যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৩২
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার
আদ্রিশার ভাবনার মাঝেই মালিহা ইয়াসমিন ছেলেকে অসহায় মুখে বলেন, “এমন করছিস কেনো? মেয়েটারও তো কিছু শখ আহ্লাদ আছে! স্বামী হয়ে কিন্তু তোর এসব খেয়াল রাখা উচিত!”
মুগ্ধ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “মা, এমন ভাবে বলছো যেনো আমি কিছুই খেয়াল রাখি না। প্রতিটা কাজের পেছনে যথার্থ কারন থাকে। আমার এই সিদ্বান্তের পেছনেও আছে।”
মালিহা চোখ গরম করে বললেন, “কি এমন কারন যার জন্য সদ্য বিয়ে করা বউকে পাহাড় দেখাতে নিয়ে যেতে চাইছিস না?”
মুগ্ধ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললো, “সদ্য বিয়ে করা বউ যেতে চাইছে বলেই নিয়ে যেতে হবে, আর বিয়ে পুরনো হলে অর্থাৎ তুমি চাইলে বাবা নাও নিয়ে যেতে পারে! এটাই বলতে চাইছো?”
মালিহা থ বনে গেলেন ছেলের কথায়। তিনি কি বললেন আর ছেলে কি বুঝলো! শওকত শাহ গলা ঝেড়ে বললেন, “কথা না ঘুরিয়ে বল যা বলার। বিয়ের পর প্রথম কোথাও যাচ্ছিস নিজেদের পছন্দের জায়গায় তো যাবি না কি?”
মুগ্ধ মুচকি হেসে বললো, “আদ্রিশা আপনি এর আগে কখনো পাহাড়ে গিয়েছেন? ট্রেকিং করা বা পাহাড়েই ঘুরোঘুরি করেছেন?”
আদ্রিশা মাথা দুলিয়ে বললো, “না, পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু বাবা মা কখনো পারমিশন দেন নি!”
মুগ্ধ এবার দু হাতের কুনই টেবিলের উপর ঠেস দিয়ে দু হাত মুঠো করে বললো, “তাহলে ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না?”
আদ্রিশা সহ তার শ্বশুড় শাশুড়ি কিছুই বুঝলেন না। তারা একে অপরের মুখ দেখছেন। মুগ্ধ আবারও বললো, “যেমন আপনি কখনো পাহাড়ে যান নি তেমন আমিও যাই নি। আর এখন আমরা দুজন বেড়াতে যাচ্ছি। সাথে তো কেউ নেই। পাহাড়ে গাইড ছাড়া, সঙ্গী ছাড়া কিভাবে যাবো বলুন তো। আর তাছাড়া, ট্রেকিং করা কতোটা ডিফিকাল্ট! পাহাড়ি রাস্তায় হাটাচলা করতে কতোটা অসুবিধা হতে পারে, কত বিপদে পড়তে পাড়ি তার কোনো আইডিয়া আছে আপনার?”
মুগ্ধর কথা শুনে তার বাবা মা গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। সত্যিই তো এমন তো তারা ভাবেন নি! আদ্রিশা বাচ্চাদের মতো হাত নাড়িয়ে বললো, “আমরা কি আর একা একা পাহাড়ে চলে যাবো না কি! গাইড নিবো তো! হাটা চলা করতে তেমন অসুবিধা হবে না। আর হলেই বা কি? আমি সামলে নেবো। ট্রেকিং করা তো এমনি এমনি শেখা যায় না। শিখতে হলে একটু রিস্ক নিতেই হবে। প্লিজ মুগ্ধ মানা করবেন না!”
শওকত শাহ আদ্রিশার সাথে তাল মিলিয়ে বললেন, “হ্যা ঠিকই তো বলেছে। এখনই তো বয়স এসব করার। বুড়ো হয়ে গেলে হাটতেই পারবি না ট্রেকিং তো দূরে থাক!” স্বামীর কথায় মালিহাও মাথা নাড়লেন।
কিন্তু মুগ্ধ তার সিদ্ধান্তে অটল। সে বললো, “সেসব মানলেও যাওয়া সম্ভব নয় আদ্রিশা! পরে নাহয় দু পরিবার একসাথে পাহাড় ট্রিপে যাবো!”
মালিহা মুগ্ধকে থামিয়ে বললেন, “উফফ,,,, তুই আর বড় হলি না। বলি, আমরা বুড়ো বুড়িরা পাহাড়ে কি করবো শুনি?”
মুগ্ধ হেসে বললো, “সিনিয়ার সিটিজেন্সরা হোটেলে থাকবে আর বাকি ইয়াঙ্সটার্সরা পাহাড়ে ঘুরবো। কি বলেন আদ্রিশা? আইডিয়াটা কেমন?”
আদ্রিশা ভেঙচি কেটে বললো, “পরের কথা পরে! এখন যে কথা হচ্ছে সেটায় ফিরে আসুন। হুট করে অন্য কথায় লাফ দেন কেনো?”
আদ্রিশার কথায় মালিহা আর শওকত শাহ মিটি মিটি হাসছেন। মুগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “যা বলতে চাইছিলাম না , সেটাই বলতে হচ্ছে।(আদ্রিশা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মুগ্ধর দিকে) আদ্রিশা, আমরা এক সপ্তাহের জন্য যাবো। পাহাড়ে মাত্র এই কদিনে আপনি কিছুই এক্সপিরিয়েন্স করতে পারবেন না। পাহাড় ভ্রমণে সুইটেবল সময় প্রয়োজন। আরেকটা কথা হলো, আমরা হানিমুনে যাচ্ছি! এক সপ্তাহ কি পাহাড়েই ট্রেকিং করবো? এমন যায়গায় যাওয়া উচিত যেখানে ঘুরাঘুরিও করা যাবে সাথে আমরাও কিছু টাইম স্প্যান্ড করতে পারবো।”
মুগ্ধর কথায় এবার আদ্রিশার যায় যায় অবস্থা। কার সামনে কি বলতে হয় তার বেসিক সেন্সটাও মুগ্ধর নেই! এদিকে মুগ্ধর কথায় মালিহা ঝট করে চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে পরেন। তারপর টেবিল থেকে বাটিগুলো নিয়ে রান্নাঘরে গেলেন। শওকত শাহও গলা খাকরি দিয়ে ঘরের দিকে যাওয়ার ব্যাস্ততা দেখালেন। মুগ্ধর এতে কোনো ভাবান্তর হলো না। দিব্যি গ্লাস নাড়াচাড়া করছে। আদ্রিশা চোখ মুখ কটমট করে বললো, “সামান্য বুদ্ধিটুকু নেই! কি করে এতো খাপছাড়া কথা বার্তা বলেন?” মুগ্ধ চেয়ার থেকে উঠে আদ্রিশার দিকে ঝুকে বললো, “ভালো ভাবে বলছিলাম শুনছিলেন না। তাই বাধ্য হয়েই এসব কথা বলতে হলো। এনিওয়ে বুঝতে তো পারলেন সেই অনেক!” বলেই চোখ টিপ মেরে ঘরে চলে গেলো। আর আদ্রিশা এখনো ডাইনিংএ আছে। কি করে শাশুড়ির সামনে যাবে তাই ভেবে পাচ্ছে না। এই ছেলেটা নিজে উল্টো পাল্টা কথা বলে আর ফাঁসিয়ে দেয় আদ্রিশাকে!
_________________
আদ্রিশা মুখ ফুলিয়ে বিছানার পাশে দাড়িয়ে আছে। মুগ্ধ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আদ্রিশার উদ্দেশ্যে বললো, “ভার্সিটি যাবেন না?”
আদ্রিশা কিছু না বলে ঘরে থেকে বেরুতে নিলে মুগ্ধ সামনে দাড়িয়ে পরে। অস্থির কন্ঠে বললো, “কি হয়েছে আপনার? কাল থেকে ইগনোর করছেন আমাকে!”
আদ্রিশা রাগ দেখিয়ে বললো, “তো কি করবো? আপনাকে নিয়ে নাচবো বুঝি?”
মুগ্ধ হাত দিয়ে কলার ঠিক করে বললো, “না না, আমি নাচতে পারি না। তবে আপনি শেখাতে চাইলে আপত্তি নেই।”
আদ্রিশা মুগ্ধর কাধ ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বললো, “ফালতু কথা একদম বলবেন না। আর হে শুনুন, আমি না হ্যাংলা নই! অন্যের জিনিসের উপর কোনো লোভ নেই আমার।”
মুগ্ধ কপাল কুঁচকে বললো, “জিনিস! কার জিনিস? কোন জিনিসের কথা বলছেন?”
আদ্রিশা ঠোঁট বাকিয়ে বললো, “আপনার কথা বলছি। বুঝতে পারছেন না?” মুগ্ধ হাতের কোট বিছানায় ছুড়ে বললো, “আমি! জিনিস!? কার জিনিস?”
আদ্রিশা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ” তিথির জিনিস! নেহাত ছোট বেলার ইচ্ছে তাই আবদার করেছিলাম। বাবা মায়ের সামনে বলতে না পারলেও আমাকে আলাদা বলে দিতেন, তিথিকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে ঘুরতে যাবেন না আপনি? এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কি আছে? আমি তো আপনার সাথে সত্যি সত্যি হানিমুন করতে যাচ্ছি না। ঘুরতেই তো যেতে চেয়েছিলাম!”
মুগ্ধ পকেটে হাত গুজে বললো, “আমি কারো জিনিস নই মিস থুরি মিসেস শাহ! হ্যা, তিথি আমার ভালোবাসা। আমি ওর আপনজন, ওর কথায় ওর পৃথিবী । তবে জিনিস?উহুম,,,,মোটেও নই!”
‘মিসেস শাহ’ শব্দটি শুনেই আদ্রিশার বুক কেঁপে উঠলো। পরোক্ষনের ‘তিথি আমার ভালোবাসা’ কথাটা শুনেই রাগে গা জালা করছে তার! মুগ্ধ বললো, “পাহাড়ে না যাওয়ার যুক্তিটা কিন্তু সত্যিই আমি এসব কিছু ভেবে দিই নি। ঘুরতে না যাওয়ার হলে অন্য কোথাও যেতে চাইতাম না অবশ্যই! তিথি ছাড়া অন্য একজনের সাথে যখন একই ছাদের নিচে, একই বিছানায় থাকতে পারছি তখন ঘুরতে যেতে আপত্তি কেনো হবে?”
আদ্রিশা কিছু বলতে নিলে মুগ্ধ বিরক্তির সুর তুলে বললো, “নাও প্লিজ ডোন্ট স্টার্ট এগেইন! টোন্ট করে বলি নি কথাটা। লজিকালি বলেছি।”
আদ্রিশা মাথায় চাপর মেরে বললো, “আমি কিছুই শুরু করছি না। কিন্তু পাহাড়ে যাওয়াটাই বেস্ট ছিলো!”
মুগ্ধ চোখ বন্ধ করে খুললো। শ্বাস টেনে বললো, “কিভাবে?”
আদ্রিশা বিছানায় বসে বললো, “আমরা তো আর সত্যিকার স্বামী স্ত্রী নই! হানিমুনে নিশ্চয় দুজন রোমান্স করবো না! তাহলে করবো টা কি? আই মিন পাহাড় হলে নাহয়, ট্রেকিং করতাম সময় কেটে যেতো!”
মুগ্ধ বুঝলো আদ্রিশার কথাটায় দম আছে। কিন্তু আদ্রিশার কথা মেনে নিলে তার সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। সেটা তো করা যাবে না। নিজের অক্ষমতার প্রকাশ করলে ইগোতে লাগবে! তাই বাঁকা হেসে বললো, “পাহাড় ছাড়া বুঝি আর কোনো জায়গা নেই ঘুরার মতো? ঘুরতে যাওয়া মানেই তো আনন্দ উল্লাস। অপেক্ষা করুন, এমন এক যায়গায় নিয়ে যাবো আপনি শুধু দেখতেই থাকবেন! হোটেলেও বসে থাকতে হবে না আর বোরও ফিল হবে না। অন্য কাপলসদের মতো রোমান্টিকতা থাকবে না আমাদের হানিমুনে তবে এনজয় মেন্ট থাকবে। ট্রাস্ট মি নিরাশ হবেন না।” ব্যাস, বেরিয়ে গেলো মুগ্ধ। আদ্রিশাও তার ব্যাগ হাতে নিয়ে পিছু ছুটলো মুগ্ধর। যেতে যেতে ভাবছে, কোথায় নিয়ে যেতে পারে মুগ্ধ? যেভাবে বললো, ‘দেখতেই থাকবেন’-এমন না হয় শুধু দেখতেই থাকলো, দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকলো না! আনন্দটাও না মাটি হয়ে যায়!
ভার্সিটি গেটে আদ্রিশাকে নামিয়ে দিয়ে মুগ্ধ তার অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো, আদ্রিশাকে পিক করতে আসবে। আগ বারিয়ে যেনো বাড়িতে না চলে যায়। যদিও সেদিন বলেছিলো, আদ্রিশাকে শুধু ভার্সিটিতে ড্রপ করে দেবে তবুও কদিন ধরে তাকে পিকও করছে! আদ্রিশার হাজার বারণও শুনেনি মুগ্ধ। তার এক কথা, যতো দিন আদ্রিশা তার ওয়াইফ ততোদিন আদ্রিশা তার দায়িত্ব! এর থেকে পিছপা হবে না সে। কোনোভাবেই আদ্রিশার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না। কিন্তু একা যাওয়া আসাতে কিসের ক্ষতি হবে সেটাই বুঝতে পারছে না আদ্রিশা। ক্লাসে আসতেই নীলা , রুহি আর তুহিন আদ্রিশার সামনে এসে দাঁড়ালো। আদ্রিশা চোখ তুলে ওদের দিকে দেখতেই নীলা বলে উঠলো,
“ভাইয়া দিয়ে গেলো!”
আদ্রিশা মাথা নেড়ে সিটে বসলো। তিন বন্ধুও আদ্রিশাকে ঘিরে বসে পরলো। রুহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আদ্রিশা বললো, “ঐ হারামী, কোথায় ছিলি এতোদিন? তুই নাকি প্রেম করিস! কার সাথে? জলদি বল।”
সবাই এখন রুহিকে দেখছে। রুহি শুকনো ঢোক গিলে বললো, “আগে এটা বল, কোথায় যাবি ঠিক করলি?”
আদ্রিশা ভ্রু কুঁচকে বললো, “কিসের কোথায় যাবো?”
রুহি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে আদ্রিশার কাধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো, “ম্যাডাম যে হানিমুনে যাচ্ছেন তাও কি আমায় বলতে হবে?”
নীলা আর তুহিন চোখ বড় বড় করে আদ্রিশাকে দেখছে। তুহিন বললো, “কিহ! তুই হানিমুন যাচ্ছিস? ঐদিন বললি, বেবি প্ল্যানিং করছিস না, আর এখন,,,,, উহুম,,উহুম!!”
নীলা মুখ ফুলিয়ে বললো, “বাহ বাহ, আমাদের জানালিও না!”
আদ্রিশা ঠোঁট কামরে বললো, ” হানিমুনে যাচ্ছি, যুদ্ধে নয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে হবে!?”
নীলা মুখ ঝামটিয়ে বললো, “হুহ,,,, তাহলে রুহিকে কেনো বললি?”
আদ্রিশা চোখ ঘুরিয়ে রুহির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো, “আমি তো তোকে কিছু বলিনি! তুই কিভাবে জানলি আমার হানিমুনের কথা? তাও আবার একদিনেই!”
নীলা তুহিন সন্দেহী দৃষ্টিতে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি পরেছে মহা ফ্যাসাদে! ভেবেছিলো কথা ঘুরিয়ে বেঁচে যাবে, কিন্তু এখন তো আরো ফেঁসে গেলো! কি উত্তর দেবে এদের ভেবেই পাচ্ছে না।
চলবে,,,,,,,,,,
যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৩৩
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার
রুহির থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আদ্রিশা এক ভ্রু উচু করে বললো, “স্নিগ্ধর সাথে বুঝি!?”
রুহি হতচকিত হয়ে গোল গোল চোখ করে আদ্রিশার দিকে তাকালো। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “আমি বলতাম তোদের। কিন্তু সুযোগ পাই নি!”
নীলা মুখ হা করে রুহির কাধে থাপ্পড় মেরে বললো, “বদমাইশ কোথাকারের! ঐদিন না বললি, ছেলেটা তোর সাথে ফ্লার্ট করে! তুই তো পছন্দ করতি না। ওয়েট ওয়েট, ওকে অপছন্দ করার নাটক করিস নি তো আবার?”
তুহিন দাড়িয়ে রুহির চুলের বিনুনি ধরে বললো, “তুই যে এতো ভালো অভিনয় করতে পারিস তা তো জানা ছিলো না দোস্ত! আফসোস, সাকিব খানের সাথে একখান বাংলা ছবি করতে পারলি না।”
রুহি তুহিনের হাতে চিমটি কেটে বিনুনি ছাড়িয়ে নিলো। তারপর বললো, “আরে ধুর! আমাকে কিছু বলতে তো দিবি!”
আদ্রিশা সিট ছেড়ে দাড়িয়ে পরলো। পেছনের উচু বেন্চটায় পা দুলিয়ে বসে রুহির কাধে হাত রেখে বললো, “তো বল। যা যা লুকিয়েছিস সব বল। কমা দারিও যেনো বাদ না পরে।”
রুহি মাথা নিচু করে লজ্জা রাঙা হয়ে ওড়নার আঁচল আঙুলে ঘুরাচ্ছে। তুহিন বেজায় রেগে গেলো। দাঁত কেলিয়ে হেলেদোলে বললো, “আপনার লজ্জা পাওয়া হয়ে গেলে কাহিনি কি বলবেন!? আসলে, আপনার এই লজ্জাবতী চেহাড়া দেখে আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ইশশশ!”
নীলা আর আদ্রিশা হো হো করে হাসতে লেগে গেলো। রুহি মুখ ভার করে বললো, “তোদের রিসেপশনের পরদিন আমার ফেইসবুক আইডিতে ও ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলো। তারপর মেসেজও করেছিলো। (আদ্রিশার দিকে তাকিয়ে বললো) ও তো তোর দেবর। তাই এক্সেপ্ট করেছিলাম রিকুয়েস্ট! কিন্তু ও এত্তো ডিস্টার্ব করতো যে, ওর প্রেমে পরতেই হলো!”
আদ্রিশা লাফ দিয়ে বেন্চ থেকে নামলো। তুহিন ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে আছে রুহির দিকে। নীলা রুহির দিকে ঝুকে বললো, “ও ডিস্টার্ব করলো, আর তুই ওর প্রেমে পড়ে গেলি?”
রুহি মাথা নাড়তেই আদ্রিশা ওর গালে ঠাস করে চড় মেরে দিলো। এতে আশেপাশের সবাই ওদের দিকে তাকালো। তবে তা কয়েক সেকেন্ড ছিলো। তুহিন নীলা রুহির কোনো ভাবান্তর হলো না। আর না তারা চমকালো। আদ্রিশার এমন চড় ওরা সবাই কম বেশি খেয়েছে। আবার চড় মারার পেছনে কোনো স্পেসিফিক কারনও থাকে না। কিন্তু আজকের থাপ্পড়ের পেছনে কারন আছে। আদ্রিশার মনে হচ্ছে রুহি মিথ্যে কথা বলছে। কেউ কাওকে বিরক্ত করলে কিভাবে প্রেম হয়। বরং বিরক্তি বাড়ে এবং একসময় কথা বলার ইচ্ছেটাও নষ্ট হয়ে যায়। অথচ এই মেয়ে ভালোবেসে বসে আছে! রুহি আদ্রিশাকে বসিয়ে বললো,
“সত্যি বলছি দোস্ত!”
তুহিনের ঝটপট প্রশ্ন,” কি সত্যি বলছিস? একটা ছেলে তোকে কিছুদিন বিরক্ত করলো আর তুই ফট করে তার প্রেমে পরে গেলি! ইয়ারকি হচ্ছে?”
রুহি তুহিনের কথার জবাব না দিয়ে আদ্রিশার দিকে তাকিয়ে বললো, “ওর আমার সাথে ফ্লার্ট করা, অহেতুক ঝগড়া করা, ডিস্টার্ব করা আমায় প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সেইসব বিরক্তিই ভালো লাগতে শুরু করি। মাঝখানে একদিন রেগে গিয়ে ওকে মেসেজ করতে মানা করেছিলাম। আমার কথা শুনে আমায় দু দিন মেসেজ করে নি। তখন ওর কথা খুব মনে পরছিলো। আমাদের আগের কনভার্জেশনগুলো বার বার দেখতাম। অপেক্ষা করতাম কখন মেসেজ করবে। জানিস তো, ওর কথা না বলা আমার বড্ড পুড়াচ্ছিলো। ও অনলাইন থাকতো স্টিল আমায় নক করতো না! ইগনোরেন্স সহ্য করতে পারছিলাম না। পাগল পাগল লাগতো নিজেকে। বাধ্য হয়ে আমিই ওকে নক দিই। খুব ঝগড়া করেছিলাম সেদিন। অবশ্য যা বলার আমিই বলেছি বেচারা চুপচাপ শুনে গেছে। তবুও ভালো লাগছিলো। আমার কথা গুলো, অভিযোগ গুলো নিশ্চুপ হয়ে শুনছিলো! এক পর্যায়ে বলেই দিলাম খুব ভালোবাসি তাকে! আর তারপর থেকেই আরকি, প্রেম! কিন্তু তোদের বলার সুযোগ পাই নি বিশ্বাস কর।”
এতোক্ষন ধরে রুহির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সবাই। আদ্রিশা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো, “সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু যে ছেলেকে তুই পছন্দ করতিস না তাকেই ভালোবেসে ফেললি!?”
রুহি হালকা হেসে বললো, “আদু, তুই ই একদিন বলেছিলি, ভালোবাসা প্ল্যান করে হয় না। যাস্ট হয়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই হুট করে একদিন কারো জন্যে মনে ছোট্ট জায়গা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে সেই কেউ একজন মনের সম্পূর্ন জায়গা দখল করে নেয়। না চাইতেও কখন কাকে কিভাবে ভালো লেগে যায় বলা যায় না। মনের অজান্তেই, ভালো লাগা থেকে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। অনুভুতি তো আর কন্ট্রল করা যায় না, এক না একদিন সেটা প্রকাশ পাবেই! তাই নিজে থেকেই প্রকাশ করে দেয়া শ্রেয়। অপেক্ষায় থাকলে যদি সুযোগ না থাকে আর। যদি অপূর্ণ থেকে যায়! সবাইকে ধোকা দেয়া গেলেও হৃদয়কে ধোকা দেয়া যায় না!”
কথা গুলো বলার সময় রুহি এক অন্য জগতে চলে গিয়েছিলো। তার চোখে মুখে তৃপ্তি ছিলো। ভালোবাসার তৃপ্তি।কথা শেষে মুখ ঘুরিয়ে দেখে আদ্রিশা নীলা আর তুহিন তার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। রুহি ভ্রু উচিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে। আদ্রিশা হাত ভাজ করে বললো, “এতসব কথা আমি কখন বললাম?”
রুহি এগিয়ে এসে বললো, “বলেছিস। সব না বললেও আংশিক তোর কথা। আর বাকিটা আমিই বললাম। প্রেমে পরলে কাব্যিক ব্যাপার চলে আসে! সব কিছুই তখন বেস্ট।”
সবাই খানিক হাসলো। নীলা ঢোক গিলে বললো, “সবই বুঝলাম কিন্তু এই হৃদয় কে? হৃদয়কে কেনো ধোকা দেয়া যায় না?”
আদ্রিশা মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। রুহি তুহিনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই তুহিন নীলার ডান হাত নিজের হাতে পুরে বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরে বললো,”এই যে এখানটাকে হৃদয় বলে। হৃদয়কে ধোকা দেয়া যায় না, কারন স্পেশাল মানুষটাকে দেখলেই বুক ধুকপুক ধুকপুক করে। এই দেখ, এখন কেমন লাফাচ্ছে! ফিল করতে পারছিস?”
নীলা ঝটকা মেরে হাত ছুটিয়ে নিলো তুহিনের থেকে। তারপর বললো, “আমার ওতো এমন হয়। তবে কি আমিও ওকে ভালোবাসি?”
তুহিন ভ্রু কুঁচকে বললো, “কাকে? কাকে দেখলে তোর এমন হয়?”
রুহি আর আদ্রিশাও চোখ বড় বড় করে দেখছে নীলাকে। নীলা লজ্জা পেয়ে বললো, ” রবিন স্যার!”
তুহিন তেড়ে এসে বললো, “হোয়াট! ঐ বুইড়া বেটা!”
নীলা রাগি স্বরে বললো, “খবরদার বুইড়া বলবি না! কত্তো কিউট! দেখলেই মনটা চায় বিয়ে করে ফেলি!”
আদ্রিশা আর রুহি হাসি আটকাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর তুহিন রাগে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই ক্লাসের ঘন্টা পড়ায় নীলা ব্যাগ হাতে দৌড়ে নিজের ডিপার্টমেন্টে ছুটলো। তুহিন আদ্রিশার দিকে দেখে দাঁত বের করে হেসে করে বললো, “দোস্ত যাই এখন। ঐ বুইড়াটার ক্লাস। নীলা তো বেটার উপর পাগল প্রায়! ঐ বেটা না আবার বাচ্চা মেয়েটারে ফাঁসায়! আসি হে!” তারপর তাড়াহুড়ো করে ছুটলো। রুহিও আদ্রিশাকে বাই বলে ক্লাসে চলে গেলো। এদের চারজনেরই ডিপার্টমেন্ট আলাদা। আদ্রিশা ইংলিশ, রুহি একাউন্টিং , নীলা ইকনোমিক্স আর তুহিন জীব বিজ্ঞানের ছাত্র! তবুও এই কলেজ লাইফের বন্ধুত্ব ভাঙে নি। বরং সময়ের সাথে সাথে আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। যদিও নীলা তুহিনের ক্লাস আলাদা তবে তুহিনকে খুব একটা নিজের ক্লাসে দেখতে পাওয়া যায় না। হয় নীলার সাথে এক বেন্চে বসে নীলার ক্লাস করবে নয়তো নীলার ক্লাসের বাইরে দাড়িয়ে তাকে নজরে রাখবে। আজও এর ব্যাতিক্রম নয়। আদ্রিশা এদের কান্ড দেখে হাসলো। আর ভাবলো, তুহিন সত্যিই নীলাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই গর্ধবটা যে কবে বুঝবে কে জানে। তুহিনও আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে না। পরে না দুজনকেই কষ্ট পেতে হয়!
_______________
ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাড়িয়ে ছিলো আদ্রিশা। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে দরজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলো মুগ্ধকে। আদ্রিশার দিকে এগিয়ে আসছে সে। আদ্রিশাও কোনো কথা বলে নি। মুগ্ধ আদ্রিশার পাশে দাড়িয়ে রেলিংএ ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। আদ্রিশার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ছাদে আজ!”
আদ্রিশা কিছুই বললো না। একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ এবার বললো, ” ছাদ আমার খুব পছন্দের জায়গা। বিকেল বেলার এই সময় টা বেশ লাগে! কোলাহল নেই! নিশ্চুপ সব কিছুতেও যেনো কিছু আছে।”
আদ্রিশা মুগ্ধর দিকে দেখে বললো, “আমার মাঝরাতে ছাদে আসতে ভালো লাগে। আসলে বিষয়টা ছাদ নিয়ে নয়, আকাশ নিয়ে। আমার ঐ অন্ধকার আকাশ খুব আপন মনে হয়। অবশ্য চাঁদ আর তারার আলোতে খারাপ লাগে না। মাঝে মাঝে চাঁদের সাথে গল্প করতে পারা যায়, তারার সাথে খুনশুটি আর আকাশের সাথে ,,,,,,” এতোটুকু বলেই থেমে গেলো আদ্রিশা।
মুগ্ধ বললো, “আকাশের সাথে?”
আদ্রিশা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললো, “ভাগাভাগি! অনুভুতি, কষ্ট সব ভাগাভাগি করা যায়!”
মুগ্ধ হয়তো কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছে না। আদ্রিশা শুকনো কাপড় তুলতে তুলতে বললো, “কিছু বলার জন্য এসেছিলেন বুঝি? বলুন।”
মুগ্ধ আবারও অবাক হলো আদ্রিশার কথায়। এই মাত্রই তার কথায় অভিমান খুঁজে পাচ্ছিলো মুগ্ধ। কোনো এক না বলা কথার কষ্ট রাগ প্রকাশ পাচ্ছিলো। আর এখন কতো স্বাভাবিক। কথা বার্তায় মনে হবে না, একটু আগে এই মেয়ে মন খারাপ করে ছাদে এসে দাড়িয়েছিলো। আদ্রিশার কথায় ঘোর কাটে মুগ্ধর।
“কি হলো বলুন!”
মুগ্ধ হালকা হেসে আদ্রিশার হাতের কাপর নিজের হাতে নিয়ে নিলো। তারপর বললো, “গোছগাছ শুরু করে দিন।”
আদ্রিশা না বুঝে বললো, “মানে?”
মুগ্ধ অন্য কাপড়গুলো রসি থেকে নিজের হাতে তুলে নিতে নিতে বললো, “কাল যাচ্ছি। আমাদের সো কল্ড হানিমুনে!”
আদ্রিশা চোখ গোল গোল করে বললো, “সত্যি!? কাল? কোথায়?”
মুগ্ধ ভাব নিয়ে বললো, “কালই দেখতে পাবেন। আপনার এই টেম্পরারি হাজবেন্ড আপনাকে কোথায় নিয়ে যায়!”
আদ্রিশা ভ্রু কুঁচকে খানিক পিছিয়ে গেলো। ঢোক গিলে বললো, “আপনি কি আমায় কিডন্যাপ করবেন না কি? তারপর মেরে ফেলবেন!?এএএএ,,,,,, আমি তো বলেছি আপনার আর তিথির মাঝখানে আসবো না। আপনার তিথিকে আসতে দিন আমি চলে যাবো তো। কোথাও নিয়ে যেতে হবে না আমায়। আমি মা কে বলবো যাওয়ার দরকার নেই কিন্তু মারবেন না আমায় প্লিজ!! এহেএএএ,,,”
মুগ্ধ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কোন কথাকে কোথায় নিয়ে লাগাচ্ছে! মুগ্ধ কোনোরকম বললো, “আদ্রিশা, কিসব যাতা বলছেন! কুল ডাউন! আপনাকে মারতে কেনো যাবো? আর কিডন্যাপ কিসের জন্য করতে যাবো?”
আদ্রিশা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো, “তাহলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
মুগ্ধ বুঝলো না বলে উপায় নেই। তাই শান্ত কন্ঠে বললো, “শ্রীমঙ্গল!”
আদ্রিশা চোখ বড় বড় করে মুগ্ধর দিকে এগিয়ে এসে বললো, “শ্রীমঙ্গল? হানিমুনে শ্রীমঙ্গল?”
মুগ্ধ কাধ দুলিয়ে বললো, “আরে শ্রীমঙ্গলে অনেক ঘুরার জায়গা আছে। চিল! আপনার ভালো লাগবে।”
আদ্রিশা মাথা দুলিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “বাকি কাপড় আপনি নিয়ে আসুন। আমি ব্যাগ গুছাতে গেলাম।” বলেই ভো দৌড় দিলো। মুগ্ধ আহাম্মকের মতো কাপড় হাতে দাড়িয়ে আছে। তার বুঝতে বাকি নেই, আদ্রিশার কান্না, কিডন্যাপিংএর কথা বলা ওসব এক্টিং ছিলো! মুগ্ধর থেকে জায়গার নামটা জানতেই তার এইসব নাটক। মুচকি হেসে বাকি কাপড়গুলো তুলতে লাগলো মুগ্ধ। মনে মনে বললো, “টেম্পরারি বউ যদি এতো কাজ করায় পারমানেন্ট বউ না জানি কতো কিছু করাবে! হে আল্লাহ রহম করো আমায়। আমার মতো এতো নিশ্পাপ, কিউট, ড্যাশিং ছেলেটাকে সারাক্ষন খাটাচ্ছে ঐ ঝগড়ুটে মেয়েটা!”
দরজার অপাশ থেকে আদ্রিশা বলে উঠলো, “অভিশাপ দিচ্ছেন না কি আমায়? লাভ নেই! আপনার জীবন আমি তেজপাতা করেই ছাড়বো। আর তিথি এসে আপনার তেজপাতা জীবনকে তেলে ভাজবে!” বলেই হৃদয়বিদারক হাসি দিলো। কারন এই হাসি টা মুগ্ধর হৃদয়ে গিয়ে লাগলো! মুখ ফুলিয়ে বউয়ের আদেশকৃত কাজ সম্পাদনে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো সে।
চলবে,,,,,,,