শুধু তোমারই জন্য পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
951

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৪১
#Ornisha_Sathi

একটা লেকের পাড়ে এসে বসেছে আনিতা আর আহিয়ান। আনিতা ওর হাত থেকে টিফিন বক্সটা আহিয়ানের দিকে এগিয়ে দিলো। আহিয়ান বক্স খুলে প্রথম চামোচ আনিতাকে খাইয়ে দিয়ে নিজে খেতে শুরু করে। খাওয়া শেষে বেশ কিছুটা সময় বসে থেকে হুট করেই আহিয়ান আনিতার কোলে মাথা রেখে শুইয়ে পড়ে। প্রথমে বেশ ঘাবড়ে গেলেও পড়ে নিজেকে সামলে নেয় ও। আহিয়ান আনিতার ওড়নার কোনা আঙুলে পেঁচিয়ে আবার খুলে ফেলছে। আর আনিতা আহিয়ানের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। পাশ দিয়ে একটা লোক যাচ্ছিলো বাদাম নিয়ে। আহিয়ান তাকে ডেকে বাদাম কিনে নেয়। আনিতা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে নিজেও খাচ্ছে আর আহিয়ানের মুখেও দিচ্ছে।

বেশ কিছুটা সময় দুজনে এভাবে কাটানোর পর আহিয়ান উঠে আনিতার দিকে ঘুরে বসে। আনিতা হাতদুটো ধরে বলে,

–“রিদমান কিন্তু বেশি ভালো ছেলে না। ও আবারো তোমাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করবে। তুমি ওর থেকে দূরে দূরে থাকবে কিন্তু।”

–“আচ্ছা।”

–“আর এর পর থেকে বাইরে বের হতে হলে ফাইয়াজ তন্ময় অথবা আমাকে নিয়ে বের হবে ওকে?”

–“হুম।”

–“একটা কথা বলবো?”

–“অনুমতি নিচ্ছেন কবে থেকে?”

–“রোদেলাকে বলবে না কিন্তু।”

–“কি এমন বলবেন যে ওকে বলা যাবে না।”

–“আছে সিক্রেট কিছু। ওর জানার সময় হলে ও ঠিক জেনে যাবে। কিন্তু আপাতত ওকে কিছু বলবে না।”

–“আচ্ছা বলবো না।”

–“তন্ময় ভালোবাসে ওকে।”

–“কিইইহ?”

–“চেঁচিয়ে ওঠার কি আছে? যা সত্যি তাই তো বললাম।”

–“কবে থেকে?”

–“শুরু থেকেই ভালো লাগতো। ধীরে ধীরে সেটা ভালো লাগা থেকে ভালোবাসায় রুপান্তর হয়েছে।”

–“হুম বুঝলাম। তো জানাচ্ছে না কেন ওকে?”

–“ও জানে এখন রোদেলাকে প্রপোজ করলে ও কিছুতেই রাজি হবে না। একবার কাউকে ভালোবেসে কষ্ট পেয়েছে রোদেলা। তাই ও আর প্রপোজ করবে না। একেবারে ফ্যামিলিকে নিয়ে গিয়ে বিয়ের প্রপোজাল দিবে।”

–“বাহ ভালোই তো! এই আমার না খুব খুশি খুশি লাগছে। রোদেলার বিয়ে নিয়ে আমার অনেক প্ল্যানিং আছে।”

–“কি প্ল্যানিং আছে শুনি।”

–“এখন বলা যাবে না। পরেই দেখবেন।”

এভাবে আরো বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ ওরা বাসার দিকে রওনা দেয়। মিনিট পনেরো বাদেই ওরা বাসায় পৌঁছে যায়। আনিতা কিচেনে গিয়ে দেখে রোদেলার রাতের রান্না প্রায় শেষের দিকে।

আনিতাকে নামিয়েই দিয়েই আহিয়ান বাসায় চলে যায়। রোদেলার রান্না শেষে আনিতা রোদেলা শুভ তিনজনে মিলে ড্রয়িংরুমে গল্পগুজব করছিলো। কলিংবেল বেজে উঠলে রোদেলা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে আহিয়ান ফাইয়াজ আর তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা সরে আসতেই ওরা ভিতরে ঢুকে। ফাইয়াজ দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে সবার সাথে সোফায় বসলো। তন্ময় রোদেলার দিকে দুটো পলিথিনের প্যাকেট এগিয়ে দিলো। রোদেলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে তন্ময় বলে,

–“ফুচকা আছে সবার জন্য।”

ফুচকার কথা শুনেই আনিতা আর রোদেলার জিভে জল চলে এলো। ওরা দুজনেই কিচেনে চলে গেলো। মিনিট পাঁচেক এর মাঝেই প্লেটে করে ফুচকা আর একটা বাটিতে করে টক পানি এনে টি-টেবিলের উপর রাখলো। সবাই ধীরে সুস্থে খেলেও আনিতা আর শুভ পাল্লা লেগে গেলো কে কতগুলা খেতে পারে। সবার থেকে আনিতা আর শুভই বেশি ফুচকা খেয়েছে। আনিতা শূন্য প্লেটের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে,

–“যাহ বাবা! শেষ হয়ে গেলো?”

–“এভাবে গপাগপ গিললে শেষ তো হবেই তাই না?”

আহিয়ানের কথায় আনিতা মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকালো। আধঘন্টার মতো সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। আনিতার ফোন বেজে উঠতেই ও রুমে চলে গেলো ফোন রিসিভ করতে। আনিতা রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে ওর আম্মুর ফোন। দ্রুত রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করে। একে একে আনিতা বাসার সকলেই সাথেই কথা বলে।

প্রায় মিনিট দশেক হয়ে এলো। আনিতা এখনো আসছে না। আহিয়ান বারবার ওর রুমের দিকে উঁকি মারছে। শেষে ধৈয্য হারা হয়ে আহিয়ান উঠে দাঁড়ালো। সকলের দিকে একবার তাকালো। সবাই গল্পে মগ্ন। আহিয়ান গুটিগুটি পায়ে আনিতার রুমে গেলো। আনিতা রুমের কোথাও নেই। ব্যালকোনি থেকে আনিতার কথার শব্দ আসছে। আহিয়ান ধীরে ধীরে গিয়ে আনিতাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরায় আনিতা প্রথমে কিছুটা চমকে উঠে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো ওটা আহিয়ান তখন একটা স্বস্তির শ্বাস নেয়। আহিয়ান পিছন থেকে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে ওর পেটের উপর হাত রেখেছে। আর আনিতার ঘাড়ে মুখ গুজেছে। আনিতার কেমন একটা ফিল হচ্ছে। বার বার কেঁপে উঠছে ও। আনিতা বা হাতে ফোন কানে নিয়ে ডান হাত আহিয়ানের হাতের উপর রাখলো। আহিয়ান এখনো ওর ঘাড়ে মুখ গুজে আছে। আনিতা সবার সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিলো। আনিতা পিছন ফিরে আহিয়ানের দিকে ঘুরতে চাইলে আহিয়ান আরো ভালো করে চেপে ধরে ওকে। আনিতা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

–“কি হ্ হচ্ছে এ্ এসব? ছাড়ুন কেউ দেখে ফেলবে তো।”

–“কেউ দেখবে না।”

–“কিন্তু ভুল করে ভুল টাইমে এন্ট্রি নিয়ে আমি তো সব দেখে ফেললাম।”

ব্যালকোনির দরজার কাছ থেকে শুভ কথাটা বলে উঠে। আহিয়ান সঙ্গে সঙ্গেই আনিতাকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। আনিতা লজ্জায় পড়ে যায়। এখন সারাটা সময় শুভ ওকে এই ব্যাপারটা নিয়ে খুঁচাবে ভাবতেই আনিতার আহিয়ানের উপর বেশ রাগ হলো। আনিতা দ্রুত পায়ে ওখান থেকে সরে যায়। আহিয়ান মুখটা কালো করে বলে,

–“রং টাইমে যখন এন্ট্রি নিয়েছিলে তখন কথা না বলে যে পথ দিয়ে এসেছিলে আবার সেই পথ দিয়ে চলে গেলেই তো পারতে।”

–“আসলে ভাইয়া কি বলুন তো__আমি সিঙ্গেল তো। তাই আমার সামনে কোনো কাপল রোমান্স করবে এই ব্যাপারটা আমার ঠিক সহ্য হয় না। তাই আপনাদের রোমান্সের বারোটা বাজালাম।”

–“হুম বুঝলাম। এখন মনে হচ্ছে আমার শান্তিতে একটু রোমান্স করার জন্য হলেও তোমায় খুব শীঘ্রই একজন খুঁজে দিতে হবে।”

কথাগুলো বলে ওরা দুজনে হাসতে হাসতেই রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এসে বসলো। আনিতা আর রোদেলা পাশাপাশি বসেছে। আর ওদের দুজনের মুখোমুখি ভাবে আহিয়ান আর তন্ময় বসেছে। আর টেবিলের দুই মাথার চেয়ার দুটোতে শুভ আর ফাইয়াজ বসেছে। রোদেলা আর আনিতা একে একে সবার প্লেটে খাবার সার্ভ করে দিলো। ডিনারে রোদেলা বড় ইলিশ ভূনা, ডাল চচ্চড়ি আর লাল শাক ভাজি করেছিলো। ডাল চচ্চড়ি আনিতা আর ফাইয়াজের পছন্দের একটা খাবার। আর রোদেলার হাতের ডাল চচ্চড়ি হলে তো আনিতার আর কোনো কথাই নেই। একেবারে আঙুল চেটেপুটে খায়।

এই প্রথম বার আহিয়ান আর তন্ময় রোদেলার হাতের রান্না করা খাবার খেলো। বেশ প্রশংসা করেছে রোদেলার রান্নার। আহিয়ান তো আনিতাকে বলে ফেলল রোদেলার থেকে রান্না শিখে রাখতে। বিশেষ করে ডাল চচ্চড়িটা। এটা নাকি ওদের সকলেরই বেশ ভালো লেগেছে। ডিনার শেষে আরো কিছুক্ষণ গল্প করে আহিয়ান আর তন্ময় চলে গেলো নিজেদের বাসায়। ফাইয়াজ আর শুভও নিজেদের রুমে চলে গেলো ঘুমোতে। আনিতা আর রোদেলা কিচেনের সবকিছু গোছগাছ করে ওরা দুজনেও ঘুমাতে গেলো।

পরদিন সকালে আনিতা আর রোদেলা একটা ক্লাশ করে বের হলো। শুভ একটা কাজে গিয়েছে। মাঠে বসে আছে দুজনেই। আনিতার মুড অফ হয়ে আছে। সকালে যখন রিকশা করে ভার্সিটি আসছিলো তখন রাস্তায় আনিতা আহিয়ানের মতো একজনকে দেখতে পায় একটা মেয়ের সাথে রিকশায় করে যেতে। মেয়েটা ছেলেটার হাত জড়িয়ে ধরে ছেলেটার কাঁধে মাথা রেখে বসে ছিলো। আর ছেলেটাও কি সুন্দরভাবে মেয়েটার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে রেখেছে। অবিশ্বাস্য চোখে আনিতা কয়েক সেকেন্ড রিকশায় বসা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিকশাটা চোখের আড়াল হতেই আনিতা ফোন করে আহিয়ানের নাম্বারে ডায়াল করে। ফোন বেজে বেজে কেটে গেলো। বেশ কয়েকবার ফোন করার পরও আহিয়ান ফোন রিসিভ করেনি। সেই থেকে আনিতার মুড অফ। রাগ হচ্ছে প্রচুর। কিছুই ভালো লাগছে না।

হঠাৎ করেই আনিতার চোখ যায় ক্যান্টিনের দিকে। একটা মেয়ে আহিয়ানকে টানতে টানতে ক্যান্টিনে নিয়ে গেলো। আনিতা এমনিতেই রেগে ছিলো। তার উপর আবার এখন এই দৃশ্য দেখে ওর রাগ আরো বেড়ে গেলো৷ উঠে দাঁড়ালো আনিতা। বড় বড় কদম ফেলে ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে গেলো ও। রোদেলাও ওর পিছু পিছু যাচ্ছে। আনিতা ক্যান্টিনে গিয়ে ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা চিৎকার করেই বলে,

–“সমস্যা কি আপনার? আমি সকালে এতবার ফোন করলাম আপনি ফোন রিসিভ করলেন না কেন? আর মেয়েটা কে ছিলো? যার সাথে আপনি সকালে রিকশায় করে ঘুরে বেড়ালেন? আর এই মেয়েটিই বা কে? এখন আমাকে আর ভালো লাগে না তাই না? যার জন্য এখন আমায় রেখে অন্য মেয়েদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পুরোনো হয়ে গিয়েছি আমি তাই না?”

–“আরেহ কে আপনি? এখানে এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন কেন?”

–“বাহ! এখন দেখছি আপনি আমাকে চিনতেও পারছেন না। এক দিনেই ভুলে গেলেন কে আমি?”

রোদেলা আনিতাকে সরিয়ে নিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে,

–“আহ আনিতা! কি করছিস এসব? হয়তোবা আহিয়ান ভাইয়া কোনো কাজে এসেছে এখানে। পরে সব মিটমাট করে নিস। এখানে পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করিস না।”

–“সিনক্রিয়েট? সিনক্রিয়েট আমি করছি? আর উনি? উনি কি করছে এসব? সকালে এক মেয়ে এখন আবার অন্য মেয়ে। এত না বলে আমাকে ভালোবাসে তাহলে এখন আমার ফোনও তুলছে না কেন উনি? বুঝেছি আমি। ভালোবাসেন না উনি আমাকে। একটুও ভালোবাসেন না। যদি ভালোবাসতোই তাহলে এভাবে আমাকে ঠকাতে পারতো না। আমাকে চিনতে অস্বীকার করতো না।”

আনিতা আবার ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

–“আপনি আর কোনোদিনও আমার চোখে সামনে আসবেন না। ভালোবাসি না আমি আপনাকে। কেউ হন না আপনি আমার। আজকের পর থেকে আর কোনো সম্পর্ক থাকবে আমাদের।”

এইটুকু বলেই আনিতা চোখের পানি মুছতে মুছতে ক্যান্টিন থেকে বের হতেই আহিয়ান এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। আনিতা রাগে অভিমানে আহিয়ানের দিকে ভালোভাবে না তাকিয়েই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। আহিয়ান আনিতার হাত ধরে ওকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে আনিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

–“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন এভাবে?”

–“আপনাকে না বললাম আমার চোখের সামনে আপনি আর কোনোদিনও আসবেন না। আপনার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।”

–“মানে? এই কথা তুমি আমাকে কখন বললে?”

–“ছাড়ুন আমায়। আমি আপনার সাথে আর কোনো কথা বলতে চাই না। ভালোবাসি না আমি আপনাকে।”

–“আরেহ আমি কি করেছি সেটা তো বলবে?”

–‘কি করেছেন আপনি? এই কথাটাও আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আপনি? একটু আগেই তো আমাকে চিনতে অস্বীকার করলেন আপনি। এখন আবার কেন এসেছেন আপনি? আপনি ওই মেয়ের কাছেই যান। আমার কাছে একদম আসবেন না বলে দিলাম।”

–“আরেহ কোন মেয়ের কাছে যাবো? আর আমি তোমায় চিনতে কখন অস্বীকার করলাম?”

–“একদম নাটক করবেন না। আমি খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছি আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।”

–“আরেহ বাবা আমি তো তোমাকেই ভালোবাসি। তুমিই তো কিসব উল্টাপাল্টা বলে যাচ্ছো কখন থেকে।”

–“আমি উল্টাপাল্টা বলছি? আমি? লজ্জা করে না আপনার সকালে এক মেয়ের সাথে রিকশায় ঘুরলেন তা দেখে আমি আপনাকে এতবার ফোন করলাম আপনি রিসিভ করলেন না। এখন আবার আরেক মেয়ের সাথে ক্যান্টিনে বসে কফি খাচ্ছেন আবার আমায় ভালোবাসি বলছেন। লজ্জা করে না এসব___”

–“আরেহ কিসব আবোলতাবোল বলে যাচ্ছো তুমি? এবার কিন্তু আমার সত্যিই রাগ হচ্ছে।”

কিছুটা ধমকের সুরেই কথাগুলো বলল আহিয়ান। আনিতা তখন চুপ হয়ে যায়। কথা থামিয়ে দিয়ে ডুঁকড়ে কেঁদে উঠে আনিতা। পাশ থেকে একজন বলে উঠে,

–“আমি বুঝিয়ে বলছি তোকে।”

আহিয়ান পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পাশে ফিরে তাকায়। পাশে দাঁড়িয়ে আছে এর বড় ভাই নাহিয়ান। এই ভার্সিটির প্রফেসর ও। নাহিয়ান একে একে সবটা আহিয়ানকে খুলে বলে। এবারে আহিয়ান বুঝতে পারলো আনিতার এমন কান্নাকাটি আর ওসব কথার মানে। পাশ থেকে অন্যএকজনকে সবটা বলতে শুনে আনিতা মাথা তুলে তাকায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে। আনিতা আর রোদেলা দুজনেই চোখ বড় বড় করে দেখছে দুজনকে। আনিতা আর রোদেলাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহিয়ান বলে,

–“এটা হচ্ছে আমার বড় ভাই নাহিয়ান। এই ভার্সিটিরই প্রফেসর।”

–“আপনারা দুজনে কি যমজ?”

–“উঁহু। আহিয়ান আমার থেকে গুনে গুনে সাড়ে চার বছরের ছোট।”

রোদেলার প্রশ্নের জবাবে নাহিয়ান বলল কথাটা। আনিতার অবাকের মাত্রা যেন এখনো কমছে না। চোখ বড় বড় করে একবার আহিয়ানকে দেখছে তো একবার নাহিয়ানকে দেখছে। দুটো মানুষের মাঝে চেহারার এতটা মিল কিভাবে থাকতে পারে? যমজ না দুজনে। কিন্তু যে কেউ দুজনকে একসাথে দেখলে গুলিয়ে ফেলবে। দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যাবে এই ভেবে যে কোনটা নাহিয়ান আর কোনটা আহিয়ান? দুজনেই একদম ফর্মাল লুকে আছে। কালো প্যান্ট সাদা শার্ট। আহিয়ানের থেকে নাহিয়ানের গায়ের রংটা সামান্য একটু উজ্জ্বল। দূর থেকে দেখলে কেউ সেটা ধরতেও পারবে না। অতি কাছ থেকে যে দেখবে দুজনকে সেই বুঝতে পারবে ওদের গায়ের রঙে কিছুটা তফাৎ আছে। আর তাছাড়া নাহিয়ান হাসলে বা গালে টোল পড়ে কিন্তু আহিয়ানের টোল পড়ে না। এ দুটো পার্থক্য ছাড়া আর কোনো অমিল খুঁজে পাওয়া যাবে না দুজনের। আনিতা অবাকের রেশটা এখনো কাটিয়ে ওঠতে পারেনি।



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৪২
#Ornisha_Sathi

একটা রেস্তোরাঁয় বসে আছে ওরা চারজনে। আনিতা লজ্জায় মুখ তুলে নাহিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে না অব্দি। কি একটা অস্বস্তিকর অবস্থা। আহিয়ান ভেবে আহিয়ানের বড় ভাইকে যা না তাই বলে দিলো। এখন লজ্জায় একদম নুইয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে নাহিয়ানই প্রথমে আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

–“তোর পিচ্চির চক্করে পড়ে ভার্সিটিতে সকল স্টুডেন্টদের সামনে আমার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে গেলো।”

–“আর একটু হলে যে তোমার জন্য আমার না হওয়া সংসারটা ভেঙে যাচ্ছিলো। বাসায় যাই একবার তারপর ভাবীকে বলছি মেয়েদের নিয়ে রিকশায় করে ঘুরা আবার ভার্সিটি এসে ওই রুপশার সাথে ক্যান্টিনে বসে কফি খাওয়া তাই না?”

–“আরেহ ভাই সকালে ওটা তোর ভাবীই ছিলো। ওকে ওর বাবার বাসায় নামিয়ে দিয়েই আমি ভার্সিটি এসেছি।”

–“হ্যাঁ সকালে না হয় ভাবী ছিলো। কিন্তু ভার্সিটি এসে রুপশার সাথে কফি খাচ্ছিলে কেন? ভাবী না বলেছে ওর থেকে দূরে দূরে থাকতে?”

–“আমাকে তো জোর করে টেনে নিয়ে গেলো।”

–“বুঝেছি আমি। এখন আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না।”

–“তোর এইসব ফালতু পেচাল বাদ দিবি? আনিতার সাথে সহজ হতে দে আগে আমায়। মেয়েটা একদম ভয় পেয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে এক কোনে।”

আহিয়ান কিছু না বলে পকেট থেকে ফোন বের করলো। দুপুর দেড়টা বাজে। তাই আহিয়ান একজন ওয়েটারকে ডেকে লাঞ্চের অর্ডার করলো। আহিয়ান আনিতার দিকে চোখ বুলালো একবার। মেয়েটা এখনো আনইজি ফিল করছে৷ করারই তো কথা। আহিয়ান ভেবে আহিয়ানের বড় ভাইকেই হুমকি ধমকি দিয়েছে কিনা? তার উপর আবার ওদের প্রফেসর। অস্বস্তি ভয় লজ্জা তো হবেই। আহিয়ান নাহিয়ান দু ভাই মিলে বেশ কিছুটা সময় ওকে বুঝিয়ে স্বাভাবিক করেছে। সেদিনের মতো ওরা লাঞ্চ করে বাসায় ফিরে আসে। বাসার সামনে এসে আনিতা এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যায়।

তার কিছু দিন পরের কথা। বিকেলে আনিতা আর আহিয়ান সেই নদীরে পাড়ে গিয়ে বসে সময় কাটাচ্ছিলো। হঠাৎই একটা বাচ্চা মেয়ের উপর আনিতার চোখ যায়। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে প্রথমেই আনিতার নুজাইরাহ এর কথা মনে পড়ে৷ আনিতা ভাবলো, আহিয়ান আর নুজাইরাহরা তো একই বিল্ডিংয়ে থাকে। তাহলে নিশ্চয়ই আহিয়ান নুজাইরাহকে চিনবে। ওকে একবার নুজাইরাহ এর কথা জিজ্ঞেস করবে? দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে আনিতা আহিয়ানকে বলে,

–“আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

–“হুম।”

–“নুজাইরাহকে চিনেন?”

নুজাইরাহ এর নাম শুনতেই আহিয়ান ফোন পকেটে পুড়ে আনিতার দিকে ফিরে বসলো। আনিতার হাত ধরে বলে,

–“কোন নুজাইরাহ?”

–“আপনাদের বিল্ডিংয়েই তো থাকে। কি কিউট করে বাচ্চা একটা মেয়ে। কেন আপনি চিনেন না?”

–“হ্যাঁ চিনি। কেন বলো তো?”

–“ওকে আমার বেশ ভালো লাগে। ইচ্ছে করে সবসময় ওকে আমার সামনে বসিয়ে রেখে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। কত্তত্ত কিউট। বারবার ওর গাল গুলো টেনে দিতে ইচ্ছে করে। ওর কথা গুলো শুনতে ভালো লাগে।”

–“তাই?”

–“হুম তো। জানেন ও না আমাকে কয়েকবার কাকিয়া বলে ডেকেছিলো। ওর কাকাই এর ফোনে নাকি আমার অনেক ছবি দেখেছে। কিন্তু কে ওর কাকাই সেটাই বুঝলাম না।”

আনিতা ঠোঁট উলটে কথাগুলো বলল। আহিয়ান দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হেসে বলে,

–“কেন জিজ্ঞেস করোনি ওর কাকাই কে? কার এত বড় সাহস আমার পিচ্চিপাখির অনেকগুলো ছবি নিজের ফোনে রাখে।”

–“জিজ্ঞেস করেছিলাম তো। কিন্তু কিছু না বলেই খেলতে চলে গিয়েছিলো।”

–“আচ্ছা চলো।”

–“কোথায়?”

–“আরেহ চলো না। গেলেই দেখতে পাবে।”

এই বলে আহিয়ান আনিতার হাত টেনে ধরে বাইকের কাছে নিয়ে গেলো। ওরা দুজনে বাইকে উঠে বসতেই আহিয়ান বাইক স্টার্ট দিলো। মিনিট দশেকের মাঝেই আহিয়ান ওদের বিল্ডিংয়ের সামনে এসে বাইক থামালো। আহিয়ান বাইক পার্ক করে আনিতার হাত ধরে ওদের বিল্ডিংয়ের ভিতর যেতে শুরু করলো। আনিতা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,

–“এখানে কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

–“চলো আমার ফ্যামিলির বাকী সবার সাথেও তোমার পরিচয় করিয়ে দেই।”

–“কিন্তু আপনার মা?”

–“আম্মু বাসায় নেই আজ।”

এইটুকু বলে আনিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লিফটে করে ফোর্থ ফ্লোরে উঠে পড়লো। লিফট থেকে বের হয়ে ডান দিকের দ্বিতীয় ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে আহিয়ান কলিংবেল চাপলো। এক থেকে দু মিনিটের মাঝেই দরজা খুলে গেলো। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্রিকে দেখে আনিতা চোখ বড় বড় করে তাকায়। অদ্রি একগাল হেসে দরজার পাশ থেকে সরে গিয়ে বলে,

–“ভিতরে এসো ভাবী। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা।”

এইটুকু বলেই অদ্রি ভিতরে চলে গেলো। আহিয়ান আনিতার হাত ধরেই বাসার ভিতরে প্রবেশ করে। আনিতা আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

–“ও___”

–“ভিতরে চলো আগে তারপর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।”

প্রত্যত্তুরে আনিতা আর কিছু বলল না। আহিয়ান আনিতার হাত ধরে সোজা সোফায় গিয়ে বসলো। নাহিয়ান আর অদ্রি এসে বসলো পাশের সোফায়। রুহি উড়নায় হাত মুছতে মুছতে কিচেন থেকে এসে আনিতার পাশে বসলো। আনিতা অবাক চোখে সবাইকে দেখছে। এরাই কি আহিয়ানের ভাবী আর বোন? আনিতা কিছুই বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল করে ওদের সবার দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি মুচকি হেসে আনিতাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,

–“এই যে ঝাসির রানী তোমার পাশে যে অতি কিউট হ্যান্ডসাম ড্যাশিং শান্তশিষ্ট ভদ্র‍ ছেলেটাকে দেখছো আমি তার একমাত্র ভাইয়ের একমাত্র বউ অর্থাৎ তার অতি আদরের ভাবী।”

রুহির এমন ঘোরপ্যাঁচ কথা শুনে আনিতা বিষম খেলো। আহিয়ান শান্তশিষ্ট? ওর মতো রাগী ছেলে তো মনে হয় আর দুটো দেখেনি আনিতা। অদ্রি কিচেনে গিয়ে একগ্লাস পানি এনে আনিতার সামনে ধরলো। আনিতা গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে খালি গ্লাসটা টি-টেবিলের উপর রাখলো। আহিয়ান সবার সাথে আনিতার পরিচয় করিয়ে দেয়। অদ্রি আহিয়ানের ছোট বোন। আর ওই ফুটফুটে পিচ্চি কিউট নুজাইরাহ হলো নাহিয়ান আর রুহির মেয়ে। রুহি উঠে গিয়ে কিচেন থেকে ট্রেতে করে কয়েক ধরনের খাবার এনে টি-টেবিলে রাখলো। আনিতার পাশে বসে আনিতাকে খেতে ইশারা করলো। আনিতা কাচুমাচু হয়ে চুপচাপ বসে আছে। এতদিনে রুহি আর অদ্রির সাথে আনিতা বেশ সহজ হলেও জানতো না ওরা আহিয়ানের ভাবী আর বোন। আজকে জানার পর কেমন একটা জড়তা কাজ করছে। পাশের রুম থেকে নুজাইরাহ “কাকাই” বলে দৌড়ে এসে আহিয়ানের কোলে চেপে বসলো। আহিয়ানও পরম আদরে নুজাইরাহকে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে।

অনেকটা সময় সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দিতে দিতে একপর্যায়ে আনিতা আবার আগের মতো রুহি আর অদ্রির সাথে সহজ হয়ে গেলো। আর কোনো জড়তা কাজ করছে না ওর মাঝে। নাহিয়ানের সাথেও আনিতা এখন বেশ ফ্রি হয়েছে। সন্ধার ক্ষানিকটা আগে আনিতা ওঠে দাঁড়ালো নিজেদের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য। নুজাইরাহ আনিতার কাছে এসে দাঁড়াতেই আনিতা ওকে কোলে তুলে নেয়। নুজাইরাহ আনিতার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। নুজাইরাহকে কোলে নিয়েই সকলের থেকে বিদায় নিয়ে আনিতা আহিয়ানদের ফ্ল্যাট থেকে বের হলো। সাথে আহিয়ানও এসেছে। আনিতা নুজাইরাহকে কোলে করে নিয়েই নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে গেলো। আহিয়ান পরে এসে নুজাইরাহকে নিয়ে যাবে।

বেশ কিছুদিন যাবত রিদমানের বিরক্ত করার পরিমানটা বেশ বেড়ে চলেছে। যখন তখন যেখানে সেখানে বিরক্ত করতে চলে আসে। ওর জন্য এখন আনিতা ফাইয়াজ বা আহিয়ানকে ছাড়া একা বাসা থেকে বেরও হয় না। রিদমানের বিষয়ে আহিয়ান আর ফাইয়াজকে জানিয়েছে আনিতা। ওরা দুজনে বেশ কয়েকবার রিদমানকে ওয়ার্ন করেছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না এতে। রিদমানের অসভ্যতামো দিন দিন বেরেই যাচ্ছে। কিন্তু আজ তো রিদমান সব লিমিট একেবারে ক্রস করে ফেলেছে।

বিকেলে নুজাইরাহ এসেছে বাসায়। সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই বায়না ধরে চিপস্ খাবে। ফাইয়াজ আর শুভ বাসায় নেই। রোদেলাও রাতের রান্না করছে। তাই বাধ্য হয়েই আনিতা উঠে দাঁড়ালো দোকানে যাওয়ার জন্য। আনিতাদের বিল্ডিংয়ের প্রথম তলায় একটা দোকান আছে। একটা চিপস্ তো কিনবে। তিন থেকে চার মিনিট লাগবে। তাই ও গায়ে উড়না জড়িয়ে দরজা খুলে আশেপাশে দেখে নিলো একবার৷ নাহ রিদমান কোথাও নেই। আনিতা মনে মনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে পা বাড়ালো সিড়ির দিকে। দোকানে গিয়ে দু প্যাকেট চিপস্ কিনে নিলো আনিতা। দোকানীকে টাকা দিয়ে পিছু ঘুরার আগেই হুট করে কেউ আনিতার কোমড়ে বাজে ভাবে স্পর্শ করে। চট করে আনিতা পিছন ফিরে রিদমানকে দেখে কয়েকপা সরে দাঁড়ায়। রাগে ঘৃণায় আনিতার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। দ্রুত পা ফেলে আনিতা সিড়ি বেয়ে চার তালায় উঠে যায়৷ নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ভিতরে যাওয়ার আগেই রিদমান ওকে টেনে নিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। রিদমান বা হাত দিয়ে আনিতার একহাত পিছনে নিয়ে পিঠের সাথে মুচড়ে ধরে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে আনিতা। ডান হাত দিয়ে রিদমান আনিতার কপাল থেকে থুতনি অব্দি বাজে ভাবে স্পর্শ করে। এবার কিছুটা শব্দ করেই কেঁদে ফেলে আনিতা৷ রিদমান আনিতার কপালে পড়া চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে বলে,

–“এখন কোথায় তোমার আহিয়ান? এলো না আমার হাত থেকে তোমায় বাঁচাতে? ও তো আমায় তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাতে অব্দি বারন করেছিলো। কিন্তু আমি তো তোমায় টাচ করে ফেললাম। এবার কি হবে?”

–“চোরের মতো লুকিয়ে আহিয়ানের চোখের আড়ালে আমার সাথে এরকম না করে পারলে ওর সামনে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখান। আপনার হাত আর হাতের জায়গায় থাকবে না।”

–“এই চুপ। একদম চুপ। আহিয়ানের ভয় দেখানো হচ্ছে আমাকে? আহিয়ানের ভয়? তোমার সাহস হয় কি করে ওর সাথে এভাবে ঘুরে বেরানোর? তোমাকে একদিন বলেছি না তুমি শুধু আমার? তাহলে কেন ওর সাথে মিশো তুমি? নেক্সট টাইম যাতে আর না দেখি ওর সাথে তোমাকে। আমি ভালোবাসি তোমাকে। আমি ভালোবাসি। আমি তোমাকে আহিয়ানের কিছুতেই হতে দিবো না।”

এইটুকু বলে রিদমান একহাতে আনিতার দু গাল চেপে ধরে ওর ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। আনিতা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। এদিক ওদিক মাথা নাড়াচ্ছে। কিছুতেই রিদমানের সাথে পেড়ে উঠছে। এই মূহুর্তে ওর নিজেকে খুব বেশি অসহায় অসহায় লাগছে। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে বারবার। হঠাৎ করেই সিড়িতে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে রিদমান আনিতাকে ছেড়ে দেয়। আনিতা ছাড়া পেয়ে রিদমানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে।

আনিতাকে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিতে দেখে রোদেলা কিচেন থেকে বের হয়ে এলো। সদর দরজা খোলা দেখে রোদেলা সদর দরজা আটকাতে গিয়ে দেখে বাইরে রিদমান দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ফ্ল্যাটের দিকেই উঁকিঝুঁকি মারছে। রোদেলা এবার বুঝতে পারলো আনিতার ওভাবে দৌড়ে গিয়ে রুম লক করে দেওয়ার কারন। রোদেলা সদর দরজা লাগিয়ে ওদের রুমের সামনে চলে যায়। দরজা ধাক্কা দিয়ে বেশ কয়েকবার আনিতাকে ডাকে রোদেলা। কিন্তু আনিতা ভেতর থেকে কোনো সারা দিচ্ছে না। রোদেলার বেশ ভয় লাগছে এবার। বাইরে রিদমান উল্টাপাল্টা কিছু করেনি তো আনিতার সাথে? এসব ভেবে রোদেলার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। নুজাইরাহ সোফা থেকে নেমে রোদেলার পাশে দাঁড়িয়ে ওর জামা ধরে টানে। রোদেলা হাটু ভেঙে নুজাইরাহ এর সামনে বসতেই নুজাইরাহ বলে,

–“আন্টি কাকিয়ার কি হয়েছে?”

–“কিছু হয়নি সোনা। তুমি যাও গিয়ে কার্টুন দেখো।”

–“আমি চিপস্ খাবো।”

–“আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি সোনা।”

এইটুকু বলে রোদেলা উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো টি-টেবিলের উপর দু প্যাকেট চিপস্ রাখা। রোদেলা নুজাইরাহকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে এক প্যাকেট চিপস্ ওর হাতে দিয়ে আবারো আনিতাকে ডাকতে গেলো। কিন্তু আনিতা এবারেও সারা দিচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ ডাকার পরও যখন আনিতা সারা দিচ্ছে না তখন রোদেলার ভয় হতে শুরু করে। আর কোনো উপায় না পেয়ে ফাইয়াজকে কল দেয়। ফাইয়াজের ফোন ওয়েটিং বলছে। কি করবে না করবে কিছু ভাবতে পারছে না রোদেলা। উপায়ন্তর না পেয়ে শেষে আহিয়ানকে ফোন করে আনিতা। দু বার রিং হতেই আহিয়ান ফোন রিসিভ করে। রোদেলা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

–“ভাইয়া আনিতা রুমের দরজা খুলছে না।”

–“ঘুমিয়েছে হয়তো। ডাকো ভালো করে।”

–“নাহ ভাইয়া ঘুমায়নি ও।”

–“তাহলে দরজা খুলবে না কেন?”

–“আধ ঘন্টা আগে নুজাইরাহ বায়না ধরেছিলো চিপস্ খাবে। তাই ও চিপস্ কিনতে নিচে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে দরজা লক করেছে। এখন এত করে ডাকছি দরজা খুলছে না ও। সদর দরজা লক করতে গিয়ে রিদমানকে দেখেছিলাম আমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে। আম্ আমি কি করবো ভাইয়া? খুব টেনশন হচ্ছে আমার। আনিতাকে এত করে ডাকার পরও কিছুতেই সারা দিচ্ছে না ও।”

–“আসছি আমি।”

এইটুকু বলেই আহিয়ান লাইন কেটে দিলো। অফিস থেকে বের হয়ে বাইক স্টার্ট দিলো আহিয়ান। যতটা জোরে সম্ভব বাইক চালাচ্ছে আহিয়ান। বাইক চালাতে চালাতেই আহিয়ান একা একা বিড়বিড় করছে,

–“এবার যদি রিদমান বাড়াবাড়ি কিছু করেছে তো আমি খুন করে ফেলবো ওকে। আমার হাত থেকে এবারে কেউ বাচাতে পারবে না ওকে। আই সোয়্যার, আই উইল কিল হিম।”



চলবে।

#শুধু_তোমারই_জন্য
#পর্ব_৪৩
#Ornisha_Sathi

আহিয়ান বাসার সামনে এসে কোনোমতে বাইক পার্ক করে দ্রুত সিড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে গেলো। সদর দরজা খোলাই ছিলো। আহিয়ান ভিতরে ঢুকে দেখলো আনিতার রুমের দরজা খোলা। রুমে ঢুকতেই দেখে আনিতা ফাইয়াজকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আহিয়ান আনিতাকে একদম ঠিকঠাক দেখতে পেয়ে মনে মনে আল্লাহ এর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করে। আহিয়ানকে দেখে রোদেলা আনিতার অন্যপাশ থেকে সরে বসলো। আহিয়ান আনিতার পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

–“আনি___কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন এভাবে? আমাকে বলবে না?”

আহিয়ান আনিতার মাথায় হাত রাখার সাথে সাথেই আনিতা ফাইয়াজকে ছেড়ে আহিয়ানকে জড়িয়ে ধরে। আহিয়ানের বুকে মাথা রেখে ওর শার্ট খামচে ধরে কিছুটা শব্দ করে কাঁদছে এখন আনিতা। শুভ নিরব দর্শকের মতো এক কোনে দাঁড়িয়ে আনিতাকে দেখছে। আহিয়ান আবারো আনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–“তুমি যদি না বলো তোমার কি হয়েছে তাহলে আমি বুঝবো কিভাবে? তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয় তো।”

আনিতা তখনো চুপচাপ আহিয়ানের বুকে মাথা রেখে হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আহিয়ানের মনে পড়লো রোদেলা বলেছিলো, আনিতা যখন দরজা লক করে তখন সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রিদমান উঁকিঝুঁকি মারছিলো। রিদমানের কথা মনে হতেই আহিয়ানের মাথা গরম হয়ে গেলো। তবুও নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বলে,

–“রিদমান কিছু বলেছে তোমায়?”

রিদমানের কথা শুনতেই আনিতা আরো শক্ত করে আহিয়ানকে আঁকড়ে ধরলো। আগের তুলনায় আরো বেশি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আহিয়ানের বুঝতে বাকী রইলো না রিদমানই কিছু করেছে। আনিতার পিঠে হাত রেখে আহিয়ান বলে,

–“কি করেছে ও?”

–“উন্ উনি আমার সা্ সাথে_____”

একে একে সবটা খুলে বলল আনিতা আহিয়ানকে। কথাগুলো শুনে আহিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর। ওই রিদমানের এত সাহস হলো কি করে ওর আনিতার গায়ে হাত দেয়? রাগে নিজের হাত মুঠো করে নিলো ও। আহিয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে শান্তর নাম্বারে ডায়াল করলো। কয়েক সেকেন্ড বাদে শান্ত ফোন রিসিভ করতেই আহিয়ান বলে,

–“রিদমান কোথায়?”

–“জানি না ভাই।”

–“এক্ষুনি খোঁজ লাগা৷ আর ওর খোঁজ পাওয়ার সাথে সাথেই আমাকে লোকেশন জানাবি।”

–“আচ্ছা ভাই।”

এইটুকু বলেই ওপাশ থেকে শান্ত ফোন কেটে দিলো। মিনিট দুয়েকের মাথায় শান্ত ম্যাসেজ করে জানালো রিদমান তিন রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আহিয়ান আনিতার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। গটগট করে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আনিতাকে নিয়ে বাইকে উঠে বসলো আহিয়ান। ফাইয়াজ এসে আহিয়ানের কাঁধে হাত রেখে বলে,

–“বাদ দে এসব। এখন আর ঝামেলা করে লোক জানাজানি করে লাভ নেই। নেক্সট টাইম এমন করলে আর ছাড় পাবে না ও।”

–“ওকে অনেকবার ওয়ার্ন করা হয়েছে ফাইয়াজ। কিন্তু ও কিছুতেই শুনেনি। আর আজ তো সব লিমিট ক্রশ করে ফেলেছে ও।”

এইটুকু বলে সাথে সাথেই বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো আহিয়ান। ফাইয়াজ বুঝতে পেরেছে ওকে একা সামলাতে পারবে না। তাই ও তন্ময় রাতুল ওদেরও ডেকে নিলো ওখানে। ফাইয়াজও বাইক বের করে তিনজনে বাইকে করে কিছু সময়ের মাঝেই তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছে যায়। আহিয়ান ততক্ষণে রিদমানের শার্টের কলার ধরে রাস্তায় বের করে এনেছে। সন্ধ্যা বিধায় এখন এখানে প্রচুর মানুষ জনের আনাগোনা। সন্ধ্যার পর এই জায়গাটা বেশ জমজমাট থাকে। সেই কারনে এখানে আজও প্রচুর মানুষের ভীর। সবাই উৎসুক চোখে আহিয়ান আর রিদমানের দিকে তাকিয়ে আছে।

আহিয়ান রিদমানকে বাইরে টেনে এনে ওর গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারে৷ রিদমান ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে৷ তন্ময় আর রাতুল এসে আহিয়ানকে টেনে ওর থেকে দূরে নিয়ে গেলো। আহিয়ান ঝাড়া মেরে ওদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবারো রিদমানের কাছে গিয়ে ওর শার্টের কলার ধরে বলে,

–“কু___বাচ্চা তোর সাহস হলো কি করে ওকে স্পর্শ করার? তোকে এর আগেও বেশ কয়েকেবার ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম আমি। কিন্তু তুই আমার কথা শুনিস নি। উলটো আজ তুই আমার আনিতাকে স্পর্শ করার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছিস। তোকে তো আমি আজ জানেই মেরে ফেলবো।”

এই বলে আহিয়ান রিদমানের নাক বরাবর একটা পাঞ্চ মারে। রিদমান ছিটকে ক্ষানিকটা দূরে সরে দাঁড়ায়। রিদমান নিজের নাক আঙুল দিয়ে ঘঁষে বলে,

–“ভুল করছিস আহিয়ান। খুব বড় ভুল করছিস। এর ফল তো তোকে ভোগ করতেই হবে। আর যেই আনিতার জন্য আজ তুই জনসম্মুখে আমার গায়ে হাত তুললি না? সেই আনিতার এমন হাল আমি করবো যে আয়নায় নিজের চেহারা দেখতেও হাজার বার ভাববে।”

ফাইয়াজ এবার এগিয়ে গিয়ে রিদমানকে আরো একটা পাঞ্চ মারে। আহিয়ান এগিয়ে গিয়ে রিদমানের শার্ট খামচে ধরে বলে,

–“কি বললি তুই? আর একবার বল। একদম জিন্দা মাটির নিচে পুতে ফেলবো৷”

রিদমান ঝাড়া মেরে আহিয়ানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শার্ট ঝাড়া দিতে দিতে বলে,

–“এখন আর বলবো না। করে দেখাবো।”

এইটুকু বলে আনিতার দিকে এগিয়ে যায় রিদমান। আনিতাকে টাচ করার জন্য হাত বাড়াতেই আহিয়ান রিদমানের হাত ধরে টেনে ওকে রাস্তায় ফেলে দেয়। হাটু গেড়ে রিদমানের পাশে বসে ওর শার্টের কলার ধরে একের পর এক থাপ্পড় দিয়েই যাচ্ছে রিদমানকে। রাতুল আরহান তন্ময় ওরা সকলেই আপ্রান চেষ্টা করছে আহিয়ানকে ছাড়িয়ে আনতে। কিন্তু পেরে উঠছে না। সকলকেই ঝামটা মেরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তন্ময় গিয়ে আনিতাকে বলে,

–“তুমি যাও। তোমার কথা শুনবে আহিয়ান। এমন চলতে থাকলে তো ও রিদমানকে জানে মেরে ফেলবে৷ সরিয়ে আনো ওকে।”

আনিতা এক পা দুপা করে আহিয়ানের দিকে এগিয়ে যায়। আহিয়ানের কাঁধে হাত রাখতেই আহিয়ান পিছু ফিরে তাকায় ওর দিকে। রিদমানকে মারতে মারতেই আহিয়ান বলে,

–“সরে যাও আনি। আমাকে আটকাতে আসবে না বলে দিলাম।”

–“হাত জোর করছি। চলে আসুন প্লিজ। এভাবে মারলে ও মরে যাবে তো।”

–“মরুক। মেরে ফেলতেই তো চাই আমি ওকে। ওর সাহস হলো কি করে তোমার গায়ে হাত দেয়ার? তোমাকে স্পর্শ করার মতো সাহস দেখিয়েছে ও। তোমাকে? ওর কতো বড় বুকের পাঠা আজ আমিও দেখবো।”

–“আমি বলছি। প্লিজ ছাড়ুন ওকে। বাসায় চলুন।”

আনিতা আহিয়ানের হাত ধরে টেনে রিদমানের থেকে ছাড়িয়ে আনলো ওকে। একপ্রকার জোর করেই আহিয়ানকে নিয়ে বাসায় ফিরলো ওরা।

রাত এগারোটা বাজতে চলল। আনিতা আহিয়ানকে খাওয়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আহিয়ান কিছুতেই খেতে চাচ্ছে না। এখনো রেগে আছে প্রচুর। এতো মেরেও কিনা এই ছেলের রাগ কমলো না। আনিতা বহু কষ্টে কয়েক লোকমা খাবার খাইয়ে দিলো আহিয়ানকে। তারপর ডাইনিংয়ে বসে নিজেও সবার সাথে খেয়ে নিলো। আরহান আর রাতুল চলে গিয়েছে বেশ কিছুটা সময় হলো। আহিয়ান আর তন্ময় এখনো আনিতাদের বাসাতেই আছে। আহিয়ান কিছুতেই বাসায় যেতে রাজি হচ্ছে না। ফাইয়াজ আহিয়ানকে আস্বস্ত করে বলে,

–“আর সমস্যা হবে না আহিয়ান। আমি আর শুভ তো এখন বাসায় আছি। আর রিদমান যদি এরপরেও কোনো ঝামেলা করে তাহলে তোকে আমি ফোন করে জানিয়ে দিবো। তোর বাসা তো এখানেই। তখন না হয় চলে আসবি।”

অনেক বোঝানোর পর আহিয়ান বাসায় যেতে রাজি হয়। বাসায় যাওয়ার আগে আহিয়ান বেশ ক্ষানিকটা সময় সবার সামনেই আনিতাকে জড়য়ে ধরে রাখে। তারপর আলতো করে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে যায় বাসা থেকে। আহিয়ানের পিছু পিছু তন্ময়ও চলে যায়। আনিতা আর রোদেলাও নিজেদের রুমে চলে যায়। আনিতা আগেই গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। রোদেলা লাইট অফ করে আনিতার পাশে শুতেই আনিতা রোদেলাকে জাপ্টে ধরে ঘুমায়।

সকাল আটটা নাগাদ আনিতার ঘুম ভাঙে। ও পাশে রোদেলাকে দেখতে পেলো না। বিছানা ছেড়ে ওঠে অলস ভঙ্গিতে ওয়াশরুমে চলে গেলো আনিতা। বেশ ক্ষানিকটা বাদে ফ্রেশ হয়ে বের হলো ও। টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আনিতা আয়েশ করে সোফায় গিয়ে বসলো। রোদেলা তখন গ্যাসে কফির পানি বসিয়েছে৷ ফাইয়াজ বাজারে গিয়েছে সকালের নাস্তা আনতে৷ আর শুভ কুম্ভকর্ণের মতো এখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।

মিনিট পাঁচেক বাদেই ফাইয়াজ নাস্তা নিয়ে বাসায় ফিরলো। আনিতা নাস্তা নিয়ে প্লেটে রেখে একে একে টেবিলে খাবার সাজালো। ফাইয়াজ চেয়ার টেনে বসলো৷ আনিতাও পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। রোদেলা তিনমগে কফি করে এনে টেবিলে রাখলো। তিনজনে মিলে একসাথে খাবার শেষ করে সোফায় গিয়ে বসলো। ফাইয়াজ নিজের রুমে গিয়েছে। অফিস যাওয়ার জন্য একটু বাদেই রেডি হবে। আনিতা আর রোদেলা আজ ভার্সিটি যাবে না। আনিতার ফোন বেজে উঠতেই ও ফোন হাতে নিয়ে দেখে জেরিনের ফোন। আনিতা ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই জেরিন বলে,

–“এফবিতে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে দেখেছিস?”

–“কিসের ভিডিও?”

–“জানিস না তুই?”

–“নাহ তো।”

–“রাস্তার মাঝে একটা ছেলেকে ফেলে আহিয়ান ভাইয়া মারছে। তোকেও দেখা গিয়েছে সেখানে। ছেলেটা তোর সাথে নাকি উল্টাপাল্টা কিছু করেছে।”

–“মা্ মানে? কি বলছিস এসব তুই?”

–“আমি তোকে ভিডিও এর লিংক পাঠাচ্ছি তুই দেখে নে।”

–“আচ্ছা দে তো।”

জেরিন ফোন কেটে দিয়ে এফবিতে একটা ভিডিও এর লিংক সেন্ড করলো আনিতাকে। আনিতা লিংকে ক্লিক করতেই একটা ভিডিও এলো। খুবই পুপুলার একটা পাবলিক গ্রুপে ভিডিওটা পোস্ট হয়েছে। কালকের ঘটনার পুরো দেড় মিনিটের একটা ভিডিও কেউ এফবিতে আপলোড করেছে। কাল যা ঘটেছিলো তার সাথে ক্যাপশনে আরো রংচঙ মেখে ঘটনাটাকে আরো বাজে ভাবে সবার সামনে উপস্থান করা হয়েছে। ভিডিও দেখে কেঁদে ফেললো আনিতা৷ তেরো ঘন্টায় ভিডিওটাতে প্রচুর ভিউস কমেন্টস শেয়ার এসেছে। এক কথায় ভাইরাল ভিডিও। পুরো দেশ দেখেছে এই ভিডিও। আনিতার এবার ভয় হতে শুরু করলো। ওর বাসার কেউ দেখেনি তো এটা? তাহলে তো ওকে জানে মেরে ফেলবে। রোদেলা ফাইয়াজকে ডেকে ভিডিওটা দেখালো। ফাইয়াজও ঘাবরে গিয়েছে। ফাইয়াজ ভাবছে এটা যদি ওর ছোট মামা দেখে তাহলে আর রক্ষা থাকবে না। হুট করেই কলিংবেল বেজে উঠলো। বাসা থেকে কেউ আসেনি তো? ভয়ে আনিতার হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। রোদেলা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। আহিয়ান এসেছে। ফাইয়াজ আহিয়ানকে ভিডিওটা দেখালো। মূহুর্তেই আহিয়ানের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। জনগন তো এমনিতেই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে তিল থেকে তাল বানায়। আর এখানে কাল রাতে জনসম্মুখে একটা ছেলে আর একটা ছেলেকে রাস্তায় ফেলে ইচ্ছে মতো পিটিয়েছে। রক্তাক্ত করেছে তাও আবার তার গার্লফ্রেন্ডকে স্পর্শ করেছিলো বলে। পাবলিক তো এটাকে আরো রংচঙ মাখাবেই। আনিতা সোফায় বসে কেঁদে যাচ্ছে। মিনিট দশেক বাদে আবারো কলিংবেল বেজে উঠলো। এবারেও রোদেলা দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে আনিতার ছোট চাচ্চু দাঁড়িয়ে আছে। আনিতা এবার ভয়ে সিটিয়ে গেলো। ফাইয়াজও শুকনো ঢোক গিলে। আনিতার ছোট চাচ্চু একপলক আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে আনিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শান্ত গলায় আনিতাকে বলে,

–“ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নাও এক্ষুনি।”

–“কে্ কেন চাচ্চু?”

–“আমার সাথে বাসায় ফিরবে আজ আর এক্ষুনি।”

–“ছয়দিন পর আমার ফার্স্ট সেমিস্টার এক্সাম।”

–“অনেক পড়াশুনা করেছো এতোদিনে। আর দরকার নেই।”

ফাইয়াজ এগিয়ে এসে ওর ছোট মামার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

–“কিন্তু মামা এভাবে হঠাৎ করে?”

–“কাল এখানে যা ঘটেছে তারপরও আমি ওকে এখানে রাখবো ভেবেছিস?”

–“এখানে তো ওর কোনো দোষ ছিলো না।”

–“কার দোষ ছিলো আর কার ছিলো না এসব আমি জানতে চাচ্ছি না। ও আমার সাথে বাসায় যাবে ব্যাস।”

আহিয়ান এতক্ষন নিরব দর্শকের মতো সবটা দেখছিলো। কিন্তু আর বসে থাকতে পারলো না। আহিয়ান গুটি গুটি পায়ে আনিতার চাচ্চুর সামনে এসে দাঁড়ালো। আহিয়ান মাথা নিচু করেই বলে,

–“মামা ভুল বুঝছেন আপনি।”

–“তোমার থেকে অন্তত কিছু শুনতে চাইছি না আমি। আর কাল ওই ভিডিওটাতে তুমিই তো ছিলে। তুমিই তো মারছিলে ওই ছেলেকে আনিতার গায়ে হাত দেওয়ার জন্য। কালকের ঘটনার পর সবার আর জানা বাকি আছে তোমাদের দুজনের মধ্যে কি সম্পর্ক আছে? সমাজে কারো সামনে মুখ দেখাতে পারবো আমরা?”

–“ভিডিও তে আসলে যা দেখানো হয়েছে তার পুরোটা সত্যি না।”

আনিতার চাচ্চু আহিয়ানের কথা আমলে নিলেন না। আনিতার সামনে দাঁড়িয়ে ধমকে সুরে বললেন,

–“তোকে ব্যাগ গুছাতে বললাম না আমি?”

আনিতা মাথা নিচু করে রুমে চলে গেলো। ওর পিছু পিছু রোদেলাও গেলো। আনিতা ব্যাগ গুছিয়ে বিছানায় বসে কাঁদছে। রোদেলা গিয়ে ওর পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই আনিতা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো৷ আনিতার চাচ্চু বাইরে থেকে বার বার আনিতাকে ডাকছে। আনিতা চোখের পানি মুছে ব্যাগ হাতে রুম থেকে বের হয়ে এলো। আনিতা বের হতেই আনিতার চাচ্চুর ওর হাত থেকে ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে নিলো। ফাইয়াজ আহিয়ান ওরা অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু আনিতার চাচ্চু বুঝতে নারাজ। আনিতার হাত ধরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। পিছন পিছন আহিয়ান ওরা সকলেও নিচে নেমে এলো। সেকেন্ড ফ্লোরের সিড়িতে নামতেই আনিতা দাঁড়িয়ে পড়লো। আনিতার চাচ্চু আনিতার দিকে তাকাতেই আনিতা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নিচু করে বলে,

–“আহিয়ানকে আমি ভা্ ভালোবাসি চাচ্চু। প্ প্লিজ আ্ আমাদের আলাদা করে দি্ দিও না।”

কথাটা বলতে দেরী হলেও আনিতার গালে থাপ্পড় পড়তে দেরী হলো না। কথাটা শুনার সাথে সাথেই আনিতার চাচ্চু সজোরে আনিতার গালে থাপ্পড় মারলো। বিস্ময়ে আনিতা গালে হাত দিয়ে ওর চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইলো ক্ষানিকটা সময়। এই প্রথম আনিতার গায়ে ওর পরিবারের কেউ হাত তুলল। ওর ছোট চাচ্চু ওকে মেরেছে আজ। এটা যেন আনিতা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আহিয়ান চোখ বন্ধ করে আনিতাকে দেওয়া থাপ্পড়টা হজম করে নিলো। আহিয়ানের মনে হচ্ছে থাপ্পড়টা আনিতার গালে না ওর গালে পড়েছে। আনিতার চাচ্চু আর কথা না বাড়িয়ে আনিতার হাত ধরে টানতে টানতে ওকে নিচে নিয়ে গাড়িতে বসালো। আনিতার চাচ্চু গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। আনিতাদের গাড়িটা চোখের আড়াল হওয়ার আগ অব্দি আহিয়ান গাড়ির দিকেই তাকিয়েছিলো অশ্রুসিক্ত নয়নে। আনিতাদের গাড়ি আড়াল হতেই আহিয়ান চোখের কোনের পানিটুকু মুছে নিলো।

যতটা সময় সামনের লুকিং গ্লাসে আহিয়ানকে দেখা যাচ্ছিলো আনিতা ততটা সময়ই আহিয়ানকে দেখেছে। আহিয়ান চোখের আড়াল হয়ে যেতেই আনিতা কিছুটা শব্দ করেই কেঁদে ফেললো। নিজের মনেই আনিতা বলে,

–“তবে কি আপনাকে আমার আর পাওয়া হবে না? আজই কি আমাদের শেষ দেখা আহিয়ান? কিভাবে থাকবো আমি আপনাকে ছাড়া? আপনাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবলেও যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। ধীরে ধীরে যে আপনার থেকে অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছি আমি। আমাদের এই দূরত্ব কি কোনোদিনও কমবে আহিয়ান? আমি কি তবে সত্যিই আপনাকে হারিয়ে ফেললাম? এই জীবনে কি আমার আর আপনাকে পাওয়া হবে না আহিয়ান?”



চলবে।

[ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। আর গল্পটা কেমন হচ্ছে অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং🥰 ]