মেঘের উল্টোপিঠ পর্ব-১৫

0
723

#মেঘের_উল্টোপিঠ
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
পর্ব-১৫

সন্ধ্যার ঢল নেমেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। আশপাশে শুনশান নীরবতা! মাঝেমধ্যে একগুচ্ছো পাখির দল মাথার ওপর দিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে নিঃশব্দ প্রকৃতিতে ক্ষনিকের জন্য কিচিরমিচির শব্দ প্রদান করে গেলো! বেশ কয়েকজনের হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিবর্গ কারা তা মস্তিষ্কে চট করে আসতেই বিরক্ত লাগলো! বেশ বিরক্ত! রাগের প্রকোপে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঘাড় কাত করে শব্দের উৎস স্থান অবলোকন করে পুনরায় বাহিরে দৃষ্টিপাত ফেললাম।

ভাইয়ার এংগেইজমেন্টের সকল যাবতীয় কর্ম কিয়ৎ পূর্বে সমাপ্ত হয়েছে। ফাংশন শেষ হতেই সব কাজিন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো আমাদের এপার্টমেন্ট এর ছাঁদে আড্ডায় বসবে। সিদ্ধান্ত অনুসারে হলো তাই। প্রতিবার কাজিন মহলের আড্ডার মধ্যমনিটা আমি ছিলাম। আমার চাঞ্চল্যতা! কিন্তু আজ! আজ সবার মধ্যমনি পূর্ব! আমার দিকে কারো খেয়ালই নেই। এটা নিয়ে কিছুটা হিংসা হলেও তা প্রকাশিত না করে ছাঁদের এক কর্ণারে চলে এসেছি। হটাৎ পূর্বের খানিক উঁচু কন্ঠ! খোঁচা মেরে বললেন,

‘ বুঝলি সায়ান! এখানে উপস্থিত একজন জ্বলে পুড়ে মরছে আমার এতো গুরুত্ব দেখে। আমি আবার মহান টাইপের লোক কিনা, তাই বলছি তাকে আমাদের মাঝে এনে ইচ্ছেমতো পাত্তা দেয়া হোক। ‘

সবার দৃষ্টি আমাতে!মিটিমিটি হাসছে সকলে। আমি হতভম্ব! আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেলাম। আমার ক্ষুব্ধ দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ হলো পূর্বের মাঝে। তবে তার তাতে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে মাথা নিচু করে তার পূর্ণ দৃষ্টিপাত ফোনে ফেলেছেন। অতঃপর সবার মধ্য হতে তারা আপু বলল,

‘ ওখানে কি করছো দোল? এদিকে এসো! তোমার সাথে তো আসার পর কথাই হলো না। ‘

তারপর একে একে সবাই উঠে আসতে লাগলো আমার দিকে। আমি তখনো অনুভূতিশূন্য! এই মূর্হতে কেমন রিয়াকশন দেয়া উচিত বোধগম্য হলো না। তবে সবাই কাছাকাছি এসে পাশাপাশি দাঁড়াতেই কথার মাঝে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। পূর্ব আসেননি আর! হুহ্! না আসুক! কার কি?কিছু আসে যায় না আমার। তবুও যেনো এক অশান্তি অন্তরাল ঘিরে ধরলো।পূর্ব মানব একটু এগিয়ে এসে দুই চারটা কথা বললে এমন কি হয়ে যেতো?বদ লোক একটা!

কিয়ৎক্ষণ বাদে পূর্ব উঠে আসলেন আমাদের দিকে। ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ওষ্ঠাধরের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,

‘ আমাকে একটু হসপিটালে যেতে হবে। রাতে এসে কথা বলবোনে। আসি! ‘

পূর্বের কথা শ্রবণ করার পর সিশা আপু ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল, ‘ আজ নাহয় না যেতেন ভাইয়া। ‘

‘ আর্জেন্ট না থাকলে যেতাম না। বাট যেতেই হবে।’

কথা শেষে এক বিন্দুও না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন পূর্ব। আমার পানে ফিরে অব্দি তাকালেন না। তার এই ব্যাবহারে মনক্ষুন্ন হলেও তা বহিঃপ্রকাশ করলাম না। হুট করে তার এরূপ আচরণে খারাপ লাগছে কেনো? আমি তো পূর্বে এটাই চাইতাম। সে আমায় ইগনোর করুক! না দেখার ভান করে চলুক। তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিক! কিন্তু এখন?ক্ষনকালে ধারণা, ইচ্ছা, আকাঙ্খা সবকিছু আমার পাল্টাচ্ছে। কি অদ্ভুত!

___

পূর্ব যাওয়ার পর-পরই রুমে এসে ঘরবন্দী হয়েছি অনেকক্ষণ হলো! সবাই বারংবার এসে দরজায় টোকা দিয়ে খুলতে বলছে কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি পড়ার ব্যাস্ততা দেখিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। কিছুক্ষণ আগ অব্দি স্বাভাবিক ভাবেই পড়ছিলাম কিন্তু একটুবাদে যখন আম্মু এসে বলল, ‘ পূর্ব এসেছে বের হ! ‘ তখন থেকে এক অদৃশ্য অস্থিরতা হানা দিয়েছে নিভৃতে। তোলপাড় সৃষ্টি করেছে যেনো এক প্রকার। শত চেষ্টার মধ্যি দিয়ে মধ্যরাত অবধি রুমেই বসে থাকলাম! উদ্দেশ্য আজ পূর্বকে দর্শন করবো না। একটুও না! তিনি আমায় ইগ্নোর করতে পারলে আমিও করতে পারি।

রাতের প্রহর শেষে যখন শুভ্র ভোরের আগমন ঘটার প্রহর আসতে চলেছে তখন বই ফেলে উঠে বসি! ঘুমানো দরকার! মাথায় যন্ত্রণা করছে। বই সোফায় রেখে বিছানার দিকে এগোতেই ‘ঠকঠক’ শব্দধ্বনি কর্ণপাত হয়। চমকে যাই কিছুটা! দরজা খুলতেই দৃশ্যমান হলো পূর্বের কঠিন মুখোশ্রী।বিস্মিত হয়ে বললাম,

‘ আপনি এতোরাতে? ‘

সে প্রতুত্তর না করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। একহাতে তার খাবার ভর্তি প্লেট! ঠাস করে দরজা বন্ধ করে শক্ত কন্ঠে বললেন,

‘ সবাই এতো ডাকাডাকি করলো দরজা খুললে না কেনো?’

আমি স্থির হয়ে বলে উঠি, ‘ পড়ছিলাম তাই খুলিনি।’

‘ অহ! পড়ছিলে না? তাহলে এটা কি?’

শেষোক্ত কথা তুলে ধরে তিনি আমার সামনে তার ফোন ধরলেন। ফোনে স্পষ্টত দর্শন হলো আমার অস্থির পায়চারি’ময় একটা ভিডিও! পরপর বেশ কয়েকটা ভিডিও। একটা শেষ হতে আরেকটা শুরু অটোমেটিকলি! এতক্ষণ যে আমি পড়িনি, পড়া বাদে যা যা করেছি তা অল্প অল্প করে একেক ভিডিও তে তুলে ধরা হয়েছে। আমি ভড়কে গেলাম! তবে মুখোশ্রীতে তা ফুটিয়ে তুললাম না। ভাবান্তর ছাড়া বলি,

‘ আপনি ভিডিও করলেন কিভাবে? আপনার নামে তো মামলা করা উচিত। একটা মেয়ে একা রুমে কি করছে? তা আপনি সেই মেয়ের অনুমতি ছাড়া ভিডিও করেছেন। ছিহঃ! লজ্জা হওয়া উচিত আপনার। আপনাকে ভালো মনে করেছিলাম। ‘

পূর্ব তার হাতের খাবারের প্লেট পাশেট টেবিলে শব্দ করে রাখলেন। সেই শব্দে খানিক কেঁপে উঠে পূর্বের পানে দৃষ্টিপাত ফেলি! তিনি যে রেগে গিয়েছেন তা নিশ্চিত। লম্বা কদম ফেলে আমার সন্নিকট এসে চিবিয়ে বললেন,

‘ কথা ঘোরাবে না একদম! মিথ্যা কেনো বললে সেটা বলো কুইক! আর রইল ভিডিও করার বিষয়। এটা আমি করিনি তোমার কাজিনরা করেছে সায়ানের রুমে ঢুকে। ‘

নেত্রযুগল বন্ধ করে অন্তরালে প্রতেকটা কাজিনকে শ’খানেক গালি দিলাম। এরা ভাই বোন নাকি শত্রু? একবার এই পূর্বের কবল থেকে বের হই! এক একটাকে শায়েস্তা করে ছাড়বো।

‘ ওদের শায়েস্তা পরে করিও। আগে আমার করা প্রশ্নের উত্তর দাও! ‘

আমি অবাক হয়ে বলে উঠি, ‘ আপনি কি করে..?’

বিরক্ত নিয়ে মুখোশ্রী কুঁচকে নিলেন পূর্ব। হাবভাব তার এরূপ বেশ বোকাসোকা এক প্রশ্ন করেছি তাকে। ক্ষীণ সুরে বললেন,

‘ তুমি যেভাবে বিড়বিড় করছিলে। তোমার ঠোঁট নারাচারা করার অঙ্গভঙ্গিই বলে দিচ্ছিলো তুমি কি বলছিলে ষ্টুপিড! ‘

নেত্রযুগল বন্ধ করে লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললাম,

‘ আপনি যেমন আমার করা একটা প্রশ্নেরও কখনো ঠিক মতোন উত্তর দেননি আজ আমিও আপনার করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিনা মি.পূর্ব! গট ইট?’

শেষোক্ত কথন হুবহু পূর্বের মতো বলে আঁড়চোখে তার প্রতি অবলোকন করলাম। কি আজব! এই লোক হাসছে? তার তো আমার কথা শুনে চার পাঁচটা থাপ্পড় মারার কথা রেগে গিয়ে। সবকর্ম উল্টো কেনো করেন এই মহোদয়?
পূর্ব আমার হাত ধরে টান মেরে সোফায় বসিয়ে দিলেন। টেবিল থেকে প্লেট হাতে নিয়ে আমার পাশে বসে চটপট কন্ঠে বললেন,

‘ এন্সার দিচ্ছোনা ফাইন! আমার কোনো প্রবলেম নেই তবে…,আমার কথা অমান্য করলে আমি শাস্তি দিয়ে থাকি দোল! মনে আছে না? শাস্তিস্বরূপ তোমাকে প্লেটের সম্পূর্ণটুকু খাবার শেষ করতে হবে তাও আমার হতে। ‘

আমি বিমূর্ত রূপে একবার প্লেটের দিকে আরেকবার পূর্বের মুখোশ্রীর প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছি। প্লেট ভর্তি অতিরিক্ত খাবার যা আমি আগে কখনো খেয়েছি বলে মনে হয়না তার ওপর পূর্বের হাতে খেতে হবে! হিসাব-নিকাশ মিলানো শেষে মাথা ঘুরতে লাগলো। আমি বিচলিত হয়ে বলে উঠি,

‘ অসম্ভব! একদমই না। এতো খাবার? তার ওপর আপনার হাত থেকে? ইম্পসিবল! ‘

সোফা ছেড়ে উঠতে নিবো তৎক্ষনাৎ পূর্ব তার বলিষ্ঠ হাত দ্বারা আমায় হেঁচকা টানে তার নিকট টেনে ধরলেন। পূর্ব মানব এবং আমার মাঝে ব্যাবধান অতি কিঞ্চিৎ! আমি তার অচঞ্চল নেত্র পানে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হাত দু’টো জরতা ছেড়ে এক বাঁধনে আঁটকে পড়া শুরু করলো। মৃদু চেঁচিয়ে বললাম,

‘ পূর্ব হাত বাঁধছেন কেনো? কি করতে চাচ্ছেন?’

সে নিরুত্তর! হাতদুটো কোমল কাপড় দ্বারা বেঁধে দূরত্ব বজায় রেখে বসলেন।ফের উঠতে নিলে তার কড়া দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজ স্থানে স্থির হয়ে বসতে হলো। অতঃপর কন্ঠনালী দ্বারা শব্দগুচ্ছোর দলা বের করতে নিলেই তিনি মুখে খাবারের লোকমা পুরে দেন। এক লোকমা গিলতেই আরেক লোকমা যার ফলস্বরূপ আর কিছু বলা হয়ে উঠলো না। খাওয়ার পর্ব শেষে তিনি উঠে যেতে নিলে তাড়া দিয়ে বলি,

‘ আরে.. হাত তো খুলে দিয়ে যান! ‘

ফিরে তাকিয়ে বিরক্তি কন্ঠে বললেন, ‘ হাত তো ধুয়ে আসি। এভাবে নয়তো কিভাবে খুলবো ষ্টুপিড? ‘

তপ্তশ্বাস ফেলে নতজানু হই। হাতদুটো বাঁধা উল্টো দিকে অবস্থায় থাকার ফলে চিনচিন ব্যাথা করছে। তার ওপর এতো খাবার অনায়াসে, বিরতিহীন ভাবে গেলা! অসম্ভব কিছু ছিলো। নেত্র কার্নিশ অশ্রুসিক্ত হলে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। বিড়বিড় করে বলে উঠি,

‘ এরূপ শাস্তি প্রদানের থেকে মেরে ফেললেও বুঝি ভালো লাগতো। প্রতিক্ষণে তার এরূপ আদেশ, অদ্ভুত শাস্তি আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য! ‘

….

‘ নিজের আত্নাকে কেও মেরে ফেলে ডাফার?’

কানের নিকট ফিচেল কন্ঠ! ডান দিকটায় তাকাতে দৃশ্যমান হলো পূর্ব মানবকে। সে স্থির! আগের থেকে নেত্রযুগলে আলাদা এক অস্থিরতাময় ভাব বিরাজমান। ওষ্ঠাধর কম্পমান! দ্রুত এগিয়ে এসে বিনাবাক্যে আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে তিনি হাতের বাঁধন খুলে আমার হস্তযুগল মুক্ত করলেন। ফ্লোরে হাঁটুগেড়ে বসে শীতল কন্ঠে বললেন,

‘ আমার ব্যাবহার! বা আমায় যদি তুমি মেনে নিতে না পারো এতে আমার কিছু করার নেই! তুমি অন্য কাওকে পছন্দ করো অথবা তুমি শত সন্তানের জননী হলেও আমার সাথে আমার মৃত্যুর আগ অব্দি তোমায় থাকতে হবে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা অব্দি! তোমার এবং আমার দু’জনেরই। ‘

‘ ভালোবাসেন আমাকে?’

আমার করাকৃত প্রশ্নে পূর্বের নেত্রযুগল শান্তই রইল। আগের মতো! যেনো জানতেন আমি এটা জিজ্ঞেস করবো। অচঞ্চল নেত্রযুগল আশপাশে এলিয়ে বললেন,

‘ “ভালোবাসা “, ” প্রেম – প্রীতি “, ” ভালোলাগা ” এই শব্দগুলোর প্রতি আমার বিশ্বাস নেই। এসব বলে কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই! তবে..
হোয়াটএভার, হটাৎ এই কথা?’

‘ আপনার পূর্ববর্তী কথাগুলো শুনে মনে হলো ইউ লাভ মি! ‘

পূর্ব ঝটপট উঠে দাঁড়ালেন। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, ‘কাম অন!বিয়ে এক পবিত্র বন্ধন! এন্ড আই বিলিভ ইট! হুট করে তো আর তালাক নেয়া যায়না না? তুমি আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো চিন্তাধারা করবে না! তুমি অন্যতমা! মাইন্ড ইট, ‘

পূর্ব ত্রস্ত গতীতে রুমের বাহিরে চলে গেলেন। আমি বিভোর তার কথার জালে ফেঁসে। হুট করে আপির চিৎকারের উঁচুমাত্রার শব্দ কর্ণপাত হতেই আমি দ্রুত পায়ে রুম হতে বের হই। শব্দের উৎস ছিলো ড্রইংরুম। সেখানে উপস্থিত হতেই আমার চক্ষু চড়কগাছে! আপি পূর্বের পায়ের কাছে জবুথবু হয়ে পড়ে আছে। অস্ফুটস্বরে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার পূর্বেই সেখানে সকলে হাজির! সবাই প্রশ্নোত্তর দৃষ্টি আপির দিকে নিক্ষেপ করে আছে আর তখনই আপু চিল্লিয়ে যা বলল তাতে সবাই নির্বাক! আমি স্তম্ভিত! নিরুত্তর চাহনি নিক্ষেপ করি পূর্বের পানে।

চলবে..