“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৩
(নূর নাফিসা)
.
.
মধ্যরাতে নাফিসার ঘুম ভেঙেছে। বাইরে কুকুরের আর্তনাদ শুনা যাচ্ছে। নাফিসা উঠে বসে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। বাইরে যাবে সে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না একা বের হওয়ার। বিছানা ছেড়ে নেমে এসেছে তবুও অতটা সাহস হচ্ছে না বাথরুম পর্যন্ত যাওয়ার! জানে ভুত বলতে কিছুই নেই, তবে চোর ডাকাত আছে। এখন বের হলে কোনো পাগলও যদি এসে উঁকি দেয় তবেই সে নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবে এটা তার ধারণা। নিজের বাড়িতেই বোন অথবা মাকে ডেকে তারপর বের হয়। আর এখানে বারান্দার গেইট তালা দেওয়া তা জেনেও মনে ভয় কাজ করছে। ইমরানের দিকে তাকিয়ে দেখলো কপালের উপর হাত রেখে ঘুমাচ্ছে। কয়েক মিনিট ভেবে নাফিসা নিচু শব্দে ইমরানকে ডাকলো। দুবার ডাকতেই যখন শুনছে না তখন সে কাছে এসে তার হাতটা সরিয়ে তারপর ঠেলে বললো,
– এই, শুনছেন?
ইমরান ঘুমঘুম চোখে তাকাতেই নাফিসা বললো,
– আমি ওয়াশরুমে যাবো একটু।
ইমরান দুহাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো এবং বললো,
– তুমি এতো সাহসী মেয়ে হয়ে ভুতকে ভয় পাও?
– আমি ভুতকে ভয় পাই না। তবে নিরিবিলি পরিবেশে কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলেই ভয় পেয়ে যাই।
ইমরান মৃদু হেসে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বললো,
– ভয় পাও আর না পাও। একা বের হবে না কখনো। কাউকে সাথে নিয়ে বের হবে। পাশে কেউ না থাকলে প্রয়োজনে আশেপাশের কাউকে কল করে তারপর বের হবে।
নাফিসা বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো নিশাতও রুম থেকে বেরিয়ে আসছে। ইমরান বাথরুমে গেলে নাফিসা নিশাতকে বললো,
– তুমিও উঠে পড়েছো দেখছি! এমন নিরিবিলিতে মাঝরাতে বের হতে ভয় পাও না?
– কি বলো! ও ঘরে ভেতরে বাথরুম তা-ও একা যাই না আর এখানে একা বের হবো! আমি শুধুমাত্র রাতে বের হতে হবে বলে বেশিরভাগ সময় ওই ঘরে থাকি। আর এখানে থাকলে ভাইয়াকে কল করে বের হতে বলে তারপর বের হই।
– ভুতকে ভয় পাও?
– হু।
– দেখেছো কখনো?
– উহু, গল্প শুনেছি।
– ভুত বলতে কিছুই নেই।
– উহ! আছে। নানু থাকতে সত্যি ঘটনা বলতো ।
– ওগুলো ভুত না। জ্বিন-পরী। আগে ছিলো, এখন ঝোপঝাড় সমৃদ্ধ এলাকা ছাড়া ওসব নেই বললেই চলে।
নিশাত বাথরুমে গেলে নাফিসা রুমে চলে এলো। শুয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘুম আসছে না। একবার এপাশ তো আরেকবার ওপাশ!
.
আজ ইমরান রেডি হয়ে যখন নাস্তা করতে যাবে তখন নাফিসা বললো,
– আপনি এখানেই বসুন, আমি খাবার এনে দিচ্ছি।
– এতোদূর টানাটানির কি প্রয়োজন!
– আমি আনতে পারলে আপনার সমস্যা কোথায়!
ইমরান আর কিছু বললো না। নাফিসা খাবার আনতে চলে গেলো বড় ঘরে। দেখলো জেরিন আগেই খাবার সাজিয়ে রেখেছে আরমানের জন্য টেবিলে আর ইমরানের জন্য ড্রয়িং রুমে! বাকিরা পরে খাবে। নাফিসা জেরিনকে জিজ্ঞেস করলো,
– ড্রয়িং রুমে খাবার কার ভাবি?
– ইমরানের।
– ওহ্! আচ্ছা।
নাফিসা খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলো। তা দেখে জেরিন বললো,
– এসব কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
– উনি এখানে আসতে পারবেন না। ওই ঘরে খাবেন।
– কেন?
– ইচ্ছে হলো তাই।
– এতো টানাটানির দরকার নেই। ডাকলে এখানেই আসবে। আমি ডেকে আনছি।
– আপনার সমস্যা কোথায়, ভাবি? টানাটানি তো আমিই করছি!
কথাটা বলে নাফিসা প্লেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাফিসা ভাতের প্লেট রেখে আবার এ ঘরের দিকে আসার সময় দেখলো জেরিন বাটি নিয়ে আসছে। নাফিসা উঠুনে পথ আটকে দাড়িয়ে বললো,
– আমি নিয়ে যেতে পারবো, ভাবি। আপনাকে এতো কষ্ট করতে হবে না। আপনি বরং নিজের স্বামীর খেদমত করুন, যাতে সওয়াব হবে।
জেরিন দাত কিড়মিড়িয়ে বললো,
– ছোট ছোটর মতোই থাকো। আমার জায়গা দখল করতে এসো না।
– আপনার জায়গা কেন দখল করতে যাবো আমি! আমি আমার জায়গাতেই আছি। আপনি যেহেতু বড় সেহেতু বড়’র সম্মানটা বাচিয়ে সম্মানিত জায়গায়ই অবস্থান করুন। বড় হয়ে আপনিই যদি ঘরে স্বামী রেখে পরপুরুষের দিকে নজর দেন তাহলে আমি ছোট হয়ে আপনার কাছে কি শিখবো, ভাবি!
– নাফিসা!
– অযথা চোখ রাঙিয়ে কোনো লাভ নেই। সম্মান লঙ্ঘনকারীর ধমকে আমি মোটেও ভয় পাইনা।
– ইমরান আমার দেবর। আর সংসারের বড় বউ হওয়া সত্ত্বে সবার কাজ এগিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য।
– এ কেমন কর্তব্য, যেখানে স্বামীর চেয়েও অধিক লক্ষ্য রাখা হয় দেবরের প্রতি! আগে স্বামীর প্রতি কর্তব্য পালন করতে শিখুন। পরে না পরিবারের বাকি সদস্য! ইমরান এখন বিবাহিত, সুতরাং তাকে নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। তার কাজ এগিয়ে দেওয়ার জন্য সে আমাকে এনেছে। তার চিন্তা ছেড়ে নিজের দৃষ্টিকে সংযত করুন। যেটা আপনার জন্য মঙ্গলজনক!
নাফিসার স্পর্দা দেখে জেরিনের চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। নাফিসা তার হাত থেকে বাটি নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। ইমরান নাফিসাকে বললো,
– তোমার প্লেট আনলে না?
– বাকিদের সাথে পরে খাবো।
– এখনই নিয়ে এসো। ভার্সিটি যাবে।
– যাবো না এখন।
– কেন?
– কাজ আছে।
– কি কাজ?
– সংসারে কাজের অভাব হয়!
– কাজের দোহাই দিয়ে শুধু শুধু বাসায় থেকে লাভ নেই। প্রতিদিন ক্লাস করবে। অবসর সময় সংসারে ব্যয় করবে। তুমি না করলেও পড়ে থাকবে না কোনো কাজ।
– হ্যাঁ, আপনার কথা মানি আর দিনরাত খোটা শুনি!
– কে দিচ্ছে তোমাকে খোটা! একমাত্র জেরিন ছাড়া কেউই কিছু বলবে না। আর জেরিনের কথায় তুমি কান দিবে না। নাস্তা করে রেডি হও দ্রুত। প্লেট নিয়ে এসো আর না হয় ভাতের বাটিতেই খেয়ে নাও।
নাফিসা আর প্লেট আনতে গেলো না। বাটিতেই অতিরিক্ত ভাত খেয়ে নিলো। নাফিসা রেডি হচ্ছে আর ইমরান বসে আছে। নাফিসা বললো,
– আপনি বসে আছেন কেন? অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে না?
– তোমার সাথে যাবো।
– আমার সাথে কেন! আপনার অফিস কি ওদিকে?
– না, ভার্সিটিতে যাবো তোমার সাথে।
– আবার এডমিশন নেওয়ার শখ জেগেছে?
– হুম।
– ঢং!
ইমরান হাহা করে হেসে উঠলো। নাফিসা আবার বললো,
– আমি একাই যেতে পারবো।আপনি অফিস যান।
– আজ আমার অফিস অফ। সপ্তাহে পাচ দিন আমার অফিস। দুদিন ছুটি। আর এই দিনে ভার্সিটিতে যাই স্যারের কাছে, যিনি আমাকে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন সাথে যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন। এজন্যই প্রতি সপ্তাহে স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করতে আমার ভার্সিটি যাওয়া। আর হঠাৎ করেই একদিন এইদিনে তোমাকে পাওয়া।
নাফিসা আয়নায় তার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিলো। ভার্সিটির জন্য প্রস্তুত হয়ে সে ইমরানের সাথে বেরিয়ে এলো। বড় ঘরে এসে মা ও বড়মার কাছে বলে বের হতে যাচ্ছিলো এমন সময় জিহান পিছু নিলো। ইমরান বাসার পাশের দোকান থেকে চিপস কিনে তাকে বাড়িতে এনে নামিয়ে দিলো। আর জেরিনের উদ্দেশ্যে বললো,
– ভাবি, জিহানকে ধরুন।
পাশে ছিলো বড়মা। জেরিন প্রায় কাদো কাদো গলায় বললো,
– বড়মা, দেখো ইমরান কি শুরু করেছে কাল থেকে! তাকে বলে দাও, এসব ফাজলামো ছাড়তে!
নাফিসা বললো,
– ভুল কি বললো ভাবি!
– তুমি চুপ থাকো!
– আচ্ছা। আমি চুপ।
বড়মাও একই কথা বললো,
– ঠিকই তো জেরিন! ভুল কি বললো! ইমরান ঠিকই আছে। বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কে তুই বড়। তোকে সম্মান দেওয়া উচিত। এটাই ভদ্রতা।
নাফিসা মৃদু হেসে বললো,
– আসি বড়মা।
আসার সময় একবার জেরিনের মুখভঙ্গি দেখতে ভুলেনি নাফিসা। জেরিনকে এমন রাগান্বিত ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাটতে হাটতে নাফিসা তাকে দেখানোর জন্য ইমরানের হাত মুঠোয় ধরলো। ইমরান এতে একটু অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না। সে গেইটের বাইরে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
– রাতে ভয় পাও আমাকে, দিনে ভয় পাও না?
নাফিসা এবার তার হাত ঝাড়ি দিয়ে ছেড়ে ভেঙচি কাটলো! ভেঙচিতে তাল মিলিয়ে ইমরান বুকের বা পাশে হাত রেখে তীর বিদ্ধ ন্যায় ভঙ্গিতে বললো,
– হায়, মে মার যাবা!
না চাইতেও নাফিসা হেসে উঠলো ইমরানের কথায়। গাড়ির জন্য একটু সামনে হেটে আসতেই ফেক্সিলোডের দোকান দেখে নাফিসা বললো,
– আমার ফোনের ব্যালেন্স নেই তিন দিন ধরে। রিচার্জ করা প্রয়োজন।
– তিন দিন ধরে ব্যালেন্স নেই, এখন বল কেন!
– এখন ফেক্সিলোডের দোকান দেখলাম তাই বললাম।
– আমার বিকাশ ছিলো। যখন তখন রিচার্জ করে দিতাম।
কথা বলতে বলতে ইমরান ফোন বের করে নিলো এবং নাফিসার ফোনে রিচার্জ করে দিলো। নাফিসা গাড়িতে বসে নাহিদাকে কল করলো ভার্সিটি আসার জন্য। নাহিদা জানালো সে আসবে। ইমরানের সাথে ভার্সিটি আসার পর নাফিসার ফ্রেন্ডের মুখোমুখি হতেই নাফিসাকে নানা ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। নাফিসা বরাবরের মতো সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে দিলো, “এ আমার উনি আর তোদের তিনি। আজ তো সামনাসামনি পেয়ে গেলি, তাই ট্রিট যা চাওয়ার চেয়ে নে। এরপরেও যদি কখনো আমার কাছে বিয়ের ট্রিট চাইবি কেউ। যার যতগুলো দাত আছে সব ফেলে দিবো!”
এরপর ইমরানের অবস্থা হয়েছে করুন! যা দেখে নাফিসার মনোক্তি, “এবার বুঝ ঠেলা! আজ বিয়ের স্বাদ মিটে যাবে মিস্টার!”
আর ওদিকে সবারই এক কথা, “দুলাভাই, আজ ট্রিট না দিলে আপনাকে ছাড়ছি না।”
আর তাদের প্রতুত্তরে ইমরানের উক্তি,
” ঠিক আছে, আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। ধরে রাখো যত ইচ্ছে। দেখি, কে কতক্ষণ ধরে রাখতে পারো!”
ইমরান পকেটে দুহাত রেখে ঠেই দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গাতেই। মাছির মতো তাদের ভ্যানভ্যান, ঘ্যানঘ্যান চলছেই কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। ইমরান বিরক্তহীন দাড়িয়ে আছে। আর যাই হোক, ওয়ালেট কেড়ে নিয়ে ট্রিট আদায় করার সাহস তো আর নেই কারো মাঝে! নাফিসাও দাড়িয়ে ছিলো তাদের কান্ড দেখার জন্য। এক পর্যায়ে ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেছে! আর ইমরানকে হার মানাতে না পেরে বাকিরাই বিরক্ত হয়ে নাফিসাকে হার কিপটের বউ বলে বকাঝকা করতে করতে ক্লাসের জন্য চলে গেলো। নাফিসা রেগে ইমরানকে বললো,
– সব তো শেষ করেছেন! এখন ফ্রেন্ডের কাছেও ইজ্জতটুকু বজায় রাখলেন না! চিনি ছাড়াই ফালুদা বানিয়ে দিলেন!
– তুমিই আমাকে ফাসিয়ে দিতে চাইছিলে আর উক্ত জালে নিজেই ফেসে গেছো! এতে আমার কি দোষ বলো!
– কোন পাগলের মুখ দেখে যে আজ ঘুম ভেঙেছে আল্লাহ জানে! কে বলবে আপনার সাথে ভার্সিটি আসার জন্য! তিল পরিমাণ ইজ্জতও বেচে রইলো না আমার! সব শেষ!
– ঘুম থেকে উঠে মনে হয় আমার মুখটাই দেখেছিলে!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৪
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসা আর দাড়িয়ে না থেকে হনহন করে ক্লাসে যাওয়ার জন্য হাটতে লাগলে ইমরান হাসতে হাসতে তার পাশাপাশি হাটতে লাগলো। ওয়ালেট বেরএক হাজার টাকার একটা নোট বের করে নাফিসার হাতের মুঠোয় ঠেসে দিয়ে বললো,
– এটা নিয়ে যাও। যতটুকু সম্ভব ততটুকুই আয়োজন করো। এর বেশি দেওয়ার মতো আপাতত ক্যাশ নেই। পরে না হয় অন্য কোনো একদিন আবার আয়োজন করো।
– আর কোনো দরকার নেই!
নাফিসা নিতে চাইছিলো না। ইমরান জোরপূর্বক মুঠোয় দিয়ে বললো,
– আরে, নাও। আমি মজা করছিলাম। আর ওরাও কিন্তু সেটা ফান হিসেবে নিয়েছে। তুমি এতো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো কেন! রাখো।
নাফিসা চলে গেলে ইমরান আশিককে কল করেছিলো আসতে পারবে কি-না। ইমরান স্যারের সাথে সাক্ষাৎ-এর সময় আশিক এসেছে। দুজনেই কথাবার্তা শেষ করে যখন ক্যান্টিনের দিকে আসছিলো তখন নাহিদার দেখা পেল! নাহিদা সালাম দিয়ে কথা বললো। নাফিসার কথা জিজ্ঞেস করতেই ইমরান বললো সে ক্লাসে আছে। নাহিদা বাসার সকলের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেছিলো এমন সময় মাঠে তুর্যে ও হিমেলের সাথে মেহেদীকে দেখতে পেল। ইমরান সালাম দিতেই মেহেদী সালামের জবাব দিয়ে কাছে এলো। ইমরান হ্যান্ডশেক করে কুশলাদি বিনিময় করলো। সাথে আশিকও। নাহিদা এসময় তাকে ভার্সিটিতে দেখে একটু অবাকই হলো। কেননা তার তো এখন অফিসে থাকার কথা। নাহিদা ইতস্তত বোধ করেও হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি এসময় এখানে?
– কেন? আমি এসে তোমাদের খুব ডিস্টার্ব করে ফেললাম!
সাথে সাথেই নাহিদার মুখভঙ্গি ফ্যাকাসে হয়ে গেলো! এ কেমন জবাব দিলো সে! তাদের সামনে কি এভাবে কথা বলার প্রয়োজন ছিলো! বাকিদের মুখও একটু বিস্মিত! তবুও নাহিদা মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো,
– না, ডিস্টার্ব কেন হবে! অফিস যাওনি যে, তাই বললাম।
মেহেদী নাহিদার দিকে তাকিয়ে চাপা রাগ দেখিয়ে দাতে দাত চেপে বললো,
– যাবো, অফিস। থাক তোমরা।
মেহেদী চলে যাচ্ছিলো। ইমরান বললো,
– ভাইয়া, এক কাপ কফি খাওয়া যায় না?
– নাহ, তাড়া আছে।
নাহিদাও চাপা লজ্জা নিয়ে কৌশলে ইমরান ও আশিকের থেকে কেটে পড়লো। সে আর ক্লাস করলো না আজ। দুএকজন ফ্রেন্ড ও কোচিং-এর ব্যাপারে টিচারের সাথে কথা বলে নাফিসার জন্য অপেক্ষা করলো। নাফিসা ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে এলে তার সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো নাহিদা। আর নাফিসা কৌশলে ক্যান্টিনে গিয়েছে তার ফ্রেন্ডদের ট্রিট দিতে। কিছুক্ষণের জন্য ইমরান ও আশিক ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলো। এখন এসে কল করে জানতে পারলো তারা ক্যানটিনে আছে। ইমরান আর সেদিকে যায়নি কিন্তু আশিক গিয়েছে। ক্যান্টিনে ট্রিট দেওয়া হচ্ছে, সে কেন তা মিস করবে!
আশিক নাফিসা গ্রুপকে পেয়ে চেয়ার টেনে তাদের পাশে বসে পড়লো। নাফিসা এসময় তাকে দেখে অবাক! নাফিসাকে উদ্দেশ্য করে আশিক বললো,
– ভাবি, এটা কেমন হলো! আমিও তো আপনাদের বিয়ে খাই নি! তাহলে আমার ট্রিট মিস হবে কেন!
– আপনি আবার কোত্থেকে উদয় হলেন!
– শূন্য থেকে মেবি!
– তো আবার শূন্যে মিশে যান।
– এইটা কিন্তু ঠিক না! সবাই এমন কিপটে হলে কিভাবে! প্রায় তিন ঘন্টা ধরে ভাই ঘুরেছে আমাকে নিয়ে অথচ এক ফোটা পানিও খাওয়ালো না! এখন আপনিও কিপটামী শুরু করলে তো একটু পর ভুখা থেকে মারা যাবো! কি বলো ছোট আপুরা!
নাফিসার ফ্রেন্ডরা হেসে উঠলো। তারাও আশিকের সাথে তাল মিলিয়ে নাফিসা ও ইমরানকে কিপটে ফ্যামিলি উপাধিতে ভূষিত করছে! খাচ্ছেও আবার কিপটেও বলছে এতে নাফিসা প্রচন্ড রেগে গেছে! আশিক নাফিসার কথা বলে খাবার অর্ডার করে ক্ষণে নাফিসার পক্ষে কথা বলছে, ক্ষণে তার ফ্রেন্ডদের!
এক পর্যায়ে আশিক হাতে স্পিড আর বার্গার নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে ক্যানটিন থেকে। ইমরান পরিচিত দুজন ছেলের সাথে কথা বলছিলো। সাথে একজন শিক্ষকও আছে। আশিক তাদের দেখে আর ইমরানের কাছে না গিয়ে অন্যদিকে চলে গেছে। ইমরান ডাকলে আশিক দূর থেকেই বললো, “ভাবি তাড়া করছে, ভাই! আমি পালাই!”
আর ওদিকে দেখলো নাফিসাও রেগে বেরিয়ে এসেছে ক্যান্টিন থেকে। সে সোজা ইমরানের কাছে চলে এসেছে। আর এসেই রাগান্বিত গলায় বললো,
– খুব প্রয়োজন ছিলো আপনার ভাইকে পাঠানোর! ধরতে পারলে এখন খুন করে ফেলতাম!
ইমরান তাদের সামনে নাফিসার এমন আচরণে বড় বড় চোখ করে জ্বিভ কাটলো! আর পাশের তিনজন হেসে উঠলো! নাফিসার এতোক্ষণ খেয়ালই ছিলো না এখানে একজন স্যার দাড়িয়ে! সে সালাম দিলো স্যারকে। জবাব দিয়ে স্যার বললেন,
– কি হয়েছে নাফিসা? রেগে আগুন কেন?
– তেমন কিছু না স্যার।
ইমরান বললো,
– বাসায় চলে যাবে এখন?
– হ্যাঁ।
ইমরান স্যারের কাছে বিদায় নিয়ে গেইটের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে নাফিসা তার শার্ট টেনে বললো,
– ওদিকে কোথায় যান! আগে এদিকে আসুন। কড়া হিসাবনিকাশ আছে।
ইমরান হাটতে হাটতে বললো,
– কেন? কি হয়েছে?
– কি হয়েছে তা জিজ্ঞেস করেন আবার!
– না জানলে জিজ্ঞেস করবো না!
– তিন ঘন্টা ঘুরিয়ে নাকি এক ফোটা পানিও খাওয়ান নি, তাই আমার হাত ফাকা করেছে! এখন বলুন, আপনার ভাই যে আমাকে ঋণী করে দৌড় দিলো, সেই দেনা পরিশোধ করবে কে?
– এই মাত্র সিঙ্গারা আর সস দিয়ে পুরি খেয়ে এলাম।
– দেখছেন, কত বড় মিথ্যুক!
– দুষ্টুমি করেছে। বাদ দাও, দেনা কত টাকা?
– এক হাজার থেকে কৌশলে দুইশো টাকা বাচিয়ে আটশো টাকা খরচ করেছিলাম। মাঝখান দিয়ে আপনার গিরগিটি ভাই এসে মোট এগারো শ সত্তর টাকা বিল করে ফেলেছে! এমনিতেই আমার পার্স ফাকা! যা ভাঙতি ছিলো আশি টাকা মিল করে পরিশোধ করতে পেরেছি। এখনো নব্বই টাকা বাকি।
ইমরান ওয়ালেট বের করে একশো টাকার নোট তার হাতে দিয়ে বললো,
– যাও, দিয়ে এসো। আমি এখানে আছি।
নাফিসা বিল পরিশোধ করে পার্স নিয়ে বেরিয়ে এলো সাথে তার ফ্রেন্ডরাও। পেট পুরে খেয়ে এক এক জনের দোয়া, ” স্বামী সংসার নিয়ে সুখী হও বাছা!” “নাফিসা তোদের এত্তোগুলা বাচ্চাকাচ্চা হোক!” “নাফিসা, আমি মন্ত্রী হলে তোদের বাচ্চাকাচ্চা সহিত দাওয়াত করবো ফাইভ স্টার হোটেলে!”
আর নাফিসার রিয়েকশন থাপ্পড়, লাথি দেওয়ার নাম করে তাড়া করা! অস্পষ্ট ভাবে বললেও ইমরানের কান পর্যন্ত এসেছে তাদের কথা। সবকিছুর বাইরেও ভালোই লাগছে নাফিসার ফ্রেন্ডের সাথে দুষ্টুমি দেখতে। ইমরানকে টাটা জানিয়ে তারা চলে গেলো। ইমরান নাফিসাকে বললো,
– চলো এবার?
– হুম।
– খেয়েছো তুমি কিছু?
– না খেলে খাওয়াবেন?
– খাওয়াতে তো হবেই। খাওনি?
– খেয়েছি।
হুট করেই আশিক এসে বললো,
– আমি খাইনি, ভাই!
নাফিসা চোখ রাঙিয়ে বললো,
– আপনি আবার আসছেন!
– ভাই, আমি জানতাম বিয়ে করলে নাকি সবাই নিঃস্ব হয়ে যায়। আর তোমার তো কপাল খোলা! এতো কিপটে ভাবি পাইছো! দশ বছরে দশতলা বিল্ডিং উঠবে তোমার বাড়িতে।
ইমরান হেসে তার হাত থেকে অবশিষ্ট অর্ধেক স্পিডের ক্যান টা নিয়ে বললো,
– না উঠলে কিন্তু তোকে ফুলফিল করে দিতে হবে।
– ধুর! দোয়া করছি যে সেটাই বেশি!
নাফিসা বললো,
– আপনার এমন বেশি দোয়া আপনার কাছেই রাখুন বেশি বেশি! রাজাকার একটা! পেট পুরে পুরি সিঙ্গারা খেয়েও বলে এক ফোটা পানিও নাকি খায়নি!
– ভাই, তুমিই বলো। পানি জীবনে খাওয়া যায়! আমি তো পান করছিলাম!
কথাবার্তা ও হাসিঠাট্টা করতে করতে তিনজনই ইমরানের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। মাঝরাস্তায় থাকাকালীন নিয়াজ উদ্দিনের কল এসেছে ইমরানের ফোনে। তিনি তাদের বাড়িতে আছেন। বাড়িতে এসে দেখলো নিয়াজ উদ্দিন বেয়াই বাড়ি মিষ্টি ও ফলফলাদির সাথে খামারের মুরগী নিয়ে এসেছে। তবে আসার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো মেয়েকে দেখা ও মুরগী নিয়ে আসা। নাফিসার অনুপস্থিতিতেও তার বাবার আপ্যায়ন ভালোই ছিলো যেটা নাফিসার ভালো লেগেছে। দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করে বিকাল পর্যন্ত ইমরান ও আশিকের সাথে সময় কাটিয়ে আরমানের সাথে দেখা করে চলে গেছেন তিনি। নাফিসার খুব ইচ্ছে করছিলো বাবার সাথে যাওয়ার কিন্তু ইচ্ছেটা কারো কাছেই প্রকাশ করলো না।
রাতে ঘুমানোর সময় ইমরানের এক হাত চিত করে রাখা দেখে কাল রাতের ঘটনা মনে হয়ে গেছে নাফিসার। অত:পর নিজের মনে নিজেই সাহস যোগাতে লাগলো,
ইমরান তো যথেষ্ট ভালো ছেলে। তবে তাকে কাছে অনুভব করতে পারলে সে এতোটা নার্ভাস কেন হয়ে যায়! এতোটা ভয়-ই বা কেন পায়! সে তো তার স্বামী, যেখানে একসাথে থাকতে পারে তারা সেখানে ভয়ের কি আছে! না, এসব আলতু-ফালতু ভাবলে চলবে না। তার উচিত ইমরানের সাথেও ফ্রি হওয়া। বাকিদের সাথে যেহেতু ফ্রি আছে তাহলে তার সাথে কেন নয়! এ পরিবারে তো সবচেয়ে আপন সে-ই, তার জন্যই তো আসা এখানে। তাহলে তাকে কেন ভয় পাবে।
এখন থেকে আর একটুও ভয় পাবে না ইমরানকে, এটাই নাফিসার সিদ্ধান্ত। কেননা কাল তার ভয়ার্ত চেহারা দেখে ইমরান নিজেকে অপরাধী ভাবছিলো যেটা নাফিসার চোখেও স্পষ্ট ধরা দিয়েছিলো। তখন থেকে বিষয়টি আজ কয়েকবার ভেবেছে সে। অত:পর এখন চুড়ান্ত ভেবে সিদ্ধান্তে অটুট হলো। নাফিসা আস্তে আস্তে তার হাতটা বাড়িয়ে ইমরানের হাতের উপর রাখলো। আঙুলের ভাজে আঙুল রেখে আলতো ভাবে মুঠোয় ধরলো। ইমরান তার একটু আগে শুয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘুমায়নি। নাফিসার স্পর্শ পেয়ে সে চোখ খুলে তাকালো। নাফিসা তাকে হঠাৎ তাকাতে দেখে লজ্জা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই লজ্জার রেশ একটুও ভেসে উঠেনি মুখে! ইমরান বললো,
– আমি কিন্তু তোমায় স্পর্শ করিনি।
ইমরানের মুখে এমন কথা শুনে নাফিসা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইমরান মৃদু হেসে বললো,
– লাইট অফ করবে না?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। ইমরান লাইট অফ করার জন্য উঠতে গেলে হাতে টান পড়তেই নাফিসা শক্ত করে মুঠোয় ধরে নিলো সেই হাত। ইমরান অতিরিক্ত কোনো মনোভাব পোষণ করলো না। সে স্বাভাবিকই আছে। নাফিসা মুঠোয় ধরা সত্ত্বেও সে স্বাভাবিকভাবে তার হাত মেলে রেখে লাইট অফ করলো।
আজ আর ভার্সিটি যায়নি। সে ঠিক করে নিয়েছে সপ্তাহে তিনদিন যাবে ভার্সিটি। ইমরান অফিস যাবে সেজন্য রান্নার কাজ শেষ করে তার কাজকর্ম এগিয়ে দিচ্ছে। খাবার এই ঘরে আনতে চাইলে আবিদা বেগম এতো দূর টানাটানি করতে নিষেধ করলেন। নাফিসা আবিদা বেগমের মুখের উপর কোনো কথা বললো না। সে নিশ্চিত জেরিন কিছু বলেছে এ নিয়ে। তাই ইমরান এ ঘরেই খেতে এসেছে কিন্তু নাফিসা সম্পূর্ণ সময়টা তার পাশেই থেকেছে। খাওয়া শেষে ইমরান, নাফিসাকে নিজেদের ঘরে ডাকলো তাকে মিষ্টি করে বিদায় দেওয়ার জন্য। ইচ্ছা না থাকলেও জেরিনের জন্য আসতে বাধ্য সে! নাফিসা যতক্ষণ ছিলো এখানে ততক্ষণ পর্যন্ত মুখে হাত দিয়ে রেখেছিলো। ইমরান বুঝতে পেরে মুখ টিপে হেসেছিলো। বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললো,
– মুখে হাত কেন? ব্রাশ কর নি?
নাফিসা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলে ইমরান বললো,
– তাহলে?
নাফিসা মুখ ঢেকেই বললো,
– এমনি।
ইমরান মুচকি হেসে কাছে টেনে তার হাতের উপরই একটা চুমু একে বললো,
– এমনি এর কারণটাও আমি জানি। ফি আমানিল্লাহ।
ইমরানের মুখে হাসি থাকলেও তার এমন স্টুপিড মার্কা কর্মে নাফিসার মুখ রাগান্বিত!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৫
(নূর নাফিসা)
.
.
নিশাত আজ বাসায়ই আছে। ইমরান বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই এক মেয়ে এসে নিশাতকে ডাকতে লাগলো। নিশাত বারান্দায় এসে বললো,
– রেখা আপু! বেড়ানো শেষ হইছে তোমার!
– হু।
বলেই দুজনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। নাফিসা বাইরে এলে নিশাত বললো,
– এই যে, নতুন ভাবি।
– কেমন আছেন ভাবি?
মেয়েটি জিজ্ঞেস করতেই নাফিসা বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমি কিন্তু আপনার ননদ। আমাকে তুমি অথবা তুই করে বলবেন। নিশাত আমার খুব পছন্দ হইছে ভাবি কে! ইমরান ভাইয়ার পছন্দ আছে বলতে হয়।
– উহ! নজর দিও না, ভাবি তুমি কাজল দিয়েছো তো?
নাফিসা মৃদু হাসলো নিশাতের মস্করায়। অত:পর নিশাত পরিচয় করিয়ে দিলো রেখার সাথে। পাশের বাড়ির মেয়ে সে। বয়সে একটু বড় হলেও চাচাতো বোন হিসেবে নিশাতের সাথেই চলাফেরা। বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তার। পাশের দুতিন বাড়ি জুরে কিশোরী মেয়ে বলতে তারা দুজনই আছে আপাতত। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে নাফিসা বুঝতে পারলো মেয়েটি ভালোই। সহজ সরল ও মিশুকও বটে। নাস্তার পর তারা তাদের বাড়ির এক কোনে এলো বরই পারতে। দুইটা বরই গাছ আছে তাদের বাড়িতে। একটা ইমরানের ঘরের কোনে আরেকটা রাস্তার দিকে গেইটের পাশেই। এছাড়াও বেশ কিছু ফলের গাছ আছে এখানে। বরই পারার সময় নিশাত বললো,
– ভাবি, কোটার দরকার আছে নাকি! তোমার নাক-ই তো বেশ লম্বা!
রেখা ও নিশাত হেসে উঠলো। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে নাফিসাও বললো,
– সর্দি লাগছে আমার। নাকে পারলে কি খেতে পারবে? তার চেয়ে ভালো হাতে ঝাকা দেই।
মাঝারি আকৃতির গাছ হওয়ায় নাফিসা ঝাকা দিয়েই বড়ই পারলো আর ওদিকে আবিদা বেগম দেখে বললেন,
– দেখ খালি কি আন্দাজ যে! এমনে পারা লাগবো! হাতে কিছু নিয়া পারলা না! কতগুলা কাটা পড়ছে, সারাদিন জিহান দৌড়ায় উঠানে, সেই খেয়াল নাই!
ওদিকে জেরিনের উক্তি,
– হাতে পায়ে বাড়ছে ফুপি, বুদ্ধিতে বয়স হয় নাই। নাবালিকা।
নাফিসা তাকে ইগনোর করে আবিদা বেগমকে বললো,
– আম্মা, ঝাড়ু দিয়ে দিবো একটু পর। বরই তো পেকে যাচ্ছে, পেরে ফেলবো পাকা গুলো?
– যা খাইবা তা পারো। ঘরে রাইখা পচানোর দরকার নাই।
– পচবে কেন! পাকা গুলো শুকাতে পারবেন।
– সব পারতে পারবা?
– হুম।
– তাইলে পারো।
নাফিসার ভালোই লাগলো আবিদার সাথে কথা বলে। কিন্তু জেরিনকে দেখে মনে হয়েছে তার খুব হিংসে হচ্ছে তাদের বউ শ্বাশুড়িকে কথা বলতে দেখে! নাফিসা গাছ ঝাকা দিয়ে পাকা বরই ফেললো। আবিদা বেগম সহ নিশাত ও রেখা কুড়িয়ে নিলো। ঘরের কোনেরটা পারলেও রাস্তার ধারেরটা নিষেধ করলেন আবিদা বেগম। কেননা একে তো সেটা বড় গাছ, অন্যথায় রাস্তার পাশে। অর্ধেক বাড়ির ভেতরে পড়লে বাকি অর্ধেক পড়বে রাস্তায়। আর মেয়েদের তিনি রাস্তায় পাঠাবেন না বড়ই কুড়াতে!
বরই পারা শেষে নাফিসা টমেটোর সাথে কাচা বরই ভর্তা করে খেয়েছে নিশাত ও রেখার সাথে। জেরিনকে ডাকা হয়েছিলো কিন্তু আসেনি। বড় মা একটু নিয়েছে আর আবিদা বেগমের তেমন ঝাল খাওয়া নিষেধ বিধায় ভর্তা থেকে দূরেই থাকে। গোসলের পূর্বে আনাচে-কানাচ সহ পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে ঝকঝকে করতে পেরে হাপিয়ে যাওয়া নাফিসার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। অত:পর নিশাত আর সে, দুজন একই বাথরুমে গোসলের জন্য দুষ্টুমিতে মাখা দন্দ্ব লেগে গেছে! বুঝে আর না বুঝে জিহানও তাদের সাথে ভিজে গেছে পানি ছিটিয়ে! জেরিন তাকে মাইর দিতে আসছিলো। তার আগেই নাফিসা বাথরুমের দরজা লাগিয়ে জিহানকে গোসল করিয়ে দিলো। জেরিন বাইরে থেকেই তাদের উভয়কেই বকে গেছে যদিও জেদ ছিলো কেবল নাফিসার উপর! কিন্তু তারা সেদিকে কান দিলো না। সব মিলিয়ে শ্বশুর বাড়িতে এই প্রথম খুব আনন্দে দিন কাটলো আজ। সারাদিনের আমেজে মনটাও ফুরফুরে আজ। ইমরান অফিস থেকে ফিরে তাকে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে শুকানো কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখতে দেখে বললো,
– কি গো? এতো খুশি লাগছে কেন?
– তাহলে কান্না করি? ভ্যায়ায়ায়া…
ইমরান হেসে বললো,
– কি আর বলবো, তোমাকে কাদতে দেখলেও ভালো লাগে।
– হু, লাগবেই তো! আপনার তো কাদাতেও ভালো লাগে।
ইমরান ঘড়ি খুলে টেবিলে রেখে বললো,
– আমার কোনো ইচ্ছে ছিলো না সেদিন তোমার গায়ে হাত তোলার! বারবার তোমার জেদের কারণে একটু বেশিই রেগে গিয়েছিলাম।
নাফিসা কাপড় ভাজ করা রেখে ইমরানের মুখের দিকে তাকালো। তার চেহারায় অপরাধী ভাব স্পষ্ট! নাফিসা তেমন কিছু বলতে চায়নি। ইমরানের কথার প্রেক্ষিতে শুধু জবাব দিয়ে যাচ্ছিলো এতোক্ষণ। তার তো সেদিনের কথা মনেও ছিলো না। কিন্তু ইমরান যে সেটাই ভেবে আবার মুড অফ হয়ে গেলো! এখন নাফিসার কাছেই খারাপ লাগছে! বারবার তার জন্য লোকটা অপরাধী মনোভাবে চলে যায়! পরশু রাতেও এমন অপরাধবোধ করছিলো আবার আজও! মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য এখন কি করা যায় সেটাই ভাবছে নাফিসা!
ইমরান হাতমুখ ধুয়ে এলে নাফিসা হাত মুঠ করে তার সামনে ধরে বললো,
– নিন।
– কি?
– নিয়ে দেখুন।
ইমরান তার হাতের নিচে হাত রাখতেই নাফিসা মুঠো ছেড়ে দিলো। কিন্তু ইমরান তার হাতে কিছুই অনুভব করতে পারলো না! তাই বললো,
– এটা কি হলো?
– কি আর হলো! আপনাকে বোকা বানানো হলো।
ইমরান মৃদু হেসে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
– অফিস থেকে বাসায় ফিরতে না ফিরতেই এতো বড় ছ্যাকা দিলে!
নাফিসার মন এখন আরও খারাপ হয়ে গেলো! কোথায় একটু মজা করতে এলো! তা আর হলো না! ছ্যাকা দিয়ে ভোলাভালা লোকটাকে ব্যাকা বানিয়ে দিলো! ধুর! এটা না করলেই পারতো!
ইমরান ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালে নাফিসা আবার তার কাছে এসে দাড়ালো। এবং অন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এটা নিন।
– বারবার ছ্যাকা খেতে কে চায়!
– ছ্যাকা না, কিছু আছে। নিন।
– থাক, লাগবে না কিছু।
– না, নিন।
– বললাম তো লাগবে না।
– আরে নিন তো।
– উহুম।
– আপনি এখন নিবেন না?
নাফিসার রাগান্বিত চেহারা দেখে ইমরান হাত বাড়িয়ে নিয়ে দেখলো দুইটা বরই! মুচকি হেসে সে একটা নিজের মুখে দিয়ে অন্যটা নাফিসার মুখের সামনে ধরলো। নাফিসা হাতে নিতে গেলে ইমরান হাত সরিয়ে দিয়ে মুখে নেওয়ার জন্য ইশারা করলো। নাফিসা মুখে নিতেই ইমরান বললো,
– হয়ে গেছে!
– কি হয়ে গেছে?
ইমরান নাফিসার দিকে একটু ঝুকে বললো,
– বুঝো না?
নাফিসা একটু পেছনে হেলে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– না!
ইমরান আরেকটু ঝুকে বললো,
– সত্যিই বুঝো না?
নাফিসা আরও একটু পেছনে হেলে বললো,
– না তো!
ইমরান হাহা করে হেসে উঠলো এবং চিরুনী নিয়ে মাথা আঁচড়ে নিলো। নাফিসা পাশেই দাড়িয়ে ছিলো। ইমরান যখন রুম থেকে বের হতে যাবে তখন সে বললো,
– বললেন না, কি হয়ে গেছে?
ইমরান ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে তার কাছে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– সূচনা হয়েছে। প্রেমের সূচনা। অবশেষে প্রেমটা হয়েই গেছে!
নাফিসা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,
– ঘোড়ার ডিম হয়ে গেছে! যত্তসব ফালতু কর্মকাণ্ড!
কথাটা বলে নাফিসাই তার আগে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। উঠুনে এসে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ইমরান দরজা লাগিয়ে বের হতে হতে এখনো হাসছে। তার হাসিতে নাফিসারও হাসি পেল। কেন হাসি পাচ্ছে জানে না সে। অথচ হাসিমুখেই সে আরও দ্রুত পা চালিয়ে বড় ঘরে চলে গেলো।
এঘরে এসে দেখলো ড্রয়িং রুমে বড়মা সোফায় আর আবিদা বেগম মেঝেতে বসে আছে। বড়মা তেল লাগিয়ে দিচ্ছে আবিদা বেগমের মাথায়। নাফিসা এদের দেখে সত্যিই অবাক! মনেই হয়না এরা সতীন! যেন এরা দুজন আপনের চেয়েও আপন বোন অথবা মা-মেয়ের সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে। নাফিসার ধারণা মতে বড় মার জায়গায় যদি আয়েশা বেগম থাকতো কখনো এতোটা মহব্বত খুজে পাওয়া যেতো না। যদি কিছু দেখার থাকতো তাহলে তা কেবল চুলাচুলি ছাড়া আর কিছুই না! যেখানে প্রকৃত সতীনের সংসারের রূপ দেখা যেতো!
নাফিসা তাদের কাছে এসে বললো,
– বড়মা, রান্নার জন্য কি কি ব্যবস্থা করবো?
– মুরগী না রান্না করা আছে! এখন ভাত আর একটু টক হলেই হয়।
– আচ্ছা।
জেরিন নিজ রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় নাফিসাকে দেখে বললো,
– ওফ্ফ! মাথাটা ব্যাথা করছে! শোনো, এখন আমি কিছু করতে পারবো না। আজ তুমি সামলে নাও রান্নাবান্না।
নাফিসা তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে চুপচাপ কিচেনে চলে গেলো আর কাজকর্ম সে একাই করে নিলো। বড়মা এসে দেখলো, ভাত এবং টক রান্না প্রায় শেষ দিকেই।
– ভালোই তো পাকা দেখছি! তবে সবাই নাফিসাকে আলসে বলে কেন, হুম?
– যে বলে সে আরও বড় আলসে, বুঝলে!
– এহেম! তোর মা ই কিন্তু বলেছে!
নাফিসা জ্বিভ কেটে বললো,
– মা তো একটু বেশি বেশিই বলে!
– হু, এখন মা বেশি বেশিই বলে। তাই না! তা লবন চিনি ঠিকমতো দিয়েছিস তো?
– টকে চিনি দিবো!
– নাহ, মনযোগ সহকারেই রান্না বসিয়েছিস তাহলে। আমাদের আরেক ফুলি আছে তো! মাঝে মাঝে লবনের জায়গা দখল করে ফেলে চিনি!
নাফিসা হেসে উঠলো এবং বললো,
– বড়মা, আপনি দাদীকে দেখেছিলেন না?
– হ্যাঁ, কেন?
– দাদী কেমন স্বভাবের ছিলেন?
– পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলতেন না। ধার্মিকও ছিলেন বটে।
– আপনাকে নিশ্চয়ই খুব আদর করতেন?
বড় মা মুচকি হেসে বললো,
– তুই কিভাবে বুঝলি?
– যে একজন শ্বাশুড়ি হিসেবে ভালো সে নিশ্চয়ই একজন বউ হিসেবেও ভালো ছিলো! আর ভালো বউ হলে তো আদর করবেই।
– পাকা বুড়ি! যা, আযান পড়েছে। নামাজ পড়ে নে।
আজ রাতে ইচ্ছে করেই ইমরান নাফিসার বেশ কিছুক্ষণ আগে শুয়ে পড়েছে। হাত গতরাতের মতোই রেখেছে। নাফিসা আজও একই কান্ড করলো। তার হাত মুঠোয় ধরে তারপর চোখ বুজে রইলো। ইমরান চোখ খুলে দেখলো আজ লাইট অফ। সে অন্ধকারে নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এভাবে হাতে হাত রেখে ঘুমানোর মানে কি?
নাফিসার কোনো সাড়া পেল না! ইমরান তার হাতটা টেনে নিজের বুকের বা পাশে শার্টের নিচে রেখে বললো,
– সাহস থাকলে স্বেচ্ছায় এখানে হাত রেখে দেখ।
ইমরানের হৃদস্পন্দনের সাথে নাফিসার ভেতরের ধুকপুক বেড়েই চলেছে! এমন ঢিপঢিপ কম্পন উপলব্ধি করতে পেরে নাফিসা তার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। টানের সাথে সাথে ইমরানও ছেড়ে দিয়েছে তার হাত। সবটাই এখন নিশ্চুপ! কারো কোনো সাড়া নেই শব্দও নেই। একই ঘরে একই বিছানায় নিস্তব্ধ দুটি প্রান দু’প্রান্তে! মন ডাকে মনকে, কে জানে পৌছেছে কি-না সেই হাক সীমান্তে!
চলবে।