“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০২
(নূর নাফিসা)
.
.
– এ..! তাহলে কি এখন বিয়েটা খাওয়া হবে না আমার!
– রোজা থেকেও এতোবার খাওয়ার নাম জপো!
– ধুর! খালি বেশি বেশি।
নাফিসা রুম থেকে বের হতে গেলে ইমরান বললো,
– যাচ্ছো কোথায়? নিশাতকে রাজি করিয়ে বিয়ে ঠিক করতে!
– বেশি কথা বলবা না একদম! ইফতার কি তুমি তৈরি করবা?
– সাবধানে। আবার ভুলে যেওনা তুমি রোজা রেখেছো।
নাফিসা দরজার বাইরে এগিয়ে এসেছিলো। ইমরানের কথা শুনে আবার পিছু পথে ইমরানের সামনে এসে বললো,
– কি বললে? আবার বলো…
ইমরান হালকা কেশে খাটের দিকে যেতে যেতে বললো,
– বললাম আমার পড়া আছে, জিহান যেন এখন এসে ডিস্টার্ব না করে।
– সত্যি কথা, এখন কিছু একটা দিয়ে ঠিক মাথায় মারতাম!
কথাটা বলে নাফিসা চোখ রাঙিয়ে চলে গেলো আর ইমরান হেসে উঠলো।
আবিদা বেগম শোনা মাত্রই রাজি হয়ে গেছেন। তাছাড়া ওদিকে আয়েশা বেগম দিনকাল, ছেলেমেয়ের ব্যাপারস্যাপার, ভালোমন্দ বুঝিয়ে দিয়েছেন বোনকে। যা আবিদা বেগমের কাছে যুক্তিযুক্ত। তারও একই মতামত, মেয়ে উপযুক্ত হয়ে গেছে যেহেতু ঘরে বসিয়ে রাখবে কেন! তাছাড়া যথেষ্ট পড়াশোনা হয়েছে, এরপরও যদি করতে চায় তো জামাই করাবে এই প্রত্যাশা রেখেছিলেন তিনি। আর এখন তো জামাই হিসেবে আশিককে পেয়ে যাচ্ছে, তাহলে আর চিন্তা কি! চোখ বুজেই বিয়ে দেওয়া যায়! কিন্তু আরমান ও ইমরান উভয়েই অমত পোষণ করছে। আশিকের সাথে বিয়ে দিবে তার জন্য নয়, তাদের অমত তারা নিশাতের ভার্সিটির পড়াশোনা শেষ করিয়ে বিয়ে দিবে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে খালামনির সাথে কথা বলবে। তাদের ধারণা খালামনিই তারাহুরো করছে। আশিক যে সয়ং ব্যাপারটা তুলেছে সেটা তাদের ধারণার বাইরে।
আর নিশাত? যখনই তার সামনে বিয়ের কথা উঠছে তখনই নিশাত বিরক্তির সাথে বলছে সে আশিককে বিয়ে করবে না, না, না! যদি বাড়ি থেকে বিদায় করা এতো জরুরি হয় তবে অন্যত্র পাত্র দেখুক।
বড়মা নিশাতকে যেমন শান্ত রাখার চেষ্টা করছে তেমন সবার মতামত ভাবছে আর ভাবছে! আবিদার ইচ্ছেটাকেও সরাসরি রিজেক্ট করতে পারছে না বড়মা। যতই হোক, মেয়েটা তার। অবশ্যই তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। জেরিন নিশ্চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছে, আর নাফিসা কনফিউশান এ আছে বিয়েটা খেতে পারবে কি পারবে না! অর্থাৎ আশিক নিশাতের বিয়েটা হবে কি হবে না! তার বাইরেও বারবার এটা ভাবছে নিশাত আশিককে পছন্দ করতো কিন্তু বিয়ের কথা শুনে কান্না কেন করছে!
বউদের কাছে কোনো মতামত চাওয়া হয়নি এ ব্যাপারে। কি আর চাইবে, তারা মূল সদস্যরাই কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। এমনকি বেশি একটা ভাবছেও না। শুধু আয়েশা বেগম আর আবিদা বেগমই যেন মেতে আছে! দুপুর থেকে কতবার যে ফোনে কথা বললো তার হিসেব নেই। আর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত একটু পরপরই যেন এ নিয়ে এক আসর বসিয়েছেন আবিদা বেগম!
নাফিসা আজ দিনে কথা বলতে পারেনি তাই ইফতারের পর কথা বলছিলো মা বাবা ও আপুদের সাথে। প্রথমে নাহিদা কল করেছিলো। তার সাথে কথা বলে বাবা মায়ের সাথে কথা বললো। এরপর আবার কল করলো নাজিয়ার কাছে। নাজিয়া কল কেটে দিয়ে আরাফের ফোন থেকে ডায়াল করেছে। তার সাথে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে জানতে পারলো আশিক নাকি নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলেছে! এ কথা শোনার পর নাফিসার মাথায় পুরো গন্ডগোল লেগে গেছে! এমনিতেই এ বাড়িতে একটু পরপর এক এক ধরণের শুটিং দেখছে! এখন আবার আরেক ব্যাপার জেনে তার মাথায় সত্যি সত্যিই ব্যাথা উঠে গেছে! এতোদিন নিশ্চিত ছিলো নিশাত পছন্দ করে আর আশিক বোধহয় কিছু জানতোই না! আর এখন নিশাত কান্না করে বিয়ে করবে না আর আশিক নাকি সয়ং বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে!
অসহ্য লাগছে তবুও বড় ঘরেই বসে ছিলো নাফিসা! একা তার রুমে যাবে না বলে। তাদের মুখের গপ্পো শুনতে শুনতে ভোররাতের রান্না কোনো মতো শেষ করে নিয়েছে শ্বাশুড়িদের সাথে। জেরিন তো দিনরাত কামড়াবন্দি ই থাকে! ইশার নামাজ ও তারাবিহ পড়ে যখন খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হলো তখন আবার সব গুছিয়ে সে দাড়িয়ে রইলো। এমনিতেই এক মজলিস, তার উপর দুইভাই খেলা দেখতে বসেছে! কোন দেশের খেলা চলছে তা-ও বলতে পারবে না নাফিসা! তার মা ও বড়মার সাথে কথাও বলছিলো খেলাও দেখছিলো! কিভাবে পারে! অন্যান্য সদস্যরা এখানে থাকায় সে ডাকতেও পারছে না ইমরানকে! এবার সে কৌশলে ইমরানকে ডাকলো চাবি কোথায় তা জিজ্ঞেস করে! ইমরান তার দিকে তাকাতেই সে ইশারায় আসতে বললো। ইমরান উঠে এলো ড্রয়িং রুমের বাইরে।
– কি?
– ঘরে যাবো।
– বাইরে দাড়িয়ে আছো?
– ধ্যাৎ! ফাজলামো করো না। আমার খারাপ লাগছে।
– কি হয়েছে?
– মাথা ব্যাথা করছে।
– এই ম্যাচটা শেষ হোক, তারপর যাবো। এখন গিয়ে বড়মার রুমে শুয়ে থাকো।
– বড়মার রুমে গেলে আজ আর আমার রুমে যেতে পারবো না। চলো প্লিজ।
– একটু বাকি আছে।
নাফিসা রেগে বললো,
– তোমার আসতে হবে না। চাবি দাও। আমি একাই যাবো।
– চাবি তো তোমার কাছেই আছে। তো যাও…
– রুমের চাবি?
ইমরান পকেট থেকে শুধু রুমের চাবিটা বের করে দিয়ে আবার খেলা দেখতে চলে গেলো। নাফিসা বিরক্তি নিয়ে চাবি হাতে নিশাতের কাছে এলো। নিশাত বড়মার রুমে বিছানা ঝেড়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করছে। নাফিসা তার কাছ থেকে ওই ঘরের গেইটের চাবি নিয়ে একা একাই বের হতে যাচ্ছে। সে ড্রয়িং রুমের সামনে দিয়ে আসার সময় ইমরান লক্ষ্য করেছিলো তাকে। আর নাফিসা বড় ঘরের গেইটের সামনে এসে দাড়িয়ে গেছে! লাইট জ্বলছে বিধায় উঠুন আলোকিত। কিন্তু গেইট খুলে বের হওয়ার সাহস হচ্ছে না! দু তিন মিনিট যাবত শুধু ভাবছে আর ভাবছেই! হঠাৎই তার পেছনে ইমরান হাত রাখলে সে ভয়ে কেপে উঠলো! ইমরান বললো,
– এখানেই ভয় পেয়ে যাও, বাইরে বের হবে কিভাবে?
নাফিসা গোমড়া মুখু হয়ে দাড়িয়ে আছে। মাকে গেইট লাগাতে বলে ইমরান গেইট ঠেলে বেরিয়ে এলো। আবিদা বেগম গেইটে তালা লাগিয়ে গেলে ইমরান নাফিসাকে নিয়ে তাদের ঘরে চলে এলো। নাফিসা রুমে এসেই ধপাস করে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো! ইমরান বললো,
– আরে এটা কি! আজ এতো তাড়া কেন ঘুমানোর! খেলাটাও দেখতে দিলে না! আবার মশারিও আমার জন্য রেখে দিলে!
– কথা বলো না তো। আরেকটু হলে আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাবো!
ইমরান দরজা লাগিয়ে মশারী হাতে নিতে নিতে বললো,
– সে আর হবে কি! অলরেডি ডান!
নাফিসা শুনলেও তার প্রত্যুত্তর করেনি। মশারী টানিয়ে নিজেই গুজে দিয়ে আবার বেরিয়ে যাচ্ছিলো ইমরান। দরজা খোলার শব্দে নাফিসা চোখ খুলে তাকিয়ে বললো,
– আবার কই যাও তুমি!
– বাথরুমে। যাবে?
জবাবহীন নাফিসা আবার চোখ বুজে রইলো। একটু পরেই কপালের দুই কিনারায় হাতের স্পর্শ পেল। নাকেও ঝাঝ লাগছে! চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো ইমরান তার ধারে বসে বসে ব্যাথার মলম মালিশ করে দিচ্ছে। মাথায় যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও মন সহ সর্বাঙ্গে যেন প্রশান্তির সুখ ছেয়ে গেছে তার! অতি সুখে এবং মলমের ঝাঝ উভয়েই চোখ থেকে অশ্রু গড়াতে ভুমিকা রেখেছে! নাফিসা ইমরানের হাত সরিয়ে উঠে বসলো। এবং ইমরানের কপালে খুব গভীরভাবে চুমু একে দিলো।
ইমরান ঠোঁটের কোনে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে ব্রু সামান্য কুচকে বললো,
– শান্তি দিলি না তুই! একটুও শান্তি দিলি না আমায়!
নাফিসা ঝটপট শুয়ে পড়লো এবং বললো,
– এখন দুষ্টুমি করবে না বলে দিচ্ছি। সত্যিই আমার খারাপ লাগছে।
– দুষ্টুমি কেন করবো! বউ অসুস্থ হলে সেবা করা দরকার।
– সেবাও করতে হবে না। ঘুমাও, এতেই আমার সেবা হয়ে যাবে।
ইমরান লাইট অফ করে পাশে শুয়ে অল্প দুষ্টুমি করে আবার একহাতে কপালে মালিশ করে যাচ্ছে, অত:পর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। নাফিসা নিষেধ করলো তবুও শুনলো না। ব্যর্থ হয়ে সে পরম আবেশে চুপচাপ মিশে রইলো ইমরানের সাথে। দুমিনিটের মতো চুপ থেকে ইমরানকে বললো,
– এই?
– হুম?
– আশিকের সাথে নিশাতের বিয়েটা দিয়ে দাও। মন্দ হবে না।
– এতো বিয়ে খাওয়ার পাগল কেন! হুম? নিজের বিয়ে খেতে পারোনি বলেই কি?
– ধুর, ফাজলামো করছি না এখন। সিরিয়াসলি বলছি।
– আচ্ছা, এতো সিরিয়াস হওয়ার কারণটা কি শুনি?
– নিশাত ওবাড়িতে গেলে যতটা সুখী হতে পারবে অন্য মেয়ে তা পারবে না। বোনের মেয়ে হওয়া সত্ত্বে নিশাত নিশ্চয়ই পছন্দের বউমা হবে। তোমার খালামনির স্বভাবটাই কেমন যেন! আপনজন ছাড়া বাইরের লোককে সহ্য করতে পারে না।
– ভাবির জন্য বলছো?
– শুধু আপু কেন, আমি মনে করি যে কেউ হলেই এমনটাই করতো।
– ভাবির সাথে এমনটা হওয়ার কারণ আছে।
– কি?
– মামীর ইচ্ছাতে মারিয়া আপুর তো আরও আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। অত:পর খালামনি আরাফ ভাইয়ার জন্য জেরিনকে পছন্দ করেছিলো।
নাফিসা চমকে একটু সরে গিয়ে অন্ধকারেই ইমরানের দিকে তাকালো। মাথা ব্যাথা সত্ত্বেও সে এমন চমকে উঠায় ইমরান আবার তাকে আগের জায়গায় এনে বললো,
– একটা মাইর দিবো! এজন্যই বলতে ইচ্ছে করে না কিছু।
নাফিসা আবার আগের মতো মিশে থেকে বললো,
– না, বলো।
– খালামনি আরও চারপাঁচ বছর আগেই ভাইয়াকে বিয়ে করতে বলেছিলো। আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয় ভালো লাগে না তাই ভাইয়া নিষেধ করে দিয়েছে তখন বিয়ে করবে না। আরও পরে করবে বিয়ে। এ নিয়ে খালামনি রাগারাগি করেছে। আরাফ ভাইয়া নিষেধ করায় সুযোগ বুঝে মা ই আরমান ভাইয়ার বউ করে নিয়ে চলে এলো! এ নিয়ে আবার মায়ের সাথে খালামনির মনোমালিন্য ছিলো কিছুদিন। ভাইয়ের মেয়েকে আরাফ ভাইয়ার বউ করতে পারেনি বলেই উনার মাঝে ছেলের বউয়ের প্রতি এমন স্বভাব পরিলক্ষিত! যা ফেস করছে ভাবি।
– বাহ! বাহ! ভালোই তো তোমাদের পরিবারের কীর্তি! মজার বিষয়! শুধু শুধু অন্যত্র যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো! নিজেদের মধ্যে সব আবদ্ধ থাকলেই তো তোমাদের দুনিয়াটা শান্তি থাকতো! মিল তো ছিলোই! আরাফ ভাইয়ার সাথে না হয় জেরিনের বড় বোনটার বিয়ে হতো, আরমান ভাইয়ার সাথে জেরিন, আয়াতের সাথে তুমি আর নিশাতের সাথে আশিক। বাকি তো আর কেউই থাকতো না! দারুণ মিল ছিলো তোমাদের মাঝে!
– এহ! আসছে মিল ওয়ালী! তাহলে তোকে আমার করে পেতাম কি করে শুনি! ঘুমা চুপচাপ!
নাফিসা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।
পরদিন বিকেলে নিশাত নিজেই আশিককে কল করেছে। রিসিভ হতেই সে সালাম দিলো। আশিক সালামের জবাব দিতেই সে বললো,
– খালামনি কি শুরু করেছে এসব!
– কোথায় কি শুরু করছে!
– জানো না তুমি কিছু?
– কি জানবো!
– তোমার বিয়ে ঠিক করছে সেটা জানো না তুমি?
– কই না তো! আমার বিয়ে তো আমি নিজেই ঠিক করলাম।
– হচ্ছে কি এসব!
– আশ্চর্য! ক্লিয়ার না বললে আমি কিভাবে বলবো কি হচ্ছে না হচ্ছে!
– তুমি আমার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছো কেন?
– তোর পরিবারের জামাই হবো বলে।
– এসব প্রস্তাব ফিরিয়ে নাও। আমি বিয়ে করবো না তোমাকে।
– কেন?
– কেন আবার! এমনি।
– এমনি কেন?
– আমার ইচ্ছে তাই।
– অনন্ত রাজকুমারী থাকবি নাকি?
– সেটা তোমার কাজ। আমার না।
– আচ্ছা? আর সেখানে আমিই বিয়ে করতে চাইছি আর তুই কেন না!
– আমি তোমাকে বিয়ে করবো না।
– কাকে করবি?
– যাকে ইচ্ছে তাকে। জাস্ট তোমাকে না।
– পরশু পর্যন্তও আমাকে চাইলি আজ কেন নয়।
– এমনি।
– এমনি কেন, শুনি একটু।
– কাজিনের মধ্যে রিলেশন আমার ভালো লাগে না।
– যখন আমি তোর পছন্দের কেউ ছিলাম তখনও কাজিনই ছিলাম। তাহলে তখন চাইতে পারলে এখন রিজেক্ট কেন!
নিশাত খুব বিরক্ত হচ্ছে আশিকের প্যাচানো কথায়। তাই এবার বলেই ফেললো,
– আমি তোমার অনন্ত রাজকুমার হওয়া দেখতে চাই। এবার হয়েছে তো!
আশিক যেন এমন কোনো জবাবের প্রত্যাশাই করছিলো। তাই সে স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,
– তোকে দেখার সেই সুযোগ আমি দিব না। বিয়েটা অবশ্যই করবো।
– একদম না। আমি এই বিয়েতে একদম রাজি না। কনের উপর জোর করে নিশ্চয়ই বিয়ে সম্পাদন সম্ভব হয় না!
আশিক ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে বললো,
– প্রয়োজনে না হয় একটু জোরই করলাম। তাই বলে তো আর অন্যের ঘরে পড়ে পড়ে সারাজীবন কাঁদতে দিতে পারি না তোকে।
– করুণা দেখাচ্ছো? এতোটা অসহায় হয়ে পরিনি যে করুণা দেখাতে হবে আমার উপর। আমি তোমার জন্য কাঁদতে যাবো কেন অযথা।
– এখন আরও কতকিছুই না বলবি। এতোসব শুনতে পারবো না আমি। তুই রোজা না থাকলেও আমি রোজা আছি। শেষ সময়ে এতো কথা আসে না পেট থেকে। তাই এক কথায়ই বলে দিচ্ছি, বিয়েটা হচ্ছে। হুম? অভিমান ভালো কিন্তু বেশি অভিমান ভালো না। তাহলে আবার আমাকে আরেকটু কষ্ট করতে হবে। এমনি এমনি কাজ না হলে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ইফতারের পরেই কাজি অফিসে বিয়ে সারবো বলে দিচ্ছি।
নিশাত কল কেটে ফোন আছড়ে ফেললো খাটের উপর! প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আশিকের উপর! কান্নাও আসছে সাথে। ইফতার পর্যন্ত সে গোমড়া মুখুই হয়ে ছিলো। ইফতারের পরপরই আবার নিজের রুমে চলে এসেছে। নাফিসা তার রুমে পড়ছে আর নিশাত অন্ধকার রুমে একা শুয়ে আছে। একটু পরেই ফোনটা আবার বেজে উঠলো। আশিকের নম্বর থেকেই কল এসেছে। সে কল কেটে দিলো। মিনিটখানেক পরেই মেসেজ এলো, “অভিমান ভেঙেছে? জবাব আরেকবার না আসলে এখনই বল। এমন ব্যবস্থা করবো যে, তুই আর একদিনও কুমারী থাকতে পারবি না আর না থাকবো আমি কুমার!”
নিশাত বিরক্ত হয়ে ফোন সাইলেন্ট করে বালিশের নিচে রেখে দিলো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে বিকেলে বলা কথাগুলোই আবার মনে করছে সে। কয়েকবার মনে করে এক পর্যায়ে ফিক করে হেসে উঠলো! অথচ তার চোখে পানি। আর মুখে উচ্চারিত হচ্ছে,
– স্টুপিড, নন্ সেন্স, ইদুর, তেলাপোকা, চিক চিক চিকা….
তখন রোজা থাকায় বকা দেয়নি আশিককে কিন্তু এখন বকে নিচ্ছে ইচ্ছেমতো! কিন্তু এই ছোকরাটার হঠাৎ বিয়ে নিয়ে এতো তাড়া কেন হলো সেটাই তার অজানা রয়ে গেছে! ফোনটা আবার হাত বাড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে টেনে এনে দেখলো আরও একটা টেক্সট এসেছে,
“পারবো না আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না আমি ভুলতে তোকে
পারবো না ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যা না রাজি একবার…!”
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“পারবো না আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না আমি ভুলতে তোকে
পারবো না ছেড়ে বাঁচতে তোকে
হয়ে যা না রাজি একবার…!”
তার পরপরই আরেকটা টেক্সট,
“এটা কিন্তু সিনেমার গান ছিলো।”
নিশাত হেসে উঠলো! এরপর আর কোনো কল বা মেসেজ আসেনি। নিশাত অন্ধকারে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজায় ধুপধাপ শব্দে ঘুম ভেঙেছে। ইমরান ডাকছে। সে চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো। সবাই ডিনারের জন্য প্রস্তুত আর তার নামাজই পড়া হয়নি! সে বড়মার রুমে এসে নামাজ পড়ে নিয়েছে। জেরিনের খাওয়াদাওয়া একা একা তার নিজ রুমেই চলে। ইফতারের সময় বড়মা তাকে ডাকে কিন্তু সে নিজ থেকেই আসতে চায় না। আরমানের মতো অনেকেরই খারাপ লাগে বিষয়টি কিন্তু কেউই কিছু বলে না।
মায়ের উপর ভার ছেড়ে দিয়ে আশিক নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে। আয়েশা বেগম ও আবিদা বেগমের তাড়ায় দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা সম্পাদিত হলো। সপ্তম রমজানে নিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াত পড়েছে তৃ-তনয়ার শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের। মোটামুটি বড়সড় এক আয়োজন। সেই সুবাদে নাফিসা সেখানে দুদিন কাটিয়ে এসেছে। দশম রমজানে আবার আরাফের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াত পড়েছে। সবাই গিয়েছে কিন্তু নাফিসা বাদে। ইমরান বারবার বলেও তাকে রাজি করাতে পারেনি। আরাফ ও নাজিয়াও মন খারাপ করেছিলো এ নিয়ে। কিন্তু তার উক্তি পরিষ্কার, সে ওই বাড়িতে কখনোই পা রাখবে না! যদিও এবাড়ির লোকজনের সামনে অসুস্থতার অযুহাতই দিয়েছে। অন্যদিকে সবার অবাধ্য হওয়ায় ইমরান একটু রাগারাগিও করেছিলো তার সাথে। কিন্তু নাফিসা চুপচাপ বসে ছিলো। যে যা-ই বলুক, যাবে না সে। অত:পর তাকে বাড়িতে রেখেই সবাই চলে গেছে। আজ বহুদিন পর নীরব বাড়িতে থেকে সেই দিনটার কথা বেশ নাড়া দিয়েছে তার মাঝে। এমনিতে সে রাগ নিয়ে বেশিক্ষণ স্থির থাকে না। কিন্তু সেই ব্যাপারটা তার আত্মসম্মানে লেগেছে খুব। তার পরিবারের অসম্মান হয়েছে সেখানে! যদি বাবা-মা জানতো তাহলে হয়তো একটা না একটা ঝামেলা ঠিকই হতো। কিন্তু আয়েশা বেগমের কুৎসিত মানসিকতার কথা জানায়নি তাদের তৃ-তনয়ার একজনও।
কুরআন পড়তে পড়তে মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। নাফিসা এক গ্লাস পানি পান করে সিয়াম ভঙ্গ করলো। অত:পর এইঘরে তালা দিয়ে বড় ঘরে এলো। ভেতর থেকে গেইটে তালা লাগিয়ে সে ড্রয়িং রুমে নামাজ আদায় করে নিলো। অত:পর কিচেনে এলো। যদিও কিছুক্ষণ আগে ইমরান কল করে বলেছিলো ইফতারের জন্য খাবারদাবার সব আগেই নিজের রুমে এনে রাখতে। কিন্তু সে তা করেনি। ভেবেছে বড়ঘরে থাকলে টিভি দেখেও একা একা সময় কাটানো যাবে তাই এখানে এসেই নামাজ আদায় করলো। একা বাসায় থাকায় আর কিছু তৈরিও করেনি। এমনিতে ঘরে ফাস্টফুড আছে খাওয়ার জন্য। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে বেগুনি বানানোর ব্যবস্থা করলো। নিরবতার ভয় কাটাতে মোবাইলে ওয়াজ শুনছে আর একা একা বেগুনি তৈরি করে খাচ্ছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে নাফিসা আঁতকে উঠল! এক ঢোক পানি পান করে ফোন রিসিভ করলো। সে “হ্যালো” বলতেই ওপাশ থেকে ইমরান ধমকের সুরে বললো,
– কোথায় তুমি?
– কেন? বড় ঘরে বসে আছি।
– কখন থেকে ডাকছি! গেইট খুলো।
নাফিসা ফোন রেখে চাবি নিয়ে গেইটের কাছে এলো। ইমরান হাতে ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সে গেইট খুলতে লাগলে ইমরান বললো,
– কানে তুলা লাগিয়েছো? ডাকতে ডাকতে গলা ব্যাথা হয়ে গেছে!
– আহ! চেচাও কেন! ওয়াজ চলছিলো ফোনে তাই তোমার গলার আওয়াজ যায়নি কানে।
– বাইরের লাইটটাও জ্বালায়নি আবার বলে চেচাই কেন!
গেইট ঠেলে ভেতরে এসে মাত্রই ব্যাগটা তার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলো ইমরান। এদিকে নাফিসা তার কথা শোনার জন্য দাড়িয়ে না থেকে দৌড় দিলো কিচেনে। তার বেগুনি পুড়ে যাচ্ছে! ইমরান আবার গেইটে তালা লাগিয়ে টেবিলে ব্যাগটা রেখে কিচেনে এসে দেখলো সে বেগুনি বানাচ্ছে। তাই বললো,
– এখন এগুলো বানাও, তো ইফতার করছো কি?
– এই যে, ইফতার করছি এখন।
– এতোক্ষণে!
– হুম। তখন পানি পান করে নামাজ আদায় করেছি। এখন নিশ্চিন্তে বসে বসে খাবার তৈরি করছি আর খাচ্ছি। তুমি এসে পড়লে কেন এতো তারাতাড়ি?
– আমি তো ব্যস্ত মানুষ, কাজকর্ম বেশি থাকে তাই বেড়ানোর সুযোগ হয় না কোথাও।
– হুহ্! ব্যস্ত মানুষ! এটা বললেই পারো হৃদপিণ্ডটা বাসায় রেখে গেছো তাই দেহ টিকেনি সেখানে।
ইমরান তার দিকে এক পলক তাকিয়ে শার্ট খুলতে খুলতে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– প্যাকেটে খাবার দিয়ে দিছে ভাবি। এগুলো খাও। নাকি এখন তাদের বাড়ির খাবারও খেতে পারবে না?
নাফিসা কিছু বললো না। ইমরান বাইরের লাইট জ্বালিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে গেলো। নাফিসা চুলা বন্ধ করে বেগুনির প্লেটে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। ইমরান সেন্টু গেঞ্জি পরে ফ্যান অন করে খাটে বসে টিভি দেখছে। ইমরানের সামনে প্লেট দিয়ে খেতে বলে নাফিসা ডাইনিং টেবিলের সামনে এলো। ইফতারসহ রাতের খাবার দিয়ে দিয়েছে নাজিয়া। প্যাকেট নাড়াচাড়ার শব্দ পেয়ে ইমরান বললো,
– ভাজা জিনিস এখন বেশি খেয়ো না। পেট ব্যাথা করবে। বরং ডিনার করে ফেলো।
নাফিসাও তাই করলো। ইফতারের খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে প্লেটে পোলাও মাংস নিলো। দুই প্লেট হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো প্লেটের তিনটা বেগুনিই খেয়ে ফেলেছে ইমরান! তাই বললো,
– তুমি কি ইফতার না করেই চলে এসেছো?
– করেছি।
– কিভাবে করলে! এইটুকু সময় তো পথ অতিক্রম করতেই লাগবে!
– এক গ্লাস জুস, একটা চপ আর এক টুকরো আপেল খেয়ে নামাজ আদায় করেছি। এতোক্ষণে ভাবি গুছিয়ে রেখেছে সব। এরপর ব্যাগটা নিয়ে ছুটেছি। মাগরিবের আগেই দেখা করে চলে আসতাম, তারা আসতে দেয়নি।
– নিজেই ইফতার করোনি আবার আমাকে শাসাও! হাত ধুয়ে খেয়ে নাও।
– ইশার নামাজ পড়ে তারপর।
– না, এখন খাও। একটু পরে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে থেকো।
ইমরান তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে অত:পর হা করলো। নাফিসা ব্রু কুচকে বললো,
– বাইরে থেকে এসেছো হাতমুখ তো অন্তত ধুয়ে এসো!
– একটু পর ওযু করবো তাই আলসেমি করছিলাম।
ইমরান হাতমুখ ধুয়ে এসে আরাম করে বসলো। অত:পর টিভি দেখতে দেখতে এক প্লেটেই খাবার নিয়ে নাফিসার হাতে দুজনের ডিনার হলো।
খাওয়াদাওয়া শেষে নাফিসা ভোর রাতের রান্না বসিয়ে দিলো। আর ইমরান টিভি দেখে সময় কাটিয়ে একটু জিরিয়ে নিলো। অত:পর দুজন একসাথে নামাজ আদায় করলো। নামাজ পড়ে আবার খেলা দেখছে ইমরান আর নাফিসা রান্না শেষ করে ইমরানের ফোনে গেমস খেলছে। এমনি সবাই হাজির। নাফিসা রান্না করে রাখায় শ্বাশুড়িরা উভয়েই খুশি হয়ে প্রশংসা করলো। কেননা কোথাও ঘুরে এসে রান্না করাটা সবার জন্যই বিরক্তিকর হয়ে পড়ে! আর সেখানে নাফিসা তাদের ক্লান্তিটা নাশ করে রেখেছে! প্রশংসাটা যদিও বড়মা একটু বেশিই প্রকাশ করলো আর আবিদা বেগম তুলনামূলক কম। কিন্তু ইমরান ও নাফিসা উভয়েই মনে মনে খুশি এতে। কিছুক্ষণ পরেই দুজন নিজেদের ঘরে চলে এলো। ইমরান ঘরে এসেই নাফিসার মুখখানা ধরে কপালে খুব গভীরভাবে চুমু একে দিলো। নাফিসা হয়তো বুঝতে পেরেছে সে কেন দিলো এই উপহারটা তাই আর কারণ জানতে চায়নি। বরং মনের মধ্যে খুশিটা আরও তীব্রভাবে ধারণ করেছে। স্বেচ্ছায় কিছু কিছু কাজ করে যদি শ্বাশুড়িদের আর স্বামীকে খুশি করানো যায় তাহলে কে না অনুপ্রাণিত হবে এমন কাজগুলো আবার করতে! একটু প্রশংসা শুনতে আর একটু ভালোবাসা পেতে কার না ভালো লাগে!
অত:পর ষোড়শ রমজানেই ইফতারের পর ঘরোয়াভাবে বিয়ে সম্পাদিত হয়ে গেলো আশিক ও নিশাতের! তাড়া ছিলো আশিকের কিন্তু প্রকাশ্য তাড়া ও ব্যবস্থা আয়েশা বেগম ও আবিদা বেগমের। তাদের ধারণা রমজান মাসে সম্পর্ক স্থাপনে আল্লাহর রহমত বেশি থাকবে। ইমরানের মোটেও মত ছিলো না এখন এমন বিয়েতে। কিন্তু বাকিদের বিপরীতে গিয়ে অমতও পোষণ করলো না। বিয়ে উপলক্ষে তাদের বাড়িতেও আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে মোটামুটি বড়সড় আয়োজন হলো। যদিও জেরিনের বাবা মা আসেনি। আর মেহেদীর পরিবারও আসতে পারেনি। তাদের অন্যত্র দাওয়াত আছে। কিন্তু তারা এই নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, যখন আনুষ্ঠানিকভাবে আবার বিয়ে হবে তখন ইনশাআল্লাহ আসবে।
নাফিসার মতো নিশাতও বউ সাজেনি বিয়েতে। গর্জিয়াছ থ্রিপিস পড়েই তার বিয়ে সম্পাদিত হয়েছে। নাফিসা বলেছিলো শাড়ি পড়তে কিন্তু সে নিজ আত্মীয়দের মাঝে এমনিতেই লজ্জায় মরে যাচ্ছে! সেখানে শাড়ি পড়ার কথা ভাবতেও পারেনি! তবে আজ আশিকের মাঝেও লজ্জা স্পষ্ট ছিলো! বাইরের লোক হলে হয়তো এতোটা নার্ভাস ফিল হতো না। এতোদিন যাদের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ছিলো, আজ তারা তার মুরুব্বি হয়ে বসে আছে। লজ্জা তো পাবেই! তবুও ধৈর্য ধারণ করে সময় কাটিয়েছে সে। কেননা, এমন লজ্জা তো আর প্রতিদিন আসছে না। বিয়েটা সম্পাদন হলেই সে মুক্ত। বিয়ে হওয়ার পর থেকে নাফিসা নাজিয়াকে বেয়াইন ডাকছে আর আরাফকে বেয়াই সাহেব ডাকছে! নিয়াজ উদ্দিন ও রুমানা বেগম বাড়ি চলে যাবে। তাই নাজিয়া, নাফিসা, আরাফ, ইমরান কথা বলতে বলতে এগিয়ে দিতে এলো। নাজিয়া আর নাফিসা রাস্তার গেইটের সামনে দাড়িয়ে ছিলো। ইমরান আর আরাফ রাস্তায় এসে রিজার্ভ গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলো। বাবা-মা চলে গেলে তারা আবার বাড়ির ভেতরে এসে উঠুনে হাটছে আর কথা বলছে। নাফিসাকে রাগিয়ে দিতে দুষ্টুমির ছলে উপহাস করছিলো আরাফ। নাফিসা তার বিয়ের দিন কেমন আচরণ করেছিলো, ইমরান কেমন ভেজা বিড়াল হয়ে ছিলো সেদিন! নাফিসা কেমন তাদের দাওয়াত না দিয়েই ইমরানের খরচ বাচাতে একেবারে একা একাই শ্বশুর বাড়ি এসে পড়েছে! এসব কথাবার্তা নিয়ে হাসাহাসি চলছে। ইমরান হাসছে আর চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। কেননা আরাফের বিপরীতে নাফিসা চাপা ছাড়ছে। এক পর্যায়ে নাফিসা বললো,
– ওকে, মানলাম আমি আপনার ভাইয়ের খরচ বাঁচিয়েছি। কি করবো বলুন, ছোট্ট একটা সংসার। তারউপর কমার্সের স্টুডেন্ট! হিসেব না করে চললে কি হবে নাকি! তা বেয়াই মশাই, একটা জবাবদিহি করেন তো।
– কি?
– আপনার বিয়ের ঘটক কে ছিলো?
– আমি নিজে।
– বড় আপুর বিয়ের ঘটক কে ছিলো?
– বিয়ে আমাদের, ঘটক তো একই হলো না!
– এক আর দুই বুঝি না। সরাসরি উত্তর চাই।
– হুম, তোমার বড় আপুর বিয়ের ঘটকও আমিই ছিলাম।
– এবার বলুন আমার বিয়ের ঘটক কে ছিলো?
নাফিসার প্যাচ ধরতে পেরে আরাফ চুপ হয়ে গেছে! মুখে তার চাপা হাসি! ইমরান ফিক করে হেসে উঠে বললো,
– কি হলো, মাস্টার মশাই? বলুন, বলুন? আপনি প্রফেশনাল মাস্টারের পাশাপাশি কি প্রফেশনাল ঘটকও? দুইটা বিয়ের চারটা পক্ষের ঘটক আপনি একা! ডিয়ার ওয়াইফি, একটা গিফট পাওনা তোমার।
– ওপ্স! কি গিফট?
– গিফট একটা হলেই হলো। বলতে হবে কেন!
– ওকে, ভালো হওয়া চাই।
আরাফ নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি গো? তুমিও কিছু বলো, ওরা দুজন আমাকে চাপানোর চেষ্টা করছে যে!
– আমাকে কিছু বলেছো? আমি শুনিনি তো কিছু!
– ওহ! আমিও তো শুনিনি! চলো চলো, বাসায় যেতে হবে। কিরে আশিক? তোর বিয়ে করা হয়েছে? এবার বাড়ি যাবি, নাকি ঘরজামাই থাকবি?
আরাফ উঠুন থেকে ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে আর তারা সবাই হাসছে!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৪
(নূর নাফিসা)
.
.
দ্বাবিংশ রমজানে নাফিসা ও নিশাতকে নিয়ে শপিং করতে গেছে ইমরান। সাথে আশিককেও ডেকেছে। তারা বাসা থেকে বেরিয়েছে বিকেলে। কেননা শপিং করে তারা রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া করে আসবে। আশিক ও ইমরান নামাজ পড়লেও নিশাত ও নাফিসার মাগরিবের নামাজটা মিস হয়ে গেলো। ইফতার করে ঘুরাফেরা ও কেনাকাটার পরপর তারা ডিনার করতে রেস্টুরেন্টে এলো। আশিক চেয়ার টেনে বসেই নাফিসার দিকে মেনু এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ভাবি, কি খাবেন? অর্ডার করুন।
– ওরেব্বাস! আপনি খাওয়াবেন নাকি?
– কেন নয়!
– আচ্ছা!
নাফিসা বেছে বেছে কয়েকটা আইটেম অর্ডার করলো। এখানে আসার সম্পূর্ণ সময়টাতেই সে লক্ষ্য করলো নিশাত ও আশিক একে অপরের সাথে তেমন কথাবার্তা বলছে না। স্বামী স্ত্রী তো দূরে থাক, তারা যে আগে ভাইবোন ছিলো তার রেশটুকুও উপলব্ধি করা যাচ্ছে না! মনে হচ্ছে যেন তারা একে অপরকে চেনেই না! সে ভাবছে তাদের বিয়ের এক সপ্তাহ না যেতেই কি ঝগড়া বেধে গেলো?
খাওয়াদাওয়া শেষে তারা সবাই শপিং ব্যাগ-ট্যাগ সহ বেরিয়ে এলো। নাফিসা ঢেকুর তুলতে তুলতে বললো,
– মজা পেয়ে বেশি খেয়ে ফেলেছি বোধহয়! যাইহোক, অবশেষে ধনেপাতা ডুলাভাইকে!
আশিক হাস্যকরভাবে বললো,
– ধনেপাতা আবার ডুলাভাই! যাক, ধনেপাতা আমার লাগবে না ভাবি। ওটা আপনি ভাইকে দিয়ে দিয়েন। কেননা রেস্টুরেন্ট বিলটা ভাই দিয়েছিলো।
আশিকের কথা শুনে নাফিসা রেগেমেগে তাকালো ইমরানের দিকে। আর আশিক যেন হাসতে হাসতে শহীদ! নিশাতও হাসছে! নাফিসাকে দেখে ইমরান বললো,
– এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? হাত ব্যাথা করছে? ব্যাগগুলো আমার আছে দাও তাহলে।
নাফিসা শাস্তিস্বরূপ ব্যাগ গুলো তো দিলোই সাথে তার পার্সটাও ইমরানের গলায় ঝুলিয়ে দিলো! ইমরান আশিকের সাহায্যে পার্সটা হাতে নিয়ে হাটতে লাগলো। অত:পর বাড়ির নিকটবর্তী স্ট্যান পর্যন্ত রিজার্ভ সিএনজি নিলো। আশিক সামনে আর তিনজন পেছনে বসেছে। নাফিসা সম্পূর্ণ পথ গাল ফুলিয়ে ছিলো! আর আশিক খোচা মেরে আরও রাগিয়ে দিচ্ছিলো তাকে! শুধু গাড়িতে আছে বিধায় কিছু বললো না আশিককে! নতুবা ইটা মেরে মাথা ফাটিয়ে দিতো! আশিক স্ট্যান থেকে তার বাসায় ফিরে গেছে। আর তারা নিজ বাসায় এসে পড়লো। ঘরে এসে নাফিসা রেগেমেগে চলাফেরা করছে বিধায় ইমরান বললো,
– ছি, তুমি এই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার নিয়ে এমন রেগে আছো! বড় ভাই হয়ে আমি তাকে বিল দিতে দেই কি করে!
– একদম চুপ! একটা কথাও বলবা না। ওই আশিক্কা বারবার আমার খরচ করিয়ে দৌড়ে পালায়! সেদিন ভার্সিটিতে যেই রাগ উঠেছিলো, ভাবলাম আজ বেশি বেশি খেয়ে তার উশুল তুলবো! আসছে আরেক মহান দরদী ওয়ালা! আজকের বিলটাও তারই দেওয়ার ছিলো! বেশি খেয়ে এখন আমার অবস্থা টাইট!
– এক্কেবারে উচিত হইছে! অন্যের জন্য কূপ খুড়লে সেখানে নিজেকেই পড়তে হয়।
– তুমি না এলেই তো পড়তাম না! কূপ তো ওই আশিক্কা খুড়ছে! আসুক আবার। শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদরে জামাল গোটা খেয়ে যাবে!
ইমরান হেসে বললো,
– আচ্ছা? দেখো, সেই জামাল গোটা যেন আবার তোমার পেটে না যায়! এখন কি একটা সেভেন আপ এনে দিবো? খাবার হজম হয়ে যাবে তারাতাড়ি।
নাফিসা রেগে তার গলা চেপে ধরে পিছু ঠেলতে লাগলো। ইমরান হাসতে হাসতে ইচ্ছে করেই পিছু হেলে নাফিসাকেসহ বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো। নাফিসা উঠতে চেষ্টা করলো কিন্তু ইমরান তাকে দুহাতে জড়িয়ে রেখে চোখ বুজে ঘুমের ভান করে আছে! নাফিসার প্রায় সম্পূর্ণ ভারই ইমরানের উপর। সে ছাড়তে বললেও ছাড়লো না তাই নাফিসাই আবার ব্যর্থ নিশ্বাস ফেলে তার বুকের মধ্যখানে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। দু’মিনিট চুপচাপ থেকে অত:পর শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
– ছি! শার্ট থেকে ঘামের কি দুর্গন্ধ বেরিয়েছে। ছাড়ো।
ইমরান তবুও কোনো রেসপন্স করলো না!৷ নাফিসা এবার তার পেটে চিমটি দিয়ে বললো,
– ওই ব্যাটা, ছাড়তে বলিনি?
ইমরান ব্যাথা পেয়ে তাকে ছেড়ে দিলো! নাফিসা উঠে পড়লো আর ইমরান পেটে স্লাইড করতে করতে উঠে বসে বললো,
– ওফ! আমি বউকে আদর করি আর বউ আমাকে এমন অত্যাচার করে! কারে বলিবো, এই মনের দুঃখ গো…আমি?
তার মুখে এমন সুর শুনে নাফিসা মৃদু হেসে বললো,
– নিজে তো চিতপটাং হয়ে আরামে শুয়ে আছেন! উপুড় হয়ে যে আমার দম আটকে যাচ্ছে সেটা চোখে পড়ে না?
– ধুর কথা নাই তোমার সাথে।
– বলতে হবে না কথা। শার্ট দাও।
– দিবো না। অর্ধেক খুলে রাখছো কেন?
নাফিসা এবার কাছে এসে পুরোটাই খুলে নিলো। সাথে তার খোচা খোচা দাড়িযুক্ত গালে আলতো কামড় বসিয়ে দিলো। ইমরান বাঘের থাবার মতো ভঙ্গিতে রিটার্ন করতে গেলে নাফিসা খিলখিলিয়ে হেসে পেছনে সরে এলো। ইমরান ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
– ওইঘরে ফ্রিজে মনে হয় সেভেনআপ আছে। দেখে এসো। না হলে দোকান থেকে এনে দিবো।
নাফিসা বেরিয়ে বড় ঘরে গিয়ে সেভেন-আপ নিয়ে এলো। ভাবলো নিশাতকে জিজ্ঞেস করা যাক খাবে কি-না। তাই নিশাতের রুমে এলো। দরজা চাপানো ছিলো। সে একটু ঠেলে ফাঁক করতেই দেখলো নিশাত এক হাতে জামাকাপড়, জুতা গুছিয়ে রাখছে আর ফোনে কথা বলছে,
“বাসায় ফিরেছো?”
“না, আবার ডিনার করবো বুঝি! খেয়ে না এলাম।”
“ইশ তুমিই খাও আবার।”
“ভালো হইছে, আমি মোটা ই। তাই আর খাবো না। তুমি চিকন তুমিই খাও বেশি বেশি।”
“না, নামাজ পড়বো, তারপর ঘুম।”
নিশাতের কথাবার্তা শুনে বুঝে গেছে আশিকের সাথেই কথা বলছে। তাই আর ডিস্টার্ব করলো না নব দম্পতিকে। আস্তে করে দরজা চাপিয়ে সে নিজের রুমের দিকে এগোতে এগোতে বললো,
– হুহ্! তখন দেখালো যেন কেউ কাউকে চিনেই না! আর এখন চোখের আড়াল হতেই এতো আলাপ! আহা, কি প্রেম!
মাঝপথে হঠাৎই ইমরান বেরিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে। তার শেষ উক্তি শুনে বললো,
– কি বলছো একা একা?
– তোমার ভাই বোনের মাঝে কি প্রেম! একটু আগে দেখা করে এলো আর এখনই ফোনে জমে গেছে! আমাদের বিয়েতেও তো প্রোগ্রাম হয়নি! আমিও বাপের বাড়ি চলে যাই, কি বলো? তারপর না হয় ফোনে প্রেম করতে করতে ভার্সিটি পাড় করেই তোমার কাছে আসবো!
ইমরান হেসে তাকে নিজের সাথে চাপিয়ে রুমের দিকে হাটতে হাটতে বললো,
– অসম্ভব। তোকে ছাড়া আমার চলবে নাকি! আর আমাদের মতো প্রেমই কেউ করতে পারে নাকি!
– এহ! আসছে বিখ্যাত প্রেমিক! এওয়ার্ড কে দিবে শুনি?
– তুই ই আমার এওয়ার্ড। আর কিছু লাগে না আমার।
– নাও, ধরো। এটা নিয়ে যাও। আমি ওযু করে আসি। একসাথে নামাজ পড়বো।
দরজার সামনে এসে ইমরানের হাতে বোতল ধরিয়ে দিয়ে নাফিসা ওযু করতে চলে গেলো। বাড়ির অন্যান্যরা ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত। তারা নামাজ পড়ে দেড়ি করেই ঘুমালো।
ঈদুল ফিতর কাটলো তাদের আনন্দের সাথেই। নাফিসার ইচ্ছে ছিলো কোথাও বেড়াতে যাবে কিন্তু সামনে এক্সাম থাকায় ইমরান নিয়ে গেলো না। রোজার আগে বেড়াতে গিয়েছে তাই নাফিসাও তেমন জোর করলো না। তাছাড়া তারা দিনাজপুরে ঘুরে এলো, রোজা গেলো, ঈদ গেলো হাতটানও তো পড়েছেই কিছুটা! তা ভেবে নাফিসা দ্বিতীয়বার আর সেই কথা তুলেনি। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে সে। তার আবদার বা ইচ্ছাতে ইমরান কখনোই সরাসরি না করেনি। সাথে সাথে পূরণ সম্ভব না হলে পরে পূরণ করার জন্য সময় নেয়। ইমরানের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোই নাফিসাকে তার প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট করেছে। যদিও শখের বশে ফটাফট প্রকাশ করে ফেলে কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে পেরে নাফিসাও দ্বিতীয়বার সেই শখ প্রকাশ করে না। যদি অতিব জরুরি না হয়, তবে সেটা ক্যান্সেল করে দেয়। আর জরুরি হলে অপেক্ষা করে।
.
আরাফ ইশার নামাজ পড়ে ঘরে এসেছে। নাজিয়া রান্নাবান্নার কাজকর্ম সেড়ে দরজা চাপানো রেখে নামাজ পড়ছিলো। আরাফ এসে দেখলো মোনাজাতে খুব কাঁদছে নাজিয়া। হয়তো আরাফের উপস্তিতি টের পেয়েছে। তাই মোনাজাতে আর বেশি সময় নিয়ে কান্না করেনি। দুতিন মিনিটের মধ্যেই সে শান্তভাবেই মোনাজাত শেষ করে উঠে পড়লো। নাজিয়া জায়নামাজ রাখার সময় আরাফ টুপি রাখতে রাখতে বললো,
– মিসেসের মনটা কি কোনো কারণে খারাপ হয়ে আছে?
– উহু, ভাত খেতে এসো।
– এই, দাড়াও!
নাজিয়া দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে জবাব দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলে আরাফ থামিয়ে দিলো। আজ বিকেলেই বাসায় ফিরেছিলো সে। তখন থেকে একটা বারও নাজিয়াকে তার দিকে তাকাতে দেখেনি! এমনকি কোনো কারণে তার কাছও ঘেঁষেনি! নিজেকে কেমন যেন আড়াল রাখতে চাইছে, এবং আরাফকে এড়িয়ে চলছে। যেটা এ পর্যন্ত বারবার লক্ষ্য করে আরাফ নিশ্চিত হয়েছে। আর এখন তাকে থামিয়ে দিয়ে সে দরজা লাগিয়ে নাজিয়ার কাছে এসে বাহুতে হাত রেখে বললো,
– হয়েছে কি, বলোতো?
– কোথায় কি হয়েছে!
– আমাকে এড়িয়ে চলছো তুমি।
– কি বলো এসব! এড়িয়ে চলবো কেন! ক্ষুধা লেগেছে, খেতে এসো।
– এখনো তুমি একবারের জন্যও আমার দিকে তাকাওনি।
নাজিয়া জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে আরাফের চোখে তাকাতে গেলো। কিন্তু মিথ্যে হাসিটা পরিপূর্ণ ভাবে ফুটে উঠলো না! তার আগেই চেহারায় বিষন্নতার ছাপ ও চোখে অশ্রু ভীড় জমিয়েছে! আরাফের ব্রু অটোমেটিক কুচকে গেলো! নাজিয়া তাকে ছাড়িয়ে চলে আসতে চাইলে আরাফ হাতের বাধন শক্ত করে বললো,
– কি হয়েছে? বলো আমাকে?
– কিছুনা।
– নাজিয়া, বারবার একই কথা শুনতে ভালো লাগছে না। বিনা কারণে পরিস্থিতি এমন হয় না।
সাথে সাথেই নাজিয়া আরাফকে ঝাপটে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো! আরাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– আরে! কাঁদছো কেন? কি হয়েছে বলো আমাকে?
– আরাফ, আমার খুব ভয় করছে। খুব ভয় করছে আমার! বারবার যদি একই ঘটনা ঘটে আমার সাথে। আমি পারবো না মানতে।
আরাফ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে নাজিয়ার মাথায় থুতনি রেখে বললো,
– আরোহী ফ্যাক্ট কিছু?
নাজিয়া ভয়ার্ত কান্নার মাঝেই জবাব দিলো, “হু”! আরাফ মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে নাজিয়ার মুখখানা দু’হাতে ধরে বললো,
– আরোহীর আম্মুটা ইদানীং অনেক ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছে! তুমিই না বলো, “পা ফেললে মচকে যেতে পারে সেই ভয়ে কি আমরা হাটা বন্ধ করে দিবো?” তাহলে আজ তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন?
– ওই সময়টা খুব কঠিন আরাফ। আমি ভোগ করে এসেছি সেই ব্যাথা৷ সহ্য করার মতো না! আজও খুব কষ্ট দেয় আমাকে। এমন মেয়েদের বারবারই সমস্যাটা দেখা দেয়। জানি না তারা কিভাবে সহ্য করে! আমার খুব ভয় করছে।
আরাফ তাকে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
– কিছু হবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। সবকিছু সহিহ সালামত রাখার মালিক তিনি। কাল বা পরশু ডক্টরের কাছে যাবো। হুম? আরে, এভাবে কাদছো কেন তুমি? আমি আছি না তোমার পাশে! আর আল্লাহর রহমত আছে না আমাদের সাথে? বোকা বউ, এ তো আমাদের সৌভাগ্য আমরা প্যারেন্টস হবো। খুশির সময় কেউ এভাবে কাঁদে! হেসে হেসে কাঁদতে হয়। হাসো…
আরাফ চেষ্টা করে হাসাতে পারেনি কিন্তু শান্ত করতে পেরেছে। ওদিকে আয়েশা বেগমের হাক পড়লে নাজিয়া চোখ মুছে বেরিয়ে গেলো। মুখটা মলিন রেখেই খাওয়াদাওয়া সেড়ে এলো।
পরদিন দুপুরে বাসায় ফিরে এসেছে আরাফ। অত:পর বিকেলে নাজিয়াকে নিয়ে হসপিটালে গেলো। ডাক্তার নাজিয়াকে কয়েক মাস বেড রেস্টে থাকতে বললো। পাঁচ-ছয় মাস হলে নিজের সুবিধামতো টুকটাক কাজ ও হাটাহাটি করবে। আরাফ পড়ে গেল দুশ্চিন্তায়! কেননা সংসারের প্রায় সম্পূর্ণ কাজের ভারই নাজিয়া বহন করে। এতোগুলো দিন কি নাজিয়ার পক্ষে বেড রেস্টে থাকা সম্ভব! এই মেয়ে তো বসে থাকার না! সে ই বা আর কতক্ষণ তাকে চোখে চোখে রাখবে! বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিলে সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতো। কেননা রুমান বেগম মেয়েকে খুব সযত্নে রাখতে পারবেন। কিন্তু সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে! রুমানা বেগম একা মানুষ। মুরগির খামার দেখাশোনাসহ নিজের সংসারের কাজই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! আর এদিকে আয়েশা বেগম যেতেও দিবে না। আবার তিনি যে তেমন যত্ন নিবে না সেটাও সে নিশ্চিত। তাই অনেক ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিলো একটা কাজের লোক রাখবে। ভারি কাজকর্ম যা আছে সব করে দিয়ে যাবে, আর বাকিটুকু তার মা দেখাশোনা করবে। কিন্তু এখন তার মা মানবে কি-না সেটা দেখার বিষয়। বাসায় ফিরে সে মায়ের সাথে কথা বললো। ডাক্তারের বলা বিষয়াদি বুঝিয়ে কাজের লোক রাখার কথা বললো। তা না হলে বারবার সেই ঝুঁকি থাকে আর বাচ্চা ঠিকঠাকভাবে আসার সম্ভাবনা কম থাকে। আয়েশা বেগম প্রথমে নিশাতকে বাড়িতে নিয়ে আসার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু আরাফ নিষেধ করলো। কেননা সে তুলনামূলক ছোট। না পারবে কাজের দায়ভার নিতে, আর না পারবে যত্নাদির ব্যাপারে তেমন নজর দিতে। তাই তিনি আরাফের সিদ্ধান্তেই রাজি হলেন। আয়েশা বেগম তো রাজি হয়ে গেলেন৷ আরাফও খুশি হলো। এখন শুধু দেখার বিষয় যত্নাদি ঠিকঠাক মতো হয় কি-না! মায়ের ব্যাপারটা নিশ্চিন্ত হয়ে এবার নাজিয়াকে সাবধান করে দিলো তার কথার যেন অমান্য না করে। তবে আয়েশা বেগম আয়াতকে কল করে বললেন কিছুদিন থেকে যেতে। সে তো এখন ফ্রী ই আছে। মায়ের সাথে কাজকর্ম এগিয়ে দিতে পারবে। কাজের লোক ঠিক হলে না হয় চলে যাবে।
চলবে।