তৃ-তনয়া পর্ব-৮১+৮২+৮৩

0
812

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮১
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যায় বলা মেহেদীর কথামতো সকালে অফিস যাওয়ার পূর্বে নাহিদাকে বাবার বাসায় রেখে গেছে আর সবার সাথে দেখা করে গেছে। ওবাড়ি থেকে আসার সময় মেহেরুন ইসলামের নানান সতর্কবাণী, বাসায় আসার পর ফোন কলে মেহতাজেরও সতর্কবাণী নাহিদার জন্য। রুমানা ও নাফিসা উভয়ের কাছেই ভালো লেগেছে নাহিদার প্রতি তার শ্বশুর বাড়ির কেয়ারনেস।
নাফিসা নাহিদার বোরকা দেখে বললো,
– সুন্দর তো বোরকাটা। দাম কত হয়েছে? কোথা থেকে কিনছো?
– আমি জানি না কিছু। তোর ভাইয়া এনে দিছে।
– জিজ্ঞেস করোনি কিছু?
– উহুম।
এদিকে নাহিদার উপস্থিতি দেখে নাফিসা নাজিয়াকে বারবার কল করে বিরক্ত করে ফেলছে এখানে আসার জন্য। নাজিয়ারও মন মানছে না। এমনিতেও ইচ্ছে করছিলো মায়ের কাছে কিছুদিন থেকে আসার, এখন বোনরা একসাথে যাওয়াতে আরও বেশি ইচ্ছে করছে! কিন্তু তাকে কি যেতে দিবে! রুমানা বেগম বলেছিলো আয়েশা বেগমের সাথে কথা বলবে। কিন্তু নাজিয়া নিষেধ করলো। ভয় একটাই, আয়েশা বেগম তার সাথে তেমন একটা কথা বলে না। সেই যে তার শ্বশুর বকাঝকা করেছিলো এখনো রেগে আছে তার উপর। এখন মা কথা বললে যদি উল্টাপাল্টা কিছু শোনায়, এখানেই তার ভয়। পরক্ষণে নাজিয়াই সুযোগ বুঝে কথা তুললো।
– আম্মা, নাহিদা নাফিসা বাসায় এসেছে। মা আমাকেও বলছিলো যাওয়ার জন্য। যাবো?
আয়েশা বেগম তার কোনো প্রত্যুত্তর করলো না! নাজিয়ার মনটা একটু বিষন্ন হয়ে গেছে! সে আর কোনো কথা বললো না। মাঝে মাঝে নিরবতাই অনেক কিছু বলে দেয়। এখনও স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আয়েশা বেগম অসন্তুষ্ট তার আবেদনে! সারাটাদিন বিষন্ন মনেই কাটালো সে। দুপুরে আরাফ কল করেছিলো একটু কথা বলার জন্য। তখন বিষন্নতা চাপা রেখে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিলো তার সাথে। তবুও আরাফ জিজ্ঞেস করেছে,
“মন খারাপ?”
“উহু।”
“মিথ্যে বলছো না?”
নাজিয়া চুপ করে রইলো। এতো কিছু বুঝে যায় কেন সে! নাকি দোষ তার নিজের, যে ঠিকমতো চাপাও রাখতে পারে না! তা ই যদি হয়ে থাকে তো অন্যরা বুঝে না কেন! নাজিয়াকে চুপ থাকতে দেখে আরাফ বললো,
“নাফিসা কল করেছিলো। নাহিদাও এসেছে ওবাড়িতে। তুমি যাবে?”
“উহু।”
“কেন?”
“এমনি।”
“যেতে ইচ্ছে হলে বলো, বাবার কাছে পারমিশন নিয়ে আমি আশিককে বলে দেই বিকেলে পৌছে দিয়ে আসতে। আমি তো কোচিং রেখে সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারবো না।”
“না, যাবো না।”
” কিছু বলবে?”
“উহু।”
“আচ্ছা, রাখি এখন। ক্লাসে যাবো।”
“ওকে”
“আর তুমি, কাজগুলো একপাশে চাপিয়ে রেখে একটু ঘুমাও।”
নাজিয়া শেষ দুপুরে ঘুমিয়েছিলো। আসরের আযান পড়েছে তা-ও শুনতে পায়নি। ঘুম ভাঙলো আয়েশা বেগমের ডাকে।
– আযান দিছে এহনো ঘুমাইতাছো কে? উঠো, তোমার বাপে আইছে।
নাজিয়া বিছানা পত্র গুছিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আলফাজ সাহেবের ঘরে এলো। নিয়াজ উদ্দিনকে দেখে সালাম দিলো। নিয়াজ উদ্দিন সালামের জবাব দিলে নাজিয়া বললো,
– বাবা তুমি এসময়? আসবে যে আগে তো কেউ কিছু বললো না!
– এদিকে আসছিলাম হাটতে হাটতে। ভাবলাম বড় আম্মাকে দেখে যাই৷
নাজিয়া মুচকি হেসে বললো,
– বসো, আমি চা নিয়ে আসি।
– না, কিছু করতে হবে না। আমি চলে যাবো।
আলফাজ সাহেব বললো,
– আরে, থাকেন তো আরেকটু গল্পগুজব করি। রাতে খাওয়ার পর যাবেন।
– না, বেয়াই। তা হয় না।
– চাইলেই হইবো। নাজিয়া চা দিয়ো।
নাজিয়া চলে গেলো চা বিস্কুট আনতে। এদিকে কথায় কথায় নিয়াজ উদ্দিন আলফাজ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলো নাজিয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুই মেয়ে বাড়িতে আছে বড় মেয়েটা গেলেও ভালো লাগবে। আর এখানে আসার আইডিয়াটা ছিলো নাফিসার। এমনি কল করে বললেও আলফাজ সাহেব নিষেধ করতো না। কিন্তু আরাফ তো ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে রাতে কি আর নিয়ে যেতে পারবে! তাই নাফিসা তার বাবাকেই বলে পাঠিয়ে দিলো নিয়ে আসার জন্য।
চা বিস্কুট নিয়ে আসার পর যখন আলফাজ সাহেব নিজেই জিজ্ঞেস করলেন নাজিয়া যাবে কিনা? নাজিয়া তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়েছিলো একবার। নিয়াজ উদ্দিন যখন বললেন,
– নাহিদা নাফিসা এসেছে, তবে নাজিয়া কেন যাবে না?
পরক্ষণে নাজিয়া হাসি মুখে বলে দিলো, “আম্মা বললে যাবো।”
আলফাজ সাহেব আয়েশা বেগমকে ডেকে বলে দিলো নাজিয়া আজ তার বাবার সাথে বাড়ি যাবে। আয়েশা বেগম বলে দিলেন যাওয়ার হলে যেন সন্ধ্যার আগেই যায়। সন্ধ্যা বেলা যেনো বাড়ির বাইরে ঘুরাঘুরি না করে। নাজিয়া খুশি হয়ে আসরের ফরজ নামাজ আদায় করে নিলো। পরক্ষণে রেডি হয়ে আরাফকে জানিয়ে সন্ধ্যার আগেই বাবার সাথে রওনা দিলো। রিকশায় থাকাকালীন বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবা তুমি আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছো না?”
প্রত্যুত্তরে নিয়াজ উদ্দিন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আর মনে মনে এই ভাবলেন, “নিজের মেয়ের উপর আজ নিজেরই অধিকার নেই। মেয়েকে আনতে যাবে তবুও কত কৌশলে প্রস্তাব করতে হয় শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছে! “হ্যাঁ” বলবে তো নিয়ে যাও আর “না” বলবে তো রেখে যাও! আযব নিয়তির খেলা! বিয়ে দেওয়া মানেই মেয়ে পর করে দেওয়া। হুহ্!”
বহুদিন পর ঘরটা পূর্বের ন্যায় কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠলো। তৃ-তনয়াকে কাছে পেয়ে আজ বাবা মায়ের মনটাও ভরে উঠলো। নয়টা দশটার ঘুম আজ বারোটা একটায়! গল্পগুজবেই কাটছে সময়। সকালে নাজিয়া আরাফকে কল করে বললো,
“দেখা করে আসিনি বলে রাগ করেছো?”
“উহুম।”
“তাহলে কল দাওনি যে একবারও!”
“কতদিন পর বেড়াতে গেলে, সবাই একসাথে গল্প করবে আড্ডা দিবে তাই আর বিরক্ত করিনি।”
“এভাবে কথা বলছো কেন? তুমি রেগে আছো না আমার উপর?”
“কেউ যদি ইতিবাচক মনোভাবকে নেতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করে তো আমার কি করার আছে বলো?”
“তোমার কথার ধরন বাধ্য করছে নেতিবাচক মনোভাবে গ্রহণ করতে!”
মুহুর্তেই আরাফ তার কথার ধরন পাল্টে বললো,
“উম্মে আরোহী, আমার ব্লু শার্টটা আয়রন করেছিলে?”
“হ্যাঁ”
“কোথায় রেখেছো?”
“আলমারিতে, সামনেই রাখা আছে।”
“জান, আমার কালো প্যান্টটা দেখেছো? আয়াতের বিয়ের পর যে বানিয়েছিলাম?”
“আলমারিতেই থাকে।”
“অহ, আচ্ছা। মিসেস আরাফ, আমার গ্রিন চেক লুঙ্গিটা দেখেছো?”
নাজিয়া হেসে উঠলো এবং বললো,
“গোসল করেছো?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে তোমার পরনেই আছে।”
“ওকে, এবার ঠিক আছে কথা?”
“একটু বেশিই হয়ে গেছে।”
“আচ্ছা, কমবেশি মিলিয়ে সমান করে নাও।”
“স্কুলের জন্য রেডি হচ্ছো নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“সবসময় ওই প্যান্ট দুটোই কেন পড়, মাঝে মাঝে জিন্স পড়েও তো যেতে পারো। একের পর এক চেঞ্জ করে পড়লে নতুনত্ব বজায় থাকে।”
“ওটা তো আমার স্কুল ড্রেস, জানো না!”
“এহ! যেন স্কুল থেকে নির্ধারিত করে দিয়েছে!”
আরাফ হেসে বললো,
“জিন্স পড়লে পিচ্চি পিচ্চি মনে হয়। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কেমন যেনো বেমানান! আমি যেখানে কাউকে শিক্ষা দিতে যাবো সেখানে যদি টিশার্ট, জিন্স পড়ে এমন পিচ্চি সেজে বসে থাকি তাহলে কি শিক্ষার্থীরা আমাকে অনুসরণ করতে অনুপ্রানিত হবে? শিক্ষক না ছাত্র বুঝতেই অসুবিধা হয়ে যাবে। একজন শিক্ষককে সবদিক থেকে অবশ্যই এমন মুডে থাকতে হবে যাতে আশেপাশের সকলে এক পলকেই চিহ্নিত করতে পারে ইনি একজন আদর্শ শিক্ষক। আর আমি মনে করি, বেড়াতে গেলে জিন্স পড়াটা মানানসই। বুঝতে পেরেছো?”
“হুম, মাস্টার সাহেব। খুব ভালো বুঝেছি। এবার সময় বাঁঁচিয়ে রেডি হয়ে যান, নতুবা আপনার লেট হবে।”
“যথা আজ্ঞে মিসেস।”
“ঘুম হয়েছিলো রাতে?”
“একটু সমস্যা তো হয়েছিলোই! তবে ঘুমিয়েছি।”
“আচ্ছা, তারাহুরোর প্রয়োজন নেই। খাওয়ার সময় ধীরে সুস্থে খেয়ো।”
“ওকে।”
“আর শুনো, ভালোবাসি আমার মাস্টারকে।”
“আর আমি, আরও ভালোবাসতে চাই তোমার মাস্টারের মিসেসকে।”
আস্তে করে শেষ কথাটা বলার সময়ই কারো উপস্থিতি টের পেয়েছিলো রুমে। আর এখন কল কেটে পেছনে ফিরে দেখলো নাফিসা দাত চেপে হেসে দুই কানে আঙুল দিয়ে দাড়িয়ে আছে। আর নাজিয়া তাকানোর সাথে সাথেই বললো,
– মনে হয়, শুনিনি কিছু।
নাজিয়া চোখ পাকাতেই নাফিসা হেসে পালিয়ে যেতে যেতে বললো,
– নাস্তা করতে এসো।
পরদিন দুপুরে নাফিসা যখন ঘুমাচ্ছিলো, হঠাৎই তার ঘুমটা ভেঙে গেছে! যেন কেউ তাকে ঘুমের মধ্যে বেত্রাঘাত করেছে! ঘটনা হঠাৎই সংঘটিত হওয়ায় সে ধরফরিয়ে উঠার চেষ্টা করলো কিন্তু চেষ্টা বৃথা! চারপাশে এতো লোক তাকে ঘেরাও করে বিছানায় চেপে রেখেছে। চাইতেও মিলছে না মুক্তি! যেন কেউ তাকে হত্যা করতে এসেছে। হত্যা তো করেছে ঠিকই কিন্তু পুরোপুরিভাবে না! অর্ধহত্যা! তার অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে,মুখ খোলা থাকতেও চিৎকার করতে পারছে না! এটা কি স্বপ্নের মধ্যে হত্যা করা হচ্ছে নাকি বুঝতে পারছে না কিছু! আরও দুমিনিট তাকে আটকে রেখে ছেড়ে দিতেই নাফিসা উঠে বসে খুব বড়সড় এক নিশ্বাস ছাড়লো। পরক্ষণে নাকে ব্যাথা অনুভব করলো! নাকে হাত দিয়ে দেখে নাকফুল! তার সামনে নাহিদা নাজিয়া সহ পাশের বাসার পার্লারে কর্মরত আপুটা! হাতে এতোবড় মেশিন! তাহলে কেউ বেত্রাঘাত করেনি! মেশিন দিয়ে তার নাক ফুটো করে ফেলা হয়েছে! এরপর বিনা বচনে শুরু হলো চিৎকার! এএএএ….. করে আছে তো আছেই! আশেপাশের সবাই হেসে উঠলো।
রুমানা বেগম বলে গেলো,
– ঢং দেখলে আর বাচিনা!
আর নাজিয়া তার মুখ চেপে ধরে বললো,
– কাদে না সোনাপাখি। কিচ্ছু হয়নি।
ওদিকে পার্লারের মেয়েটি বললো,
– যখন ফুটো করলাম তখন কাদলি না, আর এখন এএএ…? চুপ কর, কিছু হবে না। একটু পর দেখবি ব্যাথা গায়েব হয়ে গেছে।
– এএএ….আমি ব্যাথা পাচ্ছি! পড়বো না নাকফুল। নাক কেটে ফেলে দিবো। এএএ…
নাহিদা বললো,
– আয়, বটি দিয়ে কেটে দেই।
– কেউ কথা বলবে না আমার সাথে। সবগুলা ডাকাত। উউউউ….উহু উহু হু…!
পার্লারের মেয়েটি বললো,
– নাজিয়া, টক খেতে দিস না এই পেতনিকে। আমি যাই।
– দাড়া, একটু।
মেয়েটি বুঝতে পেরেছে টাকা দেওয়ার জন্য বলছিলো। কিন্তু সে টাকা নিবে না। সম্পর্কে তার প্রতিবেশী আপু হয়, আবার নাজিয়ার সাথে পড়াশোনা এবং চলাফেরা। নাজিয়া জোর করেও তাকে দাড় করাতে পারলো না। টাকা না নিলেও রুমানা বেগম ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে দিলে একটা নিয়ে চলে গেলো। রুমানা বেগম সুই সুতা দিয়ে নাক ফুটানোর কথা বলতেই নাজিয়া, নাহিদা উভয়েই বললো, এত ঝামেলার প্রয়োজন নেই। মেশিন দিয়ে একেবারে ফুল বসিয়ে দিবে সেটাই ভালো। তারা দুজনেই বুদ্ধি করে এই ঘুমের মধ্যে কাজ সেড়ে নিলো।
আর এখন নাফিসা কান্না করছে বলে নাহিদা আরও দুষ্টুমি শুরু করেছে হাতে ফোন নিয়ে। নাফিসার কান্নার ছবি তুলছে আর বলছে এমন পাগলামি করলে ছবি ইমরানকে দেখাবে। তবুও নাফিসার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অতপর ভিডিও করা শুরু করলো বাবাকে দেখানোর জন্য! একটু পর নিয়াজ উদ্দিন বাড়ি ফিরলে নাহিদা কি ভিডিও দেখাবে, তার আগে নাফিসাই মা সহ দুই বোনের নামে নালিশ করলো কিভাবে তাকে ঘুমের মধ্যে টর্চার করলো। আর মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে চললো নিয়াজ উদ্দিনের ছোট তনয়ার পক্ষ নিয়ে কথা বলা। বিয়ে হয়ে গেছে মেয়ের, তবুও পূর্বের ন্যায় আচরণগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮২
(নূর নাফিসা)
.
.
শেষ বিকেলে ইমরান কল করলো। আজ নাফিসা ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেও ভুলে গেছে। ইমরান কিছু বলার আগে সে-ই মেজাজী কন্ঠে বললো,
– কি হইছে?
– কোথায় কি হয়েছে?
– কল করছেন কেন?
– আগে বলো তোমার কি হয়েছে?
– কিছু না।
– তাহলে এতো রেগে আছো কেন?
– কেন কল করছেন বলবেন? নাকি কল কেটে দিবো?
– তোমার ইচ্ছা।
সাথে সাথেই কল কেটে দিলো নাফিসা! কিছু ভালো লাগছে না তার! সেই তখন থেকে কান্না ধরেছে এখনো বিরতি নিয়ে নিয়ে ফুপিয়ে কাদছে! মা এসে দেখে মাঝে মাঝে বকে যায়। রুমানা যখন বলে,
“এইসব আজাইরা ঢং বাদ দে। একটুখানি নাক ফুটো করছে সারাদিন তা নিয়ে মুখ ফোলানি, নাক ফোলানি আর চোখ ফোলানি!”
তখন কান্নার সাথে নাফিসার জবাব,
” তুমি বুঝবা কি? তোমার নাক ফুটো করছে নাকি আমার! অন্যেরটা দেখলে মজাই লাগে। নিজেরটা করলে বুঝতা!”
“না, আমি বুঝবো কি করে! আমার কি আর জীবনে নাক ফুটো করছি! বিশ্বে তো এই প্রথম তুই ই করলি। তাই না?”
“বাবা…..!”
কথা বলার ইচ্ছে নেই তবুও বারবার এসে এমন রাগিয়ে দেয়! ক্ষণে মা আর ক্ষণে নাহিদা! আর নাফিসা রেগে গলা বাড়িয়ে চিৎকার করে বাবাকে ডাকে! কেবল নাজিয়া ই সান্ত্বনা দানকারী! নাক ফুটানোর পর থেকে সারাদিন যেন এই ম্যাজিক দেখাদেখি চললো তাদের!
ইমরান আর কল করেনি। ইমরানের কথা একবারের জন্যও মনে হয়নি নাফিসার! রাতে তারাতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
সকাল এগারোটা বাজে। কালকের মতো মুড খারাপ নেই আর। তবে ব্যাথা রয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে নাস্তা করে বারবার আয়নায় দেখছিলো নিজেকে। নাকফুলে তাকে কেমন দেখাচ্ছে! নাকটা কতটা ফুলে গেছে! নাকটা কি এখনো লাল হয়ে আছে! পরে রিংটোন বেজে উঠলে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো নিশাতের কল এসেছে। গতকাল আরমানের সাথে জেরিন এবং সে শপিং করে এসেছে। সেসব নিয়েই গল্পগুজব করলো কিছুক্ষণ। কথা শেষে কল কেটে দিতেই মনে পড়লো ইমরানের কথা! দিনে সে দু-তিন বার কল করে। অথচ দুপুর হয়ে গেছে আজ একবারও কল করলো না। এমনকি রাতেও কল করেনি! সে তো ঘুমিয়ে পড়েছিলো, তাহলে কি মেসেঞ্জারে নক দিয়েছে? নাফিসা অনলাইনে এসে দেখলো কোনো টেক্সটও আসেনি ইমরানের আইডি থেকে! পরক্ষণে গতকালের কথা মনে হতেই কিছুটা নিশ্চিত হলো সে রাগ করেছে হয়তো! তারই বা করণীয় কি ছিলো! মনমেজাজ ভালো না থাকলে কি কারো সাথে ভালো আচরণ করা যায়!
ভাবতে ভাবতে সে ইমরানের নম্বরে ডায়াল করে ফেললো। ইমরান রিসিভ করে সালাম দিতেই নাফিসা সালামের জবাব দিলো এবং বললো,
– কি করছিলে?
– অফিসে আছি।
– কল করনি কেন আজ?
– প্রয়োজন পড়েনি তাই।
– রাগ করছো?
– কেন কল করেছো সেটা বলো।
– হুহ্! এরপর আমি বলবো এমনি আর তুমি বলবে কেন কল করেছো বলবে নাকি কেটে দিবো! তারপর আমি বলবো তোমার ইচ্ছে আর তুমি টুট টুট টুট করে কেটে দিবে। এই তো?
নাফিসার বলা শেষ হতেই ইমরানের কথার পরিবর্তে টুট টুট টুট শব্দ এলো কানে! কল সত্যিই কেটে দিয়েছে! নাফিসার প্রচুর রাগ হচ্ছে! কত বড় স্টুপিড! ভালোমন্দ কিছু না বলেই কেটে দিলো! নাকি ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে!
নাফিসা দ্রুত তার ফোনের ব্যালেন্স চেক করলো। যথেষ্ট আছে! তাহলে ইমরান ইচ্ছে করেই কেটে দিয়েছে সে নিশ্চিত! তাই আবার কল করলো। রিসিভ হওয়ার বদলে রিজেক্ট! আবার দিলো একই কাজ করলো! এবার নাফিসা একের পর এক কল দিতেই থাকবে এই সিদ্ধান্ত নিলো! কথা হোক বা না হোক, তাকে বিরক্ত করেই ছাড়বে।
“ইমরাইন্নার বাচ্চা, তুই কথা বলবি না? তোর ঘাড় কথা বলবে! ওহ্, না! তোর পেট, কণ্ঠনালি, মুখ কথা বলবে!”
বারবার কল দিতে থাকলে ষষ্ঠ বারের মাথায় রিসিভ হলো। নাফিসা কিছু বলার আগেই ইমরান বললো,
“ব্যস্ত আছি। একটু পর কল করছি।”
এটুকু বলেই আবার কেটে দিলো! নাফিসা শুরুতেও সুযোগ পেল না, শেষেও না! তবে সে যেহেতু বলেছে কল করবে তো নিশ্চয়ই করবে। সেই আশায় ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। কিচেনে মা এবং আপুরা ভুট্টা ভেজে খাচ্ছে। কয়েকবার হাক পড়লো নাফিসাকে যাওয়ার জন্য। সে ফোন হাতে নিয়েই চলে গেলো। মুঠো ভর্তি ভুট্টা খেতে খেতে কথা বলছিলো। দশবারো মিনিট পর ইমরানের কল আসতেই সে ভুট্টা হাতে নিয়ে আবার রুমে চলে এলো।
– হ্যালো?
– বলো কি বলবে?
– আমি কি বলবো? তুমিই না কাল কল করেছিলে কিছু বলার জন্য!
– এভাবে কি টাইম নষ্ট করছো না?
– ওই, আমি কল করলেই তোমার টাইম নষ্ট হয়ে যায়! যাও আর জীবনেও কল করবো না!
– আমি অফিসে এসেছি, জানো না তুমি?
– তো, ব্যস্ত আছো জেনে তো আমি আর কল করিনি! এখন তুমিই তো কল দিলে। তাহলে আবার এতো ব্যস্ততা দেখাচ্ছো কেন!
– আচ্ছা, ব্যস্ততা দেখাবো না। বলো এবার।
– রেগে আছো আমার উপর?
– না, আমার সেই অধিকার আছে নাকি! আমাকে তো সবার রাগ দেখে যেতে হয়।
– হ্যাঁ, আর রাগ ভাঙাতেও তো হয়।
– হুম, হয়তো বা! আরও কিছু বলবে?
– কালকে মেজাজটা একটু খারাপ ছিলো তাই এমন করেছি।
– সে আর নতুন কি! আমি বলতে সবসময়ই তোমার মেজাজ খারাপ থাকে।
– এখন কি বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না!
– হ্যাঁ, আমি বললে তো বেশি বেশিই হয়ে যায়! তুমিই বলো। আমি চুপ থাকি।
– আমি কোনো বোবা জাত প্রাণীর সাথে ফোনে কথা বলছি না নিশ্চয়ই যে, শুধু আমাকে একা কথা বলতে হবে!
– কথা বললেও দোষ আবার না বললেও দোষ! তো আমার কি করা উচিত!
– যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলবে।
– আচ্ছা? কি বলবো? বলো?
– জিজ্ঞেস করবে না, কেন মেজাজ খারাপ ছিলো?
– জানানোর ইচ্ছে থাকলে জানাও।
নাফিসার প্রচুর রাগ হচ্ছে এ ধরনের কথা শুনে! ইচ্ছে তো করছে ফোনেই স্টুপিডটাকে ধোলাই করতে! কিন্তু তার আচরণের কারণেই ইমরান মন খারাপ করে আছে বিধায় নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললো,
– গতকাল আমার নাক ফুটো করছে। তাও আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে! ওটা নাক ফুটানো ছিলো না! ওটা ছিলো অপারেশন সার্চলাইট! একাত্তরে ২৫শে মার্চ রাতে যেটা ঘটেছিলো, গতকাল দুপুরে সেটা ঘটেছে আমার সাথে। ঘুমের মধ্যে নাক ফুটো করা! ঘুমটা তো নষ্ট করছেই, সাথে আমার নাকটাও শেষ করে দিছে! এখনো নাকে হাত লাগাতে পারি না পর্যন্ত, এতোটা ব্যাথা! খুব রেগে ছিলাম সবার উপর আর সেই প্রভাব তোমার উপরও!
ইমরান এতোক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলেও এখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। মন ভালো হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে কিন্তু এই মুহূর্তে তার হাসিটা মোটেও পছন্দ হলো না নাফিসার! সে ধমকের সুরে বললো,
– এতো হাসির কি আছে, স্টুপিড! অন্যের দুঃখ দেখলে হাসি পায় খুব? আমি ব্যথায় কাতর আর তুমি বসে বসে দাত কেলাও!
– আহারে, বউ? খুব ব্যথা লাগছে?
– হু।
– শুধু কি ফুল পড়ার জন্যই ফুটো করেছো? আরেকটা যে নোলক পড়ে ওইটা ফুটাও নি?
– উহু।
– তাহলে ওইটাও ফুটো করে নিও। কেমন?
– একটার জন্যই আমার প্রাণ যায় আর আসে আবার আরেকটা করতে বলছিস! সামনে থাকলে এখন ভুট্টা ছুড়ে মারতাম তোর মুখে! ফোন রাখ!
– ভুট্টা খাচ্ছো বুঝি?
নাফিসা সাথে সাথেই কল কেটে দিলো! কোথায় তার মন ভালো করতে গেলো সে, আর এদিকে উল্টো তাকেই রাগিয়ে দিলো! এই নাকের জন্য, শুধুমাত্র এই নাকের জন্য তার দিনগুলো খারাপ যাচ্ছে! এখন তো খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে! সবাই শুধু তাকে রাগিয়ে দিতে প্রস্তুত! কোথাও শান্তি নেই! হুহ্! ভুট্টা খাওয়ার রুচি কি আর আছে! ভুট্টার জায়গায় তো এখন ইমরানকে দাতের দুই পাটির চিপায় ফেলে চিবাতে ইচ্ছে করছে!
অতি রাগ এবং কষ্টে নাফিসার চোখে পানি চলে আসছে। সে হাতের ভুট্টা কিচেনে বাটিতে রেখে আবার হনহন করে ঘরে চলে এলো। নাহিদা জিজ্ঞেস করেছিলো, “কে ফোন করেছে? কাকে এমন বকে দিলি?”
কিন্তু তার কোনো জবাব নেই। এদিকে ইমরান কল করেই যাচ্ছে। নাফিসা ফোন বন্ধ করে রেখে গোসলের জন্য চলে গেলো। দুপুরে খেতে ইচ্ছে করছে না তবুও খেতে হলো বাকিদের প্রেশারে! কিছুই ভালো লাগছে না! সব যেন শুধু তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই চলছে! সবকিছু ভুলতে এবং মেজাজটাকে ঠান্ডা করতে ঘুম দিলো।
ঘুম ভাঙলো কারো কান্নার শব্দ শুনে! কেউ যেন আ….. এএএ…. উহু উহু হু… করে কান্না করেই যাচ্ছে আর করেই যাচ্ছে! খুব বিরক্তি নিয়ে সে চোখ খুলে তাকালো। চোখের সামনে দেখতে পেল ইমরানের হাসিমাখা মুখখানা! আর কানের পাশে চিৎকারের শব্দওয়ালা নাহিদার ফোন! এটা দিয়ে ইমরান তার ঘুম ভাঙাচ্ছে! সে ঝটপট উঠে বসে দেখলো ফোনে নাহিদার করা গতকালের ভিডিও! কান্না আর কারো না, সেটা তারই কান্নার আওয়াজ! সত্যিই কি সে এভাবে কান্না করে, নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য! ইমরান বললো,
– তুমি কি সত্যিই এভাবে কান্না করো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! আমি তোমাকে কান্না করতে দেখেছি নূর। কিন্তু এভাবে কান্না করতে দেখিনি কখনো!
নাফিসা ফোন হাতে নিয়ে ভিডিওটা ডিলিট করে বললো,
– আপনি এখানে কেন, আর এই ফোনই বা আপনার হাতে কেন!
– আগে ফ্রেশ হয়ে এসো, তারপর বলি।
– না, এখন বলবেন।
– আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়ার জন্য। এলাম, বসলাম, কথাবার্তা বললাম, লাঞ্চ করলাম তারপর ভাবি তোমার পাগলাটে কর্মকাণ্ডের কথা জানালো, অত:পর আপু এনে ভিডিও দেখালো!
নাফিসা নাহিদার ফোন নিয়ে পাশের রুমে এসে নাহিদাকে দেখে বললো,
– খুব মজা পাও না? ভাইয়াকে বলে এর বিহিত করে ছাড়বো, দেখে নিয়ো।
– আচ্ছা, দেখবো। তবে একটু সাবধানে থাকিস, তোর ভাইয়ার আবার মজাতে এলার্জি আছে। উল্টো না আবার তোর কর্মকাণ্ড দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়!
নাফিসার মুখভঙ্গি দেখে নাজিয়া বললো,
– নাহিদা, চুপ কর তো। নতুবা পিটুনি খাবি। নাফিসা, হাতমুখ ধুয়ে আয়।
নাহিদা হাসতে লাগলো। নাফিসা চলে গেলো ফ্রেশ হতে। নিজেকে যথাযথ ফ্রেশ করে ইমরানকে বললো,
– আপনি হঠাৎ এখানে এসেছেন কেন?
– এতো কম তোমার স্মরণশক্তি! রেডি হও দ্রুত। শপিংয়ে যাবো।
– কিসের শপিং?
– বিয়ের পর তো কিছুই কিনলে না। বিয়ের শপিংও হলো না। লাগবে না নাকি কিছু?
– না।
– বাহ! কি ভাগ্য করে একটা বউ পেয়েছি আমি! জেরিন তো প্রত্যেক অকেশনে শপিংয়ে যায় আর তুমি নিজের বিয়েতেও শপিং করলে না!
– আমি তো আর জেরিন না।
– সত্যিই লাগবে না কিছু? আমি কিন্তু সময় নিয়ে এসেছি। দ্বিতীবার না-ও পেতে পারি। সবসময় সুযোগ হয় না। তারতাড়ি বলো। যাবে না?
– নিয়ে গেলে যাবো না কেন!
ইমরান মুচকি হেসে বললো,
– পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হও। সন্ধ্যার আগে যেন ফিরতে পারি।
নাফিসা আসরের নামাজ আদায় করে বোরকা হিজাব পড়ে রেডি হয়ে গেছে। ইমরান জিজ্ঞেস করেছিলো, “কোথায় যাবে?” নাফিসা জানিয়েছে ,”গরিব মানুষ আমি তাই গরিবের মার্কেট নিউমার্কেটে যাবো!” ইমরান তাকে সেখানেই নিয়ে গেলো। ঘুরেফিরে কেনাকাটা করে মাগরিবের পরপর বের হলো। মার্কেটের এক কসমেটিকসের দোকানের সামনে নাফিসাকে দাড় করিয়ে ইমরান মাগরিবের নামাজ আদায় করেছিলো। দোকানে মহিলা কর্মরত থাকায় এখানে রেখে যেতে কিছুটা স্বস্তি বোধ করেছিলো। পরক্ষণে রাস্তায় বেরিয়ে এসে বললো,
– কিছু খাবে?
নাফিসা মনে মনে বললো,
“অবশেষে মুখ থেকে বের হলো! এতোক্ষণ তো সেটাই ভাবছিলাম, সেই কখন থেকে ঘুরছি একবারও খাওয়ার কথা বলে না কেন!”
আর প্রকাশ্যে বললো,
– ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধা লাগছে।
ইমরান আশেপাশে তাকিয়ে রেস্টুরেন্টের পথ ধরে ছোট ছোট কদম ফেলতে ফেলতে বললো,
– তাইতো জিজ্ঞেস করলাম। কি খাবে বলো।
নাফিসা তার সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে হাটতে আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
– ফুচকা, নিমতি।
– এসব খাওয়ার জিনিস হলো! ভালো কিছু বলো যেগুলোতে পেট ভরবে।
– উম্মম… তাহলে সস দিয়ে পুরি, নতুবা পিয়া…
নাফিসা কথা শেষ করতে পারলো না ইমরান তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো! তার চাহনি দেখেই নাফিসা কথা ঘুরিয়ে বললো,
– ওইতো হালিম! হালিম খাবো। আর কিছু না। ওকে?
– না। হালিমও খাওয়া যাবে না। এটা আরও বেশি অস্বাস্থ্যকর। খেতে হলে বাসায় তৈরি করে খেও। আর তোমার ভাজা পুরি খাওয়া একদম নিষেধ।
নাফিসা মুখে বিরক্তিকর ভাব এনে বললো,
– তাহলে এক কাজ করো। কোনো খাবার কিনতে হবে না বরং লোকটাকে কিনে নাও। বাসায় গিয়ে স্বাস্থ্যকর হালিম তৈরি করে খাওয়াবে।
ইমরান হেসে তার হাত ধরে হাটতে হাটতে বললো,
– এতো কথা জানে রে! তোকে দোসা খাওয়াবো, চল…
অত:পর নিজেরা খেয়ে বাড়ির সদস্যদের জন্য কিছু প্যাকেট করে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৩
(নূর নাফিসা)
.
.
সেদিন রাতে ইমরান থেকেছিলো এবাড়িতে। পরদিন সকালে নাস্তা করে এখান থেকেই অফিস চলে গেছে। নাফিসা পরিষ্কার বলে দিয়েছে বৃহস্পতিবার বিকেলে যাবে। আর নাহিদাও মেহেদীর কাছে বলে বলে তার থাকার সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। মেহেদী এসেছিলো বুধবার সন্ধ্যাবেলা। শ্বশুর বাড়িতে এক রাত থেকে সকালে নাস্তা করে নাহিদাকে নিয়ে চলে গেছে। নাহিদাকে বাসায় রেখে সে অফিস যাবে। আর নাফিসা বিকেলে রওনা হওয়ার জন্য গোছগাছ করে নিলো। নিশাতের ফোন থেকে কল করে রেখা বারবার বলছিলো সে যেনো গায়ে হলুদে যায়। ইচ্ছে না থাকলেও নাফিসা বলেছে তার সাথে দেখা করবে কিন্তু ছেলের বাড়িতে যাবে না। বিকেলে ইমরান এলে সে তার সাথে চলে গেলো। নাজিয়া আরও দুতিনদিন পর যাবে। এবার একটু বেশিই থাকার সুযোগ হয়েছে তার! আরাফ ট্রেনিংয়ে যাবে দুদিনের জন্য। সেখান থেকে ফিরে নাজিয়াকে নিয়ে যাবে। আর ওদিকে আয়াত এসেছে বেড়াতে। সুতরাং বাড়ি এখন ফাঁকা নয়।
নাফিসা বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় শাড়ি পড়ে রেখার সাথে দেখা করে এলো। নিশাত, জেরিন লগনে গিয়েছে কিন্তু নাফিসাকে জোরাজুরি করেও পাঠাতে পারেনি। একদিকে নিজের ইচ্ছে নেই অন্যদিকে ইমরানও নিষেধ করেছিলো। নিশাতকেও যেতে দেওয়ার মর্জি ছিলো না কিন্তু নিশাতের আহ্লাদে আর নিষেধ করতে পারেনি। তাছাড়া আরমান অনুমতি দিয়েছে যাওয়ার, সেখানে সে নিষেধ করে কিভাবে!
রেখার বিয়ের দিন সকাল নয়টার দিকে পার্লারে চলে গেছে জেরিন। গতকালও হলুদের প্রোগ্রামে সে এবং নিশাত পার্লারে সেজেছে। কিন্তু আজ আর নিশাত যায়নি। জিহান মায়ের কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে বারবার দৌড়ে চলে যায় বিয়ে বাড়িতে। আর বারবার নিশাত, আবিদা বেগম কিংবা আরমান গিয়ে ধরে নিয়ে আসে তাকে। কাল বাড়ি ফিরে কিছু করার সুযোগ না পেলেও আজ সকাল থেকেই কাজে লেগে গেছে নাফিসা। নিজের ঘর গুছানো, উঠুন বাড়িঘর ঝাড়ু দেওয়া, সোফার কভার, বেডশিট, বালিশের কভার, ঘরের পর্দা সব ধুয়ে দিলো। কাজের ফাঁকে নাস্তা করে নিয়েছে। পরে আবার আসবাবপত্র মুছে পরিস্কার করলো। সব যেন ময়লা হয়ে আছে! একে তো নিজের ও নিশাতের রুমের আসবাব তারউপর বড়ঘরের কাজকর্মও। যদিও এমনিতে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রাখে কিন্তু যেসব ধরাছোঁয়ার বাইরে সেসব পরিষ্কার না। কাজকর্ম শেষে নিশ্বাস ফেললো এই ভেবে, সারাজীবন বাবার বাড়িতে নিজের ইচ্ছে মতো চলে কাজকর্ম হতে দূরে থেকেছে। খাওয়া, ঘুম, আর পড়াশোনা ছাড়া যেন কোনো কাজই ছিলো না! আর শ্বশুর বাড়িতে এখন দিনরাত কাজ করছে। জোরজবরদস্তি না করলেও নিজেই আত্মসম্মানের কথা ভেবে কাজে লেগে পড়ে! কখন কোন দিক থেকে তীর এসে বিদ্ধ হয় বলা তো যায় না! রানীর ন্যায় আচরণ করে নিজের মাকে এতোদিন জ্বালাতন করে এখন অন্যের মা’সহ অন্যের ঘর সামলাও। এ-ই তো সেই দুনিয়ার নীতি! বাবার বাড়ির সেই রানী হবে শ্বশুর বাড়ির বিনা বেতনের চাকরানী! এটাই সংসার, এটাই জীবন। মিলবে না এর থেকে মুক্তি, যদি না আসে মরণ।
.
যোহরের আযান পড়ে গেছে। ছেলেরা নামাজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ওদিকে আরমানকে ফোনে কথা বলতে শোনা গেলো। জেরিনের সাথে রাগারাগি করছে, জিহানকে বাসায় রেখে এখনো পার্লারে বসে আছে বলে! জিহান গোসলও করেনি। খেলায় মেতে আছে। কেউ টানাটানি করতে গেলে চিৎকার করে! এই প্রথম আরমানকে কারো সাথে রেগে কথা বলতে দেখলো নাফিসা। নচেৎ খুবই শান্তশিষ্ট স্বভাবের একজন মানুষ। অত:পর নাফিসা জিহানকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে গোসল করাতে নিয়ে এলো। গোসল শেষে বড় ঘরে নিয়ে এলো। আরমান ও ইমরান নামাজে গেছে। নিশাত গোসল করছে, বড় মা নামাজ পড়বে ওযু করে এসেছে। এখন জিহানের জামাকাপড় নিবে কে! সে তো ভুলেও যাবে না ওই জেরিনের ঘরে! একটু পরেই আবিদা বেগম গোসল সেড়ে বেরিয়ে এলো। নাফিসা তার ভেজা কাপড় শুকাতে দেওয়ার জন্য হাতে নিয়ে জিহানের নতুন জামার কথা বললে এনে দিলেন তিনি। অত:পর জিহানকে পোশাক পড়িয়ে তৈরি করে নিজের রুমে এনে বসিয়ে রাখলো। ইমরান বাড়ি ফিরে নাফিসাকে বসে থাকতে দেখে বললো,
– এখনো গোসল করনি!
– নিশাত গোসল করছে।
– ওই ঘরে বাথরুম নেই?
– জিহানকে রাখবে কে!
– মা কোথায়?
– আম্মা, বড় মা নামাজ পড়ছে।
– যাও এবার, দ্রুত গোসল করো। তোমাদের তো আবার আটাময়দা ঘষামাজা করতে ঘন্টার পর ঘন্টা লাগে। আরেকজন বাচ্চা রেখে কোন সকালে গেছে, এখনো ফেরার খবর নেই!
– আমি মোটেও ওসব করি না। আমার রেডি হতে দশ মিনিটই যথেষ্ট। হুহ্!
নিশাত মাত্রই বেরিয়ে এসেছে আর নাফিসা গেছে। গোসল করে নামাজ পড়ে নিয়েছে সে। এমনি আবিদা বেগম এলো, হাতে গহনার বাক্স! খাটে বসে বাক্স খুলে বললেন,
– এইগুলা পইরো। বউ মানুষ, হাত কান খালি রাইখো না। চেহারার আগে হাত কানে চোখ যায় সবার।
– কার এগুলো?
– তোমার জন্যই বানাইছি। বিয়ার মধ্যে তো সুযোগ পাইলাম না দেওয়ার। সব কাজে তাড়াহুড়া চলে! এতো তারাহুড়ার কাজ আমি করতে পারি না।
হাতের আংটি, কানের দুল, কণ্ঠহার, আর টিকলি রেখে চলে গেলেন আবিদা বেগম। তার কথায় গম্ভীর ভাব প্রকাশ পেয়েছে যার কারণ ইমরানের এমন হুটহাট বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসা। এখন ইমরানও ঘরেই ছিলো কিন্তু দুজনের একজনও কোনো কথা বললো না। চুপচাপ শুধু শুনে গেলো।
নাফিসা আজ নিজের বিয়ের দিন ইমরানের দেওয়া সেই শাড়ি পড়েছে। যেটা পড়ে সে বউ সাজেনি সেটাই আজ নরমালভাবে পড়েছে। অত:পর শাড়ির সাথে হিজাব পড়েছে এবং চোখে চিকন ফ্রেমের একটা চশমা আর ঠোঁটে হালকা লাল রঙের লিপস্টিক। ইমরান এতোক্ষণ ঘরে বসেই দেখছিলো তার সাজ। শাড়ি পড়তেই শুধু যতটুকু সময় লেগেছিলো আর বাকিসব তারাতাড়িই হয়ে গেছে। পরিপূর্ণভাবে তৈরি হয়ে ইমরানের সামনে দাড়িয়ে বললো,
– ঠিক আছে সব? আর লেগেছে কি বেশি সময়?
ইমরান উঠে এসে কপালে আলতো পরশ দিয়ে বললো,
– মাশাল্লাহ, একদম পারফেক্ট। কিন্তু মায়ের দেওয়া গহনা যে পড়লে না?
– গহনা পড়ে নিজেকে অন্যের সামনে প্রদর্শন করা ভালো নাকি হিজাবে নিজেকে পর্দার আড়ালে গুটিয়ে রাখা ভালো?
– অবশ্যই হিজাব সাপোর্টার। কিন্তু মা যে ছেলের বউয়ের জন্য গড়ে রেখেছে তার কি হবে!
নাফিসা আংটি টা পড়লো এবং টিকলি টা হিজাবের ভেতরে এটে দিয়ে বললো,
– হাতে বালা, আঙুলে আংগুটি, মাথায় টিকলি আর নাকে ফুল। কান আর গলা তো দেখা ই যায় না। তো সেগুলোর আর প্রয়োজন নেই। এবার ঠিক আছে নিশ্চয়ই?
বিপরীতে ইমরান মুচকি হাসলো এবং জুতা পড়ে নিলো। নাফিসা তড়িঘড়ি করে আলমারি খুলতে খুলতে বললো,
– ভালো কথা মনে করেছো! নতুবা আমি তো এখন শাড়ির সাথে স্যান্ডেল পড়েই চলে যেতাম!
– স্যান্ডেল পড়ে চলে যাবে, আমি দেখতাম না নাকি! তাছাড়া হয়েছে নাকি এমন কখনো?
– আর বলো না, মামাতো বোনের বিয়েতে এলাহী কান্ড ঘটেছে! রিসিপশনের দিন আপুকে আনতে যাওয়ার সময় স্যান্ডেল পড়েই বেরিয়ে গেছি! পরনে লেহেঙ্গা ছিলো তাই কারো নজরে পড়িনি! গাড়িতে উঠে অর্ধেক রাস্তা অতিক্রম করার পড় চোখ পড়েছে পাশে থাকা মামীর! মামী বলার পর সেখানেই কান্না শুরু করেছি আমি যাবো না তাদের বাড়িতে। মাঝরাস্তা থেকেই খালি পায়ে বাড়ি ফিরে আসবো। সবাই হেসেছে আর আমি একা কেদেছি।
– তারপর এভাবেই চলে গেছো?
– কথা শেষ করতে দাও! তারপর মামা আমাকে নিয়ে অন্য গাড়িতে উঠে আবার বাড়ি এসেছে। জুতা পালটে পরে আমরা সবার শেষে পৌছেছি।
ইমরান হাসতে হাসতে নিজের জুতা পড়ে নিলো। কিন্তু আজ ইমরানের হাসি বিরক্ত লাগেনি নাফিসার। কেননা সেই দিনের কথা মনে হলে তার নিজেরও হাসি পায় এখন।
নিশাত এলোমেলো চুল ও হাতে চিরুনী নিয়ে এসে বললো,
– ওয়াও ভাবি, লুকিং সো গর্জিয়াছ!
– থ্যাংক ইউ। কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন? এখনো রেডি হওনি!
– দেখো… কন্ডিশনার দিয়ে চুল এতোটা পিচ্ছিল হয়েছে কোনোভাবেই আটকাতে পারছি না৷ কি করবো এখন? চুল খোলা রেখেও থাকতে পারবো না এই গরমে!
নাফিসা কিছু বলার আগে ইমরানই বললো,
– এতো দরকার কি মানুষকে চুল দেখানো! তোর ভাবির মতো হিজাব পড়।
– এতো সুন্দর এয়ার রিং কিনে আনলাম পড়ার জন্য, আর তুমি বলছো হিজাব পড়বো!
– হ্যাঁ, পড়বি। মেয়েদের হিজাবেই তো দারুণ স্টাইল হয়ে যায়, তাহলে শুধু শুধু বেপর্দায় থেকে পাপ কেন কামাই করবি!
নাফিসা তার চুল ধরে অবস্থা বুঝে বললো,
– হয় এই গরমে খোলা রাখো আর না হয় খোপা করে হিজাব পড়ো।
– হিজাবেও তো গরম!
– খোলা চুলের মতো এতোটা হবে না। আর খেয়ে চলেই তো আসবে। এতো ঝামেলা করে সাজুগুজুর কি প্রয়োজন!
– ওকে।
নিশাতও হিজাব পড়লো। আবিদা বেগম গহনা দিয়ে যাওয়ার পরপরই জেরিন এসেছিলো বাড়িতে। নিশাত ও নাফিসাকে হিজাবী স্টাইলে দেখে আরমান হয়তো কিছু বলেছিলো জেরিনকে আর জেরিন ভেংচি কেটে বিরক্তি নিয়ে হনহন করে চলে গেলো নিশাতের কাছে। তার শাড়ির পিনটা ভালোভাবে আটকে দেওয়ার জন্য। তাছাড়া এতো সুন্দর এয়ার রিং কিনে দিলো সেদিন, আজ আবার নাফিসা হুজুরাইনের সাথে ঢং দেখাতে হিজাব পড়লো কেন তা নিয়ে ফুসছে নিশাতকে! জেরিন তার চুলের অজুহাতে জেরিনকে থামিয়ে দিলো। বড় মা ও নিশাত প্রশংসা করলেও আবিদা বেগম নাফিসাকে বললো,
– কানের দুল আর হার পড়লা না কে? পড়ার জন্য দেই নাই?
– আম্মা, মানুষকে গহনা দেখিয়ে কি লাভ বলুন তো! তার চেয়ে কি ভালো না অন্যের দর্শন থেকে পর্দার আড়ালে থাকি?
আবিদা বেগম আর কিছু বললো না। তিনিও নামাজ কালাম পড়ে যথেষ্ট পর্দার আড়ালেই থাকে। কিন্তু নিশাত ও জেরিনকে কিছু বলেন না পর্দা করা নিয়ে। এই ভেবে তাদের স্বাধীনতা দেয় যে এখনই তাদের ফ্যাশনের উপযুক্ত বয়স। পরে ঠিক হয়ে যাবে। পাশের বাড়িতে প্রোগ্রাম হলেও বড় মা এবং আবিদা বেগম বোরকা পড়েই এসেছেন।
বিয়ে বাড়িতে সেই দাদুটা জেরিনকে বললো,
– কি গো? তুই বুড়া হইয়া এমন কড়া সাজতে গেলি কে? দেখতো ইমরানের বউডারে কত্ত সুন্দর লাগতাছে। তোরে তো চেনাই যায় না! মাইক্ষা আইছে কতদি সাদা চুনা মাডি!
কথার স্টাইলে নিশাত হেসে উঠলো আর জেরিন নাফিসার প্রতি রেগে! সে আর নাফিসার আশপাশে না থেকে দূরেই চলে গেলো! এদিকে এক ভিখারিনী এসে খাবার চাইছে। রেখার মা মহিলাকে বলে দিলো,
“এহন যান, যান। মেমান গো খাওয়াদাওয়া শেষ হোক, পরে আইবেন। এমন শুরুতেই আইয়া খাবার চায় কেউ!”
মহিলাটি চলে যেতে নিলে নাফিসা বললো,
– কাকি, এটা কেমন কথা হলো। ক্ষুধার্ত ব্যাক্তি খাবার চাইছে আর আপনি দিবেন না? আপনার মেয়ের বিয়েতে তো উনার দোয়া ই বেশি কাজে লাগবে।
– আরে, না করি নাই তো! পরে দিমু। এহন বিলাইয়া দিলে মেমান গো শট পড়তো না!
– তো, মেহমানরা খেয়ে গেলে উনার জন্য শর্ট পড়বে না? এখানে উপস্থিত মেহমানদের মধ্যে সবার চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত হয়তো তিনি। আর ক্ষুধার্তের জন্য আহারের ব্যবস্থা না করে আমরা বোকা মানুষেরা তাদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করি যারা খেতে অনীহা প্রকাশ করে! কেননা তেলা মাথায় তেল দেওয়া আমাদের একটা রোগ! সব জেনে বুঝেও আমরা সচেতন সুনাগরিক হইনা! আন্টি, আপনি দাড়ান। আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার খাবারের অংশটুকুই না হয় উনাকে দিয়ে দেই, কি বলেন কাকি?
দাদু বলে উঠলো,
– কি লক্ষ্মী আইছে গো আবিদার ঘরে! রেখার মা, ঠিক কতা কইছে কিন্তু!
রেখার মা হেসে বললো,
– কি কও! তোমারটা দেওয়া লাগবো! যার যার রিজিক হেয় হেয়ই খাইবো। ওইযে ইমরান ডাকে, যাও। আর আপনে চেয়ার টাইনা হেনে গিয়া বহেন। আমি পেলেট দিয়া খাবার আনাইতাছি।
নাফিসা মনে মনে বললো,
“হুহ্, জানেন তবুও মানেন না! এখনই তো উনার রিজিক মেরে দিচ্ছিলেন।”
ওদিকে ইমরান ডাকছে যাওয়ার জন্য, সিট ফাঁকা আছে। নাফিসা নিশাতের সাথে চলে গেলো। আর রেখার মা মহিলাকে উঠুনের এক কোনে চেয়ার নিয়ে বসতে বলে খাবার এনে দিলো।

চলবে।