুযায়ী মেহেদীকে রেডি করে দিতে হয়। আর বোনাস স্বরূপ শর্টকাট কিসমিস! আজ বোনাসের উপর বোনাস ছিলো। একটু অন্যরকম মাধুরি মিশিয়েছে মেহেদী।
নাহিদাও ভার্সিটি যাবে বিধায় তৈরি হয়ে গেছে। নাহিদার সাথে মেহেদী রুম থেকে বের হতেই জহিরুল ইসলাম বললো,
– আজ ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছি। তাহলে গাড়ি ড্রাইভ করবে কে! বলতো!
মেহেদী জবাব দিলো,
– ড্রাইভার যেহেতু ছুটিতে আছে, একদিন রিকশায় গেলে কি হয়!
– মেহেরুন, দেখেছো! তবুও আমার ছেলে ড্রাইভ করবে না! গাড়ি থাকতে শুধু শুধু রিকশা ভাড়া দেওয়ার দরকার আছে!
– আম্মু, আব্বু কিন্তু দিন দিন হার কিপটে হয়ে যাচ্ছে!
মেহেরুন জবাব দিলো,
– তোদের বাপ-বেটার কাহিনী পরে করলেও চলবে। অফিস তোদের হলেও ভার্সিটি কিন্তু তোদের না। নাহিদার লেট হচ্ছে।
– যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।
তারা তিনজনই গন্তব্যে চলে গেলো গাড়িতে করে।
.
ভার্সিটিতে এক্সাম দিয়ে নাফিসা বাড়িতে ফিরেছে। রাস্তা থেকে বাড়ির দিকে নামতেই তার ফুপু অর্থাৎ, শিথির মা তাকে ডাকলো,
– নাফিসা, আয়তো একটু।
– কেন ফুপু?
– আয়, দরকার আছে।
নাফিসা তাদের ঘরে এলো। মেইন দরজায় পা রাখতেই ফুপি ইশারা করলো শিথির রুমে যেতে। নাফিসা সেখানেই চলে এলো। শিথি জানালার পাশে বসে ছিলো। নাফিসা বললো,
– কি করছো আপু?
– কিছু না। আয়। ফাইল হাতে কেন? পরীক্ষা চলছে?
– হ্যাঁ। ইনকোর্স পরীক্ষা।
– অহ। বাসায় যাসনি মনে হয়। কোনো প্রয়োজনে এসেছিস?
– ফুপি না ডাকলো কি জন্য যেনো!
– ওহ্!
এমনি শিথির মা রুমে এসে বললো,
– ব্যাগটা রেখে আয় আমার সাথে।
– কোথায়?
– মেহমান আসছে।
– তো আমি কি করবো!
– আরে, আয় না।
নাফিসা কিছু বুঝতে পারছে না! শিথিও ইশারা করলো যেতে। নাফিসা ফাইল আর পার্স রেখে চলে গেলো শিথির মায়ের সাথে। পাশের রুমে গিয়ে দেখলো দুজন মহিলা আর একজন পুরুষ বসে আছে। শিথির মা নাফিসাকে সামনে দাড় করিয়ে মেহমানদের উদ্দেশ্যে বললো,
– এটা আমার ভাইয়ের মেয়ে। অনার্সে পড়ে।
পরিচয় করিয়ে দিতেই নাফিসা সালাম দিলো। মহিলাটি সালামের জবাব নিয়ে বসতে বললো। নাফিসার এখন মনে পড়েছে তার ফুপু যে ঘটক! এবং এটাও বেশ বুঝতে পারছে তার বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক করছে! নাফিসা বিরক্তি নিয়ে ফুপুর দিকে তাকাতেই তিনি চুপচাপ বসতে বললেন! বিরক্তি সহিত নাফিসা বসে পড়লো চেয়ারে! ফুপু মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলতে শুরু করলো,
– আমার ভাইয়ের তিনটা মেয়েই। বড় দুজন বিয়ে হয়ে গেছে আর এই ছোট মেয়েটা বাকি আছে। পড়াশোনায় খুব ভালো। বাবার আয়ও ভালো, জমিজমাও মোটামুটি ভালোই আছে। খুবই সচ্ছল ও মার্জিত পরিবার। ছোট মেয়েটা বিয়ে দিতে পারলেই বাবা মায়ের শান্তি। মেয়েদের নিয়ে আর ভাবতে হবে না।
নাফিসার খুব বিরক্ত লাগছে! এক গাদা সুনামের পর এখন এমন ভাবে বলছে যেন মেয়েটার বিয়ে আটকে আছে! অন্যথায় এখন বিয়ে দেওয়াটা খুবই জরুরী! মেহমান সামনে বিধায় কিছু বলছে না সে! কিন্তু বাবা মাকে বলে তো এর একটা বিহিত ঠিকই করবে! কে বলেছে উনাকে এতো পন্ডিতি করতে! মেহমানদের মধ্যে একজন মহিলা জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার মেয়ের কথাও না বলেছিলেন। সে কোথায়? আসলে আমাদের দুইটা মেয়ে প্রয়োজন।
– আমার মেয়েটা বেড়াতে গেছে। পরে না হয় দেখা করিয়ে দিব একদিন।
এমন মিথ্যে বলায় নাফিসার আরও বেশি রাগ হচ্ছে! নিশ্চয়ই সমন্ধ পছন্দ হয়নি তাই এখন তার মেয়েকে লুকিয়ে তাকে দেখাচ্ছে! ইচ্ছে করছে হাটে হাড়ি ভাঙতে! ফুপু বলে ছেড়ে দিলো। ভাঙতে গেলে তো আবার বিস্ফোরণ ঘটবে! চব্বিশটা প্রেম একসাথে করে তার মেয়ে! এজন্য সারাদিন ঘরে বন্দী রাখে আবার নাকি বলে বেড়াতে গেছে! মহিলাটি বললো,
– অহ, আচ্ছা। মা, তোমার নাম কি?
নাফিসা গম্ভীরমুখে জবাব দিলো,
– নূর নাফিসা।
– খুব সুন্দর নাম। বাবার নাম কি?
– জনাব মোহাম্মদ নিয়াজ উদ্দিন।
– মায়ের নাম?
– আমি বাঙালি মেয়ে। বাঙালিরা পিতৃতান্ত্রিক পরিচয়ে বড় হয়। সেখানে মায়ের নামটা কেন শুনাতে যাবো?
– এতে, সমস্যা কি। নামই তো বলবে।
– অনেক সমস্যা। অপ্রয়োজনে বাইরের লোকদের কাছে মায়ের নাম বলার কোনো প্রয়োজন মনে করছি না।
সাথের মেয়েটা বললো,
– মা, থাক না। ও ঠিকই বলেছে। মায়ের নাম দিয়ে কি করবে!
– দাড়াও তো দেখি একটু।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাফিসা দাড়ালো। তার উচ্চতা দেখে মহিলাটি বললো,
– মাশাল্লাহ। বসো।
– ব্যায়াম করাচ্ছেন?
মহিলাটি হেসে বললো,
– না, তোমার উচ্চতা দেখলাম। হিজাবটা খুলবে একটু? তোমার চুলগুলো দেখতাম।
নাফিসা চরম রাগ হচ্ছে! সে নির্দিধায় বললো,
– আন্টি একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– হ্যাঁ, করো।
নাফিসা পুরুষ লোকটিকে দেখিয়ে বললো,
– উনি কি পাত্র?
– হ্যাঁ, ও আমার ছেলে।
– ওহ! তা আমার চুল দেখে কি করবেন? চুল না থাকলে কি বিয়ে করাবেন না আপনার ছেলেকে? আপনার ছেলে নিজেই তো টাকলা! সেখানে আমার চুল না থাকলে সমস্যা কোথায় যেখানে আপনার ছেলের টাকলা মাথা সমস্যা বলে মনে করছেন না!
মহিলাটি সহ উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো! ফুপু একটু ধমকের সুরেই বললো,
– নাফিসা, এসব কোন ধরনের কথাবার্তা! মেহমানদের সামনে এভাবে কথা বলে!
– ভুল কিছু বলিনি তো আমি! মেয়ে দেখতে এলে আবার চুল দেখতে হয়! একটু পর তো বলবে কিচেনে গিয়ে রান্না করে দেখাও! আর এই বাট্টা টাকলার সামনে আমাকে ডাকা হয়েছে আবার আযব টাইপের ভাইভা নেওয়া হচ্ছে, এর সাথে কি আমার কোনোভাবে যায় আসে! যত্তসব ফাউল কর্মকাণ্ড!
কথা বলার পরপরই নাফিসা বেরিয়ে যাচ্ছিলো। দরজার পাশে এসে ভাবলো হাড়ি না ভাঙলেও একটা গ্লাস ভাঙা দরকার। সে বিস্মিত মেহমানদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আন্টি, আরেকটা কথা। ফুপির মেয়ে বাড়িতেই আছে। বিশ্বাস না হলে ওইরুমে গিয়ে দেখে আসুন।
কথাটা বলে আর এক সেকেন্ডও না দাড়িয়ে দ্রুত তার পার্স নিয়ে বেরিয়ে এলো। এবার খুব শান্তি লাগছে! দেখার মতো হয়েছে এক একজনের চেহারা! হুহ! মেয়ে বলে কি পেয়েছে তারা! খুটিয়ে খুটিয়ে এতো দেখতে হয়! যত্তসব ক্ষেতমার্কা রাস্কেল মাইন্ডের লোক! মেহমানরা কি করছে এখন কে জানে! তবে মিথ্যেবাদী ঘটক ফুপুকে প্যাচে ফেলতে পেরে শান্তি লাগছে! এক নম্বর বানোয়াট একটা!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৪
(নূর নাফিসা)
.
.
ঘরে ফিরে মাকে নামাজ পড়তে দেখলো নাফিসা। সে বোরকা হিজাব খুলে গোসলের জন্য চলে গেলো। গোসল সেড়ে ওযু করে বেরিয়ে এসেছে তখন তার মা কিচেনে ছিলো। সে নামাজ আদায় করার পর লাঞ্চ করতে কিচেনে এলে রুমানা বেগম তাকে দেখে চড়া মেজাজী কন্ঠে বললো,
– শেলী আপা কি বলে গেলো! তুই নাকি বেয়াদবি করছিস!
– বাব্বাহ! নালিশও দিয়ে গেছে এসে! তা তোমার শেলী আপা কি করছে সেটা বলে যায়নি!
– মেহমান এসেছে, মেয়ে বড় থাকলে দেখাতেই পারে তাই বলে এমন ব্যবহার করবি! মেহমানদেরও নাকি অপমান করেছিস! দাড়া, তোর বাবা ফিরুক! এই শিক্ষা দিয়েছি কিনা, জিজ্ঞেস করবো! ফাজিল মেয়ে, গুরুজনদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় এখনো সেটা জানা নেই! কিসের এতো পড়াশোনা করাচ্ছি শুধু শুধু, যদি প্রকৃতভাবে শিক্ষিত না ই হতে পারে!
– মা, অন্যের মুখে উল্টাপাল্টা শুনে বকো না শুধু শুধু। সবাই নিজের সাপোর্টার। সত্য মিথ্যা বানিয়ে নিজেকেই ভালো সাজাবে সবার কাছে! আর যুক্তি দিবে শুধুমাত্র সে-ই সঠিক! ফুপি কি বলে গেছে আমি জানি না, তবে আমারটাও শুনো। আমি ভার্সিটি থেকে নিজের ঘর পর্যন্ত পৌছাতে পারিনি, রাস্তার ধার থেকে ফুপি ডেকেছে আমাকে। আমি তাদের বাড়িতে গেলে তিনি আমাকে ভালোমন্দ কিছু না বলে সরাসরি মেহমানদের সামনে নিয়ে গেছে! আমি তখনও কিছু বলিনি, কথামতো চুপচাপ গিয়েছি। তুমি জানো, কেমন একটা ছেলের সামনে নিয়ে গেছে আমাকে! টাক মাথা, আমার চেয়ে এক ফুট খাটো হবে, যদিও আমি দাড়ানো অবস্থায় দেখিনি। কিন্তু যেই ফুটবল, বসে থাকা অবস্থায়ই বুঝে গেছি ওই ব্যাটা পাচ ফুটের ধারেকাছেও হবে না!
– একটা থাপ্পড় দিয়ে সব দাত ফেলে দিবো! কি বলতে কি বলে! মুখে কিছু আটকায় না! আল্লাহর দান নিয়ে এমন উপহাস করতে হয়, বেয়াদব মেয়ে!
– আমি তো উনাকে উপহাস করছি না! আমার সাথে যে কতটা বেমানান আর তোমাদের আপার কেমন রুচি সেটা বুঝাতে চাইছি! আমি যদি দেখতে এমন খাটো ফুটবল আকৃতির হতাম তাহলে মানিয়ে নেওয়া যেতো! কিন্তু এতো লম্বা একটা মেয়েকে ওই লোকের সাথে মানায় কিভাবে, সেটা বলো!
– বেমানান বলে তুই এমন আজেবাজে ব্যবহার করবি! দেখেছে বলেই কি বিয়ে হয়ে গেছে! ব্যবহারে বংশের পরিচয়। এতে তুই তোর বাবার দুর্নাম করে এসেছিস!
– মা, আমি সেজন্য কিছু বলিনি তাদের। ফুপি এতো বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে সেটা দেখে খুব বিরক্ত লেগেছে! উনারা দেখতে এসেছিলেন শিথি আপুকে! আর ফুপি নিয়ে দেখিয়েছেন আমাকে! শিথি আপুর কথা মেহমানরা জিজ্ঞেস করতেই ফুপি ডিরেক্টলি বলে দিয়েছে, শিথি আপু নাকি বেড়াতে গেছে! অথচ পাশের রুমে বসা উনার মেয়ে! তারপর আবার মেহমানদের কান্ড দেখো, আমার নাম, বাবার নাম জিজ্ঞেস করার পরেও মায়ের নাম জিজ্ঞেস করে! মূল পরিচয়ে কি আবার মায়ের নাম জিজ্ঞেস করে কেউ! এরপর আবার শুরু করেছে, দাড়াও তো একটু, বসো তো একটু! পরক্ষণেই আবার বলে, চুলগুলো দেখাও তো একটু! চিন্তা করতে পারছো কতটা আযব টাইপের লোক! এদিকে নিজের ছেলের মাথার চান্দী ফাঁকা সেই খবর নেই, অথচ আমার মাথার চুল দেখতে আসছে! এজন্যই আমি আর সহ্য করতে না পেরে মুখের উপর বলে দিয়েছি আমার চুল না থাকলে কি উনারা টাকলা ছেলেকে বিয়ে করাবে না, নাকি!
রুমানা বেগম না চাইতেও হেসে উঠলেন এবং সাথে পিটুনি দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত উঠালেন! মায়ের মুখে হাসি দেখে নাফিসাও হেসে উঠলো এবং পিটুনি থেকে বাচতে একটু পিছিয়ে গেলো। এবং বললো,
– বলো তো এবার, আমি ঠিক বলে এসেছি না? উনাদের সমস্যা কোনো সমস্যা না, আর আমাদের সমস্যাই কঠিন ও গুরুতর সমস্যা! হুহ্!
– পাকনা বুড়ি একটা আমার ঘরে জন্মেছে! প্লেট নে, ভাত খাবি।
– ওফ্ফ! মা, কথা ঠিক করো। পাকনা না, পাকা হবে!
– যা, ভাগ! আসছে আমার কুখ্যাত শিক্ষক! টাকলা, চান্দী, নিজের কথার স্টেশন নেই আবার আমাকে শেখাতে আসে!
নাফিসা খিলখিল করে হেসে উঠে বললো,
– হয়েছে, বলে বলে তোমার আর মুখুস্ত করতে হবে না! ভাত দাও, আমি একটু বাচ্চাদের সাথে দেখা করে আসি।
– এখন যেতে হবে না, খেয়ে তারপর যা।
– আরে যাব আর আসবো। মা, আরেকটা কথা! আমি না মেহমানদের জানিয়ে দিয়ে এসেছি, শিথি আপু ঘরেই আছে। ফুপি মনে হয় এজন্যই বেগুনের মতো জ্বলে উঠেছে!
কথাটা বলে নাফিসা আর এক সেকেন্ডও নেই এখানে। সে তার ছোট্ট খামারে চলে গেলো বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে। পরক্ষণে মা মেয়ে একসাথে খেতে বসেছে। রুমানা বেগম নাফিসার উদ্দেশ্যে বললেন,
– আর কখনো যেন কারো সাথে এমন দুর্ব্যবহার করতে না শুনি। এভাবে তোর বাবার অসম্মান হবে।
– মা, অন্যায় হলে আমি বসে থাকবো কেন! অন্যায়ের প্রতিবাদ অবশ্যই করবো।
– সবক্ষেত্রে প্রতিবাদ করতে হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। মেয়ে বিয়ের যোগ্য থাকলে দেখতে আসতেই পারে। আর বউ যেহেতু নিবে সেহেতু তারা দেখে শুনেই নিবে।
– তুমি কি এখন আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে?
মেয়ের একটু কঠিন গলা শুনে রোমানা বেগম মাথা তুলে তাকালো। নাফিসার চোখ দুটো ভেজা হয়ে গেছে। তিনি জবাব দিলেন,
– আমার ও তোর বাবার ইচ্ছে অনার্স শেষ করিয়ে তারপর বিয়ে দিবো। কিন্তু কার ভাগ্যে কখন কি প্রতিফলন ঘটে তা কি আর জানা! নাজিয়াকে ঠিক সময়ে দিতে পারলেও নাহিদাকে তো অনার্স শেষ করাতে পারিনি বিয়ে হয়ে গেলো। তোকেও অনার্স শেষ করিয়েই বিয়ে দিবো। বাকিটা আল্লাহর হুকুম।
– এখন যেহেতু ইচ্ছে নেই সেহেতু বাড়িতে কোনো মেহমান আসতে দিবে না। আর যদি বিয়ে দিয়ে দাও, তো বলো। আমি আর ভার্সিটি যাবো না। পড়াশোনা শেষ আমার।
– একটা মাইর দিবো, ভাত খা! তোকে তো আমি বুড়ি বানিয়ে তারপর একটা বুড়ার হাতে তুলে দিবো।
নাফিসা হেসে উঠে বললো,
– তোমার আব্বাজান বেচে থাকলে না ভেবে দেখা যেতো।
উভয়েই এবার হেসে আবার খাওয়াতে মনযোগ দিলো।
.
শীত প্রায় ছুটিতে চলে গেছে। বেশিদিন নেই, গড়িয়ে আসবে বসন্ত। অদৃশ্যমান হয়ে যাবে ভোরের কুয়াশা! মিষ্টি সুরে গান গেয়ে ভোরের ঘুম ভাঙাবে কোকিল। দুয়ার খুলে যাবে দক্ষিণা হাওয়ায়! পাতা থাকবে না তবুও থাকবে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। হয়তো বা আবার কোথাও কোথাও উঁকি দিবে কচি কচি সবুজের সমারোহ। আস্তে আস্তে ভুবন ছেয়ে যাবে নতুন সজীবতায়!
দুদিন আগে বাবার বাসা থেকে ঘুরে এসেছে নাজিয়া। দুই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি দাওয়াত করে শীতের নানান পিঠার আয়োজন করেছে নিয়াজ উদ্দিন। বাবা-মা ও বোনদের সাথে সেখানে দুদিন কাটিয়ে এসেছে নাজিয়া। নাহিদা এবার থেকেছে চার পাচ দিনের মতো।
সকালে রুটি নাস্তা করেছিলো বিধায় দুপুরার জন্য রান্না বসিয়ে দিয়েছিলো। রান্নাবান্না শেষে আরাফের কাছে কল করে সালাম দিয়ে বললো,
– আজ একটু তারাতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবে?
– কেন?
– এমনি।
– খুব প্রয়োজন?
– না, পারলে এসো।
– আচ্ছা, দেখি। ক্লাসে আছি। এখন রাখি।
– আচ্ছা।
দুপুরের পরপর আরাফ বাড়িতে ফিরেছে। ঘরে প্রবেশ করে দেখলো নাজিয়া শাড়ি পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে ভেজা চুল আচড়ে নিচ্ছে। আরাফ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে উষ্ণ ছোয়া দিলো। অত:পর কাধে থুতনি রেখে আয়নায় নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কোথায় বেড়াতে যাবে, যে এতো জরুরী তলব!
– কোথাও না।
– তাহলে এতো সাজুগুজু আর শাড়ি পড়েছো যে!
– ইচ্ছে হলো আজ।
– হঠাৎ এমন ইচ্ছের কারণ কি?
নাজিয়া চিরুনি রেখে আরাফের দিকে ঘুরে দাড়ালো এবং শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
– বলবো, আগে ফ্রেশ হয়ে এসো।
– না, এখন বলো।
– উহুম, আগে ফ্রেশ হয়ে এসো তারপর বলবো।
আরাফ চলে গেলো হাতমুখ ধোয়ার জন্য। এতোক্ষণে নাজিয়া খাবারের প্লেট নিয়ে এসেছে রুমে। তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে আরাফ বললো,
– এবার বলো?
– খাওয়া শেষ করো আগে।
– এই, এড়িয়ে যাচ্ছো কিন্তু।
নাজিয়া হিহিহি করে হেসে বললো,
– ভালো বুঝতে পেরেছো। এবার তারাতাড়ি খাওয়া শেষ করো।
– বসো তুমিও।
– খেয়েছি আমি।
– কখন খেলে! মাত্র গোসল করেছো। চুল সম্পূর্ণ ভেজা।
– না, আমি গোসল করে, নামাজ পড়ে, খেয়ে তারপর খোপা খুলে চুল আচড়ে নিয়েছি। খোপা করা ছিলো বিধায়ই ভেজা।
– তবুও বসো। একা একা ভালো লাগবে না আমার।
– ওকে, বসলাম। এবার খাও।
আরাফ ভাত মেখে প্রথম লোকমা নাজিয়ার মুখের সামনে ধরলো। খেয়েছে বলা সত্ত্বেও মুখের সামনে তুলে ধরায় নাজিয়া ব্রু কুচকে তাকালো। আরাফ হা করতে ইশারা করলে সে বললো,
– শুধুমাত্র এটাই নিবো। আর কিন্তু খাবো না।
আরাফ মুচকি হাসলো আর নাজিয়া মুখে নিয়ে নিলো। নাজিয়ার মুখেরটা শেষ হতেই আরাফ আবারও সামনে ধরে বললো,
– একবার খাওয়া ভালো না। এটাই শেষ, আর দিবো না।
নাজিয়া দ্বিতীয় লোকমা খেয়ে পানি পান করে নিলো। বাকিটা আরাফ শেষ করলো। খাওয়াদাওয়ার পর প্লেট রেখে এলে আরাফ তাকে আটকে ধরে বললো,
– এবার তো বলো?
নাজিয়া আরাফের কাধে ভর করে উঁচু হয়ে দাড়ালো। মাথাটা নিচের দিকে টেনে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– অভিনন্দন, আরোহীর আব্বু। আরোহী অথবা তার ভাই আসছে অতি শীঘ্রই।
আরাফ নাজিয়াকে আরও কাছে এনে কান পেতে বললো,
– কি বললে? শুনিনি!
– নতুন অতিথি আসবে।
নাজিয়ার মুখের সাথে কান একদম লাগিয়ে বললো,
– শুনিনি, আবার বলো।
নাজিয়া তার দুষ্টুমি বুঝতে পেরে দু’হাতে সরানোর চেষ্টা করে বললো,
– যাও, আর বুঝতে হবে না!
আরাফ হেসে তাকে কোলে তুলে নিতেই নাজিয়ার চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেছে! ঠোঁটের কোনায় হাসি ঝুলিয়ে আরাফ বললো,
– এটা, কেমন কথা! না বুঝলে বুঝিয়ে দিতে হবে না!
– এই! একদম ভালো হবে না কিন্তু! নামাও বলছি!
আরাফ বিছানার দিকে যেতে যেতে বললো,
– তোমার সব ভালো হবে না গুলোকে আজ ভালো করে দিবো, মিসেস!
– নামাতে বলছি।
আরাফ বিছানায় নামিয়ে দিয়ে বললো,
– ওকে নামিয়ে দিলাম।
নাজিয়া হাসতে হাসতে আরাফকে ঠেলে সরিয়ে নেমে যেতে চাইলে আরাফ তাকে আটকে বললো,
– আরে, যাচ্ছো কোথায়! আমার জন্য সেজেছো, আর আমি দেখবো না!
– অনেক দেখেছো, এখন আর দেখতে হবে না। রান্নার আয়োজন করতে হবে।
– সব পরে। আপাতত শুধু আরোহীর আব্বু, আরোহীর আব্বু, আর আরোহীর আব্বু।

চলবে।