#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১৮)
নুসরাত জাহান লিজা
শিউলি অফিস থেকে বাসায় এসে সাজিদের মা, ছোটবোন আর সাজিদকে বসার ঘরে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গেল। কোনোরকমে কুশল বিনিময় করে নিজের ঘরে চলে এলো। একটু পরে শেফালি এসে বললেন,
“হাত-মুখ ধুয়ে একটু আয় মা। ওরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতাসে।”
“মা, তুমি জানো না আমি এখন আর নতুন করে কিছু ভাবতে চাই না? তাইলে এসব কেন?”
“বুড়া বয়সে তাইলে দম আটকায়ে মরে যাবি তো। কথা বলার মানুষ কই পাবি তখন?” শেফালি ঠাট্টাচ্ছলে কথাটা বলে সিরিয়াস ভঙ্গিতে আবারও বললেন,
“একা থাকা খুব কঠিন রে মা। তাছাড়া তুই ওদের সাথে কথা বল। তারপর তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি তাই হবে। আয় মা।”
শিউলি মাথা নেড়ে মা’কে আস্বস্ত করে। খানিক পরে অতিথিদের মুখোমুখি এসে বসে। সাজিদরা ওদের সাথে তেমন অন্তরঙ্গ না হলেও একই এলাকায় বসবাসের সুবাদে কিছুটা হলেও আলাপ-পরিচয় আছে। শিউলি সাজিদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখল সে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, চোখে নির্ভরতা দেবার প্রতিশ্রুতি যেন। সাজিদের মা প্রথম বলতে শুরু করলেন,
“সাজিদের পাত্রী দেখতেছিলাম, তখনই তোমার কথা শুনে ও। এরপর জেদ ধরে বিয়ে করলে নাকি তোমারেই করব আর নাইলে করবই না। আমরা কেউই প্রথম প্রথম আসলে মানতে পারি নাই। একটা ডিভোর্সি মেয়ে… আবার মনে কইর না তোমারে খোঁটা দিয়ে কিছু বলছি। যা ঘটছে তাই বলতেছি সোজাসাপ্টা ভাবে। পরে ছেলে রাগ করে ঢাকায় চলে গেল। এক কথা, শিউলি ছাড়া সে বিয়ে করবে না। পরে আমরাও ভাবলাম, সেইখানে তো আর তোমার কোনো দোষ ছিল না। পরে আমরা রাজি হইলে সে পাক্কা দেড় বছর পরে ফিরল।”
টানা কথা বলে কিছুটা দম নিলেন তিনি, এরপর আবার বললেন, “তোমরা যদি আলাদা কথা বলতে চাও বলে নাও।”
কিছুক্ষণ পরেই শিউলির বারান্দায় এসে দাঁড়াল দু’জন। আজ বেশ রোদ, কয়েকদিন পরে সূর্য উঁকি দিয়েছে যেন ধরায়। মিষ্টি এই রোদ খুব ভালো লাগছে শিউলির। ওর মনটা প্রখর উত্তাপে দগ্ধ, সাজিদ কি এমন মিঠে রোদের পরশ ছুঁইয়ে দিতে পারবে!
“কথা বলছো না যে?” সাজিদের কথায় সম্বিতে ফিরল সে।
“হঠাৎ এমন পাগলামি শুরু করছিলা কেন?” শিউলির গলায় ভারিক্কি চাল।
“পাগলামি আগেও করেছি, শুধু তোমার চোখে পড়ে নাই।”
“চোখে পড়ছে অবশ্যই। কিন্তু তখন যদি আরেকটু সাহসী হতে তবে এসবের কোনো প্রয়োজন হতো না।”
“এখন তো হয়েছি।”
“তোমার করুণা চাই না সাজিদ। আমি নিজের মতো করে সব নতুন করে শুরু করেছি, আরেকবার ভেঙে পড়তে চাই না।”
“তোমায় করুণা করার শক্তি সাহস কোনোটাই আমার নেই শিউলি। আমি তোমাকে ভালোবাসার একটা সুযোগ চাই। তোমার সাথে মিলেমিশে হাসতে চাই, কাঁদতে চাই, পাশাপাশি চলতে চাই।”
“ন্যাড়া বারবার বেলতলায় যায় না, একবার মাথা ফাটিয়ে শখ মিটে গেছে আমার।”
“সবসময় বেল মাথায়ই পড়বে ভাবছো কেন? এবার আমি নাহয় নিজের মাথা বাড়িয়ে দেব।”
শিউলি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সাজিদের দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর বলল, “আমার সিচুয়েশনটা তো বুঝতেই পারতেছ। কিছুটা সময় লাগবে ভাবতে। হুট করে এমন একটা ডিসিশন নেওয়া এখন আমার জন্য সহজ নয়।”
“ভাবার আগে আমার ভালোবাসার কথাটা মাথায় রেখো, প্লিজ।”
সাজিদ বেরিয়ে গেলেও শিউলি জায়গা ছেড়ে নড়ল না। সামনের আম গাছের ডালে জোড়া শালিক বসে আছে। পরম নির্ভরতার বুনন তাদের মধ্যে। সাজিদকে হ্যাঁ বলতে পারলে বোধহয় মন্দ হয় না। জীবনকে আরেকবার সুযোগ দেওয়াটা অন্যায় নয় নিশ্চয়ই। সিদ্ধান্ত নিতে পেরে বহুদিন পরে স্বস্তির একটা শ্বাস টানল। আহ্! কী শান্তি!
***
অবন্তী মায়ের কাছ থেকে ওর খুব প্রিয় লাল শাড়ি চেয়ে নিয়ে এসেছে। রোকেয়া অত্যন্ত প্রসন্ন মনেই সেটা দিয়েছেন। মেয়ের মতিগতি এমনিতেই তিনি বুঝতে পারেন না, তাই এখন যেহেতু কোনো ঝামেলা না করে স্বপ্রণোদিত হয়েই শাড়ি পরতে চাইছে, তার আপত্তি করার প্রশ্নই আসে না।
অবন্তীর ছেলেবেলা থেকেই এই শাড়ির প্রতি একটা লোভ আছে। আগে ঘরের দোর আটকে এই শাড়ি বের করে পরত, আয়নায় নিজেকে দেখত। ছোট ছিল বলে ঠিকঠাক ভাঁজ করে রাখতে পারত না বলে মায়ের কত যে বকুনি খেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! আজ বহুদিন পরে প্রিয় শাড়িটি গায়ে জড়িয়ে খুব পরিপাটি করে মন মতো সাজুগুজু করে নিল। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় পহেলা বৈশাখে শেষবার এটা পরেছিল। এভাবেই সেজেছিল।
বাইরে যাচ্ছিল, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে। গেটের কাছে অয়নের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। অয়ন সেদিন অবন্তীর দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে সশব্দে হেসে বলেছিল,
“সর্বনাশ খুন্তি! এটা তুই? পেত্নীরা না স্বজাতি মনে করে তোকে সাথে করে নিয়ে যায়।”
অবন্তী স্বভাবসুলভ হিসিয়ে উঠে বলেছিল, “আয়না বলে একটা বস্তু আছে জানিস না?”
অয়ন আরও জোর দিয়ে হেসে বলেছিল, “তোর দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে তাইলে। ডাক্তার দেখা। নইলে কবে নিজের রূপের মিথ্যে বাহাদুরিতে আকাশে উড়ে যাস। আমরা তখন খুন্তিকে কই পাব?”
অবন্তী সেদিন আর বাইরে যায়নি। না চাইতেও অয়নের সামনেই কেঁদে ফেলেছে৷ এরপর একছুটে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে শাড়ি বদলে ফেলেছে। কত বার করে যে মুখে ঘষেমেজে সাজসজ্জা মুছে ফেলেছে। এরপর একান্ত প্রয়োজন না হলে কোনোদিন নিজেকে সাজায়নি।
অয়নটা বরাবরই এমন, অবন্তীকে কাঁদানোর জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারজন্য মারও খেয়েছে প্রচুর। কিন্তু সেদিন অবন্তী কিছুই বলতে পারেনি। ভেতর থেকে একরাশ গাঢ় অভিমান ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে প্রবল স্রোতে। তখনকার এই অকারণ অভিমানের মানে এখন সে খুব ভালো করে জানে।
অবন্তীর অবচেতন মন বোধহয় উৎকর্ণ হয়ে ছিল অয়নের মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে কিছু স্তুতিবাক্য শোনার জন্য। কিন্তু এতটা উপহাসে জর্জরিত হয়ে ভয়াবহ আশাহত হয়েছিল। চেয়েও স্বভাবসুলভ পাল্টা আঘাত হানতে পারেনি। তবে প্রথমবার তাকানোর সময় ক্ষণেকের জন্য অয়নের গভীর চোখে কিছুটা হলেও মুগ্ধতা দেখেছিল।
এত অপমানিত হবার পরেও অয়নের জন্য এই ব্যকুলতায় নিজেকে রীতিমতো বেহায়া মনে হচ্ছে। কিন্তু এই শেষবার একটা চেষ্টা না করে হাল ছাড়বে না। শাফিনের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা শুনলে অয়নের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? শাফিন দেখতে আসবে বলে অবন্তীর আয়োজনের ঘনঘটা দেখে সে একটু হলেও কি টলবে না? ঈর্ষায় কিংবা যন্ত্রণায়? এটাই যে অবন্তীর শেষ অস্ত্র!
***
অবন্তী অয়নের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল সে বেরুবার তাল করছে। একটুর জন্য ধরতে পেরেছে বলে স্বস্তি পেলো।
অয়ন আচমকা চোখের সামনে অবন্তীকে দেখে কিছুটা যেন জবুথবু হয়ে গেল বলে মনে হলো। অবন্তী হেসে বলল,
“আজ আবার পেত্নীর মতো লাগছে নিশ্চয়ই? বল না?”
অয়ন চোখ নামিয়ে নিতেই অবন্তী আবার বলল, “আজ শাফিনের পরিবার আমাকে দেখতে আসবে, জানিস? আচ্ছা, শাফিন তো আমাকে ভালোবাসে। আমাকে পেত্নীর মতো লাগলেও ও নিশ্চয়ই আমাকে অপছন্দ করবে না, কী বলিস? ভালোবাসার দৃষ্টিতে সবাই নাকি অপ্সরা?”
অয়ন পূর্ণ দৃষ্টিতে এবার অবন্তীর দিকে তাকাল। স্বভাবসুলভ গা জ্বালানো হাসি ফুটিয়ে বলল, “শাফিনের জন্য এত উতলা হইছিস যে হঠাৎ? তোরা নাকি খালি বন্ধু? আমি নাকি কুটিল মনের মানুষ। আমার চোখটাই পুড়ায়ে দিছিলি প্রায়!”
অবন্তীও তীক্ষ্ণ চোখেই তাকিয়ে আছে, অয়নের অনুভূতি খুব দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে যেন আজ। একবার মনে হচ্ছে সেখানটায় কিছুটা হলেও বিষাদে মাখামাখি, কিন্তু পরক্ষণেই কটাক্ষের মাত্রাটা অবন্তীকে ভস্ম করে দিচ্ছে।
অয়ন তীব্র কটাক্ষ হেনে আবার মুখ খুলল, “চিন্তা করিস না, শাফিনের তোরে পছন্দ হবে। বেচারা আশেপাশে মেয়েদের তেমন দেখেনি তো? যা সামনে দেখেছে তাই ওর কাছে অমৃতসম। তবে বেচারার কপাল খারাপ। তোর ঝাঁঝ সহ্য করতে করতেই বেচারার জীবন কয়লা হয়ে যাবে।”
অবন্তী আজ পুরোটাই নির্বিকার রইল। দৃষ্টির গভীরতা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মোটেও না। যেমন কুকুর তেমন মুগুর কথাটা আছে না? তুই যেমন, তোর সাথে তেমনই করি। শাফিনের সাথে আমার একটা ছিমছাম গোছানো সংসার হবে। ওর সাথে ঝাঁঝ দেখানোর দরকারই হবে না, তুই মিলিয়ে নিস।”
অয়ন আবার চোখ নামিয়ে নিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “একটা শুভ কাজে যাইতেছিলাম। দিলি দেরি করাইয়ে। ধূর, ভাল্লাগে না। যা তো।”
অবন্তী অনড় দাঁড়িয়ে রইল, কাতর গলায় বলল, “আজ শেষ সুযোগ অয়ন। আমাকে কিছু বলতে চাইলে বলে ফেল।”
অয়ন মুহূর্তকাল সময় নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইস্পাত-দৃঢ় গলায় বলল, “নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এমন ছ্যাবলামো করতেছিস কেন খুন্তি? এইসব তোর সাথে যায় না। নিজেকে আর এভাবে ছোট করিস না প্লিজ। আমার মনে কিচ্ছু নেই তোর জন্য, আগেও বলছি, তবুও তুই টিনএজ বাচ্চা মেয়েদের মতো আচরণ করছিস। তোর মধ্যে একটা দৃঢ়তা আছে, যেটাকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। কিন্তু এভাবে সেটাকে, সাথে নিজেকে খেলো করিস না। তোকে আমার ইদানিং এসব কারণে খুবই বিরক্ত লাগে।”
অয়ন কথা শেষ করেই ধাপধুপ করে বেরিয়ে গেলো। অবন্তী মাথা ঘুরিয়ে একবার তাকিয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু মুছে নিয়ে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল আর নয়, অনেক হয়েছে। যে ওর আবেগ, অনুভূতির মূল্য দিতে জানে না, তার জন্য কেন এই মিছে মায়া পুষে রাখা! শাফিন আর যাই হোক ওর আত্মসম্মানকে কটাক্ষ করবে না। সন্তর্পণে নিজের ঘরে চলে এলো। প্রতিজ্ঞা আগেও করেছিল, মনের সাথে পেরে না উঠে সেটা ভেঙেও ফেলেছে আজ। তবে এবার আর পিছুপা হবে না। সব মায়ার টান ছিঁড়ে ফেলার সময় এসে গেছে।
***
“তুই রাগ করেছিস, তাই না অন্তি?”
শাফিনের সাথে ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অবন্তী। দিনের অন্তিম মুহূর্তে দুই বন্ধু মুখোমুখি। কিন্তু আজ যেন আগের সেই সহজাত উচ্ছ্বাস নেই, তার বদলে কেমন অচেনা একটা দ্বিধা, সংকোচ এসে ভর করেছে সম্পর্কে।
“রাগ করা স্বাভাবিক না?”
“তা স্বাভাবিক আমি জানি। কিন্তু অয়ন তো তোকে পছন্দ করে না। তোর বাসায় যেভাবে পাত্রের সন্ধান চলছিল, আমি ভয় পাইছিলাম, তোকে না পাছে হারাইয়ে ফেলি। তুই তো রাজি হবি না, জানি। তাই বাধ্য হয়েই আন্টির শরণাপন্ন হইতে হইসে। তুই রেগে থাকিস না প্লিজ।”
কিছুক্ষণ থেমে শ্বাস টেনে বলল, “অয়নকে ভুলে যা। যে তোর মূল্য দিতে জানে না, তাকে জোর করে বাঁধতে গেলে তুই কষ্টই পাবি শুধু।”
“আর তোকে আমি ভালোবাসি না জেনেও তুই আমাকে বিয়ে করতে চাইছিস কেন? তুই কষ্ট পাবি না?”
“একবার সুযোগ দিয়েই দেখ?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টি শাফিনের চোখে।
“করুণা করতে চাইছিস?”
“সেই সাধ্য আমার কই? একে করুণা বলে আমার ভালোবাসাকে অপমান করিস না অন্তি। তুই রাজি না হলে সরাসরি বল, আমি আন্টিকে বুঝিয়ে বলি। তাও এভাবে বলিস না রে। আমার খুব কষ্ট হয়।”
এক ঝাঁক পাখি সুদূর অন্তরীক্ষে ডানা ঝাপটে বেড়াচ্ছে, কী মুক্ত স্বাধীন! ওই পাখিদের মতো মুক্ত আকাশে ডানা মেলে দিতে পারলে বুঝি ভালো হতো। পাখিদের নিশ্চয়ই এভাবে মন ভাঙে না!
“তোকে কিছুই করতে হবে না শাফিন। তোকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
শাফিনের চেহারায় আচমকা যেন রঙ ফিরে এলো। তবুও মুখে বলল, “ভেবে বলছিস তো? পরে পিছিয়ে গেলে কিন্তু আমি মরে যাব রে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবন্তী বলল, “ভেবেই বললাম।”
অপার্থিব খুশিতে শাফিনের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ‘হৈমন্তী’ গল্পের বিখ্যাত উক্তির মতো গলা ফাটিয়ে পুরো পৃথিবীকে বলতে ইচ্ছে করছে, “আমি পাইলাম। আমি ইহাকে পাইলাম।”
দুই মাস পরের একটা দিনকে অবন্তী আর শাফিনের বিয়ের তারিখ হিসেবে ধার্য্য করা হলো।
***
অবন্তীর সাথে শাফিনের নিয়মিতই ফোনে যোগাযোগ হয়৷ নতুন শুরুর আগে নিজেকে কিছুটা মানিয়ে নেবার প্রচেষ্টা কিংবা ব্যর্থতা ভুলে থাকবার একটা অভিসন্ধি।
শিউলির বিয়েতে সবার দাওয়াত থাকলেও বাবা আর বড়চাচা ছাড়া আর কারোর যাওয়া হয়নি। তবে অবন্তীর সাথে শিউলির বেশ সখ্যতা তৈরি হয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আর একদিন পরেই বিয়ে। অবন্তীর ভাই অনীক এসেছে, আরও কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন বাসায় এসে পড়েছে।
অবন্তী অয়নের ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখল বড়চাচী ব্যস্ত ভঙ্গিতে কিছু একটা খুঁজছেন সেখানে। সে গুটিগুটি পায়ে ঢুকল, কতদিন পরে এই ঘরে এলো। অয়নের দেশের বাইরে যাবার ব্যাপারে শুনেছে। তবে সেটা নিয়ে যতটা সম্ভব না ভাবার চেষ্টা করে গেছে। চাচীকে জিজ্ঞেস করল,
“চাচী, কিছু খুঁজতেছো?”
“হ্যাঁ রে, অয়ন সকালে ওর বাপের চিল্লানোতে ভুল করে একটা কী দরকারি কাগজ রেখে গেছে। এম্বাসীতে নাকি সেইটার নম্বর লাগব। ফোন করে বলল। আমি পাইতেছি না, একটু দেখ তো।”
অবন্তীর মনে টনটনে ব্যথা হলো। আগে সবসময়ই কিছু না কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে যেত, তখন ওকেই ফোন করত। নিজের ঘরে কিছু খুঁজে না পেলেও অবন্তীর কাছে সাহায্য চেয়ে চেয়ে অস্থির করে তুলত। এখন সে এতটা দূরের মানুষ যাকে নিজের চলে যাবার কথাটাও নিজ মুখে জানানো যায়নি!
“তোমার ছেলের ঘর যা জঙ্গল, এখানে কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তুমি ড্রয়ারে দেখছো?”
“ছেলেটা এমন যে কেন হলো? তুই একটু দেখবি মা?”
অবন্তী হাত লাগালো, খুঁজে বড়চাচীকে সেটা বুঝিয়ে দিতেই তিনি আচমকা বললেন, “আমার ছেলেরে আমি আগে থেকেই বুঝতে পারি না, কিন্তু এখন তুইও কেমন একটা হয়ে গেছিস! আগে সারাদিন একজন আরেকজনের পিছে লেগে থাকতিস। বাড়িটা প্রাণবন্ত ছিল। এখন একেবারে নিষ্প্রাণ। তোদের মধ্যে কি বড় কোনো ঝগড়া হইসে?”
অবন্তীর অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু এখন আর কী লাভ তাতে। হেসে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “আমি তোমার ছেলের এই ঘরে কিছুক্ষণ থাকি। ওর হাড় তো আর জ্বালাইতে পারব না। আজ কী করা যায় দেখি!”
প্রশ্রয়ের হাসি হেসে অবন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন, যেতে যেতেই অয়ন ফোন করল বোধহয়। বড়চাচী কথা বলছেন ফোনে। অবন্তীর চোখ পড়ল অয়নের গোপন ড্রয়ারে। আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে চাবি ঝুলছে। হয়তো সকালে এখানেই কিছু একটা করছিল অয়ন, এরইমধ্যে বড়চাচার হম্বিতম্বিতে ভুলে গেছে ঠিক করে লাগাতে কিংবা চাবি সরাতে।
অবন্তী আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুতপায়ে দরজা বন্ধ করে দিল, এরপর চাবি ঘুরিয়ে ড্রয়ার খুলল। প্রথমেই কুঁচ কুচে কালো পিস্তলটা চোখে পড়ল, তাতেই অবন্তীর মনে হলো ওর হৃদপিণ্ড যেন কেউ খামচে ধরেছে। অয়ন নিজেকে কীসের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে কে জানে! অজানা আশঙ্কা আর তীব্র এক ভয়ে ভেতরে ভেতরে সিঁটিয়ে গেল অবন্তী।
ভাঙা ব্যাটটা চিনতে পারল, আরও কত সব স্মৃতির টুকরোর মধ্যে কতক চিনল, কতক অচেনা। একটা ডায়েরি পেল। এমন ডায়েরি বড়চাচা তিনজনকেই কিনে দিয়েছিলেন। অবন্তীরটা খালিই পড়ে আছে প্রায়, অয়নেরটা উল্টেপাল্টে দেখল।
এরপর পড়তে শুরু করল, আস্তে আস্তে ডায়েরির পাতায় ডুবে গেল অবন্তী। যত এগুতে থাকল ততই যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কতক্ষণ লাগল জানে না, পড়া শেষ করে ডায়েরিটা বুকের সাথে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
যখন সম্বিতে ফিরল ততক্ষণে রাগের একটা স্ফুলিঙ্গ শিরদাঁড়া বেয়ে মাথায় চড়ে বসেছে। বহুদিন পরে নিজের মধ্যে চিরচেনা ভয়ংকর রাগের আভাস পেল। দাঁতে দাঁত চেপে একটা শব্দই কেবল অয়নের উদ্দেশ্যে বলতে পারল,
“মিথ্যেবাদী।”
…….
(ক্রমশ)