সঞ্চারিণী
আফনান লারা
১৬.
-‘নিজেকে দোষী বানাতে চাও নাকি আমার চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা করছো?কোনটা সঠিক?’
-‘আপনার কি মনে হয়?আমি হাতে ব্যাথা পেয়ে বলে দেবো যে আমি কি করেছি?’
শাওন মেধার হাত ছেড়ে দিলো।নিজের কোটটা ঝাঁকিয়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে বললো,’তুমি কিছুই করোনি।’
কথা শেষ করে চলে গেলো শাওন।মেধা ওর শেষ কথাটা ঠিক বুঝলোনা।এত কিছু ইঙ্গিত দিয়ে বলার পরেও সর্বশেষে সে এটা কি বলে গেলো?সত্যি কি বিষয়টাকে সে এতটা ছোটখাটো হিসেবে ধরে নিলো নাকি এর পেছনে তার অন্য প্ল্যান কাজ করছে।হাতের টিস্যুটাকে নিচে ফেলে একটা দিয়াশলাই কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে টিস্যুটাকে জ্বালিয়ে ফেললো মেধা।তাকে খুব শীঘ্রই একটা বড় লড়াইয়ে নাম দিতে হবে।একান্তই নিজেকে রক্ষা করার লড়াই।
-‘আজ যারা তাকে রেখে সবাইকে মারতে চেয়েছে কাল তারাই এসে সবার আগে আমাকেই মারবে।এটা আমি জানি।একটা ক্লিপের জন্য কতটা হিংস্র হতে পারে।যাই হোক না কেন ঐ ক্লিপের বর্তমান ঠিকানা সম্পর্কে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না আর জানবেও না।’
——-
শাওন রুম থেকে বের হতেই রায়হান এসে জানালো কদিন আগে মাঝরাতে যেসব আসামি ধরা পড়েছিল তারা নাম নিতে প্রস্তুত। যে ওদের সেইরাতে গুলি করেছিল তার নাম বলতে চায় তারা।শাওন বললো আজ রাতে যাবে দেখা করতে।এখন কাজ হলো আহত হামলাকারীদের থেকে কথা বের করা।মোট ছয়জন এসেছিলো আজ হামলা করতে।সবাই আহত হয়ে কাঁতরাচ্ছে ফ্লোরের উপর।সবার হাত বেঁধে রাখলো রায়হান আর নুহাশ মিলে।শাওন ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
দু মিনিট ধরে সবাইকে দেখলো এক এক করে, তারপর বললো,’তোমাদের বস কে?’
কেউ উত্তর দিচ্ছেনা দেখে শাওন একটা ধমক দিয়ে একজনের কপালে গান তাক করে বললো,’উত্তরের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছি।সেই উত্তরই যদি না পাই তাহলে তোমাদের রেখে আমার কি লাভ?’
যার কপালে শাওন গুলি তাক করেছিলো সে নড়েচড়ে কি যেন বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা।মূহুর্তেই সে মারা গেলো।তাকে বিষ দেওয়া হয়েছিলো।মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হয়ে তৎক্ষনাৎ সে মারা গেলো।শাওন পিছিয়ে গিয়ে ডাক্তারকে ডাকতে বলেছে।ডাক্তার এসে বললেন সে মারা গেছে।শুধু তাই নয়।মাত্র তিন মিনিটের ব্যবধানে বাকি যারা ছিল তারা সবাই মারা গেছে।সবাই বিষের কারণে মারা গেলো।শাওন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে ছুটে গেলো কন্ট্রোল রুমে।নুহাশ চেয়ার টেনে বসে আধ ঘন্টা আগে রিভাইস করলো ভিডিওটাকে।ঐ ছয়জন বাদে সন্দেহ করার মতন কাউকেই নজরে পড়লোনা।তার মানে দাঁড়ায়, তারা এখানে আসার আগেই বিষপান করেছিলো।
শাওন টেবিলে জোরে হাত রেখে বললো,’একের পর এক প্রমাণ লোপাট করে যাচ্ছে ঐ খুনি।আর আমরা হাতের উপর হাত রেখে দেখে যাচ্ছি।এখন মনে হচ্ছে নিজেই নিজের সাথে আলাপ করা যাবেনা পরবর্তী প্ল্যান নিয়ে।’
-‘শাওন আমার মনে হয় খুনিটা কোনো সিরিয়াল কিলার হবে।’
-‘সেটা না।সে শুধু তার পাঠানো লোকদের মেরেছে।মানে যাদের দিয়ে আমাদের মারতে চায় তাদের আগে থেকেই বিষ খাইয়ে পাঠায় যাতে আমরা ওদের ধরলেও তাকে যেন ধরতে না পারি।এমন বিষ খাওয়ায় যেটার কিনা রিয়েকশান দেখা দেয় এক ঘন্টার ভেতরে।
তার এত ভয় কিসের?অপরাধ করার সময় মনে ছিলো না?একের পর এক খুন করে যাচ্ছে।দুটো খুনের বোঝাকে ঢাকতে সে এতগুলো খুন করলো।একে যত জলদি হোক নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হবে’
—–
মেধা অফিসের পোশাক পরে বের হতেই সামনে পড়লো সামিয়ার।অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে।পারছেনা মেধাকে কাঁচা গিলে খাচ্ছে এখনই।রাগে ফু্ঁসতে ফুঁসতে সে বললো,’আমি জানতে চাই তুমি এমনটা কেন করলে?আমাকে ওয়াশরুমে আটকালে কোন সাহসে?কাল দায়িত্ব টা শাওন স্যার নিজে আমায় দিয়েছিল।তুমি কোন অধিকারে ছিনিয়ে নিলে দায়িত্বটা?সবার কাছে বড় হতে চাও তাই না??কি ভাবো নিজেকে?আমি এই ব্রাঞ্চের একজন অফিসার বিগত দু বছর ধরে।কতগুলো কেসে আমি লড়েছি জানো তুমি?তুমি অফিসে জয়েন করেছো কতদিন হলো?’
-‘দেখো সামিয়া আপু,তুমি বামহাতি।তোমার পক্ষে এতগুলো মানুষকে একা হাতে সামলানো সহজ হতোনা’
-“শাওন স্যার,রায়হান,নুহাশ,সাজিদ মিলন ওরা কি ছিল না?একা আমি শুট করতাম?’
-“হ্যাঁ।কারণ আজ তো কি হয়েছিলে তুমি জানোই।শাওন স্যারকে শুট করেছিলো তারা।বাধ্য হয়ে সবাই আত্নরক্ষার জন্য লুকিয়ে পড়েছিলো মূহুর্তেই।’
-‘কথা ঘুরাবেনা।আর কখনও আমার কাজে মাথা ঘামাতে আসবেনা।তুমি তোমার কাজ করো আর আমি আমার কাজ।এরপর যেন তোমাকে আমার সামনে না দেখি’
ঝাড়ি দিয়ে সামিয়া চলে গেলো।মেধা ওর এত লম্বা ভাষণ এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে ফেলেছে।সামিয়া না বুঝে এসব বলছে তাই আর গভীরে গিয়ে ভাবলোনা মেধা।তার কাছে ভাববার জন্য আরও অনেক বিষয় আছে।
তখন থেকে ফোন রিং হচ্ছে অথচ কোন জায়গায় মেধা ফোন রেখেছিলো তাই ভুলে গেছে। সব জায়গায় ব্যস্ত হয়ে খুঁজছে সে এখন। ফোনও বেজে যাচ্ছে।শেষে সোফার নিচে পেলো।ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার থেকে কল।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অট্টহাসি শোনা গেলো।ওপারের মানুষটা হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে।মেধা চুপ করে তার হাসি শুনছে।লোকটা হাসি থামিয়ে বললো,’তো অফিসার মেধা।কেমন আছেন?’
মেধা কিছু বলার আগেই শাওন ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে কানে ধরলো।মেধা অপ্রস্তুত ছিল।চমকে তাকিয়ে রইলো সে।শাওন কানে ধরতেই লাইনটা কাটা গেলো।ওপারের মানুষটা কি করে বুঝলো শাওন ফোন নিয়েছে?এদিক ওদিক তাকিয়ে শাওন ফোন সোজা করে ধরে নাম্বারটা দেখে বললো,’কার নাম্বার এটা?’
-‘এভাবে ফোন নেওয়া খারাপ স্বভাব ‘
-‘তুমি তো বললে রহস্য আমি সলভ্ করতাম।তাহলে আমি তোমার সাথে যা খুশি তাই করবো।ঐ যে রহস্যের জন্য।চাইলে এখন তোমার ফোনটা সাথে নিয়ে যেতে পারি।কিন্তু নেবো না।রাখো তোমার ফোন। এক মিনিট,তার আগে শুধু একটা কথা মাথায় রাখবে।শাওন তোমায় প্রতি প্রতি পদে পদে ফলো করবে আজ থেকে।’
মেধা ফোন কেড়ে নিয়ে বললো,’আমার রহস্য বের করতে গিয়ে রেদোয়ানের কেসটাকে পেন্ডিং ফেলে রাখবেন না।সেটা অধিক জরুরি।আমার রহস্য তো যেকোনো দিনই সামনে আনতে পারবেন।আফটার অল আপনি একজন সিনিয়র অফিসার।সব কিছুতে পটু’
-‘তোমার হাত ভেঙ্গেছিল কি কারণে?’
-“সিঁড়ি থেকে পড়ে’
-‘শুনলাম তোমার বাসায় তো লিফট দিয়ে যাওয়া যায় তাহলে পড়লে কি করে?’
-‘লিফট নষ্ট ছিল বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েছিলাম তাই’
-“ওহ।ভালো।বাসায় ফিরে যাও।আজকে আর তোমার কাজ নেই।অনেক কাজ করে ফেলেছো’
মেধা চুপচাপ চলে গেলো।শাওন রায়হানকে ডেকে বললো ঐদিনকার আসামি গুলোকে দেখতে যাবে।রায়হান মাথা নিচু করে বললো ওদের সাথেও একই ঘটনা ঘটেছে।বিষক্রিয়াতে মৃত্যু।
শাওনের খুব রাগ হলো।রেগে-মেগে কাঁচের টেবিলে ঘুষি মারতে গিয়ে থেমে গেলো সে।রশ্নি চিৎকার করে থামিয়েছে ওকে।রশ্নিকে দেখে মূহুর্তেই শরীরের সব রাগ যেন শূন্য হয়ে গেলো।হাতের কম্পনের তাপমাত্রা কমে গেলো।কপালের রেখা মিলে গেলো সাথে সাথে।চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে চেয়ারে টেনে বসলো সে।দূরে মেধা গিয়াস স্যারের সাথে কথা বলছে।যায়নি এখনও।শাওন রশ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,’মেধা আসলে কে জানো?’
-‘নাহ।ভালোই তো মনে হয়’
-‘ও ভালো না খারাপ তা জিজ্ঞেস করিনি।ও আসলে কে?ওর রহস্যটাকি তা জানতে চাই আমি।ওর কথা বার্তায়, প্রতিটি শব্দে আমি রহস্য খুঁজে পাই।অথচ খুঁজতে গিয়ে কোনো প্রমাণ পাইনা।সে একজন অফিসার।তার সাথে অপরাধ জগৎয়ের সম্পর্ক থাকার কথাই না।কিন্তু আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো আজ।হামলাকারীরা ওকে রেখে সবাইকে শুট করেছে।বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে।মাথায় কিছুতেই নিতে পারছিনা।মেধার সঙ্গে ওদের কি লেনাদেনা থাকতে পারে?আবার আরেকটা লজিক আসছে সামনে, তা হলো মেধা নিজে ওদের শুট করেছে।যদি মেধা ওদের দলের কেউ হতো সে তো শুট করার কথানা’
রশ্নি শাওনের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’সবকিছু নেগেটিভ ভাবতে নেই।তারা মেধাকে তন্নি ভেবেছে।তন্নিকে মারা তাদের উদ্দেশ্য ছিলনা।তাই হয়ত ওকে রেখে বাকিদের উপর হামলা করেছে’
-‘দারুণ বললে।আমি এটা ভাবিনি একবারও।তারা তো মেধাকে তন্নি ভেবে আসতে পারে।তাদের টার্গেট হয়ত তন্নি ছিলনা।আমি এবং বাকি অফিসাররা ছিলাম’
-“ঠিক’
-‘আর আমি ভাবলাম না জানি মেধার সাথে কত কি রহস্য ঝুলে আছে।সেটাই,একজন অফিসার কেন অপরাধী হবে?’
চলবে♥
Afnan Lara