তৃ-তনয়া পর্ব-৫১+৫২+৫৩

0
756

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫১
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকালে রুমানা বেগম ও নাফিসাকে হসপিটালে রেখে আরাফ বাড়ি ফিরে গেছে। গতকাল স্কুল মিস হয়েছে ,কিন্তু আজ যেতে হবে। স্কুল টাইম ওভার হতেই সে কোচিং অফ রেখে চলে এসেছে হসপিটাল। নিয়াজ উদ্দিনকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার মধ্যে সবটা গুছিয়ে আরাফ তাদের বাড়ি নিয়ে গেছে। বাড়িতে এখন দুই রোগী। নাজিয়া কিছুটা সুস্থ হলেও পুরোপুরি না। আরাফ আজ এখানেই থেকেছে। পরদিন আবার এখান থেকেই স্কুলে গেছে। নাফিসার ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না বেশ কিছুদিন ধরে। নাহিদা নাফিসা দুজনেই পড়াশোনার বাইরে। নিয়াজ উদ্দিন বাড়ি ফেরার চার পাচ দিন পর ইমরান, তার ভাই ও ভাবি এসেছে নাফিসাকে দেখতে। শুনেছে তার বাবা-ই নাকি আসতে বলেছে তাদের। যদিও মেহমান আসছে শুনতেই নাফিসার খুব বিরক্ত লাগছিলো। কেননা সে এখন বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত না! তবুও মায়ের চোখ রাঙানো দেখে সে উপস্থিত হয়েছে আজ মেহমানের সামনে। মেহমানদের মাঝে ইমরানকে দেখে তো সে চরম অবাক! সে তো একে একদিন ভার্সিটিতে দেখেছে আশিকের সাথে! ঝগড়াটে লোক একটা! কিন্তু এখানে দুইজন পুরুষকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কোনটা পাত্র! পরক্ষণে খেয়াল এলো আপুর কাছে শুনেছে ভাই, ভাবি আর ছেলে এসেছে। সেই সুত্রে সে নিশ্চিত তুলনামূলক অল্প বয়সের ছেলেটা অর্থাৎ ইমরানই পাত্র। ইমরানের চোখে চোখ পড়তেই ইমরান জিজ্ঞেস করেছিলো, “কেমন আছো?”
নাফিসা দৃষ্টি সরিয়ে মলিনতার সাথে জবাব দিলো, “আলহামদুলিল্লাহ।”
এতোক্ষণ নিয়াজ উদ্দিন বসে ছিলেন মেহমানদের সাথে। এখন নাফিসাকে নিয়ে আসায় তিনি উঠে চলে গেলেন৷ আরাফ আজ এখানে নেই। আসতে বলা হয়েছিলো তাকে কিন্তু সে ব্যস্ততা দেখিয়ে আর এলো না। যদিও এর মূল কারণ নাজিয়ার জানা। আরাফ এলে নাফিসা নিশ্চিত ভাববে আরাফ তার জন্য এই সমন্ধটি নিয়ে এসেছে। এমনিতেই সে একটুতে রাগ করে ফেলে, আর এখানে সম্পূর্ণ ভাবে দোষারোপ করবে আরাফকে। কেউ তার উপর রেগে থাকুক সেটা চায় না আরাফ। তাই ঝামেলা থেকে দূরেই আছে।
নাজিয়ার পরিচিত হওয়ায় নাফিসার সাথে এ রুমে নাজিয়া এসেছে। মেহমানদের মধ্যে মহিলাটি জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন ভাবি?
– আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?
– আছি, আলহামদুলিল্লাহ।
– জিহান, কেমন আছো তুমি?
ইমরানের কোলে থাকা পিচ্চিটা লজ্জায় যেন ইমরানের সাথে মিশে গেছে! তা দেখে নাজিয়া, ইমরান এবং বড় ভাই আরমান হেসে উঠলো। নাফিসা এতোক্ষণে বুঝে গেছে এরা নিশ্চয়ই নাজিয়ার শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে পরিচিত! নাজিয়া নাফিসা সমন্ধে বলে পরিচয় করিয়ে দিলে শুরু হলো জিহানের মায়ের জিজ্ঞাসাবাদ!
– নিয়মিত নামাজ পড়ো?
– হুম।
– কুরআন পড়তে জানো?
– হ্যাঁ।
– বলোতো কুরআনের কয়টি সূরা আছে?
– ১১৪টি।
– ১১৪ সূরার নাম বলোতো কি কি?
– মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য কি ভাইভা নিচ্ছেন? আমি চাকরি করবো না আপনার মাদরাসায়।
মহিলাটি বাদে বাকিরা মুখ টিপে হাসলো! তিনি আবার বললেন,
– বেশ চতুর তুমি! দেখেই বুঝা যায়! আচ্ছা, যাও। নিলাম না ভাইভা। রান্না করতে জানো?
– মোটামুটি।
– মোটামুটি বলতে, কখনো লবনের সল্পতা আবার কখনো প্রাচুর্যতা ! এইতো?
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। স্বভাবতই মেয়ে দেখতে এলে খুটিয়ে খুটিয়ে এতো জিজ্ঞাসাবাদ নাফিসার বিরক্ত লাগে! মহিলাটি আবার বললো,
– ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ঘর মোছা, পরিবারের সদস্যদের যত্ন নিতে পারো?
ইমরান তার ভাইকে ইশারা করলো ভাবিকে থামানোর জন্য। আরমান শান্ত স্বরে বললো, “জেরিন!”
কিন্তু এবার নাফিসা আর চুপ থাকতে পারলো না। সে বলেই ফেললো,
– আপনি বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে এসেছেন নাকি বাড়ির জন্য কাজের বুয়া খুজতে এসেছেন!
– কাজের বুয়া কেন খুজতে আসবো! ঘরে বউ থাকলে কাজের বুয়ার কি প্রয়োজন! এসব কাজ তো বউদেরই করতে হয়!
– তো সেটা বউ হলে না করে দেখাবে!
– আচ্ছা! ইংলিশে এড্রেস লিখে দেখাও দেখি।
– আপু কিন্তু বলেছে আমি অনার্সে পড়ি। এড্রেস লেখা বাচ্চাদের কাজ।
নাফিসাকে থামাতে নাজিয়া দাত চেপে নিচু শব্দে বললো,
– নাফিসা! চুপ থাকো। অতিরিক্ত কোনো কথা বলবে না। আমি খাতা নিয়ে আসছি।
আরমান বললো,
– না ভাবি, প্রয়োজন নেই। জেরিন, এসব কি শুরু করেছো তুমি!
– কেন, দেখতে এলে তো এড্রেস চায় ই! এতে কিছু শুরু করার কি আছে! আমার সময়ও চাওয়া হয়েছিলো।
– আমি চাইনি তোমার কাছে।
– তুমি না চাইলেই কি, অন্য যারা দেখতে এসেছে চেয়েছে না! ভাবি, আপনাকে দেখতে এসে এড্রেস চায়নি?
নাজিয়া জবাব দিলো,
– হ্যাঁ।
জেরিন আবার বললো,
– তো! এটা স্বাভাবিক! চাইতেই পারে।
আরমান বললো,
– যারা প্রাথমিক শিক্ষাটাও জানে না, তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। আর তুমি এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেন। এড্রেস যদি না ই বা লিখতে জানে ইমরান শিখিয়ে নিবে। এসব তথ্য নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
– তো আমাকে নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিলো!
– দেখার জন্য। তাছাড়া অন্যকিছুও তো জিজ্ঞাসা করতে পারো যেগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, কিছুক্ষণ আগে জিজ্ঞেস করলে নামাজ, কুরআন পড়ে কিনা এমন কিছু। অথবা তার সম্পর্কে জানতে পারো।
– প্রয়োজন নেই আর জানার। তোমরাই জানো বেশি করে।
জেরিন আর কোনো কথা বললো না। নাফিসার একটুও ইচ্ছে করছে না এখানে বসে থাকতে! আরমান বলার পরপরই নাফিসা উঠে চলে গেলো। নাজিয়া আরও কিছুক্ষণ বসে কথা বলেছিলো তাদের সাথে। রুমানা বেগমকেও ডাকা হয়েছে। সাক্ষাৎ শেষে তারা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিয়াজ উদ্দিন বাড়ির সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলেন। আর এদিকে শুরু হলো নাফিসার স্পেশাল ক্লাস! নাহিদা ও তার মা পাশের রুমে থেকে তাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। আর এখন ঝাড়ছেন! অন্যের কথা শোনার একটু ধৈর্য যেন নেই তার! ভালো লাগলে মাথায় নিবে আর ভালো না লাগলে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবে। মুখের উপর এভাবে জবাব দেওয়ার কি প্রয়োজন সেটা নিয়েই রুমানার রাগ হচ্ছে নাফিসার উপর!
সেখানে মুখের উপর জবাব দিলেও এখন নাফিসা পরিবারের লোকদের উপেক্ষা করে নতুন পোশাক পালটে তার খামারে চলে গেলো।
পরিবেশ শান্ত হলে নাফিসা সন্ধ্যায় নাজিয়ার কাছে জিজ্ঞেস করলো,
– আপু, ওরা তোমাদের কি হয়?
– কারা?
– আজ যে এসেছে।
– তোর ভাইয়ার খালাতো ভাই আর ভাইয়ের বউ।
– আপন?
– হুম।
– ভাইয়া নিয়ে এসেছে না তাদের?
– তোর ভাইয়া এসেছে বুঝি!
– না আসুক, ভাইয়ার পরিচিত যেহেতু ভাইয়াই আসতে বলেছে। তা না হলে এলো কিভাবে!
– শুনিস নি, বাবা বলেছে আসতে! আর ঘরে উপযুক্ত মেয়ে থাকলে দেখতে আসবেই এদিক সেদিক থেকে। তাই বলে মেহমানদের সাথে এভাবে জবাব দিতে হয় না।
– আমি কি উপযুক্ত হয়ে গেছি?
এমন প্রশ্নে নাজিয়া অন্যরকম এক দৃষ্টিতে তাকালো নাফিসার দিকে। হঠাৎই আগমন ঘটলো নাহিদার। সে বললো,
– আপু, একে অতসব বুঝিয়ে লাভ নেই! কিছুদিন আগে ফুপির ঘরে যেই এলাহি কাণ্ড ঘটিয়েছে! মায়ের কাছে শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ!
– কি হয়েছে?
– শুনো নি?
– না তো!
নাহিদা আবার সেদিনের গল্প জুড়ে দিলো। আর দুইবোন আবারও হেসে কুটিকুটি! আর নাফিসা রেগে কিড়মিড়!
পরদিন জানতে পারলো নাফিসাকে নাকি পছন্দ হয়েছে তাদের! কিন্তু নাফিসার যে পছন্দ হয়নি! এমনিতেই বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত না তার উপর পাত্র আরাফের খালাতো ভাই! অর্থাৎ ওই বদ মহিলার বদ বোনের সন্তান! উনি যেহেতু এমন তাহলে উনার বোনও একই স্বভাবের হবে সে নিশ্চিত! তাই আরও বেশি অপছন্দনীয়! ওদের আত্মীয়তে সম্পর্ক জুড়তে সে যাবে না!
ভেবে ভেবে মাথা খাটিয়ে কিছু প্ল্যান করলো। আরাফ এ বাড়িতে এলে সে ইমরান নাম খুঁজে খুঁজে ফোনে দুইটা নম্বর পেলো আরাফের ফোন থেকে। পরিকল্পনা মোতাবেক দুদিন পর ভার্সিটি গিয়ে কল করার জন্য নোট বুক বের করলো। আরাফের ডায়াল লিস্টে কোনটা আগে ছিলো সেটা ভুলে গেছে সে। প্রথমে একটাতে দিতেই রিসিভ হলো এবং সালাম দিলো সে। লোকটা সালাম নিয়ে জানতে চাইলো “কে? হ্যালো?”
নাফিসা সাথে সাথে কেটে দিলো। সে নিশ্চিত এটা ইমরান হবে না। লোকটা কেমন যেন টানা ভাষায় কথা বললো, মনে হলো লোকটা বরিশালের হবে! কেননা তার ভার্সিটির বরিশালের স্যারদের কথা এমন টানা টানা!
সে দ্বিতীয় নম্বরে কল দিতেই রিসিভ হলো এবং তার আগেই অপর পাশ থেকে সালাম দিলো। সে সালামের জবাব দিতেই ওপাশ থেকে বললো,
“কেমন আছো?”
গলাটা এতোটাই শান্ত ছিলো, নাফিসার মনে হলো যেন লোকটা তার প্রেমিকার সাথে কথা বলছে! সে ঠিক জায়গায় কল দিয়েছে তো! ভাবছে মনে মনে।
তাকে নিরব দেখে ওপাশ থেকে বললো, ” হ্যালো? হ্যালো? নাফিসা?”
তার নাম শুনতে পেয়ে নাফিসা চমকে উঠলো! সে কি মানুষের কাছে কল করেছে নাকি ভুতের কাছে! লোকটা জানলো কিভাবে নাফিসা কল করেছে! নাফিসা ঢোক গিলে বললো,
– আপনি জানলেন কিভাবে আমি কল করেছি?
– আরও তিনদিন আগে থেকে তোমার দুইটা ফোন নম্বর সেভ করা আছে।
– কোথায় পেলেন!
– সম্পর্কে তুমি আমার বেয়াইন! ফোন নম্বর পাওয়া ব্যাপার নাকি!
– আমি আপনার কিছু না।
– আচ্ছা কিছু না। শুধু মাত্র হবু বউ। ওকে? এবার বলো, কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– আমি আপনাকে একটা বিশেষ প্রয়োজনে কল করেছি।
– আমি ভেবেছিলাম ভুলে কল এসেছে! আচ্ছা বলো, কি প্রয়োজন।
– আমি এখন বিয়েটা করতে পারবো না। আর আপনি কথাবার্তা না এগিয়ে ক্যান্সেল করে দিন। অন্য মেয়ে দেখা শুরু করুন।
– বিয়ে না করার কারণ?
– সামনে আমার এক্সাম। পড়াশোনা শেষ করার আগে এসব নিয়ে ভাবছি না।
– তোমার পরিবার তো তোমাকে বিয়ে দিয়েই দিবে।
– আপনি নিষেধ করলেই তো আর দিতে পারবে না।
– আমি নিষেধ করলেও তো অন্য একজন ঠিকই আসবে।
– অন্য একজনকেও আসতে দিবো না!
ইমরান হেসে বললো,
– জীবনে বিয়ে করবে না, সেই সিদ্ধান্তে অটুট হয়েছো নাকি!
– হ্যাঁ।
– তাহলে সেটা কখনো সম্ভব হতে দিবে না। কোনো পরিবারই না। এমনকি সমাজও না। আর আমিও নিষেধ করছি না।
– কেন?
– তোমার মতো একজনকে প্রয়োজন আমার। অন্যথায় ভালো লেগেছে তোমাকে, তাই।
আপাতত আর কিছু বলার জন্য খুজে পাচ্ছে না নাফিসা। চোখের সামনে ক্যাম্পাসে জোড়া পাখিদের দেখে একটা উপায় এলো মাথায়। তাই সে বলে দিলো,
– আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।
– এতোক্ষণ পর বয়ফ্রেন্ডের কথা মনে হলো!
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে কপালের এক কোনে স্লাইড করতে করতে বললো,
– বলতে চাইছিলাম না, কিন্তু এখন বলতে বাধ্য হলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। সুতরাং ক্যান্সেল করে দিন।
– এসব বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড রাখা ভালো না। একটু মনোমালিন্য হলেই প্রেমে বিচ্ছেদ! তার চেয়ে ভালো, ব্রেকাপ করে দাও। আর আজ থেকে… না, বিয়ের পর থেকে আমাকে নতুন করে বয়ফ্রেন্ড ভাবতে শুরু করো কেমন?
নাফিসা কল কেটে কপাল চাপড়ালো! তার প্ল্যান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলো লোকটা! বেহায়া লোক একটা!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫২
(নূর নাফিসা)
.
.
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাসায় এসে শুনতে পেলো আজ তার বাবা মা নাকি আরাফ ও জহিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ইমরানের বাড়িতে গিয়েছিলো দেখতে। তাদেরও পছন্দ হয়েছে। আয়েশা বেগমের বোনের বাড়ি দেখে রুমানার একটু দ্বিধা হচ্ছিলো কিন্তু তাদের বর্তমান ভয়াবহ অবস্থার কথা ভেবে তিনিও একমত পোষণ করলেন। যদিও ওবাড়িতে তাদের আচরণ, আপ্যায়ন যথাযথ ভালো ছিলো আজ। নিয়াজ উদ্দিনের ভালো লেগেছে বেশ৷ তার প্রথম কারণ ইমরানের বাবা নেই। তিনি বরাবরই এতিমদের খুব ভালোবাসেন। এতিমদের জন্য অজান্তেই তার মনে মায়া জন্মে যায়। তাছাড়া ইমরানকেও ছেলে হিসেবে ভালো লেগেছে, মধ্যবিত্ত তাদের পরিবার। যা তাদের সাথে মানানসই।
কিন্তু সব রকম অপছন্দ কেবল নাফিসারই। কেননা তার এক কথা, সে এখন বিয়ে করবে না। বেশ কয়েকদিন ধরে নাহিদা এখানে আছে। আজ জহিরুল ইসলাম আসায় সে চলে গেলো সাথে।
পরদিন নাফিসা ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরতেই তার মায়ের প্রশ্ন, “তুই ইমরানের কাছে কল করেছিস?”
এমন প্রশ্নে নাফিসা থমকে গেলো! মায়ের মুখ গম্ভীর। পাশে ছিলো নাজিয়া। তার মুখও গম্ভীর! নাফিসা ভাবছে, “গতকাল কি ওই ব্যাটা বিচার দিয়ে দিলো নাকি! তাহলে গতকাল কিছু জিজ্ঞেস করলো না কেন মা! নাকি আজ কল করে বিচার দিয়েছে!”
তার কোনো জবাব না পেয়ে রুমানা বললো,
– কি বলেছি, কথা কানে যায় নি?
– হ্যাঁ, কল দিয়েছিলাম।
সাথে সাথেই তার দুই গালে দুইটা কষিয়ে থাপ্পড় পড়লো! রুমানা বেগম আরও কয়েকটা দিতো হয়তো! কিন্তু নাজিয়া থামিয়ে দিয়েছে তার মাকে। অত:পর তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন,
“এমনিতেই আধমরা হয়ে আছে, এবার কি পুরোপুরি মেরে ফেলবি লোকটাকে! শেষ করে দে, আমাকে সহ একেবারে শেষ করে দে! ভালো লাগে না আর তোদের নিয়ে এই যন্ত্রণা! মেয়ে মানুষ বিয়ে দিবো না তো ঘরে খুটি বেধে সারাজীবন রেখে দিবো? শান্তির নিশ্বাস ফেলে বাচতে দিবি না একটু! ভাবতেও অবাক লাগে, আমার ঘরে এমন মেয়ে আছে যে নিজের বিয়ে নিজেই ভেঙে দিতে চায়! সবকিছুতেই বাড়াবাড়ির একটা লিমিট থাকা প্রয়োজন! পড়াশোনা করিয়েই আমার ভুল হয়েছে! মূর্খ রেখে দিতাম, আর বারো তেরো বছরে আরেক মূর্খের হাতে তুলে দিয়ে ঘর থেকে বিদায় করে দিতাম। সেটাই অনেক ভালো হতো। এমন শিক্ষিত হওয়ার তো কোনো দরকার নেই যে কিনা পরিস্থিতি বুঝতে জানে না!”
নাফিসা এক গালে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে! থাপ্পড় দিতে দেড়ি হয়েছে কিন্তু চোখের পানিতে তার গাল ভিজতে দেড়ি হয়নি একটুও! কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে চেচিয়ে বললো,
– মূর্খই রেখে দিতে। করিয়েছো কেন পড়াশোনা! মেয়ে হয়ে জন্মে তো বোজা হয়ে গেছি! ঘর থেকে বিদায় করলেই শান্তি তোমাদের! দিয়ে দাও বিয়ে কিছু বলবো না আমি। মুর্খের হাতেই তুলে দাও, তবুও কিছু বলবো না। জন্ম দিয়েছো সেটাই বেশি!
এভাবে কথা বলতে দেখে নাজিয়া নাফিসাকে ধমক দিলো! নাফিসা কাদতে কাদতে পাশের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো এবং ব্যাগটা ঢিল মেরে ফেলে বালিশে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো। আর ওদিকে কষ্টে রুমানার বকাঝকা চলছেই!
প্রায় সপ্তাহ খানেক ছুটি কাটিয়ে নিয়াজ উদ্দিন আজ অফিস গিয়েছিলেন। আর বাসায় এসে দেখতে পেয়েছেন নাফিসা কাদছে। শুনেছে দুপুরে খায়ওনি সে। ঘটনা পুরোপুরি না শোনালেও তিনি বুঝতে পেরেছেন মেয়ের অভিমান কোথায়! কিন্তু আজ তিনিও যে নিরুপায়। ভাবনা যে তার পিছু ছাড়ছে না। তিনি হাতমুখ ধুয়ে নাফিসাকে ডাকলেন। আর যাই হোক, বাবার ডাক উপেক্ষা করতে পারে না কোনো মেয়ে। সে চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। গালেও দু একটা আঙুলের ছাপ বসে আছে। তা দেখে তিনি আবার রুমানাকে বলতে লাগলেন, “বয়স হওয়ার আগেই বুড়ি হয়ে গেছো তুমি! দিনদিন আক্কেল কমে যাচ্ছে তোমার! আম্মার গায়ে আবার হাত তোলে কেউ! কি করেছো মেরে মেরে! জরিমানা করা হবে তোমার!”
ওদিকে কাজ করতে করতে রুমানার বিড়বিড় চলছে, “এমন আদরামে মাথার স্ক্রু ঢিলা করে দিয়েছে। এজন্যই সন্তানদের অতি আদর দিতে নেই। লাঠির আগায় রাখতে হয় শুধু! এগুলা আদরের যোগ্য না!”
“হইছে, চুপ থাকো! তোমার বাবার মতো এমন লাঠির আগায় রাখলে আমার শান্তশিষ্ট মেয়েরা আজ তোমার মতো সারাদিন শুধু ঘ্যানঘ্যানই করতো!”
প্লেটে খাবার নিতে নিতে নাজিয়া মিটিমিটি হাসছে তার বাবামায়ের কথা শুনে। নিয়াজ উদ্দিন নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– পিচ্চি আম্মা, যাও তো। চোখে মুখে পানি দিয়ে এসো। তুমি একদিনেই ফুলে মোটা হয়ে গেছো! এবার খেয়ে একটু চিকন হওয়া দরকার।
– খাবো না আমি।
– আমার তো ক্ষুধা লাগছে! আম্মাজান না খেলে আমার ক্ষুধা মিটবে কি করে! তারাতাড়ি যাও।
– তুমি এখনো খাওনি! ওষুধ দিয়ে দেয়নি যাওয়ার সময়।
– হ্যাঁ, খেয়েছি। বাসায় আসতে আসতে আবার ক্ষুধা লেগে গেলো! তারাতাড়ি যাও, হাতমুখ ধুয়ে এলে আবার তোমার সাথে খাবো।
নাফিসার একটুও ইচ্ছে নেই খাওয়ার। কিন্তু তার বাবা এখন খাবে বলে সে যেতে বাধ্য। হাতমুখ ধোয়ার পর প্লেট হাতে নিয়েছে ঠিকই এমনকি খাবার মুখেও দিয়েছে কিন্তু ভাত তার গলা দিয়ে নামছে না। বারবার কান্না আসছে শুধু! নাজিয়া বললো, “আমি খায়িয়ে দিবো?”
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। টুপটাপ তার চোখ থেকে পানি ঝরছে। নাজিয়া হাত ধুয়ে তার পাশে বসে প্লেট নিতে চাইলো কিন্তু নাফিসা প্লেট দিলো না। সে বসেই আছে ওভাবে। নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– তোমাকে এখন বিয়ে দিবো না। আরাফকে বলবো যেনো তাদের নিষেধ করে দেয়। খাও এবার।
নাফিসা নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করতে চাইছে কিন্তু পারছে না! তবুও সে কাপানো কণ্ঠে বললো,
“আমি বিয়ে করবো। তবে বউ সাজবো না। কোনো লোক জানাতে পারবে না। ঘরোয়াভাবে বিয়ে হবে। কোনো অনুষ্ঠান হবে না, কাউকে দাওয়াত করতে পারবে না। আজকের পর থেকে তুমি অফিস যাবে না। অসুস্থ শরীর নিয়ে শুধু শুধু এতো পরিশ্রম করতে হবে না। চাকরি ছেড়ে দাও। খামারে যা আয় হবে তাতেই দিন চলবে। আর আজ কালের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দাও আমাকে।”
পেট ভরা থাকা সত্ত্বেও নিয়াজ উদ্দিন খেতে বসেছেন নাফিসার জন্য। অল্প খাবার নিয়েছে প্লেটে, অল্প অল্প মুখে দিয়ে হাত নাড়াচাড়া করছেন প্লেটে। নাফিসার মুখে এমন কথা শুনে নিয়াজ উদ্দিন থমকে গেলেন! হাতও চলছে না, মুখও চলছে না! নাজিয়াও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে। নাফিসা বা হাতে চোখ মুছে একবার তার বাবার দিকে তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি ভাবছো! এখন কি এতেও না করবে! আমার কোনো কথাই কি রাখবে না! সবসময় আমার উল্টো দিকেই থাকো সবাই! বিয়ে করতে হলে আমি এভাবেই করবো। আর ওই ভদ্রলোককেই করবো যার সাথে তোমরা ঠিক করেছো।
– ভাত খাও। বিয়ে দিব না তোমাকে।
– তাহলে আর আজীবনেও বিয়ের কথা তুলতে পারবে না। বুড়ি হয়েও তোমার বাড়িতেই পড়ে থাকবো। লোকের মুখে নানান কথা শুনবে, তবুও তখন আমাকে কিছু বলতে পারবে না।
– আচ্ছা।
– আচ্ছা মানে কি! দুপুরে মাইর খেতে হয়েছে রাজি নই বলে! আর এখন আমি রাজি তো তুমি বলছো বিয়েই দিবে না! বারবার কথা ঘুরাতে পারবে না। ভাবার সময় আজকেই শেষ। বউ সাজবো না, লোকে বিয়ের দাওয়াত পাবে না, চুপচাপ বিয়ে হবে আজ বা কালের মধ্যেই। তুমি কোনো চাকরিও করবে না। প্রয়োজনে আমি উপার্জন করে খাওয়াবো।
নাজিয়ার হাসিও পাচ্ছে খুব আবার রাগও হচ্ছে। কিন্তু কোনোই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না! চুপচাপ বসে আছে শুধু! নিয়াজ উদ্দিন বললো,
– আচ্ছা, খাওয়ার পর ভেবে দেখবো আমি। এখন খাও তুমি।
নাফিসা প্রতি লোকমার পরপর পানি মুখে দিয়ে ঢকঢক করে ভাত গিলে নিলো শুধু! নাজিয়া লক্ষ্য করে বারবার বলছিলো, “আস্ত ভাত গিলে নিলে পেট ব্যাথা করবে।”
কিন্তু নাফিসা সেদিকে ধ্যান না দিয়ে নিজের মতো করে প্লেট শূণ্য করে ফেললো। খাওয়া শেষে বাবার প্লেট সহ তার প্লেট নিয়ে চলে গেলো এবং ধুয়ে নিয়ে এলো।
ইমরানকে বলা কথাগুলো ইমরান আরাফকে জানিয়েছিলো। আর আরাফের কাছেই জেনেছে রুমানা বেগম। আজ সন্ধ্যায় আবার নাজিয়া আরাফকে জানিয়েছে বিকেলে বলা নাফিসার কথাসমূহ। তখন আরাফের পাশে ছিলো ইমরান। কিন্তু সেটা নাজিয়া জানতো না। আরাফও শুনে হাসছে নাজিয়াও তখন হাসতে হাসতে বলছিলো। নাফিসা নাজিয়ার হাসি শুনতে পেয়ে পেছন থেকে বললো,
“খুব মজা পাও তো সবাই আমাকে নিয়ে! এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে পুরো মহল্লায় জানিয়ে দেও!”
কথাটুকু বলে নাফিসা সেখান থেকে অন্য রুমে ফিরে এসেছে। বই সামনে নিয়েও রেখে দিলো। পড়াশোনা করে আর কি হবে! বিয়েই তো দিয়ে দিবে! আর লাগবে না পড়াশোনা। সে খামারে চলে গেলো। আর পড়া হলো না বই!
.
বাসর ঘরে বসে আছে নববধূ। নেই তার মাঝে কোনো সাজুগুজু! না আছে পড়নে লাল বেনারসি আর না আছে কোনো গহনাদি! আছে শুধুই সাধারণ সুতি সেলোয়ার-কামিজ! দোপাট্টার পরিবর্তে মাথায় ঘোমটা টেনে আছে সুতি ওড়নাটা। বিনা পুষ্পে সজ্জিত বিছানা। বিনা বাজনার বিয়ে বাড়ি। নেই কোনো সমাগম আর না আছে কোলাহল! আছে শুধুই নিরবতা আর বিষন্নতা! সকলের মুখ গম্ভীর ও ফোলা ফোলা! নববধুর চোখে বইছে এক রাশ জলধারা! যার নেই কোনো অন্ত আর না আছে মন শান্ত!
না সেজেছে বউ আর না সেজেছে বরণ ডালা! জাকজমাকপূর্ণ সাজের পরিবর্তে বোরকা হিজাব পড়ে গৃহে প্রবেশ করেছে গৃহ বধু। বারযাত্রী বলতে ছিলো শুধু বর ইমরান ও ভাসুর আরমান। গতকাল সন্ধ্যায় নাফিসার ইচ্ছে জানার পর ইমরান বাসায় এসে বলেছে। তার মা অমত পোষণ করলেও তার বড় মা তাকে বলেছে পছন্দ হলে আপাতত বিয়ে পড়িয়ে রাখতে। পরবর্তীতে আয়োজন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বউ ঘরে তুলতে। ইমরানেরও এ প্রস্তাবটি ভালো লেগেছে। ব্যক্তিগত ভাবে সে-ও এটাই ভাবছিলো। অত:পর আরাফকে দিয়ে নিয়াজ উদ্দিনের কাছে এই প্রস্তাবটা রেখেছে ইমরান। মেয়ের পাগলামো ও শর্তের কথা ভেবে নিয়াজ উদ্দিনও এই প্রস্তাবেই সম্মত হলেন। তাই আজ সন্ধ্যায় ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে ঠান্ডা মাথায় বাকি দুই মেয়ের ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের ন্যায় ছোট মেয়ের বিয়েতেও অনুষ্ঠান করবেন। তখন নাফিসাও নিশ্চয়ই আর এমন পাগলামো করবে না। সে শান্তভাবে ভাববে।
কিন্তু ঘটেছে ভিন্ন কিছু৷ বরপক্ষ গহনাপত্র না আনলেও শুধু শাড়ি আর একটা আংটি নিয়ে এসেছিলো। দুই বোন জোর করেও সন্ধ্যায় তাকে সেই শাড়ি পড়াতে পারলো না! সে বলেছে বউ সাজবে না তো সাজবেই না! শুধু পড়নের জামা পাল্টে নতুন সালোয়ারকামিজ পড়েছে! বিয়ে পড়ানোর পূর্বে সে বাবাকে বলেছিলো আর চাকরি করবে না তার বাবা। রেজিষ্ট্রেশন পেপারে সিগনেচারের আগেও বলেছে তার বাবা যেন চাকরি ছেড়ে দেয়। নিজের অসুস্থতার কথা ভেবে নিয়াজ উদ্দিন রাজি হয়েছে। বিয়ে পড়ানোর পর খাওয়াদাওয়া চললো, হুজুর ও কাজী বিদায় হলো। যখন জহিরুল ইসলাম ও আলফাজ সাহেবের পাশাপাশি ইমরান ও আরমানকে বিদায় দিতে যাবেন তখন নাফিসা প্রস্তুত শ্বশুর বাড়ি যাবে! বিয়ে হলে কনে শ্বশুর বাড়ি যায় তাহলে সে বাবার বাড়ি কেন থাকবে! এখন তার বরের সাথে সে-ও শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে! কথা বলে নিজেই গোছগাছ করতে শুরু করেছে! মা বোনের পক্ষে এই ক্ষেপানো পাগলীকে সামলানো দায় হয়ে পড়েছে! আর বাবা নিশ্চুপ এবং স্তব্ধ! সে বোরকা হিজাব পড়ে প্রস্তুত, আজ বিয়ে হয়েছে তো আজই বাবার বাড়ি ছাড়বে। ইমরান নতুন জামাই, সে কি বলবে এখানে ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু নাফিসার একঘেয়েমিতে আরমান বললো বউ সাথেই নিয়ে যাবে। আর ওভাবেই নববধূকে নিয়ে আসা হলো বাড়িতে!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৩
(নূর নাফিসা)
.
.
বোরকা হিজাব খুলে নাফিসা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে ঘরে। নিরবে শুধু চোখ থেকে পানি পড়ছে। ইমরানের বড় মা ও ছোট বোন, পরপর দুজন মানুষ এসে ঘুরে গেলো রুম থেকে। সে কারো দিকেই তাকায়নি। তারা এসে নিজেদের পরিচয় দিয়েছে। দু একটা কথা বলেছে। নাফিসা না দিয়েছে তাদের কোনো জবাব আর না শুনেছে তাদের কথা! তার ধ্যান অন্যদিকে ছিলো। কোনো প্রতিক্রিয়াই জানালো না কারো উক্তিতে। ধ্যান ভাঙলো ইমরানের ডাকে। ইমরান তার বাহু ধরে ঝাকিয়ে ডাকলো, “নাফিসা?”
পরক্ষণে নাফিসা মাথা তুলে ভেজা দুই নয়নে দেখতে পেলো ইমরানকে। কখন থেকে ডাকছিলো তার জানা নেই। তবে এখন নড়াচড়াতে সে শুনতে পেয়েছে। ইমরান ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে বললো,
– এভাবে আছো কেন? কখন থেকে ডাকছিলাম!
নাফিসা তার দুহাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলে ইমরান বাহু ছেড়ে দিলো। অত:পর বললো,
– খাবার কখন দিয়ে গেছে। খাওনি কেন?
নাফিসা পাশে রাখা টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো খাবারের প্লেট। কে, কখন রেখে গেছে সে বলতেই পারবে না কিছু! ইমরান আবার বললো,
– এসো আমার সাথে। হাতমুখ ধুবে।
নাফিসা নড়ছে না তার জায়গা থেকে। ধ্যান ভাঙলেও স্থীর হয়ে বসেই আছে।
– কি হলো, চলো…
ইমরান তাকে টেনে উঠানোর জন্য তার হাত ধরতে গেলে নাফিসা হাত সরিয়ে নিলো এবং দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে নিজেই উঠে দাড়ালো। ইমরান তার আগে যাচ্ছে আর সে পিছু পিছু। রুমের বামপাশেই বাথরুম। বাথরুমে এসে সে ফ্রেশ হয়ে নিলো। পাশাপাশি দুইটা রুমের মাঝে বাথরুম। নাফিসা বের হয়ে বাথরুমের বামপাশের রুমের দিকে চলে যাচ্ছিলো, কেননা তার সেই খেয়ালও নেই কোন রুম থেকে এসেছিলো। ইমরান ডানদিক থেকে বললো,
– ওদিকে না, এদিকে এসো।
নাফিসা পেছনে ফিরে ইমরানকে বিপরীত রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। অত:পর ওই রুমে চলে গেলো। ইমরান পিছু পিছু রুমে এসে নতুন তোয়ালে এগিয়ে দিলো কিন্তু নাফিসা সেটা না নিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে খুজে খুজে তোয়ালে বের করে হাত মুখ মুছে নিলো। ইমরান ব্লেজার খুলে রেখে টেবিলে রাখা খাবারের প্লেটের ঢাকনা সরিয়ে গ্লাসে পানি দিলো। ওদিকে খাটের এক কোনে গুটিসুটি মেরে নাফিসা কম্বল টেনে শুয়ে পড়েছে। ইমরান বললো,
– শুয়ে পড়লে কেন? খাবে না?
নাফিসার কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না! ইমরান তার কাছে এসে দাড়িয়ে বললো,
– ওবাড়িতে খেয়েছো তুমি?
এবারও কোনো জবাব নেই! নাফিসা চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে। ইমরান তাকে টানতে শুরু করলো,
“নাফিসা, ওঠো। খেয়ে নাও। না খেয়ে থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে। নাফিসা?”
এবার নাফিসা হাত ঝাড়ি দিয়ে উচ্চস্বরে বললো,
– চাইছেন কি আপনি! বিয়ে করতে চেয়েছেন এখন বিয়ে করে শান্ত হননি? নাকি এখন জুলুম করে মেরে ফেলে তারপর শান্তি পাবেন? তাহলে গলাটিপে একেবারে মেরে ফেলুন! আমিও মানুষ, আমারও সহ্য হয় না এতসব জুলুম আর জালাতন!
ইমরান তার হাত ছেড়ে দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে আছে। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে আছে। সে তার উপর কি জুলুম করলো সেটাই ভেবে পাচ্ছে না! সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত সব তো এই মেয়ের ইচ্ছাতেই হলো, তবুও সে এমন করছে কেন! সে বিয়ে করেছে বলেই কি তার দোষ হয়ে গেছে!
এদিকে ইমরানকে ঝাড়ি দিয়ে নাফিসা আবার চোখ বন্ধ করে শান্তভাবে শুয়ে আছে। বন্ধ চোখ থেকেও টুপটাপ অশ্রুবিন্দুর পতন ঘটছে। ইমরান তাকে আর কিছু না বলে খাবারের প্লেট নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। নাফিসার দৃষ্টি এবং মস্তিষ্ক এখন সম্পূর্ণ সজাগ! ভাবতেও পারেনি সে আজ এই অবস্থানে থাকবে! খুব কাদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু পারছে না সে কাদতে! নিজেকে শান্তও করতে পারছে না। হঠাৎ বাইরে ইমরানের গলা শুনতে পেলো। সাথে একটি মেয়েলি গলাও। সে চোখ মুছে নিলো আবার। দু মিনিট পর দরজা খোলার শব্দে সে মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। ইমরান রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে। ইমরান কি এখন তার কাছে আসবে! যদি তার কাছে আসে, জোর জবরদস্তি করে তাহলে মরে যাবে সে! কিন্তু মৃত্যুই যদি না থাকে তাহলে মরবে কি করে! ভয়ের পাশাপাশি এখন নিজের উপর প্রচুর রাগও হচ্ছে! বিয়ে হয়েছিলো তো হয়েছিলোই! সে জেদ করে এ বাড়িতে চলে এলো কেন! নাফিসা দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে কম্বল টেনে কাচুমাচু হয়ে গেছে! ইমরান খাটে বসে বললো,
– এক কম্বল কি তোমার একাই লাগে! আমার এখানে একাধিক কম্বল নেই! একটু যদি মানবদরদী হয়ে থাকো তাহলে আমার উপরও মেহেরবানী হও।
তার কথায় নাফিসা চোখ খুলে নিজের দিকে তাকালো আবার পেছনের দিকে তাকালো। ভয়ে এবং নিজেকে রক্ষার্থে কখন যে পুরো কম্বলের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তার খেয়ালই নেই! সে ইমরানের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইমরান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নাফিসা তার শরীর থেকে এবার পুরো কম্বল সরিয়ে ইমরানের দিকে দিয়ে দিলো। এবং ওড়না দ্বারা যতটুকু সম্ভব নিজেকে জড়িয়ে নিলো। ইমরান কম্বল ছড়িয়ে নাফিসার উপর দিয়ে বালিশটা একটু টেনে বললো,
– এতো কিনারায় শুয়েছো কেন! পড়ে যাবে তো!
নাফিসা রেগে পেছনে ফিরে বললো,
– আপনার সমস্যা!
– আমার বউ পড়ে যাবে, তো আমার সমস্যা হবে না!
– আমি আপনার বউ না।
– নিজের ইচ্ছাতেই এমন অপ্রত্যাশিত বিয়ে করে আমার ঘরে চলে এলে অথচ এখন বলছো তুমি আমার বউ না!
নাফিসা আর কিছু না বলে বালিশ টেনে আবার আগের জায়গায় নিয়ে গেলো। ইমরান আর কিছু বললো না। দুজন দুইপ্রান্তে শুয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ সজাগ থেকে ইমরান ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝ রাতে আবার ঘুম ভেঙে গেলো তার৷ কানে ভেসে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ। চোখ খুলে তাকিয়ে বুঝতে পারলো নাফিসা ফুপিয়ে কাদছে এখনো! ইমরানের এবার প্রচুর রাগ হলো তবুও তেমনটা প্রকাশ করলো না। সে নাফিসার বালিশ টেনে খাটের মাঝামাঝিতে এনে নাফিসাকেও টেনে বালিশে নিয়ে এলো। নাফিসা তার দিকে তাকাতেই দেখলো চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে! চোখের ধারে পানি পড়ে কালচে ছাপ বসে গেছে! নাফিসা সরে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। ইমরান তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
– সমস্যা কি তোমার? এতো কাদছো কেন! আজ যা হয়েছে সব তোমার ইচ্ছাতেই হয়েছে। তবুও এমন করছো কেন!
– এটাও আমার ইচ্ছা, ছাড়ুন।
– সব ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়া যাবে না। কেদে কেদে দুর্বল হয়ে মরে গেলে তখন আমাকে জেলের ঘানি টানতে হবে এইজন্য যে, বিয়ের প্রথম রাতেই বউ মেরে ফেলেছি আমি!
অন্যসময় এমন কথা শুনলে হয়তো হাসতে হাসতে বিষম খেতো নাফিসা কিন্তু আজ তার মুখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই! বড্ড অসহ্য লাগছে তার! ইমরান কম্বলের উপর দিয়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছে। যার ফলে নাফিসা নিজেকে ছুটাতে পারছে না। এতোটা জোরাজোরির শক্তিও যেন পাচ্ছে না। দুর্বল লাগছে তার নিজের কাছেই! কাদতে কাদতে ক্লান্ত সে!
বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখলো নাফিসার চোখ বন্ধ এবং শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক। ইমরান বুঝতে পারলো সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার তার ভেতরও একটু শান্তি লাগছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে নাফিসা! বালিশ পিঠের নিচে রেখে সে চুপচাপ বসে আছে। চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুমটাকে দেখলো। বারো ফিট অথবা চৌদ্দ ফিট বর্গাকৃতির রুম। আসবাবপত্র বলতে, একটা খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি, একটা বুক সেল্ফ আর দুইটা চেয়ার ও একটা টি টেবিল আছে রুমে। বিছানা বাদে আপাতত গুছানোই সবকিছু। দরজা চাপিয়ে রাখা হয়েছে। ইমরান রুমে এসে নাফিসাকে বসে থাকতে দেখে হাতের নতুন টুথ ব্রাশটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ব্রাশ নিয়ে বাথরুমে যাও। ফ্রেশ হয়ে এসো।
নাফিসা ব্রাশ হাতে নিয়ে প্যাকেট ছাড়াতে ছাড়াতে বাথরুমে যাওয়ার জন্য বের হতে লাগলে পেছন থেকে ইমরান বললো,
– বাথরুম চেনো তো? রুমের বামদিকে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আবার রুম ডানদিকে।
নাফিসার এখন কথা বলার মুড নেই তাই পালটা জবাব দিলো না! ভাবে টা কি, রাতে একটু ভুল হয়েছে দেখে এখন দিনের এই আলোতে কি বুঝা যাবে না কোনটা বাথরুম আর কোনটা বসবাসযোগ্য রুম!
নাফিসা রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলো লম্বাটে বারান্দা আছে রুমের সামনে। গ্রিল দ্বারা সম্পূর্ণ বারান্দা আবদ্ধ। এটা টিন শেড বিল্ডিং। দুইটা রুম আর মাঝে একটা বাথরুম। আর এর সামনের দিকটা পুরোটাই বারান্দা। রাতে যখন গেইট ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছিলো তখন মনে হয়েছিলো কোন বহুতল ভবনে বুঝি প্রবেশ করছে। কিন্তু তা নয়। এই ঘরটার সামনে ফাঁকা উঠুন। তার বিপরীতে আবার একটা একতলা ভবন দেখা যাচ্ছে। তাদেরই হবে হয়তো। নতুবা মা, ভাই, বোন এই দুই রুমে আবার থাকে কিভাবে! সকালের পরিবেশটা ভালোই দেখা যাচ্ছে তবে জনমানব শূন্য। নাফিসা বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই পাশের রুম থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। নাফিসাকে দেখে হাসিমুখে মেয়েটি বললো,
– গুড মর্নিং, ভাবি।
কুশলাদি জানাতে নাফিসাও ঠোঁটের কোনায় জোরপূর্বক মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
– গুড মর্নিং।
মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– চেনো আমাকে?
নাফিসা চিনতে না পেরে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে তাই মেয়েটিই বললো,
– আমি নিশাত। তোমার পিচ্চি ননদ। প্রথমে বড় ভাইয়া আরমান, তারপর ছোট ভাইয়া ইমরান আর অবশেষে আমি নিশাত।
– ওহ্! কিসে পড় তুমি?
– এইচএসসি এক্সামিনার। তুমি তো মেবি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের?
– হ্যাঁ।
– তোমার রুমের পাশেই এটা আমার রুম। এসো আমার রুমে…
– না, পরে যাবো। মুখ মুছতে হবে। মুখেই পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
– আচ্ছা। যাও।
নাফিসা ধীর পায়ে রুমের দিকে এগোতে এগোতে নিশাত বারান্দার গেইট খুলে উঠুনে বেরিয়ে বিপরীত ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নাফিসা দাড়িয়ে রইলো বারান্দায়। নিশাত ওই ঘরের গেইট খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই নাফিসা তার রুমে চলে এলো। ওটা তাদের ঘর কি-না দেখার জন্যই নাফিসা এতোক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো। এবার সে নিশ্চিত। তবে ওই ঘর ছেড়ে দুই ভাইবোন আবার এই ঘরে কেন সেটাই এক মুহুর্তের জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছিলো। কেননা সেটা দেখতে প্রায় বড়সড় ঘর। এমন একটা ভবনে মিনিমাম চারটা রুম তো থাকারই কথা। তাদের পরিবারের সদস্য বেশি হলেও তো ওটা দোতলা করতে পারতো। এখানে এমন আলাদা টিন শেডের কি প্রয়োজন ছিলো! তা-ও ওটার তুলনায় এটা নতুনই মনে হচ্ছে।

চলবে।