#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৩৮
#Ornisha_Sathi
তিনটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। মাত্রই একটা বাসার সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলো ওরা৷ আনিতা একবার বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালো। সাদা রঙের ছয় তলা একটা বিল্ডিং। এই বিল্ডিং এর সামনে এসে যেহেতু গাড়ি থামলো তার মানে নিশ্চয়ই এই বিল্ডিংয়েই ফাইয়াজ থাকে। সকালেই বের হওয়ার কথা ছিলো ওদের। কিন্তু আনিতার আম্মু সকালে ছাড়েনি ওদের। তাই বাধ্য হয়ে ওরা দুপুরের খাবার খেয়ে বের হয় বাসা থেকে। ঢাকায় আসার পর এখন আনিতার বেশ মন খারাপ করছে। আসার সময় আনিতার আম্মু দাদু অনেক কেঁদেছিলো। বাসার সকলের কথা মনে পড়ে আনিতার বেশ কান্না পাচ্ছে এখন। আনিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোদেলা বলে,
–“কিরে চল।”
–“ভালো লাগছে না রে। তোরা থাক আমি বাসায় চলে যাই হ্যাঁ?”
–“প্রথম প্রথম ক’দিন এমন লাগবে। ধীরে ধীরে সবটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে দেখিস।”
ফাইয়াজ এগিয়ে এসে কথাটা বলল। আনিতা তবুও মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। ফাইয়াজের কথাটা যেন ও ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না। আনিতাকে এখনো আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফাইয়াজ আনিতার হাত টেনে ধরে উপরে নিয়ে যায়। সিড়ি বেয়ে চার তলায় উঠে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে ফাইয়াজ। ওর পিছু পিছু আনিতা শুভ রোদেলাও ভিতরে যায়। ওরা সবাই চারিদিকে চোখ বুলালো একবার। বড়সড় আকারের একটা ফ্ল্যাট। তিনটে বেডরুম। দুটোর সাথে এটাচড বাথরুম আর একটা কমন বাথরুম। ছোটখাটো একটা ডাইনিং আর কিচেন। ফাইয়াজ একা এত বড় ফ্ল্যাটে থাকতো? আনিতা ফাইয়াজকে জিজ্ঞেস করে,
–“তুমি একা এত বড় ফ্ল্যাটে থাকতে ভাইয়া?”
–“নাহ। তোরা আসবি বলে পরশুই এই বাসাটা নিয়েছি।”
–“এত কম সময়ে ঢাকার শহরে বাসা খুঁজে পাওয়া কি করে সম্ভব?”
–“আহিয়ান খুঁজে দিয়েছে। ওর পরিচিত একজনের বাসা এইটা। এই বিল্ডিংয়ের সামনের বিল্ডিংয়ের চার তলায় ওরা থাকে।”
আহিয়ানের কথা শুনে রাগে অভিমানে আনিতার কান গরম হয়ে গেলো। কাল যে আনিতা অভিমান করলো আহিয়ান একবারো তা ভাঙানোর চেষ্টা করেনি। আজকে তেমন ফোনও করেনি। দু/তিনবার ফোন করেছিলো আনিতা রিসিভ করেনি বলে পরে আর ফোনও দেয়নি। আনিতার অভিমানটা যেন আরো বেশিই গাঢ় হলো। ফাইয়াজ আনিতাকে ডেকে বলে,
–“কোন রুম নিবি তোরা দুজনে ঠিক করে নে।”
ফাইয়াজের কথায় আনিতা নড়েচড়ে দাঁড়ালো। তারপর রুমগুলো ঘুরে দেখার জন্য পা বাড়ালো। একে একে সবগুলো রুম ঘুরে দেখে আনিতা। মেইন ডোর দিয়ে ঢুকলে ডাইনিং স্পেস শেষেই পূর্ব দিকে পরপর দুটো রুম। আর দক্ষিনে একটা রুম। শুধুমাত্র দক্ষিন দিকের রুমেই ব্যালকনি আছে। দক্ষিন দিকের রুম আর পূর্ব দিকের বা সাইডের রুমে এটাচড ওয়াশরুম। পূর্ব দিকের ডান সাইডের রুমের আর দক্ষিন দিকের রুমের মাঝ খান বরাবর কমন ওয়াশরুম। মেইন ডোর দিয়ে ঢুকলে হাতের বা দিকে কিচেন। এক কথায় পুরো বাসাটা সুন্দর পরিপাটি ভাবে সাজানো গোছানো। আনিতা আর রোদেলা দক্ষিন দিকের রুমটাই চুজ করলো নিজেদের জন্য। আনিতা ওরা যে রুম চুজ করেছে সে রুমে খাট পাতা নেই। মেঝেতেই মোটা করে তোষক বিছানো। তার পাশেই ছোট্ট একটা ড্রেসিংটেবিল রাখা। আর তাছাড়া একটা আলমারি পড়ার টেবিল আর একপাশের দেয়াল জুড়ে একটা বুকসেল্ফ রাখা। সাথে ব্যালকোনি ওয়াশরুম তো আছেই। রুমটা আনিতা আর রোদেলার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তাই ওরা ওই রুমটাই নিলো নিজেদের জন্য। নিজেদের লাগেজ দুটো ফ্লোরে রেখে আনিতা ফোন হাতে বারান্দায় চলে গেলো বাসায় কল করতে।
*
রাত নয়টা বাজে। রোদেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছে। আনিতা মাত্রই গোসল শেষ করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। আসার পরই দুজনে নিজেদের জিনিসপত্র সব কিছু জায়গা মতো গুছিয়ে রেখে ফাইয়াজকে বাজারে পাঠায় রঙের কৌটো আর রঙের তুলি কিনে আনতে। যে দুটো দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে তোষক বিছানো সে দেয়াল দুটো রঙ তুলি দিয়ে পেইন্টিং করবে। ফাইয়াজ বলেছিলো পরে এনে দিবে। কিন্তু ওদের দুজনের কাছে হার মেনে শেষে বাধ্য হয়েই বাজারে যায়। ফাইয়াজ রঙ তুলি এনে দিলে দুজনে তখনই পেইন্টিং করা শুরু করে দেয়। একদম সিম্পল ভাবেই দুটো দেয়ালে পাখি লতা-পাতা গাছ ফুল এসব আর্ট করে। পেইন্টিং এর কাজ শেষ হয় আটটার দিকে। প্রচুর গরম লাগাতে কিছুটা সময় রেস্ট নিয়ে রোদেলা গোসল করতে চলে যায়। রোদেলা বের হলেই আনিতা গোসলে যায়। আর মাত্রই গোসল শেষে বের হয় আনিতা।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝারছিলো। রোদেলা উঠে কিচেনে যায় কফি করতে। আনিতা চুল মুছে আচড়ে নিলো। আনিতা চুলে ব্যান্ড লাগানোর সময় কলিং বেল বেজে উঠে। আনিতা সেদিকে পাত্তা দিলো না।
শুভ সোফায় শুয়ে ফোন ঘাটছিলো। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে উঠে বসে শুভ। চারিদিকে চোখ বুলালো একবার। ফাইয়াজ আর আনিতা নিজেদের রুমে। আর রোদেলা কিচেনে কফি বানাচ্ছে। তাই শুভই উঠে গেলো দরজা খুলতে। শুভ দরজা খুলতেই দেখে আহিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। শুভকে দেখে আহিয়ান বেশ অবাক হয়। শুভ দরজার সামনে থেকে সরে আহিয়ানকে ভিতরে আসতে বললেই আহিয়ান বলে,
–“তুমি? কখন এলে?”
–“এই তো চারটার দিকে।”
–“ওহ আচ্ছা। তো কেমন আছো?”
–“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া। আপনি?”
–“তোমার বন্ধু আর আমাকে ভালো থাকতে দেয় কোথায়? বাই দ্যা ওয়ে, ফাইয়াজ কোথায়?”
–“রুমেই আছে।”
–“আচ্চা তোমার সাথে একটু পরে কথা বলছি। আসছি।”
এই বলেই আহিয়ান ভিতরে চলে এলো। নতুন বাসা এটা। ফাইয়াজ কোন রুম নিয়েছে সেটা ঠিক জানে না আহিয়ান। পরপর রুম তিনটার দিকে তাকিয়ে থেকে আহিয়ান দক্ষিন দিকের রুমটাতেই ঢুকে পড়ে। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই আহিয়ান অবাক হয়ে যায় আনিতাকে দেখে। আনিতা ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে ঘিয়ে রঙের প্লাজু আর কালো টি-শার্ট। বিছানায় স্কার্ফ ফেলে রাখা। আয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে মডেলদের মতো নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি করছে আর দেখছে নিজেকে। দেখতে খারাপ লাগলে চোখ মুখ কুঁচকে আবার অন্যরকম অঙ্গভঙ্গি করছে। আহিয়ান চোখ বড় বড় করে আনিতাকে দেখছে। আনিতা তখনো আহিয়ানকে খেয়াল করেনি। হঠাৎই ফাইয়াজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা জোরেই বলে,
–“আহিয়ান তুই নাকি খুঁজছিলি আমাকে? তো এখানে কি করছিস?”
ফাইয়াজের কথায় আহিয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে ফাইয়াজের দিকে তাকালো। হঠাৎ করে ফাইয়াজ এভাবে কথা বলাতে আনিতা চমকে উঠে ভয়ে বুকে থু থু দিলো। আনিতা পিছনে তাকাতেই দেখে আহিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আনিতা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে স্কার্ফ নিয়ে গলায় ঝুলালো।
–“তো্ তোমরা দুজনে এখানে আমার রুমে কি করছো?”
–“কিছু না। আমি তো আহিয়ানকে ডাকতে এসেছিলাম। এই আহিয়ান তুই এখানে আনিতার রুমে কি করছিলি হ্যাঁ?”
বোকা বোকা ফেস করে ফাইয়াজ কথাগুলো বলল। আহিয়ান ফাইয়াজের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে আনিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“তুমি এখানে? কখন এসেছো? কেন এসেছো? আর আমাকে একবারো জানালে না কেন?”
–“আপনাকে কেন জানাবো আমি? কে আপনি?”
–“কে আমি?”
–“হ্যাঁ কে আপনি?”
–“বোঝাবো কে আমি?”
–“এ্ এই একদম না। এক পা সামনে এগোবেন না বলে দিলাম।”
কথাটা বলে আনিতা দু পা পিছিয়ে গেলো। ওদের কান্ড দেখে ফাইয়াজ মৃদু হাসলো। গলা খাঁকারি দিয়ে জানান দিলো যে, ও এখানে আছে। ফাইয়াজের গলার স্বর পেয়ে আহিয়ান থেমে যায়। ফাইয়াজ বাঁকা হেসে আহিয়ানকে বলে,
–“ভুলে যাস না আমিও এখানে আছি।”
–“হুম ভুলে গিয়েছিলাম বলেই তো ভুলটা করতে যাচ্ছিলাম। তুই এখন যা তো এখান থেকে। তোর বোনের সাথে আমার কথা আছে।”
–“আরে তুই তো আমার সাথে কথা বলবি বলে আমাকে খুঁজছিলি। যেই আনি বুড়িকে পেলি অমনি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস?”
–“তোর আনি বুড়িকে নিয়েই কথা বলার ছিলো তোর সাথে। এখন যেহেতু তোর আনি বুড়ি আমার সামনেই আছে তাহলে আর তোকে বলে কি হবে? সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করে নেওয়াই কি ভালো না?”
–“হ্যাঁ তো যা বলবি আমার সামনেই বল।”
–“তুই আর তাসকিয়া যা বলিস সেসব কি আমাদের সামনে বলিস? বলিস না তো। তাহলে তোর সামনে আমি কেন বলবো? যাহ ভাগ।”
–“বাহ রে! আমার বাসায় এসে আমাকেই ভাগতে বলছিস?”
–“হ্যাঁ বলছি। এখন যা ভাই। তোর বোন কাল রাত থেকে রেগে আছে আমার উপর। ওর রাগ ভাঙাতে হবে।”
কথাগুলো বলে আহিয়ান ঠেলতে ঠেলতে ফাইয়াজকে রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলো। ফাইয়াজ বাইরে থেকেই চেচিয়ে বলে,
–“বেশি সময় নিবি না কিন্তু।”
–“ওকে নিবো না। তাহলে তোর বোনকে বলে দে যাতে তাড়াতাড়ি রাগটা কমিয়ে ফেলে।”
প্রতিউত্তরে ফাইয়াজ কিছু একটা বলল। কিন্তু আহিয়ান সেটা অতটা আমলে নিলো না। আনিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে আনিতার হাত চেপে ধরে বলে,
–“সারাদিনে আমার একটাও ফোন রিসিভ করোনি কেন?”
–“ইচ্ছে হয়নি তাই রিসিভ করিনি।”
–“তোমার যা ইচ্ছে তুমি তাই করবে?”
–“হ্যাঁ করবো তো। আপনিও করুন সমস্যা কি?”
–“করবো তো?”
–“হ্যাঁ করুন।”
আহিয়ান চট করে আনিতার ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে সরে দাঁড়ালো। আনিতার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আনিতা আঙুল উঁচু করে বলে,
–“আপনিইইইই____আপনি কি করলেন এটা?”
–“আমার যা ইচ্ছে হয়েছে আমি করেছি। তাতে তোমার কি?”
–“নাহ আপনার সবসময় যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন না।”
–“সেম। তোমারও যখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না তুমি।”
আনিতা কথায় না পেড়ে ঠোঁট উলটে গিয়ে বিছানার এক কোনে গুটিশুটি মেরে বসে পড়লো। আহিয়ানও গিয়ে আনিতার পাশে বসলো। আনিতা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। আহিয়ান আনিতার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। আনিতার হাত জোড়া ওর মাথায় এনে বলে,
–“মাথাটা টিপে দিবা একটু? ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে।”
আহিয়ানের মাথা ব্যাথা করছে শুনেই আনিতার সব রাগ অভিমান যেন হাওয়া হয়ে গেলো। আনিতা অস্থির হয়ে বলে,
–“কখন থেকে মাথা ব্যাথা করছে? মেডিসিন নিয়েছেন তো?”
–“উঁহু।”
–“আগে বলবেন তো আমায়। আপনি বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ুন আমি ঔষধ নিয়ে আসছি।”
–“লাগবে না। একটু টিপে দাও তাহলেই হবে। আর যদি পারো কড়া করে এক কাপ কফি এনে দাও।”
–“যাচ্ছি।”
আনিতা উঠে কিচেনে চলে গেলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কফি বানিয়ে রুমে এসে আহিয়ানকে দিলো। আহিয়ান কফির মগে কয়েকটা চুমুক দিয়ে আবারো আনিতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। এবার আনিতা নিজে থেকেই আহিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আহিয়ান আনিতার ওড়নার এক কোনা একবার আঙুলে পেঁচাচ্ছে তো একবার সেটা খুলে ফেলছে। এমন করতে করতেই আহিয়ান বলে,
–“তা ম্যাডামের হঠাৎ ঢাকায় আসার ইচ্ছে হলো যে?”
–“এখন থেকে এখানেই থাকবো।”
–“মানে?”
–“মানে এখানে থেকেই পড়াশুনা করবো। এখান থেকে বিশ মিনিট দূরত্বে যে ভার্সিটি আছে ওটাতেই এডমিশন নিয়েছি আমি রোদেলা আর শুভ।”
আনিতার কথায় আহিয়ান চট শুয়া থেকে উঠে বসে। আনিতার দিকে ঘুরে আনিতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
–“আমায় আগে জানালে না যে?”
–“চমকে দেওয়ার জন্য বলিনি।”
–“আমি চমকায়নি একটুও।”
–“হ্যাঁ তা তো আপনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।”
–“আনিতা জানো আমার ভীষণ খুশি লাগছে। এখন থেকে তোমাকে যখন তখন চাইলেই দেখতে পারবো। একসাথে সময় কাটাতে পারবো। আ’ম সো হ্যাপি আনিতা।”
আনিতা কিছু বলল না। বিনিময়ে মুচকি হাসলো শুধু। আনিতা আহিয়ানের হাতজোরা উঁচু করে ওর দুহাতের মুঠোয় আলতো করে চুমু খেলো একটা। ড্রয়িংরুম থেকে ওদের দুজনের ডাক আসায় ওরা উঠে ড্রয়িংরুমে চলে গেলো।আনিতা গিয়ে সোফায় বসতেই ফাইয়াজ আনিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি খাবি বল? বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসছি।”
–“বাইরে থেকে খাবার আনতে হবে না। আমি রোদেলা বাড়িতেই খাবার বানিয়ে নিচ্ছি৷ ফ্রিজে কি কি আছে বলো?”
–“কে খাবার বানাবে? তুই রান্না করতে জানিস তো? তোর রান্না করা খাবার আমরা মুখে তুলতে পারবো তো?”
ফাইয়াজের এমন খোঁচা দেওয়া কথায় আনিতা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। রাগে ফুঁস করে বলে,
–“আমি রান্না পারি না তো কি হয়েছে? রোদেলা তো পারে। ও রান্না করবে আর আমি ওকে হেল্প করবো। আর তাছাড়া তোমাদের মুখে আমার রান্না করা খাবার না উঠলে কি হবে? আহিয়ান ঠিক খাবে। তাই না আহিয়ান?”
আনিতার কথায় আহিয়ান কেঁশে উঠে। ফাইয়াজ রোদেলা শুভ মুখ টিপে হাসছে। আনিতা ঠোঁট উলটে বলে,
–“কি হলো? আপনি কথা বলছেন না কেন?”
–“হ্যাঁ খাবো তো আমি। আর কেউ না খেলেও আমি খাবো তোমার রান্না করা খাবার। কিন্তু পাখি অন্য একদিন খাই? আজ না হয় হোটেল থেকেই খাবার কিনে নিয়ে আসি? আসলে প্রচুর ক্ষিধে পেয়েছে তো।”
কথাগুলো বলে আহিয়ান আনিতাকে আর কিছু বলার সু্যোগ না দিয়েই ফাইয়াজকে টেনে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আহিয়ান আর ফাইয়াজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শুভ দাঁত বের করে শব্দ করে হেসে দিলো। আনিতা রাগী চোখে একবার তাকালো শুভর দিকে। শুভর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে রোদেলার দিকে কাঁদোকাঁদো ফেস করে তাকিয়ে আনিতা বলে,
–“কি হলো এইটা? উনি এভাবে পালিয়ে গেলো কেন? আমার রান্না কি এতই খারাপ হতো?”
রোদেলা হাসতে হাসতে বলে,
–“কে বলছে তোর রান্না খারাপ হয়? তুই তো খুব ভালো করে নডুলস আর পাস্তা রান্না করতে পারিস। সাথে তোর বানানো চা টাও বেশ হয় দোস্ত।”
–“হয়েছে আর মিথ্যে বলতে হবে না।”
–“নাহ দোস্ত রোদেলা এটা একদম ঠিক কথা বলেছে। তোর হাতের নডুলস পাস্তা আর চা সেই মজা হয়।”
শুভর কথায় আনিতা তাকালো একবার ওর দিকে। রোদেলা আনিতার হাত ধরে বলে,
–“আগে সব ধরনের রান্না ভালো করে শিখে নে তারপর যত ইচ্ছে আহিয়ান ভাইয়াকে রান্না করে খাওয়াস। সমস্যা কি?”
–“বয়েই গেছে আমার উনাকে রান্না করে খাওয়াতে। কোনোদিনও আমি উনাকে রান্না করে খাওয়াবো না।”
–“তা বিয়ের পর কে রান্না করবে শুনি?”
–“কে আবার? তোর আহিয়ান ভাইয়া।”
–“আচ্ছা তাহলে এক কাজ করিস তুই সবধরনের রান্না শিখে আমাদেরকে খাওয়াইস। আহিয়ান ভাইয়াকে খাওয়াতে হবে না।”
।
।
।
চলবে।
#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৩৯
#Ornisha_Sathi
সকাল সাড়ে ন’টা বাজে। আনিতা তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য। রোদেলা রেডি হয়ে বিছানার উপর আরাম করে বসে খাচ্ছে আর ফোন টিপছে। আনিতা কালো রঙের সেমি লং টপস আর কালো জিন্স পরে কোনোভাবে রেডি হয়ে রোদেলার পাশে বসে পড়লো। রোদেলা পরোটা ছিড়ে তাতে ভাজি নিয়ে মুখে দিতে যাচ্ছিলো। আনিতা রোদেলার হাত টেনে ধরে ওর মুখের সামনে এনে খাবার টুকু খেয়ে নিলো। খাবার চিবুতে চিবুতেই তীক্ষ্ণ চোখে রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“কি হারামী ফ্রেন্ড রে তুই? আমাকে রেখে একা একা গিলছিস।”
রোদেলা আর এক টুকরো পরোটা মুখে পুড়ে বলে,
–“হ তুমি নয়টা বিশে ঘুম থেকে উঠবা আর আমি তোমার জন্য না খেয়ে বসে থাকবো তাই না?”
–“হ বসেই তো থাকবি। আমার জন্য এইটুকু সময় যদি তুই ওয়েট না করতে পারিস তাহলে তুই আমার কিসের বেস্ট ফ্রেন্ড?”
রোদেলা কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই ড্রয়িংরুম থেকে ওদের ডাক পড়ে। আনিতা কোনো রকম খেয়ে উঠে পড়লো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় স্কার্ফ ঝুলিয়ে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে বের হয়ে এলো রুম থেকে। রোদেলা খাবার প্লেটটা নিয়ে কিচেনে রেখে ও ড্রয়িংরুমে এলো। ওদের দুজনকে দেখে ফাইয়াজ বলে,
–“হয়েছে আপনাদের? তাহলে এখন যাওয়া যাক?”
আনিতা মাথা দুলাতেই ফাইয়াজ বের হয়ে গেলো। শুভ ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বলে,
–“প্রথম দিনেই তোদের জন্য লেট। কাল থেকে আমি আমার মতো আগেই চলে যাবো।”
–“কলেজে সবসময় আপনিই লেট করে আসতেন। আমরা অলওয়েজ টাইমলি পৌঁছাতাম কলেজে।”
রোদের কথায় শুভ মুখ বাঁকিয়ে বাসা থেকে বের হয়। আনিতা আর রোদেলা ওর পিছু বের হলে ফাইয়াজ বাসা লক করে দেয়। আনিতা শুভর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে নিজের কুনই রেখে বলে,
–“তা তোর হঠাৎ করে ভার্সিটি তাড়াতাড়ি যাওয়ার সুবুদ্ধি উদয় হলো যে?”
–“আরেহ কলেজে তো একটা মেয়েও পটাতে পারলাম না। এখন যদি এই শহরে থেকেও ভার্সিটিতে গিয়ে একটা মেয়ে পটাতে না পারি তাহলে কি আমার মান সম্মান বলতে কিছু থাকবে বল?”
–“ওওও মেয়ে পটাবা তাই না?”
–“হ্যাঁ।”
–“দাঁড়াও পটাচ্ছি তোমার মেয়ে।”
এই বলে আনিতা শুভকে মারার জন্য হাত উঠাতেই শুভ দৌড় লাগায়। আনিতাও ওর পিছু দৌড় দেয়। কিছুটা সামনে এগোতেই হুট করে আনিতার সামনে একটা মেয়ে এসে পড়ে। বহু কষ্টে আনিতা নিজেকে সামলে নেয়। আনিতা মেয়েটির পা থেকে মাথা অব্দি একবার স্ক্যান করে। বয়স আনুমানিক তেইস কি চব্বিশ হবে। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। লম্বায় আনিতার সমান হবে। বড় বড় চোখ। তীরের মতো লম্বা নাক। কোমড় সমান চুল। আনিতা একবার নিজের দিকে তাকালো। আনিতাও বেশ ফর্সা তবে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মতো এতটা না। জাম রঙের একটা সেলোয়ার-কামিজ পড়া। ফর্সা গায়ে রঙটা একেবারে ফুঁটে উঠেছে। মেয়েটিও আনিতাকে দেখে নিলো একবার। আনিতাকে দেখতেই মেয়েটার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা দেখা গেলো। আনিতার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির পাশেই ছোট্ট চার বছরের একটা মেয়ে দাঁড়ানো। ওনি বাচ্চাটির হাত ধরে রেখেছেন। বাচ্চাটি দেখতে অসম্ভব রকমের সুন্দর। ফাইয়াজ এসে আনিতার পাশে দাঁড়াতেই সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখে মুচকি হেসে বলে,
–“আরেহ ভাবী আপনি? কেমন আছেন?”
–“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভাই…তুমি কেমন আছো?”
–“আলহামদুলিল্লাহ।”
আনিতা আর রোদেলা ফাইয়াজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ খানিকটা দূরে দাঁড়ানো। শুভ দূরে দাঁড়িয়ে আনিতার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলেই আনিতা রাগী চোখে তাকায়। আনিতার চোখদুটো বারবার ঘুরে ফিরে ওর সামনে দাঁড়ানো মা মেয়ের দিকে যাচ্ছে। দুজনেই কি সুন্দর দেখতে। আনিতার বেশ করে ইচ্ছে করছে বাচ্চা মেয়েটার গাল টেনে দিতে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেকে নিজের মনের মাঝেই দমিয়ে রাখলো আনিতা। আনিতা ফাইয়াজের হাত ধরে বলে,
–“ভাইয়া তুমি চেনো উনাকে?”
–“হ্যাঁ কেন তুই চিনিস না?”
–“উঁহু আমি চিনবো কিভাবে? আমি তো কালই এলাম।”
–“সে হচ্ছে আহি___”
–“পাশের বাসার ভাবী। তোমাদের বিল্ডিংয়ের সামনের বিল্ডিংয়েই থাকি।”
এইটুকু বলে মেয়েটা ফাইয়াজকে কিছু ইশারা করে। ফাইয়াজের ইশারাটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। ফাইয়াজ বুঝতে পেরেই মাথা ঝাকিয়ে বলে,
–“হ্যাঁ উনি আমাদের এক বড় ভাইয়ের বউ। উনার হাজবেন্ডের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক আমাদের। সেই সুবাদেই উনাকে চেনা। আর ভাবী? ও হচ্ছে আমার মামাতো বোন।”
প্রথম কথাগুলো ফাইয়াজ আনিতার উদ্দেশ্যে বলে লাস্টের কথাগুলো ওই মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে। আনিত মুচকি হেসে বলে,
–“আসসালামু আলাইকুম আপু। আমি আনিতা।”
–“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি রুহি। রাফিয়াদ রুহি। ওরা আমাকে ভাবী ডাকে সো তুমিও ভাবী বলেই ডাকতে পারো।”
বিনিময়ে আনিতা কিছু না বলে মাথা ঝাকালো। রুহি একে একে রোদেলা আর শুভর সাথেও পরিচিত হয়ে নিলো। আনিতা নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে হাটু করে বাচ্চাটার সামনে বসে পড়লো। বাচ্চাটার গাল টেনে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“তোমার নাম কি আম্মু?”
–“নুজাইরাহ।”
–“ওওও কি সুন্দর নাম। তোমার মতো তোমার নামটাও বেশ সুন্দর।
কথাটা বলে আনিতা আবারো নুজাইরাহ এর গাল টেনে দেয়। নুজাইরাহ ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলে,
–“মাম্মাম চাচ্চুর ফোনে এই আন্টিটার ছবি দেখেছি না? তাহলে এটাই আমার কা____”
এইটুকু বলতেই রুহি নুজাইরাহ এর মুখ চেপে ধরলো। রুহির কান্ডে আনিতা বেশ অবাক হলো। শুভ দূর থেকে ডেকে বলে,
–“এখানেই কিন্তু দশটা বাজে। আজ আর ভার্সিটি যাওয়া লাগবে না তাই না?”
শুভর কথায় ফাইয়াজ রুহিকে বিদায় দিয়ে ওদের নিয়ে ভার্সিটির দিকে হাঁটা দেয়। এক মিনিটের মতো হাঁটার পরই রিকশা পেয়ে যায় ওরা। চারজনে দু রিকশায় করে মিনিট বিশেকের মাথায় ভার্সিটির সামনে পৌঁছে যায়।
ফাইয়াজ প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে সব কাজ শেষ করে আনিতাদের ক্লাসরুম দেখিয়ে দিলো। ফাইয়াজ তন্ময় আহিয়ান রাতুল আরহান ওরা সকলেই এই ভার্সিটি থেকেই পড়াশুনা করেছে। তাই ফাইয়াজের সবকিছুই চেনা। ফাইয়াজ চলে যেতেই ওরা তিনজনে মিলে পুরো ভার্সিটি ঘুরে দেখলো।
একটা ক্লাস করে বের হয়ে তিনজনে ভার্সিটির এক কোনায় মাঠে গিয়ে বসলো। বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বাসায় ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালো সকলে।
*
দুপুরে বাসায় ফিরে ফ্রেস হয়েই আনিতা ঘুমিয়ে পড়ে। নতুন জায়গায় পরিবারের সবাইকে ছেড়ে একা এসেছে। নতুন পরিবেশে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি বিধায় আনিতা আর চোখ মেলে থাকতে পারলো না। গোসল করে বের হয়ে মাথায় টাওয়াল পেঁচানো অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ে আনিতা। রোদেলা দুপুরের খাবার খেয়ে আনিতার পাশে বসে গল্পের বই পড়ছে।
সন্ধ্যা হওয়ার ঘন্টাখানেক আগে আনিতার ঘুম ভাঙে। ফ্রেস হয়ে খাবার খেয়ে ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়ায় আনিতা। পাশের বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখে একটা ছেলে অদ্ভুত ভাবে আনিতার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় আনিতা। ফলস্বরূপ রুমে চলে আসে।
সন্ধ্যার পরে ফাইয়াজ ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বের হয়। শুভ ওর রুমে শুয়ে শুয়ে ফোনে গেমস খেলছে। রুমের ভিতর এমন ভাবে বসে থাকতে থাকতে আনিতার এখন আর ভালো লাগছে না। এভাবে রুমে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? এর থেকে তো গ্রামেই ভালো ছিলো। যখন তখন রুম থেকে বের হতে পেরেছে। যেখানে খুশি যেতে পেরেছে। আর এখানে? সারাক্ষণ এই বাসার ভিতরই পরে থাকতে হয়। আনিতার এবার বড্ড আফসোস হচ্ছে ঢাকায় আসার জন্য।
পা টিপে টিপে আনিতা আর রোদেলা বাসা থেকে বের হয়ে যায়। রোদেলা যখন দরজা লাগাচ্ছিলো তখন আনিতা উলটো ঘুরে সিড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ করেই আনিতার সামনে একটা ছেলে এসে দাঁড়ায়। আনিতা চমকে মাথা তুলে তাকায়। সেই ছেলেটা। সন্ধ্যায় বারান্দা থেকে যে অদ্ভুত ভাবে আনিতাকে দেখছিলো। আনিতা সরে দাঁড়িয়ে রোদেলার হাত ধরে নিচে নেমে যায়। ছেলেটাও মাথা চুলকে ওদের পিছন পিছন নিচে নামে।
প্রথম প্রথম কিছুটা সময় ছেলেটাকে ওদের পিছু নিতে দেখলেও পরে আর ছেলেটাকে দেখেনি ওরা। সাড়ে সাতটা কি আটটা বাজে। ওদের বিল্ডিংয়ের সামনেরই গলির রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ওরা দুজনে। ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে আছে। এই রাস্তা দিয়ে তেমন গাড়ি যাওয়া আসা করছে না। মাঝে মধ্যে দু একটা গাড়ি বাইক রিকশা আসছে যাচ্ছে। কিছুটা সামনেই তিনটা গলির রাস্তা এক হয়েছে। তিন রাস্তার মোড়ে গিয়ে ওরা দুজনে ফুচকার দোকান দেখে লাফিয়ে উঠে। ওরা দুজনেই ফুচকার গাড়ির সামনে এগিয়ে যায়। ঝাল ঝাল করে দু প্লেট ফুচকা অর্ডার দিয়ে টুল টেনে বসলো ওরা। কিছুক্ষণ বাদে একটা চৌদ্দ কি পনেরো বছরের ছেলে দু প্লেট ফুচকা দিয়ে যায় ওদের। আনিতা একটা ফুচকা তুলে সবেমাত্র মুখে দিয়েছে। এমন সময় ওর পাশে টুল টেনে আহিয়ান বসে ওর প্লেট থেকে ফুচকা নিয়ে মুখে দেয় একটা। আহিয়ানকে এসময় এখানে দেখে বেশ অবাক হয় আনিতা। ফর্মাল ড্রেসে আছে আহিয়ান। গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি অফিস থেকে ফিরলো। আহিয়ান ফুচকা খেতে খেতেই আনিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“এখানে কি?”
আহিয়ানের এমন থমথমে গলার প্রশ্ন শুনে আনিতা একটা শুকনো ঢোক গিলে। আহিয়ানের সারা চোখমুখে গাম্ভীর্যের ছোঁয়া। আহিয়ান তো বার বার বারন করে দিয়েছিলো একা বের হতে। তবুও বের হলো আনিতা? আহিয়ান কি খুব বেশি কিছু বলবে? আহিয়ান আবারো মুখে গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখে থমথমে গলায় বলে,
–“আন্সার পাইনি কিন্তু এখনো।”
–“এ্ এমনি হাঁটতে বের হয়েছিলাম একটু।”
–“একা দুজন মেয়েই কেন? ফাইয়াজ আর শুভ কোথায়?”
–“বাসায় বসে থেকে বোর হচ্ছিলাম তাই___”
–“তাই বলে একা বের হয়ে যাবে? এখানকার কোনো কিছু চেনো? জানো এখানকার মানুষজন কেমন? কিছুই তো চেনো না জানো না। তাহলে কাউকে কিছু না জানিয়ে কোন সাহসে একা একা বের হলে তোমরা দুজনে”
আহিয়ানের ধমকানো সুরে কথা শুনে আনিতা মুখ ভার করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। রোদেলা বলল,
–“আর এমন হবে না ভাইয়া।”
–“মনে থাকে যেন। আর তোমার ফ্রেন্ডের মাথায় একটু কথাগুলো ভালো করে ঢুকিয়ে দিও। আমার কথা তো শুনবেই না। কিছু বললে মহারানী তখন আবার মুখ ভার করে বসে থাকে।”
আনিতা কিছু না বলে ভেংচি কেটে অন্যদিকে ঘুরে ফুচকা খাচ্ছে। ফুচকা খাওয়া শেষে আহিয়ান বিল মিটিয়ে ওদের দুজনকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। কিছুদূর আসতেই আহিয়ান একটা ছেলেকে ডেকে ওর হাতে বাইকের চাবি দিয়ে বলল,
–“বাইকটা একটু আমাদের বাসায় রেখে আয়।”
–“আচ্ছা ভাই।”
এইটুকু বলেই ছেলেটা আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বাইকের কাছে গিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো। আহিয়ান ওদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে। ততক্ষণে আহিয়ান আনিতার অভিমান ভাঙিয়ে ফেলেছে। কিছুটা সামনে একটা আইসক্রিমের গাড়ি দেখে আহিয়ান ওদের সেদিকে নিয়ে যায়৷ রোদেলা ভ্যানেলা ফ্লেভারের আর আনিতা চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম নেয়। আহিয়ান ইচ্ছে করেই নেয়নি। আইসক্রিম খাচ্ছে আর হাঁটছে ওরা। আনিতা আইসক্রিমে একটা কামোর বসিয়ে আহিয়ানের দিকে এগিয়ে দেয়। আহিয়ান খেতে রাজি না হলেও আনিতা জোর করে আহিয়ানের মুখের সামনে আইসক্রি তুলে ধরে। আহিয়ান মুচকি হেসে আনিতার হাত ঘুরিয়ে আইসক্রিমের ঠিক সেখানটায় বাইট বসায় যেখান থেকে আনিতা খেয়েছে। আহিয়ানের চোখে মুখে দুষ্টুমির ছাঁপ। আহিয়ানের ওরকম চাহনিতে লজ্জা পেয়ে যায় আনিতা। দুজনে মিলেই আইসক্রিমটা শেষ করে। প্রতিবারই আনিতার কামড়ে নেওয়া অংশটা থেকেই আহিয়ান খেয়েছে। কিছুদূর হাঁটার পর আহিয়ান বলে,
–“সামনেই একটা নদী আছে। যাবে ওখানে?”
আহিয়ানের কথায় রোদেলা বলে,
–“এইসময়?”
–“হ্যাঁ। সন্ধ্যার পরপর সময়েই ওখানে মানুষজনের আনাগোনা বেশি। আর ওখানে এখন ফাইয়াজ ওদেরকেও পাবে।”
–“আচ্ছা চলুন।”
রোদেলার কথায় আহিয়ান আর আনিতা আবারো হাঁটতে শুরু করে। পাঁচ মিনিটের মতো হেঁটেই ওরা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। মেইন রোড থেকে প্রায় অনেকটা জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস। তারপরেই নদী। নদীর পাড় জুরে প্রায় ছয় থেকে সাতটা নানান ধরনের খাবারের স্টল বসেছে। মানুষও মোটামুটি ভালোই। প্রত্যেকটা স্টলে মানুষের ভীর তো আছেই। আহিয়ান ওদের দুজনকে নিয়ে একটা বটগাছের কিছুটা দূরত্বে এসে দাঁড়ালো। বটগাছ থেকে নদীটার দূরত্ব হাত দশেক হবে। বট গাছটার নিচে নদীর দিকে মুখ করে ছয় সাতজন ছেলে বসে আছে। কিছু সময় বাদে বাদেই সকলে কোনো একটা কথা নিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠছে। হঠাৎ হঠাৎ আবার কেউবা গান গেয়ে উঠছে। আহিয়ান ওদের নিয়ে ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আহিয়ানের সাথে আনিতা আর রোদেলাকে দেখে বেশ অবাক হয় ফাইয়াজ। আর তন্ময় তো চোখই সরাচ্ছে না রোদেলার থেকে। ফাইয়াজ বলে,
–“আনি বুড়ি? তোরা এখানে?”
–“হুম এখানে। এরপর থেকে যখনই বাসায় থেকে বের হবি বাসা বাইরে থেকে লক করে আসবি।”
আহিয়ানের কথায় ফাইয়াজ ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে। বাকী সবাইও ততক্ষণে হাসি আড্ডা থামিয়ে ওদের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। ফাইয়াজ এক ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–“কেন?”
–“তোর বোনের তো আবার সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। গ্রামে সারাক্ষণ টইটই করে বেরিয়েছে কিনা? এখন ঢাকায় এসে রুমে আটকা বসে থাকতে কি আর ভালো লাগবে নাকি? যেই দরজা খোলা পেয়েছে অমনি শুভকে না জানিয়েই দুজনে বের হয়ে এসেছে।”
–“তোর সাথে দেখা হলো কিভাবে? তুই তো অফিস ছিলি।”
তন্ময়ের কথায় আহিয়ান বলে,
–“অফিস থেকেই ফিরছিলাম। তিন রাস্তার মোড়ে এসে দেখি দুজনে ফুচকার দোকানে বসে ফুচকা খাচ্ছে।”
আহিয়ানের কথায় ফাইয়াজ আনিতার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। আনিতা মাথা নিচু করে নিলো। ফাইয়াজ বলে,
–“একা একা বাসায় থেকে বের হতে না করেছিলাম না?”
–“কি করবো? তুমি নেই শুভ ফোনে গেমস খেলছে। আমি আর রোদ কতক্ষণ একা একা বোর হতাম রুমে বসে? তাই বের হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দুজনে মন মতো হাঁটবো। প্রান খুলে শ্বাস নিবো। কিন্তু তা আর হলো কই? তোমার বন্ধু তো আমাদের তা করতে দিলো না। পারে শুধু আমাকে বকাবকি করতে।”
ঠোঁট উলটে আনিতা কথা গুলো বলল। আহিয়ান আনিতার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,
–“বাহ রে এই যে তোমার রাগ ভাঙানোর জন্য বাড়ি না ফিরে এতটা পথ হাঁটলাম তোমার সাথে। কত কষ্ট করে তোমার রাগ ভাঙালাম। আইসক্রিম খাওয়ালাম। নদীর পড়ে ঘুরতে নিয়ে এলাম এসবে তোমার মন ভরেনি তাই না?”
–“প্রথমে বকাবকি করে পড়ে কে বলছে রাগ ভাঙাতে? আইসক্রিম খাওয়াতে? কে বলেছে আপনাকে নদীর পাড়ে নিয়ে আসতে।”
প্রত্যুত্তরে আহিয়ান কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু তন্ময় এসে ওদের বাঁধা দেয়। আনিতা আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কেটে অন্যদিকে তাকালো। ওখানকার সবাইকেই আনিতা আর রোদেলা চিনে শুধুমাত্র দুজনকে ছাড়া। তন্ময় ওই দুজনের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো। তন্ময় আনিতাকে ফাইয়াজের বোন বলেই পরিচয় করালো। তা শুনে আহিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“ও শুধু ফাইয়াজের বোনই না। আমার ভালোবাসা আর তোদের ভাবীও হয়।”
সবার সামনে আহিয়ানকে এভাবে নির্লজ্জের মতো ভালোবাসার কথা বলতে দেখে আনিতা লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়। আনিতার দিকে তাকিয়ে সবাই ঠোঁট চেপে হাসলো। আনিতার লজ্জা পাওয়া দেখে আহিয়ানের বন্ধুরা বেশ মজা পেলো। আহিয়ানের সক বন্ধুরাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একসাথেই বলে উঠে,
–“তা ভাবী কেমন আছেন আপনি?”
বাকি সবার সাথে সাথে ফাইয়াজ আর তন্ময়ও আনিতাকে ভাবী ডেকেছে। নিজের থেকে বয়সে এত বড় বড় ছেলেদের মুখ থেকে ভাবী ডাক শুনে আনিতার লজ্জার পরিমান যেন আরো বেড়ে গেলো। আহিয়ানের পিছু গিয়ে ওর শার্ট খামচে ধরে লজ্জায় মুখ লুকালো।
।
।
।
চলবে।
#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৪০
#Ornisha_Sathi
তিনদিন পরের কথা। আনিতা আর রোদেলা বাসা থেকে বের হয়েছে বিকেলে। আজ অবশ্য শুভ সাথেই আছে। প্রথম বারের মতো একা বের হওয়ার সাহস করেনি আর। আহিয়ান এসময়ে অফিসে আর ফাইয়াজ রুমে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। আজ অফিস যায়নি। ফাইয়াজকে বলে তিনজনে বের হয় বাসা থেকে। আনিতারা রাস্তায় বের হয়ে বেশ কিছুটা দূর যেতেই পাশের একটা দোকান থেকে সেই ছেলেটা এগিয়ে এসে আনিতার পথ আটকে দাঁড়ায়। দেখে মনে হচ্ছে কথা বলতে চাচ্ছে। আনিতা সরে গিয়ে শুভর অন্যপাশে দাঁড়ায়। শুভ ছেলেটার আগাগোড়া ভালো করে দেখে নিলো। দেখে ফাইয়াজদের বয়সী মনে হচ্ছে। এলাকার বড় ভাই হবে। তাই শুভ নিজেই জিজ্ঞেস করে,
–“কিছু বলবেন ভাই?
–“ওর নাম কি?”
ছেলেটা রোদেলা আর আনিতা ওদের দুজনের দিকে ইশারা করে বলল। শুভ ওদের দুজনের দিকেই একবার তাকায়। আবার ঘুরে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“এখানে তো দুজন আছে৷ আপনি কার নাম জিজ্ঞেস করছেন?”
–“ওই তো যে মেয়েটা এখান থেকে সরে তোমার ওখানে গিয়ে দাঁড়ালো। লাল জামা পড়া মেয়েটা।”
–“ওওওহহহ ওর নাম? কেন ভাই ওর নাম দিয়ে কি করবেন?”
–“শুভ চল তো এখান থেকে। পড়ে উনি দেখলে আমার জন্য খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।”
আনিতা শুভর বাহু ধরে টেনে শুভর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কথাটা বলল। রোদেলাও ইশারা করছে এখান থেকে যাওয়ার জন্য। শুভ ঠিক ভাবে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে বলল,
–“আমাদের একটু তাড়া আছে ভাইয়া। আজ আসি?”
এই বলে ওরা পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলেই ছেলেটা পিছু ডেকে আনিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“আমার সাথে এখানে দেখলে কি খারাপ হবে শুনি? কাকে ভয় পাচ্ছো তুমি? কেউ বিরক্ত করছে তোমায়? তাহলে বলো আমায়। দেখবে এরপর থেকে আর তোমার ধারের কাছেও ঘেঁষার চেষ্টা করবে না।”
আনিতা কিছু না বলে রোদেলার হাত ধরে চলে যাচ্ছিলো। শুভও আছে ওদের সাথে। ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে আবার আনিতার সামনে দাঁড়ায়। আনিতার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলে,
–“তোমার নামটা বললে না তো।”
–“ভাই পথ ছাড়ুন না প্লিজ। এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি? রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
শুভর কথায় ছেলেটার বিন্দুমাত্র কোনো ভাবাবেগ হলো না। ঠায় ওদের সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আনিতার দিকে তাকিয়ে আছে। আনিতার দিকে চোখ রেখেই ছেলেটা ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–“ভালো লেগেছে আমার ওকে।”
ছেলেটার কথায় ওরা তিনজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আনিতা সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিলো। কেননা ছেলেটা ওর থেকে চোখ সরানো তো দূরে থাক চোখের পলক অব্দি ফেলছে না। শুভ কিছু বলার আগেই পাশের একটা চায়ের দোকান থেকে একটা ছেলে বের হয়ে এসে ওদের সামনেই দাঁড়ালো। ছেলেটাকে দেখেই আনিতা রোদেলা চট করে চিনে ফেলল। এটা তো সেই ছেলেটা। যার কাছে আহিয়ান ওর বাইকের চাবি দিয়ে বাসায় বাইক রাখতে পাঠিয়েছিলো। কি যেন একটা নাম বললো সেদিন আহিয়ান। শান্ত। হ্যাঁ শান্তই তো বলেছিলো। যে ছেলেটা আনিতা ওদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে ছিলে তার দিকে তাকিয়ে শান্ত বলে,
–“রিদমান ভাই___ভাবীরে ভালো লেগে লাভ নেই। ভাবী আগে থেকেই বুকড আছে। তার দিকে নজর না দেওয়াই ভালো।”
শান্তর কথায় আনিতা কেশে উঠে। রোদেলা হালকা ভাবে আনিতার পিঠে থাপ্পড় মারে দু/একটা। রিদমান শান্তকে বলে,
–“ভাবী ডাকছিস তার মানে আমাদেরর এলাকার বা চেনাজানা কেউই কিন্তু কে সে? পাঁচ দিনও হলো না আমাদের বিল্ডিংয়ে নতুন একটা মেয়ে এসেছে। আমিই জানলাম দুই দিন আগে। আর তুই বলছিস এর মাঝেই ও বুকিং হয়ে গেছে? এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”
–“হ্যাঁ হবে তো। আমাদের বড় ভাইয়ের নিজস্ব প্রপার্টি হলো ভাবী। সো দূরে থাকুন সুস্থ স্বাভাবিক থাকুন। কাছে এসে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলে আপনার হাত হাতের জায়গায় থাকবে না।”
–“থ্রেট করছিস আমাকে?”
–“এটা আমার কথা না। বড় ভাইয়ের কথা।”
–“কে তোর বড় ভাই শুনি?”
শান্ত রিদমানের কথার উত্তর না দিয়ে আনিতার দিকে তাকালো। আনিতা ওরা তখনো এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। শান্ত আনিতার সামনে গিয়ে হাসিমুখে বলে,
–“ভাবী আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না। আর বিরক্ত করলেও তাকে ঠিক করার জন্য ভাই তো আছেই।”
আনিতা আশেপাশে তাকালো একবার। এতক্ষণ রোদেলার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলো। বেশ অস্বস্তি নিয়েই আনিতা শান্তকে বলে,
–“ভা্ ভাবী ডাকবেন না প্লিজ। বয়সে আমি আপনার থেকে ছোটই হবো। না্ নাম ধরেই ডাকতে পারেন।”
শান্ত কিছু বলার আগেই সেখানে আহিয়ান এসে উপস্থিত হয়। আনিতার ঠিক সামনে এসেই আহিয়ান বাইক থামায়। আহিয়ানকে দেখে আনিতা ঘাবড়ে যায় কিছুটা। রোদেলা আর শুভ এতক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকলেও এখন আহিয়ানকে দেখে সাহস পাচ্ছে মনে। এতক্ষণে ওরা যদিওবা বুঝে ফেলেছিলো শান্ত আহিয়ানের কথাই বলছে। তারপরও কিছুটা ভয় কাজ করছিলো মনে। নতুন জায়গা তেমন জানা শোনা কেউ নেই। আহিয়ান একপলক রিদমানের দিকে তাকালো। রিদমান কপাল কুঁচকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। শান্ত এগিয়ে এসে আহিয়ানকে বলে,
–“ভাই আপনি এসেছেন?”
–“তোর সাথে পরে কথা বলছি।”
রিদমানের দিকে তাকিয়েই আহিয়ান কথাটা বলল। কয়েক সেকেন্ড বাদেই আহিয়ান রিদমানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনিতার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–“বাসা থেকে বের হয়েছো কেন?”
–“আ্ আজ তো শুভ আছে সাথে।”
আহিয়ান রাগী চোখে তাকাতেই আনিতা মাথা নিচু করে নিলো। রিদমান এবারেও বেশ অবাক হলো। আহিয়ান বাইক থেকে নেমে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। এক আঙুল দিয়ে আনিতার থুতনি ধরে উঁচু করলো। আনিতা আহিয়ানের চোখের দিকে তাকালো। আহিয়ানের চোখের ভাষাটা আনিতা ঠিক বুঝতে পারলো না। পাশ থেকে রিদমান ক্ষানিকটা ঝাঁজালো স্বরে বলে,
–“হাউ ডেয়ার ইউ টাচ হার?”
–“সেটা আমি তোকে পরে বলছি।”
আনিতার চোখের দিকে তাকিয়েই আহিয়ান রিদমানের প্রশ্নের জবাব দিলো। আহিয়ান আনিতার থুতনি থেকে নিজের আঙুল সরিয়ে বলে,
–“বাসায় যাও।”
আনিতা কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলো। কিন্তু তার আগেই আহিয়ান ওকে কিছুটা ধমকের সুরে বলে,
–“নো মোর ওয়ার্ড।”
আনিতা কিছু না বলে নিঃশব্দে উলটো ঘুরে বাসার পথে হাঁটা লাগালো। আনিতার পিছু পিছু শুভ আর রোদেলাও চলে এলো। আনিতারা বেশ কিছুটা দূর যাওয়ার পর আহিয়ান আনিতার থেকে দৃষ্টি সরালো। আহিয়ান রিদমানের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত গুজে বলে,
–“হ্যাঁ কি যেন বলছিলি এবার বল।”
–“কোন সাহসে তুই ওকে টাচ করলি?”
–“সাহস? ওকে টাচ করতে সাহস লাগে না আমার। অধিকারবোধ আছে। আর সেটা ও নিজেই দিয়েছে।”
রিদমান আহিয়ানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। রিদমানের দৃষ্টি দেখে আহিয়ান মৃদু হাসে। আহিয়ান পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে দেয়। শান্তর দিকে ইশারা করতেই শান্ত লাইটার এগিয়ে দেয় আহিয়ানকে। আহিয়ান সিগারেট জ্বালিয়ে লাইটার শান্তর দিকে ছুড়ে মেরে রিদমানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“যাকে লাইন মারার চেষ্টা করছিলি না সে অলরেডি আমার হয়ে গিয়েছে। আর ওকে টাচ করার অধিকার সাহস যাই বলিস না কেন সব শুধুমাত্র আমারই। সুতরাং এরপর যদি ভুল করেও ভুল নজরে ওর দিকে তাকাস তাহলে তোর ওই চোখদুটো খুলে আমি লুডু খেলবো।”
এইটুকু বলেই আহিয়ান রিদমানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলো আবার সেই রাস্তা দিয়েই চলে গেলো আহিয়ান। রিদমান আহিয়ানের যাওয়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। শান্তকে বলে,
–“আহিয়ানকে বলে দিস, ও যদি আমার না হয় তাহলে আহিয়ানেরও হবে না। আমি হতে দিবো না।”
এইটুকু বলেই রিদমান হনহনিয়ে চলে গেলো। শান্ত রিদমানের কথা শুনে ওর যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো পাশের সেই দোকানটাতে চলে যায়।
*
আনিতারা ওদের বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাস্তার ধারে ইট দিয়ে উঁচু করে বসার মতো জায়গা করা। সেখানেই আনিতা রোদেলা আর শুভ বসে পড়লো। রাস্তার মাঝেই কয়েকজন বাচ্চা খেলছে। বাচ্চাদের মাঝ থেকে হঠাৎ নুজাইরাহ বের হয়ে আনিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। আনিতা নুজাইরাহ এর গাল টেনে দিতেই নুজাইরাহ বলে,
–“জানো কাকাই এর ফো্ ফোনে তোমা্ তোমার অনেক ছবি দে্ দেখেছি।”
নুজাইরাহ আধো আধো ভাবে কথা গুলো বলল। আনিতা ভ্রু কুঁচকালো নুজাইরাহ এর কথা শুনে। নুজাইরাহ আবারো বলে,
–“কাকাই বলে্ বলেছে তুমি আমার কা্ কাকিয়া হও। আর আর মাম্মাম তোমাকে মামুনি বলে ডাকতে বলেছে।”
এইটুকুন বাচ্চা মেয়ের এত পাঁকা পাঁকা কথা শুনে আনিতা রীতিমতো অবাক। আনিতা নুজাইরাহ এর হাত ধরে বলে,
–“তোমার কাকাই কে আম্মু?”
নুজাইরাহ কিছু বলবে তার আগেই আর একটা বাচ্চা এসে ওকে খেলার ওখানে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় নুজাইরা বলে যায় এখন সে খেলবে আনিতার সাথে পরে কথা বলবে। আনিতা ভাবুক হয়ে নুজাইরাহ এর কথাগুলো ভাবছে। কি বলে গেল বাচ্চা মেয়েটা? ওর কাকাই এর ফোনে আনিতার ছবি? কে ওর কাকাই?
সন্ধ্যার কিছুটা আগে রুহি আর একটা মেয়ে নিচে নামে। আনিতা ওদের দেখতে পেয়ে রুহি ওদের সাথে গিয়ে কিছুটা সময় কথা বলে। রুহি জানায় ওই মেয়েটা ওর ননদ। নাম আদ্রিশা। ছোট্ট করে সবাই অদ্রি বলে ডাকে। এই অল্প সময়েই ওদের সবার মাঝে বেশ ভাব জমে যায়। অদ্রি এবার ক্লাস টেন এ পড়ছে। সন্ধ্যার কিছুটা আগেই রুহি অদ্রি আর নুজাইরাহ বাসার ভিতর চলে যায়। রুহিরা যেতেই ফাইয়াজ নিচে নেমে এসে বলে,
–“সন্ধ্যা হয়ে আসছে বাসায় যা। আমি একটু বাজারে যাচ্ছি রান্নার কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে।”
আনিতা মাথা দুলাতেই ফাইয়াজ চলে গেলো। আনিতা ওরা ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আহিয়ান এসে বাইক থামায় ওর সামনে। আনিতাকে বলে,
–“ঠিক দশ মিনিট বাদে নিচে নামবা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
–“কেন?”
–“প্রয়োজন আছে। এখন চুপচাপ ভিতরে যাও।”
আনিতা সম্মতি জানিয়ে ভিতরে চলে গেলো। আহিয়ানও নিজের বাসায় ঢুকে পড়ে। দূর থেকে রিদমান ওদের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে ছিলো।
দশ মিনিট বাদেই আনিতা নিচে নেমে আসে। হাতে একটা ছোট্ট টিফিন বক্স। আনিতা সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই আহিয়ানকে দেখতে পেলো। বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে। পড়নে কালো টি-শার্ট আর কালো থ্রি কোয়ার্টার। চুল বস্যে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে। শাওয়ার নিয়েছে অথচ ভালো করে চুল মুছে নি। আনিতাকে দেখেই আহিয়ান পকেটে পুড়ে নেয়৷ বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিয়ে আনিতাকে ইশারা করে বাইকের পিছনে বসতে। আনিতা এগিয়ে গিয়ে টিফিন বক্সটা বাইকের সিটে রেখে ওর ওড়না দিয়ে আহিয়ানের মাথা মুছে দেয়। মাথা মুছে দিয়ে আনিতা আবারো দূরে সরে দাঁড়ালো। আনিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহিয়ান বলে,
–“কি হলো উঠো?”
–“কোথায় যাবো?”
–“সামনেই___তোমার হাতে কিসের বক্স ওটা?”
–“পাস্তা আছে এতে।”
–“তুমি রান্না করেছো?”
–“হ্যাঁ।”
–“কার জন্য?”
–“আপনি ছাড়াও তো আমার আরো একজন আছে। তার জন্যই রান্না করে নিয়ে যাচ্ছি।”
আনিতার কথায় আহিয়ান মুচকি হাসলো। হেসেই বলল,
–“হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। এখন উঠো আমিই তার কাছে তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
আনিতা বিনাবাক্যে বাইকে উঠে বসলো। রোদেলা ওদের রুমের ব্যালকোনি থেকে কিছুটা জোরেই আহিয়ানকে বলে,
–“এই অসময়ে আমার বান্ধুবিটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?”
–“তোমাদের কাছে এটা অসময় মনে হলেও আমার কাছে প্রেম করার জন্য এটাই বেস্ট সময়। সামনেই যাচ্ছি ঘন্টা খানেকের মাঝেই ফিরবো।”
এইটুকু বলেই আহিয়ান বাইক চালাতে শুরু করে। রিদমান ওর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছিলো। ওর সহ্য হচ্ছে না আনিতার সাথে আহিয়ানকে। কেন যেন আহিয়ানের উপর বেশ হিংসা হচ্ছে ওর। রিদমান ভাবছে আনিতাকে ওর চাই। চাই মানেই চাই। সেটা যে ভাবেই হোক। ও আনিতাকে নিজের করবেই। মনে মনে এসব ভেবেই রিদমান বাঁকা হাসে।
।
।
।
চলবে।
[ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। আর গল্পটা কেমন হচ্ছে অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং🥰 ]