“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯০
(নূর নাফিসা)
.
.
স্বজনরা সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যার পূর্বে কাছে থেকে দেখতে পেয়েছে নাফিসাকে। মা বাবা, আপু, ভাইয়া, স্বামী, ভাসুর, ননদ সবাই হসপিটালে আছে। এতো মানুষজনকে তার আশেপাশে দেখে চোখের দুই ধার বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অনেকের চোখই ভেজা ভেজা। রুমানা বেগম নাফিসার মাথার পাশে বসে বললো,
– কেমন লাগছে মা?
নাফিসা শুধু চোখে পলক ফেললো। বাবার চোখটাও যেন ভেজা ভেজা, মুখটা গম্ভীর! সবার মাঝে ইমরানকে খুঁজে দেখলো ইমরান অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেমন যেন অপরাধী মনোভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে!
নাফিসার পরিবারের লোকজন কমবেশি সবাই জেনে গেছে জেরিন এমনটা করেছে। আরমান নিজেই জানিয়ে দিয়েছে। আরাফ সকলের মন হালকা করতে এর কারণটা গুটিয়ে নিয়েছে। আর ইমরান ছিলো নিশ্চুপ! কি বলবে! তার বলার মতো কিছুই নেই! তার উপর থেকে জেরিনের নজর তুলতে গিয়ে নাফিসার জীবনটা নষ্ট করে দিলো, বারবার এই ভেবেই নিজেকে সব কিছুর জন্য দোষারোপ করছে সে। জেরিন এতোটা জঘন্য কাজ করবে সেটা সম্পূর্ণ ধারণার বাইরে ছিলো!
সন্ধ্যায় আরাফ, ইমরান, বড় মা ও রুমানা বেগম ছাড়া বাকি সবাই চলে গেছে। খামারে মুরগী থাকায় নিয়াজ উদ্দিনকে চলে যেতে হয়েছে আর তিনি একা বাসায় থাকবেন বলে রান্নাবান্নার জন্য নাজিয়া বাবার সাথে বাসায় চলে এসেছে। রাত ন’টার দিকে আরাফ বড় মা ও রুমানা বেগমকে খাওয়ার জন্য নিয়ে গেলে ইমরান নাফিসার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে ধাধানো স্বরে বললো,
– তুমি সকালে আমাকে কল করেছো অথচ তোমার এই অবস্থার কথা বলোনি কেন?
নাফিসা চুপ করে আছে। ইমরান আবার বললো,
– খুব বেশি বিরক্ত হও আমার প্রতি? এতোটাই অপছন্দের আমি? আচ্ছা, আমি না হয় অপছন্দের, তো বাবা মা? উনারা কি তোমার প্রিয়জন না? তাহলে এতোটা জঘন্য কাজ কিভাবে করতে পারলে?
ইমরান যখন কথাগুলো বলছিলো নাফিসা একটু অবাক হয়ে অবুঝের মতো তাকিয়ে ছিলো! কি বলছে এসব! তার এসব কথার মর্মার্থ কি! কিন্তু যখন বললো,
– কিভাবে পারলে সকলকে ছেড়ে এভাবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে! মরে যাওয়া কি এতোটাই সহজ? তুমি যদি সাথে সাথে আমাকে কল করে বলতে, আমি কি ছুটে আসতাম না? সাথে সাথে হসপিটাল নিয়ে এলে কি এতোটা অসুস্থ উপলব্ধি করতে হতো এখন?
এবার নাফিসা বুঝতে পারলো তাকে জানায়নি বলে এতোটা রেগে কথা বলছে। তাই সে দৃষ্টি নত করে চুপচাপ হয়ে আছে। ইমরানও অভিমান নিয়ে কিছুক্ষণ নিরবে বসে রইলো। পরক্ষণে নিজেকে একটু শান্ত করে বললো,
– কেমন লাগছে এখন তোমার, বলোতো একটু?
– মাথা খুব ব্যথা করছে, আর হঠাৎ হঠাৎ যেন আমিসহ সব উল্টে যাচ্ছে।
– এরকম কিছু হতে পারে সেই ধারণা যদি বিন্দুমাত্রও থাকতো তাহলে আমার জীবনের সাথে কখনোই জড়াতাম না তোমাকে।
যদিও ইমরান তার জন্য ব্যথিত হয়ে বলছে তবুও কথাটা নাফিসার মোটেও পছন্দ হলো না। সে বললো,
– আপনার জীবনে এসে কি খুব ভুল করে ফেলেছি আমি? যার জন্য এখন ছাটাই করতে চাইছেন!
এই মুহূর্তে তার মুখে এমন কথা শুনে ইমরান বিস্মিত হলো! এবং সাথে সাথেই বেড ছেড়ে মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে নাফিসার মুখোমুখি হয়ে বললো,
– তুই কেন ভুল করবি? ভুল তো আমি করেছি তোকে আমার জীবনে এনে! এই ভুলটা শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ দে আমায়। জীবনটাকে উৎসর্গ করে দিবো তোর তরে। ছাটাই হতে হলে নিজে সবকিছু থেকে ছাটাই হয়ে হারিয়ে যাবো তোর মাঝে। সত্যি বলছি, একটু সুযোগ দে। আর সুযোগের সাথে আমাকেও একটু প্রিয় করে নে।
নাফিসা অতি সুখে কাদছে এখন। হঠাৎই চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে, এবং মাথাটাও এক ঝাটকায় চক্কর দিয়ে উঠেছে! নাফিসাকে কপালে ভাজ ফেলে এভাবে চোখ খিচে বন্ধ করতে দেখে ইমরান চমকে বলে উঠলো,
– কি হলো?
নাফিসা দুইবার দীর্ঘ শ্বাস টেনে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো কিছু হয়নি। পরক্ষণে আবার নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে ইমরানের উক্ত কথার প্রেক্ষিতে বললো,
– তুই তো আমার সেই প্রিয় ই।
– মিথ্যে বলছিস কেন? আমি প্রিয় হলে তুই এতোবড় ভয় দেখাতে পারতি আমাকে! লুকিয়ে রাখতে পারতি এতো বড় ঘটনা!
নাফিসা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
– আর লুকিয়ে রাখবো না কখনো।
ইমরান হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধা আঙুলে চোখের ধার মুছে দিয়ে বললো,
– কি থেকে কি হয়েছিলো, সবটা কি মনে আছে? হসপিটাল থেকে বাসায় গিয়ে আমি থানায় ডায়েরি করবো। তোমার হেল্প লাগবে। আজই করতাম, কিন্তু পুলিশ এখানে এসে বিরক্ত করবে তাই ইনফর্ম করিনি। ডাক্তারকেও নিষেধ করেছি বাইরে এসব বিষয় না ছড়াতে।
– কার বিরুদ্ধে ডায়েরি করবে?
– তুমি জানো না কার বিরুদ্ধে? ভাইয়ার কাছে আমি অলরেডি পারমিশন পেয়ে গেছি, তুমি কিন্তু বরাবরের মতো ভালো সাজতে এসো না। বেশি ভালো ভালো না। এতো সহজে সব ভুলতে বসো না। এসব মার্ডারারের জন্যই জেলখানা তৈরি হয়েছে।
– মার্ডারারের জন্য জেলখানা, তার আগে মার্ডারারের অবস্থানটা তো দেখো একবার। এলাকা জুড়ে নিজের বাড়ির বদনাম করে ফেলবে বাড়িতে পুলিশ এনে। যেটা মোটেও ভালো দেখায় না। তাছাড়া, আইন সবসময় সঠিক শাস্তি দিতে পারে না। আজ ইন, তো কাল আউট। আর এভাবে কোনো মানুষকেও শুধরে নিতে দেখিনি আমি। বরং আরও খারাপ হতে দেখেছি।
– এক কথা ই না বললাম, বেশি ভালো ভালো না!
নাফিসা বিড়বিড় করে বললো,
– ঘরোয়াভাবেও শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। সেটাই বলছিলাম, মানুষ ভালো হলেই তো সবার জন্য ভালো।
এমনি নার্স প্রবেশ করলো কেবিনে। নাফিসাকে দেখে বললো,
– ঘুম ভেঙেছে তাহলে আপনার!
নাফিসা জবাব দিলো,
– না, এখনো তো ঘুমিয়েই আছি।
ইমরান মুচকি হেসে বসা থেকে উঠে দাড়ালো। নার্সও মৃদু হেসে বললো,
– বাহ! ফ্রেশ মাইন্ডে আছেন বলে মনে হচ্ছে! বডিতে পেইন আছে?
– মাথায়।
বড় মা ও রুমানা বেগমকে কেবিনে নিয়ে এসে আরাফ ইমরানকে নিয়ে গেলো ডিনারের জন্য। দুপুরেও খাওয়া হয়নি তাদের। এদিকে নাফিসা একটু পরেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
দুইদিন হসপিটালে কাটিয়ে তারা তৃতীয় দিন বাড়িতে ফিরে এলো নাফিসাকে নিয়ে। রুমানা বেগম নিজের কাছে নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নাফিসা যায়নি। এমনিতেই বাবা অসুস্থ, খামারে মুরগী, আবার সে গেলে তার খেয়াল রাখতে হবে। মা একা হয়ে আর কতদিক সামলে নিবে! নাফিসা যখন বলেছিলো সে মায়ের সাথে যাবে না, তখন ইমরানের চেহারায় যেন উৎফুল্লতা কাজ করছিলো। যেটা খুব সহজেই ধরা পড়েছে নাফিসার চোখে। আরাফও খামারের ঝামেলার কথা বলে নাফিসাকে ইমরানের বাসায় যেতেই সাপোর্ট করলো।
হসপিটালে এই দুইদিন রুমানা বেগম ও ইমরান থেকেছিলো নাফিসার সাথে। আজ বাড়িতে ফিরে গোসল এবং খাওয়াদাওয়া করলো নাফিসা। আবিদা বেগমও নাফিসার শরীর কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করলো। সবই ঠিক আছে কিন্তু জেরিনকে দেখা যাচ্ছে না। জিহান সহ সবাই বাড়িতে, তাহলে জেরিন কোথায়! ইমরানকে তো তার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করা যায় না৷ কিছু বললেই কেমন যেনো ক্ষেপে যায়! আজ খাওয়াদাওয়া বাদে বাকিটুকু সময় ঘুমেই কাটলো। পরদিনও ইমরান অফিসে গেলো না নাফিসার জন্য। এক সপ্তাহের মতো ছুটি নিবে সেটাই ভাবছিলো সে। কিন্তু নাফিসা নিষেধ করলো। সে অচল নয়। নিজ নিজে চলতে পারে। তাছাড়া বাড়িতে বড় মা, আবিদা বেগম নিশাত যথেষ্ট খেয়াল রাখছে তার। সুতরাং ইমরানের ছুটি কাটানোর কোনো প্রয়োজন নেই। সে পরিস্কার বলে দিলো, আগামীকাল থেকে যেন অফিস যায়।
আজ বিকেলে ঘুম থেকে উঠলে জিহানকে নিয়ে নিশাত এলো তার কাছে। অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে বলতে সে কথার ছলেবলে জেরিনের কথা জিজ্ঞেস করে ফেললো। নিশাত তো বাড়িতে ছিলো, সে নিশ্চয়ই সবটা জানবে আর ইজিলি শেয়ার করবে। নিশাত জিহানকে বড় ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নাফিসার সাথে কথা বললো। নাফিসা খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করে তার কাছে জেনে নিলো,
সেদিন জেরিনই আরমানকে কল করে ইমরানকে নাফিসার কথা জানিয়েছিলো। নিজ হাতে ভয়ানক কার্য সম্পাদন করে আবার নাফিসাকে নিয়ে ভয় পেয়ে কান্নাও করেছিলো। সন্ধ্যায় যখন আরমান নিশাতকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে, তখন আরমান মেরেছে জেরিনকে। আবিদা বেগমও বকেছে দিনে। আরমান নাকি আগে থেকেই জানতো ইমরানের প্রতি সে দুর্বল আর ইমরান তার প্রতি বিরক্ত। কেউ তাকে কিছু না জানালেও তার চোখে পড়েছে জেরিনের আচরণগুলো। আর যখন পড়েছে তখন ওয়ার্নিংয়ে রেখেছিলো তাকে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটিও হয়েছে। কাউকে বুঝতে দেয়নি সেটা। নিজের সাধ্যমতো সে চেষ্টা করেছে তাকে শুধরে নেওয়ার। কিন্তু বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও জেরিন সীমা লঙ্ঘন করেছে। তাই তাকে আর সুযোগ দেওয়া যায় না। জেরিন আরমানের পা ঝাপটে ধরে ক্ষমা চেয়েছিলো। কিন্তু আরমান তাকে উপেক্ষা করে সরাসরি তার মায়ের কাছে কল করে বলেছে তাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে। রাতেই তার বাসা থেকে লোকজন আসে। আরমান এভাবে জেরিনকে মেরেছে বিধায় তার পরিবার আরমানের উপর ক্ষেপে গেছে। এবং আরমান ও আবিদা বেগমের সাথে রাগারাগি করে নিজেদের মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে। যদিও জেরিন তার পরিবারের বিরুদ্ধে থেকে বারবার আরমানের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিৎকার করছিলো সে যাবে না। কিন্তু কেউ তাকে একটা বারের জন্যও আটকালো না। বরং আরমান পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে তাকে ডিভোর্স দিবে! তা দেখে এবং শুনে তার পরিবার আরও জোরপূর্বকই তাকে নিয়ে গেছে এখান থেকে। এর একটা ভালো সমাধান চাইলে না হয় তারা একজোট হয়ে ভাবতো, কিন্তু এমন ডিরেক্ট ইগনোর আর সইতে পারেনি। জেরিন জিহানকে ঝাপটে ধরে রেখেছিলো, সে যাবে না এখান থেকে, তার ছেলেকেও সে দূরে সরাবে না। কিন্তু আরমান জিহানকে কখনোই দিবে না তার কাছে। জেরিনকে মারতে দেখে জিহান প্রথমে কান্না করলেও পরে ভয়ে চুপসে গেছে। সে এখনো তার বাবার কাছে যায় না। ভয় পায় বাবাকে। আরমান তাকে কোলে নিতে চাইলেই সে কান্না করে। দাদু, কিংবা ফুপির গলা ঝাপটে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে মন ভালো থাকলে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে। জেরিন পরদিন সকালে জিহানের কথা জানতে কল করেছিলো নিশাতের কাছে। রিসিভ করে কথা বলতেই আরমান বুঝতে পেরে নিশাতকে ধমক দিয়েছিলো। এরপর থেকে নিশাতও কল রিসিভ করে না। তবে শুনেছে বড় মা নাকি ফোনে কথা বলেছিলো। জেরিন যখন কান্না করে ক্ষমা চাইছিলো তখন বড় মা জিজ্ঞেস করেছিলো, নাফিসা যদি মরে যেতো তাহলে সে জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতো কি-না? উত্তরে জেরিনের কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছুই আসেনি। সেই কল কাটার পর আর কথা হয়নি ও বাড়ির কারো সাথে।
নিশাত সেদিনই প্রথমবারের মতো আরমানকে এতোটা রাগতে দেখেছে আর নাফিসা এখন শুনেছে। নিজ পরিবার ছাড়া অসহায় জেরিনের জন্য যতটা না খারাপ লাগছে, তার চেয়েও ভীষণ কষ্ট লাগছে জিহানের কথা ভেবে। মা যেমনই হোক, সন্তানের জন্য তার মন প্রতিনিয়ত ঠিকই কাদে। সেদিনই জিহান খিচুড়ি খেয়েছে ভেবে যেই কান্না শুরু করেছিলো। আর এইটুকু বাচ্চা মাকে ছাড়াই বা থাকবে কি করে! যেখানে বাবার গলা ঝাপটে থাকে সারাক্ষণ, সেখানে সে বাবার কাছও ঘেঁষছে না আজ!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯১
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে যখন খাওয়াদাওয়া শেষ হলো তখন আরমান জিহানকে নিজের সাথে নিতে চাইলে জিহান কান্না শুরু করলো৷ গত রাতগুলোও তার সাথে কাটায়নি। আজও নানান বাহানা দিয়েও লাভ হলো না। জোরপূর্বক কোলে নেওয়া মাত্রই “আম্মু, দাদু” ডেকে চিৎকার করছে! পরক্ষণে ইমরান তাকে শান্ত করতে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আরমান ব্যর্থতার নিশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেলো। যে ছেলে আব্বু বলতে পাগল, আজ তিনদিন হলো সেই ছেলেকে কাছে পায় না সে। বাসার কেউই কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। যে বাচ্চারা মা চেনে তাদের মা ছাড়া লালন পালন করা যায় না। সেটা উপস্থিত সবাই জানে কিন্তু কি করবে! জিহানের অবস্থা দেখে সবারই খারাপ লাগছে কিন্তু কারোই কিছু করার নেই। যার যেমন কর্ম তাকে তেমন ফল ভোগ করতে হবে। কিন্তু বাচ্চাটা যে কষ্ট পাচ্ছে!
নাফিসা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ইমরান জিহানকে দোকানে নিয়ে গিয়েছিলো। এখন উঠুনেই হাটছে। জিহান তার গলা ঝাপটে পড়ে আছে, হাতে চিপসের প্যাকেট। মাত্র ডিনার করেছে তাই নাফিসাও চুপচাপ ইমরানের সাথে একটু হাটছে। হঠাৎই চোখ পড়লো আরমানের রুমের দিকে! অন্ধকারে দৃষ্টি রেখে জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে। মুখটা সারাক্ষণই গম্ভীর থাকে। সেদিনের পর থেকে কারো মুখেই স্পষ্ট হাসি দেখা যায়নি। নাফিসা ইমরানকে বললো,
– জিহান আজ আমাদের সাথে থাকুক?
– হুম।
– ভাইয়া অপেক্ষা করছে বোধহয়। বলে এসো ভাইয়াকে।
– রুমে যাও, আসছি আমি।
মিনিটের মধ্যেই ইমরান আরমানের কাছে বলে চলে এলো। নাফিসা বিছানা গুছিয়ে মশারী টানিয়ে নিয়েছে। ইমরান জিহানকে রেখে গেইট তালা দিতে চাইছিলো কিন্তু জিহান তাকে ছাড়লো না! গলায় ঝুলে আছে। এই মুহূর্তে নাফিসার হাসি পেয়েছিলো তাই মুখ চেপে হেসেছে। ইমরানকে বলে সে নিজেই গেইটে তালা লাগাতে গেলো। ফিরে আসার সময় আবারও তাকালো আরমানের রুমের দিকে। জানালা তো আর দেখা যায় না এদিক থেকে কিন্তু লাইটের আলোতে জানালা ও গ্রিল ধরে দাড়িয়ে থাকা আরমানের ছায়া দেখতে পেয়েছে। এখনো সেখানেই দাড়িয়ে আছে সে। “শূন্যতা বোধহয় খুব প্রকটভাবেই ঘিরে ধরেছে! হবেই না কেন! দুদিনের জন্য নিশ্চয়ই কেউ সংসার বাধে না! আর অল্পতেই নিশ্চয়ই এতো সহজসরল মানুষ এতোটা কঠোর হয় না। নিজের কপাল নিজে ভাঙলি রে জেরিন! কি হতো, যদি একটু সেক্রিফাইস করে সুন্দরভাবে সংসারটা সাজিয়ে নিতি!”
নাফিসা রুমে এসে দেখলো জিহান ইমরানের গলা ঝাপটে ধরে মিশে আছে। সে দরজা লাগিয়ে চিপসের প্যাকেটটা খাট থেকেও টেবিলে রাখলো। অত:পর নিজের জন্য অবশিষ্ট ফাঁকা জায়গায় না শুয়ে ইমরানের পেছনে অবশিষ্ট অল্প জায়গা দখল করে নিলো।
– এটা কোথায় এলে! ওপাশে যাও?
– উহুম।
– পড়ে যাবে তো!
নাফিসা পেছন থেকে ইমরানের সাথে মিশে বললো,
– উহুম।
অত:পর ইমরানই জিহানকে ঠেলে বিপরীতে একটু চেপে জায়গা করে দিলো।
– জিহান ঘুমিয়ে গেছে?
– পুরোপুরি না।
নাফিসা ইতস্তত বোধ করে বললো,
– মা ছাড়া এইটুকু বাচ্চা থাকবে কি করে!
– আমরা মরে গেছি?
– আচ্ছা, এভাবে কথা বলো কেন! আমি কি এখন তোমার সাথে রেগে কথা বলেছি?
প্রথমে বিরক্তিকর ভাবে জবাব দিলেও ইমরান এবার স্বাভাবিকভাবেই বললো,
– থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আমাদের যত্নাদি থাকলেই হয়।
– তবুও, মায়ের সাথে সন্তানের তো আলাদা সম্পর্ক, ভিন্ন মায়া জড়িত।
– মায়ের আগে দেখতে হবে সে একজন মানুষ। যে মানুষ কাউকে খুন করতে অগ্রসর হয় সে কোনো কারণে সন্তানকেও খুন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। দরকার নেই তো এমন মায়ের।
– তুমি কি সত্যি সত্যিই থানায় ডায়েরি করবে?
– ভেবেছিলাম করবো। আরাফ ভাইয়া নিষেধ করেছে। তোমার মতো একই কথা বললো। বাবার সম্মান নষ্ট হবে, বাড়ির বদনাম হবে। বাড়ি থেকে বিদায় করা হয়েছে এটাই নাকি তার জন্য বড় শাস্তি হবে।
– মামাবাড়ির সবাইও তো তোমাদের সাথে রেগে আছে। তাই না?
– ভাইয়ার নামে নাকি মামী নারী নির্যাতনের মামলা করতে চেয়েছিলো। আরাফ ভাইয়াই ঠেকিয়ে দিলো এই বলে, নারী নির্যাতনের মামলা করতে গেলে তার আগে খুনের মামলা করা হবে তাদের মেয়ের নামে।
– ঠিকই তো করেছে ভাইয়া। এতো ঝামেলায় জড়ানোর প্রয়োজন নেই তো। এজন্যই ভাইয়াকে খুব ভালো লাগে। আরাফ ভাইয়া শান্তি প্রিয় মানুষ। সবদিকের ঝামেলা মিটিয়ে শান্ত করে দিলো।
– সবাই তো শান্তি চায়। কিন্তু শান্তি কি সবার ভাগ্যে জুটে? টেনে হিচড়ে সেই অশান্তিই বয়ে আনে!
– হুম। তুমিও বড্ড অশান্ত হয়ে গেছো। এবার নিজের দিকটা ভেবে একটু শান্ত হও।
ইমরান তাদের ছাড়িয়ে বাইরে গেলো। ফ্রেশ হয়ে আবার রুমে এসে দেখলো এইটুকু সময়ে নাফিসা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে! মেয়েটার প্রায় সারাদিন ঘুমিয়ে কাটলো এখনো আবার শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়লো! ওষুধের প্রতিক্রিয়া খুব বেশিই কাবু করে ফেলেছে তাকে! ইমরান বড়সড় এক নিশ্বাস ফেলে নাফিসাকে জিহানের দিকে চাপিয়ে সে উভয়কে এক হাত দ্বারা আবদ্ধ করে শুয়ে পড়লো।
পরদিন বিকেলে একটু তারাতাড়িই ফিরেছে আরমান। নিজে রেডি হয়ে জিহানকে চকলেট জুস কিনে দিয়ে মানিয়ে নিয়ে ঘুরতে বের হলো। জিহান ফ্রেশ মাইন্ডে এতোক্ষণ খেলাধুলা করছিলো বিধায় এখন কান্না করেনি। সারা বিকেল ঘুরেফিরে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেছে বাবা ছেলে। আজ একটু তারাতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছে জিহান। ঘুমন্ত জিহানকে নিয়ে চারদিন পর আরমান রাত কাটালো। কিন্তু সীমিত সময়ের জন্য। মাঝরাতে জিহান তার মাকে না পেয়ে কান্না শুরু করেছে। বাবার প্রতি আবারও সেই ভয়টা হানা দিয়েছে। যেই বাবাকে পেলে জিহান কাদে না আজ সেই বাবার পক্ষেই তার কান্না থামানো দায় হয়ে পড়েছে। এ ঘরের সকলেরই ঘুম ভেঙে গেছে। দাদুরাও শান্ত করতে পারছে না। নিশাত তাকে কোলে নিয়ে সারা ঘর হাটলো এবং শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। মানসিকভাবে অসহ্য এক যন্ত্রণায় ভুগছে আরমান! যা সবাই বুঝতে পারলেও কেউই মানতে পারছে না, আর না পারছে শুধরাতে!
প্রায় এক সপ্তাহের মতো কাটলো এভাবে। আরামান প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভাবে চেষ্টা করছে তার ছেলেকে স্বাভাবিক করতে। কখনো ঘুরতে যাওয়া, কখনো দোকানে নিয়ে গিয়ে এটাসেটা কিনে দেওয়া, কখনো বা খেলনা কিনে দেওয়া। সবকিছুর পরেও সে মাকে তেমনভাবে ভুলতে পারেনি। দিনের কোনো না কোনো সময় সে মাকে মনে করবেই, এমনকি কান্নাও করবে। আর জেরিনও প্রতিদিনই কারো না কারো ফোনে কল করে কিন্তু রিসিভ করার মতো কেউই নেই! শুধু বড় মায়ের সাথে কথা হয়েছে দুইবার। কিন্তু সেটা কেউই জানে না। এর মাঝে নাফিসা একদিন বড় মা’র সাথে কথা বলে এক প্রকার চুপিচুপিই জেরিনকে কল করলো বড় মায়ের ফোন থেকে। তারা কোনো কথা না বলে জিহানকে কথা বলতে দিলো। জিহান অভিমানী সুরে জিজ্ঞাসা করেছিলো,
– আম্মু, তুমি কই?
জেরিন কান্নাজড়িত কন্ঠে জবাব দিয়েছে,
– আমি তো নানু বাড়িতে আছি, আব্বু।
– আমি যাবো নানু বাড়ি।
– তোমার আব্বু নিয়ে আসবে না তোমাকে।
– কেন? আমি যাবো।
– তাহলে তুমি আব্বুকে বলো নিয়ে আসতে।
– না।
– কেন? তুমি দুষ্টুমি করো?
– না।
– গুড বয়। দুষ্টুমি করবে না একদম। আব্বুর কথা শুনো তো?
– না।
– কেন? আব্বুর কথা শুনবে।
– না, আব্বু মাবে।
– মারবে না। আব্বু তোমাকে আদর করবে।
– উউ! মাবে। মেএছে না তোমাকে!
জেরিন চুপ হয়ে গেছে! জিহান আবার ডাকলো তাকে,
– আম্মু?
– হু?
– তুমি আসো।
– আসবো?
– হু।
– আমি তো একা আসতে পারিনা। আব্বুকে বলো নিয়ে যেতে।
– পিপিপ দিয়ে আসো।
ছেলে যত কথা বাড়িয়ে চলেছে জেরিনের চাপা কান্না ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিটের মতো কথা বলেছে জিহান।
.
প্রায় দু সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে নাফিসা হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরেছে। সেদিনের পর থেকে দিনগুলো যেনো তার ঘুমে ঘুমেই কাটছে! হাফ ডে হওয়ায় দুপুরে বাড়ি ফিরেছে ইমরান। এখনো তাকে ঘুমাতেই দেখলো। দিনে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গড়ে ষোলো ঘন্টা তার ঘুমে কাটে! ঘুম থেকে ডাকলেই বিরক্ত হয়ে পড়ে! সারাদিন ঘুমাতে ঘুমাতে শরীর ফুলে গেছে। এই ঘুমের জন্য ইমরান এখন তাকে ডেইলি সকাল বিকাল দুইবার গোসল করায়! নাফিসা বিরক্ত হয় বলে নিজেও বাধ্য হয়ে দুইবার গোসল করে। কিন্তু তবুও তার ঘুমের রেশ তেমন কাটছে না! গোসলের পর আধ-ঘন্টা বা এক ঘন্টার মতো ফ্রেশ থাকে তারপর আবার চোখে ঘুম এসে জড়ো হয়! এভাবে চললে তো আরও খারাপ হয়ে যাবে তার অবস্থা! অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হবে বেশি বেশি। এতো আয়েশে কি মানুষ স্ট্রং ভাবে বেঁচে থাকতে পারে! নাহ, অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
ভাবতে ভাবতে ইমরান পোশাকাশাক চেঞ্জ করে নিলো। নাফিসার পাশে বসে কপালে ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে ডাকলো তাকে। সে যেমন মৃদুস্বরে ডেকে চলেছে, নাফিসাও তেমন ঘুমের ঘোরে তার ডাকে সারা দিয়ে চলেছে
কিন্তু চোখের পাতা খুলছে না! এবার ইমরান জোর গলায় হাক ছাড়তেই নাফিসা চমকে উঠে বসলো। ওদিকে বাইরে থেকে নিশাত জবাব দিলো,
– ভাইয়া, ভাবি তো রুমেই ঘুমাচ্ছে। দেখোনি?
– হ্যাঁ, দেখেছি। ঘুম ভাঙানোর জন্যই ডেকেছি।
– তো এভাবে ডাকতে হয়! হুহ্!
এদিকে নাফিসার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে ইমরান এভাবে চিৎকার করায়! ইমরান ব্রু কুচকে বললো,
– এভাবে তাকাও কেন? কখন থেকে আদুরে গলায় ডাকছি কানে যাচ্ছে না? এতো ঘুম কিসের!
– আমি ঘুমাবো তোর কি! এতো ডাকাডাকি কেন করিস! একটাবারও শান্তিতে ঘুমাতে পারি না! শুধু নাফিসা, নাফিসা আর নাফিসা!
রেগে একদমে কথাগুলো বলে ফেললো নাফিসা। ইমরান ফোন চার্জে লাগাতে লাগাতে বললো,
– নিজেকে আয়নায় দেখেছো একবার? ঘুমাতে ঘুমাতে যে ফুটবল হয়ে যাচ্ছো!
নাফিসা বিছানা ছেড়ে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজেকে একটু ভালো করে দেখলো, সত্যিই সে মুটকি হয়ে যাচ্ছে৷ ঢিলেঢালা জামাকাপড় সব ফিটিং হয়ে গেছে। নিজেকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখে ইমরান বললো,
– মিথ্যা বলিনি আমি।
নাফিসা এগিয়ে এসে বললো,
– সত্যি সত্যিই মটো হয়ে গেছি না?
– হু।
– তো তোর কি? তোর কোলে উঠে চড়ি আমি! ইডিয়ট!
নাফিসা চুল খোপা করতে করতে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে আর ইমরান কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে পরক্ষণে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! তার হাসির শব্দ শুনে বেরিয়ে যাওয়া নাফিসার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯২
(নূর নাফিসা)
.
.
নামাজ পড়ে দুপুরে খেয়ে নাফিসা ইউটিউবে ভিডিও দেখতে লাগলো কি কি করলে চিকন হওয়া যাবে এবং স্বাস্থ্য পারফেক্ট থাকবে। বেশিরভাগই ডায়েট মাস্ট! সে তো খাওয়া দাওয়া আগের মতোই করছে। শুধু ঘুমটা একটু বেশি। এটা কমাবে কি করে! সে তো আর ইচ্ছে করে এমন করে না! সারাক্ষণ ঘুম পায়!
ইমরান তার হাত থেকে ফোন রেখে দিয়ে তাকে সহ নিজে শুয়ে পড়লো ঘুমানোর জন্য। এবং বললো,
– এসব দেখে লাভ নেই, ঘুমের পরিমাণ কমিয়ে সাত-আট ঘন্টায় আনো। এমনিতেই ফিট হয়ে যাবে। এখন চুপচাপ ঘুমাও।
একদিকে ঘুম কমানোর কথা বলে অন্যদিকে তাকে ঘুমের জন্য আহ্বান করলো! তা দেখে নাফিসা তাকে সরানোর চেষ্টায় ধাক্কা দিয়ে বললো,
– এটা কি ঘুম কমিয়ে আনতে বলা হলো নাকি বেশি করে ঘুমাতে বলা হলো!
ইমরান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
– এখন ঘুমাও, ঘুম কাটানোর জন্য কাল বেড়াতে যাবো। দেখি ঘুম দূর হয় কি-না!
– কোথায় যাবো?
– দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
আবারও এক ঘুম দিয়ে আসরের পর উঠলো। নামাজ পড়ে মাগরিব পর্যন্ত নাফিসা শ্বাশুড়িদের সাথে সময় কাটালো। মাগরিবের নামাজ পড়ে আবার তার চোখে ঘুম নেমে আসছে। তাই ইমরান অফার করলো বাইরে হাটাহাটির জন্য। নিশাত উৎফুল্ল হলেও নাফিসা ঝিমাচ্ছে! পরক্ষণে নাফিসা, নিশাত বোরকা পড়ে জিহান ও ইমরানের সাথে বেরিয়ে গেলো সন্ধ্যায় বেড়াতে। ফুচকা, বাদাম, পেয়ারার ভর্তা খেতে খেতে তারা ফুটপাতে হাটলো ঘন্টাখানেক। ইশার আযান পড়লে আবার বাসায় ফিরে এলো সাথে ভুট্টা নিয়ে। ইশার নামাজ পড়ে আবার ভুট্টা ভেজে খেতে খেতে রাত দশটা বাজিয়ে দিলো। পরদিন ইমরান নাফিসাকে নিয়ে দূর পথে যাত্রা শুরু করলো। উদ্দেশ্য একটাই, তার ঘুমের ঘোর কাটানো। নতুবা এমন হুটহাট যাওয়ার কোনো প্ল্যান ছিলো না। দুপুর বারোটায় কমলাপুর স্টেশন থেকে দিনাজপুরের ট্রেনে উঠেছে। নাফিসা জিজ্ঞেস করতেই ইমরান জানালো তার নানার পৈত্রিক নিবাস দিনাজপুর। কিন্তু বর্তমানে সেখানে তেমন ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয় নেই। তবে এক বন্ধুর বাড়ি আছে, তারা সেখানেই উঠবে। প্রায় একদিন সময় লাগলো তাদের দিনাজপুর পৌছাতে! স্টেশনের পর স্টেশনে ট্রেন থামছে, তারা নামছে, ফ্রেশ হচ্ছে খাবার কিনছে, খাওয়াদাওয়া করছে। সম্পূর্ণ পথ ইমরান জেগে থাকলেও নাফিসা কখনো ঘুমিয়ে আবার কখনো জেগে! ইমরান তাকে ডেকে ডেকে এটা সেটা দেখাচ্ছে, স্টেশন চেনাচ্ছে। রংপুর স্টেশনে যখন ট্রেন থেমেছিলো তখন এক ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে! নাফিসা ঘুমিয়ে ছিলো। ইমরান তাকে জাগিয়ে জানালার বাইরে তাকাতে বললো। নাফিসা যেই তাকালো অমনি মস্ত এক হাতি তার অতি নিকটে জানালায় সুর ঠুকলো! নাফিসা ভয়ে চিৎকার করে উঠে! তার চিৎকার শুনে হাতিও গর্জন তোলে! আর নাফিসা হুমড়ি খেয়ে ইমরানের উপর পড়ে তাকে ঝাপটে ধরেছে। ইমরান বারবার বলছে কিছু হবে না, কিন্তু তার ভয় দূর হচ্ছে না। যত দ্রুত সম্ভব ইমরান জানালা দিয়ে টাকা দিয়ে হাতি বিদায় করলো এপাশ থেকে। নাফিসা ভয়ে কুকড়ে গেছে, আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে। হাতি দেখে সে কিছুটা ভয় পেতে পারে সেটা ইমরান জানতো। কিন্তু হাতিটা যে এখনই গর্জন তুলে তাকে এতোটা ভয় পায়িয়ে দিবে সেটা ধারণার বাইরে ছিলো! ভেবেছিলো তার হাতে হাতিকে টাকা দেওয়াবে। কিন্তু তা আর হলো না! ইমরান তাকে স্বাভাবিক করতে বললো,
– চলে গেছে তো, সোজা হও।
ইমরান এটা ইচ্ছে করেই করেছে তা বুঝতে সময় লাগেনি নাফিসার! ফলশ্রুতিতে ইমরানকে কিল ঘুষি চিমটি উপভোগ করতে হয়েছে এবং নাফিসার গাল ফুলানো সহ্য করতে হয়েছে পরবর্তী স্টেশন পর্যন্ত! ইমরানের সাথে চলছে, পথঘাট হাটছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না! ইমরান বললো,
– সরি বললাম তো! এতো ভয় পাও তুমি আগে জানলে ডাকতামই না।
নাফিসা কোনো কথা বলছে না। আশপাশ দেখছে ঠিকই কিন্তু এমন একটা ভাব নিয়ে আছে যেন ইমরানের উপর এখনো প্রচন্ড রেগে আছে! ইমরান বললো,
– বেড়াতে এসেছি আমরা। এমন গাল ফুলিয়ে থাকলে কি উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে না?
নাফিসার কোনো জবাব না পেয়ে এবার বললো,
– ওইযে ধান ক্ষেত দেখছিস? এখন কাদায় চুবিয়ে তারপর গন্তব্যে যাবো।
– তোর সাহস থাকলে আয় তো দেখি, কে কাকে চুবায়!
নাফিসার হাসিমাখা মুখে কথা শুনে ইমরান হেসে এক হাতে তাকে কাছে টেনে হাটতে হাটতে বললো,
– না থাক, এমনিতেই কেডস সো পড়ে এসেছি। তার উপর কাদায় চুবালে আমার ধলা বউ কালো হয়ে যাবে।
নাফিসা তার পেটে কনুই মেরে বললো,
– পাম দেওয়ার আর জায়গা পাও না! তোমার বউ আবার ধলা হলো কবে!
– প্রশংসা করলেও দোষ! নিজের প্রশংসা নিজেই কাদায় মাখামাখি করে ফেলে নাকি কেউ!
– হু, আমি করি। যেটা সত্য সেটা অবশ্যই বলবো।
– আচ্ছা, যাও। আমার কালী বউ।
– ওই, মুখ সামলে কথা বলো। আমি কালীও না!
– ধলাও না, কালীও না! তাহলে কি, শুনি?
– শ্যামলী।
– কালো বরের শ্যামলী বউ?
– উহু, শ্যামলের শ্যামলী।
দুজনেই হেসে উঠলো। তাদের বর্তমান অবস্থান দিনাজপুরের বিরল। গ্রাম্য এলাকায় বেশ কিছুক্ষণ হাটছে দুজন। রাস্তায় রিকশা চলছে তাই নাফিসা বললো,
– রাস্তায় রিকশা চলছে তাহলে আমরা হাটছি কেন?
– শ্যামলীর ঘুম তাড়ানোর জন্য।
নাফিসা নাকমুখ ফুলিয়ে রেগে তাকিয়ে বললো,
– আমি পা ব্যাথায় মরি, আর তুমি ঘুম তাড়াও!
– টাকাটাও তো বেঁচে গেলো। এক ঢিলে দুই পাখি।
নাফিসা তাড়া করতেই ইমরান হেসে তার থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলো। নাফিসার পা যেন এবার আর চলছেই না! তার সত্যিই পা ব্যাথা করছে নাকি অভিনয় করছে বুঝা মুশকিল। তারা একটা আধ ভাঙা বিল্ডিংয়ের কাছে এসে বেঞ্চিতে বসলো। নাফিসা বললো,
– তোমার ফ্রেন্ডের বাড়িতে এসেছো তাহলে রিসিভ করতে এলো না কেন!
– জানাই নি, সারপ্রাইজ দিবো বলে।
– কিহ! ব্যবস্থা না করেই এখানে এসেছো! যদি তারা কোনো কারণে অন্যকোথায় গেলো তো?
– তো কি? বাড়িঘরের অভাব আছে নাকি! ভাড়া নিয়ে থাকবো।
– তো বসে আছো কেন এখানে! তাদের বাড়িতে চলো। না পেলে তো আবার ভাড়া নিতে হবে।
– চিনি না তো বাড়ি।
– কিহ! তাহলে এলে কেন অচেনা জায়গায়!
– চেনার জন্য এলাম।
এই মুহূর্তে ইমরানকে একদম পাগল পাগল লাগছে নাফিসার কাছে! সে দাত কিড়মিড় করে তাকাতেই ইমরান হেসে তার বন্ধুকে কল করলো। নাফিসা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আধ ভাঙা বিল্ডিংয়ে একটা অর্ধেক লেখা দেখা যাচ্ছে, “রিষদ”! এর আগে পরে কি হতে পারে বুঝা মুশকিল। তবুও নাফিসা ধরে নিলো শব্দটা ” ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা পরিষদ” হবে হয়তো। যার বাকি অংশ ধসে গেছে! ইমরান কল করার চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাটু পর্যন্ত প্যান্ট ফোল্ড করা, সেন্টু গেঞ্জির সাথে কাধে গামছা ঝুলানো এক যুবক প্রায় দৌড়ে আসছে এদিকে। পায়ের গোড়ালির উপর পর্যন্ত কাঁদা লেগে আছে! রোদে পোড়া চেহারা, মাথার চুলগুলো যে উষ্কখুষ্ক হয়ে কপালের দিকে লেপ্টে আছে তা দূর থেকেই বুঝা যাচ্ছে! এসে থামেও নি, অতি খুশিতে ইমরানের পিঠ চাপড়ে বললো,
“ব্যাটা, তুই আসবি একবার কল করবি না! এমন হুটহাট বাড়ির তলে এসে সারপ্রাইজ দিলে হার্ট অ্যাটাক হয় না!”
ইমরান জবাব দিতে দিতে এদিকে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো, “আসসালামু আলাইকুম, ভাবি। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?”
“আছি, আলহামদুলিল্লাহ।”
পরক্ষণে তাদের নিয়ে বাড়ির পথে হাটা ধরলো। ইমরানের মুখে মুখে তার নাম শুনে বুঝতে পারলো লোকটার নাম শিপন। আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই কিছু একটার দিকে নজর আটকে গেলো নাফিসার। সে পেছন থেকে ইমরানের শার্ট টানলে ইমরান তাকালো তার দিকে। সে ওই জিনিসটা ইশারা করে বললো,
– ওইটা কি?
– গরুর বা মহিষের গাড়ি।
প্রথমে নৌকার ছইয়ের মতো দেখা গেলেও এবার একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো নিচে চাকা দেখা যাচ্ছে। অর্ধেক ড্রেনের ভেতর পড়ে থাকায় নজরে পড়েনি সেটা। তবে এবার তার কাছে ক্লিয়ার। এটা দেখতে দেখতে যে তার পথ চলা থেমে গেছে সেটা খেয়ালই করেনি। কথা বলতে বলতে ইমরান একটু এগিয়ে গিয়ে পেছনে ফিরে বললো,
– এখন কি এটাই দেখবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে?
নাফিসা আবার হাটতে লাগলে শিপন বললো,
– ভাবি আসেন, ভাঙা গাড়ি দেখে কি করবেন। ভালো গাড়িতেই চড়তে পারবেন।
নাফিসা উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– গরুর গাড়ি চলে এখনো?
– হু।
নাফিসা ইমরানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আমি কিন্তু গরুর গাড়িতে চড়বো। জীবনেও চড়িনি। এমনকি চোখের সামনে দেখিও নি কখনো!
– ওইযে, ড্রেনে পড়ে আছে। চড়ো গিয়ে।
ইমরান মস্করা করাতে নাফিসা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো। বাসায় এসে তারা পরিচিত হলো পরিবারের লোকজনের সাথে। যৌথ পরিবার তাদের। মা, বাবা, ভাই সবারই একসাথেই বসবাস। বাড়িটা মোটামুটি বিশাল। তিনদিকে ঘর আর মাঝখানে উঠুন। এক দিকে মাটির ঘর আর দুইদিকে টিনের ঘর। প্রত্যেকটা ঘরই লম্বাটে। তিনটা করে রুম তো অবশ্যই হবে! শিপনের দুইটা বাচ্চা আছে। মেয়েটার বয়স চার-পাঁচ বছর হবে আর ছেলেটা মাত্র হাটতে শিখেছে। ভাবিদের চেয়ে শিপনের বউটা বেশ মার্জিত। নাফিসা ভাবলো এতো মার্জিত বউ কিভাবে এমন মেঠো লোকের বউ হয়! আর ইমরানের বন্ধু হলে সে মেঠোই হয় কিভাবে! ব্যাপারটি একটু বেমানান লাগলেও পরে ক্লিয়ার হলো। তখন রোদে পুড়ে নিজ জমিতে সেচের কাজ করছিলো বিধায় এমন দেখা গেছে। বাসায় ফিরে যখন গোসল করে স্বাভাবিক বেশ ধারণ করলো, এবার বুঝা গেলো সে ইমরানের বন্ধু! এছাড়া এতোক্ষণ মনে হচ্ছিলো বয়সে আরমানের চেয়েও বেশি বড় হবে। এখন ইমরানের মতোই। তবে এবার আরও একটা বিষয় বেমানান লাগলো! এতোক্ষণ শিপনকে দুই বাচ্চার বাপ বুঝা গেলেও এখন মনে হচ্ছে বাচ্চাদের বড় ভাই! ভাবতেই নাফিসা মুখ চেপে হাসলো! এছাড়া তারা কাপল হিসেবে পারফেক্ট! নাফিসাকে মুখ চেপে হাসতে দেখে ইমরান কারণ জিজ্ঞেস করলো। উত্তরে নাফিসা ফিসফিসিয়ে বললো,
– ভাইয়া যদি তোমার বয়সের হয়, তবে দুই বাচ্চার বাপ হয় কি করে!
ইমরান হেসে ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো,
– আমিও যদি বিশ একুশ বছরে বিয়ে করতাম তবে এখন দুই বাচ্চার বাপ থাকতাম।
– যাহ! ভাইয়া এতো অল্প বয়সে কেন বিয়ে করলো?
– পরিবারের ইচ্ছে।
সেদিন আর ভ্রমণ হলো না। খেয়েদেয়ে বিশ্রামে কাটিয়েছে তারা।
চলবে।