“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৯
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে সবার আগে উঠুন বাড়িঘর ঝাড়ু দিলো নাফিসা। এবাড়িতে কাজে হাত লাগানোর পর থেকে প্রতিদিন সে-ই বাড়িঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার রাখে। জেরিনের হাতে কখনো ঝাড়ু দেখেছে কিনা সন্দেহ! বড় ঘর ঝাড়ু দেয় হয়তো আবিদা বেগম নতুবা বড়মা। আর নাফিসা যদি দেখে তাহলে সে-ই ঝাড়ু দিয়ে দেয়। জেরিন কাজ বলতে শুধু রান্নার কাজটাই এগিয়ে দেয়। আর যদি নাফিসাকে আগে যেতে দেখে তো তার অসুস্থতার রেশ নেমে আসে আর যদি পরে যেতে দেখে তো আঁকাবাঁকা কথা বলে খোচা দেয়। তখন নাফিসারও ইচ্ছে করে কিছু একটা বলে দিতে। কিন্তু আবিদা বেগম পাশে থাকলে কিছু বলতে পারে না। যতই হোক, বাবা মায়ের সম্মানটা একটু বুঝতে শিখেছে। তাই আগের মতো সর্বদা পাগলামি না করে এখন সুযোগ বুঝেই উল্টো ধাওয়া দেয় সে।
ঝাড়ু দেওয়া শেষে সে হাতমুখ ধুয়ে রান্নার আয়োজন করতে বড় ঘরে এলো। বড়মা তাকে দেখে রুমে ডাকলেন। নাফিসা রুমে এসে বড়মাকে সালাম দিলো। তিনি জবাব দিয়ে বসতে বললো। আলমারি থেকে একটা বাক্স নিয়ে নাফিসার কাছে এসে বসলো। বাক্স খুলে একজোড়া বালা বের করে বললো,
– দেখতো মাপ টা ঠিক আছে কি-না?
– এটা কার?
– তোর।
– স্বর্ণের?
– হ্যাঁ। পড়।
– আমি এসব পড়বো না, বড়মা। অলংকার আমার ভালো লাগে না।
– মেয়ে মানুষের আবার অলংকার ভালো না লাগে! তাছাড়া বউদেরও তো একটা সৌন্দর্যের ব্যাপার আছে। নাক কান গলা হাত সব খালি। বউয়ের সৌন্দর্যের অভাব আছে তোর মাঝে। পড়ে দেখ ভালো লাগবে। জেরিনকে একজোড়া দিয়েছি, বিয়ের পর তোর হাতের মাপ দেখে এটা গড়ে নিয়েছি। আয়োজন করলে তো আরও আগেই ব্যবস্থা করা হতো।
নাফিসা বালা জোড়া হাতে পড়ে নিলো। সাইজ ঠিকই আছে। বড়মা হাসিমুখে বললো,
– এবার বউ বউ লাগছে। নাকে একটা পিনও তো পড়তে পারিস আপাতত।
– বড়মা, এসব কি বাধ্যতামূলক! আগের দিনের লোকেরা কুসংস্কারে বিশ্বাস করতো তাই এসব পড়তো। এর কিন্তু কোনো রীতিনীতি নেই।
– কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে কে বললো! আমি তো শখ করে দিলাম। তবে একটা জিনিস কিন্তু মানতে হয়, অলংকারে মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। তুই এটাই ভেবে দেখ, জেরিনকে দেখে যে কেউ বলবে সে এবাড়ির বউ আর তোকে দেখে বলবে নিশাতের মতো তুইও এ বাড়ির মেয়ে! এর কারণ কি হতে পারে বলতো?
– সাজসজ্জা ?
– হ্যাঁ, আর এই সাজসজ্জা ধারণ করলে নিজের মধ্যেই একটা আলাদা ভাব আসে। নিজেকে দায়িত্বশীল মনে হয়। সবসময় পড়ে থাকবি, দেখতে ভালো লাগে।
– হু, স্বর্ণের বালা সবসময় পড়ে থাকি আর দিনদুপুরে ডাকাতি হয়ে যাক!
বড়মা হেসে বললো,
– ধুর! আমরাও তো পড়ি, কই? হয় নাকি এমন কিছু! আর একটু সাবধানে থাকলেই হয়, আল্লাহ ভরসা।
– রান্না কি বসাবো?
– যা, আসছি আমি।
নাফিসা চলে গেলো কিচেনে। জেরিন কাজ থেকে ছুটি নেওয়ার জন্য এসে একবার বুলি ছেড়ে গেলো তার জ্বর জ্বর লাগছে। নাফিসা ভেবে পায় না মানুষ এমন কেন হয়! কিছু করবি না যখন এতো বাহানার কি প্রয়োজন! মনে মনে কারো সাথে হিংসে করারই বা কি প্রয়োজন! এতে ক্ষতি ছাড়া তো কোন লাভ হচ্ছে না! এ কেমন স্বার্থপরতা! মানুষের মাঝে এতোটা ভেজাল কেন! স্পষ্টবাদী হতে পারে না তারা!
নাফিসা বড়মাকেও কাজে হাত লাগাতে নিষেধ করে একা একাই সব করতে চেষ্টা করলো কিন্তু বড়মা হাত লাগিয়েছে। আবিদা বেগম এসে কিছুক্ষণ বসেছিলো এবং কথা বলেছিলো বড়মার সাথে। আর বারবার নাফিসার হাতের দিকে তাকাচ্ছিলো যেটা নাফিসা লক্ষ্য করেছে। তাকাবেই না কেন! নাফিসাকে কাজ করতে বড্ড বিরক্ত করছিলো বালা দুটো! বারবার উপরে উঠায় আর ঢলঢল করে নেমে যায় হাতের কবজিতে! হাড়িপাতিল ধরতে গেলে ঠকঠক আওয়াজ হয়! বড়মাও বিষয়টি দেখে হেসে বলেছিলো, “খুব বিরক্ত করছে? আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
কাজকর্ম শেষে রুমে এসে বালা দুটো খুলে ড্রেসিং টেবিলে থেতলে রাখলো! চোখে মুখে বিরক্তিকর ছাপ স্পষ্ট! ইমরান দেখে বললো,
– কি হয়েছে?
– কোনো জড় পদার্থও যে এতো বিরক্ত করতে পারে আজ প্রথম উপলব্ধি করলাম!
– কে দিয়েছে?
– বড় মা।
ইমরান হাতে নিয়ে দেখে আবার রেখে বললো,
– সুন্দরই তো।
– সুন্দর হলেই কি, এসব পড়ে কাজকর্ম করা যায়! কেন যে মানুষ এসব পড়ে আল্লাহ জানে!
– কেন আবার! ভালো লাগে তাই পড়ে।
– না পড়লে কি হয়! কই আমার তো একটুও ভালো লাগলো না!
ইমরান তার মুখে এমন বিরক্ত ভাব দেখে বললো,
– বড় মা দিয়েছেন শখ করে, ইচ্ছে হলে পড়বে ইচ্ছে না হলে পড়বে না!
নাফিসা আর পড়লো না। চুপচাপ সে আলমারিতে তুলে রেখে দিলো। তার মতে যদি হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকা যায় তাহলেই কেবল এসব পড়ে থাকা যায়!
ইমরান অফিস চলে গেলেও নাফিসা ভার্সিটি যায়নি। কেন জানি ইচ্ছে করছে না যেতে। তাছাড়া নিশাতের এক্সাম সামনে হওয়ায় নিশাত এখন বাড়িতে আছে। বাড়িতেই তার সাথে সময় কাটবে ভালো।
বিকেলে ইমরান বাড়ি ফিরেছে আরমান ও অন্য এক লোকের কাধে ভর করে। নাফিসা নিশাতের সাথে পড়ছিলো রুমে। বাইরে হইচই শুনে তারা উভয়েই বেরিয়ে এলো। উঠুনে মাথায় ও পায়ে ব্যান্ডেজ করা ইমরানকে দেখে ভেতরটা ধুক করে উঠলো! নিশাত দৌড়ে উঠুনে বেরিয়ে এলো আর নাফিসা বারান্দার গেইট পর্যন্ত এসে দাড়ালো। আবিদা বেগমের কান্নাজড়িত কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে আর বড়মার একের পর এক প্রশ্ন! ইমরানকে রুমে এনে বসিয়ে আরমান ঘটনা খুলে বললো। আরমানের আগে সে অফিস থেকে বেরিয়ে রিকশা করে বাড়ির দিকে ফিরছিলো। জ্যামময় রাস্তায় কোনো এক ট্রাককে সাইড দিতে গিয়ে রিকশা একদম চাপিয়ে ফেলেছে ফুটপাতে। তবুও ধাক্কা লেগে রিকশা উলটে গেছে! আর ইমরান ছিটকে পড়েছে দোকানপাটের উঁচুনিচু সিড়িতে। সেই সূত্রে মাথায় আঘাত লেগেছে আর পায়ের উপর রিকশার চাকা পড়ায় চামড়া কেটে মাংসে দেবে গেছে কিছুটা! পরিচিত লোকজন আরমানকে খবর দিলে আরমান ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। আর নিয়ে যায় হসপিটালে।
বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ইমরানের ধারে কাছেই আছে সবাই। ওদিকে রান্নাবান্নাও যে পড়ে আছে। তার সবটা দুহাতে সামলে নিয়েছে নাফিসা। ইমরানকে সে যখনই দেখছে তখনই যেন তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে! কেন এমন হচ্ছে তার অজানা। জেরিন প্রায় পুরোটা সময়ই ইমরানের রুমে আছে অথচ সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই নাফিসার! সম্পূর্ণ সময়টা যেন তার অন্যমনস্কভাবেই কেটেছে! ঘুমানোর পূর্বে নাফিসা রুমে প্রবেশ করলো। ইমরান বসে আছে এখনো। নাফিসা অন্যমনস্ক থাকলেও বাড়িতে ফেরার পর থেকেই ইমরান লক্ষ্য করছে তার মুখ গম্ভীর। চোখ ভেজা ভেজা! কারো সাথে কোনো কথাও বলতে দেখেনি। সে নিজ থেকেই এখন জিজ্ঞেস করলো,
– খেয়েছো?
নাফিসা কোন জবাব না দিয়ে আলমারি খুললো। বালা জোড়া হাতে পড়ে তারপর আলমারি লক করলো। ইমরানের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– বসে আছেন কেন? শুতে পারবেন না?
– হুম, আবার এটা পড়লে যে?
– পড়িনি বলেই তো আজ আপনার এই অবস্থা হলো! তা না হলে কি আর হতো!
– কিসব আজেবাজে বলছো! গুজবে বিশ্বাস করো না। বিপদ এলে এমনিতেই আসে।
– হ্যাঁ, এমনিতে হলে আজই কেন আসতে হলো!
ইমরান কিছুক্ষণ তার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো ! কেননা ক্ষণিকের জন্য নাফিসারও আজ কুসংস্কারে বিশ্বাস এসে গেছে! তার ধারণা এটা রেখে দিয়েছিলো বলেই আজ ইমরানের সাথে এমন দুর্ঘটনা ঘটলো! মশারী টানিয়ে নাফিসা বললো,
– খাওয়ার পর ওষুধ খেয়েছেন আপনি?
– হ্যাঁ। রান্না কি আজ তুমি করেছো?
– কেন?
– লবন মনে হয় একটুও বেশি পড়েনি!
– কই, কেউই তো খেয়ে কিছু বললো না!
কথাটুকু বলে নাফিসা নিজেই বোকা বনে গেলো! ইমরান তো সেটাই বললো একটুও বেশি পড়েনি! তারমানে ঠিকই ছিলো! নাফিসা ইমরানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইমরানের ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসি লেগে আছে। নাফিসা খাটে উঠে মশারী ঠিক করতে করতে বললো,
– এমন ব্যাথা পেয়ে এসেছে তবুও হাসে কিভাবে মানুষ!
– ব্যাথা আমি পেয়েছি, তুমি কাদছো কেন! তাইতো একটু হাসানোর চেষ্টা করলাম!
– এতো বেশি কথা বলবেন না। এসব মস্করা আমি মোটেও পছন্দ করি না।
ইমরান বাম হাত বাড়িয়ে একটা মলম নিয়ে বললো,
– এটা লাগিয়ে দিতে হবে তোমার। পিঠে একটু কেটে গেছে।
শার্ট খোলা থাকলেও ইমরানের পড়নে আছে সেন্টু গেঞ্জি। নাফিসা মলম হাতে নিয়ে বললো,
– গেঞ্জি খুলুন।
ইমরান বামহাতে একটু টেনে বললো,
– তোমার হেল্প লাগবে।
– হাতেও ব্যাথা পেয়েছেন?
– কাত হয়ে পড়েছিলাম বিধায় ডান হাতের কনুই মচকে গেছে।
– মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব শেষ করে আসছে! একটু সাবধানে চলাফেরা করা যায় না! এতো তাড়া কিসের! দোয়াদরুদ তো মনে হয় মুখেই আনে না!
বিড়বিড় করতে করতে নাফিসা তার গেঞ্জি খুলে দিলো। পিঠের ছোট ছোট কাটাগুলোতে মলম লাগিয়ে দিতে গিয়ে সে নিজেই কেপে উঠছে! ইমরান তার বিড়বিড় শুনে জবাব দিলো,
– গাড়িতে যতবার উঠি আর যতবার নামি ততবার দোয়া পড়ি। এছাড়াও গাড়িতে থাকাকালীন দোয়া ইউনুস পড়ি।
নাফিসা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আজও পড়েছিলেন?
– হুম।
– তাহলে এক্সিডেন্ট হলো কেন!
– তোমার হয়েছে কি, বলোতো! কেমন যেন আজব টাইপের কথাবার্তা বলছো আজ! মানুষ হয়ে পৃথিবীতে এসেছি বিপদ-আপদ তো থাকবেই! এ সবই যে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা সেটা তুমি জানো না?
নাফিসা আর কোনো কথা বললো না। বিছানা ছেড়ে নেমে গামছা ভিজিয়ে মচকে যাওয়া কনুইয়ে জলপটি দিলো। একটা কাথা পেচিয়ে উচু করে ইমরানের আঘাতপ্রাপ্ত পায়ের নিচে রেখে দিলো। তারপর ঘুমানোর জন্য নিজের ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দিলো।
গতরাতে হালকা জ্বর অনুভব করছিলো ইমরানের দেহে। তাই ঘুম থেকে উঠেই আগে তার গালে ও গলায় হাত দিয়ে জ্বর পরিমাপ করলো নাফিসা। বেড়ে গেছে কিছুটা। দেহ থেকে হাত সরিয়ে নেওয়ার সময় চোখ পড়লো বুকের বাঁ পাশটায়! কেমন গতিতে হৃদস্পন্দন হচ্ছে সেটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে। এ পাশটা কাপছে। সেদিন রাতের কথা মনে হতেই ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো নাফিসার! ইমরান যখন হাত টেনে নিয়ে চেপে ধরেছিলো তখন যেন শকড লেগেছিলো তার দেহে! কিন্তু আজ বড়ই লোভাতুর হয়ে গেছে তার মন! সাহস দেখাতে সে কাপা কাপা ডান হাতটা আলতোভাবে রাখলো ইমরানের বুকের বাঁ পাশে। ভেতরের ঢিপঢিপ স্পন্দন যেন সরাসরি তার মস্তিষ্কে সাড়া দিচ্ছে! তা অনুভব করতে করতে কখন যে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলো তার খেয়াল নেই! কিন্তু চোখ খুলে দেখতে পেয়েছে ইমরান তাকিয়ে আছে তার দিকে! প্রত্যক্ষ লজ্জা পেয়ে নাফিসা দ্রুত হাত সরিয়ে নেমে গেলো বিছানা ছেড়ে।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭০
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকালেই রুমানা বেগম ও জহিরুল ইসলাম এসেছেন ইমরানকে দেখতে। ওদিকে আয়াত ও তুর্যসহ আরাফের পরিবারের সবাই এসেছে। দেখা সাক্ষাতের পর দুপুরের দিকে নিয়াজ উদ্দিন ও রুমানা বেগম চলে গেছেন আর আরাফরা বিকেলে চলে গেছে যদিও আয়েশা বেগম থেকে গেছেন। জেরিনের বড় বোনও এসেছিলো। স্কুল পড়ুয়া দুইটা ছেলে আছে তার। তার আচার-ব্যবহার জেরিন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নাফিসার কাছে বেশ ভালোই লেগেছে মারিয়াকে। সন্ধ্যার পর যখন আবিদা বেগমের সাথে আয়েশা বেগম ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিলো তখন নাফিসা রুমের সামনের ফাকা জায়গাটুকু ঝাড়ু দিচ্ছিলো। জিহান ও তার খালাতো ভাইয়ের খেলাধুলা করে ধুলোবালিতে ময়লা করে ফেলেছে। নাফিসাকে দেখে আয়েশা বেগম ঝাঝালো গলায় বললো,
– তোর ঘরের বিপদ-আপদ দূর হইবো কেমনে! দেখ দেখ কি করে! এই সাজ সন্ধ্যায় ঘর ঝাড়ু দেয় কেউ! বিয়া কইরা অলক্ষ্মী তুলছে ঘরে! বারবার মানা করছিলাম, শুনছিলি আমার কথা! এমন বউ ঘরে থাকলে তো অঘটন ঘটবোই! ওইদিকে একটা আমার ঘর জ্বালাইতাছে এইদিকে এইবার তোর ঘর ছাড়খাড় করবো!
আয়েশা বেগম নাফিসাকে মোটেও সহ্য করতে পারে না। এখানে আসার পর যখন সামনাসামনি হয়েছিলো তখনই তার ব্রু কুচকে মুখে বিরক্তিকর ছাপ নেমে এসেছিলো। তখন সেদিকে নাফিসা ভ্রুক্ষেপ না করলেও এখন আর চুপ থাকতে পারলো না। মুখের উপর জবাব দিয়েই দিলো,
– সাবধানে কথা বলুন! উল্টাপাল্টা কিথা আমি বলিও না আর কারো মুখে শুনতেও পারিনা! নিজের সংসারে তো আমার বোনটাকে একটু শান্তি দেনই না, এখন আবার আসছেন আমার সংসার জ্বালাতে!
– নাফিসা!
আবিদা বেগম একটা ধমক দিলো নাফিসাকে আর আয়েশা বেগম রেগে তেলে বেগুন জ্বেলে উঠলো! আর কর্কশ কণ্ঠে বললো,
– কি? কি কইলা? আমি জ্বালাই? তোমাগো মতো দুই একটা কাল থাকতে আমার জ্বালাইতে হয়!
– তা নয় তো কি! আপনার মতো এমন বদ মহিলা দুনিয়াতে আমার চোখে আর একটাও পড়েনি! মেহমান হয়ে আসছেন, মেহমানের মতো থাকেন! সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাকা করতে আমিও জানি! আমি কিন্তু নাজিয়া না! সুতরাং নাফিসা হইতে সাবধান থাকেন খালা….আম্মা!
– দেখছোস, দেখছোস খালি ক্যামনে কথা কয়!
আবিদা বেগম ধমকে উঠলেন,
– কত্ত বড় স্পর্ধা তোমার! আদব কায়দা শিক্ষা দেয় নাই! জেরিন কইছিলো পরেই মানা করছিলাম আমি! পোলা কি আর আমার কথা শুনছে! ক্যামনে বশ কইরা রাখছে কেডা জানে!
– আম্মা, আপনি দয়া করে এমন উল্টাপাল্টা কিছু বলবেন না! যথেষ্ট সম্মানিত দৃষ্টিতে মর্যাদা দিয়েছি আমি। আপনার বোনের মতো আচরণ করে সেই মর্যাদার ক্ষুন্ন করবেন না আশা করি!
– চুপ করো! বেয়াদব মাইয়া! আবার মুখে মুখে তর্ক করে! ব্যাবহারেই নাকি বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। খুব ভালাই পরিচয় করায় দিছো!
আয়েশা বেগম আবার গলা বাড়িয়ে বললো,
– থাক, চুপ কর আবিদা!
– বুবু গো, পোড়াকপালি আমি! কি পাপ যে করছিলাম আল্লাহ জানে! মান সম্মান তো যা যাওয়ার গেছেই এহন দেখছি শান্তিও উইড়া যাইবো! একটার পর একটা অঘটন ঘইট্টাই যায়! একজনরে তো চিরতরে উঠাইয়াই নিছে এহন কি সন্তানদেরও কাইরা নিয়া নিঃস্ব করবো আমারে! নামাজ পড়ি আর আল্লাহর কাছে কই, আমার বাচ্চাগুলারে যাতে বিপদ মুক্ত রাখে! আল্লাহ কি আমার ডাক শোনে না! এত বিপদ দেয় কে!
কথা বলতে বলতে আবিদা বেগম কান্না শুরু করেছে। বংশের কথা বলায় নাফিসা চুপসে গেছে! খুব লেগেছে মনে! পরিবার নিয়ে কোনো বাজে কথা শুনতে পারে না সে! কান্না চলে আসে তার! এখন যদি কোনো জবাব দিতো হয়তো মা বাবার নাম ধরেও বকা দিয়ে যেতো যেটা মোটেও সহ্য করতে পারতো না সে! তাছাড়া কথায় কথা বাড়ে। এর উপর বাড়িতে একজন অসুস্থ ব্যক্তি। এখানে তার একমাত্র শক্তি সেই ব্যক্তি। কথা যদি প্রকট আকার ধারণ করে তাহলে হট্টগোল বেধে যাবে! হয়তোবা ইমরানও তার পরিবারের সাপোর্ট করবে। তখন তার কি হবে সবাই যদি তার বিপক্ষে কথা বলে! বাবা-মাও তো তার উপর ভরসা না করে ভেবে নিবে অতিরিক্ত চঞ্চলতার সাথে বেয়াদবি করেছে তাদের মেয়ে! যেটা করতে বরাবরই সাবধান করা হয়েছিলো তাকে! পৃথিবীর প্রাণগুলো এমন কেন! মনুষ্যত্ব শব্দটার সাথে তারা এতো অপরিচিত কেন! কি হয় যদি একটু ভালো কাজ করে! কি হয় সবার সাথে যদি একটু ভালো আচরণ করে! এতে কি খুব ক্ষতি হয়ে যায়! মানুষ এতোটা স্বার্থপর কেন! তারা নিজেরা অন্যের ভালো আচরণ লাভের প্রত্যাশা ঠিকই করে অথচ নিজেরা তা অন্যের সাথে বিনিময় করতে পারে না! যেটা আমি পারবো না সেটা অন্যের কাছ থেকে পাওয়ার প্রত্যাশা কি করে করতে পারি! এই বোধটুকু কি মানুষের মগজে আটে না! ভাবতে ভাবতে নাফিসা চুপচাপ তার কাজের বাকিটুকু সম্পন্ন করে নিলো এবং এঘর ত্যাগ করে তাদের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। ইমরানের কাছে বড়মা, আরমান ও জেরিন আছে। আরমান সাথে এক লোককে নিয়ে এসেছে দেখা করতে , তাদের আশেপাশের কেউ হবে হয়তো। তারা এক্সিডেন্ট নিয়েই কথা বলছে। তাই নাফিসা নিজ রুমে প্রবেশ না করে নিশাতের রুমে চলে গেলো। এখানে নিশাত ও জিহান আছে। নিশাত পড়ছে আর জিহান একা একা খেলা করছে। নাফিসা কারো সাথেই কোনো কথা বললো না। মনমরা হয়ে চুপচাপ শুধু খাটের কোনে বসে রইলো।
কিছুক্ষণ পর জিহানকে ডাকতে জেরিন এলো এই রুমে। নাফিসাকে এখানে বসে থাকতে দেখে বললো,
– এ-ই বউয়ের দায়িত্ব! হাসব্যান্ড এর কিছু প্রয়োজন আছে কি-না সেটা দেখার জন্য তো রুমে উঁকিও পড়লো না!
নাফিসা বিরক্তিকর মনোভাব নিয়ে জবাব দিলো,
– আমার আর কি প্রয়োজন! ভাবি কি কম সেবাযত্ন করছে তার দেবরের! বাকিসব ছেড়ে তো ভাবি দেবরের সায়াহ্নে বসে আছে সারাদিন। সেখানে নিশ্চয়ই সেবার কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়! আমাকে তো আনা হয়েছে চাকরানী হিসেবে যার কাজ, কেবল ঘরের কাজকর্ম করা!
কথাটুকু বলে নাফিসা তার রুমে এলো। আরমান চলে গেছে, শুধু বড়মা বসে আছে এখনো। নাফিসাকে দেখে তিনি উঠে পড়লেন। ইশার আযান দিয়েছে তাই নামাজ পড়তে যাবেন। যাওয়ার সময় নাফিসাকে বললেন,
– রান্নাবান্না শেষ নাফিসা?
– হ্যাঁ।
– কি হয়েছে তোর? মুখটা এমন মলিন কেন?
– কিছু না।
– ইমরানের জন্য টেনশন করছিস? চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ, সুস্থ হয়ে যাবে তারাতাড়ি।
বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো বড়মা। নাফিসা বাইরে জেরিনের কথা শুনছিলো। তার মনে হলো সে জিহানকে নিয়ে আসছে হয়তো এ রুমের দিকে। তাই এসে দরজা আটকে দিলো নাফিসা। সব কিছু বিরক্তিকর মনে হচ্ছে এখন তার কাছে। ইমরান বললো,
– কি হয়েছে গো মহারানী?
– এতো ন্যাকামোর কি প্রয়োজন! সরাসরি চাকরানী বলে ডাকতে পারেন না!
নাফিসার মেজাজ দেখে ইমরানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে গেলো! নাফিসা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাটুকু বলে অগোছালো আসবাবগুলো গুছিয়ে রাখলো। কিছু একটা হয়েছে ইমরান নিশ্চিত। নাফিসাকে এভাবে কাজ করতে দেখে বললো,
– ওই বইটা একটু দাও তো।
নাফিসা সেল্ফ থেকে বই নিয়ে প্রায় ঢিল দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু ইমরানের অবস্থা দেখে আবার থেমে গেলো। কাছে এসে ঠিকভাবেই দিয়ে চেয়ারগুলো ঠিক করে রাখলো। অতপর বিছানার একপাশে এসে শুয়ে পড়লো। ইমরান তার দিকে একটু চেপে বসে কাধে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো,
– মনটা এতো বিষন্ন কেন? কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে?
নাফিসা মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনার মা নিষেধ করেছিলো না আমাকে বিয়ে করতে?
ইমরানের ব্রু হালকা কুচকে গেলো! নাফিসার দুচোখ টলমল করছে! অশ্রু গড়াতেও সময় নিলো না তার! ইমরানকে জবাবহীন তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার বললো,
– বলছেন না কেন?
– হ্যাঁ।
– তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?
– তার কারণ তো আগেও একবার বললাম!
– এখন যদি আপনার পরিবারের বাকি লোকজন আমাকে পরিবার থেকে বহিষ্কার করতে চায় তাহলে আপনি কি করবেন?
– কিসব বলছো! এমন কিছুই হবে না।
– না হওয়ার কি আছে! আমি অলক্ষ্মী, আর অলক্ষ্মীকে কি কেউ ঘরে জায়গা দেয়!
– পাগল হয়ে গেছো! এসব কি বলছো!
– আমি পাগল হইনি! এসব বলাতে যদি পাগল মনে করা হয় তাহলে আপনার মা আর খালা পাগল হয়ে গেছে! বারবার আপনাকে নিষেধ করেছিলো তবুও আপনি কেন আমাকে বিয়ে করতে গেলেন! বউ কি এখন পরিবারের বাইরে রেখেছেন? এমন পাগলময় পরিবারে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়!
– আমি তোমার কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারছি না! ক্লিয়ার বলো।
– সারাদিন আপনার ভগ্নীরা খেলাধুলা করে ঘর ময়লা করে ফেলেছে। একা একা রান্না শেষ করে সন্ধ্যায় ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলাম বলে আপনার খালাম্মার উক্তি, আমি অলক্ষুণে তাই এমন সব কাজকর্ম করছি! আমি অলক্ষুণে তাই আপনি এমন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন! আমি অলক্ষুণে তাই এ পরিবারে কখনো শান্তি আসবে না। মুখের উপর জবাব দিতে গেলেও আমি বেয়াদব! আর এক দুশ্চরিত্রা ডাইনী তো আছেই আঁকাবাঁকা কথা শুনানোর জন্য। একটা কথা খুব ভালো করে জেনে রাখুন, এসব অত্যাচার আমি কখনোই সহ্য করতে পারবো না। চোখের সামনে কোনো অন্যায় এই নাফিসা সহ্য করতে জানে না! যদি খুনখারাবিরও প্রয়োজন পরে, নিশ্চিত লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে! এরপর যা হওয়ার হবে! তবে আজ কেবল চুপ ছিলাম, কেননা আপনার খালার মতো জঘন্য মানুষ সোজা আঙুল তুলবে আমার পিতামাতার দেওয়া শিক্ষার উপর! শুনতে খারাপ লাগলেও একটা সত্য কথা জানেন তো? আপনার এই আন্টি একজন স্টুপিড মহিলা! কখনো কারো ভালো চাইতে জানে না! কেবল মানুষের অমঙ্গল কামনা করতে জানে আর অভিশাপ দিতে জানে! ওদিকে আমার বোনটাকে একটুও শান্তি দেয় না আর এদিকে আমার সংসারে আসছে আগুন ধরিয়ে দিতে! আপনার মা-ও ঠিক সেই তালেই নেচে যাচ্ছে! আর আপনার কাছেও একটা অনুরোধ, কখনো আমার পক্ষ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না! আপনার এই পরিজন বিন্দু মাত্র অপেক্ষা করবে না এটা বলতে যে, ছেলে বিয়ে করে বউ পাগলা হয়ে গেছে আর বউয়ের কথায় এখন নেচে যাচ্ছে! অন্যথায় আমাকে যদি উল্টাপাল্টা বলে শ্বাসাতে আসেন তো আপনি বলেও ছাড় দেবো না মাইন্ড ইট। এখন বউ রাখবেন কি রাখবেন না সেটা আপনার ব্যাপার! আর আপনার পরিবার দ্বারা যদি আমার বাবা-মা বিন্দুমাত্র কষ্ট পায় তো নিজ হাতে শেষ করে দেবো আপনার এই পরিবার। নারী গড়তেও পারে আবার ধ্বংসও করতে পারে!
দুহাতে চোখ মুছে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে নাফিসা। চোখ মুছলেই কি হবে, বালিশ তো ঠিকই ভিজে যাচ্ছে! আর ইমরান নিস্তব্ধ! এতোক্ষণ বলা কথাগুলো শুনে তার কখনো কষ্ট লেগেছে, কখনো রাগ হয়েছে আবার কখনো হাসিও পেয়েছে! কিন্তু কোনটাই বাইরে প্রকাশ পায় নি! সে সোজা হয়ে বসে চুপচাপ বইটা খুলে মনে মনে পড়তে লাগলো। আর এদিকে একটু পরপর নাফিসার নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে! কিছুক্ষন পর নিশাত বাইরে থেকে ডাকলো,
“ভাবি, বড়মা তোমাকে ডাকছে ভাইয়ার খাবার নিয়ে আসার জন্য। ভাবি?”
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। ইমরান বললো,
“নিশাত, নাফিসার মন খারাপ। তুই নিয়ে আয় খাবার। নাফিসারটা সহ।”
নিশাত কোনো জবাব না দিয়ে চলে গেলো। শুনেছে কি-না কে জানে! একটু পরেই আবার নিশাতের ডাক পড়লো। খাবার নিয়ে এসেছে সে। ইমরান নাফিসাকে দরজা খুলতে বললো কিন্তু নাফিসা কোনো সাড়া দিলো না। ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। অথচ একটু পরপর নাক টানছে! বাধ্য হয়ে ইমরান নিজেই বিছানা থেকে নামতে যাচ্ছিলো। টের পেয়ে নাফিসা দ্রুত উঠে ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে এসে দরজা খুলে দিলো। ইমরান আবার বিছানায় উঠে বসলো। নিশাত প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
– কি হয়েছে ভাবির?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। ইমরান বললো,
– মন পিছলে পড়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে তোর ভাবির!
নিশাত হেসে উঠলেও নাফিসা কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। দরজার বাইরে জেরিনকে বাটি নিয়ে আসতে দেখে নাফিসা এসে তার হাত থেকে বাটি নিয়ে নিলো। জেরিন বললো,
– তোমার আবার কি হলো! ভঙ ধরে আজ খাবার আবার এঘরে আনতে বললে কেন! এইটুকু যেতে পায়ে ঠোসা পড়ে যায়?
– কথা যত কম বলবেন তত ভালো থাকবেন। বেশি কথা বললে আবার দন্তহীন হয়েও যেতে পারেন!
– মানে!
– আমি কাউকে বলিনি আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতে! নিজের পেট ভরে শান্তি থাকুন। আর অন্যের পেছনে লাগা বন্ধ করুন। না হয় উল্টো তীর নিক্ষেপ হবে!
– ইমরান, দেখেছো দেখেছো কত বড় স্পর্ধা এইটুকু মেয়ের মাঝে! আগেই বলেছিলাম একটুও ভালো হবে না এই মেয়ে!
– বললেই কি হবে ভাবি? দুনিয়াতে ভালো মানুষ খুজে পাওয়া যে দুষ্কর! একটাও তো খুজে দিতে পারলেন না ভালো মেয়ে!
– খুজতে সময় দিয়েছো তুমি?
– আপনি এখন দয়া করে যান তো ভাবি! বউকে বকেছি, তাই বউ এমনিতেই লাল মরিচ হয়ে আছে! অযথা কথা বাড়িয়ে এখন পচন ধরানোর কোনো প্রয়োজন নেই!
নিশাত তাদের কথা শুনে একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে! বেশ ভালোই বুঝতে পারছে তার ভাবিরা একে অপরকে দেখতে পারছে না! তবে এখানে জেরিনের দোষটাই একটু বেশি আটলো তার চোখে। কেননা খাবার নিয়ে নাফিসাকে এমন খোচা দিয়ে কথাটা নাও বলতে পারতো সে! কথা সংক্ষেপ করতে নিশাত বললো,
– আপু, চলোতো! অযথা কথা বাড়িয়ো না!
– আমি কথা বাড়াই! খুব ভালো পক্ষ নিয়ে কথা বলতে পারিস এক একজন! আর আমিই সবার চোখে খারাপ!
রাগান্বিত হয়ে জেরিন বেরিয়ে গেলো। নাফিসাও ঠাস করে আবার দরজাটা চাপিয়ে দিলো। খাবারদাবার ঠিক করে ইমরানের সামনে দিয়ে সে আবার শুয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। ইমরান বললো,
– তুমি খাবে না?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ শুয়ে আছে। তাকে শুনিয়ে ইমরান নিজের সাথেই বলতে লাগলো ,
– সকালে মা খায়িয়ে দিয়েছে, দুপুরে বড়মা খায়িয়ে দিয়েছে। কারণ তো একটাই, ডান হাতটা যে মচকে গেছে! কিন্তু এখন কি যে করি! পেট তো গুরুম গুরুম করছে! আবার ওষুধও খেয়ে হবে!
হঠাৎ করেই নাফিসা বলে উঠলো,
– শান্তি দিবেন না নাকি একটু! সবসময় আমাকে জ্বালাতন করে খুব মজা পান!
– সরি? আমি তো তোমাকে কিছু বলিনি!
নাফিসা রাগান্বিত হয়ে উঠে বসলো। হাত ধুয়ে প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখতে লাগলো। এক হাতে ভাত মাখছে আর অন্যহাতে ওড়না দ্বারা চোখ মুছছে! ইমরান তাকিয়ে শুধু দেখছে তাকে! আর এদিকে নাফিসার খুব অসস্তি লাগছে! ছোট বাচ্চাদের খায়িয়ে দেওয়া যায় কিন্তু এতো বড় লোকের ক্ষেত্রে সেটা কিভাবে সম্ভব! তবুও কাপা কাপা হাতে লোকমা তুলে ধরলো ইমরানের মুখের সামনে। ইমরান বললো,
– ডাক্তার বলেছে লবন মরিচ ঠিক পরিমানে খেতে। দেখতো তো আছে কি-না!
– আপনি এখন খাবেন নাকি খাবেন না?
– একের পর এক এমন ধমকি দিলে তো ক্ষুধা এমনিতেই মজে যাবে! তুমি আগে মুখে দাও তারপর আমি খাবো।
– কোনো প্রয়োজন নেই তো! আপনাদের কথাবার্তা শুনেই আমার পেট ভরে যায়। তাছাড়া খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।
– তাহলে কিন্তু আমি খাবো না।
– না খেলে নাই!
নাফিসা প্লেট রেখে হাত ধুয়ে নিলো। এ যে অসম্ভব জেদী! তাই ইমরান আবার বললো,
– আমার ওষুধ খেতে হবে।
– তো আমি কি করবো!
ইমরান তার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে বসিয়ে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
– এমন কেন করছো তুমি! ভালো খারাপ মিলেই তো এই জগৎ। সেখানে এসব আলতু ফালতু বিষয় নিয়ে নিজের ক্ষতি করা কি বোকামি না? নিজে একটু ইজি হও, দেখবে সব ঠিক আছে। আমি তো জানিই তুমি একজন সাহসী মেয়ে। পরিস্থিতি সামলে নিতে খুব ভালো জানো। তবে এতোটা রিয়েক্ট করছো কেন! আর আমার এতে কি দোষ আছে সেটা বল, যার কারণে আমার সাথেও এতো রাগ দেখাচ্ছো! নিজের তো ক্ষতি করছোই আমারও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছো। এতো নড়াচড়া করছো কেন? আমার হাতে ব্যাথা তো!
প্রথমে ছোটার জন্য চেষ্টা করলেও এখন থেমে গেছে নাফিসা। পারতো জোরাজুরি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। কিন্তু ইমরান অসুস্থ হওয়ায় করেনি সেটা। তাছাড়া তারই বা কি দোষ! তা ভেবে অবশেষে ইমরানকে আকড়ে ধরেই আরও জোরে কান্না করে দিলো সে! কাদতে কাদতে কিছু বলছেও সে কিন্তু কি বলেছে তা অস্পষ্ট! তবে ইমরান এটা বুঝতে পেরেছে তার মনের কষ্টটাই কান্নার সাথে প্রকাশ করছে। কয়েক মিনিট কান্নার পর ইমরান যথাসম্ভব তাকে শান্ত করলো। এবং দুজনেই খেয়ে নিয়েছে। অত:পর প্লেট ধুয়ে নিজেই চুপচাপ রেখে এসেছে বড়ঘরে। বহু প্রতিক্ষার পর আজ রাত ইমরান অভিমানী নাফিসার মাথা বুকে জড়িয়ে কাটাতে পেরেছে!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭১
(নূর নাফিসা)
.
.
জহিরুল ইসলাম বাড়ি ফেরার পরদিনই নাহিদা অফিসের কাজকর্মে নিয়োজিত হওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করছিলো। অত:পর তিনি ম্যানেজারকে ডেকে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিলেন অফিসটা ঘুরে দেখানোর জন্য। তাদের এমন সব কান্ড দেখে মেহেদীর খুব রাগ হচ্ছিলো! যার ফলে সে আর যায়নি অফিস! সারাদিন বাসায়ই থেকেছে আর নিজের ভ্রান্তিময় কর্মের জন্য মনমরা হয়ে বসে ছিলো বাসায়।
অফিসে নাহিদাকে প্রথমে সিইও, পিএ, ম্যানেজার এবং স্টাফদের ডেস্ক দেখানো হলো। এমন অফিসে তাদের কি কাজ হয় সেটাই তার মাথায় ঢুকছে না! একটা অফিসের কাজকর্ম কি শুধু খাতা কলম আর ফাইল নিয়েই আবদ্ধ থাকে!
ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে সে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো,
– আংকেল, এখানে তো সবাই খাতা কলম নিয়ে ব্যস্ত! কাউকে তো কোনো প্রোডাকশনের কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না!
– আছে তো মেডাম। আপনাকে এতোক্ষণ যাবত শুধু অফিসিয়াল কাজকর্মের প্লেসটা দেখালাম। কেননা আপনার কাজ এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আপনি কি ফিল্ড ওয়ার্ক দেখতে চান?
– হ্যাঁ।
– তাহলে চলুন, আমরা নিচ তলায় যাই।
ম্যানেজারের সাথে ছয় তলা থেকে লিফটের সাহায্য প্রথম তলায় নেমে এলো নাহিদা। এই হচ্ছে একটা কোম্পানির মূল কর্মস্থল! এখানে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অবস্থান! সাধারণ বাতির আলোয় আলোকিত সম্পূর্ণ ভবন! সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। মাথার উপর বৈদ্যুতিক পাখা চলছে তবুও বেশ গরম! মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ক্ষুধা নিবারণ করছে, সংসারের চাহিদা মেটাচ্ছে শত শত মানুষ! আর উপর তলা ছিলো সচ্ছল! পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন! রকমারি লাইটিং! পরিবেশ শীতল করে রেখেছে এয়ার কন্ডিশনার! এ যেন এক নরক আর সে যেনো এক স্বর্গ! বিষয়টা এমন হয়ে দাড়িয়েছে নাহিদার দৃষ্টিতে! তবে প্রকৃত জীবন দেখতে হলে সেই ছয় তলা নয়, এই প্রথম তলায়ই অবস্থান করতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে তাদের জীবন ব্যবস্থা। সেই ভেবে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো নাহিদা। সম্পূর্ণ এরিয়া ঘুরে সে আবার ষষ্ঠ তলায় চলে এলো। তাকে জহিরুল ইসলামের কেবিনেই বসার জন্য বললো ম্যানেজার। নাহিদা কেবিনে প্রবেশ করেছে ঠিকই, কিন্তু জহিরুল ইসলামের আসন দখল করেনি। সে বিপরীত দিকের ছোট চেয়ারে অবস্থান করেছে। ওটা তার সম্মানিত শ্বশুরের জন্য বরাদ্দ। সেই সম্মানের জায়গা সে দখল করতে চায় না। তবে নিচু পদে যুক্ত হয়েই নিজেকে একটু স্বাবলম্বী করতে চায়।
আজ তার কাজ কিছুই ছিলো না। শুধু পরিচিত হওয়া আর ঘুরেফিরে দেখাটাই যেন তার কাজ।
বিকেলে বাড়ি ফিরেছে সে। মেহেদীকে বাড়িতেই পেয়েছে। ঘুমাচ্ছিলো মেহেদী। সে চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে নিলো। সন্ধ্যায় আবার অফিসের গল্প করতে করতে নাহিদা মেহেরুনের সাথে রাতের খাবার তৈরি করে ফেললো। জহিরুল ইসলামকে খাবার দিতে গেলে তখন তিনি জানতে চাইলেন অফিসে কেমন কাটলো তার সময়। নাহিদা উত্তরে জানিয়েছে তার বেশ ভালো লেগেছে।
প্রথম দিন নাহিদা বোরকা হিজাব পড়ে অফিস গেলেও, দ্বিতীয় দিন থেকে শাড়ি আর হিজাব পড়ে অফিস যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। শাড়িতে বেশ সুন্দরী হয়ে উঠে বাঙালি নারী। নিজের কাছেই এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। শাড়ি পড়লে মনে হয় যেন নতুন করে বাঙালীর ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটেছে। আর সে প্রকৃত বাঙালির রূপ ধারণ করতে পেরেছে! যদিও সবসময় সম্ভব হয় না তবুও ভালো লাগে শাড়ি।
নাহিদা যাওয়াতে মেহেদী রাগ করে অফিস না গেলেও পরদিন ঠিকই গিয়েছে। কেননা বাসায় সময় ভালো কাটছে না। অফিসে গেলে সময়ও কাটবে আবার কাজও হবে। যদিও এটা ভালো লাগছে না যে, নাহিদা অফিস যাচ্ছে!
অফিসের জন্য বের হওয়ার পূর্বে বারবার সে তার মাকে বলে গেছে প্রয়োজন হলে যেন কল করে। আর বাবা তো কোনো কথাই বলে না! নাস্তা শেষ করে চালাকি করে সে নাহিদার আগে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে অফিস চলে গেছে! নাহিদা নিচে এসে ড্রাইভারের কাছে জেনে বিরক্ত হলো মেহেদীর উপর! কেননা জহিরুল ইসলাম তাকে শুরুতেই বলে দিয়েছে গাড়িতে আসবে এবং যাবে! কিন্তু এই মেহেদীটা হতে দিলো না তা! এখন যদি তিনি জানতে পারে, তাহলে কি টেনশন করবে না! সেই ভেবে নাহিদা ড্রাইভারকে বলে দিলো জহিরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করলে যাতে বলে দেয়, সে মেহেদীর সাথেই অফিস গেছে।
নাহিদা রিকশা নিয়ে একটু লেট করেই চলে এলো অফিস। জহিরুল ইসলামের কেবিনে এসে দেখলো মেহেদী টেবিলের কাছে দাড়িয়ে ফাইল দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছে ম্যানেজারের সাথে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে নাহিদাকে দেখতে পেল সে। তারা কথা বলছে বিধায় নাহিদা বেরিয়ে এসে ডেস্কের সামনে দিয়ে হাটতে লাগলো। কেউ কেউ তাকে দেখে জিজ্ঞেস করছে ভালোমন্দ, সে-ও তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। সবাই যখন কাজে ব্যস্ত তখন নাহিদার এক রকম বোরিং লাগছে! কেননা, কর্মস্থলে কেবল সে ই এমন অবসর সময় কাটাচ্ছে! কি-ই বা তার কাজ সেটাই তো জানে না! যে জানাবে সে তো মেহেদীর সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত! তিন দিকের সারি সারি ডেস্কগুলোর মধ্যে একটা ডেস্ক ফাকা! স্টাফ আসেনি মনে হয়। বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকায় নাহিদা সেখানেই বসে পড়লো। ফোনটা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করলো কিন্তু মন টিকছে না! পরক্ষণে আশেপাশের মানুষদের দেখে দেখে পর্যাবেক্ষণ করতে লাগলো। কে কতটা মনযোগ দিয়ে কাজ করছে, কে কতটা ফাকি দিচ্ছে সবটাই স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে চোখে। হঠাৎ কেউ একজন তার সামনে এসে দাড়ালে আৎকে উঠলো নাহিদা! সামনে দাড়িয়ে থাকা লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই কিশোর ছেলেটা দাতের পাটি বের করে হাসি দিয়ে বললো,
– মেডাম, আপনের কফি।
নাহিদা একটু নেড়েচেড়ে বসে বললো,
– আমি কি কফি অর্ডার করেছিলাম?
ছেলেটা শব্দসহযোগে হেসে বললো,
– না, মেডাম। তবে স্যারের অর্ডার দেওয়া আছে।
– কোন স্যার?
– ম্যানেজার স্যার।
– ম্যানেজার স্যার কেন অর্ডার করবে! আমি তো উনাকেও বলিনি!
– আপনে না কইলেই কি, বাড়ি থাইকা বড় স্যার তো ঠিকই অর্ডার কইরা দিছে।
নাহিদা হাত বাড়িয়ে কফির কাপটা তার নিজের দিকে টেনে আনলো। ছেলেটা এখনও দাড়িয়ে আছে কেন! না বুঝতে পেরে নাহিদা বললো,
– আপনাকে কি আবার বকশিস দিতে হবে?
– না, মেডাম! দোয়া দিলেই হইবো।
– তাহলে দাড়িয়ে আছেন যে! কিছু বলবেন?
– কফির লগে কি টোস্ট দিমু?
– না, এটাই ঠিক আছে।
– আইচ্ছা। বড় স্যার কিরুম আছে?
– আলহামদুলিল্লাহ। ভালো।
– মেডাম আরেকটা কথা, আপনে খুব সুন্দরী। মাইন্ড কইরেন না, আমি সত্যি কথা কইয়া দেই।
কথাটা বলেই ছেলেটা হাসিমুখেই চলে গেলো। কিন্তু নাহিদা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে এমন মন্তব্যে! পরক্ষণে কফির মিষ্টি সুবাসে কাপটা হাতে নিয়ে গরম কফিতে চুমুক দিলো। একটা লোককে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলতে দেখছে নাহিদা। এই মাত্র মেহেদী আর ম্যানেজারকে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে সাথে সাথেই লোকটা ফোন নামিয়ে নিয়েছে। মেহেদী তার ডেস্ক অতিক্রম করে আসতেই ফোন কানে দিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে কল কেটে ফোন রেখে দিলো! পরক্ষণে কলম হাতে নিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো! কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে লোকটার চালাকি দেখছিলো নাহিদা। এতোক্ষণে মেহেদী যে তার পাশে চলে এসেছে সেই খেয়ালই নেই তার! ধ্যান ভাঙলো ম্যানেজারের কথায়!
– মেডাম, আপনি স্যারের রুমে গিয়ে বসুন। আমি নিচ থেকে একটু আসছি।
নাহিদা একবার মেহেদীর দিকে তাকিয়ে আবার ম্যানেজারকে বললো,
– না, থাক। এখানেই ঠিক আছি। আপনি যান, আমি এখানেই আছি।
ম্যানেজার চলে গেলো কিন্তু মেহেদী এখানেই দাড়িয়ে থেকে বললো,
– এখানে ঠিক থাকা যাবে না। উঠুন এবং প্রয়োজনে বাসায় গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। অফিসে আপনার প্রয়োজন নেই।
নাহিদা তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে নিচু স্বরে বললো,
– প্রয়োজন আছে কি নেই সেটা আপনার না জানালেও চলবে। নাকে তেল দেওয়া আপনার কাজ হতে পারে কিন্তু আমার না। আমি আমার কাজেই এসেছি এখানে!
কথাটুকু বলে নাহিদা দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। মেহেদী তার পকেটে দুহাত রেখে বললো,
– তা অন্যের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করাই কি আপনার কাজ?
– মানে!
– আপনি আমার চেয়ারে বসে আছেন কেন! আমার কাজগুলো কি আপনি করে দিচ্ছেন?
– আমি আপনার চেয়ারে বসতে যাবো কেন! এখানে কি আপনার নাম লেখা আছে!
– চেয়ারে নাম থাকতে হবে, এমন কোনো কথা আছে! কিন্তু টেবিলে যে আমার নামটা লেখা আছে সেটা কি পড়ছে না চোখে?
নাহিদা টেবিলের দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো সত্যিই মেহেদীর নাম লেখা! এতোক্ষণ তো খেয়ালই করেনি এটা মেহেদীর ডেস্ক! তাহলে বসতো নাকি এখানে!
সে মুখ মলিন করে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লো। জহিরুল ইসলামের কেবিনের দিকে পা বাড়ালে পেছন থেকে মেহেদী বললো,
– আপনার কফি নিয়ে যান মেডাম! এটা আবার রেখে যাচ্ছেন কার জন্য?
মেহেদীর কথা শুনে আশেপাশের সবাই হেসে উঠলো। কেউ কেউ কমেন্ট করছে, “নাইস এক্টিং, স্যার!”
নাহিদা তাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে কফির কাপ নিয়ে আবার কেবিনের দিকে চলে গেলো।
বাকি কফিটুকু আর খাওয়া হলো না! ঠান্ডা তেতোমিঠা পানি হয়ে গেছে! চুপচাপ বসে আছে নাহিদা! কখন ম্যানেজার আসবে আর কখন তার কাজকর্ম বুঝিয়ে দিবে! একটু পর আবার মেহেদী এলো এখানে। নাহিদা প্রথমে হেলান দিয়ে বসে থাকলেও তাকে দেখে সোজা হয়ে বসলো। মেহেদী সেল্ফ থেকে ফাইল নিতে নিতে বললো,
– এই চেয়ারে বসে আছেন কেন মেডাম! আপনার চেয়ার তো মেবি ওটা।
– আমার ইচ্ছে।
– ওহ্, আচ্ছা। তা কোন পদে নিযুক্ত হয়েছেন সেটা জানেন তো?
নাহিদা কোনো জবাব দিলো না। বড্ড বিরক্ত লাগছে মেহেদীকে! সব কিছু নিয়ে অতিরিক্ত কথা বলে! কে বলেছে তাকে এসে উপচে পড়ে কথা বলতে! সবকিছুর বিপরীতে এটাও খুব ভালো বুঝতে পারছে মেহেদীও তাকে অফিসে দেখে বিরক্ত! এজন্যই নিশ্চয়ই সে এমন খোচা মেরে কথা বলছে! বলুক, তাতে কার কি আসে যায়! পিতামাতার কাছে সাপোর্ট পেয়ে গেছে যখন সে অগ্রসর হবেই তার পথে! এটাই নাহিদার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত!
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। ম্যানেজারও কিছুক্ষণ আগেই এসেছে এখানে। কিন্তু অন্যান্যদের সাথে সাক্ষাৎ এবং কাজে ব্যস্ত। নাহিদা যে অফিসে আছে সেই খেয়ালই যেন তার নেই! আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য নাহিদা কেবিন থেকে বেরিয়ে ম্যানেজারের মুখোমুখি হলো।
– আংকেল, আপনি কি খুব ব্যস্ত? আমি অনেক্ক্ষণ যাবত বসে আছি। আমার উপর কোনো দায়দায়িত্ব পড়ছে না কেন?
ম্যানেজার সরাসরি ভাবে নাহিদাকে না জবাব দিয়ে আগে মেহেদীর দিকে তাকিয়েছে! মেহেদী তার কাজের ফাকে মাথা না নাড়িয়ে শুধু দৃষ্টি উপরে তুলে তাকিয়েছিলো নাহিদার কথা শুনে। পরক্ষণে আবার কাজে মনযোগ দিলো। যেটা নাহিদা লক্ষ্য করেছে। ম্যানেজার নাহিদাকে বললো,
– মেডাম, আপাতত আপনার কোনো কাজ নেই। তবে আমাদের একটু ব্যস্ততা আছে। যখন আপনার কাজ হবে তখন আমি বুঝিয়ে দিবো। একসাথে তো আর সবটা বুঝিয়ে দেওয়া যায় না। ঠিক বলিনি?
– হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন। আপনি একসাথে বোঝাতে চাইলেও কিন্তু আমি বুঝবো না। তবে আমার একটু একটু বুঝে নেওয়া প্রয়োজন, যেটা আমি একটুও আয়ত্তে আনতে পারছি না। বাবা কিন্তু আমাকে বলেছিলো কাজ দুএক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝে নিতে পারবো। অথচ আজ দুদিন পেরিয়ে গেলো আমি একটুও বুঝতে পারলাম না!
– বুঝবেন তো। ওই যে বললাম যখন সময় হবে তখন বুঝিয়ে দিবো।
নাহিদা আর কোনো কথা বললো না। একই জায়গায় দাড়িয়ে থেকে সে জহিরুল ইসলামের কাছে কল করলো। সালাম দিয়ে বললো,
– বাবা, কাজ বুঝে নেওয়ার সময়টা কখন আসে?
ম্যানেজার একটু অন্যদিকে চলে গিয়েছিলো। নাহিদার মুখে এমন উক্তি শুনে মেহেদী এবং ম্যানেজার ও পাশের একজন স্টাফ নাহিদার দিকে তাকালো। তিনজন তার কথা শুনলেও ম্যানেজার ও মেহেদীর দৃষ্টি অন্যরকম ভাবে নিক্ষেপ হয়েছে নাহিদার দিকে! ওপাশ থেকে জহিরুল ইসলাম কিছু বুঝতে না পেরে ক্লিয়ার বলতে বললো। তখন নাহিদা মেহেদী ও ম্যানেজারকে শুনিয়ে বলতে লাগলো,
– বাবা, মানে ম্যানেজার আংকেল জানালো অফিসের কাজকর্মের নাকি নির্দিষ্ট সময় আছে তাই আমি কোনো কাজ শিখতে পারলাম না গত দুইদিনে। আপনি যেহেতু উচ্চ স্তরের কর্মকর্তা তাই ভাবলাম সময়টা আপনার কাছে জেনে নেই যাতে আমাকে বসে বসে সময় না কাটাতে হয়। বরং অবসর সময় কাজে লাগাতে পারি।
জহিরুল ইসলাম ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে চাইলে নাহিদা ফোন দিয়ে দিলো। ম্যানেজার যেমন কিছুটা ভয়ে ভয়ে কথা বলছে আর মেহেদী যেন ইলেক্ট্রিক মেশিনের মতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে! যেটা সে সন্দেহ করেছিলো ঠিক সেটাই হলো! তাদের আচার-আচরণ ও ভাবভঙ্গিতে বুঝে গেছে মেহেদী নিষেধ করেছিলো নাহিদাকে কাজ শিখিয়ে দিতে! যাতে সে অফিসে মনযোগী না হয়। কিন্তু এতে কোনো লাভ হলো না! নাহিদার ভেতর যেন আরও বেশি অনুপ্রেরণা কাজ করছে মেহেদীর ইচ্ছাকে এমন উপেক্ষা করতে পেরে! জহিরুল ইসলামের সাথে কথা বলার পর বাকিটুকু সময় ম্যানেজার নাহিদাকে কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়েছে।
অফিস টাইম শেষে মেহেদী নাহিদার সামনে গাড়ি নিয়ে এসেছিলো। কিছু বলেনি তবে এমনভাবে গাড়ি সামনে ব্রেক করেছে, বুঝাই যাচ্ছে তাকে উঠার সিগনাল দিচ্ছে! আসার সময় যেহেতু গাড়ি দিয়ে আসেনি সেহেতু যাওয়ার সময়ও যাবে না। তাই নাহিদা তাকে ইগনোর করে বিপরীত পাশে এসে রিকশা ঠিক করে নিলো। রিকশায় উঠে একবার মেহেদীর দিকে তাকিয়েছিলো। সানগ্লাস পড়নে থাকায় মেহেদীর দৃষ্টিভঙ্গি না দেখলেও মনোভাবটা একটু হলেও বুঝতে পেরেছে নাহিদা। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই! সে রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরে এলো।
চলবে।