“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৪
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসা রুমে এসে দেখলো ইমরান বিছানাপত্র গুছিয়ে ফেলেছে। সে চুপচাপ মুখ মুছে খাটে বসে রইলো। মাথা যেন ঝিম ধরে আছে! ইমরান বললো,
– এভাবে আছো কেন। এখানে প্রসাদন সামগ্রী কিছু আছে। ইউজ করতে পারো। তা না হলে পাশের রুমে চলো, সেখানে সব পাবে।
– প্রয়োজন নেই। আমি অন্যের জিনিস ইউজ করি না৷
– তোমার জন্য আলাদা আনতেও তো সময় লাগবে। আপাতত ওটা ইউজ করো।
– না।
– আচ্ছা, তাহলে মাথাটা অন্তত আঁচড়ে রাখো। কেউ দেখতে এলে কি ভাববে!
– খবরদার কোনো লোক যদি আসছে দেখতে!
– নতুন বউ বাড়ি এলে তো আশেপাশের সবাই আসবেই!
– দরজা লাগিয়ে রাখুন। তাহলেই হবে।
ইমরান দুষ্টুমির সাথে বললো,
– ইশ! দুজন বন্দী হয়ে সারাদিন দরজা লাগিয়ে রাখলে লোকে কি বলবে, বলোতো!
– আপনাকে কে বলেছে থাকতে! বের হোন!
ইমরান, হাসতে হাসতে বললো,
– আচ্ছা, যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে আবার ডাকবে না তো?
এমনিতেই মাথা ব্যাথা, তারউপর আবার এই লোকের মস্করা! বড্ড অসহ্যকর! ইমরান জানালা খুলে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। নাফিসা বললো,
– মাথা ব্যাথার জন্য কোনটা ওষুধ আছে?
ইমরান পেছনে ফিরে বললো,
– মাথা ব্যাথা করছে?
– করছে বলেই তো চাইছি!
– আসছি আমি।
তিন চার মিনিট পর ইমরান এলো। সাথে এক মধ্যবয়সী মহিলা। প্রায় বৃদ্ধের কাতারে পা রাখছে। ইমরান বললো,
– উনি আমার বড় মা।
নাফিসা সালাম দিলো। মহিলাটি সালামের জবাব দিয়ে ইমরানের উদ্দেশ্যে বললো,
– পরিচিত হয়েছি রাতেই।
এদিকে নাফিসার মনোক্তি, “কখন পরিচিত হলেন! আমি তো এইমাত্র দেখলাম আপনাকে!”
মহিলাটি নাফিসার কাছে বসে বললো,
– শুনেছি, বউ মা নাকি খুব জেদি! বাবা মায়ের সাথে আবার রাগ করে কেউ। সবসময় বাবামায়ের মতামতে সহমত হওয়া উচিত। পিতামাতা সন্তানের ভালোর জন্যই করে সবকিছু। আর যদি ভুল ধরা পড়ে তবে বুঝিয়ে বলবে। এই ভুলের উপরও যদি যুক্তি থাকে তবে সেটা ভেবে দেখা উচিত। জেদ নিয়ে বিপক্ষে লড়া উচিত না। তোমার মাথা নাকি ব্যাথা করছে। দেখি।
– আমার কাছে দিন। আমি লাগিয়ে নিব।
– মায়ের হাতে জাদু আছে। আমি লাগালে তারাতাড়ি ব্যাথা উধাও হয়ে যাবে।
কথা বলতে বলতে বড় মা মলম হাতে নিয়ে কপালের দুপাশে মেসাজ করতে লাগলো। ইমরান বেরিয়ে গেছে। তিনি নাফিসার পরিবার সমন্ধে জিজ্ঞাসা করে জানতে লাগলেন। একটু পরেই আবার ইমরান এলো ফোন নিয়ে। নাজিয়া কল করেছে কথা বলার জন্য। বড় মা নাজিয়ার সাথে একটু কথা বলে চলে গেছে। নাফিসা ইমরানের কাছ থেকে ফোন হাতে নিলো না। সে বলে দিলো কথা বলবে না। ইমরান লাউড স্পিকারে রেখে দিলো৷ ওপাশ থেকে কথা বলছে, কিন্তু নাফিসা চুপ। নাজিয়া তার বাবা মায়ের কথা বললো তবুও সে কথা বলবে না। তাকে নিতে আসবে সেটা বলতেই নাফিসা বললো, “কেউ আসবে না আমার শ্বশুর বাড়ি। আমি বাড়ি যাবো না তোমাদের সাথে।” এটুকু বলেই সে নিজেই কল কেটে দিলো এবং ইমরানকে বললো,
– আরেকবার যদি আমার কাছে ফোন নিয়ে আসেন, আপনার ফোন টুকরো টুকরো করে ফেলবো বলে দিলাম!
– আচ্ছা, এমন করছো কেন তুমি? তুমি কারো সাথেই ভালোভাবে কথা বলছো না! কি চাইছো সেটা ক্লিয়ার বলো আমাদের!
– কিচ্ছু না, আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। আর কিচ্ছু চাই না আমি। সবার কথা অসহ্য লাগে আমার! কেউ আমার সাথে কোনো কথা বলবেন না।
নাফিসা আবারও কাদতে লাগলো! ইমরানের ফোনে আবার কল আসছে। ইমরান রিসিভ করে বেরিয়ে গেলো। সারাদিন ঘরে বন্দী ছিলো নাফিসা। খাবার রুমে এনে দিয়েছে ইমরান। খেতে চাইছিলো না। অত:পর বড় মা এসে বুঝিয়ে খাওয়ালেন। ছুটির দিন হওয়ায় ইমরান আজ বাসায়ই ছিলো। যখনই নাফিসা একা থাকে রুমে, তখনই সে কাদে! ইমরান তাই নিশাতকে পাশে থাকতে বলেছিলো। একটু পরপর নিশাতেরই আগমন রুমে আর টুকটাক কথাবার্তা। বিকেলে আরাফ এসেছিলো। নাফিসার সাথে কথা বললো কিন্তু কোনো জবাব পেলো না! আরাফ নিশ্চিত, সবচেয়ে বেশি রেগে আছে তার উপর। ইমরান আরাফকে বলে দিলো, আরও দু-চার দিন থাকুক এখানে। তাকে বিরক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই। ইচ্ছে হলে সে নিজেই যেতে চাইবে। জেদ নিয়ে তো একজন মানুষ আর একা বসবাস করতে পারবে না।
সারাদিন কেটে গেলো বিরতি নিয়ে কেদে কেদে! আশেপাশের বাড়ি থেকে কোনো মানুষ আসেনি তাকে দেখতে। হয়তো জানেই না তারা! এমনকি বড় মা, ইমরান আর নিশাত ছাড়াও আর কেউ আসেনি তার রুমে। নাফিসা বাথরুমে যাওয়ার সময় একবার সেই ভাবিটাকে দেখেছিলো। উঠুনে বাচ্চার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে খাবার নিয়ে।
বিয়ের দ্বিতীয় দিন কেটে আজ তার তৃতীয় দিন। আজ এসেছে জেরিন এই ঘরে। ইমরান এই মাত্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে এর দুমিনিট পরই জেরিনের আগমন ঘটেছে। ঘরে প্রবেশ করে দেখলো নাফিসা বিছানাপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। সে বললো,
– নতুন বউ বাইরে বের হও না কেন? বিনা আয়োজনে বাড়িতে আসতে লজ্জা লাগেনি আর এখন ঘর থেকে বের হতে এতো লজ্জা! প্রতিদিন কি তোমার খাবার এইঘরে এনেই দিয়ে যেতে হবে আমাদের!
– এক্সিউজমি, আমি কাউকে খাবার নিয়ে আসতে বলিনি। আর কারো মুখে অতিরিক্ত কথাও শুনতে পারি না। আমার সাথে কথা কম বলবেন।
– বারে! দুদিন না হতেই চাপা! বাকি দিন টিকবে কি করে!
– সেই চিন্তা আপনার না করলেও চলবে।
এমনি নিশাত এলো রুমে।
– আপু, জিহান ডাকছে তোমাকে। ভাবি, তুমিও চলো ওই ঘরে।
জেরিন বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– না, থাক। বের হতে বলিস না তাকে! ঘর থেকে বের হলে ঠোসা পড়বে! হুহ্!
ভেঙচি কেটে চলে গেলো জেরিন। নিশাত বললো,
– ভাবি তুমি চলো ওই ঘরে। একসাথে নাস্তা করি।
– না, আমি নাস্তা করবো না এখন। তুমি যাও।
– আরে এসো তো। বাড়িঘর ঘুরেও তো দেখবে একটু। এক ঘরে সারাদিন বসে থাকতে কি ভালো লাগে কারো। এসো।
নিশাত হাত ধরে টানতে লাগলে নাফিসা বললো,
– দাড়াও, চুল বেধে নেই।
– ওকে, তারাতাড়ি করো।
– ও তোমার বড় ভাবি হয় না?
– হ্যাঁ।
– তাহলে আপু বললে যে?
– সম্পর্কে আমার মামাতো বোনও হয়। আগে থেকে আপু বলি তাই এখনো আপু ই বলি।
– আপন মামাতো বোন?
– হ্যাঁ। আমার একমাত্র মামার দুইমাত্র মেয়ে।
নাফিসা মৃদু হেসে বললো,
– ভাবিরা দুই বোন?
– হুম।
– লাভ ম্যারেজ ছিলো ভাবির?
– না, এরেঞ্জই।
– ওহ্, চলো।
মাথায় ঘোমটা টেনে রুমের দরজা লাগিয়ে নাফিসা তাদের অন্যঘরে এলো। নিশাত তাকে নিয়ে প্রথমেই এলো কিচেনে৷ সামনের দিকটায় একটা ডাইনিং টেবিল পেছনের দিকটায় রান্নাবান্নার সামগ্রী। বড় মার সাথে আরও একজন মহিলা আছে কিচেনে। রান্না শেষ হয়ে গেছে। আসবাব গুছিয়ে রাখছে আর বড় মা ডাইনিং টেবিলের দিকে খাবারের বাটি নিয়ে যাচ্ছে। নিশাত বললো,
– উনি আমার মা। মানে তোমার শ্বাশুড়ি আম্মা।
নাফিসা সালাম দিলো। মহিলাটি এক পলক তাকিয়ে সালামের জবাব দিলো। কিন্তু অন্য কোনো কথা বললো না। মুখ যেন আয়েশা বেগমের মতো ফোলা ফোলা! চেহারাও দেখতে অনেকটা একইরকম! এছাড়া চেহারায় বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট! হতেই পারে ছেলের বিয়েতে ইনিও সন্তুষ্ট না। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা করলো না নাফিসা। নিশাত তাকে পুরো ঘর ঘুরে দেখানোর জন্য নিয়ে গেলো। চারটা রুমের মাঝে একটা ড্রয়িং রুম যেখানে সোফা সেটের সাথে খাট পাতানো আছে। একটা আরমানের রুম, একটা মায়ের রুম আর একটা বড় মায়ের রুম। গোসল সেড়ে ইমরান রেডি হয়ে এ ঘরে এসেছে। বড় মা নাফিসাকে ডাকলেন খাওয়ার জন্য। আরমান তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। বসো।
আরমান চেয়ার টেনে বসলো। নিশাতও বসেছে। নাফিসার ইচ্ছে করছে না তবুও বসতে হলো বড় মা ও নিশাতের জোরাজোরিতে। ইমরান জিহানকে কোলে নিয়ে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে আর জেরিন প্লেটে খাবার বেড়ে ইমরানের হাতে তুলে দিলে ইমরান খাবার নিয়ে চলে গেলো ড্রয়িং রুমে। নাফিসা বুঝতে পারলো না কিছু! সবাই টেবিলে আর সে অন্য রুমে চলে গেলো কেন! দেখে তো মনেও হচ্ছে না কারো সাথে ঝগড়াঝাটি আছে! সবার সাথেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলছে। তাহলে সে আলাদাভাবে চলে গেলো কেন! থাকেও আলাদ আবার খায়ও আলাদা! এখানে সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে ইমরানে মাকে “আবিদা” নামে ডেকে খেতে বসতে বললেন বড় মা ও নিজে প্লেট নিয়ে চলে গেলেন ইমরানের সাথে! জেরিন টেবিলে এটা সেটা এগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও পানির গ্লাস, আলাদা বাটিতে ডাল নিয়ে আসছে আর যাচ্ছে ইমরানের কাছে। বড় মা সেখানে চলে গেলে সে-ও বসে পড়লো তাদের সাথে ডাইনিং টেবিলে। নাফিসা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য করছে আরমানের কোলে বসে থাকা জিহান, নাফিসার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নাফিসা তার দিকে তাকালে জিহান নিচের দিকে তাকায় আবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নাফিসা তাকে দেখছে কিনা! যখনই নাফিসা তার দিকে তাকাচ্ছে তখনই সে দৃষ্টি নামিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছে আর আড়চোখে আবার নাফিসাকে দেখছে! নাফিসার মজা লাগছে জিহানের সাথে এভাবে দৃষ্টিতে খেলতে। তাদের আগেই ইমরান খাওয়া শেষ করে কিচেনে প্লেট রেখে গেছে। নাফিসার খাওয়া শেষ হতেই সে-ও কিচেনে গিয়ে নিজের প্লেট নিজে ধুয়ে মিটসেফে রেখে দিলো। অত:পর একা একাই নিজের রুমে চলে এলো। ইমরান মাথা আঁচড়ে কোথাও যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি। নাফিসাকে রুমে আসতে দেখে ইমরান বললো,
– অফিস যাচ্ছি আমি। নিশাতও কলেজে যাবে। সুতরাং এখানে তুমি একা। ভালো না লাগলে এই ঘর লক করে ওই ঘরে চলে যেও। মা ও বড় মা’র সাথে সময় ভালো কাটবে। আর পার্সোনালি তোমার কি কি লাগবে লিস্ট করে দাও। আসার সময় নিয়ে আসবো।
– ঘোড়ার ডিম লাগবে। আশা করি এবার খুঁজে নিয়ে আসবেন।
হঠাৎ তার মুখে এমন কথা শুনে ইমরান হতবাক! সে মজাটা আরও বাড়িয়ে দিতে বললো,
– এতোবড় ডিম তুমি খেতে পারবে!
– আমি খাবো না। আপনাকে খাওয়ানোর জন্য আনতে বলেছি।
– যাক, তা-ও তো বউয়ের হাতের রান্না খেতে পারবো! এবার বলো জামা, জুতো, স্নো, পাউডার, কসমেটিকস জাতীয় কি কি লাগবে?
নাফিসা মুখে বিরক্তিকর ছাপ এনে চুপচাপ আবার শুয়ে পড়ার ব্যবস্থা করছে। ইমরান তার কাছে এসে হাত টেনে দাড় করিয়ে বললো,
– শুধু শুধু এমন রেগে আছো কেন! রেগে থাকলে তো তোমারই লস।
– তাতে আপনার কি! হাত ছাড়ুন।
হঠাৎ করেই ইমরান তার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে মুখে দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে বললো,
– এখন আমারই তো সব! আল্লাহ হাফেজ।
দরজার কাছে গিয়ে আবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা রেগে ঠোঁটে আঙুল ঘষে যাচ্ছে! তাই বললো,
– আরে আস্তে! এমন করলে তো ঠোঁট কাটা বউ হয়ে যাবে!
নাফিসা রেগে বালিশটা নিয়েই ঢিল দিতে যাচ্ছিলো! ইমরান হেসে দ্রুত চলে গেলো। তাকে মারতে না পেরে নিজের মুখেই বালিশ দিয়ে একটা মারলো নাফিসা!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৫
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে নাস্তার পর যে ঘুমিয়েছে সেই ঘুম ভেঙেছে দুপুরে বড় মা’র ডাকে! নাফিসা ঘুমঘুম চোখে তাকাতেই তিনি বললেন,
– নাফিসা, গোসল করবি না? ওঠ।
চোখ ডলতে ডলতে নাফিসা উঠে বসলো। দুদিন যাবত এক ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে শরীরে যেন অলসতা নেমে এসেছে। কিন্তু এছাড়া তার আর করনীয়ই বা কি!
সে গোসল সেড়ে নামাজ পড়ে নিলো। বড়মা ডাকলো খাওয়ার জন্য। খাওয়ার জন্য এতো ডাকাডাকি করে সেটাও ভালো লাগে না তার! অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে গেলো ওই ঘরে। দুই বছরের পিচ্ছিটা দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করছিলো। নাফিসাকে দেখে আবার সে থেমে গেলো। নাফিসা হাত বাড়িয়ে বললো,
– এসো, জিহান।
জিহান দৌড়ে বড়মার পেছনে লুকিয়ে গেলো! বড়মা বললো,
– ভয় পাও কেন দাদু? সে তোমার চাচী হয়।
নাফিসা আবারও হাত বাড়ালো কিন্তু জিহান দৌড়ে চলে গেলো। বিকেলে ইমরান ফিরেছে সাথে স্নো, পাউডার, লোশন, ফেসওয়াশ নিয়ে। প্যাকেট নাফিসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– ঘোড়ার ডিম খুজে খুজে পেলাম না। তাছাড়া আর কিছু বলনি তবুও নিয়ে এলাম এগুলো। আরও কিছু প্রয়োজন হলে বলতে পারো। দুপুরে খেয়েছো?
নাফিসা কোনো জবাব না দেওয়ায় ইমরান বললো,
– চতুর দেখে বিয়ে করলাম আর এখন এতো চুপচাপ কেন তুমি! নিজেই নিজের ক্ষতি করলে সবচেয়ে বেশি বোকামি করবে।
সন্ধ্যা থেকে বাকিটুকু সময় ইমরান ঘরেই ছিলো। রাতে নিজের খাবার সহ নাফিসার খাবার এনেছে। ইচ্ছে করছিলো না খেতে বরাবরই তাকে জোর জবরদস্তি করে খাওয়ানো হয়। চতুর্থ দিন নাফিসা বোরকা পড়ে রেডি হচ্ছে। ইমরান নাস্তা করার জন্য ডাকতে এসেছিলো, তাকে হিজাব পড়তে দেখে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো তুমি?
– যেদিকে দুচোখ যায়।
এমন অপ্রত্যাশিত জবাবে ইমরান বিরক্ত হলো। গতদিন গুলোতে সে কারো সাথেই ভালো ব্যবহার করছে না। যা দেখে ইমরান অসন্তুষ্ট। সে আবার বললো,
– বাসায় যাবে তুমি?
– না।
– তাহলে?
– বললাম না, দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে।
– দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে যেতে পারবে না। বোরকা খুলো আর নাস্তা করবে, চলো।
– আমি এখন নাস্তা করবো না। আমার তাড়া আছে।
– ভার্সিটিতে যাবে? তাহলে আমি যাওয়ার সময় নামিয়ে দিয়ে যাবো। এখন নাস্তা করবে চলো।
– একবার বললে আপনি শুনতে পান না! বারবার কেন বলতে হয়! আমি নাস্তা করবো না তো করবোই না।
– করবে। তা না হলে কোথাও যেতে পারবে না।
– এখন কি আপনি আমাকে ঘরে বন্দী করে রাখতে চাইছে! বিয়ে করেছেন বলে সব শুধু আপনার কথায়ই চলবে!
– এ পর্যন্ত আমার কথায় কিছুই চলেনি। সব তোমার কথায়ই চলছে।
– তাহলে এখন বাধা দিচ্ছেন কেন?
– যেটা একদমই ঠিক না সেটা কিভাবে চলতে দেওয়া যায়। কোথায় যাচ্ছো সেটাও বলছো না, খেতে যেতে বলছি তা-ও যাচ্ছো না। এভাবে তো স্বাধীনতা দেওয়া যায় না।
হিজাব পড়া শেষ হতেই নাফিসা চুপচাপ বেরিয়ে যাচ্ছিলো। ইমরান তার হাত ধরে বললো,
– এভাবে কোথাও যেতে পারবে না তুমি।
– একশো বার যাবো। হাত ছাড়ুন।
– উল্টাপাল্টা বলে রাগিয়ে দিও না। খাটে গিয়ে চুপচাপ বসো, আমি খাবার এখানে নিয়ে আসছি।
– বসবো না। কি করবেন আপনি?
– দেখবে তুমি কি করতে পারি আমি?
কথাটা বলেই ইমরান তাকে ধাক্কা দিয়ে খাটে ফেলে দিলো এবং বললো,
– ঘর থেকে এক পা ও বাইরে বের হতে পারবে না আমার অনুমতি ছাড়া। একটা কথাও বলতে পারবে না আমার কথার বাইরে! অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না সেটা নিশ্চয়ই তোমারও অজানা নয়। পাগলামো অনেক করেছো গত তিনদিনে! এখন থেকে তোমার ইচ্ছে মোটেও কার্যকর হবে না।
ইমরান বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে গেলো! নাফিসা কান্না করতে করতে খাট ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়লো! জীবনটাকেই অসহ্যকর মন হচ্ছে তার কাছে! ইমরান এক প্লেট খাবার নিয়ে এসে দেখলো পানির জগ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে মেঝেতে। আর পানিতে ভেসে আছে মেঝে! ইমরান টেবিলে প্লেট রেখে বললো,
– জগ ভাঙলে কেন?
কান্নার সাথেই নাফিসা জেদ নিয়ে জবাব দিলো।
– ইচ্ছে হয়েছে ভেঙেছি। কৈফিয়ত দিতে হবে আপনাকে!
সাথে সাথেই তার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় পড়লো! নাফিসা হতবাক হয়ে গালে হাত রেখে বসে আছে! ইমরান দাতে দাত চেপে বললো,
– এতো জেদ কেন শরীরে! ওঠাও এগুলো। ওঠাও! ইমরানের ধমকে একহাত গালে রেখেই ঠোঁট কামড়ে ধরে কাদতে কাদতে নাফিসা ভাঙা কাচগুলো বড় কাচের টুকরোর মধ্যে রাখতে লাগলো। তোলা শেষ হলে ইমরান সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো এবং নিশাতের রুম থেকে পানির জগ এনে দিয়ে বললো,
– প্লেটের একটা ভাতও যেন নষ্ট না হয়। চুপচাপ খাওয়া শেষ করো। ঘরের বাইরে এক কদম রাখাও তোমার বন্ধ! কারো সাথে কোনো সাক্ষাতের প্রয়োজন নেই। এক ঘরে বন্দী থাকো।
ড্রয়ার থেকে তালা নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইমরান। দরজা চাপিয়ে সে বারান্দার গেইট তালা দিয়ে চলে গেলো। আর এদিকে নাফিসা কেদেই চলেছে। হিজাবের পিন খুলে সে ছুড়ে মারছে এদিক সেদিক! হিজাবটাও খুলে ঢিল মেরে অন্যদিকে ফেলে দিলো।
ওদিকে নাফিসার গায়ে হাত তুলে ইমরানেরও খারাপ লাগছে। কিন্তু তখন যে রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনি! সে সকালে নাস্তা না করেই চলে গেছে। বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর যখন বার্থডে উইশ করার জন্য নাজিয়া কল করেছিলো তখন ইমরানের ভেতরটা আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছিলো! সে তো জানতোই না আজ তার জন্মদিন! এমন একটা দিনেই তাকে হাত তুলতে হলো! দুপুরের দিকে ইমরান ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। আসার সময় নাফিসার জন্য কেক নিয়ে এসেছে সাথে। তালা ঝুলছে গেইটে। ইমরান তালা খুলে ভেতরে এসে দেখলো বোরকা পড়নে থেকেই অগোছালোভাবে নাফিসা খাটে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো এই অবস্থা দেখে! সে দরজা লাগিয়ে কেক টেবিলে রাখতে গেলে দেখলো খাবার যেমন রেখে গেছে ঠিক তেমনই আছে! সে নাফিসার কাছে বসে মাথা ঝাকিয়ে ডাকলো। কাদতে কাদতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ইমরানের ডাকে ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই ইমরান বললো,
– এখনে এভাবে বসে আছো কেন! ওঠো।
নাফিসা তার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো। ইমরান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে চারটা আঙুলের ছাপ বসে আছে গালে! সে গাল স্পর্শ করে বললো,
– সরি।
নাফিসা এবারও হাত সরিয়ে দিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে উঠে দাড়ালো। ইমরানও উঠে দাড়িয়ে নাফিসার কাছে এসে চোখের ধার মুছে দিলো। নাফিসার জোরাজোরি সত্বেও সে দু’হাতে মুখখানা ধরে থাপ্পড় দেওয়া গালে আলতো চুমু একে বললো, “হ্যাপি বার্থডে।”
নাফিসা তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বললো,
– কচুর বার্থডে! কার বার্থডে আর কিসের হ্যাপি বার্থডে? পুরো লাইফটাকে হেল করে দিয়ে এখন হ্যাপি বার্থডে উইশ করা হচ্ছে! যেই বার্থডে তে সারাদিন এভাবে ঘরে বন্দী করে রাখা হয় সেই বার্থডে হ্যাপি হয় কি করে! যেই বার্থডে তে বিনা কারণে থাপ্পড় খেতে হয় সেই বার্থডে হ্যাপি হয় কি করে! জগটা কি আমি ইচ্ছে করে ফেলেছিলাম! যার কারনে আমাকে থাপ্পড় খেতে হলো! আপনার হাতে নাড়া লেগে কিছু পড়েনি আজ পর্যন্ত! ভাঙেনি কিছু হাত থেকে পড়ে!
– তুমি তো তখন বলনি সেটা! তাছাড়া অতি জেদ করছিলে তাই রেগে গিয়েছিলাম।
– তো এখন আসছেন কেন এতো আদিক্ষেতা দেখাতে!
– সরি, ফর দ্যাট।
– সরি মাই ফুট! সরি বললেই সব ঠিক হয়ে গেলো! সরি বললেই সেই থাপ্পড় মুছে গেলো! আমার লাইফে সবচেয়ে ঘৃণিত পাত্র আপনি! জানেন সেটা? আর অতি অল্প সময়েই জঘন্য কারণে এতোটা ঘৃণিত হয়ে উঠেছেন! পুরো লাইফটাকে হেল করে দিয়েছেন আপনি! আপনার জন্য আমি এতো বড় হয়েও মায়ের কাছে দুইটা থাপ্পড় খেয়েছি! আমার কাছেই তো নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তারপরও খুব প্রয়োজন ছিলো সেদিন মায়ের কাছে বিচার দেওয়ার! আমার এতোটা সর্বনাশ করেও শান্তি হননি আজ নিজে মেরে আবার আসছেন বার্থডে উইশ করতে! দুদিন হয়নি বিয়ে করেছেন আর এখনই টর্চার শুরু করেছেন! আপনার জন্য আমি আজ এক্সামটাও দিতে পারলাম না আমি! সব শেষ করে দিয়েছেন আমার। সব! সব!
– আমি বারবার জিজ্ঞেস করা সত্বেও তুমি বলনি কেন ভার্সিটিতে এক্সাম আছে তোমার!
– সব কেন আপনার কাছে বলে বলে করতে হবে! আর সবকিছুর কৈফিয়তই বা কেন দিতে হবে! আমার স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই!
ইমরান তার দিকে এক কদম এগিয়ে বললো,
– স্বাধীনতার মাঝেই তো রাখতে চেয়েছি দিয়েছো সেই মর্যাদা?
– খবরদার, আমাকে টাচ করেছেন তো! আপনাকে তো কিছু করতে পারবো না। নিজেকে শেষ করে দিবো একেবারে!
ইমরান তার বাহু চেপে ধরে বললো,
– এই মেয়ে! এমন করছো কেন তুমি! বিয়ে করেছি বলেই কি আমার খুব অপরাধ হয়ে গেছে! পাগলের মতো আচরণ ছেড়ে স্বাভাবিক কেন হতে পারছো না! তুমি জানো কতগুলো মানুষকে টেনশনে ফেলে রেখেছো! ক’দিন আগে যে তোমার বাবার ব্রেইন স্ট্রোক হলো সেটা জানা আছে তোমার! এখন নিজের এই জেদে স্থির হয়ে তো আরও বেশি ক্ষতি করে যাচ্ছো উনার! সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা কি কম কোনো বাবামায়ের!
নাফিসা একদম হতবাক হয়ে গেছে ইমরানের কথা শুনে! তার বাবার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে! সে মুহুর্তেই বাকিসব ভুলে গিয়ে ইমরানকে বললো,
– ব্রেইন স্ট্রোক হয়নি বাবার। ডাক্তার বলেছে প্রেশার বেড়ে গেছে।
– ডাক্তার বলেনি সেটা। বলেছে আরাফ ভাই। তোমরা টেনশন করবে বলে লুকিয়েছে তোমাদের কাছে! আর সেই তোমরাই এখন উনার আরও বেশি ক্ষতি করে ফেলছো! আমি মনে করি আগেও সেটা তোমাদের জন্যই ঘটেছে। তাছাড়া নিশ্চয়ই আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকতে পারে না উনার মাঝে।
– আপনি জানলেন কিভাবে?
আগের চেয়ে একটু শান্তভাবে ইমরান বললো,
– আরাফ ভাই ই বলেছে। তোমাকে এখন বিয়ে দিতো না তোমার পরিবার। তোমার বাবা অসুস্থ বলেই বাধ্য হয়েছে। সন্তানদের ভালো অবস্থানে দেখতে পারলেই কেবল পিতামাতার শান্তি।
– আমি বাবার সাথে কথা বলবো।
– তোমার আপুরাও কেউ কিন্তু জানে না সেটা। শুধু তোমার বাবা মা ও আরাফ ভাই জানে। তোমাদের জানানো হয়নি কারণ তোমরা টেনশন করবে। এখন যদি এ সম্পর্কে তুমি কিছু বলো একে একে সবাই জেনে যাবে। আর বাবা আরও বেশি টেনশন করবে এই ভেবে, যে তোমরা টেনশনে আছো। আমি মনে করি, তোমরা সবাই স্বাভাবিক থাকো আর এতেই তোমার বাবা সুস্থ থাকবেন, ইনশাল্লাহ।
– আমি বাবার সাথে কথা বলবো।
– তুমি এখনো কান্না করছো। বাবা জানলে আরও বেশি কষ্ট পাবেন। আগে নিজেকে শান্ত করো তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলো। সকালে গোসল করেছো?
নাফিসা চোখ মুছতে মুছতে দু’দিকে মাথা নাড়লো। ইমরান বললো,
– গোসল করে এসো। তারপর কথা বলবে। যাও।
নাফিসা বোরকা খুলে চলে গেলো গোসল করতে। ইমরানও পোশাক পাল্টে নিলো। নাফিসা রুমে আসতেই ইমরান বললো,
– নাফিসা, ওবাড়িতে যাবে? ভাবি কল করেছিলো তোমাকে উইশ করার জন্য। জন্মদিনে তুমি অভিমান ভেঙে তাদের কাছে থাকলে আরও বেশি খুশি হবে।
– যাবো আমি।
– ভাত খাও। তারপর রেডি হও।
খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তবুও প্লেট হাতে নিলো। ইমরান তার জন্যও খাবার এখানে নিয়ে এসেছে। নাফিসা ভাত মাখতে গেলেই “ওফ্ফ!” শব্দ করে আঙুল মুখে দিলো। ইমরান হাত টেনে নিয়ে বললো,
– কি হয়েছে? দেখি। কাটলো কিভাবে?
“আমাকে মেরে এখন ভুলে গেছে!”
নাফিসা বিড়বিড় করে চোখ কাচুমাচু করে হাত টেনে নিলো। পরক্ষণে ইমরানের মনে হলো জগ ভাঙার কথা। কাচের টুকরো তুলতে গিয়ে কেটে গেছে বোধহয়! তাই সে বললো,
– হাত ধুয়ে নাও। আমি খায়িয়ে দেই।
– লাগবে না।
– সব লাগবে না হলে লাগে কোনটা! হাত ধোও।
অত:পর ইমরানই খায়িয়ে দিলো তাকে। নাফিসার অসস্তি লাগছিলো তার হাতে খেতে তবুও খেয়ে নিলো পেটে ক্ষুধা থাকায়। অন্যথায় নিজ বাড়ি যাওয়ার জন্য।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫৬
(নূর নাফিসা)
.
.
খাওয়ার পর খুঁজে খুঁজে পিনগুলো ফ্লোর থেকে উঠিয়ে নিলো নাফিসা। ইমরান প্লেট রাখতে গেছে। বড়মা এসেছে এখানে।
– ভার্সিটি গেছোস নাকি?
– না, ঘরেই ছিলাম।
– গেইট না তালা দেওয়া দেখলাম!
– উনি তালা দিয়ে গেছে।
– কে?
এই কেন এর উত্তর কিভাবে দিবে! ঘরে যাইহোক বাইরে কিছু না জানানোই ভালো। তাছাড়া দোষ খুজতে গেলে তার দোষটাই বেশি বের হয়ে আসবে! কেন জানি গত কয়েকদিন ধরে কাউকেই সহ্য হয় না তার! বড়মা উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে তাই নাফিসা বললো,
– আমি ঘুমাচ্ছিলাম তাই।
– ওহ্। বাবা মায়ের উপর রাগ কমছে?
– বড় মা, আমি বাড়িতে যাবো আজ।
– হু, ইমরান বলছে। আবিদার কাছে বলে যা। এমন ধাচের বিয়ে হওয়ায় রাগ করছে একটু ছেলের আর ছেলের বউয়ের উপর। তুই মানিয়ে নিলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। পারবি না?
নাফিসা এখনো কাউকে তেমন চিনলোই না, মানাবে কি করে! তবুও সে পারবে সেই আশ্বাস দিয়ে মাথা নাড়লো বড়মার সামনে। বড় মা মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাফিসা বোরকা পড়ে তৈরি হচ্ছে। জিহানকে সাথে নিয়ে ইমরান এসে বললো,
– এতো তারাতাড়ি রেডি হয়ে গেছো। আরও পরে যাবো।
নাফিসা আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীরমুখে ইমরানকে বললো,
– এখনই যাবো।
– কাজ আছে একটুখানি।
– বলার আগে কাজের কথা মনে ছিলো না!
– হুম, মনে ছিলো। বাট বুঝতে পারিনি এতো দ্রুত রেডি হয়ে যাবে! যাইহোক, রেডি হয়েছো ভালো হয়েছে। এবার আগে কাজটা করে নাও, তারপর যাই।
ইমরান জিহানকে খাটে বসিয়ে দিয়ে প্যাকেট থেকে কেকটা বের করলো। ছুরিটা সামনে রেখে নাফিসাকে বললো,
– কেক কাটো বেগম সাহেবা।
– আমি এসব কেক টেক কাটবো না।
– টেক বাদ রাখো, কেক কাটো। শুভদিনে মুড খারাপ রাখতে নেই।
– বেশি বারাবাড়ি করবেন না বলে দিলাম। আমি কেক কাটি না।
– জিহান পিচ্চিটা বসে আছে কেক খাওয়ার জন্য আর তুমি এমন অবহেলা করছো!
– তো আপনি কেটে খায়িয়ে দিন। আমাকে ডাকছেন কেন!
– তোমার বার্থডে আর কেক কাটবো আমি! সেটা কি করে হয়! অন্তত একটা পোচ দাও! বাকিটা আমিই কাটি। দাও, দাও তারাতাড়ি।
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে ছুরিটা হাতের মুঠোয় ধরে কেকের মাঝামাঝিতে এক কোপ বসিয়ে দিয়ে বললো,
– হয়েছে এবার?
– এটা কি করলে তুমি! এমন একটা শুভক্ষণে তুমি অশুভ কাজ করলে! বলা নেই, কওয়া নেই ডিরেক্টলি কেকটাকে খুন করে ফেললে!
বলে নিজেই হাসতে লাগলো ইমরান। নাফিসা খাটে বসে পড়লো এবং বললো,
– এখন কি নিয়ে যাবেন না?
– কেকটা কাটো আগে। তারপর আমি রেডি হব। দেড়ি কিন্তু তুমিই করছো। যত তারাতাড়ি কেক কাটবে তত তারাতাড়ি আমিও রেডি হতে পারবো।
জিহান শুধু তাদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। নাফিসা বসা থেকে উঠে আবার ছুরি হাতে নিয়ে বললো,
– এইবার রেডি না হলে কেকের ন্যায় আপনাকে কাটবো!
এই বলে নাফিসা সম্পূর্ণ কেকে ছুরি চালিয়ে কুচিকুচি করে ফেললো। যেন আজকের সকল রাগ জেদ সব কেকের উপর ঢেলে দিয়েছে! এদিকে তার কেক কাটার স্টাইল দেখে ইমরান হেসে ভিডিও করতে করতে বলছে “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু বার্থডে গার্ল নাফিসা!” জিহান তাদের কান্ড দেখে হাত তালি দিয়ে হেসে উঠলো। জিহানের হাসি দেখে নাফিসাও হাসি মুখে জিহানের দিকে তাকালো। অত:পর একটুখানি কেক নিয়ে জিহানের মুখে দিলো। ইমরান ফোন রেখে তার কাছে এসে একটুকরোতে যতটুকু উঠে এসেছে ততটুকু হাতে নিয়ে নাফিসার মুখের সামনে ধরলো। নাফিসা তার হাত ইমরানের মুখের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
– আপনি খান বেশি করে।
– যার জন্যে আনা সে না খেলে কিভাবে। তুমি খাও আগে, পরে আমি খাবো।
নাফিসা মুখ ফিরিয়ে নিলো। তাই ইমরান বললো,
– হা করো নয়তো গাল, নাক, মুখ সব খাবে।
এই লোকের সাথে বিশ্বাস নেই। এতোক্ষণ ধরে সে রেডি হয়েছে এখন গালে মেখে দিলে আবার রেডি হতে হবে। তাই নাফিসা মুখে নিয়ে নিলো। ইমরান ইশারা করতেই নাফিসা নিজে এক টুকরো হাতে নিয়ে ইমরানের মুখে দিতে বাধ্য হলো। অত:পর হাতে লেগে থাকা ক্রিম মুছে নিলো ইমরানের নাকে। ইমরান একটুও রাগ করলো না। ঠোঁটের এক কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– রেডি হয়ে গেছো বিধায় বেচে গেলে। নতুবা কেকের সবটুকু ক্রিম তোমার ফেসে মাখামাখি হতো!
– হুহ্! আমি ছেড়ে দিতাম নাকি!
– হা হা হা…কে বলেছে ছেড়ে দিতে। সারাজীবন আকড়ে ধরে রাখো না। সেটাই তো চাই।
– আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো। একটু পর সন্ধ্যাই হয়ে যাবে!
– তোমার এটুকুতে হলেও আমার এটুকুতে কিছুই হয়নি। সবটা জ্বিভেই আটকে আছে। গলা পর্যন্তও নামেনি।
এই বলে ইমরান জিহানের হাতে কেক দিয়ে সেও কাটা চামচ ন্যায় ছুরিতে আটকে খেতে লাগলো। নাফিসা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– তাহলে হাতে নিয়ে নিন। খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে যাবেন।
– হু, আমার পেট খারাপ করার আর আইডিয়া পাওনা! না? ওয়েট, পাচ মিনিট লাগবে আমার। খাবে আরও?
– না।
– নিশাতের রুমে রেখে আসি।
নাফিসা জিহানকে দেখিয়ে বললো,
– ওকে আরেকটু দিন।
– না, এখন এতো খেলে ভাত খাবে না। নিশাত খাওয়ার সময় আবার ডেকে খাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমরান রেডি হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় আবিদা বেগমের কাছে বলেছিলো নাফিসা। বড়মা পাশে থাকায় বড়মার দিকে তাকিয়ে আবিদা বেগম গম্ভীরমুখে শুধু এইটুকু শব্দ করলো, “যাও।” ইমরান নাফিসাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাসায় এসে সালাম দিয়ে মায়ের আগে বাবার সাথে কথা বললো নাফিসা,
– কেমন আছো বাবা?
– এইতো, আলহামদুলিল্লাহ। এখন অনেক ভালো আছি। ছোট মা কেমন আছে?
সেই জবাব না দিয়ে নাফিসা কাদো কাদো গলায় ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– এতো চিন্তা কিসের তোমার? কি নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা করো! নিজের ক্ষতি করতে খুব ভাল্লাগে তোমার!
– না, ভাল্লাগেনা তো! আমি কোথায় দুশ্চিন্তা করি!
– একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবে না! তুমি দুশ্চিন্তা করো বলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছো! এতো দুশ্চিন্তা কেন থাকে তোমাদের?
নিয়াজ উদ্দিন মেয়ের চোখ মুছে দিয়ে বললো,
– কে বলেছে আমি দুশ্চিন্তা করি! তোমরা ভালো ও হাসিখুশি থাকলেই তো আমি আর কোনো চিন্তাই করি না।
– আমরা ভালো আছি। আর কোনো টেনশন করবে না তোমরা।
– বাবার উপর রেগে ছোট মা চারদিন ধরে কোনো কথা বলে না, কিভাবে বুঝবো ভালো আছে!
– এই যে, এখন বলছিতো! আর প্রতিদিন বলবো।
– আরে! জন্মদিনে কেউ কাদে! একদম পচা পঁচা দেখায়!
নাফিসা চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। মায়ের সাথেও প্রথমে অভিমান নিয়ে কথা বলে পরে আবার অভিমান ভেঙে ফেললো। নাজিয়া আছে বাসায়। নাহিদা বিয়ের পরদিন সকালেই চলে গেছে মেহেদীর সাথে।
নাফিসা ফ্রেশ হয়ে নিলে নাজিয়া তাকে বার্থডে উইশ করলো। আপাতত দেওয়ার মতো কিছু নেই বলে গিফট বাকি রাখলো। বোরকা হিজাব গুছিয়ে রাখতে নাফিসা তার রুমে এসেছিলো। নাজিয়ার হাসির শব্দ শুনে পাশের রুমে এসে দেখলো তার বাবা মা আর নাজিয়া ফোনে কিছু দেখছে। ইমরান খাটে বসে আছে। সবার মুখেই হাসি লেগে আছে। ফোনটা দেখে মনে হচ্ছে ইমরানের। কি দেখছে তারা!
নাফিসাকে এই রুমে আসতে দেখে নিয়াজ উদ্দিন বললেন,
– আম্মা, তুমি কি কেক কেটেকুটে রান্না করছো?
নাজিয়া হাসতে হাসতে বললো,
– না বাবা। কেক কুরবানি দিছে!
নাফিসা বুঝতে না পেরে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইমরান দুপুরের কান্ড ভিডিও করে রেখেছে! সে লজ্জা ও বিরক্ত নিয়ে ভিডিও ডিলিট করে দিলো। এতেও রেহাই নেই! সন্ধ্যায় নাহিদা কল করে বললো,
– কিরে বার্থডে কুইন। তুই নাকি বার্থডে স্পেশাল করতে কেক কুরবানি দিছোস!
নাফিসা রেফে আগুন! লোকটাকে পাটা পুতোয় পিষতে পারলে এখন খুব ভালো লাগতো তার! সে নাহিদাকে বললো,
– এতো কথা না বলে আমার গিফট দাও।
– এখন কিভাবে দিব! বকেয়া থাক।
– সবাই শুধু বকেয়াই রাখছে, বাবা ছাড়া কারো কাছেই নগদ পেলাম না! আজ কি আমার বকেয়া বার্থডে!
.
নাফিসাকে রেখে জরুরি প্রয়োজনে ইমরান সন্ধ্যায় খাওয়াদাওয়া করে চলে গেছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় নাফিসা নাজিয়াকে বললো,
– আপু?
– হু?
– ভাইয়া আসে না এখানে?
– হ্যাঁ। গতপরশুও না এলো।
– কথা হয় তোমার সাথে?
নাজিয়া একটু চিন্তিত হয়ে নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
– মাথায় কি ঘুরছে, খুলে বল তো?
– তুমি যে সেদিন ভাইয়াকে বলে দিয়েছো আরেকটা বিয়ে করে নিতে। ভাইয়া কি এখনো রেগে আছে?
নাজিয়া ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ডানেবামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– আজ বিকেলে বাবা আর তোর ভাইয়া নিতে আসতো। তুই আসবি বলে তোর ভাইয়া বলেছে কাল নিয়ে যাবে।
– ওহ্।
– ওবাড়িতে কেমন কেটেছে সময়?
– ভালো না।
– কেন?
– এমনি। কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার।
– নিজে একটু ইজি হয়ে যা, দেখবি সব ভালো লাগবে।
– জানো, ওর মা তো পুরো উনার দজ্জাল বোনের মতো মুখ ফোলা! যেমন চেহারা তেমনই মেডাম ফুলি!
– হেপ! এসব বলে না।
– ওদের পরিবারে তেমন কাউকে দেখলাম না। আই মিন, বাবা তো নেই ই। চাচা বা চাচাতো ভাইবোনও দেখলাম না। তাছাড়া বড়মা ডাকে যে, উনি কি বড় চাচি না?
নাজিয়া একটু বড় বড় চোখ করেই নাফিসাকে বললো,
– তুই এসব নিয়ে কাউকে উল্টাপাল্টা ভাবে জিজ্ঞাসা করিস নি তো?
– না। কেন?
– কথার ভঙ্গিতে কষ্ট পেতে পারে। তাই বললাম। বড়মা যাকে ডাকে উনি চাচী না। ইমরানের বাবার প্রথম স্ত্রী। আর ইমরানের মা হচ্ছে দ্বিতীয় স্ত্রী। উনারা আবার মামাতো ফুপাতো বোন। বড় আন্টির কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি তাই তিনিই বিয়ে করিয়েছেন ছোট আন্টিকে। ছোট আন্টি একটু বদমেজাজি টাইপের হলেও কখনো ঝগড়া হয়নি তাদের মাঝে। বড় আন্টি হতে দেয়নি সেটা। খুব আপনভাবেই মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। আর আংকেলের নাকি খুব প্রিয় ছিলেন বড় আন্টি। তবে ছোট আন্টিকেও অধিকার বঞ্চিত করেননি তিনি। কিন্তু ভাগ্যে সন্তান থাকলেও সন্তানদের সংসার দেখার সুযোগ হলো না। তবে তিন ছেলেমেয়ে বড়মাকেও খুব ভালোবাসে। আপন মায়ের মতোই। ওসব নিয়ে কখনো কথা না বলাই ভালো। বলিস না তুই কখনো।
– আচ্ছা।
চলবে।