আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-১৬+১৭

0
174

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১৬)
নুসরাত জাহান লিজা

আনোয়ার সাহেবকে নিয়ে দু’দিন হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হলো, তার হার্টের সমস্যা বেশ কিছুদিন থেকেই, হাই ব্লাডপ্রেশার। ডায়াবেটিস নেই যদিও। ডাক্তার টেনশন করতে পুরোপুরি নিষেধ করে দিয়েছে। অয়নের কানে খবরটা পৌঁছাল অনেক পরে, যেদিন হাসপাতাল থেকে তাকে বাড়িতে আনা হয় সেদিন।

সেদিন রাগারাগি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পরে সে সানকিপারায় রনির মেসে গিয়ে ওঠে। বাসা থেকে ছোট চাচা আর অবন্তী অনেকবার কল দিলেও রিসিভ করেনি, ভেবেছে ওকে ফেরাতে কল দিচ্ছে। ফোন বন্ধ করে রেখেছিল, ফেসবুকেও যাওয়া হয়নি। আজ সকালে ফোন সচল করতেই টুং করে মেসেঞ্জারের শব্দ হলো বেশ কয়েকবার। অবন্তীর মেসেজে চোখ আটকে গেল। একদিন আগে সে লিখেছে,

“ফোন না ধরলে সেটা সাথে রাখিস কেন? এতগুলো মানুষ তোকে নিশ্চয়ই ঢং করতে কল দেয়নি? বড়চাচাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হইছে গতকাল। তুই যাওয়ার পরপর। পারলে আসিস।”

আরেকটা মেসেজ ডিলিট করা, হয়তো স্বভাবসুলভ কড়া ভাষায় কিছু লিখেছিল। পরে কিছু ভেবে মুছে ফেলেছে। অয়নের মনে গাঢ় কালো মেঘ ভীড় করল। সেদিন মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বলে মনে হলো নিজের কাছে। সেইসাথে উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করালো। আর একমুহূর্তও বসে থাকতে পারল না, উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলো।

বাসায় আসতেই অবন্তী দরজা খুলে দিল, চোখে আগুন ঝরছে। অয়ন সেই অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে ভেতরে চলে গেল। কাঁপা কাঁপা বুকে বাবা-মায়ের ঘরে এলো। আনোয়ার সাহেব কিছুই বললেন না, একবার শুধু মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে আবার চোখ বুজলেন। আগে অয়নকে দেখলেই তার চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠত, কিন্তু আজকের চাহনিতে সেই জ্বলন্ত আগুন ছিল না, কেমন নিষ্প্রভ ঘোলাটে একটা দৃষ্টি।

কোনো কথাও বললেন না। তার নীরবতা অয়নের হৃদপিণ্ডটা যেন খামচে ধরেছে। অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মনটা যেন প্রস্তুত হয়েছিল দুটো কড়া কথা শোনার জন্য, আজ যখন সেটা হলো না, খুব শূন্য লাগল। অয়নের বুকে কেমন খা খা হাহাকার বাসা বাধল। কেন তা জানা নেই।

***
ইদানিং অবন্তীর কাছে এই বাড়িটাকে একটা প্রেতপুরী মনে হয়। কেমন নিথর, নির্জীব হয়ে আছে। আগে প্রতিদিন সকালে বড়চাচার চিৎকার, চেচামেচিতে বাড়িটা মুখর থাকত। ইদানিং তিনি অত্যন্ত শান্ত হয়ে গেছেন। একটা কথাও প্রয়োজন ছাড়া বলেন না। যেটুকু বলেন তাও অত্যন্ত ধীর গলায়। সারাদিন কীসের চিন্তায় ডুবে থাকেন কে জানে! অয়নকেও কিছু বলেন না আর। একসময় যেটাকে বিরক্ত লাগত অবন্তীর, এখন মনে হচ্ছে সেটাতে অন্তত একটা প্রাণ তো পাওয়া যেত!

বড় চাচী আর মা দুপুরে আর সন্ধ্যার পরে কী চমৎকার গল্পের আসর বসাতেন, এখন সেটাও হয় না। রান্নাঘরে টুংটাং কাজের ফাঁকে জমে উঠিত আড্ডা। সব যেন বিলীন হয়ে গেছে। একেবারে অকস্মাৎ সবাই যেন নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে তাদের চলমান জগৎ থেকে। কোনো কিছুই তাদের উপর আর প্রভাব ফেলে না৷

সেদিন ক্যাম্পাসে রেখে আসার পর থেকে অয়নও ওর সাথে কথা আর বলে না। কখনো মুখোমুখি হয়ে গেলে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। এই তো গত পরশু ছাদে অয়নকে পেল, অবন্তী কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই ছেলেটা সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় নেমে গেল। অবন্তী মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল, তীব্র অপমানে, অবজ্ঞার অনলে দগ্ধ হলো। অয়নের সাথে ওর একটা খুঁনসুটির সম্পর্ক ছিল। নিজের মনের কথা বলাতেই কী আগের সম্পর্কটাও ভেঙে গেল! সে একেবারে অচ্ছুৎ হয়ে পড়েছে অয়নের কাছে!

মা তো সেই কবে থেকেই ওর সাথে ঠিক করে কথা বলেন না। বিয়ে ভেঙে দেবার পর থেকে মায়ের ক্ষোভ জমে আছে ওর প্রতি।

সবমিলিয়ে আচমকা ঝড়ে এই বাড়ির চলমান জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ কোনো এক বিস্তৃত সুদূরে হারিয়ে গেছে। আনন্দ সঙ্গীতের তাল কেটে গেছে, সেখানে কোনো সুর নেই, ছন্দ নেই, হাসি-আনন্দ কিচ্ছু নেই! কোথাও যেন বীণার সরু তাড় ছিঁড়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে ছোট্ট পরিবর্তন কিন্তু ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।

এই নিস্পৃহ জীবনে অনভ্যস্ত অবন্তীর ভেতরটায় হুহু করে উঠল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে।

***
শিউলির সময় এখন অন্য সময়গুলোর চাইতে ভালো কাটছে। তুহিনের সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তবে তুহিনের কেসটা এখনো চলমান, নারীপাচার চক্রের সাথে সে কতটা জড়িত, তাদের সাথে কীভাবে পরিচয় হয়েছে, আরও কোনো অপকর্মের সাথে জড়িত কিনা এসব নিয়ে তদন্ত চলছে।

সফুরা একদিন ফোন করেছিলেন শিউলিকে৷ খুব হম্বিতম্বি করলেন। এক পর্যায়ে বললেন, “তোমার এই অতিরিক্ত দেমাগই তোমার সর্বনাশ করব। আমার কোল খালি করার মতলব আঁটছো তুমি? তোমার জীবনেও ভালো হবো না।”

এমন শাপশাপান্ত করে ফোন কেটে দিলেন। শিউলি একজন মাতৃস্নেহে অন্ধ মহিলার কথায় কান দিল না। সে নিজের মতো ভালো থাকার চেষ্টা করছে। বাইরের কত মানুষ নানা কথা বলে, বলছে, তাতে কী! তাদের কথায় কান দিয়ে থেমে যেতে আছে নাকি! তাদেরটা খায়ও না পরেও না। তাহলে তাদের এতটা গুরুত্ব কেন দেবে নিজের জীবনে? এমনিতেই করার মতো কত কাজ পড়ে আছে, সেসব ফেলে সারাক্ষণ অন্যকে নিয়ে চর্চা করার মতো সময় কোথায় পায়! এত সময় মানুষের হাতে!

কাছের মানুষগুলো ওকে কতটা ভালোবাসে এটাই সে শুধু অনুভব করে মর্মে মর্মে। এদের জন্য হলেও তো নিজেকে দাঁড় করাতে হবে!

ইন্টারমিডিয়েট পাশ যোগ্যতার সার্কুলার দেখে দেখে এপ্লাই করতে শুরু করল, কিছু জব সল্যুশনসের বই কিনে দিয়েছে শাফিন। সেসব পড়তে শুরু করল। প্রথম দিকে মাথায় কিছু ঢুকল না, মন বসাতে পারত না। পড়ালেখা আগেও সেভাবে ভালো লাগেনি কোনোদিন। তার উপর বহুদিন চর্চা নেই। চাকরির বয়সও আর বেশি নেই। দেড়, দুই বছর হাতে আছে। শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে পড়তে শুরু করল। একসময় মন বসে গেল।

অল্প কয়েকটা জব এক্সামও দিল কিন্তু টিকল না। তবুও লেগে রইল। বিকল্প কিছু ভেবেছিল, কিন্তু সেসবের জন্য বেশ ভালো অঙ্কের পুঁজি প্রয়োজন। তাই সাহস করেনি। বাবা, মা আর শাফিন অনেক বড় শক্তি হয়ে রইল ওর ভেঙে পড়া জীবন গুছিয়ে দেবার ক্ষেত্রে।

***
সফুরা প্রথমদিকে শিউলির উপরে খুব রেগে গিয়েছিলেন। বিড়বিড় করে সারাক্ষণ অভিশাপের বুলি আওড়ে গেছেন। কিন্তু কোর্টে কেস উঠার পরে উনি বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খান। ছেলে তাকে একলা ফেলেই পালাতে চেয়েছিল! যে ছেলের পেছনে তিনি নিজের জীবনের পুরো সময়টা ব্যয় করেছেন, সেই ছেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল অপকর্ম করে গা ঢাকা দেওয়া। সেখানে তিনি কোথায় ছিলেন!

একটা প্রবল ধাক্কায় তার মোহভঙ্গ হলো। মেয়ে থাকা সত্বেও তিনি যেন ছেলেকেই সবসময় অন্ধের ষষ্টী হিসেবেই দেখতেন। মেয়েকে দিতে কমতি রাখেননি তবুও ছেলের প্রতি তিনি একচোখা পনা করতে কার্পণ্য করেননি। দুই ভাইবোন ছেলেবেলায় ঝগড়া, মারামারি করলেই তিনি মেয়ের দিকে আঙুল তুলে তাকেই বরং সাবধান করেছেন।

ছেলেবেলায় তুহিন স্কুলে পড়ার সময়, বা পাড়ার মাঠে খেলতে গেলে গণ্ডগোল বাধলে কেউ যদি তুহিনের নামে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসত তবে তিনি ছেলের দোষ তো শুনতে চাইতেনই না, উল্টো অভিযোগকারীকেই কত গালমন্দ করেছেন। এসব নিয়ে অনেক অভিভাবকের সাথে তার তুমুল কথা কাটাকাটি হয়েছে।

এখন তার আফসোস হচ্ছে, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেই শিক্ষাটা যদি ছেলেকে দিতে পারতেন! তবে আজ এমন বিপর্যয় তার জীবনে আসত না। চোখে অন্ধ স্নেহের ঠুলি সরে যেতেই বুঝলেন কী ভীষণ ভুলের মধ্যেই না বসবাস করেছেন!

শিউলির সাথে ছেলের করা অন্যায়গুলো চোখের সামনে দেখেও দেখেননি। একটা নারী হয়েও তিনি অন্য মেয়ের কষ্টে সমব্যথী হননি। বরং ওই মেয়েকেই কেমন করে গালমন্দ করেছেন! তার আজ সন্তাপের সীমা নেই। নিজের বিবেকের আয়নায় আজ চোখ মেলে তাকাতে পারছেন না। মাটিতে মিশে যাচ্ছেন। অন্ধ মাতৃস্নেহ ভয়ংকর জিনিস! যার প্রতি এই উদ্দাম স্নেহ তাকেই শেষ করে দিতে পারে অনায়াসে।

তুহিনের বিরুদ্ধে সব তদন্ত শেষে শুনানিতে তার অপরাধের ব্যাপারে নারী নির্যাতন, পাচার, জুয়া এসব এলো। রায় হলো সাত বছরের জেল। সফুরা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেন।

অনেক ভেবেচিন্তে শিউলিকে ফোন করলেন, “মা রে, আমারে মাফ কইরে দিস। অতি আদরে পোলাডা কবে যে অমানুষ হয়ে গেছে বুঝি নাই। তোর সাথে অনেক অন্যায় করছি। পারলে এই বুড়ি মায়েরে ক্ষমা করে দিস। অনেক খারাপ খারাপ কথা বলসি। মনে রাখিস না।”

শিউলি বলেছিল, “আপনি আপনার ভুল বুঝতে পারছেন। এইটাই অনেক। তবে অন্ধ হয়ে গেলে সাদা জিনিসও কালো দেখা যায়। তখন সূর্য উঠলেও চোখে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আপনার চোখের পর্দা সরছে, আমি খুশি হইছি।”

সফুরা ফোনেই কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলেন, এরপর রেখে দিলেন। তার মেয়েটা তাকে ওর সাথে যেতে বলেছে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এই শেষ বয়সে এসে মেয়ে জামাইয়ের ঘাড়ে বসতে চান না। একলা মানুষ তিনি, জীবন চলেই যাবে। কয়দিনই আর বাঁচবেন! শেষ বেলায় এসে কারোর যেন অন্যের উপরে যেন পড়তে না হয়, এমন দোয়া করলেন সফুরা৷

***
সময় যেন চোখের পলকে বয়ে গেল। দেখতে দেখতেই কেমন দুই বছর গড়িয়ে গেল প্রায়। অবন্তী বাড়ির সেই দমবন্ধ পরিস্থিতির সাথেই খাপ খাইয়ে নিয়েছে কিছুটা হলেও। পড়ালেখায় আগের চাইতে বেশি সময় দিচ্ছে। মাস্টার্স প্রায় শেষ। থিসিস সেমিস্টার চলছে। এখন এমনিতও ভয়াবহ ব্যস্ত। সুপারভাইজার স্যার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কারেকশন দিচ্ছেন। সেসব নিয়ে কাজ করতে করতেই প্রাণ জেরবার। সময় তো কেটেই যাচ্ছে। থেমে নেই কিছুই, তবুও অনুভূতিগুলো কিংবা ভারী দীর্ঘশ্বাস সবটা একই রকম আছে, বদলায়নি কিছুই।

বিসিএসের প্রিলিতে টিকেছিল, রিটেনে টিকতে পারেনি। তবে শাফিন রিটেনে টিকেছে, কদিন আগেই রেজাল্ট হলো। সামনে ভাইভা। এই সেমিস্টারে সে থিসিস জমা দেবে না। পরের সেমিস্টারে দেবে। থিসিস দিয়ে দিলেই আর হলে থাকতে পারবে না। এই মুহূর্তে মেসে উঠে, বা সব গুটিয়ে বাসায় চলে যাওয়া সম্ভব নয়। গেলে পড়াশোনা হবে না। একেবারে ভাইভা দিয়ে তারপর পরের কথা ভাবা যাবে এমনটাই বলেছে অবন্তীকে।

অবন্তী স্যারের চেম্বার থেকে বের হতেই দেখল শাফিন দাঁড়িয়ে আছে।
“বাব্বাহ্! তোরে তো এখন দেখাই যায় না। কী অবস্থা?”

“অবস্থা ভালোই। তোর সাথে দেখা করতে আসলাম। এক সপ্তাহ দেখা হয় নাই। হাঁসফাঁস লাগতেছে। চল, জব্বারে যাই।”

“আচ্ছা, চল।” অবন্তী খেয়াল করেছে বেশ কিছুদিন ধরে শাফিন উশখুশ করে, কিছু একটা যেন বলতে চায়, কিন্তু বলে না। প্রেমে টেমে পড়েছে নাকি! জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবল অবন্তী।

“তোরে একটা সুখবর দেই, শিউলি আপুর একটা চাকরি হইসে। খুব বড় না, তবে ওর নাকি ভাল্লাগছে। সময় কাটতেছে।”

“দারুণ খবর! তুই আগে বলিস নাই তো?”

“ভাবলাম একবারে দেখা করে বলব।” হেসে বলল শাফিন।

“ট্রিট দে দোস্ত। এত খুশির খবর দিলি খালি মুখে?” অবন্তীর গলায় কপট অভিমান, মুখে মিষ্টি হাসি।

“ট্রিট তো দিবই। বল কী খাবি?”

“আপাতত দুধ চা। পরেরটা পরে দেখা যাবে। সারাজীবন আমি বিল দিছি চায়ের বিল। আজকেরটা তুই দিবি!”

“অবশ্যই মহারানী। যথা আজ্ঞা। চলুন।” নাটকীয় একটা ভঙ্গি করল শাফিন। অবন্তী খুব হাসল। বহুদিন পরে সে এমন প্রাণ খুলে হাসতে পারল।

অবন্তী আগে আগে হাঁটছিল, শাফিন একটু পেছনে। বিকেল গড়াচ্ছে, লালচে সূর্যটা ডুবি ডুবি। সূর্যের এক চিলতে লালচে আলো অবন্তীর মুখে এসে পড়ছে, গাছের সাড়ির উপর দিয়ে সূর্যটা ঘরে ফিরছে। কণে দেখা আলোয় সবকিছু স্নিগ্ধ লাগে অবন্তীর চোখে।

সহসা দুই কদম পিছিয়ে থাকা শাফিনের কথা শুনে অবন্তী চমকে উঠে থমকে দাঁড়ায়! হতভম্ব ভাব কিছুটেই কাটছে না। শাফিনের গলায় কথাটা আবার ভেসে এলো,

“আমাকে বিয়ে করবি, অন্তি?”
………..
(ক্রমশ)

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১৭)
নুসরাত জাহান লিজা

শাফিনের কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন সহসাই থমকে গেছে। এই চমৎকার গোধূলি বিকেল, এইমাত্র পাশের রেললাইন ধরে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা ট্রেনটা, ঘরে ফেরার জন্য উদ্যত কর্ম ক্লান্ত জনমানব, উড়ে চলা পাখিরা সব যেন ওর মনের সাথে সাথে স্থির হয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে আছে সময়টা, ঠিক যেন ওর হৃদপিণ্ডটার মতো।

কত সময় গেল সে জানে না, তবে মনে হলো এক মহাকাল পরে যেন অবন্তী ঘুরে তাকালো, চোখ তুলে শাফিনের চোখে চাইল। ঠিক যেন বনলতা সেনের চাহনি, চমকে উঠল শাফিন! শ্যামলা বর্ণের অবন্তীর নাটোরের বনলতা সেনের পাখির বাসার মতো চোখ দুটোতে এক পৃথিবী দ্বিধা, নাকি অভিমান, ক্ষোভ কিছুই বুঝতে পারল না, তবে এটুকু বুঝল আশঙ্কাটাই সত্যি হয়েছে হয়তো!

মস্ত ভুল করে বসেছে, এবার বন্ধুত্ব টিকবে কিনা তার অনিশ্চয়তায় গুমরে উঠল হৃদয়টা! রাশি রাশি প্রগাঢ় নীল ব্যথারা হৃদপিণ্ড চিড়ে কিলবিলিয়ে গলার কাছে উঠে আসতে লাগল। অবন্তীর কথা কানে যেতেই মূর্ত অনুভূতি ফিরে এলো, মোহভঙ্গ হলো।

“শাফিন, তোকে কি আমি কখনো নিজের অজান্তে এমন কোনো ইঙ্গিত দিয়েছি? বল না? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কত কথাই তো বলেছি তোকে, ভুলবশত তেমন কোনো ইশারা পেয়েছিস কি আমার দিক থেকে?”

শাফিন বুঝল অবন্তী নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তাই নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, “তুই মিছেমিছি এসব ভাবছিস অন্তি! তুই কোনোদিন আমাকে এমন কিছু ইশারা দিস নাই রে। আমিই বোকার মতো তোরে ভালোবেসে ফেলছি। অবশ্য আমার কাছে একদমই বোকামি নয়, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর আর মিষ্টি অনুভূতির একটি। কিন্তু তোকে বলাটা বোধহয় ঠিক হয় নাই।”

স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও শাফিন নিজেকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না, সব হারানো নিঃস্ব কোনো মানুষ মনে হচ্ছে তার। দৃষ্টি আবছা হয়ে আসছে, অন্ধকার নামার আগেই সামনে দাঁড়ানো অবন্তী আড়ালে পড়ে গেছে, কয়েক বিন্দু রঙহীন তরলের আড়ালে।

“তোকে একটা প্রশ্ন করি অন্তি?”

“কর? একটা প্রশ্ন করার আগে পারমিশন নিতে হবে, তোর সাথে আমার এমন সম্পর্ক বুঝি?”

শাফিন জানে এরপর যতবার অবন্তীর সামনে আসবে এই অস্বস্তিকর বিষয় সামনে চলে আসবে, চেতনে কিংবা অবচেতনে। স্বচ্ছ নদীর মতো বয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের পথচলা বুঝি এতটুকুই ছিল, নদীর গতিপথ বুঝি দু’দিকে বেঁকে যাচ্ছে এখান থেকেই।

“তুই কাউকে ভালোবাসিস?”

অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল শাফিনের গলাটা। অবন্তীর গলায়ও একই সুর।
“আয়নকে ভালোবাসতাম।”

অপ্রত্যাশিত মনে হলো শাফিনের কাছে, তবে অবিশ্বাস করল না।
“বাসতি বলছিস কেন? এখন বাসিস না?”

“ও আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছে। আমাকে নিয়ে নাকি তেমন কিছু ভাবে না।”

“আমাকে আগে কোনোদিন বলিসনি তো? তাহলে হয়তো এই ভুলটা করতাম না।”

“সাহস হয়নি। আজ আমার কী মনে হচ্ছে জানিস? মানুষ বোধহয় বেশিরভাগ সময় ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলে। বিপরীত প্রান্তের মানুষটার মনে হয়তো আমাদের নিয়ে ভাবনার লেশমাত্র থাকে না, কিন্তু আমরা তাদের নিয়ে আমাদের গোটা পৃথিবীটাকে কী সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলি!”

নিগূঢ় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অবন্তীর বুক বেয়ে। আবারও বলতে লাগল, “যখন সত্যিটা সামনে এসে দাঁড়ায় তখন কাঁচের তৈরি সেই পৃথিবীটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে যায়! তোর কষ্টটা আমি বুঝি শাফিন। আমার কষ্টটাও তোরই মতো।”

অবন্তীর কথাগুলো শাফিনকে স্পর্শ করতে পারল না। অয়ন তো রাজি হয়নি, তবে অবন্তী কেন তাকে একই কষ্ট দিচ্ছে! ইচ্ছে করলেই তো সে রাজি হতে পারে। ওই মেয়ের কষ্টে সে কি প্রলেপ দিতে পারত না, তার ভালোবাসা দিয়ে! অয়নের প্রতি ঈর্ষার একটা কাঁটা যেন খঁচ করে বিঁধল শাফিনের হৃদয়ে।

“অয়ন কি তোর জীবনে ফিরে আসবে তোর ভালোবাসা উপলব্ধি করে?”

“হাহ্! অয়ন অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা ছেলে শাফিন। বারবার সে আমার ক্ষতে আঘাত করেছে। এখনো সুযোগ পেলে তা হাতছাড়া করে না! আমাকে পুড়িয়ে ওর শান্তি।” করুণ একটা হাসি ঝুলছে অবন্তীর ঠোঁটের কোণে! নিজের প্রতিই যেন কটাক্ষ তাতে।

“তাহলে কীসের এত প্রতীক্ষা? আমি অপেক্ষা করব তোর জন্য। যদি অয়ন ফিরে না আসে, যদি অন্য কাউকে বিয়ে করিস তবে সবার আগে আমাকে মনে করিস। সেটা যেন আমিই হই।”

অবন্তী কথা বাড়ায় না, একটা রিকশা থামিয়ে তাতে উঠে হুট তুলে দিল, রিকশা চলতে শুরু করল। সেই রিকশা দৃষ্টির সীমানায় যতক্ষণ থাকল নির্নিমেষ সেদিকে তাকিয়ে রইল।

একটা সোনা ঝরা লালচে বিকেল নিমিষেই কেমন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। এই হেমন্তেও সবটুকু কালবৈশাখী মেঘ যেন শাফিনের পুরো মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

***
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও অয়ন নদীর ধারে বসে আছে। হালকা ঠান্ডা আবহাওয়া পড়তে শুরু করছে। সান্ধ্য শিশিরের উপরে পা মেলে বসেছে সে। আশেপাশে বেশ লোক সমাগম। তবে তারা কেউই অয়নের কেউ নয়। সে এই বিশাল জনারণ্যে একেবারে জনহীন। কী ভীষণ একা!

এখন আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হয় না। ঘরটা একটা বিশাল কারাগার বলে মনে হয়। মন যতই ভাঙা থাকুক, বাইরে থাকলে ডানা মেলে দেওয়া যায় মুক্ত আকাশে, কিছু বিষাদের ভারও বুঝি চাপিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু বদ্ধ প্রকোষ্ঠ যে বড্ড অপছন্দ অয়নের।

অয়ন মনস্থির করে ফেলেছে দেশের বাইরে চলে যাবে। যাকে দেখলে হাহাকার বাড়ে তার কাছ থেকে বহুদূরে চলে যাবে! বাসায় কাউকে বলা হয়নি। বলার সময় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। মহিউদ্দিন ভাইয়ের কিছু ছোটখাটো কাজ করে দেবার সুবাদে বেশ ভালো অঙ্কের টাকা আছে হাতে। যদিও কাজটা তেমন সুখকর কিছু নয়, আবার এতটা খারাপও নয়। বাকি টাকা বাবার কাছ থেকে বলে নিতে হবে। তিনি রাজি হবেন কিনা সেটা হলো কথা।

তবে যাবার আগে অবশ্যই জুনায়েদের একটা ব্যবস্থা করে যেতে হবে, নয়তো অবন্তীর বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। বাসায় যেভাবে তোরজোর চলছে পাত্র দেখা নিয়ে, তাতে বলা যায় সেটা খুব শীঘ্রই তা ঘটবে। অদৃশ্য একটা দায়িত্বের ভার হাতবদল করবে সে, কেউ কোনোদিন জানবেও না গভীর আস্থা দেবার জন্যই একটা অদেখা বন্ধনীতে বেঁধে রেখেছিল, আগলে রেখেছিল নিজের অংশ বলে মনে করা মেয়েটাকে। সে যে বড্ড অপারগ, লক্ষ্মীছাড়া, বাঁধনহারা। এর বেশি আর কীই-বা করার সামর্থ্য আছে তার!

জুনায়েদের সাথে বড় রকমের হাতাহাতির পরে কয়েকমাস তেমন কিছুই ঘটেনি। এরপর হঠাৎ লাপাত্তা। পরে অয়ন খোঁজ নিয়ে জেনেছিল ঢাকায় জুনায়েদের বাবার কী একটা নতুন ব্যবসা শুরু করা নিয়ে নাকি খুব ব্যস্ত ছিল। সেখানেই প্রায় আট-নয় মাস ছিল। দুই মাস হলো আবার ফিরে এসেছে। যদিও সেভাবে কিছু বলেনি, তবে ক্ষ্যাপাটে হাসি হেসেছে অয়নকে দেখে৷ অয়ন সেটা সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে। তবে সরাসরি কিছু বলতে এলে ছেড়ে কথা বলবে না অয়ন। এটুকু সে জানে।

***
অবন্তী এবার ভেতরে ভেতরে আরও খানিকটা গুটিয়ে গেছে। শক্ত খোলসের আবরণে নিজেকে গেঁথে ফেলেছে। আরও চার মাস চলে গেছে। অবন্তীর মাস্টার্স শেষ হয়েছে। শাফিনের চূড়ান্ত রেজাল্ট দিয়েছে গতকাল। পিএসসি’র চূড়ান্ত গ্যাজেটে নাম এসেছে। অবন্তী প্রথমে খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু সেটা মিলিয়ে গেল মায়ের কথায়।

“শাফিন তোর এত ভালো বন্ধু। আশা করি এইবার আর আপত্তি করবি না। তোর পড়াশোনা শেষ। সেই বাহানাও আর দিতে পারবি না।”

হতচকিত হয়ে কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল অবন্তী। শাফিন কীভাবে মায়ের চিন্তায় এলো সেটা সে ভেবে পেল না।

“এগুলা কী বলতেছো আম্মু? নিশ্চিত তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ, আমার মাথা তো সারাজীবনই খারাপ। তোর, তোর বাপের আর অয়নের মাথা সুস্থ আছে খালি, তাই না?”

“আম্মু, তুমি সব কথার মধ্যে অয়নরে নিয়ে আসো কীসের জন্য?”

“কেন রে? অয়নের কথা বললেই তোর গায়ে এত ফোস্কা পড়ে কেন?”

“ছিঃ আম্মু! আমি ভাবতেই পারতেছি না তুমি…”

“যা সত্যি তাই বলি। চুলে পাক ধরতেছে তো এমনি এমনি? অনেক কিছু দেখি আমি।”

অবন্তী কিছু বলল না আর। বিরক্ত লাগছে খুব। রোকেয়া বললেন, “শাফিন কাল যখন মিষ্টি নিয়ে আসছিল, তখন প্রস্তাব দিয়ে গেছে। ছেলেটাও ভালো, বুদ্ধিমান, ঘরেরটার মতো উড়নচণ্ডী না। জীবন কী, সেটা খুব ভালো চিনে। এই শুক্রবার ওর পুরা ফ্যামিলি আসব তোরে দেখতে। এইবার কোনো গাইগুই করবি না খবরদার।”

শাফিনের উপরে রাগ হচ্ছে, এতদিন যেটুকু সহানুভূতি ছিল তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অবন্তীকে জিজ্ঞেস না করে বাসায় মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সাহস ওর কী করে হলো! পরশু রাতে শুধু একবার কথা হয়েছিল শাফিনের সাথে। বলেছিল, অয়নের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন নেই। অবন্তীর বিয়ের জোর আলোচনা চলছে। তাতেই প্রশ্রয় পেয়ে গেল? দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে হলো। এই ছিল বন্ধুত্ব!

শাফিনের নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েও করল না। আগে নিজের মাথা ঠান্ডা হোক। এখন কিছু বলবে না। সামনাসামনি বুঝিয়ে বলতে হবে। অবন্তী নিজের পাগুলে রাগকে নিজেই ভীষণ ভয় পায়। তাই এই অপেক্ষা। যেদিন দেখতে আসবে সেদিনই শাফিনের সাথে খোলাখুলি কথা বলবে বলে ভাবল অবন্তী।

তার আগে শেষবার অয়নকে বাজিয়ে দেখতে হবে! ছেলেটার মন পৃথিবীর সবচাইতে জটিল গোলকধাঁধা। তাতে আঁতিপাঁতি হাতড়ে যদি একফোঁটা জায়গা জুড়ে নিজেকে পাওয়া যায়!

কুহকিনী যেন হাতছানি দিচ্ছে অবন্তীকে! মিথ্যে জেনেও পিছু নেবার বড্ড সাধ হলো!
……..
(ক্রমশ)