দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-১৯+২০

0
250

#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ১৯+২০
নীলাভ্র জহির

গতরাতে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাটি সারাদিন চিত্রার মনকে প্রভাবিত করে রইল। সকালে রান্নাঘরে এলে জোসনা বেগম চিত্রাকে বসার সুযোগ দিলেন না। ছেলের ওপর হওয়া ক্ষোভ তিনি এখনো ভুলতে পারছেন না।
সারাদিনে বেশ কয়েকবার বললেন, অন্য জায়গায় বিয়া হইলে আমার পোলায় কত জিনিস পাইতো!
মনে অশান্তি চিত্রার। প্রতিদিন এই এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি তার আর ভালো লাগছে না। রূপককে কথা দিয়েছিল বলেই সে শাশুড়ীর মুখের ওপর কোনো জবাব দিতে পারেনা।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। রান্না ঘরের চালার নিচে ভাত জ্বাল দিচ্ছেন জোসনা বেগম। চিত্রা উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছে । সন্ধ্যা হলেও আশেপাশের ঝাউ জঙ্গলে জোনাকির আনাগোনা বেশ প্রকট । ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক জানান দিচ্ছে নেমেছে রাত্রি । এই রাতের অন্ধকারে দখিনা বাতাসে চিত্রার মনটা কেমন যেন ছটফট করে । সে মনে মনে বলছিল যদি এই মুহূর্তে রূপক বাড়ি ফিরত তবে অনেকক্ষণ সে রূপককে জড়িয়ে ধরে থাকতো । মাঝে মাঝে রূপকের কথা খুব মনে পড়ে । সারাদিন মানুষটা কেমন করে কাটায় খুব জানতে ইচ্ছে করে চিত্রার । হাঁটতে হাঁটতে আবছা অন্ধকারে একটা ছায়া দেখে চমকে উঠলো । অন্ধকার কাটিয়ে বের হয়ে আসছে মানুষটা । কাছাকাছি আসতেই চিত্রা বুঝতে পারল সেটা আর কেউ নয়, তার রূপক। মাঝে মাঝে তার মনের আশা গুলো এভাবে পুরণ হয়ে গেলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয় ।
রূপক চিত্রার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, কি গো বৌ এইখানে কি করতাছো ?
একটু হাটতে ছিলাম ।
তুমি কি জানবার পারছিলা আমি আসতাছি ?
না তো ।
চিত্রা মনে মনে রূপককে খুব করে কামনা করছিল সেটা অপ্রকাশ্য রাখল । নিজের অনুভূতি গুলো সব সময় প্রকাশ করতে চিত্রার ভালো লাগেনা ।
রূপকের হাতে দুটো ব্যাগ। একটা ব্যাগ রান্নাঘরে মায়ের কাছে রেখে আরেকটা ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। জোসনা বেগম তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে। চিত্রা ঘরে ঢুকে ভেজিয়ে দিল দরজা। বুকের ভেতরটা কেমন যেন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল জোসনা বেগমের। তিনি এত আদিখ্যেতা সহ্য করতে পারেন না। এই ভরসন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দরজা আটকে দেয়ার ঘটনা টা তাকে যতটা না কষ্ট দিয়েছে তার চেয়ে বেশি তিনি কৌতুহলী হয়ে উঠেছেন রূপকের ব্যাগে কি আছে সেটা জানার জন্য। বউ এর জন্য কি নিয়ে এসেছে সে?

রূপক চিত্রার জন্য নিয়ে এসেছে একটা নতুন শাড়ী, ব্লাউজ পিস, নারিকেল তেল ও এক কেজি আপেল।
খুশিতে ঝলমল করতে করতে চিত্রা জিনিস গুলো নাড়াচাড়া করছিল। হারিকেনের টিম টিমে আলোয় ওর মুখে লাল আভা পড়েছে। রূপক সেই গোলগাল লাল গাল দুটো টেনে দিয়ে বলল এত খুশি হইছো বউ? তোমারে এমন সব সময় হাসি খুশি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।
আপনার মত মানুষরে পাইলে হাসিখুশি না থাকলে উপায় নাই।
আম্মায় তোমারে কিছু কইছে?
না,
কাম করনের লাইগা কিছু কয় নাই?
চিত্রার মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনি ক্যান কইছেন আমারে কাম না করতে দিতে। সে আমার উপর রাগ কইরা আছে। আমারে কোন কামে ধরতে দেয় না।
কাম কাজ না করতে দিলে তো আরো ভালো । শুইয়া বইসা কাটাও ।
আমার শুইয়া বইসা থাকতে ভালো লাগে না । আর তাছাড়া ওনারে দিয়া কাম করাইয়া আমি বইসা থাকমু সেটা কেমনে হয় ?
মন খারাপ কইরো না। দুইদিন পর ঠিক হইয়া যাইবো। তুমি এই এক কেজি আপেল আমার আম্মারে দিয়ে আসো। কইবা আপনার পোলায় এক কেজি আপেল আনছে। আপনারা খান। আমারে এইখান থাইকা দুইটা দিয়েন। তাইলে দেখবা তোমারে বেশি কইরা দিব। পোয়াতি হইলে একটু ফলমূল খাওয়াইতে হয় শুনছি। কিন্তু তুমি তো আর এক কেজি আপেল একা একা খাইতে পারবা না। আমার আম্মারে দিয়া দাও সে তোমারে খাইতে দিবো।
চিত্রা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যাইতাছি।
এখনই যাইতে হইবো না। একটু কাছে আসো। আজ আব্বা দোকানে বইছে। বেচাকেনা নাই। কইলাম তাইলে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই।
জামা কাপড়ের অর্ডার কেমন আসে?
প্রতিদিন দুই একটা অর্ডার থাকেই। দর্জিগিরি কাজ শিইখা ভালো করছি। রমজান মাসে আমার কাম বাইড়া যাইবো।
হ, আপনার লাইগা আমি সব সময় দোয়া করি।
বউ নতুন কাপড়টা একটু পড়ো। তোমারে মন ভইরা দেখি। তুমি পোয়াতি হওয়ার পর তোমারে আরো বেশি সুন্দর লাগে।
কি কন। আমারও তো এখনো পেটই বাইর হয় নাই।
পেটের জন্য না। তুমি এমনি খুব সুন্দরী হইয়া গেছ।
হইছে আর কইতে হইবো না।
দুইহাত বালিশের উপর দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রূপক। টর্চ লাইট নিয়ে পুকুর ঘাটে হাতমুখ ধুতে গেল চিত্রা। সন্ধ্যার অন্ধকার কেটে এখন রাত নেমেছে। ঝিঁঝির ডাক আর পুকুর ঘাটে ভেসে আসা শীতল বাতাসে তার মনটা ফুরফুরে লাগে। তার স্বামীর কাপড়ের ব্যবসা। চিত্রা আগে শুনেছে যাদের স্বামীর কাপড়ের ব্যবসা থাকে তারা বউকে খুব একটা কাপড় এনে দেয় না। তার স্বামী সবার চাইতে আলাদা। কয়েকদিন পরপর দোকানের সবথেকে সুন্দর শাড়িটা বউয়ের জন্য নিয়ে আসে রূপক। শরীরে হাওয়া লাগছে শিরশির করে। ঠান্ডা পানি দিয়ে চিত্রা হাত মুখ ধুলো। বাসনা সাবান মুখে ডল ফেনা তুলে মুখ ধুয়ে ফেলল। তারপর গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বাড়ির ভিতরে চলে এলো সে।
কয়েকদিন আগে কিনে দেয়া ক্রিম গালে মেখে তার ওপর পাউডার মাখল। মাথায় দিল সুগন্ধি তেল। চোখে মোটা করে কাজল টেনে দিয়ে কপালে দিল একটা ছোট্ট কালো টিপ। তারপর নতুন শাড়ির ভাঁজ ভেঙে পেটিকোটের ওপরে একটু একটু করে কুঁচি করতে লাগলো। চিত্রার শাড়ি পরা দেখতে দেখতে অন্য ঘোরে ডুবে যাচ্ছিল রূপক। তার বউয়ের পূর্ণযৌবনা শরীর। সুতীক্ষ্ণ নাভি। নাভির উপরের ব্লাউজের ভেতর থেকে ফেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে হৃষ্টপুষ্ট বক্ষ। শুধু পেটিকোট ও ব্লাউজে চিত্রাকে বড়ই রূপবতী লাগে। রূপকের খুব ইচ্ছা করল উঠে এসে চিত্রাকে একটু দলাই মলাই করে দিতে। কিন্তু সে উঠলো না। আজকাল বউয়ের জন্য তার খুব মায়া হয়। কামনার তীব্রতা বোধহয় ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
চিত্রা শাড়ি পড়া শেষ করে বুকের ওপর আঁচল তুলে দিল। তারপর লাজুক মুখে এসে বসল রূপকের সামনে। তার মাথায় হারিকেনের আলোয় জবজব করছে তেল। রূপক বলল তোমারে খুব সুন্দর লাগতাছে বউ।
লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চিত্রা মিটিমিটি হাসলো।

তাকে মন ভরে দেখল রূপক। প্রিয় মানুষকে দেখার মাঝে এক স্বর্গীয় আনন্দ বিরাজ করে। রূপক যতই তাকিয়ে আছে চিত্রার দিকে তার হৃদয়টা ভরে যাচ্ছে পুলকে। সদ্য মাড় ভাঙ্গা শাড়িতে চিত্রাকে নতুন বউয়ের মত লাগছে। তার সন্তানের মা হওয়ার পরও কি চিত্রাকে এমন নতুন নতুন লাগবে। নতুন বউ লাগার জন্য মাঝেমাঝে রূপক তাকে একটা করে নতুন শাড়ি এনে দেবে ভাবতে লাগলো।
এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল রুবিনা। হাতে এনেছে বাটি ভর্তি পেঁয়াজ মরিচ ও সরিষার তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি। রুপক বিছানার উপর উঠে বসলো। মুড়ির বাটি নিয়ে খেতে শুরু করল সে। একপলক চিত্রার দিকে তাকিয়ে রুবিনা বলল ভাবি তোমারে সুন্দর লাগতাছে। এই কাপরটা কে দিছে?
তোমার ভাইজান একটু আগে নিয়ে আসলো।
ভাবি আমি যাই।
রূপক বলল, রুবিনা দাঁড়া। আমি আপেল আনছিলাম। আপেলের ব্যাগটা নিয়ে যা।
থমকে দাঁড়াল রুবিনা। চিত্রা টেবিলের উপরে থাকা আপেলের পুরো ব্যাগটাই রুবিনার হাতে দিয়ে দিল।
রূপক বলল, ওইখান থেইকা দুইটা আপেল তোর ভাবিরে দিয়া যাস ।
কাইটা নিয়া আসি। তুমি খাইবা না ভাইজান?
তোর ভাবিরে দুইটা গোটা আপেল দিস। ওর এখন পুষ্টি খাবার খাওয়া দরকার আছে।

রুবিনা তাদের সামনেই পলিথিন এর প্যাকেট খুলে দুইটা আপেল বের করে টেবিলের উপর রাখল। হাসিমুখে বলল, ভাবী এই দুইটা তুমি খাইয়ো।
তারপর বাকি আপেল গুলো নিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাতের ঘটনার পর থেকে রুবিনার আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। চিত্রার প্রতি যেমন তার সম্মানটা অনেক বেড়েছে তেমনি বেড়ে গেছে সহানুভূতি ও ভালোবাসাও। চিত্রা এখন অনেক আপন হয়ে গেছে তার। বিষয়টা খুব ভালো লাগছে চিত্রার কাছে।

কিন্তু ওই দিকে হিতে বিপরীত ঘটলো। জোসনা বেগম আপেলের খোলা প্যাকেট দেখে ভাবলেন ছেলে বউয়ের জন্য অনেক ফলমূল নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে মাত্র কয়েকটা আপেল দিয়েছে তার জন্য। তার সামনে আপেল রাখতেই তিনি বললেন, তোর ভাই আনছে?
হ মা । ভাবিরে দুইটা দিয়া আইছি। এইগুলা আমাগো লাইগা দিলো। দুইটা ধুইয়া ভাইজান রে কাইটা দিয়ে আসি?
দিয়ে আয়।

জোসনা বেগম অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ছেলে আগে কখনোই বাড়িতে আপেল কমলা নিয়ে আসেনি। ইদানিং বউয়ের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কিছু নিয়ে আসে। সেগুলো মায়ের হাতে দেয় না। সরাসরি নিয়ে যায় বউয়ের কাছে। তারপর বউয়ের দয়া হলে সেখান থেকে দিয়ে যায় তার কাছে কিছু। বিয়ে করতে না করতেই তার ছেলেটা কেমন স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। পেটের ছেলে ও কি কখনো আপন হয় না? ওনার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে লাগলেন তিনি।
তিনটা আপেল কেটে পিরিচে করে কিছু ভাই ও ভাবীর জন্য নিয়ে গেল রুবিনা। সেগুলো দিয়ে এসে জোসনা বেগমকে বলল, তুমি খাইবা না?
না, তুই খা।
কেন খাইবানা?
অত কথার উত্তর তো দিতে পারুম না। খামু না আমি। এগুলা আমার চোখের সামনে থাইকা সরা।
রুবিনা কিছুই বুঝতে পারলো না। সে জানে মা ভাবির উপর রেগে আছে। সেই রাগ এখনো স্থায়ী হবে সেটা রুবিনার জানা ছিল না। সে দাওয়ায় বসে আপেল খেতে খেতে বলল, আম্মা ভাইজান ভাবির লাইগা একটা খুব সুন্দর কাপড় আনছে।
কোন দিন?
আইজই। একটু আগেই একটা কাপড় নিয়া বাড়িতে ফিরছে।
নতুন কাপড় নিয়ে আইছে?
হ মা ।
লগে আর কি আছে?
আমিতো টেবিলের উপরে শুধু আপেল দেখলাম। আর নারিকেল তেল। একটা ব্লাউজের পিস মনে হয়।
ঈর্ষায় আরো জ্বলে গেলেন জোসনা বেগম। তার ছেলে সত্যি সত্যি পর হয়ে গেছে। পরের বাড়ির একটা মেয়ে তার বাড়িতে ঢুকে দুদিনেই হাত করে ফেলেছে তার ছেলেটাকে। সে এখন শুধুমাত্র বউয়ের জন্য কাপড় আনে। ভুল করে কখনো মায়ের জন্য কাপড় আনে না। বউয়ের জন্য নারিকেল তেল নিয়ে এসেছে। ফলমূল নিয়ে এসেছে। আর মাকে দিয়ে গেল মাত্র কয়টা আপেল?

জোসনা বেগম অন্যদিকে মুখ করে আঁচলের আড়ালে নিজেকে ঢেকে ফেললেন। তার চোখ ভিজে আসছে। মনে মনে ভাবলেন আজকে স্বামী ফিরলে এর একটা ব্যবস্থা তিনি করেই ছাড়বেন।

জোসনা বেগম রাতে ভাত খেলেন না। দাওয়ায় ছেলে মেয়ে ও ছেলের বউকে তিনি নিজের হাতে ভাত বেড়ে দিলেন। পুরোটা সময় মুখ গম্ভীর হয়ে রইলো ওনার। রূপক বারবার বলল, আম্মা তুমি খাইবা না?
তিনি উত্তরে বললেন, তোর বাপ আসলে খামু।
জোসনা বেগম মাঝে মাঝেই এমন করেন। স্বামী ফিরলে একসঙ্গে বসে ভাত খান। তাই রূপক এটা নিয়ে কোন বাক-বিতণ্ডা করল না।
কিন্তু রাতে ভাত খেলেন না তিনি। স্বামী বাসায় ফিরতেই তিনি কান্না জুড়ে দিলেন। আহাজারি করা কান্না। তার ছেলে পর হয়ে গেছে। বিয়ে দিতে না দিতেই ছেলেটা আর বাবা মাকে চেনেনা। এখন তার সবকিছু নিজের স্ত্রী। স্ত্রীর জন্য কত কি নিয়ে আসে আর তার কপালে জোটে দুটো আপেল।
স্ত্রীকে তিনি সান্তনা দিতে পারলেন না । তিনি যাই বলতে চান না কেন জোসনা বেগম আরো বেশি হাহাকার করে কাঁদতে থাকেন। তবে সেই কান্নার শব্দ চিত্রার ঘরে পৌঁছালো না। কারণ বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। রূপক আর চিত্রা অনেকদিন পর শব্দ করে হাসার সুযোগ পেয়েছে। রূপকের কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে চিত্রা। নতুন শাড়ির আবরণ গা থেকে সরিয়ে সে স্বামীর বক্ষে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

ভরদুপুর। উত্তপ্ত গরম চারদিকে। কোকিলের কুহু কুহু ডাক ভেসে আসছে। ঘরের দাওয়ায় বসে আছে চিত্রা। হঠাৎ খেয়াল করলো গোয়ালঘর থেকে ছাগলের দড়ি হাতে নিয়ে রুবিনা ঘরের দিকে যাচ্ছে। প্রথমে বিষয়টা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হল। কারণ সকাল বেলা ছাগলগুলোর গলা থেকে দড়ি খুলে ছেড়ে দেয়া হয় ঘাস খাওয়ার জন্য। তারপর আবার সময়মতো দড়ি গলায় বেঁধে ছাগলগুলোকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু যখন দেখল রুবিনা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল তখন মনে খটকা লাগল চিত্রার। এই ভর দুপুরে দড়ি নিয়ে মাঠে না গিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করবে কেন?
চিত্রা কিছুক্ষণ ওর দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল নিরবে। এখনো রুবিনা দরজা খুলছে না। চিত্রার মনের খচখচানি বেড়ে গেল। সে ধীরে ধীরে উঠে রুবিনার ঘরের দিকে এগিয়ে আসলো। গত কয়েকদিন ধরে জোসনা বেগম চিত্রার সঙ্গে সারাক্ষণ খারাপ আচরণ করছেন। রান্নাঘরে ওকে ঢুকতে দেয়া হয় না। এমনকি বাড়ির কোন কাজে হাত দিতে দেননা জোসনা বেগম। কথায় কথায় পাড়া-পড়শিকে দেখে তিনি যৌতুকের বিষয়ে নানান আজেবাজে কথা শোনাতে থাকেন। এসব কিছু নিয়ে চিত্রার মনটা সারাক্ষণ খারাপ হয়ে থাকে। সে বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে বসে কাটায়। বাড়ির আর কারো দিকে তার খেয়াল ছিল না। আজকে হঠাৎ মনে হল গত কয়েকদিন ধরে রুবিনার মনটা খুব বিষন্ন। সেটা সে আগে খেয়াল করেনি। রুবিনার ঘরের দিকে আস্তে আস্তে চিত্রা সেসব কথাই ভাবছিল। তার মনের ভেতর এক ধরনের কু ডাক ভেসে আসছে।

টিনের ঘর রুবিনার। চিত্রা দরজায় ধাক্কা না দিয়ে আগে টিনের ফুটা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ঘরে কি ঘটছে? কিন্তু মনের কু ডাক সত্যি এভাবে ফলে যাবে সেটা কল্পনাতেও আসেনি চিত্রার। ফুটা দিয়ে ভেতরে তাকানো মাত্রই তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। এটা কি করছে রুবিনা? উপরের বাঁশের খুঁটির সঙ্গে সে ছাগলের দড়ি দিয়ে বেঁধে গলায় ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করছে। মুহূর্তেই পুরো দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে গেল। ছোটখাটো একটা চিৎকার করে উঠল চিত্রা। তবে তার চিৎকার শুনে এগিয়ে আসার মত এই সময় বাড়িতে কেউ নেই। রুপক ও তার বাপ গেছে দোকানে। জোসনা বেগম গেছেন গরুর ঘাস কাটতে। চিত্রা দৌড়ে এসে খুব জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। তবে দরজা খুব শক্তভাবে বাধা হওয়ার কারণে তার শক্তিতে কিছুই ঘটল না। চিত্রার খুব ছটফট লাগছে। পাগলের মত সে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। একবার দৌড়ে গেল জানালার কাছে। জানালা বন্ধ। আবার দৌড়ে এল দরজার কাছে। সে ভেবেছিল তার চিৎকার শুনে রুবিনা দরজা খুলে বের হয়ে আসবে। কিন্তু না, উল্টো শুনে রুবিনা আরো তাড়াতাড়ি রশির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। টিনের ফুটো দিয়ে আবারও তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখে যেন চিত্রার গায়ে অশুরের শক্তি ভর করল। ঝড়ের বেগে ছুটে এসে দা দিয়ে টিনের উপর বড় বড় কোপ দিয়ে টিন কেটে ফেলল। ঘরের ভিতরে লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ল চিত্রা। ততক্ষনে রুবিনা দড়ির ভেতর গলা ঢুকিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এখনো পায়ের তলা থেকে টুল সরাতে পারেনি। চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তার দুই পা জাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। চিত্রার কান্না দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল রুবিনা। এর আগে কেউ কোনদিনও তাকে এভাবে ভালোবেসেছে বলে তার মনে পড়ল না । মা বাবা ভাই তাকে অনেক ভালোবাসে। তবে চিত্রার কান্না দেখে মনে হচ্ছে সে হারিয়ে গেলে সব থেকে বেশি কষ্ট পাবে তার ভাবি। এভাবে তাকে মরে যেতে দেবে না চিত্রা।
রুবিনা নিজেও হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। চিত্রা তার দুই পা জাপ্টে ধরে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বইন তুমি এইকাম কইরো না। আমি জানিনা তোমার কি হইছে? কিন্তু এই কাম কইরো না। আমারে কও কি হইছে? কিসের কষ্ট তোমার। কেন তুমি মইরা যাইতে চাইতেছ?

রুবিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল ভাবী আমারে ছাইড়া দাও। আমি কাউরে আর কোন কষ্ট দিতে চাইনা। আমি আমার বাপ মায়েরে কোন কষ্ট দিতে পারুম না।
বাপ মায়েরে কষ্ট দিবা ক্যান? তুমিতো খুব ভালো একটা মাইয়া। কষ্ট দেয়ার মত কোন কাম তুমি করবা না।
আমি যে কাম করছি তাতে তারা অনেক কষ্ট পাইব। এই কষ্ট পাইলে আমার আব্বা সহ্য করতে পারবো না। তিনি নিজে আমারে কাইটা টুকরা টুকরা কইরা নদীতে ভাসাইয়া দিব।
কি হইছে তোমার বইন? আমারে কও।
চিত্রার কান্না থামল না। সে বলল, তুমি উপর থাইকা নাইমা আসো নাইলে আমি কিন্তু চিৎকার করমু। তোমার পা ছারুম না।

ভাবির কান্না দেখে বাধ্য হয়ে রুবিনাকে নিচে নেমে আসতে হল । রুবিনা আসার পর তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কি হইছে তোমার বইন? কষ্টের কথা কেন কইতাছো?
মান সম্মান সব নষ্ট কইরা ফেলছি।
ক্যান বইন? কি ভুল করছ তুমি?
ভাবি আমি সেদিন আপনারে একটা কথা কই নাই।
কথাটা বলতে বলতে আবার ওকে কাঁদতে শুরু করল রুবিনা। চিত্রা ওর হাত ধরে বলল, কি কথা?
আপনের কাছে একটা জিনিস লুকাইছিলাম। কইছিলাম মেইন জিনিসটা বাদ দিয়ে সব হইয়া গেছে। মিথ্যা কইছিলাম। আমাগো কোন কিছুই বাদ নাই। সবকিছুই হইয়া গেছে। মেলা কয়বার আমরা একলগে থাকছি।
তাতে কি হইছে? সেই জন্য মরতে হইবো? ওই পোলায় কি কইছে তোমারে বিয়া করব না?
রুবিনা কিছু বলতে পারলো না। কান্নায় ভেঙে পড়ল। চিত্রা তার হাত চেপে ধরে বলল কি হইছে বইন। আমি তো তোমার বড় বইন। আমারে কও।
ভাবি আমি অনেক বড় সর্বনাশ কইরা ফেলছি। আমার প্যাটে বাচ্চা আইছে।
চিত্রার সমস্ত শরীর হঠাৎ করে যেন প্রচন্ড কম্পন করে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এই ভ্যাপসা গরম ভরদুপুরে কোকিলের ডাক সবকিছুই অবাস্তব। দরিয়ার অতল গহব্বরে সে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। ডুবতে ডুবতে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে রুবিনার ভয়াবহ মৃত্যু। দেখতে পাচ্ছে তার স্বামীর আর্তনাদ ও শ্বশুর-শাশুড়ির চিৎকার। দেখতে পাচ্ছে পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন ও গ্রামবাসী সবাই কিভাবে তার স্বামীর পরিবারকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অপমান করছে। সব কিছু ভাবতে ভাবতে তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। এবার তার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে লাগল রুবিনা। কাঁদতে কাঁদতে বলল ভাবি আমি কি করবো আপনি কন। এই কথা আমি কাউরে কইতে পারুম না। এই কলঙ্ক নিয়া আমি কি করুম? আমি কই যামু?

রুবিনার কান্না যেন পুরো বাড়িটাকে আরো গুরুগম্ভীর করে তুলল। এ যেন অকুল দরিয়ায় তুমুল ঝড়। অবশেষে চিত্রা ফিরে এলো তার বাস্তব জগতে। ধীরে ধীরে সে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ভেঙে পড়লে চলবে না। সে যদি ভেঙ্গে পড়ে তবে চোখের সামনে যা ভাসছিল সেটাই ঘটবে। বরং এই মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে সবকিছু ধীরেসুস্থে সামাল দিতে হবে। কথা বলতে গিয়ে টের পেল তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।

আস্তে আস্তে সে রুবিনাকে তুলে তার পাশে বসালো। তারপর বলল আমি তোমারে যা কমু তুমি সেটা করতে পারবা?
ফ্যালফ্যাল করে চিত্রার দিকে তাকালো রুবিনা।
চিত্রা রুবিনার হাত ধরে বলল তার আগে আমারে তুমি একটু বিশ্বাস করতে হইবো। আমি এসব কথা কোনদিনও কাউরে কমু না। আমি বাইচা থাকতে তোমার মান সম্মানের হানি হয় এমন কোনকিছুই কাউরে কমু না। তুমি আমারে বিশ্বাস করো। মন একটু শক্ত করো। এইখানে একটু চুপচাপ বস। আমি যা কই শুনো

শান্ত হয়ে বিছানার উপর বসল রুবিনা। চিত্রা সবার আগে ছাগলের দড়ি দিয়ে টাঙ্গানো ফাঁসটা খুলে ফেলল।

কিন্তু ঝামেলা হল টিনের বেড়া কেটে ফেলেছে। এটা কিভাবে জোড়া দিবে? সেই চিন্তা বাদ দিয়ে দা লুকিয়ে রেখে আপাতত চিত্রা রুবিনার পাশে এসে বসল। রবিনা অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। চিত্রা বলল, বইন সবথেকে বড় কথা হইল এই কথাটা তুমি কাউরে কইবানা। কাউরে বুঝতেও দিবানা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পারলে দুই-একদিনের মধ্যে ওই পোলার লগে তোমার বিয়ার ব্যবস্থা করতে হইবো।

সেটা কেমনে হইব ভাবি? সে তো বেকার। কাম কাজ কিছুই করে না। আমার বাপ ভাই জীবনেও ওর লগে আমার বিয়া দিব না।
তোমার ভাইরে আমি বুঝাই কমু । তুমি কিছু কইবানা। আমি যা কওনের কমু। তুমি শুধু আমার কথায় হ হ কইরা যাইবা। যত ঝামেলা ঝাটি যাইহোক বিয়েটা দিতেই হইবো। বিয়া হইয়া গেলে কয়টা দিন পরেই সবাইরে কইবা তুমি পোয়াতি হইছ।
কিন্তু কিভাবে ওর লগে আমার বিয়া কেমনে হইব? আমাগো বাড়ির কেউ রাজী হইবো না। ওর বাড়ির মানুষজনের কেমনে রাজি করাইব এত তাড়াতাড়ি।
ওর বাড়ির মানুষজনের রাজি করানোর দায়িত্ব তুমি কইরা দিবা। সবচাইতে বড় কথা হইলো এই মুহূর্তে মান সম্মান রক্ষা করতে হইবো। তাও এমন ভাবে করতে হইবো যেন গ্রামের লোকজন কিছু না জানে। ওই পোলা কি তোমারে বিয়া করব?
হ, করব।
তাইলে তুমি এই মুহূর্তে ওরে আমার লগে দেখা করতে কও। আমি চিন্তা করতেছি কেমনে সব কিছু সামাল দিব।

রুবিনা তার ভাবিকে জাপ্টে ধরে কেঁদে ফেলল। চিত্রা চোখ মুছে দিল রুবিনার।
রুবিনা বলল ভাবি। তুমি মানুষটা বড় ভালা। আমার মানসম্মানের কথা তুমি এমন কইরা ভাব। তোমারে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে মন চাইতেছে।
তুমি তো আমার বোইন। তোমাগো সম্মান আমার সম্মান। আমি এই পরিবারের সম্মানের কথা ভাববো না তোকে ভাববো?
তুমি যে এত ভাল মানুষ এটা আমি আগে বুঝিনাই ভাবি। আমি ওরে একটা কল দিমু। সাবিনা আপার মোবাইল থেকে মিসকল দিলে ও কল ব্যাক করব। যেহেতু আম্মা বাড়িতে নাই, ওরে আমাগো বাড়িতে আসতে কমু?
আম্মা যদি আইসা পড়ে?
বাড়ির বাইরে বইসা কথা কইবেন। আম্মা কিছু মনে করব না। এলাকার পোলাপান। মাঝেমধ্যে তো বাড়িতে আসে। আম্মা কিছু টের পাইব না।
আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি ওরে আইতে কও। আমি কমু তোমার ভাইয়ের খোঁজে আইছিল।

শরীরে কম্পন কিছুটা কমেছে মনে হচ্ছে রুবিনার। সে মাথায় ওড়না দিয়ে পাশের বাড়ির সাবিনার কাছে গেল । সাবিনা কলেজে পড়ে। তার কাছে মোবাইল আছে। সাবিনার সঙ্গী রুবিনার সম্পর্ক বেশ ভালো। তাই ওর ফোন থেকে মাঝে মাঝে প্রেমিকের সঙ্গে ফোনালাপ করতে পারে রুবিনা।

রুবিনা বেরিয়ে গেলে নিস্তব্ধ বাড়িতে দাঁড়িয়ে চিত্রার বুকটা কেমন যেন হাহাকার করতে লাগলো। এত বড় জটিল একটা সমস্যা কিভাবে সমাধান করবে সেটা ভেবেই তার শরীর কাঁপছে। এই কথাটা রূপক কে বললে রূপক অনেক কষ্ট পাবে। রুবিনার প্রতি রূপকের ঘৃণাও জন্মাতে পারে। তাছাড়া রুবিনা কে সবার চোখে ছোট হতে দেয়া যাবে না। সবাইকে না জানিয়েই কিছু একটা করতে হবে।
উঠানে পায়চারি করতে করতে ছটফট করছিল চিত্রা। আর মনে মনে ভাবছিল কিভাবে এই জটিল সমস্যার সমাধান করবে। রুবিনার কাটা টিনের বেড়ার দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতরটা আরো বেশি হাহাকার করে উঠলো। জোসনা বেগম বাড়ি এসে জানতে চাইবেন কী করে বেড়ায় এই অবস্থা হলো। তাকে মিথ্যা কথা বলে সামাল দিতে হবে। বলতে হবে রুবিনা ও চিত্রা গোসল করতে গিয়েছিল। বাড়িতে এসে দেখেছে এই অবস্থা। কে বা কারা এসে এমন করেছে তারা জানে না। এই মিথ্যা কথা বলা ছাড়া জোসনা বেগমের চোখ ফাঁকি দেওয়ার কোনও উপায় নেই।

রুবিনা বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে চিত্রা কে বলল, ভাবি আমি ওরে আইতে কইসি। ও সাইকেল লইয়া আইতাছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আইসা পড়বো।

চলবে…