যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৪০
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার
আদ্রিশা ঘরের পাশে আসতেই মুগ্ধর গলার আওয়াজ পেলো। মনে হচ্ছিলো হয়তো কারো সাথে ফোনে কথা বলছে কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখলো মুগ্ধ একাই বক বক করছে।
—“এবার ঠিক আছে। হ্যাঁ। পারফেক্ট। হাহহা,,,,, ফেইল করার চান্সই নেই। আর না টেনশন করার কোনো কারন। বলতে হয়, ইউ আর জিনিয়াস মুগ্ধ! জিনিয়াস!”
কথাগুলো বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে আদ্রিশাকে পাশে দেখলো মুগ্ধ। থতমত খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো সে। আদ্রিশা মুগ্ধর হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“কি এটা? আর কি বলছিলেন একা একা? একদম কথা লুকোনোর চেষ্টা করবেন না। ঠিক ঠিক বলুন, এতো ভোরে উঠে কি কাজ করছিলেন?(টেবিলের উপর ভাজ করে উল্টে রাখা খাতাটার দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললো) ওটা আমার খাতা না!? এই আমার বই খাতায় কি করছেন বলুন তো?”
মুগ্ধ টেবিলে হাত ভর দিয়ে ভাব নিয়ে বললো
—“মানচিত্র আঁকছি তোমার খাতায়। তুমি তো হিজিবিজি লিখে খাতার নকশাই পাল্টে ফেলেছো! দেখে মনে হচ্ছে মুঘল আমলের কাগজ!”
আদ্রিশা তেতে উঠে বললো,
—“একদম বাজে কথা বলবেন না। আমার খাতা আমি যেমন ইচ্ছা রাখবো তাতে আপনার কি? আর মুঘল আমলে বুঝি কাগজ ছিলো? ( মুগ্ধ কাধ ঝাকিয়ে কিছু বলতে নিলে আদ্রিশা হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে) থামুন! যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দিন চটপট।”
মুগ্ধ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাতের কাগজটা আদ্রিশার দিকে এগিয়ে দিলো। আদ্রিশা ভ্রু কুঁচকে কাগজ হাতে নিলো। কাগজে চোখ বুলিয়ে দু তিন বার চোখের পলক ফেলে মুগ্ধর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। মুগ্ধ মাথা থেকে আদ্রিশার ওড়না খুলে গলায় ঝুলিয়ে বললো,
—“এই কাজ করছিলাম। আসলে, ভাবলাম রুটিন বানানো থাকলে পড়তে সুবিধা হবে। তাই বানিয়ে দিলাম নিজেই। আমি তো আর ইংরেজির স্টুডেন্ট নই তাই কোন সাবজেক্টে কতোটা সময় ব্যায় করতে হবে সেটাও জানি না। তোমার বইগুলো ঘেটে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না তারউপর তোমার নোট খাতার লিখাগুলো বোধগম্য ছিলো না। (আদ্রিশা রাগি চোখে তাকাতেই মুগ্ধ আমতা আমতা করে বললো) আই মিন, আমি বুঝতে পারছিলাম না। তাই আরকি গুগলের সাহায্য নিলাম আর আমার কিছু ক্লাসমেটদের সাথে যোগাযোগও করলাম। এইটুকুই!”
আদ্রিশা মাথায় হাত দিয়ে বললো,
—“শুধুমাত্র একটা রুটিন তৈরি করতে আপনি ভোর থেকে জেগে আছেন! গুগলেও সার্চ করেছেন? বাহ! কিন্তু ক্লসমেটদের ইনবোল্ভ করতে গেলেন কেনো?”
মুগ্ধ মাথা ঝাকিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো,
—“ওদের তো অন্য কারনে ইনবোল্ভ করেছি।”
আদ্রিশা বিস্ময় নিয়ে মুগ্ধর দিকে দেখছে। মুগ্ধ ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“তোমার তো নোটস নেই। কোথা থেকে পাবে? তুহিনের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম কিন্তু ওতো তোমার ডিপার্টম্যান্টের না। তাও বললো খুঁজে দেখবে কেউ দিলেও দিতে পারে। তার অপেক্ষায় বসে থাকলে তো হবে না সুতরাং অন্য রাস্তা চাই। তাই তাদের সাথে কথা বললাম। আর ওরাও রাজি হলো দেয়ার জন্য। এক এক জনকে এক একটা সাবজেক্টের দায় ভার দিয়েছি। দু তিন দিনের মধ্যে পেয়ে যাবে। আর তারপর মাথায় গামছা বেধে পড়তে হবে। আমায় দেখো তোমার সামান্য রুটিন তৈরি করতে হবে বলে মাথায় ওড়না বাধলাম। গামছা পাই নি তো তাই!”
আদ্রিশা হো হো করে হেসে উঠলো। মুগ্ধ এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা থেকে ওড়না খুলে আদ্রিশার হাতে ধরিয়ে দিলো। প্রশস্ত হেসে বললো,
—“তোমার জন্য ঠিকমতো ঘুম হয় নি। সো এখন বেরোও! ঘুমোবো আমি!”
আদ্রিশা হাসি আটকে ওড়না চেয়ারে রাখলো। রুটিন টেবিলে পেপার ওয়েট দিয়ে রেখে মুগ্ধর সামনা সামনি দাঁড়ালো। দুহাত পেছনে রেখে বললো,
—“আপনার কি মনে হয়, এই রুটিনের জন্য আমার পড়াশুনা ঠিকঠাক হবে?”
মুগ্ধ উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বললো,
—“অবশ্যই। না হওয়ার কোনো মানেই নেই।”
আদ্রিশা ঠোঁট উল্টে বললো,
—“এর আগেও এরকম রুটিন বানানো হয়েছে। কিন্তু দুদিনের বেশি এসব ফলো করা আমার দ্বারা হয় না। তারপর এই একটুকরো কাগজ কই যাবে না যাবে তার হদিস ও পাবেন না। খামোকা এতো কষ্ট করলেন। আমায় জিজ্ঞেস করে নিতেন। আমি হ্যাল্প করতাম বিষয়টা জানিয়ে। ইশশশ,,, কতো পরিশ্রম করলেন। আমারই আপনার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে!”
মুগ্ধ শয়তানি হাসি হেসে বললো,
—“তখন তো আমি ছিলাম না তাই উড়েছো। এখন সেটা সম্ভব নয়। আমি আছি কি না! রুটিনটা তুমি ফলো করবে তাও দুদিন নয় পরীক্ষার শেষ অব্দি। তোমার কোনো কাকুতি মিনতি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না মনে রেখো। আমার পরিশ্রম বৃথা হবে না মিসেস আদ্রিশা! আর হ্যাঁ আজকের এলার্ম আমিই অফ করেছিলাম। কাল থেকে পড়াশুনা করতে হবে রেস্ট নেয়ারও সময় পাবে না তাই আজ শুতে দিলাম। কাল থেকে ভোর পাঁচটায় উঠবে।গট ইট? নাও বেরোও!”
আদ্রিশার মাথার পেছনে হাত দিয়ে ঠেলে বের করে দিলো ঘর থেকে। ঠাস করে দরজাটাও বন্ধ করে দিলো। আদ্রিশা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে রাগে ফুসতে লাগলো। মনে মনে বললো,
—“হুহ। আপনি বলবেন আর আমি আপনার কথায় রুটিন ফলো করবো? নো! নেভার! আমি আমার মতো পড়বো। রুটিন ফুটিনের জালায় নিজের আরাম হারাম করতে রাজি নই আমি। দেখি আমায় কি করে জোর করে পড়ান আপনি!”
_____________
আদ্রিশা বিছানায় বসে ঝিমাচ্ছে। কোলের উপর বালিস রেখে বই পড়ছিলো আদ্রিশা। কখন যে হাতের উপর ভর দিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো তা তার অজানা। ঘুম গাঢ় হয়ে আসছিলো ঠিক তখনই মুগ্ধর ধমকানিতে চোখ খুলে সে। ঝাপসা লাগছে সবকিছু তার কাছে। মুগ্ধর কোনো কথাই কানে ঢুকছে না তার। ঝিমুতে ঝিমুতে আবারও চোখটা লেগে আসছিলো কিন্তু মুগ্ধর গলার আওয়াজে চোখ কচলে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। হাত দিয়ে বই ঠেলে দিলো মুগ্ধর দিকে। চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
—“আমার ঘুম পাচ্ছে।”
মুগ্ধ কড়া গলায় বললো,
—“এই চ্যাপ্টার কম্প্লিট করে শুয়ে পরুন। আটকাবো না আমি। কিন্তু এখন ঘুমানো যাবে না।”
আদ্রিশার চোখ টলমল করে উঠলো। সারাদিন অফিসে থাকলেও বার বার ফোন করে আদ্রিশার রুটিনের পড়া পড়িয়েছে মুগ্ধ। যদিও আনেকটা ফাঁকি দিয়েছে আদ্রিশা। তবে অফিস থেকে ফিরেই সন্ধ্যেতে পড়তে বসিয়ে ছিলো মুগ্ধ। রাত ৯ টায় উঠার পারমিশন দিয়েছিলো একবার। খাওয়া শেষে আবারও বই হাতে বসিয়ে দিয়েছে আদ্রিশাকে। প্রতিদিন একটা করে চ্যাপ্টার শেষ না করলে ঘুমাতে দিবে না, বলে দিয়েছে মুগ্ধ। রাত ১২ টা হতে চললো তবুও উঠতে দিচ্ছে না বেচারিকে। চোখের পানি বাধ মানলো না আর। গাল বেয়ে উপচে পড়লো। ঠোঁট উল্টে নাক ফুলিয়ে বললো,
—“পড়বো না আমি। থাকবো না আপনার সাথে। ভালো লাগে না আমার। বলছি না আর পড়তে পারছি না। বুঝেন না কেনো? ঘুম পাচ্ছে। কাল পড়বো তো বাকিটা। একটুও মানবিকতা নেই! মন বলে কিচ্ছু নেই না আপনার? একটা মেয়ে কাঁদছে, ঘুমের জন্য বেকুল হয়ে পরেছে আর আপনি! আপনি বকে চলেছেন!”
মুগ্ধ শান্ত কন্ঠে বললো,
—“আগেই তো বলেছিলাম রুটিন মাফিক পড়তে হবে। আমার কথা শুনে দিনের বেলা পড়তে বসলেই এখন এতো রাতে জেগে থাকতে হতো না। কিন্তু ওই! তোমার জেদ! এই জেদের কারনেই পড়োনি দুপুরে তাই এখন শেষ করো। তারপর ঘুম!”
আদ্রিশা চোখ মুছে বললো,
—“দুপুরে পড়তে ভালো লাগে না আমার। আর এই চ্যাপ্টারটা খুব কঠিন। মাথায়ই ঢুকছে না। শেক্সপিয়ার সম্পর্কে পড়ে কিছুই বুঝছি না। আর না পড়তে ভালো লাগছে। আমারই ভুল। কেনো যে এই সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে গেলাম!”
মুগ্ধ আদ্রিশার বইগুলো গোছাতে লাগলো। আদ্রিশার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
—“আমার ছুটি!?”
মুগ্ধ মাথা নাড়লো। বললো,
—“আজকের জন্য। কাল থেকে কোনোরকম পাকামো করে পড়ায় ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করো না। সবদিন মাফ পাবে না কিন্তু।”
আদ্রিশা বিরস মুখে মাথা নেড়ে শুয়ে পরলো। মুগ্ধ আলো নিভিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে বললো,
—“আদ্রিশা! ডু ইউ নিড এনি টিচার?”
আদ্রিশা অন্যদিকে ফিরে শুয়েছিলো। মুগ্ধর প্রশ্নে তার দিকে কাত হয়ে বললো,
—“হলে তো ভালোই হতো তবে আমি চাই না।”
মুগ্ধ কপাল কুঁচকে বললো,
—“কেনো?”
আদ্রিশা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
—“আমি সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারি না মুগ্ধ। সব শিক্ষক শিক্ষিকার পড়ানো আমি বুঝি না। আর এখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। বর্তমানে কোনো টিউটরের কাছে পড়তে গেলে কতোটা বুঝবো, উনি কতোটা বুঝাতে সক্ষম হবেন জানি না। হয়তো পড়ার চেয়ে মানিয়ে নিতেই সময় চলে যাবে অনেকটা। আনকম্ফোর্টও লাগতে পারে। তাই দরকার নেই। একা একাই পড়ি। তাছাড়া এখন আমি বাচ্চা না। ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। সো টিউটরের থেকে একজন গাইড থাকলে ভালো হয়। যে শাসন করবে, বুঝাবে, আমাকে বুঝবে, আমার সমস্যা সম্পর্কে অবগত থাকবে আর যাকে আমি মেনে চলবো। এক কথায় যার ভয়ে হলেও মন দিয়ে পড়বো। বুঝলেন?”
মুগ্ধ মাথা নাড়লো। অন্ধকারে মুগ্ধর সম্মতি বুঝলো না আদ্রিশা। কাঁথা জড়িয়ে বললো,
—“এখন ঘুমান তো আর আমাকেও ঘুমাতে দিন। সারাক্ষন খালি এক পড়া আর পড়া। আপনার বিরক্তি লাগে না? গুড নাইট!”
মুগ্ধ হাসলো। মনে মনে কিছু একটা আওড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সে।
চলবে,,,,,,,,
যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৪১
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার
রোদের হালকা আলো পর্দা ভেদ করে আদ্রিশার মুখে আড়াআড়ি ভাবে পরছে। টেবিলে বসে মাথা একপাশে কাত করে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিশা। চোখের পলকও যেনো পরছে না তার। মুগ্ধ হাতের বইখানা টেবিলে রেখে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
—“বুঝলে?”
আদ্রিশার ধ্যান ভেঙে গেলো। চমকে উঠে মাথা নাড়লো। মুগ্ধ আদ্রিশার দিকে বই এগিয়ে দিয়ে বললো,
—“ভালো করে দেখো। কিছু না বুঝলে এখুনি বলো রাতে কিন্তু পড়া ধরবো।”
আদ্রিশা মৃদু হেসে জবাব দিলো,
—“আপনি এতো ভালো পড়াতে পারেন জানতাম না। শিক্ষক হলেই বেশ হতো।”
মুগ্ধ শার্টের হাতা ফোল্ড করে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
—“পড়ালাম কোথায়, বুঝালাম শুধু। শিক্ষক হলে বেশ হতো বলছো!এই যে আমায় দু ঘন্টা সহ্য করতে পারো না শিক্ষক হলে তো সারাদিন বসিয়ে রাখতাম বইয়ের সামনে। তখন ভালো হতো?”
আদ্রিশা মুখ ভেঙিয়ে বললো,
—“ইশশশ, বললেই হলো!”
মুগ্ধ ফোনের স্ক্রিণ অন করে সময় দেখে নিয়ে বললো,
—“ইউর টাইম ইজ আপ। সো এখন উঠে পরতে পারো। মাগরিবের নামাজের পর সোজা টেবিলে বসা দেখতে চাই আমি। বলতে যেনো না হয়!”
আদ্রিশা চট করে বই উল্টিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। মুগ্ধ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। ঘাড়ের পেছনে হাত রেখে মাথা ঝাকালো। চুল গুলো টেনে ধরে বললো,
—“সত্যিই খুব কঠিন! বুঝাতে গিয়ে আমারই মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে পড়তে না জানি কতো কষ্ট হবে বেচারির!”
—“সব বুঝেও তো কষ্ট দেন আমায়।” আদ্রিশার কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে দেখলো মুগ্ধ। আদ্রিশার একহাতে পানি ভর্তি গ্লাস আর অন্য হাতের মুঠোতে কিছু একটা। এগিয়ে এসে মুঠো করা হাতটা মুগ্ধর দিকে এগিয়ে দিলো আদ্রিশা। মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকালে আদ্রিশা গ্লাস টেবিলে রেখে মুগ্ধর হাত টেনে ধরলো। অন্য হাত থেকে একটা ট্যাবলেট মুগ্ধর হাতের তালুতে রাখলো। মুগ্ধকে স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু আওয়াজে বললো,
—“মাথা ব্যাথার ঔষধ।”
মুগ্ধ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে ট্যাবলেটটা মুখে দিলো। পানি খেয়ে গ্লাস টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াতেই ঘর থেকে প্রস্থান করলো আদ্রিশা। অথচ মুগ্ধর কিছু বলার ছিলো তাকে। বেশি কিছু না শুধু জিজ্ঞেস করতো সে কিভাবে জানলো মুগ্ধর মাথা ব্যাথার কথা। মুগ্ধতো সবেই বললো কথাটা যখন আদ্রিশা দরজায় এসে দাঁড়ায়! তবে কি আদ্রিশা মুগ্ধকে দেখলেই সব বুঝে যায়? ঐদিন যেমন মুগ্ধর অস্বস্তি বুঝে গেছিলো। যেমন করে সেদিন শাহিনের সামনে মুগ্ধর হাত জড়িয়ে ছিলো। ঠিক যেমন কিছুদিন আগেই তিথির সাথে মুগ্ধর ফোনালাপের পর নিজ থেকেই ডিভোর্স পেপার বানানোর তাগিদ দিয়েছিলো। অথচ মুগ্ধকে একবারো প্রশ্ন করেনি তিথির সাথে কি কথা হয়েছে। শুধু বলেছিলো, ‘মুগ্ধ ডিভোর্স পেপার ঠিক করে নিন না। প্রসেসেতো টাইম লাগবে! তিথি আপুও দেশে ফিরবেন খুব তাড়াতাড়ি!’ বিষয়গুলো খুব অদ্ভুত ঠেকে মুগ্ধর কাছে। তবু বলা হয় না আদ্রিশাকে। আসলে, বলার সুযোগ দেয় না আদ্রিশা! আজকাল আর আগের মতো ঝগড়া হয় না দুজনের মাঝে। আদ্রিশা মানিয়ে নিয়েছে সব কিছুর সাথে। মুগ্ধর সব কথা না মানলেও অগ্রাহ্য করে না। যেখানে দুজনের মতের অমিল সেখানে নিজ থেকেই হার শিকার করে কথা ঘুরিয়ে নেয় নতুবা অন্য কাজে লেগে পরে সে। মুগ্ধও তাই কথা বারায় না আর।
_____________
রুহি আর স্নিগ্ধর প্রেম মাখো মাখো হয়েছে এ কদিনে। পড়াশুনার পাশাপাশি ভালোবাসাও জোরদার চলছে তাদের। তুহিন বেচার নীলার পেছন ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত। কতো রকম নিজের ভালোবাসা বুঝানোর চেষ্টা করেছে তাকে কিন্তু নীলা সেসবের কিছুই বুঝে না। আদ্রিশা আর রুহির পরামর্শ অনুযায়ি তুহিনের নীলাকে প্রপোজ করা উচিত। কিন্তু তুহিনের এক কথা, ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করবে না সে। নীলাকেই বুঝে নিতে হবে সব। মনের কথা, চোখের ভাষা সব কিছুই নিজ দায়িত্বে বুঝতে হবে। কেউ কাওকে ভালোবাসি বলবে না তবু ভালোবাসা থাকবে। এসব নিয়ে একদফা হাসাহাসি ও করেছে আদ্রিশা রুহি। রুহি তো বলেই দিয়েছে, “তোর জীবনে প্রেম নাই দোস্ত! মনের কথা মনেই রাখ তুই । নীলার বিয়ের দিন মদ খেয়ে মাতলামি করিস আর তারপর নীলার সাথে কোনো একদিন দেখা হলে বলবি, তুই আমারে বুঝলি না! তখন নীলাও তার বাচ্চারে ডাইকা বলবো, ঐ দেখো তোমার মামা!” রুহির এমন কথায় আঘাত পেলেও বুক কেঁপে উঠে তুহিনের। সত্যিই যদি এমন কিছু হয় তার সাথে! অনেক বারই বলার চেষ্টা করেছে সে। তবুও সফল হতে পারে নি। প্রতিবারই ‘আই ‘তে আটকে যায় সে। ‘লাভ ইউ’ বলা হয় না আর। শেষ ভরসা হিসেবে মুগ্ধর কাছে পরামর্শ চায়। মুগ্ধ তাকে আশ্বস্ত করে বলে নীলার সাথে দেখা করে ফিল্মি স্টাইলে প্রোপোজ করতে। তাই আর দেরি না করে মুগ্ধর সাথে বিচার বিবেচনা করে নীলার সাথে দেখা করতে যায় সে। পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতে ভার্সিটি আসা বন্ধ করেছে নীলা। উপায় না পেয়ে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে হবে। লাল গোলাপ, চকোলেট বক্স আর একটা গিফ্ট পেপারে আবৃত করা প্যাকেট নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে আছে সে। পড়নে কালো রঙের শার্ট, কোট, প্যান্ট। হাতে কালো রঙের ঘড়ি। শুও কালো রঙের। কেননা, নীলার পছন্দের রঙ কালো! দুহাত মুখে চেপে ঘামছে সে। হার্ট লাফাচ্ছে রিতিমতো! ঠোঁট কামরে ইমোশন আটকে সামনে তাকাতেই অপ্সরীকে দেখলো সে। তার হৃদয়ের অপ্সরী! দেখা মাত্রই শরীর শিউরে উঠছে। শিহরিত হচ্ছে হৃদয়! কালো রঙের শাড়ি পরিহিতা নীলার থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল। হাত ভর্তি কাচের চুরি, কানে ঝুমকো, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি তার। সচরাচর মেকাপ করে না বলে এবারও মেকাপ নেই তার মুখে। নীলা যত এগুচ্ছে তুহিন ততোই ঘাবরে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে নীলা তুহিনের একদম সামনে চলে এলো। সামনের চেয়ারে বসতেই তুহিন দাঁড়িয়ে গেলো। নীলা গোল গোল চোখ করে তাকাতেই বসে পরলো সে। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো তুহিন। নীলা হাত নাড়িয়ে বললো,
—“কি রে? কেনো ডাকলি বল!”
তুহিন জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবিষ্কার করলো তার থেকে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে চেয়ারে বসে আছে মুগ্ধ। মাথায় ক্যাপ পরেছে বলে চেনা যাচ্ছে না দূর থেকে। মুগ্ধ ইশারায় তুহিনকে প্রপোজ করতে বললো। তুহিন থেমে থেমে বললো,
—“একটা কথা বলতে চাই!”
নীলা শাড়ির আচল পিঠের দিকে টেনে বললো,
—“হ্যাঁ তো বল!”
তুহিন হালকা কাশলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,
—“কিছু খাবি?”
নীলা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“এই কথা বলার ছিলো?”
তুহিন মাথা নাড়লো ঝটপট। ওদিক থেকে মুগ্ধ মাথা চাপরাচ্ছে। তুহিন হাত দিয়ে আবারও কপালের ঘাম মুছে আমতা আমতা করে বললো,
—“আ,,,,,আই,,, আ,,আই,,”
নীলা ধমক দিয়ে বললো,
—“আই আই না করে যা বলার বল!”
তখনি নীলার ফোন বেজে উঠলো। ফোনটা তুলে নীলা থমথমে গলায় বললো,
—“আসছি!”
তুহিন অস্থির গলায় বললো,
—“আসছি মানে!? আমার কিছু বলার ছিলো তো!”
নীলা নিশ্বাস টেনে বললো,
—“বলবি তো তুই না। কখন থেকে বসে আছি কিছু বলেছিস? যেতে হবে আমায়! মনির বাবু এসেছেন।”
তুহিনের চোখ সরু হয়ে গেলো। বললো,
—“মনির বাবু কে?”
নীলা লাজুক হেসে বললো,
—“আমায় দেখতে এসেছেন। ওনার সাথে বিয়ের কথা চলছে।”
তুহিন রাগ নিয়ে বললো,
—“আর তুই ড্যাঙ ড্যাঙ করে দেখা দিতে চলেছিস?”
নীলা বোকা বোকা ফেইস নিয়ে বললো,
—“এমন করে বলছিস কেনো? বাবার পছন্দ ওনাকে।”
তুহিন চোখ কটমট করে বললো,
—“তো তোর বাবাকে বিয়ে করতে বল!”
নীলা আঙুল তুলে বললো,
—“খবরদার বাজে কথা বলবি না। আসছি আমি। বাই।”
নীলা উঠে চলে যেতে নিলে তুহিন নীলার হাত টেনে ধরে। গম্ভীর গলায় বলে,
—” যাবি না!”
নীলা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
—“তুহিন! ছাড়। দেরি হয়ে গেলে ওরা চলে যাবে।”
তুহিন অপর হাত মুঠো করে নিজের রাগ সংযত করে বললো,
—“গেলে যাবে! তোর এতো কি? পরপুরুষের সামনে সেজেগুজে বসে থাকতে ভালো লাগে? এক পাও নড়বি না এখান থেকে। চুপচাপ বসে থাক। আমার কথা শেষ হলে তারপর দেখা যাবে।”
নীলা ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে বললো,
—“তোর কথা কেনো শুনতে হবে আমায়? আমার বাবা আমার জন্য ছেলে ঠিক করেছেন। ঐ ছেলেটা ভালো। আমি তো তাকেই বিয়ে করবো।”
তুহিনের রাগ মাথায় উঠে গেছে ততোক্ষনে। চিৎকার করে বললো,
—“শাট আপ! ঐ ছেলে ভালো? ভালো ঐ ছেলে? আমি কেমন? বল আমি কেমন? চোখে পড়ে না তোর? সারাক্ষন তোর পেছনে পরে থাকি সেটা দেখিস না? তোর জন্য করা পাগলামি সবাই দেখে খালি তুই দেখিস না! আদু, রুহি শালার তোর ঐ বুইড়া স্যার ও বুঝে আমি তোরে নিয়া কি ফিল করি। আর তুই! তুই যারে পেত্নি বলে ডাকিস না ঐ মুক্তি! ঐ মেয়েটাও জানে আমি তোরে ভালোবাসি! আর তুই বুঝিস না? না কি বুইঝাও না বুঝার নাটক করিস? চোখে পরে না তোর? (কপালে হাত দিয়ে নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করে এগিয়ে গেলো নীলার সামনে। দু বাহু ধরে বলতে লাগলো) কেনো বুঝিস না ইডিওট, আই লাভ ইউ? আর কিভাবে বললে বুঝবি? এখন তোর লাইগা হাত পা কাটতে হইবো না কি তোর বাপের সাথে দেখা করা লাগবো? কোনটা বল কোনটা? আমি সব করবো তবুও আর কারো সামনে যাবি না তুই। বুঝছোস? তুই আমার!! ইউ আর যাস্ট মাইন! গট ইট?”
নীলার চোখে পানি টলমল করছে। তুহিন সাথে সাথে ছেড়ে দিলো তাকে। সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে দেখছে তাদের। নীলা মুখ ভার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—“এতো ব্যাথা দিলে কেনো?”
তুহিন মুখ ভেঙিয়ে বললো,
—“তো কি করবো? অন্য ছেলের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করতে যাচ্ছে আবার বলে ব্যাথা কেনো দিলে! আমি তো ফুল, চকোলেট, শাড়ি আনছিলাম। আর তুই কিসব বলে মেজাজ খারাপ করে দিলি?”
নীলা চোখ মুছে বললো,
—“আমার কি দোষ? আদু আর রুহিই তো বললো এমন করতে। নাহলে না কি তুমি জীবনেও আই লাভ ইউ বলবে না। ‘আই’-তে এসেই ব্রেইক লাগিয়ে দেবে!”
তুহিন ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“মানে? আর তুই আমারে তুমি কেনো বলছিস?”
নীলা লাজুক হাসলো। মাথা নিচু করে বললো,
—“উড বি কে কেউ তুই করে বলে না কি?”
তুহিনের চোখ উজ্জল হয়ে উঠলো। চোখ পিট পিট করে মৃদু হেসে বললো,
—“তুই থুরি তুমি আমায়,,,,!”
নীলা মাথা নাড়লো। তুহিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চোখ বন্ধ করতেই দু ফোটা জল গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলাকে জড়িয়ে ধরলো সে। মুগ্ধ ক্যাপ খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু থেমে গেলো আদ্রিশার গলার আওয়াজ পেয়ে। পেছন তাকিয়ে দেখলো আদ্রিশা, রুহি আর স্নিগ্ধ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
—“দোস্ত! পাবলিক প্লেসে প্রেয়সীর সাথে প্রেম নিবেদন করছো ভালো কথা কিন্তু জাপটা জাপটি করো না। কেমন জানি দেখায়!” (আদ্রিশা)
তুহিন ছেড়ে দিলো নীলাকে। নীলাও মাথা নিচু করে সরে দাঁড়ালো। মুগ্ধ পেছন থেকে বললো, “তোমরা সবাই এখানে?”
আদ্রিশা ভ্রু উচিয়ে বললো, “আপনিও এখানে?”
চলবে,,,,,,,,,,