#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো
( অংশ ০১.)
বাইরে বৃষ্টির অবস্থা এতো প্রবল সেটা স্পষ্ট কানে শোনা যাচ্ছে। আকাশের বাজ যেভাবে পরছে দালানকোঠা কেঁপে কেঁপে উঠছে। নূরানী হাউমাউ করে কেদেঁ যাচ্ছে। এদিকে চোখের সামনে পূর্বকে ওভাবে যেতে দেখে পূর্ণতা একবার ভাবলো কোনোক্রমেই ওকে আটকাবেনা! পরক্ষনে চিন্তা করলো এতোটা কঠোর হওয়ার কোনো মানে হয়না। ওই লোক যেমনই হোক, পূর্ণতা ওর মতো পাষাণ হতে পারেনা। পূর্ব যেই বাইরে পা দিবে ওমনেই পূর্ণতা চেঁচিয়ে উঠলো,
– ওয়াসিফ পূর্ব !
শব্দটা খট করে পূর্বের কানে অদ্ভুত ভাবে ঠেকলো। পূর্ণতা সহজে পূর্বের পুরো নাম ধরে ডাকেনা। যখন ডাকে তখন একচোট কথা না শুনিয়ে ছাড়েনা। পূর্ব থামলো না। রাগে, ক্ষোভে শরীরের ভেতর সত্যিকার অর্থে আগুন ফুটছে ওর। আছাড় মেরে সবকিছু ভাঙতে পারলে শান্তি লাগতো ওর! পূর্ব আর দাড়ালো না। ভয়ংকর রাগ পুষে সত্যি সত্যি বাইরে পা বারিয়ে চলে যাচ্ছিলো। পূর্ণতা ওর কান্ড দেখে কি করবে উপায় না পেয়ে শেষমেশ নূরানীকে তাড়াহুড়ো করে বললো,
– থামতে বল যা! বাইরে বাজ পরছে !
নূরানী শুনতে দেরি ওমনেই এক ছুট দিয়ে বাইরে দৌড় লাগালো। পূর্ব ততক্ষণে লিফটের দিকে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু পেছন থেকে নূরানী এমনভাবে আসলো, ঠিক পূর্বের সামনে কাকতাড়ুয়া স্টাইলে দুইহাত দুইদিকে প্রসার করে রাস্তা আটকে দিলো। উন্মাদের মতো অনবরত মাথা নাড়িয়ে না সূচকে বললো,
– যাইবেন না ভাই, যাইবেন না। আপা খুব কষ্ট পাইবো। আপনে গেলে আপা কানবো পূর্ব ভাই। আপনে এমুন কইরেন না আপার সাথে।
পূর্ব স্থিরদৃষ্টিতে নূরানীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। তখনো চোখে কঠোরতার ছাপ। আজ নূরানীর জায়গায় পুরুষ থাকলে ঠাস করে এক চড় মারতো পূর্ব। কিন্তু নূরানীও এদিকে একচুল হার মারলো না। সে এগিয়ে এসে পূর্বের উত্তপ্ত হাতটা এমনভাবে পেচিয়ে ধরলো একপ্রকার জোর জবরদস্তি করে পূর্বকে ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে ছাড়লো। নূরানীর উপর চরম রাগ উঠছিলো পূর্বের। শুধু ‘মেয়ে’ বলে পূর্ব ইচ্ছাকৃত ভাবে নূরানীকে জোরে ধাক্কা বা থাপ্পর মারতে পারছিলো না, আবার জোর গলায় চিল্লিয়েও কোনো লাভ হচ্ছিলো না। পূর্ব প্রচণ্ড রাগে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকলে পূর্ণতা গমগম গলায় বলে উঠে,
– বেশি তামাশ না করে যেই রুমটায় ছিলেন, ওই রুমটায় চলে যান। বাইরের অবস্থা ভালো না, চুপচাপ ওই রুমে শুয়ে পরেন। আমি আর কোনো ঝামেলা পোহাতে চাইনা। প্লিজ ওই রুমে যান।
পূর্ণতার ঠাসঠাস কথা শুনে পূর্ব চোখ রাঙিয়ে কিছু বলবে তার আগেই পূর্ণতা রুমে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিলো। পূর্ব তখনও মুখের মাস্ক খুলেনি। সে রাগে তার হাতের মুঠো শক্ত করলে নূরানী চটজলদি সব সামাল দিতে পূর্বকে অতিথি কক্ষে পাঠায়। একটা মোটা কম্বল বের করে বেডের উপর রাখলে পূর্ব মুখের মাস্ক খুলতেই নূরানীকে বলে,
– কম্বল খুলতে হবেনা। আমি বেডে ঘুমাবো না। ফ্লোর পরিস্কার তো? ফ্লোরে ঘুমালে সমস্যা হবে?
পূর্ব আর এক মূহুর্তও দাড়িয়ে থাকতে পারছিলো না। শরীর প্রচুর খারাপ লাগছিলো ওর। মাথা অদ্ভুত ভাবে ঝিমঝিম করছিলো। হাত-পা এমনভাবে অবশ হয়ে আসছিলো যেনো যেকোনো সময় লুটিয়ে পরবে ও। নিজের সর্বোচ্চ শক্তিটুকু খরচ করে সে কঠোর থাকার চেষ্টা করছিলো। নূরানী ম্লান গলায় অসহায় দৃষ্টিতে বললো,
– ভাই আপনে বিছানায় ঘুমান। ফ্লোরে ঘুমাইয়েন না। ফ্লোর বহুত ঠান্ডা। আপনের শরীরে প্রচুর জ্বর। বৃষ্টিতেও পুরা ভিজা গেছেন। এখন যদি এই অবস্থায় ফ্লোরে ঘুমান, তাইলে শরীর আরো খারাপ করবো। আমি পানিপট্টি নিয়া আসি ভাই, আপনে ঘুমান।
পূর্ব চেঁচিয়ে উঠলো নূরানীর উপর,
– আমি তোকে পানিপট্টি আনতে বলেছি? বলেছি আমার খেয়াল রাখ? চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে ঘুমা। আর মনের ভুলেও এই রুমে আসবিনা। বৃষ্টিটা কমলেই আমি বিদায় হবো। আমার খেয়াল রাখতে হবেনা।
পূর্বের জোরালো কন্ঠের চেঁচানি শুনে নূরানী একদম মিইয়ে গেলো। সে চুপচাপ পূর্বের রুম থেকে চলে গেলেও পূর্ণতার রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে, পূর্ণতা বিছানায় শুয়ে আছে। নূরানী বেডের কাছে এসে নিচু কন্ঠেই পূর্ণতাকে ডাকলো। পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে আছে। কোনো সাড়া দিলোনা নূরানীকে। নূরানী চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকেও নির্বাকভাবে নিজের রুমে চলে গেলো।
রাত বারোটা। ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজার শব্দ হচ্ছে। পূর্ণতার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। চোখদুটো জানালার ওপাশে অস্বচ্ছ গ্লাসের বৃষ্টির দিকে আটকে আছে। একঘন্টা পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টি আর কমেনি। বুকের ভেতর চাপ অনুভূত হচ্ছে পূর্ণতার। মন ছুটে যেতে চাইছে পূর্বের কাছে। মানুষটা ভালো নেই শোনার পর থেকে মাথা কাজ করছেনা ওর। নূরানী বলেছিলো জ্বরে গা পুড়ছে। কিন্তু পূর্ণতা যতদূর জানে, পূর্বের মতো মানুষ নাকি একটানা বৃষ্টিতে দাড়িয়ে থাকলেও ঠান্ডাজ্বর হওয়ার চান্স নেই। আজ কেনো মানুষটা অসুস্থ? মনটা ব্যকুল হয়ে ছটফট করে উঠলো। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করে মোচড়ে আসছে। পেটের ভেতর যেনো সব নাড়া খেয়ে যাচ্ছে। বিছানায় মোটা কম্বল মুড়ে যেখানে পূর্ণতা আরামে ঘুমাচ্ছে, সেখানে অপরদিকে পূর্ব ভালো আছে? পূর্ণতা এপাশ-ওপাশ ফিরেও আর শুয়ে থাকতে পারলো না। কম্বল সরিয়ে গলায় ওড়না দিয়ে চুলে হাত খোপা করতেই ড্রিম লাইটের নীলচে আলোয় দরজা খুলে বের হলো। যতটা নিঃশব্দে পা ফেলা যায় সেটাই পূর্ণতা করলো। চুপিচুপি পূর্ব যে রুমে শুয়ে আছে সে রুমের দরজাটা নিজের ঠোঁট কামড়ানো অবস্থায় হালকা করে খুলে ফেললো। দরজা খুলতেই নিচের ঠোঁট থেকে দাঁত সরে মুখ হা হয়ে গেলো ওর। ফ্লোরে গুটিশুটি হয়ে দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বামকাতে শুয়ে আছে পূর্ব। তৎক্ষণাৎ কপাল কুঁচকে যায় পূর্ণতার। সে দ্রুত পূর্বের কাছে এসে হাটু গুজিয়ে বসতেই বাহুতে হাত রাখলো। শিউরে উঠে চোখ বড় করতেই সজোরে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলো। হাপানো ভঙ্গিতে অনবরত নিশ্বাস টানতেই থরথর করে কাঁপা হাতের দিকে তাকালো পূর্ণতা। এই হাত যেনো আগুনের স্পর্শ পেয়ে কাঁপছে। পূর্ণতা ওই অবস্থায় মুখ হা করে শ্বাসকার্য চালাতেই তাড়াতাড়ি পূর্বের রুম থেকে পালালো। নূরানীর রুমে গিয়ে ওকে টেনে তুলে পূর্বের কাছে জলপট্টি করতে পাঠালো। পূর্ণতা নিজের রুমে এসে তাড়াহুড়ো করে আলমারি খুলে ওয়াসিফ ভিলা থেকে পূর্বের যেই টিশার্ট এনেছিলো সেটা বের করলো। কবিরের অব্যবহৃত নতুন একটা ট্রাউজার নিয়ে নূরানীর হাতে ধরিয়ে বললো পূর্ব যেনো এক্ষুনি পোশাক পাল্টে নেয়। পূর্ণতা আর পূর্বের কাছে গেলো না। রুমে ঢুকে দরজায় পিঠ লাগিয়ে হাটুতে মাথা রেখে ফুপিয়ে কেদেঁ দিলো। পূর্ব কিভাবে অসুস্থ হয়ে গেলো? কি করেছে নিজের শরীরের সাথে? এই অসুস্থ তো পূর্ণতার জন্য কায়েম, এটা কেনো পূর্বের সাথে হলো? কানের দুইপাশ থেকে চুল টেনে হাটুতে কপাল লাগিয়ে হুহু করে কাঁদছিলো ও।
নূরানী জোর করেও পানিপট্টি দিতে পারলো না পূর্বকে। পূর্ণতার পাঠানো পোশাকও সে দরজার বাইরে ড্রয়িং স্পেসে ছুড়ে মেরেছে। জ্বরের ঘোরে চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে গেছে। পূর্ব শত চেষ্টা করেও দাড়াতে পারছিলো না, ব্যর্থ অবস্থাতেই উঠে দাড়ানোর জন্য শ্রম দিচ্ছিলো সে। পূর্বের জেদীপনা দেখে অস্থির হয়ে নূরানী পূর্ণতাকে জানায়। পূর্ণতা চোখ মুছতে মুছতে পূর্বের সামনে এসে দাড়ালে পূর্ব তখন পরিস্কার দেখার জন্য চোখ ঝাপটালো। পূর্ণতা নূরানীকে যেতে বলে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। ফ্লোরে বসে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে মাথা বিছানায় ছেড়ে দিলো পূর্ব। তাচ্ছিল্যপূর্ণ কন্ঠে হেসে দিয়ে বললো,
– দয়া দেখাতে এসেছো? নাকি দেখতে এসেছো মরে যাচ্ছি কিনা? আরে, চিন্তা নেই। আমি এতো সহজে মরছিনা। মরলে তো সেই হাসপাতালেই মৃত্যু হতো। মরিনি তো। দিব্যি বেঁচে আছি… শান্তিতে বেঁচে আছি।
পূর্ণতা ধীরপায়ে চুপচাপ হেঁটে এসে পূর্বের সামনে বসলো। চোখের সামনে রাশভারী, গম্ভীর স্বভাবের মানুষটা অসুস্থ অবস্থায় কাতরাচ্ছে। নিস্তেজ শরীর নিয়ে ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা হেলে দিয়েছে। পূর্ণতা ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে কেদেঁ দিলো। কান্নার ফিসফিসানি শব্দ শুনে পূর্ব বন্ধ চোখের পাতা টেনে খুললো। বহুকষ্টে মাথা উঠিয়ে সামনে চেয়ে দেখলো পূর্ণতা মাথা নুয়ে আছে। সমস্ত শরীর ওর থেমে থেমে কাঁপছে। জ্বরাক্রান্ত ভারী মাথা নিয়ে টালমাটাল ভঙ্গিতে পূর্ব বললো,
– কাঁদছো কেন? খুশিতে কাঁদছো? জ্বর আনা কিন্তু আমার জন্য সহজ কাজ ছিলো না জানো? টানা তিনদিন আপির রুমের বাথটাবে বরফের পানিতে নাক ডুবিয়ে শুয়েছিলাম। ফিলিংসটা মারাত্মক ছিলো। সারা শরীর ফ্রিজ্ড হয়ে যেতো, নিশ্বাস নিতে গেলে টাইটানিক ফিল লাগতো। কিন্তু আমার তো পাশে কোনো রোজ ছিলো না। জ্যাক যেভাবে রোজের হাতটা ধরেছিলো আমিতো কারোর হাত ধরিনি। মূল তফাতটা এদিকেই… সবই ভাগ্য আসলে।
পূর্বের মাতাল মাতাল কথা শুনে মাথা তুলে তাকাল পূর্ণতা। সেই ধারালো চোখের দৃষ্টি, হাসিহীন চেহারার গম্ভীর ভাব, রাশভারী শক্ত চেতনা নিয়ে পূর্ব যেনো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অপলক চাহনিতে পূর্ণতাকে দেখছে। ওর যেনো জ্বর নেই এমন চাহনিতে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা কান্নার দমকে মৃদ্যু কেঁপে উঠতেই পূর্বের দিকে অশ্রুচোখে তাকায়। জড়িয়ে আসা কন্ঠে নম্র সুরে বলে উঠে,
– শরীরের প্রতি এতো অবহেলা কেন?
পূর্ব ওর কথা শুনে হো হো করে হেসে দেয়। রুমের মধ্যে পূর্বের হাসি প্রতিধ্বনি হয়ে শোনা যাচ্ছে। পূর্ণতা নাক টেনে চোখ মুছে জিজ্ঞাসু সুরে বলে উঠে,
– আমার কথায় হাসছো কেন? এটা হাসির?
পূর্ব কোনো জবাব দিলো না। হাসি থামিয়ে আগের মতো মুখ শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নিলো।। নিরবতার সময় যেনো আর লম্বা হলো না, ওমনেই পূর্ণতা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে দুহাতে পূর্বের গালগুলো ধরলো। একদম পূর্বের কাছে গিয়ে আবারও নিজের সমস্ত কঠোরতার বেড়িবাধ ভেঙ্গে পূর্বের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– নিজেকে মেরে ফেলতে চাও? মরতে চাও তুমি? পাগল হয়ে গেছো? কি করে ওই ফালতু কাজ করতে পারলে?
পূর্ব চোখ স্থির রেখে পূর্ণতার দিকেই তাকিয়ে আছে। কোনো সাড়া নেই, কোনো জবাবও নেই। পূর্ণতার মুখের উপর পূর্বের জ্বরতপ্ত ভারী নিশ্বাস পরছে। লালচে ঠোঁটদুটো জ্বরের প্রকটে আরো লালবর্ণ ধারন করেছে। পূর্ণতা কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকলো শুধু, এরপর তপ্তময় গালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিলো সে। বহুদিন পর পূর্ণতার স্পর্শ পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো পূর্ব। মন বলছে, সময়টা থেমে যাক… সময়টা একটু থেমে যাক। এদিকে পূর্ণতা গাল থেকে হাত সরিয়ে পূর্বের কোমরের কাছে টিশার্ট ধরে সেটা খুলার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়। প্রসন্ন গলায় বলে,
– খুলো পূর্ব। আমি টিশার্ট এনে দিচ্ছি।
পূর্ব ক্ষীণদৃষ্টিতে চোখ মেলে তাকায়। মাথায় ঝিমঝিমানি ভাবটা এতো বেশি হচ্ছে যেনো মাথার ভেতর অজস্র পাখি ডানা ঝাপটা মারছে। সে পূর্ণতার কথায় সায় দিয়ে হাত উঠিয়ে টিশার্ট খুলে ফেললো। পূর্বের উজ্জ্বল ফর্সা শরীরটা লালচে আভায় ছেয়ে আছে। পূর্ণতা গায়ে হাত দিয়ে দেখলো, গরমের তেজ বেশ প্রখর। গায়ে পানি ঢেলে তাপমাত্রা নামাতে হবে! সে তাড়াতাড়ি পূর্বকে উঠার জন্য কিছু বলবে হঠাৎ পূর্ব গা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পরলো। আস্তে আস্তে বললো,
– তুমি রুমে যেয়ে শুয়ে পরো পূর্ণ। একটু পর আমি চলে যাবো। বৃষ্টিটা একটু কমুক, আমি সত্যি চলে যাবো। আর কখনো তোমার কাছে তামাশা করতে আসবো না। আর কোনোদিন তোমার ঝামেলা বাড়াবো না। তোমাকে বিরক্ত করবো না ওয়াদা করছি। আমার আজকের ভুলের জন্য আমি ওয়াসিফ পূর্ব ক্ষমাপ্রার্থী।
পূর্ণতা এই দৃশ্য দেখে আবারও ফুপিয়ে কেদেঁ উঠলো। পূর্ব না চাইলেও সে জোরপূর্বক ওর মাথাটা কোলে তুলে পূর্বের চোখে-মুখে-গালে বারবার চুমু দিলো। পূর্ব দূর্বল হাতে পূর্ণতাকে সরাতে চাইছে কিন্তু সে কোনোভাবেই পারছেনা। পূর্ণতা হাউমাউ করে কেদেঁ দিয়ে পূর্বের মাথাটা শক্তহাতে জড়িয়ে ধরলে চেঁচানো কন্ঠে বললো,
– এতো পাষাণ আচরণ কিভাবে করো তুমি? আমাকে চোখে পরেনা? আমার চেয়ে তোমার কাছে রাগের মূল্য বেশি? প্রতিবার আমি কি তোমার কাছে আসিনা? এবার তুমি এসেও কেনো ফিরে যেতে চাইছো? আমাকে একা ফেলে যেতে চাইছো কেন? কি হাল করেছো নিজের? আমি তোমার এ অবস্থা দেখতে পারছি নাতো! আমার তো এই অবস্থা সহ্য হচ্ছেনা!! প্লিজ তুমি আমার কথা শুনো, একটু উঠো?
পূর্ণতা নিজের গালের সাথে পূর্বের খোচা খোচা দাড়ির গালটা মিলিয়ে নিলো। একহাতে পূর্বের মাথাটা আকড়ে অন্যহাতে পূর্বের পিঠ বুলিয়ে দিচ্ছিলো। পূর্বের গরম দেহটা পূর্ণতার সাথে মিশে আছে। পূর্বের ঠোঁটদ্বয় পূর্ণতার গলাটা স্পর্শ করছে। পূর্ব নিজের তপ্তকর হাতটা ধীরেসুস্থে পূর্ণতার মাথায় রেখে ওই অবস্থায় মৃদ্যু কন্ঠে বললো,
– আমাকে কতদিন পর নিজের শরীরের সাথে মিশিয়েছো? ঠিক কতদিন পর তুমি আমায় একটু আগলে ধরলে পূর্ণ? তোমার নিশ্বাস, তোমার স্পর্শ, তোমার উষ্ণতাগুলো আমাকে জড়িয়ে রাখতো সবসময়। আমার ভেতরে যতো যন্ত্রণাই হোক, তোমার জন্য তোমার সামনে কখনোই সেগুলো প্রকাশ করতাম না। তুমি আমায় বুঝেও বুঝলেনা। নির্দয়ের মতো আম্মার কথাই শুনলে। আমি যে একা একা থাকছি, তোমার আশায় পথ চেয়ে আছি সেটা তুমি কখনোই বুঝলেনা। লোকাল বাসে তোমাকে দেখে কুকুরের মতো ছুটেছি, সেটা তুমি দেখলেনা। তোমার পাশে বসে কতোবার তোমার হাতটা ধরতে চেয়েছি, তুমি শুনলেনা। আমি তবুও তোমার কাছে পাষাণ হয়ে গেছি। তোমার নজরে দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বার্থপর ব্যক্তি আমি। পূর্ণ, আমি যদি স্বার্থপর হতাম আজ কারো বুক খালি করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করে ফেলতাম। তোমাকে কাছে টেনে বুকে রেখে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি ওই পথ কখনো মেনে নেইনি। বিশ্বাস ছিলো তুমি আমাকে ছাড়া একরাতও থাকতে পারবেনা। কিন্তু সেই তুমিই আমাকে ছাড়া কতো রাত কাটিয়ে ফেলছো। তুমি আমার গায়ের গন্ধ না টেনে ঘুমাতে পারো না। আমি পাশে না থাকলে তোমার স্বস্তিদায়ক ঘুমটা কখনো আসেনা। সবই তো মিথ্যা ছিলো পূর্ণতা। তুমি সবকিছু আমায় মিথ্যা বলেছো। তুমি আমার চেয়ে তোমার মায়ের কাছেই ভালো আছো। হাসপাতালে তুমি দূর্বল ছিলে অথচ দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি কাতরাচ্ছিলাম। সারাদিন চোখে চোখে রাখার পরও কেনো ওইটুকু সময় চোখে রাখলাম না, সেই অনুশোচনায় ধুকছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকেই জঘন্য ব্যক্তি বলে দূরে সরিয়ে দিলে। তুমি কখনো আমার দিক থেকে জানতে চাওনি। কখনো জিজ্ঞেস করোনি আমি কেনো তোমায় হাসপাতালে দেখতে যাইনি। তুমি কি জানো সেদিন রাতেরবেলা ওই ইনসিডেন্ট হওয়া রুমটায় আমি হাউমাউ করে কেদেছিলাম! জানো ওই ঘটনা? আমার সন্তানটা বিনা দোষে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো আমি সেই দুঃখও কাউকে বুঝতে দেইনি। রুমটা থেকে শুষ্ক চোখে সবার কাছে এসেছি। আমি নিজেকে বুঝাতাম, যদি আমি ভেঙে যাই তাহলে তোমাকে সামলাবে কে? তোমার মা-তো তোমার চেয়ে উনার ডিউটিকে বেশি ভালোবাসে। আমার মতোই সমাজসেবক চিন্তাধারার মানুষ। তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যেতাম। তুমি আমার বউ! আমার হক! আমার সব! সেই আমি কিনা তোমার কাছে যাওয়ার অনুমতি পাইনা। আমার সাথে কি নিষ্ঠুর আচরণ হচ্ছিলো তুমি কি কখনো জানতে চেয়েছো? অথচ, দিনশেষে আমি তোমার কাছে পাষাণের আখ্যা পেলাম…
কথাগুলো যত নিঃশব্দে ছিলো তত যেনো বুকের কোথাও ক্ষতবীক্ষত আচড় বসিয়ে দিচ্ছিলো। পূর্ণতা নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে পূর্বকে চেপে ধরেছে। চোখ থেকে টলটল করে অশ্রুধারা বেয়ে পরছে। এক অদ্ভুত যন্ত্রণার শিকার হয়েছে পূর্বের অব্যক্ত কথাগুলো শুনে। মানুষটার চওড়া বুকে এতো কষ্ট কিভাবে লুকায়িত থাকতো? সহ্য করতো কিভাবে? দম বন্ধ লাগতো না? পূর্বের কানটায় চুমু খেলো পূর্ণতা। বামহাতটা থেকে পূর্বের মাথাটা নির্লিপ্তে কোলে রাখতেই দেখলো, পূর্বের দুই চোখের কার্নিশ বেয়ে কানের কাছে ভিজে আছে। তার চোখ বন্ধ হলেও গাঢ় লালের ঠোঁটদুটো কাঁপছে। পূর্ণতা মুখ নিচু করে পূর্বের চোখের পাতায় গভীর আবেশপূর্ণে ঠোঁট এঁকে দেয়। একে একে দু’চোখের পাতায় ঠোঁট স্পর্শ করে চোখের কিনারা মুছে দেয়। পূর্ব খুবই ধীরভাবে ভেজা পাপড়ির চোখদুটো খুলে তাকালে পূর্ণতা বলে উঠে,
– কমরেড সাহেব? জ্বরটা আগে কমাই?
পূর্ব দূর্বল চাহনিতে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ডান চোখ থেকে আবার একফোঁটা অশ্রু ঝরলো। পূর্ণতা কপালে হাত রেখে আবার বললো,
– আজ আদর করবো তো। জ্বরটা আগে কমাই? একটু উঠো। শরীরে পানি ঢালতে হবে। পানিপট্টি দিলে তাপমাত্রা নামবেনা। আমি আগুনের মতো ঠোঁটে বেশিক্ষন আদর করতে পারবো না পূর্ব। আমার কথাটা একটু রাখো?
পূর্ব চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গিললো। চোখ আবার খুলে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে রগ্ন সুরে বললো,
– আমি কমিউনিজম করিনা। আমাকে কমরেড ডেকো না।
পূর্ণতা কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দেয়। পূর্বের শত মানা করা সত্ত্বেও সেই ‘কমরেড’ ডাকেই যেন তার অদ্ভুত সুখ, অদ্ভুত শান্তি। পূর্ব তো জানে তার পূর্ণতার দুষ্টু কারসাজি। সেই হাসিটাই পূর্ব প্রাণভরে তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখছে। প্রিয়তমা তোমার মুখের হাসি, বড্ড বেশি প্রিয়.. বড্ড বেশি ভালোবাসি। দুঃখগুলো তোমার মাটি হোক, সুখের সাগরে ডুবে থাকো তুমি, অবশ্যই তোমার মাঝে আমি সহস্রবার হারাতে যাচ্ছি।
– ‘ চলবে ‘
( #চলবে )❤
#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫৭
#ফাবিয়াহ্_মমো
( অংশ ০২.)
বৃষ্টির মুখরধ্বনি একটু যেনো কমলো। তবুও বজ্রপাতের শব্দ আর কমেনি। পূর্ণতা অনেক তোষামোদ করতে লাগলো কিন্তু পূর্ব মাথা তুলে উঠেনি। জেদ চেপে বসেছে সে আজ পূর্ণতার কোলেই মাথা রেখে ঘুমাবে। জ্বরটা জ্বরের জায়গায় থাকুক, পূর্ব একচুল উঠবেনা পূর্ণতার কাছ থেকে। পূর্ণতা নিরুপায় হয়ে অনবরত বুঝাতে লাগলো জ্বরটা ঠিক কমলেই সে আগের চেয়েও বেশি বেশি ভালোবাসবে। এদিকে পূর্ব ঘাপটি মেরে পূর্ণতার কোমর জড়িয়ে কোলে মুখ গুজে শুয়ে আছে। পূর্ণতা ওর মাথায় আঙ্গুল চালিয়ে বললো,
– তুমি এমন করো না, একটু শোনো। আমি তো বলেছি তোমার কাছ থেকে সরবো না। এখন যদি তুমি কথা না শোনো, আমি কিন্তু রুমে যেয়ে দরজা আটকে ঘুমাবো। ইচ্ছামতো ডাকাডাকি করলেও আসবো না। কি? আমি চলে যাবো?
পূর্ব একটু যেনো সায় দিলো। কোমর থেকে দূর্বল হাতদুটো আলগা করে পূর্ণতার মুখের দিকে তাকালো। পূর্ণতা কঠোর চাহনিতে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পূর্বের এই অযথা ন্যাকামো ওর একদম সহ্য হচ্ছেনা। কথা বললে কথা শোনেনা, পূর্বকে ধরে কি করা উচিত? পূর্ব হালকা করে একটা ঢোক গিললো। আস্তে আস্তে বললো,
– উঠছি, তোমার ও রুমে যেতে হবেনা।
পূর্ণতা কথাটুকু শুনে কুঁচকানো কপাল ঠিক করে পূর্বকে ধরে ধরে ফ্লোর থেকে উঠালো।পূর্ব নিজের শরীরের উপর কাবু রাখতে পারছিলো না। ফ্লোরে পা ফেলতে প্রচুর হিমশিম খাচ্ছিলো সে। মাথার ভেতর এতো যন্ত্রণা হচ্ছিলো চোখ কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে সে কোনোরকমে পূর্ণতার সাহায্য নিয়ে পূর্ণতার রুমে গেলো। পূর্ণতার রুমে শুধু এ্যাটাচমেন্ট বাথরুম। বাকি রুমগুলোর জন্য বাইরে বাথরুম সিস্টেম। পূর্বের অবস্থা যেহেতু বেশি খারাপ তাই পূর্ণতা নিজের রুমটায় একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেলো। পূর্বকে বেডে বসিয়ে দিয়ে দ্রুত বাথরুমের দরজা খুলে এলো। এসেই দেখে পূর্ব বেডে গা ছেড়ে দিয়ে চোখ খিচে কাতরাচ্ছে। পূর্ণতা দ্রুত এগুতে গিয়েও আর এগুতে পারলো না। কনুইয়ের ভাজে চোখদুটো ঢেকে কেদেঁ দিলো। সুস্থ মানুষটার এমন দিনও দেখা লাগবে সেটা কেউ ভাবতো? গায়ের জোরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত একনাগাড়ে খাটাখাটনি করা মানুষটা এতো অসহায়ের মতো কিভাবে কাতরাচ্ছে? কখনো অসুখে পরতে দেখেনি, ঠান্ডাজ্বরে ভুগতে দেখেনি, পায়ের এক্সিডেন্টে ব্যথার শব্দও করেনি পূর্ব। সেই পূর্বের মুখ থেকে চাপা যন্ত্রণার অস্ফুট শব্দ আসছে? পূর্ণতার চোখ থেকে টলটল করে পানি বেয়ে পরছে। হিচকি তুলে কেদেঁ চলছে সে। সহ্য হচ্ছেনা কিছুই। সবকিছু তছনছ লাগছে ওর। বুকের ভেতরটা এফোড়-ওফোড় করে ঝাঁজরা করে দিচ্ছে পূর্বের আর্তনাদ। পূর্ব অস্ফুট সুরেই চোখ খুলে পূর্ণতার দিকে দূর্বল হাতটা বারিয়ে দিয়েছে। কথা বলতে গিয়েও ওর চোখ তীব্র যন্ত্রণায় খিচে আসছে। তবুও আস্তে আস্তে শোনা যাচ্ছে,
– আমার খারাপ লাগছে, দূরে দাড়িয়ে থেকো না। কাছে এসো।
পূর্ণতা ছুটে গিয়ে ওর তপ্ত হাতটা ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কিচ্ছু হয়নি তোমার। আমি তোমার জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করছি। তুমি উঠো পূর্ব। আরেকবার কষ্ট করে একটু উঠে ওয়াশরুমে আসো। আমি বলছি তো, তোমার কিচ্ছু হবেনা।
পূর্ব আধবোজা চোখের দৃষ্টিতে আবার ঢোক গিললো। পুরো মুখ লাল হয়ে আসছে ওর। পূর্ণতা আর এক মিনিট অপেক্ষা করলো না। সবটুকু শক্তি দিয়ে সে পূর্বকে টেনে তুলে বাথরুমে নিয়ে গেলো। পূর্বকে একহাতে জাপটে ধরে পূর্বের পেছনে থাকা শাওয়ারের নব মোচড়ে দিলো। থোকা থোকা বৃষ্টিফোটার পানি এসে পূর্বের তপ্ত শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। পূর্ব পূর্ণতার কাধে মাথা হেলিয়ে দিলে পূর্ণতা আবার নবটা মোচড়ে পানির স্পিড সর্বোচ্চ সীমায় করে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরোপুরি ভিজে গেলে পূর্ণতা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– তোমার জন্য এই ঠান্ডার মধ্যে ঝর্নার পানিতে ভিজতে হচ্ছে। আমার অবস্থা তুমি বুঝতে পারছো?
পূর্ব চোখ বন্ধ করে পূর্ণতার পিঠ খামচে ধরলো। শিউরে উঠলো পূর্ণতা। চেঁচিয়ে উঠলো সাথেসাথে,
– কি করছো তুমি? বলেছিনা জ্বর কমুক?
পূর্ব কোনো উত্তর দিলো না। নির্লিপ্তে আরেকহাত পূর্ণতার ঘাড়ে রাখলো। পূর্ণতার পিঠের মাঝে পূর্বের শক্ত হাতের বিচরণ চলছে তখন। গায়ের তাপমাত্রা একটু একটু করে নামতে শুরু করেছে ওর। পূর্ণতার কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে দৃষ্টি ছুড়লো পূর্ণতার চাহনির দিকে। শাওয়ারের বেগতিক সীমার জন্য পূর্বের থুতনি থেকে একনাগাড়ে পানি পরছে। পূর্ণতা আর কোনো পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলোনা পূর্বের দিকে তাকিয়ে। পূর্ব ওকে যেনো সম্মোহন করতে চাইছে। শান্ত চোখদুটো দিয়ে পূর্ণতার হৃদ গহ্বরের গভীর জায়গায় যেনো পৌঁছতে চাচ্ছে পূর্ব। পূর্ণতা বারবার পানির জন্য চোখ ঝাপটা দিচ্ছে।এদিকে পূর্বের কোনো হেলদোল নেই নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতার পিঠে হাতের পাঁচ আঙ্গুলের জোরালো চাপ দিয়ে নিজের সাথে মেশালো সে। ধীরেধীরে পূর্ণতার মাঝে স্বল্প দূরত্বটা ঘুচিয়ে ওর কানের নিচে তপ্তকর ঠোঁট ছোঁয়ালো পূর্ব। কেঁপে উঠতেই পূর্ব ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– তোমাকে কতদিন আমি কাছে পাইনা? আমার কথা তুমি স্মরণ করো? আমার যে খুব খারাপ সময় গিয়েছে তখন তুমি ছিলেনা পূর্ণ। মাথাব্যথায় মরে যেতাম। কেউ একটু এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো না। আমার বিছানায় তোমার জায়গাটা খালি পরে থাকতো, তুমি আসতে না। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে তোমার মুখটাও দেখতে পেতাম না। হাত বারিয়ে তোমার শোয়ার জায়গাটা দেখতাম। চোখে আর ঘুম আসতো না পূর্ণতা। আমি কিভাবে ছিলাম বলো? তোমার গায়ে হাত রেখে ঘুমানোর যেই অভ্যাসটা হয়েছিলো, সেই অভ্যাসমতো তোমাকে একদমই পেতাম না। চোখ খুললেই তুমি নেই। আজ তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছিনা। তোমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে চাচ্ছি। আমার অবস্থা একটু বুঝো, আমিতো অসহায় হয়ে আছি।
পূর্বের কথা শুনে ওই অবস্থায় চোখ বন্ধ করে ফেললো পূর্ণতা। পূর্বের উন্মুক্ত পিঠে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে উঠলো,
– চলে আসলে না কেন? আমার কাছে একবার বেহায়া হয়ে চলে আসতে? আমি কি ফিরিয়ে দিতাম?
– আমারও একই প্রশ্ন। তুমি কখনো যদি আমার কাছে চলে আসতে আমি কি তোমায় ফিরিয়ে দিতাম?
আর কোনো শব্দ উচ্চারণ হলো না দুজনের মাঝে। প্রশ্ন একই হলেও উত্তর দিলো না কেউই। পূর্ব জ্বরের মধ্যে থাকলেও সম্পূর্ণ সজ্ঞান চেতনায় ছিলো। পূর্ণতা তখন পূর্বের চুলগুলো আঙ্গুলে নাড়াচাড়া দিয়ে গরম ভাবটা কাটাচ্ছিলো। পূর্ব তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে বহুদিন পর কাছে পেয়ে নিজের শক্ত মূর্তি পাশে ফেলে নরম আকার ধারন করছিলো। পূর্ণতার ডান কাধে পাগলের মতো ওষ্ঠযুগল স্পর্শ করছিলো সে। প্রতিবার তপ্ত ঠোঁটের আকস্মিক ছোঁয়ায় ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠলেও পূর্বের জ্বর কমানোই যেনো পূর্ণতার মূখ্য উদ্দেশ্য। পূর্ব চুপচাপ পূর্ণতাকে ছেড়ে দিলো। আচমকা এমন আচরণে পূর্ণতা কিছুটা কৌতুহলবোধ করলেও পূর্বের চোখ যেনো অন্যকিছুর আকুলিবিকুল প্রকাশ করছে। সে খুব করে পেতে চাইছে পূর্ণতার অধরস্পর্শ। পূর্ণতা ওর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকানো অবস্থায় হাত বারিয়ে পূর্বের পেছন থেকে শাওয়ারটা স্লো করতে লাগলো। পূর্ব ওকে যেনো ঘায়েলই করতে চাইছে ওই দৃষ্টি দিয়ে। সে পূর্ণতাকে আচমকা সামনে থেকে ঘুরিয়ে শাওয়ারের নবের পাশে দেয়ালে ঠেকিয়ে ধরলো। পূর্ণতার হলদে উজ্জ্বল চামড়ায় শীতের কারনে পশমস্তর কাটা দিয়েছিলো। পূর্ব তার শান্ত গলায় মাদকপূর্ণ কন্ঠে বললো,
– জ্বর কমেছে না? এবার একটু প্রাপ্যটা বুঝে নেই?
পূর্ণতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে। কথার মানে বুঝাটা আর বাকি নেই পূর্ণতার। পূর্ব তার শক্ত হাত দিয়ে পূর্ণতার হাতদুটো দেয়ালে উঠালো। পূর্ণতার আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের আঙ্গুল গুঁজে দিয়ে দেয়ালে চেপে ধরলো। পূর্ণতার কোনো বিশেষ ভাবাবেগ স্পষ্ট না। পূর্বের দিকে সম্মোহিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই পূর্ব ধীরেধীরে ওর সিক্ত ওষ্ঠের দিকে এগুতেই একটু থামলো। পূর্ণতা ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে লজ্জায়। পূর্ব একপলক কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠদুটির দিকে তাকিয়ে পরক্ষনে পূর্ণতার লজ্জা মাখা মুখটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। পূর্ণতা চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় বললো,
– আশি কেজির মানুষ এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো সমস্যা। কিছু একটা করুন, নয়তো ছাড়ুন।
পূর্ব বাঁকা করে হাসলো। পূর্ণতার চতুর কথা শুনে পূর্ব ওর ভঙ্গিতেই উত্তর দিলো,
– পঁচাত্তর কেজির মানুষ এভাবে কেনো তাকিয়ে থাকে সেটা বুঝার কথা। অবশ্যই মারাত্মক কিছু করতে চাইছি। ছাড়ার জন্য এভাবে ধরে রাখিনি।
কথা শেষ হতেই পূর্ণতা চমকে গিয়ে চোখ খুললো। ওর পাঁচ কেজি ওজন কমার ব্যাপারটায় কিছু বলবে ওমনেই নিজের গরম ওষ্ঠজোড়ায় পূর্ণতার ওষ্ঠযুগল দখলিস্বত্ব করলো পূর্ব। ব্যকুল হৃদয়ের শুস্ক উঠোনে দীর্ঘদিন পর তৃষ্ণা নিবারণের যেনো সুযোগ পেলো। দুটি পিপাসার্ত আত্মার বহু প্রতীক্ষার প্রহর যেনো ওষ্ঠযুগলের মিলনকার্যে শেষ হলো।। পূর্ব সত্যিই তার কথা মোতাবেক মারাত্মক কাজটি করে দেখালো। পূর্ণতার নিচের ঠোঁটটি তার দাঁত দ্বারা আকড়ে ধরলো। পূর্ণতা কুকড়ে উঠতেই চোখ মেলে দেখলো রাশভারী মানুষটার সুন্দর দুই চোখ থেকে আবারও পানি পরছে। কখনো এই দৃশ্য দেখার পর পূর্ণতা স্বাভাবিক থাকতে পারেনা। আজও পারেনি। সে দ্রুত পূর্বের গালদুটো ধরে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখের দুকোণা মুছে ফেললো। পূর্বের ওজন কমলো কি করে? খাওয়া দাওয়া বাদ দেওয়ার কারনে? তাই বলে আশি থেকে একদম পঁচাত্তরে নেমে যাবে? ঠিক কি কি করলে শরীরের এন্টিবডি সিস্টেম লো হয়ে যায়? পূর্ণতার ইচ্ছে করছিলো পূর্বের ঠোঁট ছেড়ে ওর সারা মুখে চুমু দিতে। শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেছে গম্ভীর মুখটা। রাতের পর রাত যে ঘুমটা হয়না, সেটা চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকালেই বোঝা যাবে। পূর্ণতা গাল থেকে হাত নামিয়ে ধীরে ধীরে পূর্বের বুকে হাত রাখলো। এটাই তো পূর্ণতার শয়নশয্যা। এই জায়গাটায় কত রাত যে আরামের ঘুম দিয়েছে সে, তার কোনো হিসেব নেই। এখনো সেই সুনশান রাতের কথা মনে পরে ওর। বদমাইশ লোকদের ধাওয়া খেয়ে রাস্তায় বেহুঁশ হয়েছিলো। আশ্চর্যজনক ভাবে এই পূর্বের বাহুগুলোর মাঝেই ডুবে পূর্ণতা ছিলো। তখন কি পূর্ব জানতো এই মেয়েটিই তার জীবনের পূর্ণতা হবে? তাকে ঘিরে জীবনের সবকিছু চলবে? পূর্ণতার মাঝে হারিয়ে গিয়ে অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করবে? মানুষটা কিছুই জানতো না। পূর্ব ওর ঠোঁটদুটো ছেড়ে দিয়েও আবার সেখানে মৃদ্যু চাপ দিলো। চোখ নিচু করে গভীরভাবে বুকভর্তি নিশ্বাস ছাড়তে থাকলে পূর্ণতা শান্ত কন্ঠে বললো,
– রুমে আসো। এখানে দাড়িয়ে থাকতে হবেনা। আমি টিশার্ট-ট্রাউজার এনে দিচ্ছি।
পূর্ব কেমন অপ্রকৃতিস্থ কন্ঠে তড়িঘড়ি করে বললো,
– আজ একটু শাড়ি পরোনা? ওই ডার্ক ব্রাউনের শাড়িটা? একবার, শুধু একবার? আমি আজকের রাতটুকু ওই শাড়িতে দেখতে চাই।
পূর্ণতা অবাক হয়ে বললো,
– এখন? এই সময়?
– হ্যাঁ এখন, এই সময়। তুমি পরবে? একবার পরবে শুধু?
পূর্বের চোখে মুখে আকুতি জানানোর অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। পূর্ণতা ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মৃদ্যু সুরে বললো,
– পরবো। কিন্তু আগে তুমি কিছু খাবে। তারপর ঔষুধ নিবে। তারপর..
পূর্ণতার কথার মাঝে দাড়ি বসিয়ে পূর্ব প্রীতিকর হাসিতে বললো,
– তারপর পূর্ব আস্তানায় শিকার হয়ে যাবে।
লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো পূর্ণতা। এদিকে পূর্ব ফিক করে হেসে দিলো পূর্ণতার মুখ দেখে। পূর্ণতা ওয়াশরুম থেকে রুমে নিয়ে এলো পূর্বকে। বারান্দা থেকে শুকনো টাওয়ালে এনে পূর্বের মাথা মুছে দিতে গা মুছে দিলো। ড্রয়িংস্পেসে গিয়ে ছুড়ে মারা টিশার্ট-ট্রাউজার এনে ওকে চেন্ঞ্জ করতে বলে পূর্ণতা আলমারি খুললো। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা শাড়ির হ্যাঙার থেকে গাঢ় বাদামীর শাড়িটা বের করলো। ওয়াশরুম থেকে পোশাক পাল্টে পূর্ব রুমে ঢুকতেই বললো,
– ব্লাউজটা কালো হওয়া চাই। ফুল স্লিভ। মাথায় কোনো পোটলা বাধবেনা। চুল আচড়ালে পেটাবো! সুন্দর করে পিঠে ছেড়ে দিবে। ঠোঁটে খবরদার ভুল করেও লিপস্টিক জাতীয় কিছু মাখবেনা। আমি কোনো কৃত্রিম জিনিসের স্বাদ নিতে প্রস্তুত নই।
কাটকাট জবাবে গম্ভীর মুখেই আজ্ঞা জারি করলো পূর্ব। এরপর বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো পূর্ণতার। পূর্ণতা নূরানীকে বলে কিছু ফল কেটে পূর্বের সামনে বসে থাকতে বলেছে। পূর্ব যে পযর্ন্ত পিরিচের সব ফল না খাবে সেই পযর্ন্ত উঠতে না করেছে নূরানীকে। নিরুপায় পূর্ব একপিস মুখে দিয়েই চেহারা এমন ভোতা করলো যেনো অখাদ্য দিয়েছে খেতে। সে নূরানীকে বললো,
– তোদের বাড়িতে নিমপাতাও বোধহয় মিষ্টি লাগবে। কিন্তু এগুলো কি এনেছিস?
নূরানী পূর্বের ত্যাড়া কথা বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কৌতুহল গলায় প্রশ্ন করলো,
– ভাই আপনে এটা কি বললেন? নিমপাতা মিষ্টি হইবো ক্যান? নিমপাতা তো তিতা বিষ।
– নূর, তোর খালাম্মা মিসকিন স্বভাবের মহিলা না হলে বাড়িতে এইসব অখাদ্য রাখেনা। অসুস্থ রোগীকে আপেল, কমলা, মালটা দেয়। আমাকে এটা কি দিয়েছে? পেয়ারা? বাঙ্গি? তরমুজ? এই জ্বরের মুখে এগুলো ভালো লাগে?
– আপনে আসবেন এইটা কে জানতো দুলাভাই? খালাম্মা জানলে তো আগেই ফলটল কিনা আনতো।
– শোন নূর, তোর খালাম্মা জানলে বাজার থেকে ইদুঁরের বিষ আনতো। এনে আমার খাবারের মধ্যে ছিটিয়ে দিয়ে মেরে ফেলতো।
পূর্বের তীক্ষ্ম তীক্ষ্ম কথা শুনে নূরানী আশ্চর্য হয়ে গেলো। ভীতুর মতো সংকুচিত কন্ঠে বললো,
– ও ভাই? আপনের কি মাথাচাড়া দিছে? আপনে এগ্লা কি বলেন?খালাম্মা আপনেরে ইন্দুরের বিষ দিবো কেন? খালাম্মা তো বাসায় নাই।
– তোর খালাম্মা যে আমাকে দেখতে পারেনা সেটা তুই ভুলে গেছিস নূর? ভালোই হয়েছে বাসায় নেই।
এরপর পূর্ব বিড়বিড় করে নিজের সাথে বললো, আম্মার জন্য বউয়ের ঠোঁটে চুমুও খেতে পারিনা, কাছে ভিড়তে পারিনা। লোকে শুনলে আম্মার কি প্রেস্টিজটা থাকবে?কি ভাববে?ছিঃ!
এদিকে নূরানী উৎসুক ভঙ্গিতে বললো,
– খালাম্মার কথা আর বইলেন না দুলাভাই। কুয়ারা করে খালি। এমুন একটা ভাব যেন দুনিয়াত হেয় একলাই মাইয়া পয়দা করছে। আর কেউ করেনাই। আচ্ছা একটা কথা বলেন, আপনে কি আপার প্রেমিক? আপনে হইলেন জামাই। জামাই বউয়ের সাথে থাকবো। ওইখানে আপারে আপনের কাছ থেকে দূরে সরায়া রাখছে। এইটা কি ঠিক?
পূর্ব ঔষুধের পাতা থেকে ক্যাপসুল ছিড়ে পানি দিয়ে গিলে বললো,
– দেখছিস? তোর মাথায়ও কত বুদ্ধি। অথচ দেখ? উনার মতো শিক্ষিত একজন ডাক্তারের মাথায় এসবের কিছুই নেই। তোর আপাকে আমার কাছ থেকে আলাদা রেখে গুনাহ্ ছাড়া কিছুই কামাচ্ছেন না। তোর কথা শুনে ভালো লাগলো নূর। এখন এইসব আমার সামনে থেকে সরা। বিরক্ত লাগে দেখতে।
নূরানী পূর্বের সামনে থেকে ট্রে-সমেত সব জিনিস নিয়ে বাইরে চলে গেলো। এদিকে পূর্ণতার অপেক্ষায় চোখ দুটো বন্ধ করে মাথার নিচে দুহাত রেখে শুলো পূর্ব। গায়ে মোটা কম্বল টেনে শরীরের কাপুনি কাটাতে চাইলো। কিছুক্ষন পর পূর্ণতা আস্তে করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বাইরে একবার চুপি দিতেই দেখলো পূর্ব চোখ বন্ধ করে আছে। মিটিমিটি হাসি দিয়ে সে নিঃশব্দে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। ফ্লোরে পা এমনভাবে রাখলো যেনো পূর্ব ভুলেও টের না পায়। পূর্ণতা রুমের বাইরে গিয়ে নূরানীকে ঘুমাতে বলে আবার ফিরে আসলো। রুমের দরজায় সিটকিনি তুলে দিয়ে যেই পিছু ফিরবে ওমনেই পায়ের সাথে কুচি আটকে এলো ওর। পূর্ণতা মাথা একটু নুয়ে কুচি ঠিক করতেই পূর্ব চোখ খুলে ফেললো। চুলের পানিতে পূর্ণতার চিকন শরীরের পিঠটা ভিজে গেছে। গোসলের পর হুট করেই ফর্সাভাব চলে এসেছে পূর্ণতার শরীরে। সেই ফর্সাভাবের সাথে গাঢ় বাদামীর শাড়িটা তার শরীরের নিপুণতায় মিলেমিশে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। পূর্ণতার মুখটা দেখার জন্য আকুপাকু করছে পূর্ব। কখন পূর্ণতা কুচি সামলে পূর্বের দিকে ফিরে তাকাবে? পূর্ব আর ধৈর্য্য, অপেক্ষা, নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলো না। কম্বল সরিয়ে ফ্লোরে পা রাখতেই জ্বরের শরীরে আবারও মৃদ্যু শিরশিরানির কাপুনিটা এলো। সেটা তোয়াক্কা না করে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেলো পূর্ব। কুচি ঠিক করে পূর্ণতা পিছু ফিরতেই পূর্বের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো ওর। থেমে গেলো দুজনের দৃষ্টি। থেমে গেলো যেনো সময়। পূর্ণতার বুকে ধুকপুক ধুকপুক করে হৃৎপেশী ছুটছে। এই ধুকপুকনি শব্দ কি পূর্ব টের পাচ্ছে? কেমন হুল্কাস্পিডে ছুটছে হৃদপিন্ডটা! পূর্ব ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে এলো। পূর্ণতার কাছে এসে মেদহীন কোমরটার বামদিকে হাত রেখে কাধ থেকে চুল সরিয়ে বললো,
– তোমার মতো নির্দয় কেউ হয়না। বাসের মধ্যে কি বলছিলে যেনো? আমার মুখের মাস্কটাও তোমার চেয়ে সৌভাগ্যবান? আমাকে আস্তো সামনে পেয়েও কিছু করতে পারলেনা কেন? চোরের মতো সেদিন কেনো চলে গেলে?
বলতে বলতেই পূর্ণতার বামকাধে ঠোঁট ছোঁয়ালো পূর্ব। মৃদ্যু ভঙ্গিতে কেঁপে উঠতেই পূর্ণতা কঠোর কন্ঠে উত্তর দিলো,
– কারন, তোমার মতো পাষাণ লোক কখনো হয়না। হাসপাতালে আমি একাই সারাদিন শুয়ে থাকতাম। নার্সও চব্বিশ ঘন্টা পাশে এসে পরে থাকতো না। কিন্তু তুমি ছলচাতুরি করেও আমাকে একবার দেখতে আসতে না। এটা কি গ্রহণযোগ্য? বলো ওয়াসিফ পূর্ব?
কাধে ঠোঁট ছোঁয়াতেই গলার কাছে স্পর্শ করছিলো পূর্ব। ওই অবস্থাতেই তীক্ষ্ম কন্ঠে উত্তর দিলো,
– তোমার মা বাইরে থেকে ভেতরে না যাওয়ার সিস্টেমটা চালু করেছিলো। তোমার কাছে কেউ না থাকলেও তোমার কাছে কাউকে আসতে দিতো না সে।
পূর্বের কথা শেষ হতেই পূর্ণতাও আরেক চোট প্রশ্ন ছুড়লো পূর্বকে। পূর্ব তখনও উন্মাদগ্রস্তের মতো পূর্ণতাকে ঘুরিয়ে ঘাড়ে ঠোঁট স্পর্শ চালাচ্ছে। পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে কঠোর সুরে বললো,
– তুমি সেদিন আমাকে দেখতে ফ্ল্যাটে এসেছিলে তাইনা? নবের লক খুলে ভেতরে ঢুকে আমাকে দেখার ধান্দা ছিলো তোমার। আমি জানতাম ঢপ মেরে তুমি এসেছো।
পূর্ব মৃদ্যু শব্দ করে হেসে দিলো। পূর্ণতার পিঠ থেকে চুল সরিয়ে সামনে ছেড়ে দিতেই স্বহাস্য কন্ঠে বললো,
– কিভাবে বুঝলে? এতো ব্রেন তোমার? আমিতো কোনো ক্লু ছেড়ে যাওয়ার মানুষ নই।
কথাটুকু শেষ করতেই পূর্ণতা তার প্রস্তুতকৃত উত্তর শোনাবে তখনই পিঠে গরম ওষ্ঠের পরশ পেয়ে কথা আটকে ফেললো ও। পূর্ব সমস্ত পিঠে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সেই কার্যসম্পাদনের মধ্যেই আবার বলে উঠলো,
– কি হলো? বলো, বলো? কিভাবে বুঝলে আমি এসেছিলাম? আমিতো কোনো নাম-নিশানা ছেড়ে যাইনি।
পূর্ণতার ইচ্ছে করছিলো কড়া কড়া কিছু কথা শোনাতে। এদিকে পূর্ব নিরবে পেটের উপর হাত রেখে দিয়েছে। স্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি অনুভব হচ্ছিলো ওর। কিন্তু পরক্ষনে মত পাল্টে পূর্ণতা বলে উঠলো,
– তুমি আরেকদিন নবের লক খুলে ভেতরে ঢুকেছিলে। আয়মান বলেছিলো তুমি চোরা টেকনিক ব্যবহার করে লক খুলেছো।
পূর্ণতার পিঠে ছোট্ট কালো তিলের উপর ওষ্ঠ বসাতে গিয়ে থেমে যায় পূর্ব। ‘চোরা টেকনিক’ শব্দটা শুনে হেসে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– তারপর?
পূর্ণতার জন্য প্রশ্নাত্মক অবস্থা তৈরী করে ছোট্ট তিলের উপর গভীর আবেশে ঠোঁট ছোঁয়ালো পূর্ব। পূর্ণতা শিউরে উঠে উত্তরটা আর দিলো না। স্বল্প সময় পর পূর্ণতাকে নিজের দিকে ঘুরালো পূর্ব। পূর্ণতার চোখ ফ্লোরের দিকে নত। পূর্ব সেই দৃষ্টিটা নিজের দিকে আবদ্ধ করতে পূর্ণতার থুতনি ধরে উপরে উঠালো। হঠাৎ পূর্ণতা কি যেনো ভেবে চট করে প্রশ্ন করলো পূর্বকে,
– তুমি কি এমপি হওয়ার পর আমাকে ভুলে যাবে?
প্রশ্ন শুনে ভ্রুদ্বয়ের মাঝে কয়েকটা ভাজ ফেললো পূর্ব। কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই দুহাতে গায়ের কালো টিশার্ট খুলে ফেললো। ড্রেসিং টেবিলের দিকে টিশার্টটা ছুড়ে মারতেই পূর্ণতার দুই চোয়ালের নিচে হাত রেখে পূর্ব উদ্বিগ্ন সুরে বললো,
– তোমাকে আমি কিসের জন্য ভুলতে যাবো বলোতো? কেনো ভুলবো? তুমি তো আমার বউ। ম্যাথের কোনো জটিল সূত্র না।তাহলে কেনো ভুলতে যাবো?
পূর্ণতা নিচুস্বরে জবাব দিলো,
– আমি যে তোমার বউ এটা কে জানে?
– আমি যে বিবাহিত, এটা পার্টির সবাই জানে। আশাকরি আমার পার্সনাল লাইফ নিয়ে তারা মাথা ঘামানোর চেষ্টা করতে পারবেনা। আর আমি চাইনা তোমাকে কেউ চিনুক। চিনে শেষে তোমার ক্ষতি করুক। জানো পূর্ণ, আমি সবসময় তোমাকে পার্টির ক্ষতি থেকে দূরে রাখতাম, এটাই আমার মূল চিন্তা ছিলো। কিন্তু ঘরেই যে মেইন শত্রু রেখেছিলাম, আল্লাহ্ যদি আমাকে আরেকটু বুঝ দিতো! যদি আরেকটু সচেতন হতাম? তাহলে কি আমাদের বাচ্চাটা…
বুকভর্তি ভারী নিশ্বাস ছাড়লো পূর্ব। সেই নিশ্বাসের শব্দ যেনো ব্যথিত বুক থেকে ক্ষতরূপে চিড়ে বেরিয়েছে। পূর্ণতা তৎক্ষণাৎ পূর্বের হাতটা টেনে পেটের উপর রাখলো। পূর্ব ওর দিকে বিষ্ময়দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকালে পূর্ণতা ছলছল চোখে আহত কন্ঠে বললো,
– আমার মনেহয় ও এখনো আমার পেটে আছে। আমার অঙ্গ-প্রতঙ্গের সাথে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে পূর্ব। তুমি বিশ্বাস করো, আমি এখনো ওর নড়াচড়াগুলো স্মরণ করি। আমি তো ওকে কোনোদিনও ভুলতে পারবো না। ছয়মাস আমার গর্ভে যত্ন করেছি। পেটে হাত রাখলেই মনে হতো তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আছি। তুমি তো আমার পাশে চব্বিশ ঘন্টা থাকতে না। আমাকে না ডেকে, নিজেকে দেখতে না দিয়ে খুব সকাল সকাল বেরিয়ে যেতে। সারাটা দিন ওকে নিয়ে কতো কথা বলতাম। আমার একা একা সময়গুলো ওর সাথে কেটে যেতো। সন্ধ্যায় তুমি বাসায় ফিরতে। তখন মনেহতো আত্মায় শান্তি পেলাম। রাতে তোমার বুকে মাথা রেখে পেটে তোমার হাত টেনে ঘুমাতাম। দিনগুলো কোথায় গেলো? আমি যে ওইদিনগুলো মনে করে এখনো কাঁদি। আমার প্রাণটা তো শান্তিতে নেই পূর্ব। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর চিৎকার করে কেদেঁছি। ও আমাকে ছেড়ে দুনিয়া না দেখতেই চলে গেলো। তুমি আমাকে দেখা না দিয়েই দূরে চলে গেলে। আমি দিনশেষে আবারও নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। নিঃসঙ্গতার দুঃখ যে যন্ত্রনা দেয়, মৃত্যুও তাতে সহজ লাগে। আমিতো ওই যন্ত্রণা সহ্য করার অবস্থায় ছিলাম না। তবুও শ্রেয়ার মতো নিজের মৃত্যু ডেকে মহাপাপ করতে পারতাম না। কিন্তু আমার ওই মূহুর্তে এটাই মন চাইতো যেনো নিজেকে শেষ করে ফেলি। আমি কেমন খারাপ অবস্থায় ছিলাম বলো?
পূর্ণতা হু হু করে আবারও কেদেঁ উঠলো। কিছু স্মৃতি মনের গহীনে এতো গভীর কালিতে দাগ কাটে, সেটা কখনো উঠানো যায়না। পূর্ণতার একাকীত্বের সময়গুলো কেমন বিষাদের ছায়াতে লিপ্ত ছিলো সেটা পূর্ণতার কান্নাই ব্যক্ত করছিলো থখন। পূর্ব স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকলেও বুকের কোথাও যেনো পুরোনো ক্ষতের তোলপাড় শুরু হয়েছে। চোখের কোলে বৃষ্টির মতো অশ্রুর আগমন হচ্ছে। গুমোটভরা পরিস্থিতি আবারও একটু আগের চান্ঞ্চল্যকর মূহুর্তে কনভার্ট করতেই পূর্ণতার শাড়িতে হাত দিলো পূর্ব। কান্নারত অবস্থায় চমকে উঠতেই পূর্বের দিকে তাকিয়ে সব শব্দ যেনো গুলিয়ে ফেললো। পূর্ব আচঁল টেনে এক ঝটকায় পূর্ণতাকে কোলে তুলে ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো,
– দিনশেষে তো আমরা একসাথে আছি। এবার নাহয় আপকামিং এমপির শয়নশয্যা গ্রহণ করো।
পূর্ব ওকে বেডের দিকে নিয়ে যেতেই পূর্ণতা চোখ মুছে হেসে দিয়ে বললো,
– ওয়াসিফ পূর্বের নামে ভোট দিলে কি সমস্যা হবে?
পূর্ব ওর দিকে এক চিলতে হাসি দিয়ে বেডে শুইয়ে বললো,
– ওটা কি তোমার এলাকায় পরেছে?
পায়ের কাছ থেকে মোটা কম্বলটা টেনে নিলো পূর্ব। পূর্ণতার উপর ঝুঁকে ওর দুপাশে হাত রেখে ঠিক মাঝখানে বন্দি করতেই পূর্ণতা কম্বলটা টেনে পূর্বের পিঠ ঢেকে দিয়ে বলে উঠলো,
– যদি ওই এলাকায় যেয়ে তোমার বউ হিসেবে ভোট দিয়ে আসি?
শব্দ করে হেসে উঠলো পূর্ব। গালে, কপালে, নরম ওষ্ঠের ভাঁজে স্পর্শ মিলিয়ে দিলো। পূর্ণতার প্রতিটি রন্ধ্রস্থলে স্পর্শের ভুবন ছড়িয়ে দিতেই পেটে আলতো ঠোঁট ছুঁয়িয়ে পূর্ব আস্তে করে অস্ফুট সুরে ফিসফিস করে বললো,
– তুমি পূর্ণতা কবির হিসেবে ভোট দিয়ে এসো। আমি ভোট কেন্দ্রের ওয়াশরুমে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। এমপি হওয়ার খুশিতে বউয়ের কাছ থেকে কয়েকটা মিষ্টিমুখ তো করতেই পারি তাইনা? দোকানের মিষ্টি..
পূর্ব কথা করতে আর শেষ করতে পারলো না। মাথার পেছনে আকস্মিক চাপ অনুভব করতেই ছিটকে পরলো ওষ্ঠযুগলের মায়ায়। পূর্ণতার আচানক কান্ডে মনেমনে পূর্ব বললো, আহা, প্রিয়তমা!! বুঝলাম তোমার আকুতি। মিটিয়ে দিবো তোমার বাসনা। আজ ওয়াসিফ পূর্ব তোমায় ছাড়ছেনা।
-‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO