প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
শেষ পর্ব.
ভয়ংকর মুহুর্ত। ভয়ংকর তার কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, তীব্র প্রণয়। বাতাসের গতি ক্ষীণ বাড়ানো। নাম না জানা বিশাল বড় গাছটার মগডালে এক’যুগল পাখি বসে আছে। কপোত-কপোতীর বেসামাল, সিক্ত অনুভূতির বিক্ষিপ্ত স্পর্শ দেখে তারাও যেন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। লহু লহু কাঁপছে বেলা। চোখের কোণে অশ্রুকণা চিকচিক করছে। বুক ভারী, চরম সুখময় মুহুর্তে জড়োসড়ো হচ্ছে মন। মানুষটার বুক খামচে ধরেছে সে। ধারালো নখ বিঁধিয়ে দিচ্ছে বাজেভাবে। চোখ বুজে রাখা। স্পর্শের গতি দ্বিগুণ প্রগাঢ় করে আদ্র সরে এলো তার একটুক্ষণ পরেই। বেলার থুতনি চেপে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো লাজুক মুখটা। মুগ্ধ হয়ে দেখলো নিমেষহীন, একমনে, অনেক্ষণ। লজ্জায় আড়ষ্ট বেলা তাকালো না। চোখের পাতা কাঁপিয়ে বন্ধ করেই রাখলো। আদ্র হাসলো। দূর্বোধ্য হাসি। ওষ্ঠের নিম্নাংশ দাঁত দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করে মোলায়েম স্বরে শুধালো,
—“তাকাবে না বেলা?”
বেলার উত্তর নেই। ঘন শ্বাসকার্যে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে মাত্র। আদ্র আরেকটু ঘনিষ্ট হলো। আগের মতোই বললো,
—“তাকাচ্ছো না কেন? এদিকে তাকাও। আমার দিকে। দেখো তো, ধূলোবালিতে গোসল করা আমাকে কেমন লাগছে।”
বেলা আড়নজরে তাকায়। সরাসরি তাকানোর সাহস নেই। লোকটার মলিন মুখশ্রীও যেন জ্বলজ্বল করে অসীম সৌন্দর্যের জানান দিচ্ছে। চোখে অদৃশ্য তৃষ্ণা। অধরে লেগে আছে দুর্দান্ত ক্লান্তিমাখা হাসি। স্থির দৃষ্টি বেলাতেই আটক।
পলক এত কম ফেলছে কেন লোকটা? তাকে আজকে প্রথম দেখছে নাকি? নেত্রের খুব গভীরে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা সুস্পষ্ট হতেই মাথা নোয়ালো বেলা। ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো। মনে মনে ভীষণ জোরে স্বীকারোক্তি দিলো,
—“আপনি বড্ড বেসামাল আদ্র। প্রচন্ড অসভ্য প্রেমিক। পাষাণ নেতাদের এতটা বেহায়া হতে নেই। আপনিও হবেন না।”
তবে অকপটে সে গলা নামিয়ে ধীরে ধীরে বললো, “ফ্রেশ হবেন না? ক্লান্ত লাগছে আপনাকে। হাতে ব্যান্ডেজও করতে দিচ্ছেন না।”
আদ্র অদ্ভুদ ভাবে হাসলো তখন, “কিছু ক্ষত প্রশান্তি দেয় বেলা। জয়ের তৃপ্তি আনে। থাক না। ব্যান্ডেজ করতে ইচ্ছে করছে না।”
বেলা বুঝলো না কিছুই। অবুজ চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই কপাল কুঁচকে সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি মারপিট করে এসেছেন আদ্র?”
—“মারপিটে কেউ কামড় দেয় বেলা?”
কপালের ভাঁজ মিইয়ে গেল। নিজের বোকামিতে ক্ষীণ থতমত খেলো বেলা। মিনমিনে কণ্ঠে জানতে চাইলো, “তাহলে কিভাবে হ–?”
কথা শেষ হলো না। তাকে থামিয়ে দিয়ে আচমকা নিশ্বাস ভার করা কণ্ঠে বলে উঠলো আদ্র,
—“আমার দু’দিনের জন্য ঢাকা যেতে হবে বেলা।”
যেন একটু একটু করে বিরাট বজ্রপাত ঘটলো। আলোর ঝলকানিতে রুষ্ট হলো সব। তক্ষুণি মাথা উঁচিয়ে তাকালো সে। মুখ তুললো কাতর ভাবে। কি ভীষণ করুণ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“সত্যি চলে যাবেন?”
আদ্রর অভ্যন্তরে পাথরেরা ঘর বেঁধেছে। নাক, মুখ কে যেন শক্ত করে চেপে ধরেছে। নিশ্বাস নিতে দিচ্ছে না। দমবন্ধকর বিশ্রী অনুভূতি।
—“তাড়াতাড়ি চলে আসবো তো। তোমার প্রিয় ফুল নিয়ে আসবো। ওইযে, রাস্তার মোড় থেকে যেটা সবসময় কিনতে তুমি?” আশ্বস্ত করার অল্প সল্প প্রচেষ্টা।
বেলার ভেতরটা গললো না তবুও। শুনলো না কিছুই। ম্লান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—“কখন যাবেন?”
—“পরশু।”
বুক ছিঁড়ে নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। পীড়াদায়ক নিশ্বাস! মনের অবনতি ঘটলো আরও। প্রশস্ত বক্ষের মধ্যিখানে আনমনে মাথা রেখে নিজের খারাপ লাগা প্রকাশ করলো অত্যন্ত সুকৌশলে। আদ্র বুঝে নিলো সেকেন্ডেই। আগলে ধরলো নিবিড়তা নিয়ে। নিভৃতে। প্রেয়সীর জলে টলমল মুখশ্রী পানে অনড় চেয়ে থেকে অভিযোগ জানালো,
—“চোখটাকে বারবার সমুদ্র করে ফেলো কেন বেলা? আমি যে প্রতিবার ডুবে যাই।”
–
সোফার অবিন্যস্তভাবে হাত,পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে আয়াজ। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ফোনে সর্বোচ্চ লাউডে বাজছে,
‘আমার সবটুকু বিশ্বাস
যে দিয়েছে ভেঙ্গে
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই
সে যে দিয়েছে আমার
অন্ধ চোখে আলো, যার বিশালতার মাঝে আমি একটুকু পায়নি ঠায়।’
টেবিলে ছড়িয়ে থাকা আধ খাওয়া কোকাকোলার বোতল, চিপস নিতে নিতে রেখা খুব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আয়াজের পানে। রোষপূর্ণ চাহনিতে তাকিয়েই রইলেন কিছুক্ষণ। জোরেসোরে ধমক লাগালেন,
—“সমস্যা কি আয়াজ? সাত-সকালে কি শুরু করেছিস? তোরা কি আমাকে একটুও শান্তি দিবি না? ড্রইংরুমের এটা কেমন হাল! এখন যদি কোনো মেহমান এসে এমন অবস্থা দেখে? কি ভাববে বলতো?”
আয়াজ আগের মতোই ভাবলেশহীন। হতাশায় মুখ একটুখানি হয়ে আছে। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে অনেকটা রয়ে-সয়ে ভণিতার রেশ ধরে বললো,
—“তোমার ছেলে ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে গেছে মা। ভাবছি সন্ন্যাসী সেজে প্রণয়ে ব্যর্থ বিরহের গান লিখবো। তুমি হবে সাইড নায়িকা।”
রেখা তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি প্রখর করলেন। একরাশ রাগের ফুল্কি নিয়ে, নিমিষেই ভস্ম করে দেওয়ার অত্যাধিক ক্ষমতার সঙ্গে। দ্বিগুণ জোরে চেঁচালেন, “বেয়াদপ! ঘর থেকে বের হবি এক্ষণি। তার আগে ময়লা সব পরিষ্কার করবি। ফাজিল! এসব কি ধরণের কথা? তোর মা লাগি সেটা ভুলে গেছিস?”
আয়াজের মাঝে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষিত হলো না। গান শুনতে শুনতে ঝিমিয়ে উঠলো সে। উত্তরে কিছুই বললো না। রেখা কটমটে চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে চলে গেলেন রান্নাঘরে। তার ছেলে দুটো বখে গেছে সব। কিসব আজেবাজে কথাবার্তা।
গায়ে পরিপাটি কালো রঙা পাঞ্চাবী জড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল আদ্র। তার একটু পেছনেই গুটিশুটি, ভীষণ ধীর পায়ে এগিয়ে আসছিল বেলা। মুখশ্রী ভরে আছে অত্যাধিক লাজের গাঢ় আবরণে। সোফায় আয়াজের মুখোমুখি বসলো আদ্র। গানের চরণ কানে বাজতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। প্রশ্ন করলো,
—“এসব কি গান? চৈতির সঙ্গে ত্যাড়াব্যাকা কিছু হয়েছে নাকি? দেবদাস সেজেছিস কেন?”
আয়াজ কপাল থেকে হাত নামালো। একপলক তাকালো মাত্র। আফসোস নিয়ে বললো,
—“ছ্যাঁকা খেয়েছি ভাই।”
আদ্রর অবাক কণ্ঠ, “মানে?”
—“তুই আমাকে ছ্যাঁকা দিয়েছিস ভাই। মারাত্বক কষ্ট দিয়েছিস। আমাকে রেখে আগে আগে বিয়ে করার আগে তোর কি একটুও বুক কাঁপেনি? এত নির্দয় তুই?”
আদ্রর কপালের বলিরেখা তখন আকাশ ছোঁয়া। চোখ,মুখ কুঁচকে বললো,
—“বিয়ের মাস পেরবে। এতদিনে তোর কাঁপাকাঁপির কথা মনে হলো?”
—“মনে তো আগেই হয়েছে। কালকে আরেকটু গভীর ভাবে ভাবলাম। তুই যে ভাবীর সাথে আমার চক্ষের সামনে দিনরাত প্রেম করিস, কেন করিস? আমি যে বিয়ে পাগল জানিস না? আমার যে তোর মতো বিয়ে করে বাচ্চার প্লেনিং করতে ইচ্ছে করে বুঝিস না?”
—“তুই কি পাগল? আমি এখনই এসবের প্লেন করবো কেন?” কণ্ঠস্বরে আশ্চর্যের ধারা চুইয়ে চুইয়ে পরলো যেন। আয়াজ বেজায় বিরক্ত হয়ে মুখটা বিকৃত করে বললো, “এখনো করিস নি? কেন করিস নি? এত অলস কেন তুই? ওগো শুনছো ডাকটা না শুনতে পারি, চাচ্চু ডাকটা তো অনতত শুনাবি!”
বেলা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না সেখানে। চোখ বড় বড় করে দুই ভাইকে দেখলো একবার। দ্রুততর পায়ে রান্নাঘরে চলে গেল। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কাজ করতে করতে আবারও আয়াজের কথাগুলো কানে বাজতেই হড়বড়িয়ে গেল সে। লজ্জায় রাঙা হলো ফর্সা গাল। রেখা পাশ থেকে ডাকছেন। অথচ অস্বস্তিতে জবাবও দিতে পারছে না বেলা। তার যে এত কোথা থেকে আসে!
–
কাঠফাঁটা রোদ। খা খা করছে আশপাশ। ধূ ধূ মাঠ। সূর্যের সরাসরি বেগুনী রঙা ক্ষতিকর কিরণ। আদ্রর যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। মুখে নিস্তব্ধতা নিয়ে তার ব্যাগ গোছাচ্ছে বেলা। তিনটা ভিন্ন ভিন্ন রঙের ফাইল ব্যাগের একপাশে গুঁজে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—“আর কিছু ঢোকাবেন ব্যাগে?”
—“হ্যাঁ।”
আলমারির কাছটায় পা বাড়ালো বেলা। দু’পাশের দরজা লাগিয়ে জানতে চাইলো, “কি ঢোকাবেন?”
—“তোমাকে।”
জড়তাহীন, নিঃসঙ্কোচ আবদার। বেলা হকচকিয়ে তাকায়। একান্ত গাঢ় কণ্ঠের ভাঁজে সিক্ত হয়। আদ্র খুব কাছাকাছি চলে এসেছে ততক্ষণে। আলতো করে বেলার কোমড় জড়িয়ে বুকে চেপে ধরেছে। কপালে অধরের সূক্ষ্ণ স্পর্শ দিয়ে মুচকি হেসে বলে,
—“কাল সকাল সকাল চলে যাবো বেলা। তুমি এখন থেকেই কান্নার প্রেকটিসটা করে নাও। সকালে যদি আমি দেখার সময় না পাই?”
কথার পিঠে ভীষণ হতভম্ব হলো বেলা। চমকে পলক ঝাপটালো। খুব দৃঢ় অভিমান আষ্টেপৃষ্টে ধরলো। এতক্ষণ বহুকষ্টে আটকে রাখা অশ্রুগুলো বাঁধন হারা হলো। বুকে শক্তিহীন ধাক্কা দিয়ে সরে আসতে চাইলো সে। আদ্র দিলো না। শার্টের একাংশ নিমিষেই ভিঁজিয়ে বেলা ভাঙ্গা কণ্ঠে বিড়বিড় করলো, “আপনি এত খারাপ কেন? ভীষণ বাজে।”
প্রতিউত্তরে আদ্র শব্দ করে হেসে দিলো এবার। প্রাণ খুলে, বেশক্ষণ নিয়ে। নিকষকৃষ্ণ চুলের ওপর অধর ছুঁইয়ে উত্তর দিলো,
—“আমি তো তোমার কান্না দেখার জন্যই বিয়ে করেছিলাম বেলা। ভুলে গেছ?”
বেলা শুনলো। অভিমানে ভাড় হয়ে জবাব দিলো না। আদ্রর বুকের সঙ্গে লেপ্টে ফুঁফালো কিছুক্ষণ। বুকের শার্ট আঁকড়ে ধরলো। নিদারুণ অসহ্য কণ্ঠে থেকে থেকে বললো, “আপনি কেন চলে যাবেন? আমি কিভাবে থাকবো?”
বেদনায় ডুবে যাওয়া মুহুর্ত। রুমের এসি বন্ধ। ভনভন শব্দে বৈদ্যুতিক পাখা চলছে অবিরাম। অনিলের ঝাপটায় চুল এলোমেলো হচ্ছে। শুকনো গলায় ঢোক গিললো আদ্র। হাত বারিয়ে বেলার এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। বেলা ঘুমিয়ে গেছে। গালে কান্নার অবশিষ্ট জল দাগ হয়ে এঁটে আছে। আদ্র বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মোছার চেষ্টা করলো। গেল না। ব্যর্থ নিশ্বাস ফেলে বেলাকে কোলে তুলে নিলো। সোফা ছেড়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো খুব সাবধানে, ভীষণ যতনে। নিজে শুয়ে পরলো তার ঠিক পাশে। তাকিয়ে রইলো নিশ্চুপভাবে। মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। তেঁতো তেঁতো লাগছে সব। তিক্ত অনুভূতিতে বক্ষস্থল চিনচিন করছে। সময়টা এত দ্রুত এগোচ্ছে। কেন এগোচ্ছে? একটু ধীর ভাবে চলা যায় না?
–
জাতীয় সংসদ ভবন। আদ্রর বাবার চিরস্বপ্নের জায়গা। বাবার সবসময়কার বসার স্থানটা! আদ্র ফোনে দেখেছিলো একবার। এখানে দাঁড়িয়েই তো নিজের বক্তব্য দিতেন তিনি। আজ আদ্র বসেছে সেখানে। স্পর্শ করছে। যেন, যেন বাবাকে ধরেছে। বুক কাঁপলো। কেমন করে যেন নিশ্বাস ফেললো সে। সময়টা ছিল বর্ণাতীত। মাননীয় স্পিকার বসে ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো কিছু বলার জন্য। আদ্র নিজেকে সামলালো। বাবার মতোই মুখটা কঠিন করে একের পর এক হৃদয় কাঁপানো বক্তব্যের প্রস্তুতি নিলো নিপুণতার সঙ্গে।
–
সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে আদ্র সোজা গাড়িতে গিয়ে বসলো। মুজিব কোর্ট খুলে পাঞ্চাবীর প্রথম কয়েকটা বোতাম খুলে রাখলো। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। ক্লান্ত কণ্ঠস্বরে বললো, “গাড়ি সোজা কুমিল্লায় নাও আকিব। এখানে আর একটা দিনও থাকা সম্ভব না।”
আকিব গাড়ি চালু করলো না। চুপসানো ভঙ্গিতে বসে আছে ড্রাইভিং সীটে। এসির মাঝেও প্রচন্ড ঘামছে শরীর। কাঁপছে। আদ্র কপাল কুঁচকালো। বিরক্ত কণ্ঠে আবার বললো,
—“কি সমস্যা আকিব? গাড়ি ছাড়ছো না কেন?”
ওপাশ থেকে কোনোরুপ উত্তর নেই। আদ্র নেত্রজোড়া উন্মুক্ত করলো। আকিবকে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে আকিব? কাঁপছো কেন?”
—“ভাই– আসলে– ভাবী– আমি–”
এটুকু কথা বলতেই মিনিটখানেক লাগিয়ে দিয়েছে আকিব। আদ্রর বিরক্তির মাত্রা বাড়লো। গম্ভীর গলায় বললো,
—“ঠিক ভাবে কথা বলো আকিব।”
—“আসলে, ভাবী– ভাবীর ফোন থেকে কল এসেছিলো। উনি, উনার–।”
আদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো। শান্ত চোখে তাকালো,
—“এভাবে কথা বলছো কেন আকিব? ভালো ভাবে, একেবারে কথা বলো।”
—“ভাই, ভাবীর মুখে কে যেন এসিড ছুঁড়ে মারছে। অবস্থা ভালো না।”
একদমে, চোখ,মুখ খিঁচে বলে উঠলো আকিব। আদ্র স্তদ্ধ হলো। থমকালো দৃষ্টির চঞ্চলতা। বুকে ছুঁড়ির আঘাত স্পষ্ট অনুভূত হলো কি দারুণ ভাবে! আদ্র বিশ্বাস করে নিলো। বেলাকে নিয়ে অনতত মিথ্যা বলবে না আকিব। এমন মজা তো নয়ই।
কণ্ঠ নড়বড়ে হওয়ার আগেই অস্বাভাবিক শীতল গলায় বললো,
—“কে করেছে কাজটা?”
আকিব ভীতু আঁখিজোড়া মেলে ধরলো,
—“জানি না ভাই। আয়াজ ভাই একটু আগে কল করেছিলেন। তিনি নাকি তখন ভাবীকে নিতে এসেছিলেন ভার্সিটিতে। রাস্তায়– আসার সময় বাইকে করে দুজন ছেলে এসিড ছুঁড়ে মারে। ভাবীর চে-হা–রার একপাশ জ্বলে গেছে। আয়াজ ভাইয়ের হাতেও–।”
কথা শেষ হলো না। আদ্র আবারও বললো,
—“কখন হয়েছে এসব? আমাকে জানানো হয়নি কেন?”
—“আপনি সংসদে ছিলেন। আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।”
সঙ্গে সঙ্গে প্রলংকারী হুঙ্কার ছাঁড়লো আদ্র। বজ্রকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো, “আমি বিরক্ত হবো? এত বিশ্রী ভাবনা কেন তোমার? গাড়ি চালাও। এক্ষুণি! বসে থাকতে রেখেছি তোমাকে?”
গাড়ি চলতে শুরু করলো পরমুহুর্তেই।
–
কেবিনে জানালা আছে। অথচ বন্ধ করে রেখেছে কেউ। কৃত্রিম বৈদ্যুতিক বাতি সারাক্ষণ জ্বলে থাকে। মাথার ওপর ফ্যান চলছে ঠিকই, কিন্তু নিজের শীতল স্পর্শে কারো হৃদয় ছুঁতে পারছে না। দোলা দিয়ে উঠছে না মন। বিষাক্ত হয়ে আছে। হাসপাতালে পৌঁছাতে বেশি সময় নিলো না আদ্র। কেবিনের সামনে সারি করে দাঁড়িয়ে আছেন সবাই। আয়াজকে এককোণে দেখা যাচ্ছে। বাহুর অংশ ব্যান্ডেজ করা। তাকে জড়িয়ে ধরে অবিশ্রান্ত কাঁদছেন রেখা। আদ্রকে দেখতে পেয়ে ছুঁটে এলেন। আচমকা চড় মেরে দিলেন ডান গালে। আদ্র হতবাক, বিমূঢ়। চোয়াল শক্ত। রেখা কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠলেন,
—“তোকে বলেছিলাম না মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে? কেন নষ্ট করলি মেয়েটার জীবন? কি ক্ষতি করেছিল ও তোর? খুশি লাগছে না এখন? যা চেয়েছিস, তা তো পেয়েই গেছিস। এখন আবার কেন এসেছিস এখানে? চলে যা। বেলার সঙ্গে দেখা করতে দিবো না আমি।”
জবাবহীন আদ্র। কঠিন, রুষ্ট নেত্রে চেয়ে আছে মাত্র।
সায়েদ সাহেব ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। কাতর স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন, “আমার মেয়েটার সাথে এসব কি হয়ে গেল বাবা? তুমি তো বলেছিলে ওর কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। তাহলে? এভাবে কথা ভেঙ্গে দিলে কেন? নাকি আমারই ভুল ছিল।”
কণ্ঠের রেশ বাড়ছে। কান্নার অশেষ শব্দ বিরক্ত করছে অন্যান্যদের। একজন নার্স সরঞ্জাম হাতে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন। যাওয়ার আগে একবার বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
—“প্লিজ আওয়াজ কম করুন আপনারা। এটা হস্পিটাল। অন্যদের সমস্যা হচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করুন।”
আয়াজ সামলে বললো, “বুঝতে পেরেছি। আর আওয়াজ হবে না।”
তারপর আবার আদ্রর দিকে চেয়ে বললো, “ভাবীর এখনো জ্ঞান ফেরেনি ভাইয়া। অপারেশন হয়েছে মাত্র। তুই কি দেখা করতে যাবি?”
আদ্র নিশ্চুপ। এক এক করে সবার দিকে তাকালো। সবার চোখেই তার জন্য রাগ, অসন্তুষ্টি ভাব। ক্ষীণ দূরে প্রভা বেগমকে দেখা যাচ্ছে। দরজার গোল কাঁচটার দিকে দৃষ্টি রেখে ফুঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে কাঁদছেন তিনি। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন। ছোট্ট বিহান মাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আদ্র আর পাদুটো সামনে আগাতে চাইলো না। বেলাকে ওভাবে দেখার সাহস নিমিষেই হারিয়ে ফেললো। সে দূর্বল হয়ে পরবে নাহয়। থমথমে গলায় আকিবকে বললো,
—“গাড়ি বের করো আকিব।”
আয়াজ বিস্মিত হলো, “ভাই? বেলার কাছে যাবি না?”
আদ্র গটগট পায়ে চলে যেতে লাগলো। পিছু ফিরে তাকালো না। চোখটা জ্বলছে। লাল হয়ে গেছে শিরাগুলো। অসহায় লাগছে। বিশ্রী রকমের অসহায়।
–
জ্ঞান ফিরে আদ্রকে সর্বত্র খুঁজেছিল বেলা। অথচ সেটা যেন এখন বাবুন হয়ে চাঁদ পাওয়ার মতো ব্যাপার। ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলেও কাঁদতে পারে না বেলা। সারাক্ষণ মৃত্যু যন্ত্রণা হয় গালের চামড়ায়। ছটফট করে সে। দিন বেরিয়ে যায় কত! আদ্র আসে না।
ব্যান্ডেজ খোলার পরও তাকে কেউ আয়না দেখতে দেয় না। বাম চোখ ঝাপসা ঝাপসা লাগে। চোখ সহ একপাশ জ্বলে গেছে তো! বেলা বুঝে। সে আর আগের মতো সুন্দর নেই। তাকে দেখে যে কেউ ভয় পাবে। তার যখন জ্ঞান ছিলো না, আদ্র কি দেখতে এসেছিলো তাকে? ভয় পেয়ে কি একেবারে ছেড়ে চলে গেছে? বেলার কান্না পায়। কাঁদতে পারে না আগাম যন্ত্রণার কথা ভেবে। কান্না আটকে রাখাও যে কি কষ্টের! আদ্রর তো এই কান্নাই বেশি পছন্দের ছিল। অথচ, সে কাঁদতে পারবে না।
–
মাঠ জুড়ে হইচই ভাব। আদ্র ইয়ানিদ মঞ্চে উঠেছে। রমরমে ভাব সর্বত্রে। সেই গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজটা হঠাৎ বেজে উঠলো কানে,
—“আমি আদ্র ইয়ানিদ। কুমিল্লা জেলার সদ্য হওয়া এমপি।”
হইচই দ্বিগুণ হলো। প্লাস্টিকের চেয়ার ছেড়ে সবাই উঠে দাঁড়ালো। আদ্র প্রখর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখলো সবাইকে। শরীরে কাঁটা দেওয়ার মতো অসাধারণ কণ্ঠে আবারও বলতে শুরু করলো,
—“আমি আদ্র ইয়ানিদ। আমার জন্মস্থান, প্রিয় জেলা কুমিল্লার সদ্য এমপি। আমার বাবাও কিন্তু একজন এমপি ছিলেন। নাম শুনেছেন কখনো? আবদুর ইয়ানিদ। আমার রাজনীতিতে আসার মূল কারণ। কেন বলুন তো? বাবা রাজনীতি করে বলে ছেলের শরীরেও রাজনীতির রক্ত বইছে, ব্যাপারটা অনেকটা তেমন মনে হচ্ছে না? কিন্তু রাজনীতির প্রতি আমার একটুও আগ্রহ নেই। আমি শুধু মাত্র আমার বাবার জন্যে আজ এই প্লেটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার বয়স খুব কম ছিল। নবম শ্রেণিতে পড়তাম। বাবা রাজনীতির জন্য আমাদের ঠিকভাবে সময় দিতেন না। বাসায়ও আসতেন না মাঝে মাঝে। তার প্রাণ ছিল এই পেশা। সময় দিতে না পারার ব্যর্থতাকে আমি আমার বাবার সাফল্য মনে করতাম। খুব ভালোবাসতাম বাবাকে। তিনিও বাসতেন। সময় পেলেই রাজনীতির খুটিনাটি জানাতেন। অথচ এই রাজনীতি তাকে কি দিলো? বিশ্বাসঘাতকতা। অনৈতিক কাজ করতে রাজী না হওয়ায় মেরে ফেললো। আমি তাদের নিচু দেখাতেই রাজনীতিতে এসেছিলাম। দেখিয়েছি। শান্তি পাইনি।
আপনারা হয়তো জানেন না, আমার বিয়ে হয়েছে আরও একমাস আগে। বেলা আহসান মেয়েটার নাম। ওকে আমি খুব ভালোবাসি। জানোয়ারগুলো আমার স্ত্রীকেও ছাড়ে নি। এসিড দিয়ে ঝলসে দিয়েছে ওর সুন্দর মুখটা। সাহসের অভাবে আমি ওর সামনে যাইনি। আমার কারণে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ও। আমি কিভাবে দেখবো? আমার মা কিন্তু ওর সাথে আমার বিয়ে দিতে চায়নি। মা তো! বুঝে গিয়েছিলেন এমন কিছুই ঘটবে।
আমি এমপি আদ্র বলছি, যারা আমাকে ভালোবেসে ফোট দিয়েছেন, তাদের আমি নিরাশ করবো না। এমপি হওয়ার আগে এবং পরে আপনাদের সবাইকে যা যা করে দেওয়ার কথা দিয়েছিলাম, তা সম্পূর্ণ করেই ছাড়বো। পরিশেষে প্রিয় জনগণ এবং দেশকে স্বাক্ষী রেখে ঘোষণা দিচ্ছি, আমি কিছুদিনের মাঝেই আমার পদত্যাগ করবো। রাজনীতি আমার জন্য না। মরিচিকার পেছনে ছুটতে চাইনা আমি।”
আদ্র থামে। মাঠে হইহই ভাব নেই। সবাই অস্বাভাবিক চুপচাপ। আদ্র একবার তাকিয়ে মঞ্চ হতে নেমে পরলো। তৎক্ষণাৎ কি যেন হলো। করতালির আওয়াজ যেন পুরো জেলা কাঁপিয়ে তুললো। ভীষণ ভাবে, অকৃত্রিমতা নিয়ে।
গাড়ি চলছে। আকিব হাঁসফাঁস করছে। জানালার কাঁচগুলো লাগিয়ে দিতে বাটন চাপ দিলো সে। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ভাবীর ওখানটায় নিয়ে যাবো ভাই?”
আদ্রর ছোট্ট উত্তর, “হুম।”
আকিব আবার বললো, “একটা কথা ছিল ভাই।”
আদ্র এবার কিছু বলে না। ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে রয়। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে জড়তা নিয়ে বলে সে,
—“ইখতিয়ারের দেওয়া টাকাগুলো সব ড্রাগ আসক্তদের চিকিৎসার জন্য ওদের পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো কিছু টাকা রয়ে গেছে। ওগুলো কি করবো ভাই?”
—“তোমার না বউয়ের ডেলিভারি কয়েকদিন পর? টাকা আছে সাথে?” গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলো আদ্র। আকিব অপ্রস্তুত হলো। থতমত খেয়ে মাথা চুলকালো। আমতা আমতা স্বরে বললো,
—“আছে কিছু জমানো। হয়ে যাবে ভাই।”
—“কত টাকা জমিয়েছ?”
—“আট হাজার।”
—“অনেক জমিয়েছ। যে টাকা রয়ে গেছে ওগুলো প্রয়োজনে খরচ করবে। বাড়তি কথা শুনতে চাই না।”
–
টিভি চলছে অনর্গল। ইখতিয়ারের পাগল হওয়ার সংবাদ বেশ জমজমাট করে দেখানো হচ্ছে খবরে। ভারসম্যহীন হয়ে রাস্তায় নাকি পরে থাকে এখন। তার দলের প্রায় লোক আদালতে স্বাক্ষীও দিয়েছে ইখতিয়ারের বিরুদ্ধে। ধরা পরেছে অনেকেই। যারা বেলাকে এসিড মেরেছে তারাও। এসি’ড ছোঁড়ার সময় ছেলেগুলোকে একদম সামনে থেকে দেখেছিল বেলা। টিভিতেও সেই বিভীষিকাময় বিভৎস চেহারা দেখাচ্ছে।
হঠাৎ টিভির পর্দায় আদ্রর মুখশ্রী ভেসে উঠলো। কতদিন পর মানুষটাকে দেখল সে! একয়দিনে চেহারা ম্লান হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পরে গেছে। বেলা চশমা খুলে ফেললো। টিভি বন্ধ করে দিলো তৎক্ষণাৎ। লোকটাকে সে দেখবে না। এমন স্বার্থপর লোককে ভালোবাসে না সে। দূরে চলে যাক। আর কখনো যেন সামনে না আসুক। কখনো না।
তার ইচ্ছা পূরণ হলো না মোটেও। খট করে কেবিনের দরজা খুলে গেল। সুঠাম দেহের কে যেন এগিয়ে এলো। বেলা ঝাপসা দেখছে। আবারও হাতড়াতে হাতড়াতে চশমা খুঁজলো সে। পরলো। স্বার্থপর আদ্রকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মন, মস্তিষ্কের বেহায়া কথায় কান দিলো না।
আদ্র আস্তে করে বসলো তার পাশে। ঝলসানো মুখটা চোখে জল জড়ো করে দিলো। ভার ভার লাগলো নিজেকে। সে কি কখনো এতটা অসহায় বোধ করেছিল? বাবা মৃত্যুর সময়ও তো কি কঠিন ভাবে সামলে নিয়েছিল নিজেকে। তবে আজ পারছে না কেন? আদ্র সময় নিলো। গভীর নিশ্বাস নিয়ে ডাকলো,
—“বেলা? দেখো, আমি এসেছি। তাকাবে না?”
বেলা তাকালো না। শক্ত গলায় আওড়ালো, “কেন এসেছেন? কারো দয়া চাই না আমার। চলে যান।”
—“আমি তোমার ওপর দয়া করছি না বেলা। তুমি আমার ওপর একটু দয়া করো। এদিকে তাকাও।”
বেলা শুনলো না। ক্রমশই নিশ্বাস ঘন হচ্ছে তার। কষ্ট হচ্ছে। ভাঙ্গা গলায় সে জোর দিয়ে চেঁচাতে চাইলো,
—“আমি আপনার মুখ দেখতে চাইনা। চলে যান এখান থেকে। এতদিন পর কেন দরদ দেখাতে এসেছেন? নিশ্চই মুক্তি চাওয়ার জন্য। ঠিকাছে, দিয়ে দেব মুক্তি।”
পরিবেশে গুমোট ভাব। নিশ্চল সব। আদ্র নিষ্প্রভ চোখে নির্দয় বেলার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরলো গাঢ় ভাবে। বেলা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোড়াছোড়ি করলো। চেঁচালো। আদ্র শক্ত হয়েই রইলো। যা কিছু হোক, বেলাকে ছাড়বে না সে। একদমই না। দূর্বল বেলা একটু পরই শান্ত হয়ে গেল। প্রাণহীন গলায় অনুরোধ করলো,
—“এমন কেন করছেন আদ্র? চলে যান। আমি নষ্ট হয়ে গেছি। আমি আর আগের মতো সুন্দর নেই। সবাই ভয়ে দূরে দূরে চলে যায়। আয়না দেখায় না। কাঁদতেও পারি না। যন্ত্রণায় কান্না আসতে চায়না। আমি– আমি আর আগের মতো নেই আদ্র। সবার অপ্রিয় হয়ে গেছি। কেউ আর ভালোবাসে না।”
বেলার মাথায় হাত বুলালো আদ্র। শব্দজোট খুলে কণ্ঠকে মোলায়েম করে বললো, “হুশ! শান্ত হও। কে বলেছে তুমি অপ্রিয় হয়ে গেছ? তুমি তো সবসময়ের জন্যই আমার প্রিয় বেলা।”
সিক্ত গলায় প্রতিবাদ করলো বেলা, “মিথ্যে বলছেন আপনি। আপনিও আমাকে ভালোবাসেন না আর। নয়তো আমার মুখ ঝলসে যাওয়ার পরে আর আসেন নি কেন?”
আদ্র তপ্ত নিশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো, “কে বলেছে বেলা? আমি তো রোজই আসতাম। তুমিই ঘুমিয়ে থাকতে।”
বেলার ভালো গাল বেয়ে জল গড়ালো। ঝলসানো চোখটা সময় নিলো খুব। বাজে শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে, নেত্র তরতর করে কাঁপিয়ে একটুখানি জল বের হলো। সেই পানির দিকে চেয়ে রইলো আদ্র। হুট করে ঝুঁকালো মাথা। ঝলসে লাল হওয়া ভয়ংকর চামড়ায় অধর ছোঁয়ালো দৃঢ় ভাবে। ফিসফিস করে বললো,
—“আমি তোমার চেহারাকে ভালোবাসিনি বেলা।”
কান্নার তেজ বাড়লো। করুণ কণ্ঠে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বেলা। আদ্রর থুতনির ওপর কপাল ঠেকালো। আদ্র মুচকি হাসলো। মলিন স্বর শোনা গেল,
—“কাঁদে না বেলা। তোমার না কষ্ট হয়?”
বেলা শুনে না। চরম অবাধ্য হয়ে বেহায়া হয়। নিজ ইচ্ছাতে অধরে অধর মিলিয়ে দেয়। সময় গড়ায়। গড়াতেই থাকে। খেয়াল থাকে না কারোরই। এর চেয়ে সুখময় অনুভূতি কি আর আছে। প্রশান্তি কি আর আছে? আদ্রর তো জানা নেই।
______________
সমাপ্ত~