যদি আমার হতে পর্ব-৪৪+৪৫

0
740

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৪৪
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

স্নিগ্ধ অবিশ্বাসী গলায় বললো,

“ভাবি! তুমি এ কথা বলছো?”

আদ্রিশা মাথা নাড়লো। বললো,

“এটাই তো সত্যি। আসলে, মুগ্ধ আমায় কখনো বিয়েই করতে চান নি। শুধু একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য‌ই বিয়ে করছেন আমায়। কিন্তু ভুলটাকে সারাজীবন বয়ে নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব না। তাছাড়াও ভুল শুধরানোর সময় হয়েছে এখন।”

রুহি বিস্মিত কন্ঠে বললো,

“কি ভুল সিদ্ধান্ত আদু?”

আদ্রিশা মৃদু হেসে বললো মুগ্ধ আর তার বিয়ে করার কারন। কোন পরিস্থিতিতে মুগ্ধ আদ্রিশাকে বিয়ে করেছে, সব‌ই বললো। এমনকি তিথির সাথে মুগ্ধর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ব্যাপারে যা যা জানে সেটাও বললো সে। আদ্রিশার কথাগুলো শুনে থম মেরে গেলো স্নিগ্ধ। রুহির চোখ মুখে রাগ স্পষ্ট। তুহিন রাগে কটমট করে বললো,

“বিশ্বাসঘাতক! মানুষের চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই ভেতরে ভেতরে কতোটা পচে গেছে সে। ভেবেছিলাম ঐ লোকটা তোকে ভালো রাখবে। রবিনের দেয়া ধোকা ভুলিয়ে নতুন জীবনের শুরু হবে। কিন্তু উনি তো তোকে আরো কষ্টের সম্মুখীন করে তুলেছেন। না এটা মেনে নেয়া যায় না। যদি অন্যকাউকে ভালোবেসেই থাকেন তবে তোকে বিয়ে করলেন কেনো? বিয়ে তো ভেঙেই গেছিলো কে বলেছিলো তাকে মাতব্বরি করে তোর ভার নেয়ার। তোর বাবা মা বলেন নি! তাহলে? সব কিছু চাল। জেনে বুঝে ইচ্ছে করেই মুগ্ধ,,,,,,”

আদ্রিশা তুহিনের কথার মাঝেই বলে উঠে,

“না! উনি কিছুই ইচ্ছে করে করেন নি। আর না চাল চেলেছেন। পরিস্থিতিই এমন ছিলো তখন। আমাকে লোকের বাজে নজর থেকে বাঁচাতেই আমার হয়ে কথা বলেছিলেন। তোরাই বল, ঐদিন একবার‌ও কি আমায় বিয়ে করার কথা তিনি মুখ দিয়ে বের করেছেন? করেন নি তো? উনি শুধু আমাকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। মা ভেবেছিলেন হয়তো মুগ্ধ আমায় ভালোবাসেন তাই এতোকিছুর পর‌ও আমার হয়ে কথা বলছিলেন। এখানে মুগ্ধর কি করণীয় ছিলো?”

“ছিলো না বলছিস? প্রেমিকাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তোকে বিয়ে করার পেছনের কারন আমি বুঝলাম না! না দেখ, ভাইয়া যদি তিথিকেই বিয়ের প্ল্যান করে থাকেন তো সেটা তার পরিবারকে জানাতে পারতেন। না কি ইমেজ নষ্ট হ‌ওয়ার ভয়ে চুপ করে ছিলেন? এদিক দিয়ে দেখতে গেলে উনি শুধু তোকেই নয় তিথিকেও ধোকায় রেখেছিলেন!” আদ্রিশার কথা শেষ হতেই তাচ্ছিল্য হেসে বললো রুহি।

আদ্রিশা মেকি হেসে বললো,

“সবটা জানলে এমন বলতিস না তোরা।”

তুহিন ভারি গলায় বললো,

“ছাড় তো! যত্তসব বাজে এক্সকিউজ!”

নীলা তুহিনের কথায় পাত্তা না দিয়ে আদ্রিশাকে বললো,

“আদু এতোটা যখন বলেছিস তখন বাকিটাও বল।”

আদ্রিশা স্নিগ্ধর দিকে তাকালো। মাথা নিচু করে এক হাতে অন্য হাত ঘষছে সে। আদ্রিশা চোখ বন্ধ করে শ্বাস টানলো‌। চোখের কোণায় জমা জল বুড়ো আঙুলে মুছে নিয়ে বললো,

“ফুপির সাথে যার বিয়ে হ‌ওয়ার কথা ছিলো, যিনি ফুপিকে ধোকা দিয়ে বিয়ের আসরে অন্য মেয়ের হাত ধরে প্রবেশ করেন, যার সাথে গত ২৬ বছর ধরে পারিবারিক শত্রুতা সেই আসরাফ খানের একমাত্র মেয়েই তিথি!”

স্নিগ্ধ হকচকিয়ে তাকালো আদ্রিশার দিকে। উপস্থিত সবাইও অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে আদ্রিশার দিকে। মালিহা ইয়াসমিন ও মুগ্ধর থেকে শুনা প্রতিটা কথাই বলে আদ্রিশা। কথাগুলো শুনে স্নিগ্ধ ভেঙে পরে। মুখে হাত চেপে বসে আছে সে। ভেতরটা তোলপার হয়ে যাচ্ছে তার। রুহি পানি ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলো স্নিগ্ধর দিকে। স্নিগ্ধ গ্লাসটা সরিয়ে দিলো। তুহিন উদ্বিগ্ন হয়ে কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিশা বলতে লাগলো,

“যে মানুষটার নাম ওবাড়িতে কেউ উচ্চারণ‌ও করে না তার মেয়েকে কি কেউ মেনে নেবে? মুগ্ধ‌ও জানেন সেটা। তাই বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস কর তোরা এক মুহুর্তের জন্য‌ও মনে হতে দেন নি আমি ওনার কাছে বোঝাস্বরুপ। বরং প্রতিনিয়ত এটাই বুঝিয়েছেন যে আমি ওনার স্ত্রী। ও বাড়িটা আমার! হয়তো স্ত্রীর অধিকার আমি পাই নি তবে স্বামীর কোনো দায়িত্ব তিনি অবহেলা করেন নি। আমার কখন কি প্রয়োজন সব কিছুই দিয়েছেন তিনি। জানিস, আমি যেমন স্বামী চেয়েছিলাম তেমনটাই পেয়েছি শুধু আমার করে পাই নি। কয়েকটা দিনের জন্যেই আমার ছিলেন। ব্যাস!” একশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো আদ্রিশা। কিছুক্ষন থেমে আবার‌ও বললো,

“আমরা ঠিক করেছিলাম সবার সামনে স্বামী স্ত্রীর নাটক করবো। কিন্তু উনি সমাজের চোখে আমার সাথে যেমন ছিলেন চার দেয়ালের মধ্যেও কিন্তু তিনি তেমন‌ই ছিলেন। আমি ভেবে পেতাম না উনি আদৌ নাটক করছেন কি না! শুধু কি তাই রবিনের হাত থেকেও বাঁচিয়েছিলেন আমায়!”

রুহি বিস্মিত হয়ে বললো,

“মানে?”

আদ্রিশা ছোট্ট শ্বাস টেনে বললো,

“রবিন জেল থেকে ছাড়া পেয়েগেছিলো আমার বিয়ের কিছুদিন পর‌ই। আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে রোজ আমায় ফলো করতো। আমি না জানলেও মুগ্ধর চক্ষু গোচর হয় সব। কোম্পানির লস হবে জেনেও ডিল কেন্সেল করে শ্রীমঙ্গল ছুটলেন আমায় নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিলো রবিনের থেকে বাঁচানো। ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করে রবিনের কার্যকলাপের উপর নজর রাখতে বলেছিলেন। উনার ধারনা ছিলো রবিন কোনো ভুল করবে। আর হলোও তাই। ঝোকের বসে এসে রবিন আমার শ্বশুড় বাড়ি আমায় কিডন্যাপ করতে গেছিলো। আমরা এতো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছিলাম যে রবিন ভাবতেও পারে নি আমি ওখানে নেই। ভাইয়া হাতেনাতে ধরেছিলো তাকে।নতুন কেস দায়ের করে আবার‌ও জেলে ঢুকানো হয় তাকে। যদিও এর একটাও কথা মুগ্ধ আমায় বলেন নি। ভাবির থেকে শুনেছিলাম। তার পর জানিস, তিথি আপুও কতো জোর করছিলো ওনাকে যেনো আমায় হানিমুনেই ডিভোর্স দিয়ে দেন। কিন্তু এবার‌ও নাছোড়বান্দা। আমার ভবিষ্যৎ সিকিউর না করে আমায় ছাড়ছেন না তিনি! আর পরীক্ষার কথা তো ছেড়েই দিলাম। সবকিছুই তোদের চোখের সামনে ঘটেছে। এরপর‌ও বলবি উনি সুযোগ সন্ধানি? আমার জন্য এতো কিছু করার পর‌ও বিন্দুমাত্র রাগ নেই। তিথি আপুর সাথে কথা কাটাকাটি আমি প্রায়স‌ই দেখেছি! তবুও কোনো অভিযোগ করেন নি। যাকে ভালোবেসেছেন তাকে পেতে চাওয়া কি ভুল? না কি ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করে সে মেয়েকে নতুন জীবন দান করা ভুল? আমার কাছে কিন্তু মুগ্ধ ভুল নন! বরং আমার মতো বাড়ি থেকে পলাতক এক মেয়েকে সম্মান দিয়েছেন তিনি। ওনার দোষ ধরতে গেলে আমার দোষ যে অধিক প্রমাণিত হয়!”

নীলা অঝোরে কাঁদছে। এমনিতেই সে ইমোশনাল। আদ্রিশার কথা শুনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি আর। তুহিন শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখছে আদ্রিশাকে। রুহি স্নিগ্ধর এক হাত চেপে ধরে আছে। আদ্রি‌শা চোখ মুছে বললো,

“স্নিগ্ধ! তোমার ভাইকে ভুল বুঝো না। ওনার কোনো দোষ নেই।”

স্নিগ্ধ চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,

“তোমার‌ও তো কোনো দোষ নেই ভাবি। তাহলে তুমি কেনো শাস্তি পাবে? যাই বলো না কেনো, তোমার সাথে এ কাজ করা ভাইয়ের উচিত হয় নি!”

রুহি তাতে তাল মিলিয়ে বললো,

“স্বামীর দোষ আড়াল নাহয় করলি কিন্তু নিজের কষ্ট কি করে আড়াল করবি? চোখের পানিও লুকিয়ে নিলি! সব‌ই মানলাম, কিন্তু তুই কি সব মানতে পারছিস? মুগ্ধ ভাইয়ার নাহয় কিছুই করার ছিলো না কিন্তু তুই কেনো সব বুঝতে গেলি? অবুঝ হতে পারিস নি? অবাধ্য হতে পারিস নি? বলতে পারলি না, বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন আপনাকে অন্য কারো হতে আমি দেবো না?”

আদ্রিলা হালকা হাসলো। মাথা নেড়ে বললো,

“কি করে বলতাম? প্রায় ছয় মাস একসাথে থেকেও সেই মানুষের মনে একটু খানি জায়গা পাই নি আমি। অবাধ্য হলে হয়তো এতটা সময় কাটানো‌ও সম্ভব হতো না। সত্যি বলতে কি, আমি কখনো চাই নি ওনাকে নিজের করে পেতে। ওনার ভালোবাসা সফল হ‌ওয়ার জন্য‌ই দোয়া করেছি। আর যতদূর সম্ভব চেষ্টাও করবো ওদের এক করতে!”

নীলা তেতে উঠে বললো,

“বাহ! খুব ভালো! ওদের এক করতে জমিন আসমান এক করে দিবি তাইতো? এই তোর কষ্ট হয় না? অনুভব করতে পারছিস কিছু? তোর স্বামী অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে আর তুই!”

আদ্রিশা পানিতে চুমুক দিয়ে বললো,

“ভুল বললি নীলা। আমার স্বামী অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে না, অন্য এক মেয়ের হবু স্বামী আমায় বিয়ে করেছিলো বাধ্য হয়ে!”

তুহিন গম্ভীর মুখে বললো,

“অস্বীকার করতে পারবি তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস না? অস্বীকার করতে পারবি তিথির সাথে ওনাকে দেখলে তোর বুক কাঁপে না?”

আদ্রিশা জবাব দিলো না। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধর উদ্দেশ্যে বললো,

“তোমার ভাইয়ের সাথে এ বিষয়ে কোনো কথা বলো না। আগে পরিবারের সামনে সব কিছু আসুক তারপর যা বলার বলো। আর তোরাও আগ বাড়িয়ে কাওকে কিছু বলতে যাস না। আসছি আমি!”

রুহি আদ্রিশাকে ডেকে বললো,

“কি করবি ভাবছিস? ডিভোর্স দিবি?”

আদ্রিশা পেছন না ফিরেই বললো,

“ডিভোর্স কেইস কোর্টে উঠে গেছে। কয়েকদিন পর‌ই হিয়ারিং। আশা করছি ঐ দিন‌ই মিথ্যে সম্পর্কের শেষ হবে।”

আদ্রিশা বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো। রেখে গেলো আট জোড়া চোখে বিস্ময় আর জল!

______________

বাড়ি ঢুকতেই মালিহা এগিয়ে এলেন। হাতে কিছু শাড়ি নিয়ে জাপটে ধরলেন আদ্রিশাকে। শাড়িগুলো দেখিয়ে বললেন,

“দেখতো, কোনটা পছন্দ হয় তোর?”

আদ্রিশা কপাল কুঁচকে বললো,

“কেনো মা? কোথায় যাবে তুমি?”

মালিহা মুখ কালো করে বললেন,

“আমি আর কোথায় যাবো! আলমারিতে পরে পরে নষ্ট হচ্ছে ভাবলাম তোকে দেই। পরবি না মা?”

আদ্রিশা চোখ সরিয়ে নিলো শাশুড়ির থেকে। মনে মনে বললো, ‘শাড়িগুলো তোমার আসল ব‌উমাকেই দিও! আমি তো আর কিছুদিন মাত্র!’ কিন্তু মুখে প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে বললো,

“কেনো পড়বোনা বলোতো! তুমার যে শাড়ি ইচ্ছে সেটাই দাও আমায়। এতো এতো শাড়ির ভিড়ে একটা পছন্দ করা খুব ডিফিকাল্ট!”

মালিহা হাতের সবগুলো শাড়িই আদ্রিশার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

“বেশ তো, সব তোর।”

আদ্রিশা কিছু বলতে নিলে তিনি থামিয়ে দিয়ে বলেন,

“উহু! কোনো কথা শুনছি না আমি। আমার‌ও সবগুলো পছন্দ তাই সব‌ই তোর। আলমারিতে তুলে রাখ নিয়ে তবে আমার মতো বছরের পর বছর সাজিয়ে না রেখে রোজ একটা করে পড়বি। মনে থাকবে?”

আদ্রিশা হেসে সায় দিলো। ঘরে চলে যেতে নিলে মালিহা হাত দিয়ে আটকে দেন আদ্রিশাকে। আদ্রিশার চোখ মুখ ভালো করে দেখে চিন্তিত স্বরে বললেন,

“কি হয়েছে তোর? মুখটা এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেনো? লান্চ করে এসেছিস তো?”

আদ্রিশা মাথা নাড়লো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,

“হ্যাঁ। খেতেই তো গিয়েছিলাম তো না খেয়ে কি করে আসি! আসলে কি বলতো,বাইরে খুব গরম। ক্লান্ত হয়ে গেছি। রেস্ট নিতে হবে একটু।ঘরে যাচ্ছি। তুমি খেয়েছো তো?”

মালিহা মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। আদ্রিশা তার ঘরের দিকে গেলো। চোখটা জ্বলছে খুব। পেটেও হালকা ব্যাথা করছে! না খেয়েই চলে এসেছে সে। এতো দিনের জমানো কথাগুলো মন উজার করে বলার পর একটু শান্তি দরকার তার। খাবার যে গলা দিয়ে নামবে না‌। তাই শাশুরিকে মিথ্যে বলতে হলো। নাহলে রাগারাগি করবেন তিনি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে তবু কেনো কিছু খায় নি এসব নিয়ে চলবে তদারকি! এই মানুষকে কি করে কষ্ট দেবে সে? কি করে বলবে, বিয়েটা মিথ্যে? কি করেই বা নিজের জায়গায় তিথিকে বসাবে?

চলবে,,,,,,,

যদি আমার হতে🌹
পর্ব – ৪৫
লেখিকা : সৈয়দা প্রীতি নাহার

উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে মুগ্ধদের বাড়ি। ফুল বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে সব। এক দিনের মধ্যেই ডেকোরেশন করিয়েছে আদ্রিশা। অতি নিকট আত্মীয়দের‌ও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মনোয়ারা বেগম। মেয়ে স্নেহার পরীক্ষা শেষ হ‌ওয়ায় দেশে ফিরেছিলেন তিনি। ছেলের কথা রেখে এখন থেকে এদেশে থাকবেন বলেই জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে বাপের বাড়ি এলেও কি কারনে অনুষ্ঠান সেটাই তিনি জানেন না। ছেলেকে প্রশ্ন করলে সেও জানায় তার সব অজানা। শুধু কি তাই উপস্থিত কেউই বলতে পারছে না কিসের জন্য তারা আমন্ত্রিত। মালিহা ইয়াসমিনকে চেপে ধরেছেন সবাই। নিজের বাড়ির উৎসব অবশ্য‌ই তার অজানা নয়। কিন্তু না। তিনিও এসবের কিছুই জানেন না। দুদিন আগেই আদ্রিশা মালিহা আর শ‌ওকত শাহের কাছে বাড়িতে অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়েছে। অথচ কিসের উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠান সেটা এখনো সাসপেন্স। যেহেতু সে আজ বলবে বলেছে তাই আর তাকে জোর করে নি কেউ। সকাল থেকে দৌড়াদৌড়ি করছে আদ্রিশা। এটা নেই, ওটা নেই, ওখানে ফুল ছুটে যাচ্ছে, এখানের বেলুন ফুটে গেছে হেন তেন কতোকিছু! বাড়ির সবাইকে তৈরি হ‌ওয়ার তাগিদ দিচ্ছে‌। কোনো এক স্পেশাল অতিথি আসছেন! যার জন্য এসব প্রস্তুতি। এর মাঝেই আদ্রিশার বাপের বাড়ির লোকজন চলে এসেছে। সবাই না শুধু বাবা, ভাই, আর চাচা, খালার পরিবার। দরজায় তাদের আসতে দেখেই এগিয়ে গেলো আদ্রিশা। ভেতরে এনে আপ্যায়নে ব্যাস্ত হয়ে পরলো সে। আদ্রকে শরবত দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ভাইয়া! মা, ভাবি, আরু ওরা কোথায়?”

আদ্র শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে বললো, “তোর ভাবির এখন বেশি যাতায়াত করা উচিত নয়। আর এখানে এতো মানুষজন, ভীড়ভাট্টায় অসুস্থ হয়ে পরবে। তাই মা থেকে গেছে। একা তো আর রেখে আসা যায় না। আরুও তার মাকে ছাড়ছে না।”

আদ্রিশা মৃদু হেসে মাথা নেড়ে রান্নাঘরে গেলো। হামিদুর আহমেদ শ‌ওকত শাহের সাথে কথা বলছিলেন। হঠাৎ মেয়ের শশুড় বাড়ি অনুষ্ঠানের কারন জানতে চাইলে শ‌ওকত শাহ বলেন,

“কি বলবো বলুন তো! আদ্রিশা খালি এক কথাই বলছে, স্পেশাল গেস্ট আসছে। পরিবারের সবার থাকা চাই। আবার‌ বলছে খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা তাদের জীবনের সাথে জড়িত! ‌এখন কি করে না করি! বাধ্য হয়েই রাজি হলাম। এতো তাড়াতাড়ি সব হলো যে মুগ্ধর ফুফু আর খালা আসতে পেরেছেন শুধু। আপনাদের‌ দিক থেকেও দেখছি আদ্রর কাজিন রা এসেছে। ”

হামিদুর আহমেদ মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ! আদুর কথা শুনে কিছুই বুঝছিলাম না। কিন্তু ওর জুড়াজুড়িতে ওর ভাই বোনদের নিয়েই এলাম। অবশ্য আমার ছোট ভাইয়ের ব‌উ এসেছে।”

মুগ্ধ সবার সাথে যোগ দিলো এসে। সামান্তা এগিয়ে এসে বললো, “কি ব্যাপার দুলাভাই? আজ কি কোনো খুশির সংবাদ পেতে চলেছি?”

মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো, “খুশির সংবাদ! তা আমি কি করে জানবো? তোমার আপু তো আমায় কিছুই জানায় নি। সাসপেন্স রেখেছে সব।”

সামান্তা মুখ হা করে বললো, “এ বাবা! আপনিও জানেন না? আমার কি মনে হয় জানেন, আপু বোধ হয় বোমা ফাটাবে! কাউকে কিছু না জানিয়ে ডেকেছে তো এবার সাসপেন্স হিসেবে দুম করে বোমা ফাটিয়ে দেবে!”

মুগ্ধ নিঃশব্দে হেসে বললো, “বোমা কেনো ফাটাতে যাবে? আর বোমা ফাটালে তো সবাইই শেষ!”

সামান্তা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললো, “আরে না না, অমন বোমার কথা বলছি না। আমি বলছি, এমন কোনো কথা বা সিক্রেট বলবে যা বোমার সমান। দুম করে ফুটে আমাদের ঝটকা দিবে!”

মুগ্ধ কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো। গত দুদিন ধরে আদ্রিশা বেশ স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে। কিছুতেই যেনো সে রিয়েক্ট করছিলো না। তবে কি সত্যি এবার আদ্রিশা সবাইকে সব কিছু বলতে চলেছে। কথাগুলো ভেবে দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো মুগ্ধ‌। পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যাক্তি। পাশে জামদানি শাড়িতে আচ্ছাদিত এক মহিলা। তিনি খুব ঘাবড়ে আছেন। চোখ মুখ ভীষন ফ্যাকাসে লাগছে তার। লোকটাকে চিনতে মুগ্ধর কয়েক সেকেন্ড লাগলো। তিনিই আসরাফ খান। তিথির বাবা। কিন্তু পারিবারিক অনুষ্ঠানে এনার আসার কোনো কারন খুঁজে পেলো না মুগ্ধ। শ‌ওকত শাহের দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি গল্পে মত্ত। মা‌ও আশেপাশে নেই। নিজেকে সামলে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো আদ্রিশা।

“আরেহ! আমাদের স্পেশাল গেস্ট কিন্তু এসেগেছেন!”

আদ্রিশার কথায় মুগ্ধ চোখ গোল গোল করে তাকালো। শ‌ওকত শাহ সহ অতিথিরাও তাকালেন দরজার দিকে। মুহুর্তেই চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো শ‌ওকত শাহের। মালিহা‌ও রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন‌। মনোয়ারা বেগমের চোখে ভেসে উঠলো অতীত! চোখ থেকে জল গড়িয়ে বসে পরলেন সোফায়। শ‌ওকত শাহ সোজা গিয়ে আসরাফ খানের কলার ধরে বললেন,

“সাহস কি করে হলো তোর? এ বাড়িতে পা দেয়ার সাহস কোথায় পেলি? বেড়িয়ে যা এক্ষুনি! তোর মতো মানুষের কোনো যায়গা নেই আমার বাড়িতে। বেরো বলছি!”

একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই সরে গেলেন তিনি। আসরাফ খানের স্ত্রী শ‌ওকত শাহের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। শ‌ওকত শাহ সরতেই কান্না ভেজা চোখে স্বামীকে আগলে দাঁড়ালেন তিনি। আদ্রিশা ছুটে এসে শ্বশুড়কে সরিয়ে বললো,

“বাবা! কি করছেন কি? ওরা আমাদের অতিথি!”

শ‌ওকত শাহ বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললেন,

“কিসব বাজে বকছো? ওরা আমাদের অতিথি নয়। শত্রু! আর আমি আমার শত্রুদের কখনোই ক্ষমা করি না! তাহলে এরা এখানে আসার অনুমতি কি করে পেলো?”

আদ্রিশা ঢোক গিলে বললো,

“আমিই এনাদের ডেকেছি বাবা। এনারাই তো আমাদের আজকের স্পেশাল গেস্ট!”

মালিহা আঁচলে মুখ চেপে ঘন ঘন শ্বাস নিলেন। মনোয়ারা বেগম তেতে উঠে বললেন,

“কেনো? কে হয় ওরা তোমার? বাড়ির ব‌উ হয়ে শত্রুদের নিমন্ত্রণ করছো! তুমি জানতে না এই লোকটা কি করেছে আমার সাথে, এ পরিবারের সাথে?”

আদ্রিশা মাথা নাড়লো। মনোয়ারা বেগম চিৎকার করে বললেন,

“বাহ বাহ! সব জেনে শুনে এই লোকটাকে এ বাড়িতে ঢুকালে তুমি! ভাই! তুমি ভাবি খুব বড়াই করো না, এই মেয়েকে নিয়ে! মুগ্ধ, তোর তো খুব গর্ব হয় তোর ব‌উয়ের জন্য! ‌এই মেয়েই সব শেষ করে দিলো। আমাদের পরিবারের সম্মান, আমার বাবার মৃত্যুর জন্য যে দায়ী সেই আজ এ বাড়ির অতিথি! আদ্রিশা! তোমার আমায় পছন্দ নয় না? তা বলে এভাবে অপমান! ‌আমার অতীতকে আমার সামনে দাঁড় করাতে একটুকুও বাধলো না তোমার? কি করে পারলে?”

আদ্রিশা মাথা নিচু করে ছিলো। সবাই থামতেই আদ্রিশা বলে উঠলো,

“যাদের সাথে কিছুদিনের মধ্যেই আত্মীয়তা গড়তে হবে আজকে অতিথির বেশে তাদের গ্রহণ করতে পারছেন না?”

শ‌ওকত শাহ ভারি গলায় বললেন, “কি বলতে চাইছো তুমি? কাদের সাথে আত্মীয়তা গড়তে হবে?”

আদ্রিশা আসরাফ খানের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “তিথি আপু?”

আসরাফ খানের স্ত্রী বাইরের দিকে তাকালেন তিথি মাথা নুইয়ে ঘরে ঢুকলো। আদ্রিশা মৃদু হেসে তার হাত ধরে সবার সামনে দাঁড় করালো। স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

“বাবা, আপনাদের হবু ব‌উমা!”

শ‌ওকত শাহের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আদ্রিশার দিকে তাকিয়ে। আদ্রিশা হালকা হেসে তিথিকে মুগ্ধর পাশে দাঁড় করিয়ে বললো,

“কেমন লাগছে এদের বলুন? ‌একদম পারফেক্ট না! মেইড ফর ইচ আদার!”

মালিহা ইয়াসমিন বিস্মিত চোখে তাকালেন। উপস্থিত সবাই হা হয়ে গেছে। মনোয়ারা বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। সবার মাঝে শুধু আদ্রিশা, যে কিনা হাসছে! চোখে মুখে প্রয়োজনের অধিক হাসি লেগে আছে তার।

চলবে,,,,,,,,,,,