অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৬৭+৬৮

0
878

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬৭ ❤

অপেক্ষার প্রহরগুলো সর্বদা সুমিষ্ট হয় না। কিছু কিছু অপেক্ষা বোধহয় একরাশ তিক্ততা এবং বিষাদ বয়ে আনে। যেখানে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নেওয়া ও দায়। বাতাশে বাতাশে তখন কেবল বিষাক্ত অক্সিজেনের আনাগোনা। তেমনই হয়তো বা একটা বিষাদঘন পরিবেশে সাদিদ এই মুহূর্তে নিজেকে অনুভব করছে।
বুকের সাথে জড়িয়ে রাখা ছোট্ট শরীরটা এখন আর বাবার বুকে শান্তি পাচ্ছে না। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে হয়তো ইতিমধ্যে মায়ের অভাবটা বুঝে নিয়েছে। তাইতো গলায় সর্বোচ্চ জোর এনে নিজের স্বরে অভিযোগ জানাচ্ছে। কেন মা তাকে একটিবার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো না?
কেন একটিবার মায়ের বুকের সুমধুর সুধা পান করার তার ভাগ্য হলো না? কেন মা তাকে একটিবার স্নেহের চুম্বন দিলো না?
ছোট্ট প্রাণটার অবোধগম্য আওয়াজ আর কেউ বুঝতে না পারলে ও জন্মদাতা পিতা হয়তো মনের ভাবটা বুঝে নিলো।
কলিজার টুকরোকে বু্কে জড়িয়ে তাই অসার শরীরটা এবার দেয়ালে হেলিয়ে দিলো। বাচ্চাটা কোলে না থাকলে বোধহয় পায়ের সামান্য জোরটুকু আর নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারতো না। বাবা যে, তাই জীবন থাকতে নিজের রক্তকে কিভাবে ব্যাথা দিবে?
কিন্তু জন্মদাত্রী মা যে নিজের দায়িত্ব ভুলে গেল। একদিনের দুধের শিশুটাকে বাবার কাছে গচ্ছিত রেখে পারি দিলো অজানা গন্তব্যে। যেই গন্তব্যের দুরত্ব সাদিদ হাজার চেয়েও কমিয়ে আনতে পারবে না। একমাত্র মৃত্যু ব্যতিত।

— ‘ প্রিন্সেসদেখলি তো, তোর মা কতোটা নির্দয়? বাবার প্রতি একটুও দয়া দেখালো না। সে তোকেও ভুলে গিয়েছে প্রিন্সেস। সে আমাদের সবাইকে ভুলে গিয়ে…

সাদিদের গলাটা বোধহয় কেঁপে উঠল। বাক্যটা সমাপ্ত করার শক্তি অসার আর দেহে খুঁজে পেল না। ঐদিকে বুঝতে পারুক আর নাই বা পারুক। কিন্তু পিতার এমন হৃদয় ভাঙা আর্তিতে বাচ্চা মেয়েটা এবার যেন আরও গলা তুলে কান্না শুরু করলো। হসপিটালের ফিনাইলের কটু গন্ধের সাথে সেই আওয়াজ মিশে যেন এক মৃত্যুপুরীতে স্থান নিয়েছে। চারপাশে কেবল আর্তনাদ আর আর্তনাদ।

— ‘ সাদি মেয়েটাকে এবার দে, নতুবা তুই নিজে শান্ত কর। কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। এমনিভাবে চলতে থাকলে সেও যে মায়ের পথের যাত্রী হবে। ‘

বলেই শায়লা রহমান শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরলেন৷ নতুবা তার আর কি বলার আছে? একদিকে সদ্য মা হারা নবজাতক অপরদিকে ছেলের এমন দুরবস্থা! এই বয়সে এসে এতোসব ধকল কি শরীর আর কুলিয়ে উঠতে পারে?
মায়ের কথা সাদিদের কর্ণকোহর অবধি গেল কি-না সেটা বুঝা গেল না, সে কেবল নির্নিমেষ প্রিয়তমার নিস্তেজ শরীরটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
শুভ্র বর্ণ বরাবরই তার ভীষণ পছন্দের। কিন্তু এখন যেন হসপিটালের এই সাদা কাপড়টুকু তার শরীরে বিছার দংশনের সৃষ্টি করছে৷ অতি শুভ্র রঙটুকু চোখের জ্যোতি কেড়ে নিচ্ছে। তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বলে যাচ্ছে। সাদিদ পায়ের জোর দিয়ে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে গেল।
কান্নারত কোলের বাচ্চাটাকে তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে প্রাণহীন শরীরটার কাছে রেখে দিলো। নিমিষেই অবুঝ শিশুটাও যেন বুঝে গেল মায়ের শরীরের প্রখর ঘ্রাণ। নিমিষেই কান্না বন্ধ হয়ে গেল। আর ছোট্ট হাতগুলো নেড়ে মৃদুভাবে মায়ের বুকের কাপড়টা সরাতে চাচ্ছে। সাদিদ এই দৃষ্টি দেখে এতক্ষণের চেপে রাখা নরম আবেগি মনটাকে আর আটকে রাখতে পারলো না। শক্ত খোলস ভেঙে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নিঃশব্দের নোনাজল। আপন, অতি আপন প্রিয়জনকে হারানোর বেদনায় তখন চোখের জলগুলো যেন হয়ে উঠল এক একটি অগ্নিলাভা।

— ‘ কিভাবে পারলি পাখি? আমার.. আমাদের মেয়েটার কথা তোর একবারো মনে পড়লো না? এতোটাই পাষাণ তুই? আমাদের এভাবে নিঃস্ব করে যেতে তোর বুক একবারো কাঁপলো না? কিভাবে পাখি? কিভাবে পারলি? ‘

মৃত্যু ব্যক্তি কি আর রাগ-অভিযোগে প্রতিউত্তর করে? করে না তো৷ তাই সাদিদের প্রাণপাখিটাও কোনো উত্তর দিলো না৷ সব অভিযোগ, রাগ-ক্ষোভ মাথা পেতে নিলো।
সাদিদের করুণ আর্তি, নবজাতকের ক্ষুধার্তের আহাজারি কোনোটাতেই নীলার মন গলল না। সে আজ পাষাণ। ভীষণ কঠিন এক জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। যাকে ছোঁয়া যায়। কিন্তু তার থেকে মানব সহজাত বৈশিষ্ট্য আশা করা যায় না। মানব সভ্যতার জন্য তার সহজতম পরিচয় হচ্ছে লাশ। অর্থাৎ মৃত্যুব্যক্তি।
.

সাদিদ হুড়মুড়িয়ে চোখ খুলল। ভয়ার্ত উদ্বিগ্ন প্রবল দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতে লাগলো। একটু দূরেই মা-বাবাসহ সবাইকে উপস্থিত দেখা যাচ্ছে। নিজের দিকে তাকাতেই ছোট্ট প্রাণটাকে বুকের সাথে আগলে দেখতে পেল। আর ধীরে ধীরে সবটা তার বোধগম্য হতে লাগলো।
দুঃস্বপ্ন ছিল?
তাহলে সাদিদ প্রাণপণে দোয়া করবে এমন দুঃস্বপ্ন যেন তার শত্রুপক্ষ ও কোনোদিন না দেখে। বুকের ভিতরের হৃদযন্ত্রটা এখনও ধকধক করছে। বোধহয় অস্থিরতায় বেড়িয়ে আসতে চায়ছে। সাদিদের চোখের কোণ গড়িয়ে আবারও নিঃশব্দের অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। নিজের কলিজার টুকরোটাকে আরেকটু বুকের সাথে আগলে নিয়ে কপালে স্নেহের আদর দিলো।
মেয়েটা পেটে খিদে নিয়েই বাবার কোলে ঘুমিয়ে পরেছে। সাদিদ তখন এই ছোট্ট প্রাণটাকেই একদৃষ্টিতে দেখছিল। কখন যে দুই মিনিটের জন্য ক্লান্ত চোখজোড়া লেগে গিয়েছিল সেটা খেয়াল করতে পারছে না। আর এই দুইমিনিটেই সাদিদের আত্মা বেড়িয়ে আসার জোগাড় হলো। এমনটা হবে জানলে সে চোখের পাতা প্রয়োজন হলে সুপার গ্লু দিয়ে আটকে রাখতো। তারপরও একে-অপরের সাথে লেগে গিয়ে সাদিদের বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্র করতে দিতো না!
ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবারও তার চোখজোড়া রক্তিমে রাঙিয়ে উঠল।
তার প্রাণপাখিটা কি এখনও ঘুমে? তারা এখনও তাকে কাটাকাটি করছে? এখনও যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছে? কিন্তু আর কতো!
সাদিদ মুহূর্তেই উঠে দাড়ালো। কাউকে পরোয়া না করে অপারেশন থিয়েটারের দরজায় অনবরত আঘাত করতে লাগলো,

— ‘ ওপেন দ্য ডোর। বের করো আমার পাখিকে। এখানে আর এক মুহূর্ত রাখবো না। খুলো বলছি। ‘
— ‘ সাদি, কি পাগলামি এসব? এটা হসপিটাল ওনাদের ঠিকমতো কাজ করতে দে। ‘
— ‘ না বাবা, আর না। এখানে আর এক মিনিটও রাখবো না। তারা কিছু পারে না৷ আমার পাখিটাকে এতক্ষণ ধরে কষ্ট দিচ্ছে। আমি ওকে রাখবো না এখানে। খুলো দরজা। খুলো বলছি। ‘
— ‘ প্লিজ স্যার এমন করবেন না। শান্ত হোন। আরও অসুস্থ পেশেন্ট এডমিটেড আছে। তাদের এতো জোরে আওয়াজের ফলে সমস্যা হচ্ছে। ‘
— ‘ সমস্যা মাই ফুট। এইমুহূর্তে ওটির দরজা না খুললে তোমাদের সবার সমস্যা হয়ে দাড়াবে। একটাকেও ছাড়বো না আমি। গুণে গুণে হিসাব বরাবর করবো। ‘
— ‘ আচ্ছা স্যার করেন। কিন্তু এখন প্লিজ এমনভাবে চেঁচামেচি করবেন না। আপনার ওয়াইফেরও তাতে প্রবলেম হবে। ‘
— ‘ খবরদার, খবরদার যদি আমার নীলাঞ্জনার কিছু হয়। ওর কিছু হওয়া চলবে না। কিচ্ছুটি না। খুলো দরজা। ‘

সাদিদের অনবরত হসপিটালের স্টাফদের সাথে গলা উঁচিয়ে চেঁচামেচি আর বাকিদের তাকে বারণ করার অতিরিক্ত শব্দে কোলের বাচ্চাটার ঘুম ততক্ষণে ভেঙে গেল। পেটে খিদে নিয়েই সে ঘুমিয়েছিল। তাই এখন সজাগ হতেই আবারও নিজের কষ্টগুলো কান্নারূপে জানান দিতে লাগল। শায়লা রহমান এবার বেশ ধমকি দিয়েই বললেন,

— ‘ থাম সাদি। অনেক করেছিস। মেয়েটা আবারও খিদের জ্বালায় কান্না করছে। নিজেকে সামলিয়ে ওকে একটু দেখ। এখন থেকে শুধু নিজেদের কথা ভাবলেই চলবে না। ছোট্ট মেয়েটার কথা আগে ভাবতে হবে। ‘

মায়ের এহেন কথার পরিবর্তে সাদিদ আর কিছু বলে উঠতে পারল না। শুধু ছলছল অশ্রুসিক্ত চোখগুলো মেয়ের বুকের সাথে আগলে নিয়ে লুকিয়ে নিলো৷ মায়ের মন এবার নরম হয়ে এলো। ছেলের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে ডাকলো,

— ‘ আব্বা তাকা। ‘

সাদিদ চেপে রাখা রক্তলাল চোখে মায়ের দিকে তাকাতেই তিনি শাড়ির আঁচলে নিজের চোখের কোণের পানিটা মুছে নিলো। অতঃপর স্নেহময়ী মমতায় সিক্ত কন্ঠে বললেন,

— ‘ আমাদের কাছে তো থাকছে না। আর জন্মের পর থেকে একবিন্দু পানিও মুখে পরেনি। তুই একটু দেখ না আব্বা। যদি একটু কিছু খায়। ছোট্ট বাচ্চা আর কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে? ‘
— ‘ মা, মেয়ের খাবার নিয়ে আসো। ‘

সাদিদ মাথা নামিয়ে নরম গলায় কথাটি বলে উঠতেই শায়লা রহমান চোখ মুছতে মুছতে সামনে এগিয়ে গেলেন। আপাতত ছেলের পাগলামি থামানোর একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে এই অবুঝ শিশুটি৷ হয়তো বা মা হয়ে অবুঝ শিশুটিকে দুর্বলতা হিসেবে ছেলের বিপক্ষে ব্যবহার করছেন৷ কিন্তু করার যে কিছু নেই৷ পরিস্থিতিটাই এমন।
শায়লা রহমান ছোট্ট ফিডারে করে কুসুম গরম ফর্মূলা মিল্ক এনে সাদিদের হাতে দিলেন।
সাদিদ মেয়েকে নিয়ে চেয়ারে বসলো। মুখের কাছে খাবার দিতেই ছলছলে চোখে মেয়ের অনিহা প্রকাশ। সাদিদ মেয়ের মুখপানে নির্নিমেষ তাকালো। একদিনের শিশুটার ও মায়ের প্রতি কতো অভিমান!
সাদিদ আদুরে স্বরে ডাকলো,

— ‘ আম্মা? ‘

মেয়ে তাকালো। বার কয়েক চোখের পাতার নড়নচড়ন করে একদৃষ্টিতে বাবার পরবর্তী কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

— ‘ তুমি আমার লক্ষ্মি আম্মা না? একটু খাও। বাবার কষ্ট হচ্ছে তো। ‘

কয়েক ঘণ্টার বাচ্চাটাই যেন অভিমানে ঠোঁট উল্টে নিলো। বাবার প্রতি যেন আদুরে অভিযোগ জানাচ্ছে যে, এমন ব্ল্যাকমেইল করার মানে কি?
সাদিদ আলতো করে ফুলো গালটা আর ঠোঁটটা ছুঁয়ে দিলো। অতঃপর মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিডার ধরলো।
বাচ্চা মেয়েটা শেষ একবার বাবার দিকে আহ্লাদী অভিযোগমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফিডারে মুখ লাগালো। শায়লা রহমান পাশ থেকে তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
সত্যিই খোদার লীলা বুঝা বড় দায়। এই ছোট্ট বাচ্চাটা বাবাকে কিভাবে সবার থেকে আলাদা করছে! এতক্ষণ তারা তো কম চেষ্টা করেনি৷ কিন্তু না। পিচ্চি হলেও তেজ অনেক, খেলই না৷ কিন্তু এখন? বাবা আদর করে দিতেই খেয়ে নিচ্ছে!
মেয়ে অল্প একটু খেয়ে মুখ সরিয়ে নিলো। সাদিদ সেটা দেখে ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ ম্লান হাসি নিয়ে বলল,

— ‘ আচ্ছা আর লাগবে না। বাবা আর জোর করবো না। ‘

শায়লা রহমান এবার পাশ থেকে না হেসে পারলেন না। হাসতে হাসতেই বললেন,

— ‘ তোর মেয়েতো দেখি সিনেমার হিরোইনকে ও হার মানাবে সাদি। কি জবরদস্ত এক্টিং করে। ‘

সাদিদ মায়ের কথায় হাসতে পারলো না। কেবল আলতো করে মেয়ের মুখের পাশে লেগে থাকা এঁটো খাবারটা মুছে দিলো।
অতঃপর মায়ের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ একটু নামাজের জায়গায় যাব। মেয়েকে রাখবে? না-কি নিয়ে যাব? ‘
— ‘ দে। দেখি তোর আদরের দুলালী থাকে কি-না? ‘

সাদিদ আস্তে করে শায়লা রহমানের কোলে মেয়েকে দিতেই পিচ্চির মৃদুস্বরে কান্না শুরু। তা দেখে সাদিদ হাত বাড়িয়ে বলে উঠল,

— ‘ থাক লাগবে না। দিয়ে দাও আমার কাছে। ‘
— ‘ তুই না নামাজ পরবি? ‘
— ‘ সমস্যা নেই। মেয়েকে নিয়েই পরতে পারবো। ‘

সাদিদ শায়লা রহমানকে আর কিছু বলতে না দিয়েই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সামনে হাঁটা দিলো। যাওয়ার সময় স্থির দৃষ্টিতে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকালো। একহাতে আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই চোখটা আবারও ঝাপসা হয়ে এলো। মেয়ের শরীরে জড়ানো তোয়ালে দিয়ে চোখের কার্ণিশটা মুছে নিয়ে আবেগি মায়াভরা নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ প্রাণপাখি? ভালোবাসিতো। আর কষ্ট দিও না। সহ্য করতে পারছি না যে। মেয়ে তোমাকে চাচ্ছে পাখি৷ মেয়েকে বুকের সাথে আগলে ধরবে না? আমাদের মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিবে তুমি? আমার নীলাঞ্জনা কি এমন? সে তো কাউকে কষ্ট দেয় না। কারো চোখের পানি সে সহ্য করতে পারে না। তাহলে? চলে আসো লক্ষীটি। অপেক্ষা করছি। তোমার মেয়ে, তোমার স্বামী তোমার পথ চেয়ে বসে রয়েছে। প্লিজ আর কষ্ট দিও না। ‘

বলতে বলতেই সাদিদের গলাটা আবারও লেগে আসলো। সে আবারও নিঃশব্দের অশ্রুজলটুকু মুছিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
এতক্ষণে ছোট্ট প্রাণটা আবারও ঘুমিয়ে পরেছে৷ সাদিদ আলতো করে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে তাকে সাবধানে নামাজের জায়গার একপাশে শুইয়ে দিলো। অতঃপর নিজে তারপাশে নামাজের জন্য দাড়ালো।
বিপদ থেকে রক্ষা করতে করুণাময় সৃষ্টিকর্তা ব্যতিত অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা নেই৷ তার প্রিয়তমাকে একমাত্র উনিই এই সংকটপূর্ণ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারেন। তাইতো মনের সবটুকু আবেগ, ভালোবাসার গভীরতা থেকে করুণ আর্তি তুলে সৃষ্টিকর্তার নিকট সাদিদ ফরিয়াদ জানাতে লাগলো।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল সেটা বুঝা গেল না। কতটা প্রহরগুণে একান্তে নীরবে চললো সেই মোনাজাত সেটা ব্যাখা করা গেল না। অথচ মানুষটি এখনও জায়নামাজে স্থির। তীব্র আকুতিভরা প্রার্থনায় মগ্ন।
শাহেদ যখন পুরুষদের নামাজের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানে এসে দাড়ালো তখন আপনমনেই তার মুখ ফোটে বের হলো,

— ‘ করুণাময়, তোমার সৃষ্টির তুলনা নেই। ‘

ঘুমন্ত বাচ্চাটা ইতিমধ্যেই জেগে গিয়েছে। কিন্তু সে একটা আওয়াজ করলো না৷ কেবলমাত্র ডাগর ডাগর চোখে বাবার প্রার্থনায় সিক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
শাহেদ আর সাদিদকে ডেকে তার নামাজে ব্যাঘাত ঘটালো না। কেবল কিয়ৎকাল মুগ্ধ দৃষ্টিতে এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগলো।
অবশেষে সাদিদ যখন সালাম ফিরালো তখন শাহেদ ধীর স্বরে ডেকে উঠল,

— ‘ সাদি? ‘

সাদিদ ভাইয়ের ডাকে পিছন ফিরে তাকালো। তাকে পিছন ফিরতে দেখেই শাহেদ অতি উৎসাহী গলায় বলতে লাগলো,

— ‘ তোকে কতক্ষণ যাবত তন্নতন্ন করে খোঁজে চলেছি! তারপর মা বললো তুই নাকি এদিকে এসেছিস। তাই দ্রুত চলে আসলাম। ‘

উত্তেজনায় শাহেদের গলা দিয়ে অগোছালো কথা বের হচ্ছে। অবশেষে সে একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে হাসিমুখে বলে উঠল,

— ‘ নীলার অবস্থা এখন বিপদমুক্ত। ডক্টর বলেছে বাবুকে তার কাছে দেওয়া যাবে৷ তাই তোকে ডাকতে এলাম। ‘

অতি আনন্দে সাদিদও যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কেবল অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
সাদিদ বাচ্চাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসতেই সবাইকে দেখতে পেল। তাদের দৃষ্টি সাদিদের দিকে পরতেই ডক্টর ফারজানা কিছুটা ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে বলে উঠল,

— ‘ বাহ্ বা এতো প্রেম! আর আমরা তো সবাই বানের জলে ভেসে এসেছি। তাই না? নিয়ে যাও নিজের বউকে। যাদের বাড়িতে পেশেন্টের থেকে বড় পাগল এমন হাসবেন্ড-টাসবেন্ড আছে তাদেরকে আমরা ও আমাদের হসপিটালে রাখি না। জলদি বউ বাচ্চা নিয়ে দূর হও। ‘

সাদিদ প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। কেবল ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল তার কৃতজ্ঞতায় ভরা হাসি। আর এই হাসিতেই যেন ডক্টর ফারজানার মেকি রাগটাও পরে গেল। তিনিও নিচুস্বরে হেসে ফেললেন।
সাদিদই এবার বাবুকে কোলো নিয়ে নীলার কাছে যাবার জন্য এগিয়ে গেল। ডিউটি নার্স দরজা খোলে দিতেই সাদিদের চক্ষু সামনের ব্যক্তিটির দিকে স্থির হলো।
প্রাণপাখিটাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অবশ্য ক্লান্ত না হয়ে উপায় আছে? সাদিদের কলিজার টুকরোটাকে এই পৃথিবীর আলো বাতাশ দেখাতে গিয়ে তার কোমল পাখিটা যে কম যন্ত্রণা সহ্য করেনি!
সাদিদের চোখজোড়া আবারও নিজের অজান্তেই ম্লান হয়ে উঠল। সে ধীরে পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। খুব পরিচিত কারো উপস্থিতি অনুভব করে নীলা দুর্বল চোখজোড়া খুলে তাকালো। অতঃপর চোখের সামনে সেই পরিচয় প্রিয়মুখ। যা নাকি কয়েক ঘণ্টা আগেও নীলা ভেবেছিল এইটাই হয়তো বা শেষ দেখা। আর কোনোদিন হয়তো এই প্রিয়মুখটা দর্শন করার ভাগ্য তার হবে না।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সহায় হয়েছেন। নীলা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। যেই কৃতজ্ঞতা এই ইহজীবনে পূরণ করা সম্ভব নয়। নীলার সাধ্যি নেই সেই করুণার জন্য উপযুক্ত প্রতিদান ফিরিয়ে দেবার। নীলা ঋণী। আর এই ঋণের ভার সে হাসিমুখে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে রাজি।
সাদিদ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে প্রিয়তমা এবং নিজেদের মধ্যেকার সবটুকু দুরত্ব মিটিয়ে নিলো। অতঃপর গাঢ়, ভীষণ আদুরে এক উষ্ণ চুম্বন পড়লো প্রিয়তমা স্ত্রীর ললাটে। স্বামীর অতি আদুরে স্নেহময় চুমুতে নীলার নেত্রপল্লবগুলো তিরতির করে কেঁপে উঠে নিমিষেই বুজে গেল।
কপাল থেকে পুরুষালী শুষ্ক ঠোঁটজোড়া সরে যেতেই নীলা পিটপিট করে চোখ খুললো। অতঃপর সাদিদের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা ছোট্ট প্রাণটিকে একপলক দেখার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা চালালো।
সাদিদ তার অব্যক্ত অনুভূতি বুঝতে পেরে নিঃশব্দে তৃপ্তিজনক হাসলো। অতঃপর ছোট্ট শরীরটা নীলার বুকের সাথে লাগিয়ে শুইয়ে দিলো।
এর পরবর্তী এক মিনিট কি হলো নীলা বুঝতে পারলো না৷ কেবল থম ধরে নিষ্পলক ছোট্ট মুখশ্রীটার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর… অতঃপর ধীরে ধীরে তার ঠোঁট ভেঙে এলো। সাদিদ সেটা দেখেও আবার হাসলো। মেয়ে হয়েছে একেবারে মায়ের কার্বন কপি।
নীলা মুগ্ধ স্নেহময়ী দৃষ্টিতে নিজের নাড়ি ছেড়া ধনকে দেখতে লাগলো। আর পলকেই চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পরম সুখের অশ্রুজল। হয়তো এই সময়টা তার জীবনে আসবে এটার আশা সে ছেড়েই দিয়েছিল। এই মুখটা দেখার কখনও সুভাগ্যে জন্মাবে এটাও তার অলিক কল্পনায় ছিল। কিন্তু আজ সবটাই তার সামনে বাস্তব। একেবারে প্রাণোচ্ছল।
নীলা আদরের সন্তানের ললাটে স্নেহের চুম্বন দিতে গেল। কিন্তু সদ্য সেলাইয়ের যন্ত্রণায় নড়াচড়ার সাধ্যি পেল না। কিন্তু তার আহত দৃষ্টি সাদিদের নজর এড়াতে পারেনি৷ তাইতো মেয়েকে আলতো করে তুলে ধরে নীলার মুখশ্রী বরাবর করে দিলো। নীলা একপলক সাদিদের দিকে খুশিময় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছোট্ট কপালটাতে সযত্নে কোমল অধরযুগল চেপে ধরল। আর সাথে সাথেই আবারও গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা উষ্ণ নোনাজল। নীলা মেয়েকে আদর দিলো। অসংখ্য, অগণিত অজস্র স্নেহের উষ্ণ পরশ ছোট্ট মুখটাতে বুলিয়ে দিলো।
আর অপরদিকে প্রিয়তমার কান্না মিশ্রিত হাসিমুখ দেখে সাদিদ আপনমনেই বিড়বিড় করলো,

— ‘ আমার এই সুখের পরিবারে কারো নজর লাগিও না খোদা। তোমার নিকট আকুল আবেদন জানাচ্ছি। ‘

নীলা মেয়েকে ধরতে চাইলো। ছোট্ট শরীরটাকে নিজের বুকে টেনে নিতে চাইল কিন্তু হাতে কেনোলা লাগানোর ধরুন এবং শরীরের দুর্বলতায় পারছিলো না। সাদিদই সাহায্য করলো। মায়ের বুকের সাথে মেয়েকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে দিলো।
নীলার বুকে যেন তুষারপাতের ন্যায় হিমবায়ু বয়ে গেল। এতটা প্রশান্তি বুঝি মাতৃত্বে?
সেটা বোধহয় কখনও ভাষায় প্রকাশ মতো না। এটা কেবল একান্ত অনুভবের বিষয়।
পিচ্চি মেয়েটা তখন মায়ের বুকের ওম পেয়ে মুখ ঘষতে লাগলো৷ নীলা একপলক সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ তার দিকে তাকিয়েই মুখ চেপে নিঃশব্দে হাসছে। ছোট্ট প্রাণটার মনের অব্যক্ত শব্দহীন অনুভূতিগুলো বোধহয় মা-বাবা ইতিমধ্যেই বুঝতে সক্ষম হচ্ছে। নীলাও মাথা নুইয়ে মৃদু হেসে মেয়ের মাথায় সযত্নে চুমু দিলো। অতঃপর পরিহিত কাপড়ের বুকের জিপারটা খুলতে গেলেই ইতস্ততবোধ করে একপলক সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ তার মুখভঙ্গি দেখে সাথেসাথেই জানতে চাইল,

— ‘ কি? ‘

নীলা উত্তর দিতে পারলো না। কেবল মাথা নুইয়ে একেবারে চিবুক বুকে ছুঁইয়ে রাখলো। সাদিদ মৃদু হেসে নিজেই নীলার জিপারটা খুলে দিলো। অতঃপর মিহিস্বরে বলল,

— ‘ নাও। ‘

অতঃপর লজ্জা, ইতস্ততবোধ, আড়ষ্টতা নিয়েই নীলা মেয়েকে ফিডিং করাতে চাইলো। এখানেও ঘটলো বিপত্তি। নীলাকে হালকা নড়েচড়ে বাবুকে প্রসেস করতে দেখেই সাদিদ দ্রুত বলে উঠল,

— ‘ তুমি নড়াচড়া করো না৷ আমি ঠিক করে দিচ্ছি। ‘

অতঃপর সাদিদই মেয়েকে মায়ের একেবারে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। মেয়ে পরম সাচ্ছন্দ্যে মায়ের বুকে মুখ দিতেই নীলা চোখ বন্ধ করে সাদিদের হাত শক্ত করে খামচে ধরল।
সাদিদ তার অনুভূতি বুঝতে পেরে প্রিয়তমার এলেমেলো চুলগুলোতে যত্নের সহিত হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অতঃপর ভীষণ আবেগি ভরাট কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ এই অমূল্য রত্মের প্রাপ্য উপহারস্বরূপ তোমাকে কি দেওয়া যায় আমার জানা নেই। তুমি বলো কি চাও৷ কিসের পরিবর্তে আমার ঋণের ভার একটু কম হবে? নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে হলেও আমি তাতে পিছুপা হবো না। ‘
— ‘ তাই? ‘
— ‘ হুম। বলো কি চাও? ‘
— ‘ ভালোবাসা। একটু, অনেক, অনেকটা বেশি ভালোবাসা। দিবেন তো? ‘

সাদিদ প্রিয়তমার স্ত্রীর কথায় ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। অতঃপর পেটের খিদে নিবারণে ব্যস্ত মেয়েকে সাথে নিয়েই নীলাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। ভীষণ প্রগাঢ় এক ভালোবাসাময় উষ্ণ চুম্বন খেল প্রিয়তমার কোমল ললাটে। অতঃপর প্রিয়তমার বক্ষপিঞ্জরের সাথে লেপ্টে থাকা ছোট্ট প্রাণটির নরম গালেও পড়লো বাবার স্নেহেভরা আদর পরশ।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬৮ ❤

হসপিটালের তীব্র ফিনাইলের গন্ধটা যেন উপচে পরা হাসি মুখগুলোর কাছে ফিকে পরছে। খরার পর আকষ্মিক বৃষ্টিতে যেমন মাঠে খেটে খাওয়া কৃষকের মুখে ব্যাখাহীন হাসি মুখখানা দেখা যায়, তেমনিভাবে আল্লাহর অশেষ কৃপায় নীলার সুস্থতায় যেন প্রিয়জনগুলোর মধ্যে একই ছাপ। তাই আদরের মেয়েটাকে তারা নিজেদের সর্বোচ্চ আদর-স্নেহ লুটিয়ে দিতে ব্যস্ত।

— ‘ মা, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। ‘
— ‘ সেটা আর বলতে? আন্টি আমার কলিজা তো গলায় এসে আটকে গিয়েছিল। ‘
— ‘ এটা তোর কলিজা? না-কি গুরা কৃমি? এমন লাফালাফি করে ক্যান? ‘

শান্ত চোখ পাকিয়ে তানবীরের দিকে তাকালো। তাতে তানবীরের মধ্যে সেরকম কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে একধ্যানে উত্তরের অপেক্ষায় শান্তর দিকে তাকিয়ে।
কিন্তু শান্ত তাকে পুরোপুরি নিরাশ করে দিয়ে বিনা প্রতিউত্তরে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল। তাকে রেগে চলে যেতে দেখে শায়লা রহমান তানবীরের কান টেনে ধরলেন,

— ‘ পাঁজি ছেলে, সবসময় মেয়েটার পিছনে না লেগে থাকলে তোর ভালো লাগে না বুঝি? ‘
— ‘ আরে কি করো? ব্যাথা পাই তো। কান ছাড়ো। ‘

শায়লা রহমান কান ছাড়ার আগে আরেকটা কানমলা দিয়ে তবে হাত সরালেন। আর মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন,

— ‘ যা গিয়ে দেখ মেয়েটা কোথায় গেল। হাসিখুশি পরিবেশটাতে ঝগড়া না বাঁধালে শান্তি লাগে না! যতসব দুষ্টু ছেলেপেলে হয়েছে। ‘

শায়লা রহমান তানবীরের আরও কিছু গালমন্দ করলো। সবাই তানবীরের চুপসে যাওয়া মুখশ্রী দেখে ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে। তানবীর পাংশুটে মুখ নিয়েই কেবিন থেকে বের হলো।
তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে হাসিবুর রহমান বলে উঠলেন,

— ‘ অনেক তো হলো হাসিঠাট্টা। এবার যে মিষ্টিমুখের পালা৷ ‘
— ‘ সেটা আর বলতে বাবা? আমাদের বাড়ির প্রথম মেয়ে। রাজকন্যার আগমনে যে মিষ্টির বৃষ্টি হবে। ‘
— ‘ তাহলে আর দেরি কেন? ওর্ডার দাও ঢাকার সব মিষ্টি দোকানে। একদিনের জন্য শহরের সব মিষ্টি যেন আমাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ‘

আবারও আরেকদফা হাসাহাসি হলো। তারা যেন আজকে নিজেদের অতি আনন্দগুলো প্রকাশ করার ভাষা খোঁজে পাচ্ছে না। তাইতো বাচ্চাদের মতন এমন কারণে-অকারণে হেসে যাচ্ছে। কথা শেষ হতেই শাহেদ আর অর্ণব চললো মিষ্টির জন্য।
সাদিদ একপলক নীলার দিকে তাকালো। সে মেয়ের ছোট্ট আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করছে। সাদিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। নীলার আচমকা সাদিদের দিকে চোখ পরতেই দুইজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। সাদিদকে সবার সামনেই এমন নির্লজ্জের মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জাবতী নীলা বেশ লজ্জা পেল। আর সাথে সাথেই দৃষ্টি নত করলো।

.

শান্ত নিজস্ব শরীরের রাগ মেটাতে হসপিটালের নির্দোষ গাছগুলোর উপর অত্যাচার চালাতে শুরু করলো। বোধহয় দেহের সমস্ত শক্তি খরচ করে সে অনবরত গাছের পাতাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে।

— ‘ এখন এতো শক্তি! যখন থাকার দরকার তখন তো দেখি না। ‘

আগুনে যেন তানবীরের কথাটা পেট্রোল হিসেবে কাজ করলো। শান্ত কটমট দৃষ্টি নিয়ে পিছনে ফিরলো।

— ‘ আরেবাস, জলসার কটকটি দেখি বাংলাদেশের মাটিতে! ‘
— ‘ আপনি.. আপনি একটা অসহ্য। ‘

শান্ত চলে যেতে নিতেই তানবীর পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো। আর চারপাশে একবার দেখে নিয়ে শান্তকে পিছন থেকে হালকাভাবে জড়িয়ে ধরল। কাঁধে থুতনি রেখে তিক্ষতা ভুলে নরমস্বরে বলে উঠল,

— ‘ কি হয়েছে? এতো রাগ কেন? ‘
— ‘ কি আর হবে? কিছুই হয়নি। ‘

কন্ঠে প্রখর অভিমানিনীর টান দেখে তানবীর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলো। অতঃপর রাগে ফোলা নাকটা আরেকটু ফুলিয়ে দিতে বলল,

— ‘ তাহলে তো ভালো। কিন্তু মুখ এমন পেঁচার মতো কেন? এমনিতেই বান্দ..

তানবীরকে সম্পূর্ণ কথা সমাপ্ত করতে না দিয়েই শান্ত তার পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো। অতঃপর ভাঙা অভিমানী স্বরে বলল,

— ‘ তাহলে কোনো রূপসী ললনাকেই বিয়ে করতেন। আমাকে করার কি দরকার ছিলো? তখন কি চোখ ছিলো না? না-কি বিয়ে হতেই বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছে? ‘

এবার তানবীর আর দুষ্টুমির মুডে নেই৷ এই কথার পর দুষ্টুমি মানায় না। তাই ধরে রাখা হাতের বাঁধন আরেকটু জোরালো করে পুরুষালী ঘন স্বরে বলে উঠল,

— ‘ আজকেই শেষ। আর কখনও যেন তোমার মুখ থেকে এমনটা না শুনি৷ রাগ-অভিমান ঠিক আছে। তাই বলে এসব মেনে নেব না। মাইন্ড ইট। ‘

তানবীরের গলায় রাগের আভাস পেয়ে শান্ত যেন এবার নিভে এলো। কেননা তানবীরের রাগ সম্পর্কে ইতিমধ্যেই তার ধারণা জন্মে গিয়েছে।
শান্তকে চুপচাপ দেখে তানবীর এবার জোরে একটা শ্বাস টানলো। মাথায় জ্বলে উঠা রাগটা কমানোর সর্বোচ্চ প্রয়াস। অতঃপর মিনিট কয়েক নীরবতার পর তানবীরই বলল,

— ‘ তখন এভাবে রাগের কারণ কি? ‘

নিভে যাওয়া অভিমানের টুকরোগুলো যেন আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। নিজেকে তানবীরের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে শান্ত বলে উঠল,

— ‘ ছাড়ুন আমাকে। একদম কথা বলবেন না। কত বার আপনাকে বলেছি সবার সামনে তুইতোকারি করবেন না। বিয়ের আগে ঠিক ছিল। কিন্তু এখন লোকে কি বলবে? ছাড়ুন বলছি। ‘

তানবীর তার রাগের কারণটুকু জেনে শব্দ করেই হেসে ফেলল। যা দেখে শান্ত যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।

— ‘ আবার হাসি হচ্ছে! খারাপ লোক কোথাকার। ‘
— ‘ না হেসে উপায় আছে? বউ যে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন গাল ফুলিয়ে বসবে সেটা কে জানে? আমি আমার বউকে আদর করে তুই ডাকবো, প্রয়োজন হলে আপনি ডাকবো তাতে কার কি? ‘
— ‘ তুই ডাকা আদর? ছিঃ কি বিচ্ছিরি লাগে শুনতে। ‘

তানবীর তার কথায় পাত্তা দিলো না। ঠেসে শান্তর কানের পিছনে চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ বিচ্ছিরি লাগে না গো। আদর আদর লাগে। বরং একটু বেশিই লাগে। ‘

তানবীরের কর্মকান্ডে শান্ত আশেপাশে তাকিয়ে একটু যেন দমে গেল। মেকি রাগ ভুলে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল,

— ‘ পাবলিক প্লেসে এসব কেমন নির্লজ্জতা? ‘
— ‘ তাইলে বলছিস প্রাইভেট প্লেসে নির্লজ্জ হতাম? চল তাহলে, বাসায় যাই। আজ একেবারে নির্লজ্জতার ডেফিনেশন চেইঞ্জ করে ফেলব। ‘
— ‘ ধ্যাত। যতসব আজগুবি কথাবার্তা। ‘
— ‘ আরে কই আজগুবি! শুন না, সাদির মেয়ে উপলক্ষে ঐদিকে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। আমিও মিষ্টি খাব। ‘
— ‘ তো আপনাকে খেতে কে বারণ করেছে? যান গিয়ে পেটভরে মিষ্টি খান৷ ‘
— ‘ ঐ মিষ্টিতে তো পেট ভরবে না। আমার স্পেশাল মিষ্টি চাই৷ ‘
— ‘ মানে? ‘

তানবীর নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে ডানহাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে শান্তর ঠোঁটের কোণ স্পর্শ করলো। ঠোঁটে হালকা স্লাইড করতেই শান্ত চোখ বাঁকিয়ে তার দিকে তাকালো।

— ‘ এই মিষ্টি চাই৷ ‘

শান্ত এবার লজ্জা পেয়ে আস্তে করে তানবীরের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরালো। লজ্জায় ইতিমধ্যে তার গাল লালচে বর্ণ ধারণ করেছে।

— ‘ কি হলো? দিবি না? ‘
— ‘ সরুন তো। সব জায়গায় দুষ্টুমি। ‘
— ‘ দুষ্টুমির কি দেখলি? মাত্র একটা কিসই তো চাইলাম। এখানেও তোর অনীহা! ‘
— ‘ নতুবা কি করবো? আপনার বেশরমগিরিতে সঙ্গ দিব? ‘
— ‘ তুই মুডটাই খারাপ করে দিস। শুন, আমার ডিসিশন না চেইঞ্জ। শুধু মিষ্টি না, আমার এর থেকেও বড় জিনিস চাই। ‘
— ‘ মানে? ‘

তানবীর যেন এবার বেশ লজ্জা পেল। লজ্জাবতী মেয়েদের মতো মুখ লটকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

— ‘ একটা গোলুমোলু দে। ‘
— ‘ মা..নে? ‘

শান্ত যেন ছোটখাটো একটা বিষম খেল। তার চোখজোড়া প্রায় বেড়িয়ে আসার উপক্রম।
কিন্তু তানবীর খানিকটা রেগে গেল। তাইতো শান্তর মাথায় হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে বিরক্তিমাখা স্বরে বলল,

— ‘ গাধা মাইয়া কোথাকার। খালি মানে মানে করে। ‘

তারপর আবারও সে নিজের খোলস পাল্টে নিলো। মুহূর্তেই মুখে মেয়েদের ন্যায় খানিকটা লাজুকতা মিশিয়ে বলে উঠল,

— ‘ কিছু বুঝে না। একটা গোলুমোলু বাবু চাই। প্লিজ দে। ‘

শান্ত হাত দিয়ে মাথায় ঘষতে ঘষতেই তানবীরের দিকে কটমট চাহনিতে তাকালো। এই ছেলেটা কোনদিন না জানে তার মাথার সব নাট বল্টু নড়িয়ে ফেলে! অতঃপর কন্ঠে লজ্জা নয় বরং রাগ মিশিয়েই বলল,

— ‘ বাচ্চা কি হাটবাজারে বিক্রি করে? যে আপনি চায়লেই আমি কিনে এনে দিতে পারবো? ‘
— ‘ আরে সেটা তো বলিনি। আমরাই বাচ্চা তৈরির কাজে লেগে যাব। শুধু তুই মেন্টালি এন্ড ফিজিক্যালি প্রিপেয়ার হলেই চলবে। ‘

এবার তাকে আর পায় কে? বেচারা লজ্জায় প্রায় মরিমরি। শান্ত এতক্ষণ চমকিত পর্যায়ে থাকলেও এখন যেন তার দমফেটে হাসি পাচ্ছে। এই ছেলে তাকে আর কতরূপ দেখাবে! এই নরম তো এই গরম। আবার এই বেশরম তো এই লজ্জায় কাদাকাদা।

— ‘ আমি যাই। ‘

বলেই শান্ত এই আপত্তিকর পরিস্থিতি থেকে কেটে পরতে চাইলো। কিন্তু তানবীর আবারও শুরু করলো,

— ‘ প্লিজ একটা বাবু দে না। সাদির মেয়েটা দেখ, কতো নরম-তুলতুলে। আমারও চাই। প্লিজ লক্ষ্মি বউ আমার একটা বাবু দে। ‘
— ‘ আরে কি পাগলামি এসব? বাচ্চা বললেই কি পাওয়া যাবে নাকি? এটা কি হাতের মোয়া? কমপক্ষে একবছর লাগবে। ‘
— ‘ হুম তাও ঠিক। তাহলে চল আজকে থেকেই কাজে লেগে যাই। এমনিতেই একবছর, আবার লেইট মানে প্রডাকশনে আরও লেইট। ‘
— ‘ ইশশ আপনিও না! ‘

শান্ত আর এক সেকেন্ডও দাড়ালো না। প্রায় দৌড়েই হসপিটালের করিডোর পেরিয়ে কেবিনের দিকে চললো। আর তানবীর বেচারাতো নিজের নির্লজ্জতা বজায় রাখার অনশন চালিয়েই যাচ্ছে,

— ‘ আরে লক্ষ্মি বউ, সোনা বউ যাও কই? শুনো না, আমার কিন্তু লাগবেই। চাই মানে চাই। যত দ্রুত সম্ভব। ‘

___________

শাদমানকে গুটিগুটি পায়ে নীলার বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে দেখেই নিধি সর্তক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তাকে বিছানায় উঠার চেষ্টা করতে দেখে নিধি আহতস্বরে বলে উঠল,

— ‘ বাবা উঠে না। খালামণির শরীরে ব্যাথা। ‘
— ‘ খালামণি কষ্ট পাবে না। তাই না? ‘

বলেই সে নীলার মুখের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকালো। নীলা পিচ্চির পাকনামিতে হাসলো। অতঃপর নিধির দিকে তাকিয়ে বলল,

— ‘ কিছু হবে না আপুনি। ওকে আসতে দাও। ‘
— ‘ তুই চুপ থাক। কতটুকু চিনিস এই দুষ্টুকে? এখনই বিছানায় উঠে লাফালাফি শুরু করবে। ‘
— ‘ মা! যারা পঁচা কথা বলে তারা পঁচা। ‘

নিধি চোখ গরম করে তাকালো। অপরদিকে মা-ছেলের দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটিতে সবাই ঠোঁট টিপে হাসছে। নিধি কন্ঠে খানিকটা রাগ নিয়েই বলল,

— ‘ আর যারা পঁচা কাজ করে তারাও পঁচা। এজ লাইক ইউ। দুষ্টু ছেলে একটা। ‘
— ‘ ওহ্। শাদমান গুড বয়। মাম্মা ব্যাড গার্ল। ‘

পিচ্চির কন্ঠে চূড়ান্ত ভাবের আভাস। আর কথার সুরে ভীষণ ঠেলা। আবারও নিধি চোখ পাকালো। আর নিচুস্বরে বিড়বিড় করল,

— ‘ এই যুগের বাচ্চাগুলো মারাত্মক চালু। ‘

অতঃপর সবার আরেকদফা হাসাহাসির মধ্যে সাদিদ এগিয়ে আসলো৷ আর নিজেই শাদমানকে ধরে আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে দিলো।

— ‘ বাবা, বেশি নড়াচড়া করে না। চাচি মণি ব্যাথা পাবে। সাথে ছোট্ট বাবুও ব্যাথা পাবে। বুঝেছ? ‘

শাদমান বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়ালো। যেন সে খুব বুঝতে পেরেছে। অতঃপর একদৃষ্টিতে সাদা তোয়ালে দিয়ে মুড়ানো ছোট্ট শরীরটার দিকে তাকালো। অনেকক্ষণ।

— ‘ কি যে দেখতাসে আল্লাহ জানে! এই পোলা এমন কইরা কি দেখস? বাচ্চা মাইয়া নজর লাগবো। চোখ সরা। ‘

শাদমানের এখন তানবীরের সেসব কথার দিকে নজর নেই। সে এখনও একধ্যানে ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। অতঃপর সবার হৃদপিণ্ডের উপর ছোটখাটো একটা টর্নেডো চালিয়ে দিয়ে ছোট্ট পিচ্চিটার গালে আরেকজন পিচ্চি ঠোঁট চেপে ধরল। আর টান দিয়ে নরমস্বরে ডাকলো,

— ‘ বউউউ। ‘

তানবীরের বোধহয় ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যাবার অবস্থা। সে বুকে হাত চেপে ধরেছে। চক্ষুযুগল তার অক্ষিকোটর থেকে বেড়িয়ে আসতে চায়। তার সুঠামদেহী বলিষ্ঠ শরীরটাকে শান্ত কোনোভাবে ধরে আছে। তাদের ন্যায় বাকি সবারও একি অবস্থা। কিন্তু যে সবার উপর দিয়ে এমন একটা ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব চালালো সে পুরোপুরি ভাবলেশহীন। ঠোঁটের কোণে এখনও তার মিষ্টি হাসি ঝুলসে।
কিন্তু আর বাকি সবার মতো আরেকজনের দৃষ্টিও ভিন্ন। তাতে যেন সবার ন্যায় চমকের আভাস নেই। ছোট্ট মুখমণ্ডলে হালকা রাগের আভাস যেন স্পষ্ট ভেসে উঠছে। শাদমান পিচ্চিটার রাগে ফুলে উঠা লাল গালটা হালকা করে টেনে দিতেই এবার যেন সব ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। নিমিষেই ঠোঁট উল্টে এক পাহাড় সমান অভিযোগ জমিয়ে সে বাবার দিকে তাকালো। যেন নিঃশব্দে বাবার কাছে এই দুষ্টু ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছে। আর জানতে চাচ্ছে এই ছেলেটা এতো পাঁজি কেন? বাবা যেন পাঁজিটাকে বকে দেয়।
সাদিদ মেয়ের মুখপানে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। এমন ফাঁসা বোধহয় সে ইহজীবনে ফাঁসেনি।
পরিস্থিতির এমন দফারফা অবস্থা দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে শাহেদই এগিয়ে আসলো। শাদমানকে কোলে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল,

— ‘ ছিঃ বাবা এসব বলে না। বউ না, বনু হয়। ‘
— ‘ না পাপা। বউ বউ। ‘
— ‘ শাদ? ‘

শাহেদের কন্ঠে ঈষৎ ধমকের আভাস। বাবার থেকে ধমক পেয়ে সে অভ্যস্ত নয়। তাই মুহূর্তেই মুখটা মলিন হয়ে গেল। শাহেদও ছেলের এই চেহারা দেখে ধমে গেল। বুঝানোর জন্য নরমস্বরে আবারও বলল,

— ‘ বাবা, এটা তোমার বনু হয়। তুমি না বলেছিলে একটা বনু চায়। তাইতো তোমার চাচ্চু আর চাচি মণি বনু এনেছে৷ ‘
— ‘ না পাপা এই বনু চাই না। এটা বউ, আমার লক্ষ্মি বউ। ‘

বলেই শাদমান ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে পিচ্চির গালে আবারও ছোট্ট করে চুমু দিলো। অতঃপর ঝড়ের আগাম সংকেত জানিয়ে মেয়ে এতক্ষণের শান্ত-শিষ্টতা ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করলো।
নীলার অবস্থা প্রায় মেয়ের মতোনই কেঁদে দেওয়ার মতন। সে পারছে না দৌড়ে এই বিশ্রী জায়গা ত্যাগ করতে।
শাদমান ছোট্ট পিচ্চির কান্নারত মুখশ্রীতে তাকিয়ে চোখ-মুখ মুহূর্তেই কুঁচকে নিলো। আর বিরক্তিরস্বরে বলল,

— ‘ লক্ষ্মি না, এটা পঁচা বউ৷ ‘

নিধির এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। ছেলেকে জোর পূর্বক বিছানা থেকে নামিয়ে বলল,

— ‘ চুপ আর একটা কথা নয়। সবসময় পাকনামি। ‘
— ‘ নতুবা কি? পাপা যখন কিসি দেয় তুমি বুঝি কান্না করো? আমার পঁচা বউ কান্না করে! ‘

নিধি যেই দম নিয়ে এসেছিল মুহূর্তেই এবার ভেজা বিড়ালে পরিণত হলো। আর সবাইকে না হয় বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু বাবা-মা, শশুর-শাশুড়ির সামনে এসব বললে কেমন লাগে? নিধির কান দিয়ে যেন গরম ধোয়া বের হচ্ছে। শাহেদ কোনোভাবে হাসি চেপে ছেলেকে আরও বোম ফাটানোর পূর্বেই কেবিন রুম থেকে বাহির করতে আসলো,

— ‘ চলো তো বাবা৷ আমরা আইসক্রিম খেয়ে আসি। এসব পঁচা কথা তোমাকে কে বলেছে? ভালো ছেলেরা এসব বলে না। ‘
— ‘ তার মানে তামমবীর চাচ্চু পঁচা? ‘
— ‘ মানে? ‘

এতক্ষণের বাকি সবার ক্লাস নেওয়া দেখে তানবীর আর শান্ত মনে মনে হেসে খুন হচ্ছিল। কিন্তু এবার যেন তাদের আত্মাটা গলায় এসে ঠেকেছে। তারা একে অপরের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো।

— ‘ তামমবীর চাচ্ছুই তো চাচি মাকে বলেছে লক্ষ্মি বউ, সোনা বউ। তারপর কিসি দিয়েছে তারপর বাবু…

তানবীর বোধহয় ঝড়েরবেগে এগিয়ে এসে শাদমানের মুখ চেপে ধরল।

— ‘ আরে শালার ভাতিজা চুপ যা এবার। নামটারই তো জগাখিচুরি কইরা দেস। তাইলে এইগলা কেমনে কস? তুই চল আমার সাথে৷ আজকে তোর একদিন আর আমার সবদিন। ঠোঁটের মধ্যে গ্লু না লাগাইলে একবারেই হইবো না। ‘

শাদমান ছুটবার জন্য অনবরত মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের করছে। কিন্তু তানবীর আর নিজের বেঁচে যাওয়া সামান্য ইজ্জতের দফারফা করতে ইচ্ছুক নয়। তাই বগলদাবা করে পাকনা ছেলেটাকে টেনে রুম থেকে বের করলো।
ছোট্ট মেয়েটার খাবার সময় হয়েছে বিধায় তানবীরদের পিছু পিছু বাকি সবাইও কেবিন থেকে বেড়িয়ে পড়ল। নীলা আর ছোট পিচ্চিটার সাথে থেকে গেল কেবলমাত্র সাদিদ। মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে নীলা সাদিদের মুখপানে তাকালো। অতঃপর এতক্ষণের জমে থাকা প্রশ্নটা করেই ফেলল,

— ‘ ব্যাপার কি বলুন তো। আপনার এতো চুপচাপ আমার ঠিক হজম হচ্ছে না। ‘

সাদিদ নীলার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। যেন এই হাসিতে কতো শত রহস্যেরা দানা বাঁধছে। কিন্তু সে মুখ ফুটে উত্তর দিলো না। কেবল মাথা নিচু করে মেয়ের কপালে ছোট্ট করে আদুরে স্পর্শ ছুঁইয়ে দিলো।
বাবার আদর পাওয়া মাত্রই মেয়ে খাওয়া ভুলে সাদিদের দিকে তাকালো। অতঃপর ধীরে ধীরে কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। ইশশ কি যে প্রশান্তি এই হাসিতে! সাদিদের বুকটা খুশিতে যেন নিমিষেই ফুলে উঠল। সে নিচু হয়ে মেয়ের ছোট্ট শরীরটা আলতো করে নিজের বাহুবন্ধনে আগলে নিয়ে বলল,

— ‘ পাপা তার প্রিন্সেসকে ভীষণ ভালোবাসে। ‘

মেয়ে বাবার কথাটার অর্থ ঠিক কতোটা বুঝলো কে জানে? কিন্তু ছোট্ট হাতগুলো নেড়ে বাবার ধূসর বর্ণের শার্টটা আঁকড়ে ধরতে চাইল।
নীলার চোখ বেয়ে অজান্তেই কয়েক ফোঁটা সুখের অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। এই দৃশ্য যেন হাজার বছর ধরে দেখলেও তৃপ্তি মিটবে না।
সাদিদ আচমকা নীলার দিকে তাকাতেই প্রিয়তমার চোখের কার্ণিশে জমা নোনা জলগুলো নজরে পড়ল। কয়েক মিনিট থমকালেও পরবর্তীতে এর কারণটুকু সাদিদ উদঘাটন করতে পারলো। কিন্তু তাকে হাসানোর জন্য দুষ্টুমির স্বরে মেয়ের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ দেখলে প্রিন্সেস, মা কেমন হিংসুটে? তোমাকে আদর দিচ্ছি দেখে মা কান্না করছে। দিবো নাকি, তোমার হিংসুটে মাম্মামকে একটু আদর? ‘
— ‘ ইশশ আমার বয়েই গিয়েছে। আপনারা বাপ বেটি আদর করেন আর গলায় ধরে ঝুলে পড়েন তাতে আমার কি? ‘
— ‘ কিছু না বলছো? ‘
— ‘ অবশ্যই। কোনো সন্দেহ আছে? ‘

নীলা চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই সাদিদ নিচুস্বরে হেসে ফেলল। অতঃপর নীলার কাছে এসে আলতো করে অধরে অধরে মিলনরেখা তৈরি করলো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে সরে আসলো। নীলা চমকিত দৃষ্টিতে একবার সাদিদের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকটার বুকের সাথে আগলে থাকা ক্ষুদার্ত মেয়েটার দিকে। সাদিদ তার চাহনির অর্থ বুঝতে পেরে প্রিয়তমার কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ফিচেল কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ বাকিটা মেয়ে রাতে ঘুমালে পূরণ করে দিব। এখন অবস্থা বুঝে রিক্স নিলাম না। ‘

অতঃপর নরম কানের লতিতে আলতো করে ধারালো দাঁতের কামড় পড়ল। আর নীলা বরাবরের মতোই মুখে একথালা রক্তিম আবির মেখে মাথা নুইয়ে নিলো।

#চলবে…