তৃ-তনয়া পর্ব-৮৭+৮৮+৮৯

0
776

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৭
(নূর নাফিসা)
.
.
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সময় প্রায় রাত ১টার কাছাকাছি। এতোক্ষণ ধরে কান্না করছে এখনো কাদছেই! চোখের পানি মুছে দিয়ে ইমরান বললো,
– এতো কান্না করছো কেন! মাথা ব্যথা করবে জান। স্টপ ক্রায়িং। আর একটুও কাদবে না। হুম?
নাফিসা লক্ষ্য করে দেখলো ইমরানের বুকের একপাশ খামছিতে ঝাঝরা করে ফেলেছে! যতগুলো আঁচড় পড়েছে প্রত্যেকটা আঁচড় লম্বাটে হয়ে ফুলে গেছে! কোনো কোনো ক্ষত হতে রক্তও বের হচ্ছে! গলার নিচে কামড়টাও দেবে গেছে বেশ! তার এই অবস্থা দেখে আরও কান্না পাচ্ছে! ভেতরটা চিনচিন ব্যাথা করছে এই ভেবে, তিনটা থাপ্পড়ের জন্য এই অবস্থা করেছে সে! ইমরানকে ছাড়িয়ে সে উঠতে গেলে ইমরান বাধা দিয়ে বললো,
– আবার কোথায় যাও!
– স্যাভলন নিয়ে আসি।
– লাগবে না। হা করো তো, মুখটা দেখি।
নাফিসা হা করলে ফোনের টর্চ দিয়ে দেখলো ডানপাশের সামান্য বাঁকা দাঁতটাতে চাপা পড়ে গালটা ভেতর থেকে একটুখানি কেটে গেছে। তখন রক্ত পড়লেও এখন শুধু জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে আছে। মলিন স্বরে ইমরান বললো,
– ব্যাথা লাগছে খুব?
– উহুম। ছাড়ো, স্যাভলন নিয়ে আসি।
– বললাম তো, লাগবে না।
– ইনফেকশন হয়ে যাবে, ছাড়ো।
নাফিসা তুলায় স্যাভলন নিয়ে একটু লাগাতেই ইমরান তার হাত ধরে বাধা দিলো! প্রচুর জ্বালা করছে! নাফিসার আরও কান্না পাচ্ছে ইমরানের বর্তমান অবস্থা দেখে! তুলো ঠেকাতেই দিচ্ছে না জ্বালার কারণে! তবুও অনেক্ক্ষণ সময় নিয়ে নাফিসা আস্তে আস্তে স্যাভলন দিয়ে মুছে দিলো। ঘুম আসছে না কারো চোখে। রাতভর গল্প করলো দুজন। তিনটার দিকে নাফিসা ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু ইমরান জেগে! কিছুক্ষণ পর আযান পড়লে নাফিসাকে ছাড়িয়ে সে উঠে ঘরে নামাজ আদায় করে নিলো। অত:পর আবার শুয়ে পড়লো ঘুমানোর জন্য। সকাল ছয়টার পর ঘুম ভাঙলো নাফিসার। পেট টা ব্যাথা করছে আর গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে। হবেই না কেন! কাল দুপুরে খেয়েছে আরেক দুপুর এসে হাজির হচ্ছে! ইমরানকে ঘুমাতে দেখে সে যথাসম্ভব কম নড়াচড়ায় উঠে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে নিলো। এই ঘরে খাওয়ার মতো কিছু নেই। কালকের ঘটনার জন্য সেই ঘরেও যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে বোরকা পড়ে দোকান থেকে কিছু কেনার জন্যই তৈরি হয়ে গেলো। পার্স নিয়ে দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাইরে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বাড়ি থেকে বের হতে হতে ভাবতে লাগলো কি কিনবে! বিস্কুট? না! কেক? না! রুটি? খেতে ইচ্ছে করছে না! মিষ্টি জাতীয় কোনো কিছুই রুচিতে আটছে না! দোকানের কাছে এসেও সিদ্ধান্ত বদলে পুরি সিঙ্গারা কেনার জন্য হোটেলের দিকে হাটতে লাগলো। হাটতে হাটতে সেখানে এসেও সিদ্ধান্ত বদলে পরটা ভাজি কিনে নিলো।
এদিকে ইমরানের ঘুম ভেঙে গেছে। সে নাফিসাকে রুমে দেখতে পেল না। সাতটা বেজে যাচ্ছে তাই আর শুয়ে না থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লো। বাইরে এসেও দেখলো বাড়ি জনশূন্য! কোনো কোলাহল নেই। এমন স্তব্ধ হয়ে গেছে কেন সব! গতকালের ঘটনার জন্যই কি? জিহান হয়তো ঘুম থেকে উঠেনি, তাই তার গলাও শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু নাফিসা কোথায়!
গুমোট পরিস্থিতির কারণে ইমরানের মনে একটু খটকা লাগলো। বাথরুমের দিকে নাফিসাকে না পেয়ে সে বড় ঘরের দিকেই এলো। এ ঘরেরও গেইটের তালা খোলা কিন্তু গেইট লাগানো। সে গেইটে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই কিচেনে গেলো, তার মাকে একা রান্না করতে দেখলো। কিন্তু নাফিসার কথা কিছু জিজ্ঞেস না করে বড় মা’র রুমে এলো। কেউ নেই এখানে। মায়ের রুমে শুধু নিশাত ঘুমাচ্ছে। আর ড্রয়িং রুমও ফাঁকা। ইমরান বেরিয়ে এলো বড় ঘর থেকে। ভেতরের খটকাটা যেন এবার ভয়ে পরিণত হয়েছে! সে আর কোনো দিকবিক না তাকিয়ে সোজা তার রুমে চলে এলো। আলমারি খুলে নাফিসার সেই বোরকা এবং পার্স ছাড়া বাকিসব ঠিকই আছে। নাফিসা কি সত্যিই চলে গেলো! এটা কেন করলো সে! কাল রাতেই তো তাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিলো! তাহলে!
ইমরানের ভেতরটা ভয়ে খুব উথাল-পাথাল করছে! এভাবে রাগ করে সে চলে গেলো কিভাবে! তার শ্বশুর বাড়িতে জানাজানি হলেই ব্যাপারটা কোনদিকে পৌছতে পারে ভাবতে পারছে না ইমরান! কেন সে হাত তুললো তার গায়ে! নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার কাছে! সে ঝটপট নাফিসার ফোনে কল করলো, ফোন ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে বেজে চলেছে! যেখানে ইমরান রেখেছিলো সেখানেই! এখন কি করবে ইমরান ভেবে পাচ্ছে না! এতো প্রচেষ্টার পর রাগ ভাঙালো, নাফিসা তাকে আঘাত করে আবার আদরও করলো, তাহলে আজ সকাল হতেই সে চলে গেলো কেন! রাতে কি তার রাগ ভাঙেনি!
ইমরান মুখ ধুয়ে পোশাক পড়ে যতদ্রুত সম্ভব তৈরি হয়ে গেলো! মনে মনে এই প্রত্যাশা করছে ওবাড়িতে যেন নাফিসা কিছু না জানায়। আর সে যেনো নাফিসাকে ফিরিয়ে আনতে পারে! বাবাকে কি একবার কল করে শিওর হয়ে নিবে সে ওবাড়িতে গেছে কিনা! নাহ, যদি সে ওবাড়িতে না যায়! তখন বাবাকে সে কি জবাব দিবে! আর কোথায়ই বা খুজবে তাকে! আগে চুপচাপ দেখে আসা দরকার।
ইমরান তড়িঘড়ি করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে ফোন হাতে নিয়ে যেই দরজার দিকে যাবে, তেমনি নাফিসা রুমে প্রবেশ করলো! ইমরান কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে! নাফিসা তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেছে! চোখ লাল হয়ে আছে, চেহারায় যেন রাগান্বিত ভাব ফুটে আছে! ভয়ার্ত ইমরানকে দেখে তার পা দরজার কাছেই স্থির হয়ে গেছে! এমন দেখাচ্ছে কেন তাকে! কি হয়েছে তার! সে কি তার উপর রেগে আছে! রাগবে কেন শুধু শুধু! কি করেছে সে! নাফিসা এক ঢোক গিলে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে হাতের প্যাকেট এবং পার্স ড্রেসিং টেবিলে রাখলো। ইমরান যেন পাথর হয়ে দাড়িয়ে আছে! ভয়ে ভয়ে নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে?
ইমরানকে খুব রাগান্বিত দেখা গেলেও খুব শান্ত স্বরে সে প্রশ্ন করলো,
– কোথায় গিয়েছিলে?
– পরটা আনতে।
– বলে যাওনি কেন আমার কাছে?
বলে যায়নি তাই কি সে রেগে আছে! এখন কি আবার মারবে তাকে! ভয়ে নাফিসার প্রায় কাদো কাদো অবস্থা! চোখ যেন ভেজা হয়ে আসছে সাথে কম্পিত গলায় ইমরানের প্রশ্নের জবাবে বললো,
– আরেকবার আমাকে মারলে কিন্তু আমি মরে যাবো!
সাথে সাথেই ইমরান তাকে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলো, যতটা শক্ত করে ধরা যায় ঠিক ততটাই! মাথায় চুমু দিলো! তার ভেতরটা যেন কাপতে কাপতে ফেটে যাচ্ছে!
– তুমি কি এখনো রেগে আছো আমার উপর? বলো?
ইমরানের কণ্ঠ কেমন যেনো ধাধানো! তার বর্তমান অবস্থা কোন দিকে আছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না নাফিসা! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাই মুখ থেকে নিকাব সরিয়ে নিয়ে বললো,
– উহুম।
– তাহলে তুমি বলে যাওনি কেন আমার কাছে? আমি তো ভয় পেয়ে গেছি! ভেবেছি আমাকে রেখে চলে গেছো! নাফিসা, আমি কখনো কোন ভুল করলে কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? মানুষ তো ভুল করতেই পারে। আমি ভুল করলে কি আমাকে শুধরানোর সুযোগ দিবে না? অভিমান নিয়ে কি পালিয়ে যাবে আমার কাছে থেকে? আমি তো কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাতে চাই না তোমায়। তুমি কি আমাকে হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করবে? বলো? সত্যি, আমি ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেছি! যখন দেখলাম আলমারিতে পার্স ও বোরকা নেই, তখন আরও অনেক ভয় পেয়ে গেছি! বিশ্বাস করো, অনেক ভালোবাসি। আল্লাহর কাছে আমি সবসময় প্রার্থনা করতাম, যদি আমাকে জীবনসঙ্গী দেয়া হয় তো এমন একজনকে যেন দেয় যাকে আমি অনেক ভালোবাসতে পারবো। আমার মায়েদের পর যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারবো সে যেন আমার সঙ্গীই হয়। আমি তোমাকে জেনে, তোমাকে পেয়ে সেই ভালোবাসতে শুরু করেছি। আখিরাত পর্যন্ত যেন টিকে যায় এই ভালোবাসা এখন এই প্রার্থনাই করি আল্লাহ তায়ালার কাছে। তাহলে তুমি কি আমাকে কোনো কারণে এতো অল্প সময়ে এই পৃথিবীতেই ত্যাগ করবে?
ইমরানের কথাবার্তায় নাফিসার ভেতরটা ই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে! চোখের পানি তো কোনো বাধা মানছেই না! গলা দিয়েও কোনো কথা বের হচ্ছে না! তবুও তাকে শান্ত করতে বললো,
– এমন করছো কেন তুমি! আমি যাই নি তো। কোথায় যাবো তোমাকে ছেড়ে! ক্ষুধা লেগেছিলো তাই একটু বেরিয়েছিলাম। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই ঘুমটা নষ্ট করিনি।
ইমরান নাফিসাকে ছেড়ে দুহাতে তার মুখখানা ধরে চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,
– নাফিসা শোনো, সংসার করতে গেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু আধটু ঝগড়া, মনোমালিন্য হয়ই। এসবে এতো রিয়েক্ট করা ঠিক না। রাগ করলেও ক্ষণিকের জন্য সেটা স্থীর করবে। আর যত দ্রুত সম্ভব তার মীমাংসা ভালো। আমিও তো তোমার উপর রেগে গিয়ে হাত তুলে ফেলেছিলাম। তুমি কি রেগে গিয়ে আমাকে উল্টাপাল্টা বলো না? আমি কি তখন তোমাকে চলে যেতে বলি? তোমার সাথে থাকবো না সেটা বলি? তোমাকে মেন্টালি অনেক টর্চার করি? এভাবে তো সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে! এসব মোটেও করবে না কখনো। রাগ সবারই হয়। তাই বলে রাগ করে উল্টাপাল্টা কিছু করা মোটেও ঠিক না। যারা এসব করে তারা কখনো সুখী হয় না। আমি সুখের সংসার সাজাতে চাই তোমায় নিয়ে। রাগ অভিমান নিয়ে কখনো পিছপা হবে না তো? বলো?
নাফিসা ডানেবামে মাথা নাড়তেই শুরু হলো ইমরানের সেই গত রাতের মতো পাগলামো! নাফিসার সারামুখ চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে! তাকে থামানো দায়! কতটা পাগল হলে এমন কাজ করতে পারে নাফিসা ভাবতেও পারছে না! তার ভেতর থেকে শুধু কান্না আসছে! কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছে, এই কান্নাটা কষ্টের না! তাহলে এটা কিসের কান্না! কাল ইমরান তাকে আঘাত করলো তবুও এই পাগলামো এতো ভালো লাগছে কেন তার!
ইমরান তাকে পূর্বের ন্যায় শক্ত করে জরিয়ে ধরে চোখের পাতা বন্ধ রেখে কপালে ঠোঁট ছুয়ে রাখলো! নাফিসাও চোখের পাতা বন্ধ করে খুব অনুভব করলো ইমরানকে! কয়েক মিনিট কেটে গেলো তাদের এভাবেই। এক পর্যায়ে নাফিসাই অশ্রুসিক্ত লোচন ও মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
– ক্ষুধায় পেট ব্যাথা করছে আমার।
ইমরান তার নাকে আলতো কামড় দিয়ে বললো,
– এতো খাই খাই কেন করিস! যা ভাগ।
– তুই ভাগ!
– তুই ভাগ!
অত:পর দুজনেই নিচু শব্দে হেসে উঠলো!
নাফিসা বোরকা খুলতে খুলতে বললো,
– শার্ট প্যান্ট পড়ে এখন কোথায় যাচ্ছিলে?
– আমি তো তোমাকে খুজতেই বের হচ্ছিলাম! সোজা তোমাদের বাসায় যেতাম এখন।
– সেখানে গিয়ে না পেলে?
– জানিনা কি করতাম।
নাফিসা চুপচাপ বোরকা হিজাব রেখে হাতমুখ ধুয়ে এলো। পরটার প্যাকেট খোলার সময় ইমরান বললো,
– এতো ক্ষুধা লেগেছে আমাকে ডাকলে না কেন?
– রাতে ঘুমাওনি তুমি, তাই ঘুম নষ্ট করিনি।
– তুমি বুঝলে কিভাবে আমি ঘুমাইনি?
– আমি ঘুমে থেকেই তোমার পাগলামো গুলো অনুভব করেছি।
– ফোন নিয়ে যাওনি কেন সাথে?
– পাঁচ দশ মিনিটের জন্য যাবো, শুধু শুধু ফোন নেয়ার কি প্রয়োজন। তাছাড়া ভেবেছি পাশের দোকান থেকে কেক অথবা বিস্কুট নিয়ে চলে আসবো। কিন্তু ওইগুল খেতে রুচিবোধ হচ্ছিলো না৷ তাই আরও সামনে গিয়ে পরটা ভাজি নিয়ে এলাম।
– ঘুমাই আর যা-ই করি না কেন, আমাকে ইনফর্ম না করে কোথাও যাবে না। আর বাড়ির বাইরে দুই মিনিটের জন্যও ফোন ছাড়া থাকবে না।
– ওকে। হাত ধুয়ে এসো।
– পেট ব্যাথা করছে না? একটা রেনিটিডিন খাও।
ইমরান নিজেও গ্যাস্ট্রিকের একটা ট্যাবলেট খেলো এবং নাফিসাকেও খাওয়ালো। পুচকে বউয়ের আলসে বর’টা আর হাত ধুয় নি! দরজা লাগিয়ে বউকে তার হাটুর উপর বসিয়ে তারপর বউয়ের হাতেই ব্রেকফাস্ট সাড়লো।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৮
(নূর নাফিসা)
.
.
তাদের ব্রেকফাস্টের একটু পরেই আবিদা বেগম এলেন এই ঘরে। দরজার সামনে থেকেই ইমরানের উদ্দেশ্যে বললো,
– খিচুড়ি রান্না করছি। সাথে মুরগির মাংস খাবি নাকি গরুর মাংস?
– একটা হলেই হলো।
– একটা হইলেই হয় ক্যামনে! দুইটার স্বাদ কি এক? দুই ভাইয়ের মুখে এক কথাই!
– আচ্ছা, গরুর মাংসই।
অত:পর তিনি নাফিসার উদ্দেশ্যে বললেন,
– আমরা তো খারাপ লোক। খারাপের হাতের রান্না কি আর খাইতে পারবা? যা আছে ঘরে নিজের ইচ্ছা মতো রান্না কইরা নেও।
নাফিসা আবিদার কথা শোনার পরপরই ইমরানের দিকে তাকালো। ইমরান মুখ ভঙ্গিতে ইশারা করলো কিছু না বলতে। আবিদা বেগম চলে গেলে ইমরান বললো,
– কোনো বিষয়ে মায়ের সাথে তর্কে জড়াবে না। কিছু কথা চুপচাপ শুনে যাওয়ার মতো ধৈর্য নিশ্চয়ই আমার বউয়ের আছে। আর কারো উপর জেদ করে নিজের ক্ষতিও করবে না। নিজের মতো করে চলবে, ফিরবে, খাবে। আমরা যে ব্রেকফাস্ট সেড়ে নিয়েছি এটাও জানতে দিও না মাকে। জানলে কষ্ট পাবেন। আজ খেয়েছি নেক্সট টাইম কিন্তু আর এমন কিছু হবে না। মা কিন্তু সকাল থেকেই একা একা রান্না করছে আমাদের জন্য। এখন যদি না খাই তো কষ্ট পাবে না?
নাফিসা কিছু বললো না। সে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলো। চুপচাপ তা-ই শেষ করলো। ইমরান তার মুখটা মলিন দেখে বললো,
– মা কিন্তু তোমার গতকালের বিহেভিয়ারে কষ্ট পেয়ে এমন কথা বলে গেছে। তুমি কি সত্যি সত্যিই আলাদা রান্না করে খাবে?
নাফিসা তার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাতেই সে মৃদু হেসে বললো,
– মা একা রান্না করছে। হেল্প করো গিয়ে? যাবে না?
নাফিসা আবার স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকাতেই ইমরান ফিসফিসিয়ে বললো,
– হার্টবিট, যাও।
নাফিসা বেরিয়ে গেলো বড়ঘরের উদ্দেশ্যে। গেইট দিয়ে প্রবেশ করার পরপরই দেখা পেল জেরিনের। মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছে মনে হচ্ছে! তবে তাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না! চোখ মুখ একটু বেশিই ফোলা ফোলা মনে হচ্ছিলো, তারউপর নাফিসাকে দেখে মুখটা হুতোম প্যাঁচার মতো হয়ে গেছে! যদিও চলার পথে সামনে পড়ায় নাফিসা এক পলক তাকিয়েছিলো তার দিকে, তবুও লক্ষ্য করেছে বিষয়টি। নাফিসা কিচেনে এসে দেখলো আবিদা বেগম গরুর মাংস রেখে মুরগির মাংস আবার প্যাকেট করে ফ্রিজে রেখে দিচ্ছে। দুইটাই নামিয়েছিলো, কোনটা রান্না করবে সেটা কনফিউশানে থাকলেও ছেলেদের পছন্দে এবার নিশ্চিত হয়ে নিলো। নাফিসা বললো,
– আম্মা, আলু দিয়ে রান্না করবেন? আলু কেটে দিবো?
– না, আমিই কাটতে পারি।
নাফিসা তার এমন ভঙ্গিতে বলা “না” আর শুনলো না। নিজেই বটি ,আলু নিয়ে কাটতে লাগলো। পরক্ষণে আবিদা বেগম তরকারি বসানোর কাজে হাত লাগালেন। জেরিন এসে মিনিট খানেক দাড়িয়ে থেকে পরে আবার চলে গেলো। আবিদা বেগম জিজ্ঞেস করেছিলো জিহান উঠেছে কি-না। উত্তরে সে বলে গেছে “না”। নাফিসা এবারও এক পলক তাকিয়েছিলো তার দিকে। আর স্পষ্টই দেখতে পেয়েছে তার ফর্সা গালে কিছুটা নীল বর্ণ ধারণ করেছে আঙুলের ছাপ!
নিশাত, জিহান উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। আরমানও গোসল সেড়ে তৈরি অফিসের জন্য। জেরিন একদম চুপচাপ বসে আছে সোফায়। বাড়িতে আজ খুবই নীরবতা কাজ করছে! কাজকর্ম সেড়ে টেবিল গুছিয়ে নাফিসা বেরিয়ে এলো তাদের ঘরের দিকে। আসার সময়ও একবার তাকিয়েছে জেরিনের চেহারায়। এটা দেখার জন্য যে, ছাপ কি তার দুই গালেই আছে নাকি! কিন্তু না, একগালেই আছে তা-ও দুই বা তিন আঙুলের হবে। ভাবতে ভাবতে নাফিসা তাদের রুমে প্রবেশ করলো। ইমরান তাকে চিন্তিত দেখে বললো,
– আপনি কি আবিষ্কার করতে যাচ্ছেন, যার ফলে হাটতে হাটতেও ভাবছেন?
নাফিসা ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
– তোর মাথা।
– ওহ্, আচ্ছা? তোর বরের মাথা?
– হ্যাঁ আমার বরের মাথাই।
নাফিসা হিহিহি করে হেসে উঠলো আর ইমরানের মুখেও লেগে আছে মুচকি হাসি। মাত্র গোসল করে এসেছে সে। মুখে ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম ইউজ করছে। নাফিসা দরজা চাপিয়ে এসে তার উন্মুক্ত পিঠে মাথা রেখে দাড়িয়ে বললো,
– এতো ঘষামাজার কি দরকার! এই বয়সে মেয়ে পটানোর ধান্ধায় আছিস?
– বুড়ো হয়ে গেছি নাকি!
– বিয়ে করলে তো বুড়োই হয়ে যায়।
– তাই নাকি! আচ্ছা, তাহলে তুই চাইলে নিয়ে আসবো দু একটা ধরে।
– ঠ্যাং ভেঙে ফেলবো একেবারে।
ইমরান শরীর কাপিয়ে হেসে উঠলো। নাফিসা এবার স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি কি জেরিনকে থাপ্পড় দিয়েছো?
ইমরানের রিয়েকশন দেখার জন্য সে আবার পেছন থেকে উঁকি দিয়ে আয়নায় তার চেহারার দিকে তাকালো। ইমরান নরমালই আছে কিন্তু কোনো জবাব দিলো না। নাফিসা আবার আগের ন্যায় পিঠের মাঝামাঝিতে মাথা রেখে বললো,
– কি জিজ্ঞেস করলাম!
– আমি কেন অন্যের বউ পেটাতে যাবো!
– তাহলে কে দিলো! তার গালে আঙুলের ছাপ নীল হয়ে আছে।
– ভালো।
– ভাইয়া কি মারে তাকে?
– জানিনা। মারতে দেখিনি এবং শুনিনি কখনো, তবে কাল দিয়েছে হয়তো দু একটা।
– কেন?
– নিশাত খাওয়ার জন্য ডেকে যাওয়ার পর ওই ঘরে গিয়েছিলাম। ভাইয়ার সামনেই তাকে জিজ্ঞেস করে এসেছি তোমাকে চোরের অপবাদ দিলো কেন? কারো উপকার করতে গেলে চোর হয়ে যায় কি-না সেটাই জানতে চেয়েছিলাম। সে তখন চুপ ছিলো। ভাইয়াকে এটাও জানিয়ে দিয়ে এসেছি সে বাথরুমে ফোন সেট করে এসেছিলো। বেরিয়ে আসার সময় ভাইয়ার গলা শুনেছিলাম। বকেছে হয়তো। সাথে জেরিনের চাপাও। এরপর কি হয়েছে জানি না। আর থাপ্পড় দিয়ে থাকলে উচিত করেছে। কিছুটা শাস্তি পাওয়া দরকার। অনেক বেড়ে গেছে।
ইমরান মাথা আঁচড়ে নিলো। নাফিসা চুপচাপ এভাবেই আছে। তাই সে জিজ্ঞেস করলো,
– ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি!
– হুম, ঘুম ঘুম পাচ্ছে।
– আজ ভার্সিটি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার খেয়ে তারপর ঘুম দাও। এলার্ম দিয়ে রাখবে। যোহরের আযান দিলে উঠে গোসল করবে।
– আহ! প্রতিদিন যদি এভাবে ভার্সিটি যেতে নিষেধ করতো আর ঘুমাতে বলতো, কতোই না ভালো লাগতো!
– প্রতিদিন এমন দিন না আসুক। যা বললাম, তা-ই করো। আবার আড্ডায় মেতে উঠো না।
– তুমিও তো ঘুমাও নি। আজ ছুটি নেওয়া যায় না?
– কেন গো, আমাকে ছাড়া প্রহর কাটে না বুঝি!
ইমরানের চোখে মুখে দুষ্টুমি ফুটে উঠেছে! নাফিসা পালাতে চাইলেও সম্ভব হলো না! ইমরানের হাতে ধরা পড়তেই হলো।
জেরিন জিহানকে সিদ্ধ ডিম খাওয়াচ্ছে। জিহান বাইরে চলে এসেছে জেরিন ডিম হাতে নিয়ে তার পিছু পিছু ঘুরছে। হঠাৎই নাফিসা এবং ইমরানের হাসির শব্দ পেল। রুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা ইমরানকে ঠেলতে ঠেলতে রুম থেকে বের করছে। নাফিসাকে কিছুটা এলোমেলো অবস্থায় দেখে ভেতরটা কেমন যেনো চেপে গেছে তার! এতো সুখী কিভাবে হতে পারে তারা! কাল যা ঘটলো আজ কি এতোটা হাসিখুশি থাকার কথা ছিলো!
এদিকে নাফিসা ইমরানকে দরজার বাইরে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললো। ইমরান দরজায় নক করে বললো,
– দরজা খুলো।
নাফিসা ভেতর থেকে মোটামুটি উচ্চস্বরে জবাব দিলো,
– জীবনেও না, ইডিয়ট।
– অফিসের জন্য লেট হয়ে যাচ্ছে।
– হোক লেট, তবুও না।
– আর করবো না, প্রমিজ।
– তোমার গ্যারান্টি নেই।
– অফিস যাবো তো। আচ্ছা, শার্ট দাও।
নাফিসা দরজা একটু ফাঁক করে সেন্টু গেঞ্জি আর শার্ট দিয়ে হাসতে হাসতে সাথে সাথেই দরজা লাগিয়ে দিলো। যদিও ইমরান সামান্য চেষ্টা করেছিলো ঠেলে প্রবেশ করার, কিন্তু নাফিসা সেই প্রস্তুতি নিয়েই দরজা খুলেছে। ইমরান বাধ্য হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েই পোশাক পড়ে নিলো। এবং বললো,
– ফোন রয়ে গেছে।
– খাওয়ার পর নিবে।
– না, এখন লাগবে।
নাফিসা দরজার নিচ দিয়ে ফোন দিলো। আবার বললো ঘড়ি রয়ে গেছে। নাফিসা এবারও দরজার নিচের ফাঁকে দিলো। ইমরান নাফিসাকে বড় ঘরে আসতে বলে চলে গেলো। দু তিন মিনিট পর নাফিসা বড় ঘরে এলো। কিছুক্ষণ আগের খুনসুটি মনে করে একে অপরকে দেখে মিটিমিটি হাসছে যেটা জেরিনের চোখ এড়ায়নি।
পেট ভরা থাকলেও ইমরান অল্প খিচুড়ি নিলো। নাফিসাকে খাওয়ার জন্য বললে সে ইশারায় বললো এখন সম্ভব না। তবুও ইমরান বললো অল্প হলেও খেতে। নাফিসা জানিয়ে দিলো পরে খেয়ে নিবে। ইমরান খেয়ে চলে গেলো। বের হওয়ার সময় আবারও বলে গেলো খেয়ে তারপর ঘুমাতে। নাফিসা বাদে সবারই নাস্তা করা শেষ। নিশাতের সাথে যখন সে টিভি দেখছিলো এবং টুকটাক গল্প করছিলো ড্রয়িং রুমে তখন আবিদা বেগম এসে বললেন,
– না খাইয়া বইসা আছো কে? আমার রান্না খাইবা না যহন কই নাই নিজের যা ইচ্ছা রান্না কইরা খাও!
আবিদা বেগমের কথায় নাফিসা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। কি আর বলবে, সে যে পরটা ভাজি খেয়ে পেট পুড়ে নিয়েছে সেটা কি বলা যাবে! বাধ্য হয়ে চুপচাপ উঠে কিচেনে চলে এলো। নিশাতও পড়ার জন্য বেরিয়ে গেলো তার রুমের উদ্দেশ্যে। বেশি খেতে পারবে না তাই বাটিতে খাবার নিলো নাফিসা। ড্রয়িং রুমে এসে এক চামচ মুখে দিতেই নিশাতের ডাক পড়লো তার ফোন বাজছে। সে বাটি রেখে চলে গেলো ফোন আনতে। নাজিয়া নাহিদা কনফারেন্সে কল করেছে তাকে। রিসিভ করে সে বারান্দায় দাড়িয়ে কথা বলতে লাগলো আপুদের সাথে। খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই নাফিসার খাবারের কথা মনে হলো। তাই সে কথা বলতে বলতে আবার বড় ঘরে এলো। এই কয়েক মিনিটে খিচুড়ি আগের চেয়ে কিছুটা পানসে হয়ে গেছে৷ নাফিসা কথা বলতে বলতেই খাচ্ছে। এমনিতেই খেতে ইচ্ছে করছিলো না এখন যা-ই এইটুকু নিলো তা-ও কেন জানি বিস্বাদ লাগছে কিছুটা। খাবার নষ্ট করা ঠিক হবে না ভেবে খেয়ে নিচ্ছে। এরই মাঝে জিহান এসে খেতে চাইলো কিন্তু ঝাল হওয়ায় নাফিসা তাকে আর দিলো না। খাওয়া শেষে বাটি টেবিলে রেখেই আপুদের সাথে কথা বলছে নাফিসা৷ আর এদিকে জিহান বাটি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ড্রয়িং রুম থেকে। সে চামচ দিয়ে বাটি বাজাতে বাজাতে জেরিনের কাছে এসে বললো,
– আম্মু, খিচুই খাবো।
জেরিন তার হাতে বাটি দেখে চমকে উঠে বললো,
– তুমি খিচুড়ি খেয়েছো?
– আমি খিচুই খাবো।
জেরিন একটু ভয়ার্ত হয়ে বললো,
– তুমি কি এই বাটি থেকে খিচুড়ি খেয়েছো?
– হু।
জেরিনের প্রায় কাদো কাদো অবস্থা! সে বাটি ফ্লোরে ফেলে হাটু ভেঙে জিহানের সামনে বসে বললো,
– খেয়েছো কেন খিচুড়ি!
বাটি ফেলে দেওয়ায় জিহান চিৎকার করে বললো,
– আমি আরও খিচুই খাবো! দাদু…
সাথে সাথেই ভেসে উঠেছে জেরিনের হাউমাউ কান্নার আওয়াজ! নাফিসা কল কেটে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো। এদিকে আবিদা বেগমও এক প্রকার দৌড়ে এসে জানতে চাইলো কি হয়েছে? কান্নার সাথে বলছে বিধায় তার কথা অস্পষ্ট! দুতিন বার বলার পর নাফিসা বুঝতে পারলো জিহান নয়টা ঘুমের টেবলেট মেশানো খিচুড়ি খেয়ে ফেলেছে! শুনতেই নাফিসার ভেতরটা ধুক করে উঠলো এবং সে স্তব্ধ হয়ে গেলো! বুঝতে বাকি নেই জেরিন তার সাথে শত্রুতা করে এমন কাজ করেছে! জেরিন কাদছে, আরমানকে কল করার জন্য দৌড়ে ফোন নিয়ে আসছে! আর আবিদা বেগম ভয়ার্ত হয়ে একের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে যার কোনো উত্তর পাচ্ছে না। জেরিন ফোন নিয়ে দৌড়ে আসতেই নাফিসা বললো,
– জিহান খিচুড়ি খায়নি ভাবি। খেতে চেয়েছিলো, ঝাল হওয়ায় দেইনি আমি। সবটা আমার পেটেই গেছে। আপনার উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবে সফল হবে এবার। কংগ্রেচ্যুলেশন। খুব মহৎ ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন আপনি।
জেরিন কান্না থামিয়ে নাফিসার দিকে তাকিয়ে আছে। নাফিসা আবার বললো,
– আপনার খারাপের জন্য কি আমি আপনাকে সচেতন হতে বলেছিলাম? আমাকে যে এভাবে শত্রু বানিয়ে নিলেন একবার কি নিজের কর্মকাণ্ড গুলো ভেবে দেখলেন না, যা করছেন তা ঠিক না বেঠিক? এবার নিশ্চয়ই খুব আনন্দ হচ্ছে আপনার? মাত্র আড়াই বছর লালন পালন করে সন্তানের জন্য কি কান্নাটাই না জুড়ে দিলেন! যদি মস্তিষ্ক থেকে থাকে তাহলে একবার ভাবুন তো, আমার মা যদি আজ এখানে থাকতো তো তিনি কেমন করতেন? আড়াই বছরের মানিক হারাতে চান না অথচ বিশ বছর লালন পালন করে আমার মা কিভাবে আমাকে হারাতে চাইবেন! যা করলেন আপনি, হুহ্! আমি তো শেষই, আর কাউকে জানতে দিয়েন না এসব। তাহলে যেই সুখের জন্য করলেন সেই সুখ কাল হয়ে দাঁড়াবে। ক্ষমা নাকি মহৎ গুন, যেটা বরাবরই করার চেষ্টা করেছি। এবারও করে দিলাম। তবে একটা কথা জেনে রাখুন। ইমরানের জন্য আপনি এতোসব করলেন না? আমার সতেজ মস্তিষ্ক থেকে বলছি, জীবনেও ইমরানকে পাবেন না। আর যদি সে জানতে পারে, তো আপনার শেষ পরিনতি দেখে নিবে। ভালো থাকতে হলে চুপই থাকুন।
নাফিসা ফোন নিয়ে মুখ চেপে কান্না করতে করতে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আবিদা বেগম জেরিনের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
– কি করছস তুই?
জেরিন চাপা কান্নার সাথেই জবাব দিলো,
– বিয়ের পর থেকেই মেয়েটা আমাকে খুব জ্বালাতন করতো। কাল রাতে তার কারণে আরমান আমার উপর এই প্রথম হাত তুলেছে। তাই তাকে মেরে ফেলার জন্য খাবারের বাটিতে নয়টা ঘুমের টেবলেট মিশিয়ে দিয়েছি ফুপি!
কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও সে এখানে দাড়িয়ে নেই। দৌড়ে বেরিয়ে গেলো নাফিসার উদ্দেশ্যে। এদিকে আবিদা বেগমও একপ্রকার বিলাপের সাথে ছুটে চললো পিছু পিছু!

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৯
(নূর নাফিসা)
.
.
নাফিসা রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। জানে একদিন না একদিন মরতে হবেই। তবুও মরণ যদি এতোটা নিকটে এসে জানিয়ে যায় সেটা কতটা কষ্টকর হতে পারে! আপনজনদের ছেড়ে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যাবে, সেটা ভাবতেই বুক ফেটে কান্না আসছে তার! ভিন্ন জগতে কিভাবে থাকবে একা একা! সে চলে গেলে তার প্রিয়জনরাই বা কেমন করবে কিছুই ভাবতে পারছে না। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে! এটা ওষুধের প্রতিক্রিয়ার কারণে নয়, কেবল ভাবনার প্রেক্ষিতেই এমন অনুভব হচ্ছে! খুব মনে পড়ছে মা বাবা কে, খুব মনে পড়ছে ইমরানকে। খুব মনে পড়ছে তার দুই বোনকে! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাদের।
এদিকে জেরিন এসে দরজায় নক করছে দরজা খুলার জন্য। আবিদা বেগমও ডাকছে। নিশাত তাদের হইচই শুনে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। জানতে চাইছে কি হয়েছে। আবিদা বেগম ক্ষণে জেরিনকে বকছে, ক্ষণে নাফিসার জন্য বিলাপ করছে। নাফিসা সময় নষ্ট না করে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ইমরানের কাছে কল করলো। ইমরান রিসিভ করেই সালাম দিলো এবং নাফিসা জবাব দিলো। পরক্ষণে বললো,
– কি করছিলে?
– এই তো, বেশিক্ষণ হয়নি কাজে হাত লাগিয়েছি। খেয়েছো তুমি?
– হুম।
– ঘুমাওনি কেন এখনো?
– ঘুমাবো। তুমি কি কোনো কারণে রেগে আছো আমার উপর?
– না তো।
– আমি যা ভুল করেছি তুমি ক্ষমা করেছো তো?
– কি বলছো এসব? ঘুম মনে হয় একটু বেশিই কাবু করেছে তোমায়৷ একটা ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হও।
– মস্করা কেন করছো! আমি অনেক ভুল করেছি না? অনেক কষ্ট দিয়েছি না তোমাকে? এবার ক্ষমা করে দিও। আর কখনো কষ্ট দিবো না।
– কি হয়েছে তোমার, বলোতো?
– কিছু না।
– মনটা বেশিই খারাপ মনে হচ্ছে।
– মিস করছি খুব।
– দেখি, ছুটি নিয়ে আগে ফিরতে পারি কি-না।
– তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
– দেখা করে আসিনি?
– আরও দেখতে ইচ্ছে করছে।
– পাগলামো কম করে ঘুমাও একটু ।
– সিরিয়াসলি, দেখতে ইচ্ছে করছে।
– ব্যস্ত আছি একটু। কিছুক্ষণ পর ভিডিও কল দিচ্ছি হুম?
তারা যখন কথা বলছে, জেরিন ইমরানের ফোনে কল করে বিজি পাচ্ছে। অত:পর আরমানের ফোনে কল করলো। দুইবার রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলো না! পরক্ষণে মনে হলো আরমান রাগ করে আছে তার উপর। তাই হয়তো রিসিভ করছে না! নিশাতকে বললো তার ফোন থেকে কল করতে। নিশাতের ফোনে ব্যালেন্স ছিলো না তাই ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স এনে তারপর ডায়াল করলো। প্রথমবার রিং হতেই রিসিভ করলো আরমান। নাফিসার অবস্থা বলার পর সাথে সাথেই সে ইমরানের কর্মস্থলে ছুটে এলো। ইমরান মাত্রই কল কেটে কাজে মনযোগ দিয়েছে। আর অমনি আরমানের মুখে এমন কথা শুনে তার যেন দুনিয়া উলট পালট হয়ে যাচ্ছে! নাফিসা কেন এতোক্ষণ এমন করছিলো সবটা পরিষ্কার তার কাছে! সে আর দিকবিক না তাকিয়ে কাজকর্ম যেমন ছিলো তেমনই ফেলে রেখে ছুটলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। আশেপাশের কয়েকজনও তাকিয়ে ছিলো তাদের দিকে। ইমরান ছুটছে আর নাফিসার ফোনে কল করছে। কিন্তু ফোন বিজি! ইমরানের সাথে কথা বলে কল কেটেই সাথে সাথে মায়ের কাছে কল করেছে নাফিসা। রুমানা বেগমও তার অদ্ভুত আচরণে একটু বিস্মিত হয়েছে। যখন জিজ্ঞেস করলো কিছু হয়েছে কি-না, তখন নাফিসা কান্না চাপা রাখতে পারেনি। কান্নার সাথে বলে উঠলো তার ওই বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করেই অনেক খারাপ লাগছে আর ইচ্ছে করছে সেখানে যেতে। রুমানা বেগম এই বলে মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেন, ইমরানকে বলবে বিকেলে নিয়ে আসতে। নাফিসা যে-ই এখন যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো, রুমানা বেগম বললেন তার বাবাকে পাঠাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরও কিছুক্ষণ কথা হলো মা মেয়ের মধ্যে। বাবা বাসায় ছিলো না বিধায় কথা হলো না। আর মায়ের সাথে কথা বলে তো তৃপ্তিও মিটছে না যে বাবাকে আলাদাভাবে কল করে একটু কথা বলবে!
বাইরে থেকে জেরিন, নিশাত ডাকছে কিন্তু কোনো সাড়া নেই নাফিসার! ডানপাশের জানালাটাও বন্ধ! সারা রাস্তা কল করতে করতে এবং সূরা ইউনুস পড়তে পড়তে ইমরান বাসায় হাজির। সে কিভাবে রাস্তা অতিক্রম করে এসেছে আল্লাহ ই ভালো জানেন। দরজায় নক করছে কিন্তু দরজা খুলছে না! জানালায় নক করলো তাতেও লাভ হলো না। আবার দরজার কাছে এলো৷ স্টিলের বক্স ডোর যেটা ভেঙে ফেলারও উপায় নেই! একমাত্র কাটার মেশিনই প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু সেটা এখন পাবে কোথায়! যখন মায়ের মুখে জানতে পারলো জেরিন খিচুড়ির সাথে টেবলেট মিশিয়ে দিয়েছে তখন জেরিনকে চোখে পড়লে জেরিনের গলা চেপে ধরলো সে! নিশাত তাকে টেনে ছোটানোর চেষ্টা করা মাত্র ছেড়ে দিয়েছে ইমরান। কেননা তার এখন নাফিসাকে প্রয়োজন। একে তো পরেও দেখে নেওয়া যাবে। ইমরান নাফিসাকে ডাকতে ডাকতে এবার পেছনের জানালার দিকে নজর দিলো। সেই জানালা খোলা আছে। সে ঘরের পেছন দিকের জানালার কাছে এসে ডাকলো। নাফিসা ফোন হাতে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। তার যেন আশেপাশের কোনো খেয়াল নেই। কথা কানে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মস্তিষ্কে পৌছাতে পারছে না। কিছু শুনছে না বিধায় যখন ইমরান চিৎকার করে ডাকলো তখন নাফিসার ধ্যান ভাঙলো। নাফিসা তাকে জানালা দিয়ে দেখা মাত্র হু হু করে কেদে উঠলো! ইমরান দরজা খুলতে বললে সে উঠে দাড়ালো। মাথাটা কেমন যেন ভারি ভারি লাগছে। সে দরজা খুলতেই ইমরান দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। নাফিসার চোখ মুখ ফোলে গেছে। ইমরান তার মুখখানা দু’হাতে ধরে বললো,
“কি হয়েছে?”
নাফিসা কোনো কিছু না বলে তাকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কাদছে। ইমরানের ভেতরটা আর মানছে না! কি করবে সেটাও বুঝতে পারছে না! আবিদা বেগম বলছে হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিভাবে! সে তো নাফিসাকে সোজা করেও দাড় করাতে পারছে না। চেচামেচি শুনে আশেপাশের কয়েকজন জমা হয়ে গেছে বাড়িতে।
এদিকে আরমান অফিসের ভার অন্য একজনের হাতে দিয়ে ইমরানের পরপরই বেরিয়ে এসেছে। সে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে বাসায় চলে এসেছে। ইমরানকে বলে তারা নিকটবর্তী হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ইমরান আরমান ও সাথে নিশাত গেছে। নাফিসার চোখ নিভু নিভু হয়ে আসছে! ইমরানের প্রায় কাদো কাদো অবস্থা! সে বারবার কথা বলতে চাইছে চোখ খুলে রাখার জন্য। কিন্তু তার যে সেই শক্তি বিদ্যমান নেই! ইমরান বললো,
– খারাপ লাগছে খুব?
– মাথাটা প্রকটভাবে চক্কর দিচ্ছে!
– নাফিসা, বমি করার চেষ্টা করো।
– আসে না তো।
– মুখের ভেতর হাত দাও।
নাফিসা মুখে হাত দিয়ে চেষ্টা করলো। কিন্তু চেষ্টা বৃথা! মাঝ রাস্তায় এসে নাফিসার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে! ইমরান ডাকছে কিন্তু চোখ খুলছে না! ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে! নিশাত কান্না ই শুরু করে দিয়েছে! ইমরান খুব ভয়ার্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
– ভাইয়া, নাফিসা চোখ খুলছে না!
সামনের সিটে বসা আরমান চমকে পেছনে তাকালো! তার ভেতরেও ভয় চেপে গেছে! সে কিছু বলার আগেই ইমরান নাফিসার নাকের কাছে হাত রাখলো। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে কিন্তু অস্বাভাবিক! ইমরান চেচিয়ে বললো,
– গাড়ি এতো আস্তে চলছে কেন!
যদিও গাড়ি যথেষ্ট জোরে চলছে। ড্রাইভার আরও একটু স্পিড বাড়িয়ে দিলো ইমরানের পাগল পাগল অবস্থা দেখে! আরমান ড্রাইভারকে ইশারা করলো বেশি তারাহুরো না করতে। এক বিপদ কাটাতে না আবার অন্য বিপদ ডেকে আনে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হসপিটালে চলে এলো। প্রায় এক ঘন্টার মতো হয়েছে নাফিসা খাবার খেয়েছে। এখন সে সেন্স লেস! তারউপর হসপিটালে এসে ফি পরিশোধ করে ভর্তির কার্যক্রম আগে সম্পাদন করতে বলা হলে ইমরান খেপে গেলো!
“আপনারা রোগীর সেবা দিতে হসপিটাল চালু করেছেন না ইনকাম করতে? মানুষ মরে যায় আর আপনাদের কাছে টাকা বড় হয়ে গেছে! টাকা কি না দিয়ে চলে যাবো? মানবিকতা বলতে কিছু নেই নাকি? এমন হলে হসপিটাল ধুলোয় মিশিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না পাবলিক!”
রিসিপশনিস্ট ভয় পেয়ে গেছে তার চিৎকারে! আশেপাশের লোকজনও তাকিয়ে আছে ইমরানের দিকে। আরমান তাকে থামতে বলে তার এক ফ্রেন্ডের কাছে কল করলো যে এই হসপিটালেরই একজন চিকিৎসক। কিন্তু সেই ব্যক্তি এখন হসপিটালে নেই, তবুও তিনি কল করে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
চিকিৎসা চলছে নাফিসার। বাইরে অপেক্ষারত তিন ভাইবোন। নিশাত বড়মা কে কল করে জানিয়েছে, আরাফকে জানিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর ইমরান একটু এগিয়ে এসে থিয়েটারের দরজার উপরের অংশ দিয়ে ভেতরে তাকালো। স্বচ্ছ কাচের বিপরীতে দৃষ্টি দেখতে পেল নাফিসার নাকে মুখে নল লাগানো! দৃশ্যটা দেখার মতো নয়! তার কলিজাটা যেন কেউ খুব শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। কখনো ভাবতেও পারেনি এমন দিন আসবে! কিভাবে ভাববে! সম্পূর্ণ জীবনটাই যে ভাবনার আড়ালে! সকালটা তো খুব সুন্দর ছিলো, সে বাড়ি ছাড়তেই কেন সুন্দর রূপটা কুৎসিত রূপে পরিণত হলো! মেয়েটার গত কয়েকদিন শুধু কান্নাকাটির মাঝেই কাটছে, আর আজ যে তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো! বিপদ আপদ দুঃখ কি পিছু ছাড়বে না কভু!
ইমরানের কাধে কারো হাতের স্পর্শ পড়তেই ইমরান ঘুরে তাকালো। আরাফকে দেখে সে ঝাপটে ধরে এবার কান্নাই করে দিলো!
– পারলাম না ভাইয়া! তোমার বোনের খেয়াল রাখতে পারলাম না আমি! বরং তার সুন্দর জীবনটাকে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলে দিলাম!
– চুপ কর। নিজেকে শক্ত কর। আল্লাহ ভরসা, কিছু হবে না।
আরাফ যথাযথ শান্ত করে জিজ্ঞেস করলো বাবা মা কে জানিয়েছে কি-না? উত্তরে ইমরান “না” বললো। আরাফ একটু ভেবে জানাতে নিষেধ করলো। কেননা নিয়াজ উদ্দিন ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন কিছুদিন আগে। হঠাৎ এমন কিছু শুনলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ইমরান যখন বললো তাদের না জানালেও তো অপরাধ হয়ে যাবে, তখন আরমান বললো ডাক্তারের ইনফরমেশন দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। তারা তা-ই করছে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারলো, তাদের মতে পরিপাকতন্ত্র খাবার সম্পূর্ণ ভাবে শোষণ করতে পারেনি বিধায় দেহে ওষুধের প্রতিক্রিয়া কম কার্যকর হয়েছে। যার ফলে সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ইতোমধ্যে বড় মা তার ভাইয়ের বাসা থেকে সোজা হসপিটাল চলে এসেছে। ডাক্তারের কথায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে আরাফ রুমানার কাছে কল করে জানালো নাফিসা হসপিটাল আছে। কিন্তু সম্পূর্ণ ঘটনা বলেনি, শুধু জানিয়েছে ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়াতে সমস্যা হয়েছে তার।

চলবে।