উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
331

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৮
_________________

“এটা কেন করছো মাদার সালেম? এটার কারণ কি সামুরা? তুমি চাও ড্যাড আমাকে যেই কোম্পানিটা দিতে চাচ্ছে সেটা সামুরার হোক? এটাই তোমার চাওয়া? এর জন্যই এত কিছু করছো?”
ক্যানিয়ল একদৃষ্টে নাইলা সালেমের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো কথাগুলো।

নাইলা সালেম বুঝতে পারছেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন। ক্যানিয়লের কথা ঠিক। সে ওই কোম্পানিটা বিশেষ পছন্দ করে রেখেছিলেন। সে চায় ক্যানিয়লকে দিতে চাওয়া কোম্পানিটা সামুরার হোক। আর সেজন্যই তিনি পণ করেছিলেন কোম্পানিটা যাতে ক্যানিয়ল গ্রহণ না করে সেজন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। তাই করেছেন। ফোন দিয়ে হুমকি, এমন কী শারীরিক আঘাত পর্যন্ত করতে তিনি দ্বিধা বোধ করেননি। অবশ্য এই ব্যাপারটা ছাড়াও অন্য আরও অনেক ব্যাপারে সে ক্ষুব্ধ ক্যানিয়লের উপর। ক্যানিয়ল ম/রে গেলেও তার যায় আসে না। ক্যানিয়লকে সে প্রচণ্ড ঘৃণা করে! ক্যানিয়লের জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত ক্যানিয়ল তার কাছে অসহ্য এবং বিরক্তির একটা নাম। যেমন অসহ্য ছিল ক্যানিয়লের মম, ঠিক তেমনি অসহ্য ক্যানিয়ল। বেলা লিমাসকে তো তাও বিতাড়িত করা গেছে, কিন্তু ক্যানিয়লকে তিনি কিছুতেই তাড়াতে পারেননি। মুহাম্মদ ইসহাক যেন সর্ব পুত্র অপেক্ষা ক্যানিয়লকেই বেশি ভালোবাসেন। একদিন ক্যানিয়লের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়েছিল মুহাম্মদ ইসহাকের সাথে। অবশ্যই ক্যানিয়লের ব্যাপারে খারাপই বলতে গিয়েছিল সে। কিন্তু একটা বাক্য সে সম্পূর্ণ করতে পারেনি তার আগেই মুহাম্মদ ইসহাক তাকে সাফ জানিয়ে দিলেন– ক্যানিয়লের যা ইচ্ছা ক্যানিয়ল তাই করবে। ক্যানিয়লের জন্য সবকিছু উন্মুক্ত। এ ব্যাপারে তার সাথে ফারদার যদি আর কোনো কথা কেউ বলতে আসে তাহলে ক্যানিয়লের জন্য নয়, কথা বলতে আসা মানুষটাকে সে শাস্তিস্বরূপ কিছু উপহার দেবে।
মুহাম্মদ ইসহাকের কথা শুনে সেদিন নাইলা সালেম বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন মুহাম্মদ ইসহাককে বুঝিয়ে কিছু হবে না। তাই তিনি এরপর থেকে ক্যানিয়লের ব্যাপারে আর কিছুই বলেননি তার কাছে। যত ক্ষোভ, রাগ, ঘৃণা, ষড়যন্ত্র নিজের কাছেই জমা রেখেছে। ক্যানিয়লকে তাও আগে পোষ মানানো যেত। কিছু বললেও ক্যানিয়ল চুপচাপ তা মেনে মাথা নিচু রেখে চলে যেত। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যানিয়ল এমন হয়ে গেল যে কিছু বললেও ওর গায়ে লাগে না। উদ্ভট হয়ে গেছে!

নাইলা সালেম বললেন,
“তুমি কী বলছো আমি বুঝতে পারছি না ক্যানিয়ল! আমাকে নিয়ে এসব অন্যায় কথা বলার সাহস করো কীভাবে?”

ক্যানিয়ল ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসলো,
“কলে হুমকি, রোডে অ্যাটাক, আমার উপর নজরদারি…সব কিছুই তো তুমি জানো মাদার সালেম! এসব বন্ধ করো। আমি ড্যাডের কাছে বলতে চাইছি না এসব তুমি করছো। ভাই-বোনদের ভিতর সামুরা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ওর সাথে অন্তত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দিয়ো না আমার।”

নাইলা সালেম দমবন্ধকর হেসে বললেন,
“আমি সত্যিই জানি না তুমি কোন ব্যাপারে কথা বলছো।”

“অভিনয় না করে সাবধানী হও। আফসোসের স্বীকার হয়ো না।”

ক্যানিয়ল আর দাঁড়ালো না। নাইলা সালেমের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে এলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলো নানান কিছু। এসবের পিছনে নাইলা সালেম আছে এ ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছে মি. হেনরি। মি. হেনরির দেওয়া তথ্য ভুল হতে পারে না এটা সে খুব ভালো করে জানে। নিজের মমকেও মনে পড়লো। মানুষটা এই বৃহৎ রাজপ্রাসাদে তাকে একলা ফেলে কেন চলে গেল? চলে না গেলে স্মৃতির পাতা জুড়ে আজ হয়তো অনেক সুখী মুহূর্ত থাকতো। যেগুলো এখন দুঃখী মুহূর্তে পূর্ণ! মিরান্ডাকে নিয়ে ভাবতেও কার্পণ্য করলো না তার মন। মিরান্ডা! একজন ভালো বন্ধুর নাম। কিন্তু এনগেজমেন্ট হওয়ার পর থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আর অটুট নেই। সম্পর্কটা এখন কেমন যেন হয়ে গেছে। কেমন হয়েছে তা ব্যাখ্যাহীন! সেই এনগেজমেন্ট হওয়া থেকে বার বার শুধু একটা কথাই মনে হয়, মিরান্ডাকে বিয়ে করা আসলে তার পক্ষে সম্ভব নয়! তবুও সে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার কাছে শুধু ব্যর্থতা ধরা দিয়েছে। মিরান্ডার জন্য একচুল পরিমাণ ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করতে পারেনি। মিরান্ডা কাছে আসলে তার নিঃশ্বাস ভারি হয়নি কখনও, হৃদয় অদ্ভুত আচরণেরও স্বীকার হয়নি। তবে হৃদয় প্রথমবারের মতো অদ্ভুত আচরণ করেছিল সেদিন। নিঃশ্বাসও এলোমেলো হয়েছিল তখন, যেদিন ইরতিজা তার মাথায় হাত রেখে বলেছিল,
‘এরপর থেকে যখন কাঁদবে, তখন আমাকে জানাবে যে তুমি কাঁদছো। তোমার কান্নার মাঝে আমি গিয়ে তোমার মাথায় হাত রাখবো।’

ইরতিজার বলা একেকটা শব্দকে খুব যতনে অনুধাবন করে চলছিল ক্যানিয়ল। কলের শব্দে ভাবনা স্থগিত হয়ে নিজের আসন উঠিয়ে নিলো মস্তিষ্ক থেকে। ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্টিভেন কল করেছে। ফোনটা কানে ধরে বললো,
“হ্যাঁ বলো মিস্টার স্টিভেন।”

ওপাশ থেকে স্টিভেন বললো,
“ট্রিপ।”

ক্যানিয়ল ভ্রু কুঁচকালো,
“ট্রিপ?”

“হ্যাঁ, আগামীকাল ট্যুরে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা আছে আমার আর প্রফেসর ব্রুসের। তুমি কি আমাদের সাথে যোগদান করবে?”

“নো ওয়ে, তোমাদের সাথে কেন যাব? তোমরা প্রয়োজন হলে তোমাদের ওয়াইফ-বেবি নিয়ে যাও। আমাকে কেন ডাকছো?”

“বিবাহিত হলে নিশ্চয়ই ওয়াইফ-বেবি নিয়েই যেতাম। তোমার কারণেই আমার বিয়েটা আটকে রয়েছে। আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে যদি আমার ব্রেক আপ না হতো তাহলে এতদিনে আমি বিবাহিত থাকতাম। ওইদিন আসলে তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি!”

“এটা নিয়ে কি তুমি আফসোস করছো মি. স্টিভেন?” ভারি বিস্ময়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ক্যানিয়ল।

“হ্যাঁ করছি। সেদিন তোমাকে না নিয়ে গেলে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা হতো না তোমার। আর ও দেখা মাত্রই তোমার প্রেমে পড়ে যেত না। মরিয়া হয়ে উঠতো না আমার সাথে ব্রেকআপ করার জন্য।”

“এখন কি আমি দায়ী হলাম তোমাদের ব্রেক আপ হওয়ার জন্য?”

“হ্যাঁ।”

“তো এখন কী করতে পারি? তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে তোমার ব্রেকআপ হওয়ার জন্য যেহেতু আমি দায়ী, তাহলে কি তুমি আমার সাথে প্রেম করবে?”

স্টিভেন থতমত খেয়ে গেল। ঘোর বিস্ময়ে বললো,
“তুমি আমার সাথে এরকম রসিকতা করছো ক্যানি?”

“রসিকতা নয়। যদি তুমি আমার সাথে প্রেম করতে চাও তাহলে বলো। আমি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য মুখিয়ে থাকবো।”

ওপাশে লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা পেল না স্টিভেন। একজন স্টুডেন্ট তার সাথে এমন রসিকতা করছে এটা ক্যাম্পাসে প্রকাশিত হয়ে গেলে তার মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে।

__________________

আজকের আবহাওয়া ভারি সুন্দর। চকচকে রোদ, মৃদু হাওয়া, সেই সাথে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। পাহাড়ের ভ্যালিগুলো ভালো করে দেখা যাচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে এই সব কিছু বিতৃষ্ণা লাগছে ইরতিজার। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে গ্রিন লেক পার্কের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভিংয়ে আছে সাজিদ। ড্রাইভিংয়ের পাশের সিটটায় ইরতিজা। এখানে বসতে একদম ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু জুহির পীড়াপীড়িতে বসতে হলো! পিছনের সিটে আছে জুহি, রিশন এবং আন্দ্রেজ। প্রথমে যাওয়ার কথা ছিল শুধু সাজিদ, ইরতিজা আর জুহির। কিন্তু জুহি সাথে আন্দ্রেজকেও নিয়ে এলো। যদিও আন্দ্রেজ আসতে চায়নি। জুহি জোর করেছে সাথে আসতে। রিশন এসেছে নিজ ইচ্ছায়। ওখানে গিয়ে ভিডিয়ো শুট করবে এটাই তার প্রধান উদ্দেশ্য।
ইরতিজা একদমই চায়নি সাজিদের সাথে ঘুরতে আসতে। তবে পরিবারের লোকেরা ঘুরতে আসার ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিল। জোর করে পাঠিয়ে দিলো সাজিদের সাথে। সব কিছু মিলিয়ে দিনকে দিন তার বিরক্ত ধরে যাচ্ছে সাজিদের প্রতি। পরিবারের লোকেরা তো চাচ্ছে সাজিদের সাথে তার বিয়ে হোক। কিন্তু এদিকে সে তো তাতে সম্পূর্ণ বিরোধী। কিছুতেই পারবে না সাজিদকে বিয়ে করতে। মেনেই নিতে পারবে না সামান্য একটা ঘটনা থেকে তার এনগেজড হয়েছে, এবং সেই এনগেজমেন্ট থেকে বিয়েও হবে! মাঝে মধ্যে ইচ্ছা হয় দূরে কোথাও হারিয়ে যায়। যেখানে সে সবকিছু তার নিজের মতো করে করতে পারবে। কেউ চাইলেই কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না তার উপর। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল ইরতিজার বুক চিরে। জোনাসকে সামনে পেলে এই মুহূর্তে অনেক কিছু বলতো সে। শুধু ওর জন্য… ওর জন্য আজ তার জীবন এমন হয়ে গেছে! বিয়ের মতো একটা বিষয় জোর করে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর জন্য! কথাটা ভেবে কান্না পাচ্ছিল ইরতিজার।
সাজিদ মিররে ইরতিজার মুখখানি লক্ষ করে বললো,
“কাঁদবেন না। সকল কান্না আমাদের বিয়ে পর্যন্ত জমিয়ে রাখুন। বাসর রাতে চোখের জল আর নাকের জল উভয়তেই স্বামীর বুক ভিজিয়ে দেবেন।”

কথাটা শোনা মাত্র সাজিদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো ইরতিজা। সাজিদ মুচকি হাসলো।
ভাগ্যিস কথাটা পিছনের সিটে থাকা কেউ খেয়াল করেনি। করলে তো লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা হতো। লজ্জা কি সে এখনও পায়নি? পেয়েছে তো। ইরতিজা জানালার দিকে মুখ করে খানিক বিরক্ত কণ্ঠে বিড়বিড় করলো,
“লোকটা আসলেই নির্লজ্জ!”

“কী বলছেন?”

ইরতিজা আবার তাকালো। একবার পিছনে দৃষ্টি দিয়ে দেখলো তাদের দিকে কেউই ভ্রুক্ষেপ করে নেই। সে আস্তে করে সাজিদকে বললো কথাটা,
“নিজের বদনাম শোনার কি এতই ইচ্ছা আপনার?”

“বদনাম? আমি তো ভাবছিলাম আমি সুনাম পাওয়ার যোগ্যতা রাখি।”

ইরতিজা ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললো,
“সুনাম? আপনি আসলে বদনামেরও যোগ্য না। আপনি আমার স্বামী হওয়ারও যোগ্যতা রাখেন না।” নিচু স্বরে বললো ইরতিজা। যেন পিছনের কারো কানে কথাটা স্পষ্ট না পৌঁছায়।

সাজিদও ইরতিজার মতো নিচু স্বরে বললো,
“ভুল। যদি যোগ্যতার প্রশ্নই ওঠে তাহলে আপনি আমার যোগ্য নন।”

কথাটা শুনতে খারাপ লাগলো না ইরতিজার, বরং আশায় মুখটা চকচক করে উঠলো। বললো,
“তাহলে আমার আব্বুকে বলে এই বিয়ে ভেঙে দিন।”

“না। বিয়ের পর তোমাকে আমি আমার যোগ্য বানিয়ে নেবো।”

কথাটায় মুখ গোমড়া হয়ে গেল ইরতিজার।

______________

গ্রিন লেক পার্ক!
জায়গাটা এত সুন্দর না আসলে বুঝতে পারতো না ইরতিজা। এখন উইন্টার। ঘোরাঘুরির জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে সামার সিজন। বিশেষ করে লেক ঘুরতে আসার জন্য। তবে আজকের দিনটা অনেকটা গ্রীষ্ম দিবসের মতোই মনে হচ্ছে ইরতিজার। পরিবেশ তেমন শীতল নয়। নাতিশীতোষ্ণ অনুভব হচ্ছে তার। সুদীর্ঘ লেক। টলমলে নীল জলের উপর রোদের আলো থই থই করছে। লেকের পাশ ঘেঁষে আছে ওয়াকিংয়ের জন্য সুবিশাল ওয়াক ওয়ে। বসার জন্য আছে বেঞ্চি। বেঞ্চিতে বসে উপভোগ করা যায় লেকের চোখ জুড়ানো মনোরম শান্ত দৃশ্য। পানির মাঝে যাওয়ার জন্য রয়েছে কাঠের তৈরি পথ। এছাড়া সিঁড়ি আছে এখানে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে সেখান থেকে পুরো লেকটাকে একনজরে দেখে নেয়া যায়। আজকে অনেকের উপস্থিতিই লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকে আবার নিজের পালিত কুকুরকে নিয়ে বেরিয়েছে। কুকুরগুলো সুবোধ বালকের মতো হাঁটছে মনিবের পাশে পাশে। ঘাসের চাদরে মোড়ানো ওপেন স্পেসগুলোতে মানুষ শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছে।
ওরা বোট ভাড়া করে লেকে ঘুরে বেড়ালো কিছুক্ষণ। কিছুটা ক্লান্তি চলে আসলে সবাই রেস্টরুমে চলে এলো। তবে রিশন এলো না। ও আসার পর থেকেই ঘুরে চলছে এদিক-ওদিক। ভিডিয়ো করছে। এখানে আসার আগে তো ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল জুহি আর রিশনের মাঝে। জুহি রিশনকে নিজেদের সাথে আনতে চায়নি। এই নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিল।
জুহি খানিক বিশ্রাম নেওয়া শেষে আন্দ্রেজকে ডাকতে এলো রুমে। কিন্তু দেখলো আন্দ্রেজ নেই। আন্দ্রেজ আর রিশনের জন্য একটা রুম নেওয়া হয়েছে। বেরিয়ে আসার আগে জুহির চোখে পড়লো ছোটো টেবিলটায় আন্দ্রেজের ব্যাগের উপর পড়ে আছে ওর আর্ট খাতা। জুহি কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল। তার ধারণা ছিল এটাতে সে নিজের ছবিও দেখতে পাবে। কিন্তু আশ্চর্য! কোথাও তার একটা ছবি নেই। অথচ ইরতিজার ছবিও আছে। সবশেষে আন্দ্রেজ যে ছবিটা এঁকেছে সেটা মার্টার ছবি। মার্টার হাস্যজ্জ্বল মুখের ছবিটা দেখে জুহির সর্বাঙ্গে রাগের বিস্ফোরণ ঘটলো। হৃদয়েও বয়ে গেল কষ্টের একটা ফোয়ারা। আন্দ্রেজ কোথাও তার একটা ছবি আঁকেনি, অথচ এত যত্ন সহকারে মার্টার ছবি এঁকেছে? জুহি রাগে ছিঁড়ে নিলো পৃষ্ঠাটা। পৃষ্ঠাটা দুমড়ে-মুচড়ে ফেললো দুই হাতের সাহায্যে। রাগে কাঁপছে সে। ইদানিং আন্দ্রেজ একটুখানি সময় মার্টার দিকে তাকালেও সহ্য করতে পারে না সে। সেখানে মার্টার এমন হাস্যজ্জ্বল মুখ আন্দ্রেজের আর্ট খাতায় দেখে ব্যাপারটা হজম করা তার জন্য আসলেই সহজলভ্য হলো না। হ্যাঁ সে জানে আন্দ্রেজ মার্টাকে পছন্দ করে। সে হিসাবে মার্টার ছবি থাকবেই। কিন্তু সে তো মেনে নিতে পারে না এসব।

জুহি খুঁজতে বের হলো আন্দ্রেজকে। আন্দ্রেজ বেঞ্চিতে বসে ছিল নিরিবিলি। জুহি ওকে দেখা মাত্রই ডাকলো,
“আন্দ্রেজ…”

আন্দ্রেজ উঠে দাঁড়ালো। এখানে থাকতে তার খুবই অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। জুহিকে একা পেয়ে সে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করতে উদ্যত হলো,
“আমি বলেছিলাম আমি আসবো না। তুমি আমাকে…”

“এটা আমি কী দেখলাম এই মাত্র?” আন্দ্রেজের কথার মাঝে চেঁচিয়ে জানতে চাইলো জুহি।

“কী দেখেছো?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আন্দ্রেজ।

জুহি বলতে চেয়েও বলতে পারলো না, যে খাতায় তার ছবি নেই সেই খাতায় মার্টার ছবি দেখে সে এমন ব্যবহার করছে। সে আরও একটু সামনে এগিয়ে এসে আন্দ্রেজের ক্রাচটা ছিনিয়ে নিলো। টলে উঠলো আন্দ্রেজের পা। জুহির আচরণে রেগে গিয়ে বললো,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং জুহি?”

জুহির দু চোখে অভিমানী জল। আন্দ্রেজের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আর কখনও মার্টার দিকে তাকিয়ে থাকলে তোমার চোখের অবস্থা খা/রা/প বানিয়ে দেবো আমি। বুঝেছো?”

“আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে তোমার সমস্যা কী?” সাথে সাথে পাল্টা আক্রমণ করে বসলো জুহিকে।

“ও, জানো না তুমি? জানো না আমার কী সমস্যা? তুমি কি অবুঝ? বোঝো না কী সমস্যা?”

জুহির কথা আন্দ্রেজকে এবার স্থির করে দিলো। স্থির হয়ে কিছু সময় চেয়ে রইল সে জুহির দিকে। তারপর জুহির হাত থেকে ক্রাচটা কেড়ে এনে ওর চোখে দৃষ্টি রেখে বললো,
“না, আমি জানি না। আর কিছু বুঝিও না। তুমিও আমাকে কিছু জানানো অথবা বোঝানোর চেষ্টা করো না।”
বলে ক্রাচে গটগট শব্দ তুলে চলে গেল আন্দ্রেজ।
এদিকে জুহির মুখটা কষ্টে জর্জরিত হয়ে একেবারে কালো হয়ে গেল।

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৯
_________________

বাতায়ন দিয়ে প্রবেশকৃত পলকা হাওয়া ইরতিজার কালো কেশে দোল খাচ্ছে। সে আর্ম চেয়ারে বসে ব্যাগের ভিতর রিশনের ব্যস্ত হস্তে কিছু খোঁজার দৃশ্য দেখছে। রুমের দরজাটা শব্দ করে খুলে গেল এই সময়। জুহি ঢুকে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে এলো বেডের দিকে। বেডের উপর থাকা আকাশি রঙের কোটটা সাদা টি-শার্টের উপর চাপিয়ে নিলো। এগিয়ে গেল নিজের ব্যাগের দিকে। যে ব্যাগটায় কিছু খুঁজছিল রিশন। জুহি একটানে ব্যাগটা ওর হাত থেকে নিয়ে এসে বললো,
“চোরের মতো কী খুঁজছো আমার ব্যাগের ভিতর? ব্লাডি হেল!”

রিশন নিজের চোখের লেন্স রেখেছিল জুহির ব্যাগে, সেটাই খুঁজছিল। কথাটা জানাবে জুহিকে, কিন্তু জুহি ধৈর্য না ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ইরতিজা বলে উঠলো,
“কোথায় যাচ্ছ?”

জুহি থেমে পিছন ফিরলো। ওর চোখে জল দেখা যাচ্ছে এবার। কিছুটা অভিমানিনী গলায় বললো,
“আমার মুখ দেখে কি কিছু বোঝা যায় না টিজা?”

ইরতিজা অবাক হলো এমন একটা প্রশ্নে, সেই সাথে রিশনও। ইরতিজা বললো,
“হ্যাঁ বোঝা যাচ্ছে তো, তুমি এই মুহূর্তে কোনো একটা বিষয় নিয়ে স্যাড।”

“উহুঁ সেটা বোঝাচ্ছি না আমি। আমার মুখ দেখে কি বোঝা যায় না আমি আন্দ্রেজকে ভালোবাসি? এটা কি আমাকে পেন দিয়ে মুখের উপর বড়ো অক্ষরে লিখে রাখতে হবে?”

ইরতিজা বুঝলো আন্দ্রেজের সাথে কিছু হয়েছে। সে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। এমন সিচুয়েশনে কী বলা উচিত সে বিষয়ে সে অনভিজ্ঞ।

কিন্তু রিশন বললো,
“খবরদার! ওই আন্দ্রেজকে আমি আমার বোন জামাই হিসাবে মেনে নেবো না। সুতরাং ওর প্রেমে পড়া বন্ধ করো।”

জুহি কটমট করে তাকালো রিশনের দিকে। রিশন চোখ নামিয়ে নিলো। বললো,
“ও কে, যার ইচ্ছা তার প্রেমে পড়ো। জীবন তো তোমার, অবশ্যই তুমি যা চাইবে তাই হবে।”

কথাটা বলার পর রিশন অনুভব করলো, সে হঠাৎ তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে খুব মিস করছে। জীবনে একজন প্রেমিকা থাকা প্রয়োজন। প্রেমিকাকে নিয়ে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো যায়। নিজের ডলারও খরচ করা যায় প্রেমিকার পিছনে। এখন প্রেমিকাও নেই, আর তার ডলারও খরচ করতে হয় না তেমন। ডলার বলতে গেলে জমাই পড়ে রয় সব। রিশন ভিতরে ভিতরে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। জুহিকে বললো,
“আচ্ছা তুমি যে একটা মেয়েকে আমার সাথে ব্লাইন্ড ডেটে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলে…ওই যে নীল চোখা? মনে আছে? ওর খবর জানো কিছু?”

“জানি তো, তোমার সাথে ওর আর কখনও দেখা হলে ও তোমার দুই গালে দুটো চ/ড় মারার ইচ্ছা পোষণ করে বসে আছে।”

বলে সে আবারও এগোলো দরজার দিকে। একেবারে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ইরতিজা আবার ডাকলো,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

“ডাউন টাউনে ফিরে যাচ্ছি। আন্দ্রেজ কিছু বোঝে না এটা শোনার পরও আমি এখানে থাকার আর মন খুঁজে পাচ্ছি না!”

জুহি একহাত দিয়ে ভেজা দরজাটা টেনে খুললো। দরজা খোলার সাথে সাথে ভীষণ রকম চমকে উঠলো সে। তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্যানিয়ল। প্রথমে স্বপ্ন ভেবেছিল, কিন্তু ভুল ভাঙলো ক্যানিয়লের কণ্ঠে,
“তো তাহলে ঠিকই দেখেছিলাম। আমাকে ফলো করতে করতে এখান অবধি এসে গেছো তোমরা!”

ইরতিজা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে। জুহির সামনে দাঁড়ানো মানুষটা ক্যানিয়ল এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। এটা কি আসলেই ক্যানিয়ল? কিন্তু এখানে কী করছে?
ইরতিজা হাবলার মতো তাকিয়ে ছিল, ক্যানিয়লের দৃষ্টি জুহিকে এড়িয়ে হঠাৎ এই হাবলার মতো তাকিয়ে থাকা ইরতিজার উপর এসে পড়লো। ইরতিজার মাঝে সচকিতভাবের বিস্ফোরণ ঘটলো। সে মাথা থেকে খসে পড়া ওড়নাটা দ্রুত টেনে দিলো মাথায়।
ক্যানিয়ল বললো,
“এবার এটা স্পষ্ট পাকিস্টানি গার্ল।”

ইরতিজা ভ্রু কুঞ্চন করে বললো,
“কোনটা স্পষ্ট?”

ক্যানিয়ল রহস্যময় হাসলো। ওর শ্বেত মুখে রহস্যমাখা হাসির দুত্যি গভীর সৌন্দর্য খচিত করে ফুঁটে উঠলো। সে হালকা গলায় বললো,
“আমার পিছু পিছু এখানে এসেছো কেন?”

ইরতিজা ক্যানিয়লকে ওরকম হাসতে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ক্যানিয়লের এমন হাসির মানে সে খুঁজে পেল না। বললো,
“আমি তোমার পিছু পিছু এখানে আসিনি। আমরা সবাই ঘুরতে এসেছি। তুমি কেন এখানে এসেছো?” পাল্টা আক্রমণটা করতে পেরে আনন্দ হলো ইরতিজার।
কিন্তু ক্যানিয়লের কথায় তার আনন্দে ভাটা পড়লো। ক্যানিয়ল বললো,
“নিচু মানসিকতার মেয়ের কাছে আমার কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না। তবুও বলছি। দুজন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে এসেছি এখানে। মূল উদ্দেশ্যই হলো গার্লফ্রেন্ডদের সাথে সময় কাটানো।”

ইরতিজার মুখ কালো থেকে গভীর কালো ছায়ায় আচ্ছাদিত হলো। গার্লফ্রেন্ড মানে?
হৃদয়ে গুমোট কষ্টধারা ছড়িয়ে পড়লো ইরতিজার। কষ্টটা খুব করে চেপে ধরলো হৃদয়কে। তিক্ত খারাপ লাগায় ভরিয়ে তুললো মন।

রিশন ক্যানিয়লের কথাকে অহেতুক ধরে নিলো। তাই ঠেস মেরে বললো,
“আচ্ছা? গার্লফ্রেন্ড নিয়ে এসেছো? কী নাম তোমার গার্লফ্রেন্ডদের?”

“স্টিভেন এবং ব্রুস!”

নাম দুটো শুনে প্রত্যেকেই বিস্ময়ের জালে জড়িয়ে পড়লো। জুহি বললো,
“কী নাম?”

জুহির দিকে তাকিয়ে ক্যানিয়ল আরও একবার পরিষ্কার গলায় বললো,
“স্টিভেন এবং ব্রুস।”

ইরতিজা গোলগোল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। জুহি অন্যদিকে ঘুরে দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। স্টিভেন আর ব্রুস? ক্যানিয়ল কি ছেলেদের পছন্দ করে? এই জন্যই কি সে ক্যানিয়লের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল? কথাটা ভেবে জুহির বুক কাঁপছে। ক্যানিয়ল ছেলেদের পছন্দ করে এ কথা তো ঘুণাক্ষরে কোনোদিন বুঝতে পারেনি। তাই তো ভাবে, যে ক্যানিয়ল কারো সাথে মেলামেশা করে না সেই ক্যানিয়লের জন্য এত কেন কেয়ার লেকচারার স্টিভেন আর প্রফেসর ব্রুসের? এই তাহলে রহস্য!

রিশন বললো,
“এটা কেমন আজগুবি কথা বলছো? মজা করারও একটা সীমা থাকা জরুরি।”

ক্যানিয়ল রিশনের দিকে ধীর চোখে চেয়ে বললো,
“সীমাটা কীভাবে তৈরি করবো? তোমার প্রেমে পড়ে কি এই সীমা তৈরি করা সম্ভব? আমার তো মনে হয় আমি যদি তোমার প্রেমে পড়ি তাহলে আরও সীমা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।”

রিশন এখানে আর দাঁড়ানোর পরিস্থিতি অনুভব করলো না। ক্যানিয়লের দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“ইউ আর ডিসগাস্টিং!”
বলে বেরিয়ে গেল।

ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে তাকালো। হাস্য আভা জড়িত মুখে বললো,
“ইউ আর মোর ডিসগাস্টিং!”

বলে সেও হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।

_________________

আকাশে চন্দ্র উঠে গেছে। চন্দ্রালোকের পরশ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে অপলক দেখে চলছে সাজিদ। কোনো এক অজানা কারণেই মেয়েটার প্রতি তার গভীর ভালো লাগার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মেয়েটার ভালো লাগার বিন্দুমাত্র স্থান জুড়েও কি তার বসতি আছে? নেই হয়তো! দীর্ঘশ্বাস ফেললো সাজিদ।
আজাদ চৌধুরী সাজিদের সামনের চেয়ারটা টেনে বসলেন। সাজিদ তার উপস্থিতি টের পেয়েও চোখ সরালো না ইরতিজার থেকে। আজাদ চৌধুরী ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলেন সাজিদের দিকে। বললেন,
“কী দেখছো অত আমার মেয়েকে?”

“আপনার মেয়ে একটু বেশিই সুন্দর, যার কারণে ওর থেকে চাইলেও সহজে চোখ ফেরানো যায় না। মন আটকে থাকতে চায়।”
সাজিদ এবার দৃষ্টি নিয়ে এলো আজাদ চৌধুরীর দিকে। বললো,
“কিন্তু এমন নির্লজ্জের মতো পলকহীন তাকিয়ে থেকে এই প্রথম দেখলাম আপনার মেয়েকে।”

আজাদ চৌধুরী হেসে দিলেন। বললেন,
“তোমার ব্যাপারে কোনটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে জানো?”

সাজিদ মাথা নাড়িয়ে কাপে চুমুক দিলো।

আজাদ চৌধুরী বললেন,
“তুমি সব কথা নির্দ্বিধায় বলে দাও। আমি মেয়ের বাবা অথচ আমার সামনেও এসব কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করছো না তুমি।”

সাজিদ হাস্য মুখে তাকালো আবার ইরতিজার দিকে। আজাদ চৌধুরীকে বললো,
“আপনার মেয়ে ঠিক কতটা ভালো বউ হবে জানি না আঙ্কল, তবে আপনি যে একজন খুব ভালো শ্বশুর হবেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত।”
বলতে বলতে আজাদ চৌধুরীর দিকে চাইলো।

আজাদ চৌধুরী হাসলেন।

দূরে বাবা আর সাজিদের আলাপনের দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে না ইরতিজার। এই লোকটার সাথে এত হাসিখুশি ভাবে কথা বলে কেন বাবা? সাজিদকে কি বাবার খুব পছন্দ? হয়তো! এই জন্যই বিয়ে ভাঙার কথা বললেও তাতে গুরুত্ব দেয় না। লোকটার আজ একেবারে বাড়ির উপর চলে আসার কি দরকার ছিল? এরিয়া পর্যন্ত নামিয়ে দিলেই তো হতো। বাকি পথটুকু পায়ে হেঁটেই চলে আসতো তারা। কিন্তু না, বাড়িতেই চলে এলো। আর থেকেও গেল। আগামীকাল ছাড়া যাবে না।
গ্রিন লেক পার্ক থেকে ওরা সন্ধ্যার পরপরই ফিরে এসেছে।
ইরতিজা ভাবছিল, সাজিদকে কি তার সত্যিই বিয়ে করতে হবে? কিছুতেই না। চার বছর সময়টা পড়ে রয়েছে, এই চার বছরে এই সম্বন্ধ ভেঙে ফেলা কঠিন কোনো বিষয় নয়। ম্যাসেজের শব্দ কানে লাগলো। ক্যানিয়ল ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। এই প্রথম ম্যাসেজ পাঠিয়েছে সে। সিন করে দেখলো তাতে লেখা–
‘একটু আগে তোমাকে আমি দেখেছিলাম ইজা। চন্দ্রকিরণে দেখতে পেয়েছিলাম তোমার মুখ। ইচ্ছা হয়েছিল অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে দেখি তোমায়। কিন্তু আমি তাকিয়ে থাকলাম না। চলার পথে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই দেখে চলে এলাম। এটা আমার জন্য কঠিন ছিল! এত কঠিন কাজ আমি এর আগে কখনও করিনি!’

ম্যাসেজটা পড়ার পর ইরতিজার হৃদস্পন্দন হঠাৎই তরতর করে বেড়ে গেল। হৃদয়ের শব্দ নিজ কানে শুনতে পেল সে। এই ম্যাসেজ…
ইরতিজার মনে হলো পুরো শরীরই কাঁপছে তার। অসুস্থ বোধ করছে সে!

_______________

গতরাতে ম্যাসেজটা দেখার পর থেকে ইরতিজার হৃদয় ধুকপুক করে চলছে। এক মুহূর্তের জন্যও থামেনি হৃদয়ের এই অদ্ভুত আচরণ। ওই ম্যাসেজটায় এমন কী ছিল যা তাকে গতরাত থেকে এত ভাবাচ্ছে? ছিল তো কিছু অবশ্যই। আবশ্যকীয় থাকা ওই বস্তুটুকুর জন্যই তো তার এমন পাগল পাগল লাগছে এখন। সকাল বেলা এক্সারসাইজে বের হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বাবা ডাকাডাকি করে শেষমেশ তাকে বাইরে বের করিয়েই ছাড়লো। বের হওয়ার আগে অবশ্যই সে মাথায় একটা কালো হিজাব পরিধান করে নিয়েছে। আজকে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। রাস্তায় বের হয়ে দেখলো অনেকেই সাইক্লিং করছে, জগিং করছে, ওয়াকিং করছে।
ইরতিজা আশপাশ দেখছিল আর সাইকেল চালাচ্ছিল। একই প্রকৃতি দেখে রোজ, কিন্তু তাও মুগ্ধতা সরে না চক্ষু হতে। আরও কিছুটা চালিয়ে আসার পর হঠাৎ পিছন থেকে ডাক শুনতে পেল,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল!”

ইরতিজার সাইকেল থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো ক্যানিয়লও সাইক্লিং করছে। ক্রমশ ওর সাইকেলটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। ইরতিজা চোখ ফিরিয়ে আনলো। এইমাত্র কি তার দেখা হলো ক্যানিয়লের সাথে? এখন কি কথাও হবে? না, এটা হতে দেবে না। ক্যানিয়লের সাথে এখন কথা বলতে গেলেই নার্ভাস ফিল করবে। নার্ভাস ফিল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সে কোনো কিছু প্রমাণ করতে চায় না। ইরতিজা সাইকেল চালানো স্টার্ট করলো। এটা দেখে অবাক হলো ক্যানিয়ল। পিছন থেকে বললো,
“তুমি কি আমাকে অবজ্ঞা করে চলে যাচ্ছ?”

ইরতিজা কিছু বললো না, যত দ্রুত সম্ভব সাইকেল চালিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে। তা দেখে ক্যানিয়লও নিজের সাইকেলের গতি বৃদ্ধি করলো। এমনকি ধরেও ফেললো ইরতিজাকে। নিজের সাইকেল দ্বারা ইরতিজার সাইকেলের চাকায় ধা/ক্কা দিতেই সাইকেল নিয়ে পড়ে গেল ইরতিজা। মৃদু স্বরে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ওর মুখ ছুটে। ক্যানিয়ল ব্রেক কষলো। সাইকেলের নিচে চাপা পড়া ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ছোটো একটা শাস্তি!”

সাইকেল দাঁড় করিয়ে নামলো ক্যানিয়ল। ইরতিজার চোখে ইতোমধ্যে অশ্রু টলমল করছে। ক্যানিয়ল সাইকেল সরিয়ে ওঠালো ওকে। দাঁড়ানোর পরই ইরতিজা ক্যানিয়লের হাতটা ছিটকিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি কি মানুষ?”

ক্যানিয়ল অবাক হয়ে বললো,
“মানুষ নই? তাহলে কী?”
ক্যানিয়ল ভাবতে খানিক সময় ব্যয় করে বললো,
“আমি কি ভিন গ্রহের প্রাণী?”

“আমি জানি না তুমি কী, যদি জানতাম তাহলে…”
ইরতিজা থেমে গেল। অতঃপর কণ্ঠে করুণতার ছোঁয়া রেখে বললো,
“আমি তো মরেও যেতে পারতাম! এটা কীভাবে করলে? যদি আমি মরে যেতাম?”

“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ব্যথাও পাওনি তেমন, আর মৃ/ত্যু/র কথা বলছো? অবশ্য তুমি ম/রে গেলেও কিছু যায় আসতো না আমার। কারণ তুমি আমার কেউ না।” নিতান্তই অবজ্ঞাত কণ্ঠে বললো ক্যানিয়ল।

যা শুনে ইরতিজার অভিমানিনী অশ্রু চোখের কোল ছাপিয়ে নেমে গেল। বললো,
“তোমার মতো এত বাজে মানুষ আর দেখিনি ক্যানিয়ল!”

ইরতিজা ঘুরলো অন্যদিক। সাইকেল নিয়ে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই ক্যানিয়ল বললো,
“তুমি কি রাগ করেছো? বেশি ব্যথা পেয়েছো?”

ইরতিজা পিছন ফিরে বললো,
“বেশি ব্যথা না পেলে কী করবে? মেরে র/ক্তা/ক্ত করবে আমাকে?”

ক্যানিয়ল এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“কথা না শুনলে শি/র/শ্ছে/দ করে ফেলবো তোমাকে। অভদ্র মেয়ে! কথা না শুনে চলে যাচ্ছিলে কেন?”

“আমি অভদ্র নই। আর কখনও যদি অভদ্র বলো তাহলে নিশ্চয়ই আমি আর তোমার সাথে ভদ্র ব্যবহার বজায় রাখবো না!”

ইরতিজার চটাং চটাং কথা প্রমাণ করছে সে এখন রেগে আছে। ক্যানিয়ল তাকে আর না রাগিয়ে বললো,
“আমার সাথে এমন করে কী পাও ইজা?” নরম শোনালো ক্যানিয়লের কণ্ঠ।

“কী করেছি আমি?” আগের মতো তেজি কণ্ঠেই বললো ইরতিজা।

“কে জানে কী করেছো! তবে যা করেছো ভালো করোনি এটুকু জানি!” ক্যানিয়লের কণ্ঠে এখনও নমনীয়তার পরশ।

ইরতিজা এতক্ষণ যে রাগ অনুভব করছিল ক্যানিয়লের প্রতি, এখন আর সেই রাগটা বহাল নেই। বরং হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিক চলন আবারও ফিরে এসেছে। সে একদৃষ্টে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছু বললো না। তার বলার তো কিছু নেই। তবে সে সবটা উপলব্ধি করতে পারছে।

“টিজা…”
ইরতিজার চুপসে যাওয়া বিচলিত মনটা পরিচিত কণ্ঠস্বরে চমকিত হয়ে উঠলো। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল সব। ডাক অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখতে পেল তাদের থেকে কতক দূরে দাঁড়িয়ে আছে জোনাস। ওর মুখে আলতো নরম হাসি লেগে রয়েছে। ইরতিজার কণ্ঠ কাঁপতে লাগলো,
“তু-তু-তুমি…”

জোনাস ইরতিজাকে বলতে দিলো না। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই কাছে এসে দুই হাতের শক্ত বেষ্টনে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
ইরতিজার হৃদস্পন্দন রুদ্ধ হয়ে গেল। দু চোখ স্ফীত হয়ে উঠেছে।
ক্যানিয়লের দু চোখে গভীর বিস্ময়। এমন একটা ঘটনার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না!

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩০
_________________

জোনাসের উষ্ণ বুকে স্তব্ধ ইরতিজার ঠাঁই এই মুহূর্তে। ইরতিজা বেশ কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘটনাটা বুঝে উঠতে সময় লাগলো তার। প্রথমে মনে হয়েছিল সে চোখের ভুল দেখছে, কিন্তু আসলে বাস্তব। ইরতিজার প্রচুর রাগ হলো, বিরক্ত লাগলো। সে শক্ত কণ্ঠে নির্দেশ করলো,
“ছাড়ো জন!”

জোনাস ছাড়লো না।
“সবসময় তো তোমাকে ছেড়েই দিয়েছি টিজা। যখন আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছিলে তখনও তুমি মুক্ত ছিলে, এমনকি যখন নিউ ইয়র্ক ছেড়ে এই রেডমন্ড এলে তখনও তুমি মুক্ত ছিলে। এখন একটুখানি সময়ের জন্য আমার বক্ষস্থলে বন্দি থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে?”

ইরতিজা জোনাসের কথা কানে না তুলে আগের চেয়েও জোর গলায় বললো,
“ছাড়ো আমায়…”
বলতে বলতে সে নিজেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো জোনাসকে। জোনাস দূরে সরে গেল। ইরতিজার মুখমন্ডল কাঁপছে অনবরত। বললো,
“এটা কী করলে! আর এখানে কেন তুমি? আবারও কেন এসেছো?”

“না এসে উপায় ছিল না। তোমার মন আমাকে চুম্বকের মতো টানছিল। জানো তো, সকল টান উপেক্ষা করা গেলেও মনের টান উপেক্ষা করা যায় না। এটা সর্বাপেক্ষা বেশি জোরালো। আমি আসিনি, তোমার মন আমাকে আসতে বাধ্য করেছে।”

অস্বাভাবিক ভাবেই ইরতিজার খুব রাগ হচ্ছে। রাগে ফুঁসছে। তার দৃষ্টি বিরক্ত মেখে চেয়ে আছে জোনাসের দিকে। জোনাসের চোখে কোমলত্ব। সে এক পা কাছে এগিয়ে আসতেই ক্যানিয়ল ইরতিজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলো দুজনের মাঝে।
আকস্মিক ঘটনাটায় জোনাসের পা ওখানেই স্থির হয়ে গেল। ইরতিজা পিছন থেকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো ক্যানিয়লকে।
ক্যানিয়ল জোনাসকে বললো,
“ওখানেই থামো। এমনিতেই অনেক এগিয়ে ফেলেছো তুমি! আর এগিয়ো না। তুমি জানো না, কারো অনুমতি ব্যতীত তাকে জড়িয়ে ধরা অপরাধ?”

জোনাস সরু চোখে চেয়ে বললো,
“তুমি কে?”

“আমি কে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার মতো একজন অপরাধীর কাছে জানানোর প্রয়োজন বোধও করি না।”

ক্যানিয়ল আর এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়াতে চাইছে না। সে চেনে না ছেলেটা কে। তবে তার মোটেও সুবিধার লাগছে না ছেলেটাকে। ছেলেটা যে ইরতিজার পূর্ব পরিচিত সেটা বুঝতে পেরেছে। তবুও বিষয়টা হজম হলো না তার।
জোনাস বললো,
“তুমি টিজার রেডমন্ডের নতুন বন্ধু?”

ক্যানিয়ল ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললো,
“যে মেয়েটা সামান্য একটা মোবাইলের জন্য নিচু মানসিকতার পরিচয় দেয়, সেই মেয়েটার বন্ধু আমি এটা ভাবাও তোমার বোকামি কা/লপ্রিট বয়!”
ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে তাকালো।
“তুমি কি এখানে আরও কিছু সময় দাঁড়াতে চাইছো?”

ইরতিজা হকচকিয়ে গেল প্রশ্নটা শুনে। এই মুহূর্তটা কেমন ভাসা ভাসা লাগছে তার! মাথার উপর ঘুরপাক খাচ্ছে দিগভ্রান্তের অনুজ্জ্বল মিটমিট জ্বলতে থাকা হাজার নক্ষত্র। সে অপ্রস্তুতভাবে দুইপাশে মাথা নাড়লো।

“বেশ! কিছু সময় তো দূর, আমি তোমাকে একটু সময়ও দাঁড়াতে দিলাম না তাহলে…”

বলে ক্যানিয়ল ইরতিজার একটা হাত চেপে ধরে সাইকেলের কাছে এগিয়ে এলো। ইরতিজার সাইকেলটায় উঠে বসলো সে। ইরতিজাকেও উঠে বসতে বললে ইরতিজা জোনাসের দিকে তাকালো। জোনাস কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
ইরতিজার হৃদয়ে হঠাৎ কষ্ট মিশ্রিত ঘৃণার কালো রং লেপ্টে দিলো একটা অদৃশ্য হাত। ছেলেটার কীভাবে সাহস হলো হঠাৎ এমন করার? এই ছেলেটাই দায়ী তার জীবনে কঠিন কিছু ঘটে যাওয়ার জন্য! কেন করেছিল অমন? প্রত্যাখ্যান হয়েছিল বলে প্রতিশোধ নিয়েছিল? বন্ধুত্বে প্রতিশোধ থাকে না। শত্রুতায় প্রতিশোধ দারুণ শোভা পায়। আসলেই তাদের সম্পর্কটা শত্রুতার! ইরতিজা চোখ সরিয়ে এনে সাইকেলে উঠে বসলো। অমনি সাইকেল চালাতে শুরু করলো ক্যানিয়ল। ইরতিজার সাইকেলটা নিয়ে গেল। কিন্তু সামুরার সাইকেলটা পড়ে রইল অবহেলায়। এ পর্যন্ত সে দুটো সাইকেল পরিত্যাগ করেছে মেয়েটার জন্য। প্রথমে নিজের সাইকেল, আর এখন সামুরার!

জোনাস তাকিয়ে রইল ছুটন্ত সাইকেলটার দিকে। শেষ মুহূর্তে ইরতিজার চোখে যে ঘৃণার কালো পর্দাটা দেখতে পেয়েছিল, তা দেখে বক্ষ কম্পিত হয়ে উঠেছিল তার। এত ঘৃণা কেন তাদের একে-অপরের প্রতি? অবশ্য হলেই বা কী? একটা ঘৃণার সম্পর্কও কখনো কখনো অধিক সৌন্দর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে!

______________

সাইকেলে ব্রেক কষলে ইরতিজার অন্যমনস্কতায় ছিদ্র ধরলো। এতক্ষণ সে অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল চুপচাপ সাইকেলের পিছনে। সাইকেল থেমেছে তাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে বাসাটা। ইরতিজা নেমে পড়লো। আজ রোদ নেই। আকাশে ধূসর মেঘ ছোটাছুটি করছে। তবে পরিবেশ বেশি ঠান্ডা নয়। বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা আছে।

“ছেলেটা কি তোমার বন্ধু হয়?” প্রশ্নটা ক্যানিয়লের কাছ থেকে আসা বাধ্যতামূলকই ছিল যেন।

ইরতিজা উদাসীন নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“বন্ধু ছিল অতীতে, বলতে পারো এখন শত্রু!”

“শত্রু?” শত্রু কথাটায় বিস্মিত হলো ক্যানিয়ল।

“হ্যাঁ শত্রু।” হঠাৎ মন খারাপি অসুখটা আরও তীব্র হলো ইরতিজার। সে উদাসী চিত্তে বলতে লাগলো,
“জানো ক্যানিয়ল, যখন কোনো প্রিয় বন্ধু শত্রুতে পরিণত হয় তখন সেই শত্রু সর্ব শত্রু অপেক্ষা বেশি বাজে হয়ে থাকে। সে এমন এক শত্রুতে পরিণত হয় যে, তাকে ঘৃণা করাও সহজ ব্যাপার হয় না। এমন শত্রুতা বিষাক্ত! আর এই বিষাক্ত শত্রুতা আমার মনকে বার বার বিষাক্ত করে তোলে। তাকে ঘৃণা করা সহজ হয় না, কিন্তু তার জন্য মনে যে অনেক ঘৃণা জমে আছে। কঠিন হলেও তাকে ঘৃণা না করে থাকা যায় না তাই!”

ইরতিজা ক্ষণকালীন বিরতি পালন করে বললো,
“জীবনে আমার সবচেয়ে বড়ো একটা আফসোস, আমি কখনও ভালো বন্ধু পাইনি। যারা বন্ধু ছিল, তাদের সাথে বন্ধুত্ব ভেঙেচুরে গেছে! এটা একটা চরম আফসোস আমার জীবনে।”
ইরতিজা বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটা শুরু করলো।
ক্যানিয়লের মনে গভীর প্রভাব ফেলছিল ইরতিজার কথাগুলো। সে কী-ই যেন ভাবছিল। হঠাৎ ডাকলো,
“ইজা…”

ইরতিজা দাঁড়ালো।
ক্যানিয়ল ধীর পদাঙ্কে সামনে এসে দাঁড়িয়ে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার জীবনে ভালো বন্ধুর অভাব, কিন্তু খারাপ বন্ধুর অভাব কখনও রেখো না।”

ইরতিজা বিস্ময়াপন্ন হয়ে তাকিয়ে রইল। ক্যানিয়ল ওর বিস্ময় জড়িত আঁখি জোড়ায় তাকিয়ে হাসলো,
“আমাকে নিজের খারাপ বন্ধুর তালিকায় এড করে নাও। কথা দিচ্ছি খুব খারাপ একজন বন্ধু হয়ে দেখাবো তোমায়। যার কারণে অন্য খারাপ বন্ধুদের প্রভাব খুব একটা কাছে ঘেঁষবে না তোমার।”

ইরতিজা বুঝতে পারছে না ক্যানিয়লের কথা। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে।
ইরতিজা চুপচাপ দেখে ক্যানিয়ল নিজেই ইরতিজার একটা হাত ধরে হ্যান্ডশেক করে হাত ছেড়ে দিলো। এরপর বললো,
“আর হ্যাঁ, শত্রুরা যখন বন্ধুর মতো হাগ করে সেই দৃশ্যটা খুব বিশ্রী দেখায়! তখন খুব ক/ষ্টে আমি আমার হাত-পা সংযত রেখেছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল এটা সংযত রাখতে।”

ইরতিজার চোখে-মুখে আরও প্রগাঢ় বিস্ময় ছেপে গেল। ক্যানিয়ল বললো,
“আর ও তখন ‘মনের টান’, ‘উপায় ছিল না’…এসব কী বলছিল? জানি না কী বলছিল, কিন্তু কথাগুলো শুনতে খুবই বাজে শোনাচ্ছিল! ওর কথা গুলোকে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন বানরের ডাক!”

ইরতিজার ঠোঁট একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কী বলছে ক্যানিয়ল? বানরের ডাক!
ক্যানিয়ল পুরোটা ক্ষণ ইরতিজাকে বিস্ময়ের জলে ডুবিয়ে রাখলো। এমনকি যাওয়ার আগেও অদ্ভুত একটা কথা বলে গেল,
“চাঁদের আলো মেখে আর কখনও ওরকম দাঁড়িয়ে থাকবে না পাকিস্টানি গার্ল!”

ইরতিজা অনুভব করছিল কথাটা শুনে তার হৃদয়ের কার্যক্রম কেমন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। আচ্ছা, সে কি সত্যি সত্যি ক্যানিয়লের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে? না কি পড়ে গেছে ইতোমধ্যে? গা শিউরে উঠলো ইরতিজার!

________________

তখন মধ্যরাত। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ক্যানিয়ল ঘুমে আচ্ছাদিত ছিল। ফোনকলের শব্দে তার ঘুমটা ভেঙে গেল সহসা। পিটপিট করে চোখ মেলে মিরান্ডার নামটা দেখতে পেল। রিসিভ করে ফোন কানে লাগিয়ে আবারও চোখ বুজলো। ঘুম আবেশী কণ্ঠে বললো,
“হাই মিরান্ডা!”

মিরান্ডা কোনো সৌজন্যমূলক কথাবার্তা না বলে বললো,
“তুমি আমায় ভালোবাসো ক্যানি?”
মিরান্ডার গলা বেশ সিরিয়াস শোনাচ্ছে।

ক্যানিয়ল চোখ মেলে ফেললো।
“হঠাৎ কেন এমন প্রশ্ন করছো?”

“ভালোবাসো কি না?” তেজি কণ্ঠে জানতে চাইলো।

ক্যানিয়ল অবাক মিরান্ডার এমন আচরণে। ধারণা করলো কিছু একটা হয়েছে মিরান্ডার। সে কথা না পেঁচিয়ে সোজা উত্তর দিলো,
“না।”

ওপাশে অদ্ভুত রকম হেসে উঠলো মিরান্ডা। হঠাৎই আবার থেমে গেল তার হাসি। বললো,
“আমার সাথে এটা কীভাবে করলে?”

“আমি বুঝতে পারছি না তুমি কোন বিষয়ে কথা বলছো!”

“এত বছর হয়ে গেল যে ক্যানি আমার জন্য কখনও অনুভূতি অনুভব করেনি, আর সেই ক্যানি এখন অন্য একটা মেয়ের প্রতি এত সহজে কীভাবে অনুভূতি অনুভব করতে সক্ষম হলো? হ্যাঁ? কীভাবে? কষ্ট হচ্ছে ক্যানি! কোনো মতেই মানতে পারছি না এটা।” কান্না কান্নাভাব উগরে উঠছে মিরান্ডার গলায়।

ক্যানিয়লের দু কান যেন ভুল শুনছে। সে বিচলিত বোধ করলো মিরান্ডার গলায় কান্নার আঁচ লক্ষ করে। আবার রাগও হলো। ঘুম ভাঙিয়ে এসব কী আবোল-তাবোল বকছে মেয়েটা?

“তুমি কী বলছো এসব?

মিরান্ডা বোতলের তলানিতে থাকা তরলটুকু গলায় ঢেলে নিয়ে বললো,
“আচ্ছা, তুমি বলো তো, ওই মেয়েটা আমার থেকে কোন দিক দিয়ে ভালো? ও কি আমার থেকে বেশি সুন্দরী? না কি ও আমার থেকে আরও বেশি ফেমাস কেউ?”

ক্যানিয়লের এবার সত্যিই রাগ লাগছে। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো,
“কার কথা বলছো তুমি?”

“কাইফ যখন আমাকে বলেছিল তোমাকে ইদানিং একটা মেয়ের সাথে দেখা যায়, তখন আমার বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এতদিন নজর রাখার পর, এত এত ছবি, ভিডিয়ো আমার কাছে আসার পর আমি সত্যিই এটা আর অবিশ্বাস করতে পারছি না। এতদিন খুব কষ্টে আমি সবকিছু সহ্য করেছি। কিন্তু আজ পারলাম না। আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। তুমি আর ওই মেয়েটার সাথে দেখা করবে না, কথা বলবে না।”

ক্যানিয়লের কাছে এতক্ষণে সবকিছু পরিষ্কার। মিরান্ডা ইরতিজার কথা বলছে। কিন্তু সে অবাক মিরান্ডার কথাগুলো শুনে। বললো,
“তোমার কেন মনে হচ্ছে আমার অনুভূতি আছে ইজার প্রতি?”

“তুমি এখনও কী ভীষণ বোকা ক্যানি! নিজের অনুভূতি নিজে উপলব্ধি করতে পারছো না? এটা তো আমার জন্য আরও ভয়ংকর ব্যাপার হবে তাহলে। কারণ যতদিনে না তুমি এটা বুঝতে পারবে, ততদিনে এটা সমাধানও হবে না। একটা কথা মনে রাখো আমাদের বাগ্‌দান হয়ে গেছে। দুই ফ্যামিলিই চায় বিয়েটা হোক। এবং স্পেশ্যালি আমিও চাই।”

“কিন্তু আমি না চাইলে এই বিয়ে হওয়া অসম্ভব! যদি আমার মনে হয় আমি তোমার প্রতি…”

ক্যানিয়লকে থামিয়ে দিয়ে মিরান্ডা বললো,
“অনুভূতির কথা বাদ দাও ক্যানি। আমি জানি তুমি কখনোই আমার প্রতি কোনো বিশেষ অনুভূতি অনুভব করবে না। করার হলে অনেক আগেই করতে। আমরা ছোটো বেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছি, অনেক দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি একসাথে। অনুভূতি আসার হলে এতদিনে এসে যেত। তুমি আসলে আমায় নিয়ে কখনও ভাবোইনি। কিন্তু তোমায় আমি বলে রাখছি, আমি কষ্ট পেতে আগ্রহী নই। আমাকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকো। নাহলে তোমাকেও কষ্ট পেতে হবে।”

“উন্মাদ হয়ে গেছো তুমি!”

“উন্মাদই তো হওয়ার কথা। যে ক্যানি কারো সাথে তেমন একটা মিশে না, সেই ক্যানির হঠাৎ একটা মেয়ের সাথে এত মেলামেশা আমাকে উন্মাদই করে দিয়েছে…”

ক্যানিয়ল মিরান্ডাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো। ঘাড়ের পিছনে দুই হাত রেখে মাথা নিচু করে বসে রইল অনেকক্ষণ। মাথার ভিতর যন্ত্রণারা সংগ্রাম করে যাচ্ছে। প্রতিটা বিষয় নিয়ে সে ভাবতে লাগলো। ইরতিজার প্রতি কি তার আসলেই অনুভূতি আছে? মিরান্ডার প্রতি কি তার অনুভূতি জন্মাবে না? না জন্মালে সম্পর্কটা কীভাবে গড়ে উঠবে? আর মিরান্ডা বলেছে মিরান্ডাকে নিয়ে সে ভাবেনি। ইরতিজাকে নিয়েও তো সে কখনও ভাবেনি। ইরতিজার ভাবনা মাঝে মধ্যে আপনা থেকে এসে হুটহাট করে মস্তিষ্কে গেড়ে বসতো। তাহলে ইরতিজার প্রতি তার অনুভূতি কখন কীভাবে জন্ম নিলো?

________________

রাত্রিকালে ইরতিজার ঘুম ভেঙে গেল ক্যানিয়লের কলের শব্দে। চোখ খুলে ক্যানিয়লের নাম দেখতে পেয়ে অবাক হলো সে। এই সময় ক্যানিয়লের কল দেওয়াটা আশ্চর্যজনক। সে কল রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই ক্যানিয়ল বললো,
“আমি কি তোমার প্রেমে পড়েছি পাকিস্টানি গার্ল? না কি আমার উডবি ওয়াইফের ধারণা ভুল?”

(চলবে)