“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৮
(নূর নাফিসা)
.
.
বাৎসরিক ভাবে বিলীন হয়ে গেছে শীত। রিক্ততা ছাড়িয়ে প্রকৃতিতে জেগেছে নতুন সজীবতা। নাজিয়ার প্রেগন্যান্সির সাড়ে তিন মাসের এক রাতে পেটে খুব ব্যাথা লাগছে। প্রচুর ঘামছেও সে। অস্থিরতায় তার ঘুম ভেঙে গেছে। আরাফ তার পাশেই আছে। নাজিয়া এক হাতে পেট চেপে ধরে রেখেছে। কেন হঠাৎ এমন লাগছে বুঝতে পারছে না কিছু। তার উপর থেকে আরাফের হাত সরিয়ে সে উঠে বসলো। লাইটটা অন করে মশারির বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ধেক গ্লাস পানি পান করলো। দু এক মিনিটের মতো পায়চারি করে আবারও বিছানায় চলে এলো। ব্যাথা যেনো সেকেন্ডের কাটার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েই চলেছে! সে এখন না পারছে শুতে আর না পারছে বসে থাকতে! আর সহ্য করতে পারছে না! সে এক হাতে আরাফকে ঠেলতেই আরাফের ঘুম ভেঙে গেলো। আরাফ ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে বললো,
– কি হয়েছে? বসে আছো কেন?
– হঠাৎ করেই কেন জানি পেট ব্যাথা করছে।
– ঘুমিয়ে থাকো, ঠিক হয়ে যাবে।
– আরাফ, আমি আর পারছি না! মরে যাবো বোধহয়!
– কথাটা শুনে আরাফ চমকে উঠে বসলো! ঘুম তার পুরোপুরি ভেঙে গেছে নাজিয়ার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনে! সে নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে! এক হাতে পেট চেপে ধরে রেখেছে! সে ভয়ার্ত ভাবে বললো,
– কি হয়েছে তোমার? এভাবে ঘামছো কেন?
– পেটে প্রচুর ব্যাথা করছে! সহ্য হচ্ছে না আমার!
– খাওয়ার পর কোনো ওষুধ খেয়েছিলে?
– না।
আরাফ খাট থেকে নেমে পানি আনতে গেলে নাজিয়া বললো সে পানি খেয়েছে। আরাফ তাকে দাড় করিয়ে হাটতে বললো। সে একটু হেটেই আর পারছে না! আরাফ তাকে বসিয়ে রেখে দরজা খুলে মায়ের ঘরে এসে দরজায় টোকা দিলো এবং ডাকলো। আয়েশা বেগম দরজা খুলে বললেন,
– কি হইছে তোর?
– মা, নাজিয়া কেমন যেন করছে! ওর নাকি পেট ব্যাথা করছে প্রচুর!
– পেট ব্যাথা করে কেন! কি খাইছে?
– রাতে তো ভাত খেয়েছিলো, এর পর আর কিছু না।
আয়েশা বেগম বেরিয়ে আরাফের ঘরের দিকে আসছিলো। পিছু পিছু আলফাজ সাহেবও বেরিয়ে এসেছেন। আরাফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– শরীর বেশি খারাপ হইলে হাসপাতাল নিয়া যা।
– দেখি।
তাদের কথাবার্তা শুনে ওদিকে আশিকও বেরিয়ে এসেছে। নাজিয়া ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে কান্না করছে। আরাফের আর সস্তি লাগছে না! সে আশিককে পাঠিয়ে দিলো পাশের বাড়ির সি এন জি ওয়ালাকে ডেকে নিয়ে আসতে। এছাড়া এতো রাতে আশেপাশে গাড়ি পাওয়া মুশকিল। আশিক দ্রুত চলে গেলো গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এদিকে আয়েশা বেগম ভয় পেয়ে বিলাপ শুরু করেছেন, তার নাতি-নাতনি শেষ! কেননা নাজিয়ার ওয়াটার ফল শুরু করেছে! নাজিয়ারও ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাবার পালা হয়েছে। নাজিয়ার পাশাপাশি এদিকে আয়েশা বেগমও কান্না শুরু করেছেন। যেখানে অল্প কিছু হলেই তিনি কান্নাকাটি শুরু করেন সেখানে এতো বড় দুর্ঘটনার আভাস পেয়ে কান্নার জোয়ার তুলেছেন। আশিক সিএনজি ঠিক করে এলে নাজিয়াকে নিয়ে সবাই হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাসায় ছিলো আলফাজ সাহেব একা। হসপিটালে যাওয়ার সময় মাঝপথে নাজিয়া সেন্সলেস হয়ে পড়ে! সকলের ভয় বহুগুণে বেড়ে গেছে! আরাফ তাকে ডাকছে কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছে না! আরাফের দেহ যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে! এ কোন বিপদ এসে ধরা দিচ্ছে সুখের মুহুর্তে!
.
অন্ধকার ফুরিয়ে নব আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু মনের ভেতরে যে অন্ধকারটা আরও ঘনিয়ে এলো! স্থির হয়ে বসে আছে নাজিয়া! বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেছে তার! শীতে যেমনটা পূর্ণতা এনে দিয়েছিলো ভেতরটায়, আজ বসন্তে ঠিক তেমনটাই শূন্যতা! কতটা স্বপ্ন বেধেছিলো, কয়েক মাস পরেই কোল ভরে উঠবে! তা আর হলো না। গঠন পরিপূর্ণ হওয়ার আগেই নবপ্রাণের পতন ঘটলো! গর্ভধারণের মাত্র সাড়ে তিন মাস বয়সে গর্ভপাত হলো! নাজিয়ার বাবা-মা ও শুনা মাত্র অন্ধকার ভোরেই চলে এসেছে হসপিটালে। এখন সব নীরব। যদিও কিছুক্ষণ আগে হট্টগোল বেধেছিলো! আয়েশা বেগম মরা কান্নার সাথে নাজিয়াকে অলুক্ষণে উপাধিতে ভূষিত করেছেন। যদিও এমন উপাধি আরও অনেক আগেই তার কাছ থেকে পেয়েছে সে, তবে এবারেরটা সত্য বলে মেনে নিয়েছে নাজিয়া! আর পরিনত হয়েছে এক মানব পাথরে! রুমানা বেগম মেয়ের বিরুদ্ধে এমন কথা সইতে না পেরে মুখের উপর জবাব দিয়েছিলো দু’একটা। আরাফ আজ ছিলো নির্বাক। আশিক তার মাকে থামিয়েছিলো। ভোরে আলফাজ সাহেব এসে সংঘটিত ঘটনা শুনে আয়েশা বেগমকে বকে হসপিটাল থেকে চলে যেতে বলেছেন আর এটাও বলে দিয়েছেন, যেনো তার বাড়ি না উঠে চিরতরে ভাইয়ের বাড়ি চলে যায়। শেষ বয়সে এসে স্বামীর ঘর ছাড়া হচ্ছে শুধু মাত্র ছেলের বউয়ের জন্য এটা খুবই অসম্মানজনক তার কাছে! আশিক তার মাকে নিয়ে বাড়িতে চলে গেছে। এদিকে মেহেদীসহ নাহিদা ও তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি এসেছে হসপিটালে। নাফিসা আসতে পারলো না বাসা ফাঁকা থাকায়। কিন্তু কলের উপর কল করছে আপুর অবস্থা জানার জন্য। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারলো নাজিয়াকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। রুমানা বেগম জোর দিয়ে বললেন, তার মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। অনেক সহ্য করা হয়েছে অপমান। আর পাঠাবে না আরাফের বাড়ি!
কথাটা শুনতেই যেন আরাফের ভেতরটা মুচড়ে গেলো! সে তখন নাজিয়ার দিকে তাকিয়েছিলো। নাজিয়াও চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলো। আরাফকে এমন অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে! দুজনেই আজ নির্বাক! কারো কিছু বলার সাধ্য, শক্তি, সামর্থ্য কিছুই নেই আজ! নিয়াজ উদ্দিন রুমানা বেগমকে থামিয়ে আলফাজ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন নাজিয়াকে এখান থেকে তাদের বাসায় নিয়ে যাবে। তার এখন যত্নাদির প্রয়োজন। আলফাজ সাহেবও সহমত।
সারাদিন হসপিটালে কাটিয়ে বিকেলে নাজিয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। দুপুরেই আরাফ তাদের বাসা থেকে নাজিয়ার কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছিলো। আর এখন কাপড়চোপড়সহ নাজিয়াকে নিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। এতোটা সময়ে দুজনের মাঝে একটুও কথা হয়নি। নাজিয়াকে গাড়িতে তুলতে ও নামাতে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ব্যাথা পাচ্ছে কিনা তখন সে শুধু মাথা নেড়ে ইশারা করেছে।
দুপুরে নাহিদা তার শ্বশুর বাড়িতে চলে গেলেও সন্ধ্যায় এসেছে। কেননা, এমনিতেই বাড়ির সবার মনমেজাজ খারাপ! আপু অসুস্থ, বাসায় খামারে মুরগি, রান্নাবান্না আপুর সেবাযত্ন সহ সংসারের যাবতীয় কাজ তার মায়ের পক্ষে সামলানো দায় হয়ে পড়বে। নাফিসাও অতটা সামাল দিতে পারবে না। তাই সে মেহেরুনের কাছে বলে বাসায় আসতে চেয়েছে। মেহেরুন নিষেধ করেনি, বরং পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও সাপোর্ট করেছেন। সন্ধ্যায় মেহেদী তাকে পৌছে দিয়ে আবার চলে গেছে। আরাফ বিকেল থেকে এখানেই আছে। আসবাবপত্র আনা নেওয়া, ওষুধপত্র কেনাসহ এই সেই কাজে সে ব্যস্ত। রাতে আরাফ রুমে আসায় পাশে বসে থাকা নাহিদা উঠে বেরিয়ে গেলো অন্য রুমের উদ্দেশ্যে। নাজিয়া আরাফের চেহারায় তাকিয়ে দেখলো, বিশ্বের সমস্ত ক্লান্তি যেন তার মুখে নেমে এসেছে! গতরাত থেকে এক মিনিটের জন্যও বিশ্রামের কথা ভাবেনি সে! সারাদিন এদিকওদিক ছুটেছে শুধু! আরাফ তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কেমন লাগছে এখন?
– প্রথম সন্তান হারিয়ে ভালো কিভাবে থাকা যায়!
আরাফ জিজ্ঞাসা করলো দেহের অবস্থা আর নাজিয়া জবাব দিলো মনের অবস্থা! কথাই বাড়াতে ইচ্ছে করছে না আরাফের! নিজেই তো স্বাভাবিক না, তাকে স্বাভাবিক করবে কিভাবে! ইতোমধ্যে রুমে আগমন ঘটলো নাহিদার। এক গ্লাস পানি নিয়ে এসেছে আরাফের জন্য। পানির গ্লাস হাতে দিয়ে নাহিদা বললো,
– সারাদিন তো কিছুই খেলেন না। রান্না শেষ হয়নি এখনো। কেক, বিস্কুট দিবো ভাইয়া?
– না, খাবো না এখন।
নাহিদা আবার বেরিয়ে গেলো। আরাফ পানির গ্লাস নাজিয়ার মুখের সামনে ধরলে নাজিয়া খাবে না তাই মাথা দু’দিকে নাড়লো। পরক্ষণে আরাফ সম্পূর্ণ পানি পান করে গ্লাস রেখে দিলো। নাজিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে তার টুপটাপ পানির ফোটা পড়ছে। নাজিয়াকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে আরাফ বললো,
– পেটে কি এখনো প্রচন্ড ব্যাথা আছে?
– না।
– কাদছো কেন তুমি। নিজেকে শক্ত করো। আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন তা ঘটবেই। এভাবে ভেঙে পড়লে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাকাও আমার দিকে।
আরাফ এক হাতে নাজিয়ার মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে অন্যহাতে ভেজা গাল মুছে দিতে দিতে বললো,
– লক্ষ্মী মেয়ের মতো আর একটুও কাদবে না। আমি আছি তো তোমার পাশে।
– জানো, বড় ভাগ্য করে তোমার মতো একজনকে পেয়েছি! অথচ দেখো, এতো ভাগ্যবতী হয়েও আমি এক অভাগিনী! প্রথম সন্তানকেই দুনিয়াতে আনতে পারলাম না! আরাফ, সত্যিই আমি অলক্ষুণে।
– নাজিয়া স্টপ। এসব বলবে না কখনো। আর একটুও কাদবে না তুমি। আমরা আবার বেবি নিব, হুম?
– উহু, ভয় হয় আমার। পারবো না আমি। কিছুতেই পারবো না বারবার এমন নতুন প্রাণগুলোকে নষ্ট করে দিতে।
– নিজেকে এভাবে দোষারোপ করছো কেন! এটা ভাগ্য।
– একটা কথা রাখবে আমার?
– বলো।
– আরেকটা বিয়ে করো।
মুহুর্তেই আরাফের মুখে বিষন্নতার ছাপ নেমে এলো! এতোক্ষণ ধরে সে তাকে সামাল দিয়ে যাচ্ছিলো আর এখন কি করলো সে! এক কোপে হৃদপিণ্ডটাকে দুভাগ করে দিলো! নাজিয়া অশ্রুসিক্ত লোচনে আরাফকে আবার বললো,
– এবার আম্মার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করো। দেখো, আম্মা ঠিক লক্ষ্মী একজনকে নিয়ে আসবে তোমার জন্য। কোনো অলক্ষুণে কর্মকাণ্ড ঘটবে না আর ওবাড়িতে।
আরাফের চোখ ফেটে যেনো রক্ত বের হচ্ছে। এসময়টাতে কি এমন কিছুর সম্মুখীন হওয়ার কথা ছিলো! সে আর এক মিনিটও না বসে হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। এদিকে নাজিয়ার বুকের ভেতরটাও ধুকধুক করে কাপছে! জানে সে কষ্ট পেয়েছে, তবুও এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় সে খুজে পায় নি! সে মন থেকে চায়, প্রিয় মানুষটা সবসময় সুখে থাকুক। যতই ভালো থাকুক আর ভালোবাসুক এটা তো সত্য যে, গত দিনগুলোতে সে এক টুকরো সুখ এনে দিতে পারেনি সংসারে। একজন সুখী হলে তো আর সেটা সুখী পরিবার হলো না, পরিবারকে সুখী বানাতে হলে সকলকে সুখী করতে হবে। তাহলেই না সে সুখী পরিবারের এক আদর্শ বউ হতে পারবে। তার দ্বারা হয়তো সেটা সম্ভব না আর, তাই আজ আরাফকে নতুন জগতের দিকনির্দেশনা প্রদান করে নিজে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে নাজিয়া। আরাফ মোটেও প্রস্তুত ছিলো না এমন কিছু শোনার। তবুও তাকে আজ শুনাতে বাধ্য হয়েছে। গড়ে তুলুক সে নতুন সংসার, এতে যদি পরিবারে সুখ নেমে আসে তাহলে সমস্যা কোথায়! না, কোনোই সমস্যা নেই।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৯
(নূর নাফিসা)
.
.
আরাফ চলে যাওয়ার পরপরই নাহিদা রুমে এসে বললো,
– এটা কি করলে আপু! ভাইয়া যে রাগ করে চলে গেলো!
নাজিয়া তার চোখ মুছতে মুছতে বললো,
– যাক। ডাকবি না আর তাকে। বাবা মা ও যেন আর না ডাকে। নিজের ভালোটা নিয়ে ভাবতে দে তাকে। নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তুলুক।
– আর তুমি?
– আমি আর কি! আমাকে দেখতে পাচ্ছিস না! এমনই থাকবো। আমার জন্য কেউ খেটে মরুক, আমি তা চাই না। আমি অপয়া, আর অপয়াদের কারো সাথে মিশতে নেই। তোরাও থাকিস না আমার পাশে।
নাজিয়ার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনে রুমানা বেগম রান্নাঘর থেকে চলে এলেন। নাজিয়ার পাশে বসে বললেন,
– কাদছিস কেন, মা। ভেবে নে কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে। আল্লাহ যা করে সবটা আমাদের ভালোর জন্য।
নাজিয়া তার মায়ের কাধে মাথা রেখে হু হু করে কেদে উঠলো। নাহিদার একদমই ভালো লাগছে না এসব কান্নাকাটি দেখতে! ক’দিনের জন্যে দুনিয়াতে এসেছে। এই ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্র সময়টুকুতে মানুষের জীবনে কেন এতো দুঃখ এসে হানা দেয়! দেয় তো শুধু দুঃখ দিয়েই যায় না। একটার সাথে আরও দু-চারটা দিক ধ্বংস করে তারপর দুঃখের অবসান ঘটে তা-ও আবার সেটা ক্ষণিকের জন্য! সুখ সুখ করে পাগল মানব আর প্রকৃত সুখী হয়ে উঠতে পারে না!
নাফিসা রুমে এসে দেখলো মা মেয়ে উভয়েই কাদছে। নাহিদা নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো নাফিসার চোখও অশ্রুতে টলমল করছে! নাফিসা আবার বেরিয়ে যেতেই নাহিদা রান্নাঘরে চলে গেলো। নাফিসাকে পড়ার জন্য পাঠিয়ে সে রান্নার কাজ সেড়ে নিলো।
নিয়াজ উদ্দিন বাড়ি ফিরে নাজিয়াকে কাদতে দেখে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেন। এতে কি আর মন মানছে তার! এক বাচ্চার জন্য আরেক আরাফকে কষ্ট দেওয়ার জন্য উভয় দিকের যন্ত্রণা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে! নাজিয়াকে যথাসম্ভব শান্ত করে নিয়াজ উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন,
– আরাফ কোথায়?
– চলে গেছে।
– বাসায় চলে গেছে?
– হুম।
– কখন গেলো! আমাকে বললো না তো কিছু! খেয়ে গেছে?
নাহিদা জবাব দিলো,
– খেয়ে যাবে কি করে! আপু তাড়িয়ে দিয়েছে ভাইয়াকে।
নিয়াজ উদ্দিন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন নাহিদার দিকে। নাহিদা আবার বললো,
– আপু নিজেকে অলক্ষুণে ভাবছে আর ভাইয়াকে বলে দিয়েছে যেন আবার বিয়ে করে নেয়।
ওদিকে রুমানার উক্তি,
– ভালো করছে। আর পাঠাবো নাকি আমার মেয়েকে ওই জল্লাদ মহিলার বাড়িতে! কোনো দরকার নাই এমন সংসারের। প্রয়োজনে সারাজীবন আমার বাড়িতে রাখবো। তবুও ওই বাড়ি পাঠাবো না।
নাহিদা বললো,
– মা, এখানে ভাইয়ার দোষ কোথায়! ভাইয়া তো তার ঠিক জায়গাতেই আছে।
– উল্টাইছে ঠিক জায়গায় থেকে! ঠিক জায়গায় থাকলে তার মা তার সামনে ওসব বলে যায় কি করে আমার মেয়েকে! পরের মেয়েতো, তাই মুখে যা আসে তাই ছুড়ে মারে! নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে এমনটা হলে দেখতাম ওই মুখটা কেমন হয়! বার বার বলছিলাম খোঁজ খবর নিয়ে বিয়ে দাও। ছেলে ভালো পাইছে আর বিয়ে দিয়ে দিছে। ছেলে এখন তার বাবা-মা ছেড়ে সংসার করে! সবদিক দেখে নিতে হয়। শ্বশুর শ্বাশুড়িই যদি শত্রু হয় তবে সেই সংসারে সুখ কেমনে আসে!
বিষন্ন মন নিয়ে নিয়াজ উদ্দিন উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। বিষন্নতা এই জন্যে, মেয়ের সংসার বুঝি ভাঙতে চলেছে! না ওদিকে রক্ষা আর না এদিকে! কার বিরুদ্ধে লড়বে আর কাকেই বা চুপ থাকতে বলবে! সবাই যৌক্তিকতা নিয়ে নিজের অবস্থানে স্থির হয়ে বসে আছে! শেষ পর্যন্ত মেয়েটা নিজেও ছেলেটাকে উপেক্ষা করেছে! সেখানে তিনি একা আর কি প্রচেষ্টা করবে! সংসার জোড়া লাগাতে বহুদিক বিবেচনা করে দীর্ঘ সময় নিয়ে ভাবতে হয়। দোষ গুন খুজে খুজে তারপর বন্ধন সৃষ্টি করতে হয়। পরক্ষণে বন্ধনকে অটুট করতে হাজারো রঙের বাহারে সংসার সাজিয়ে তুলতে হয়। অথচ, তিলে তিলে গড়া সেই সাজানো সংসার ভাঙার জন্য একটা কারণই যথেষ্ট! যদিও সময়ের সাথে সাথে এক কারণ থেকে সৃষ্টি হয়ে যায় শত শত কারণ!
রাতে নিয়াজ উদ্দিন অল্প খাবার খেয়ে উঠে পড়লেন। মন ভালো না থাকলে খাবারে রুচি আসবে কোথা থেকে! কারোই তেমন খাওয়া হলো না। নাজিয়াকে জোর করে কিছু খাওয়াতে পেরেছে। কেননা খালি পেটে ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। রুমানা বেগম নাজিয়ার কাছে শুয়েছে। চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে গাঢ় অন্ধকার! প্রকৃতি নিরব হয়ে গেছে। বাইরে শুধু ঝিঝি পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু আধটু কুকুরের হাকও ভেসে আসছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘুমন্ত সকলের মাঝেও কিছু মানুষ আজ নির্ঘুম! কারো দৃষ্টি সজাগ! কারো দৃষ্টি ঘুমন্ত কিন্তু মস্তিষ্ক সজাগ! আবার কারো নিরবে ফেলা অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে বালিশ! আবার কেউ অন্ধকার ঘরে জানালা খুলে আনমনে তাকিয়ে আছে মেঘে ঢাকা ঘোলাটে চাঁদের দিকে! চাঁদটাও যেন আজ আলো ছড়াতে ভুলে গেছে! মনের ঘুম হারিয়ে গেলে চোখে ঘুম আসবে কিভাবে! অশান্ত মন যে সারাক্ষণ শুধু ছটফট করছে! শব্দহীন আর্তনাদ করছে একটু শান্তির খোঁজে! সেদিকে একজন ব্যথিত অভিমানে বসে আছে আনমনে আর এদিকে একজন বালিশ ভেজাতে ভেজাতে চিন্তা করছে,
“সে তো খেয়ে নিয়েছে কিন্তু সমস্ত ক্লান্তি বহনকারী লোকটা কি কিছু তুলেছে মুখে! নিস্তেজ দেহের সেই মানুষটা কি একটু বিশ্রামের জন্য দেহ এলিয়েছে বিছানায়! কাল রাতে তো একটুও ঘুমাতে পারলো না, সে ঘুমাতে পারছে তো আজ! নিশ্চয়ই ঘুম আসছে না আজ তার! আসবে কিভাবে, এদিকে সে নিজেই তো তার ঘুমটা হারাম করে দিলো!”
রাত কেটে কখন সকাল হয়ে গেছে বুঝতেই পারলো না কেউ। ফজরের আযান শুনে সবারই ধ্যান ভাঙলো। কেউ ছুটে চললো মসজিদে আবার কেউ বা ঘরে জায়নামাজ পেতে আদায় করে নিলো জান্নাতের চাবি।
আজ এলার্ম বাজেনি কারো ফোনে। নাফিসার ফোন ড্রয়ারের ভেতর ছিলো আর নাহিদার ফোনে এলার্ম দেয় না। কারণ ওবাড়িতে মেহেদীর ফোনে এলার্ম দেওয়া থাকে। রুমানা বেগম নামাজ পড়ে নাহিদা ও নাফিসাকে ডেকে দিলেন। অত:পর রাতের বেচে যাওয়া খাবারই গরম করে দিলেন। নাজিয়াকে খায়িয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে আবার নিয়াজ উদ্দিন অফিস যাবেন। গতকালের মতো আজ সকাল সকালই লোকজন আসছে নাজিয়াকে দেখতে। একদমই ভালো লাগছে না নাজিয়ার! কোনো কিছু ঘটলে সাথে সাথেই যেন রটে যায় এপাড়ায় ওপাড়ায়! আর শুরু হয় মানুষের সমাগম আর নানান কথাবার্তা! যন্ত্রণার উপর যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিতে যেন তারা ওস্তাদ! সমবেদনা জানাতে তারা যে অঘটন মনে করিয়ে বারবার বুকে ছুড়ি মারছে সেটা কি তাদের খেয়াল আছে! খেয়াল থাকবে কি করে! খেয়াল থাকলে কি আর এতো আলোচনা সমালোচনা করতো! এক একজনের মুখে এক এক কারণ শুনা যাচ্ছে বাচ্চা নষ্ট হওয়ার! যা পরিবারের কারোই শুনতে ভালো লাগছে না! কি ই বা করবে! লোকমুখে তো আর তালা দেওয়া যায় না। মানবতার খাতিরে বেদনার বিষয়বস্তুতে সমবেদনা তো জানাবেই! হোক সেটা গুণ অথবা দোষ উল্লেখ করে!
মেহেদী নাহিদার কাছে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে নাজিয়ার কথা। গতদিন থেকে তাদের মাঝেও তেমন কথা হয় না। তাদের মনমেজাজ ভালো না তাই মেহেদীও তেমন কল করে না। রাতে একবার আর অফিস যাওয়ার আগে সকালে একবার কল করেছিলো বড়জোর দুতিন মিনিটের জানি! “খেয়েছো, সবাই খেয়েছে, কি করছো, ভালো থেকো, নিজের সাথে বাকিদের যত্ন নিও” কথাগুলো এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। মেহেরুন ইসলামও রুমানা বেগমের সাথে কথা বলেছেন আর নাজিয়ার যত্নাদির ব্যাপারে কিছুটা সতর্কতা প্রদান করেছেন।
দুপুরে আশিক এসেছিলো নাজিয়ার সাথে দেখা করতে। নিজে অসুস্থতা সত্ত্বেও নাজিয়া ওবাড়ির সকলের কথা জিজ্ঞেস করেছে তারা কেমন আছে। আরাফের কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো আরাফ স্কুলে গেছে। আশিক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেনি এখানে। সে ফ্যাক্টরি থেকে এসেছে লাঞ্চ টাইমে। খাবারের জন্য বললে জানালো খেয়ে এসেছে। দেখা করার পরপরই সে আবার চলে গেছে।
দুদিন দুরাত পেরিয়ে আজ তিন রাত এসেছে, সেই সময়ের পর থেকে আরাফের সাথে একটুও কথা হয়নি! আজ সন্ধ্যায় মাগরিবের পর নাজিয়া ই নিজ থেকে কল করলো আরাফকে। কল রিসিভ হয়েছে কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনো শব্দ আসছে না। প্রায় একমিনিটের মতো অপেক্ষা করে নাজিয়া সালাম দিলো। আরাফ সালামের জবাব দিয়ে আবারও চুপ করে রইলো। নাজিয়া জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছো?
আরাফ খুব শান্ত গলায় বললো,
– কল করেছো কেন? বিয়ে করেছি কি-না, বউ কেমন সেই খোঁজ নিতে?
সাথে সাথেই নাজিয়ার গাল গড়িয়ে পানি পড়ছে। কম্পিত কণ্ঠে নাজিয়া বললো,
– সরি। আর বলবো না কখনো।
কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে আরাফের শান্ত গলা শোনা গেলো,
– আগের চেয়ে সুস্থ হয়েছো একটু?
– থাকতে পারছি না তোমাকে ছাড়া! পারবোও না কখনো। একটুও ঘুমাতে পারি না আমি! এসো না একবার। নিয়ে যাও তোমার কাছে।
– মা, তোমাকে আসতে দিবে না।
– তুমি বলে নিয়ে যাও।
– কি বলবো আমি! আর কি ই বা ভরসা দিবো! পারবো কি সব ফেলে রেখে তোমার খেয়াল রাখতে! কিসের ভরসায় মা তোমাকে পাঠাবে আমার সাথে, বলো?
– তাহলে থাকবো কিভাবে আমি!
আরাফের কোনো জবাব এলো না। এর মাঝে রুমে এসে নাফিসা ঘুরে গেছে। নাজিয়া আরাফের সাথে কথা বলছে তাই সে এখানে অপেক্ষা করেনি। নাজিয়া চোখ নাক মুছে বললো,
– কোথায় আছো তুমি?
– রাস্তায়।
– দিনরাত কি এখন শুধু রাস্তায়ই থাকো?
– না, নামাজ পড়ে হাটছি আবছা অন্ধকারে।
– আমাকে ভাবছো না?
– ভাবনার বাইরে কখনো রাখতেই পারলাম না!
– আমার ভালো লাগছে না একটুও। সারাক্ষণ কান্না আসে। কেদেও শান্তি পাই না আমি। তুমি আমাকে নিতে আসবে না আর?
– আমার কি করা উচিত বলতে পারো? আমি আমার বাবা-মাকে বুঝাতে পারি না, তোমার বাবা-মা কে বুঝাতে পারি না, কখনো কখনো তোমাকে বুঝানোরও ক্ষমতা রাখি না! নিজেকে এখন মানুষই মনে হয় না। কাপুরষ হয়ে উঠেছি আমি।
সাথে সাথেই কল কেটে নাজিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে কাদতে লাগলো। আরাফের শান্ত গলায়ও প্রচুর ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে! অনেকটা আঘাত করে ফেলেছে সেদিন উপেক্ষা করে! তারই বা করণীয় কি ছিলো! সংসারের সাধ যে তার মিটে গেছে! দিনরাত এমন কটু কথা শুনতে কার ভালো লাগে! এখন বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে, এখন তো আরও বেশি কথা শুনতে হবে এ নিয়ে! কিন্তু সে কি এখানে থাকতে পারবে! ওদিকে আরাফও যে বিষন্নতায় দিন কাটাচ্ছে! আরাফ যদি ভালো থাকতে পারতো তাহলে না হয় সে নিজেকে এখানে মানিয়ে নিতে পারতো! কিন্তু একজনকে কষ্ট দিয়ে সে শান্তিতে থাকবে কিভাবে! না, সে যাবে আরাফের কাছে। মাকে বুঝিয়ে বলবে সে। মেয়ের সুখে মা নিশ্চয়ই বাধা দিবে না। মা তো পরিস্থিতি দেখে রেগে এমন কিছু বলেছেন। মাকে বললে অবশ্যই যেতে দিবে।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫০
(নূর নাফিসা)
.
.
নিয়াজ উদ্দিন ইশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরেছেন। দুপুর থেকেই অস্থির লাগছে শরীরটা। আর এখন যেন সেই অস্থিরতা প্রচুর বেড়ে গেছে! তিনি নাজিয়ার পাশে এসে বসলেন। মেয়েটা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে! মেয়ের মন ভালো করার জন্য দু একটা কথা বললেন তিনি। অত:পর নিজ রুমে চলে গেলেন। খাবার প্লেটে বেড়ে নাফিসা ডাকতে এলো বাবাকে। দেখলো তার বাবা শুয়ে আছে কপালের উপর হাত রেখে।
– বাবা, ভাত খাবে না?
– তোমরা খাও। আমি পরে খাবো।
– কেন? এখন এসো।
– ফ্যানের সুইচটা অন কর তো, মা। আর অল্প একটু পানি দাও গ্লাসে।
নাফিসা ফ্যানের সুইচ অন করতে করতে বললো,
– এই ঠান্ডার মাঝে গরম লাগছে তোমার!
– হ্যাঁ, লাগছে একটু।
– ভাতের প্লেট এখানে আনবো?
– না, আমি পরে খাবো। আপাতত পানি এনো।
নাফিসা পানি আনার জন্য বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। রুমানা বেগম তাকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই নাফিসা বললো, “বাবার শরীরটা মনে হয় খারাপ লাগছে। এখন খাবে না বলছে। তুমি দেখে এসো তো মা।”
নাফিসা পানি নিয়ে এসেছে সাথে রুমানাও এসেছে। নিয়াজ উদ্দিন শার্ট খুলে শুয়ে আছে। ফ্যান চালু থাকা সত্ত্বেও তার দেহের পাতলা গেঞ্জিটা ঘেমে ভিজে আছে! নাফিসা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে তিনি শোয়া থেকে উঠতে গিয়েও যেন পড়ে গেলেন। রুমানা আর নাফিসা দুজনেই ভয় পেয়ে গেছে! দুজন ধরে নিয়াজ উদ্দিনকে বসতে সাহায্য করলো। নিয়াজ উদ্দিন বসে পানি পান করলো। মাথাসহ মুখমণ্ডল প্রচুর ঘামছে। উনার যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে! কিছু জিজ্ঞাসা করলেও জবাব দিতে পারছে না! শুরু হয়ে গেছে মা মেয়ের কান্নাকাটি! নাহিদা দৌড়ে এসেছে বাবার ঘরে! বাবার অবস্থা দেখে তার ভেতরটায়ও ভয় চেপে গেছে! ওদিকে নাজিয়া চলাফেরা করতে পারে না বলে সেখান থেকেই ডাকছে আর জানতে চাইছে কি হয়েছে! নাহিদা দৌড়ে এসে বললো, “আপু, বাবা যেন কেমন করছে! কি করবো এখন!”
নাজিয়া নাহিদাকে বললো তাকে বাবার কাছে নিয়ে যেতে। বাবার ছটফট দেখে নাজিয়ারও প্রচুর ভয় লাগছে। ঘরে চারজন মেয়ে। তারমধ্যে একজন অসুস্থ! এমন হুলস্থুল এর মাঝে কি রেখে কি করবে কারোই মাথায় ধরছে না! নাজিয়া তার বাবার ফোনটা হাতে নিয়েই আরাফকে কল করলো। আরাফ রিসিভ করতেই নাজিয়ার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনতে পেলো,
– আরাফ, বাবা কেমন যেন করছে! তুমি এসো একটু।
– কি হয়েছে, বাবার? কাদছো কেন তুমি!
– কি হয়েছে, বুঝতে পারছিনা কিছু! বাবার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে!
– আমি আসছি।
আরাফ আশিক দুজন একসাথেই ছিলো। ইশার নামাজ পড়ে বাড়ি যাচ্ছিলো দুজন। তারা আর বাড়ি না ফিরে রাস্তা থেকেই চলে এলো নাজিয়াদের বাড়ি। আরাফ তার বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা নাজিয়াদের বাড়িতে যাচ্ছে। নিয়াজ উদ্দিনের অবস্থা ভালো না দেখে আরাফ গাড়ি ঠিক করে উনাকে হসপিটাল নিয়ে গেছে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নাফিসা তার বাবার ডেবিট কার্ড আরাফের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। কার্ডটি নিতেও যেন আরাফের সম্মানে লেগেছে! কিন্তু কি আর করার! এদিকে নিজের হাত যে শুন্য! এমনিতেই সংসারে টানাপোড়েন তার উপর নাজিয়ার অসুস্থতায় আবার তার হাতটান পড়ে গেছে! বাধ্য হয়ে নিতে হলো তাকে। হসপিটালে নিয়াজ উদ্দিনের সাথে এসেছে রুমানা, নাহিদা, আরাফ ও আশিক। রুমানাও কাদছে, নাফিসাও খুব কাদছে। অসুস্থ একজন মানুষের সাথে দুজনকে সামলানো দায় তাই নাজিয়ার কাছে নাফিসাকে রেখে এসেছে বাসায়। আর নাহিদা একটু বুঝদার হওয়ায় তাকে নিয়ে এসেছে সাথে। অফিসের প্রয়োজনে জহিরুল ইসলাম ও মেহেদী গতকাল থেকে ঢাকার বাইরে আছে। আগামীকাল ফেরার কথা তাদের। নাহিদা তার শ্বাশুড়িকে কল করে জানিয়েছে তার বাবার অবস্থা। রাতেই তিনি আসিফের সাথে হসপিটাল গিয়েছে।
.
নিয়াজ উদ্দিন এখন বিপদমুক্ত। ডাক্তারের সাথে কথা বলে আরাফ জানিয়েছে দুশ্চিন্তার কারণে প্রেশার বেড়ে গেছে। তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। বিপদমুক্ত হলেও শরীর এখন অনেক দুর্বল। নিয়াজ উদ্দিনকে আশঙ্কামুক্ত দেখে মেহেরুন ইসলাম আবার বাড়ি ফিরে গেছে। কেননা মেয়ে ও নাতি নাতনিদের বাড়িতে রেখে এসেছে। এদিকে নাজিয়া আর নাফিসা দুজন মেয়ে লোক একা বাড়িতে। আরাফ কি করবে মাথায় ধরছে না! সে আশিককে হসপিটালে থাকতে বললো আর সবকিছু গুছিয়ে রেখে রাত বারোটার পর নিজে চলে এলো বাড়িতে। যা ভেবেছে তা-ই হয়েছে! দুইবোনই এখনো কাদছে! আরাফ যথাসম্ভব সান্তনা দিয়ে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দুজনকে খেতে বাধ্য করলো। সে-ও খেয়েছে। নাফিসা ঘুমানোর পূর্বে ওযু করে কুরআন পাঠ করেছে। আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাত করেছে মধ্যরাতে। নিরবে কাদতে কাদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই।
নাজিয়া আজ আরাফকে পেয়ে ঘুমাতে পারলেও শান্তির ঘুম হয়নি তার! একের পর এক অশান্তি যেন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে! এই অশান্তির কি কোনোই অন্ত নেই!
.
সকাল হতেই নাফিসা ঘুম থেকে জেগে নামাজ পড়ে রান্না বসিয়েছে। পরপর আবার খামারে চলে গেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে, সবদিকে কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! খামারে মুরগির খাদ্য পানি দেয়ার কাজে আরাফ সাহায্য করলো তাকে। পরপর সে রান্না শেষ করলো। আরাফ ভোরেই চলে যেতে চেয়েছিলো হসপিটালে কিন্তু নাফিসা যেতে দেয়নি, কেননা সে যাবে সাথে। রান্না শেষ করে নাজিয়াকে খায়িয়ে রেখে তারা দুজন খাবার নিয়ে চলে গেলো। সেখানে এসে দেখলো মাত্রই জহিরুল ইসলাম ও মেহেদী এসেছে। চারজনই একসাথে লিফটে উঠে কেবিনে এলো।
নাহিদা, রুমানা ও আশিক সবাই আছে কেবিনে। সকলের চোখেমুখে ভেসে আছে রাত জেগে থাকার ছাপ! নাহিদা জহিরুল ইসলামকে সালাম দিলো। নিয়াজ উদ্দিনের সাথে তাদের সাক্ষাতের পর মেহেদীর পাশে এসে দাড়িয়ে নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
– কখন ফিরেছো?
– ভোরে।
– নাস্তা করেছো?
– হুম।
– বাবা?
– হ্যাঁ, করেছে।
আরাফ নাহিদাকে বললো,
– নাহিদা তুমি মাকে সাথে নিয়ে বাসায় চলে যাও। সারারাত জেগেছো, বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। আশিক, তুইও বাসায় ফিরে যা। দেখ আজ অফিস থেকে ছুটি নিতে পারিস কি-না। রাতে ঘুমাস নি, অসুস্থ হয়ে পড়বি।
– আচ্ছা, যাচ্ছি।
আশিক বেরিয়ে যেতে নিলে নাহিদা বললো,
– ভাইয়া, বাসায় চলেন। রাতেও খাননি কিছু, নাস্তা করে তারপর যাবেন।
– না, ঠিক আছে। যাও তোমরা।
আশিক চলে গেলো। নাহিদা মেহেদীকে বললো,
– বাসায় যাবে, এখন?
– অফিস যাবো।
জহিরুল ইসলাম বললেন,
– মেহেদী চলো, নাহিদাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে অফিস যাই। দুপুরে মিটিং শেষ করে তুমি আবার চলে এসো।
– চলো।
নাহিদা লক্ষ্য করছে সবার সাথে প্রয়োজনীয় টুকটাক কথাবার্তা বললেও মেহেদীর মুখটা কেমন গম্ভীর! নাহিদা ও রুমানাকে তাদের গাড়িতে করে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে তারা বাবা ছেলে অফিস চলে গেছে। গোসল সেড়ে বিশ্রামের কোনো প্রয়োজন মনে করেনি রুমানা বেগম। আবার রান্না বসিয়ে নিজে কিছু খেয়ে তাদের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে গেছে হসপিটাল। এবার তিনি একাই গেছেন। নাহিদা তার বোনের ও খামারের দেখাশোনার জন্য বাড়িতে রয়ে গেছে।
নাফিসা তার বাবার কাছে ঘেঁষে বসে আছে। প্রথমত কাদছিলো, পরক্ষণে শান্ত হয়ে গোমড়ামুখো হয়ে বসে আছে। আরাফ একবার রোগীর কেবিন তো আরেকবার ডাক্তারের কেবিনে আসা যাওয়া করছে! কখনো রিসিপশনের ঝামেলা নিয়ে ছুটাছুটি করছে কখনো বা ওষুধ কিনতে হসপিটালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
আজ প্রথম নিয়াজ উদ্দিন ছেলে সন্তানের অভাব হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছেন। এতোদিন রুমানা বেগম ছেলে সন্তানের জন্য আফসোস করলে তিনি বারবার সামাল দিতেন এই বলে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভাগ্যবান তিনি। কেননা তার কাছে তৃ-তনয়া আছে। যখনই আল্লাহ তায়ালা খুশি হোন, তখনই পৃথিবীতে কন্যা সন্তান পাঠান! নবী করিম (সা.) ও কন্যার জনক ছিলেন। সেই সুত্রে তিনিও পরপর তিন কন্যার জনক! তার মতো ভাগ্যবান পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
কিন্তু আজ! আজ যে একটা পুত্রের খুব প্রয়োজন ছিলো! যতই আপন হোক না কেন, মেয়ের জামাইকে ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ির কষ্ট করতে দেখতে একটুও ভালো লাগছে না! তিনি মন থেকে নিজ সন্তান ভাবে কেবল খুশির সময়ে উপস্থিত করতে। কিন্তু আজ দুখের দিনে এভাবে খাটাতে একদম ভালো লাগছে না। নিজের পুত্র সন্তান থাকলে তো মেয়ের জামাইকে এভাবে কষ্ট করতে হতো না! নিজ দায়িত্বে সকল ভার বহন করে নিতো তার ছেলে। ছেলেকে বাবার জন্য কষ্ট করতে দেখতে তখন গর্ববোধ করতেন তিনি। যেটা আজ পারছেন না। বরং নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আজ!
দুপুরের দিকে আলফাজ সাহেবও দেখা করে কথা বলে গেছেন। সন্ধ্যার দিকে আবার জহিরুল ইসলাম এসেছেন কিন্তু মেহেদী আর আসেনি। একদিনেই এক একজনের চেহারার অবস্থা নাজেহাল হয়ে গেছে! তাই আজ রাতে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে আরাফ একা থেকেছে হসপিটালে।
.
রাতে ডাক্তার এসে চেকাপ করে গেলে নিয়াজ উদ্দিন আরাফকে ডেকে পাশে বসতে বললো। আরাফ পাশে বসলে নিয়াজ উদ্দিন তার মনে জমা দুশ্চিন্তার কথা শেয়ার করলেন ছেলেসমতুল্য জামাইয়ের সাথে। নাজিয়ার হাত তো বহু আগেই তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। নাহিদাকেও কোনো এক সুশৃঙ্খল পরিবারের কাছে তুলে দিতে পেরেছেন। মনে হচ্ছে জীবনের শেষ দিকে চলে এসেছেন। স্বপ্ন থাকে বহুদূর, কিন্তু সময় যে সীমিত! সেকেন্ডেরও ভরসা নেই, মুহুর্তেই সুস্থ মানুষ শূন্যে হারিয়ে যায়। আর সেখানে তিনি দুরারোগ্য! তার সকল চিন্তা এখন নাফিসাকে নিয়ে। আজ যদি সে দুনিয়া ত্যাগ করে চলে যায় তাহলে দুই মেয়ের ভার বহন করার মতো আলাদা পরিবার আছে, কিন্তু তার ছোট মেয়েটার ভার কে বহন করবে! তার ভার কারো উপর তুলে দিতে পারলে তিনি দায়িত্বমুক্ত হতে পারতেন। সম্ভব হলে তার উপস্তিতি বা অনুপস্থিতিতে আরাফ যেন বড় ভাই হয়ে একটা সুশৃঙ্খল পরিবারে তাকে পাঠিয়ে দিতে পারে। এমন একটা আবদার রাখলেন তিনি আরাফের কাছে এবং বড় ভাইয়ের অধিকারটাও দিয়ে দিলেন। মেয়েদের নিয়ে চিন্তামুক্ত হতে পারলে বাকি জীবনটা অনু প্রচেষ্টায় কাটিয়ে দিতে পারবেন তিনি এবং তার স্ত্রী।
নিয়াজ উদ্দিনের কথার সুবাদে আরাফ আজ তুলে ধরলো তার খালাতো ভাই ইমরানের কথা! কিছুদিন যাবত তার বিয়ের জন্য পাত্রী খুজছে। সেদিন আশিকের সাথে ভার্সিটিতে দেখার পর এবং আশিকের কাছে তার পরিচয় জানার পর ইমরান আরাফকে বলেছিলো নাফিসার কথা। কিন্তু আরাফ নিষেধ করে দিয়েছে, কেননা সে জানে পড়াশোনা শেষ না করিয়ে নাফিসাকে এখন বিয়ে দিবে না। তাই সেই প্রসঙ্গে কাউকেই কিছু বলেনি। নিজ থেকেই নিষেধ করে দিয়েছে। আজ আরাফের কাছে শুনে নিয়াজ উদ্দিন ইমরানের ডিটেইলস জানলেন। জামাই শ্বশুর গল্প করেই রাতের অর্ধেকটা সময় পাড় করে দিলো।
.
.
চলবে।