#বেলির_কথা (১৪)
.
মিতু গিয়ে বেলির কাধে হাত রাখে।
‘ঘরে আয়?’
বেলি খুশি হয়ে বলে,
‘আম্মা এসেছো তুমি?আমি জানতাম তুমি আসবে।’
এই বলে বেলি মিতুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে,
‘তোর আম্মা না তো কি হয়েছে?আম্মার মতো স্নেহ দিতে পারি নাকি?পারি তো,এরকম কেন কাঁদছিস?’
বেলি চোখের জল মুছে মিতুকে ছেড়ে দেয়।
‘ঘরে আয়?’
‘ভাবি?’
‘বল?’
‘সবাই তোমার মতো যদি ভাল হতো?’
মিতু চুপ করে থাকে।বেলিকে ধরে ঘরে নিয়ে যায়।
_______
‘ভাইয়া পেয়ে গেছিইই?’
হাবিবা দৌড়ে ভাইয়ের হাত টান দিয়ে ঘুরা শুরু করে।
হাসনাত বলে,
‘থাম।তুই এমন ভাব করছিস যেন চাঁদ হাতে পেয়েছিস?’
‘চাঁদ এর চেয়ে কম না।’
‘তাই বল।তা কোথাকার মেয়ে?’
হাবিবা সব খুলে বলে।হাসনাত সব শুনে হাসে।
‘তাহলে নিয়ে আসতে হয় আমাদের বাসায়?’
‘তার আগে তোমার পছন্দ হতে হবে না?’
‘আচ্ছা দেখতে যাব।তবে আড়ালে।’
‘ওকে ডান।’
হাসনাত,হাবিবা ভাইবোন।তাদের বাবা মা কেউ বেচে নেই।হাসনাত একজন কলেজ টিচার।শিক্ষকতা তার শখ বলেই এ পেশায় জড়িয়েছে।হাসনাতের বাবা বড় ব্যবসায়ী ছিলেন।আর অত্যন্ত ভাল এবং পরোপকারী মানুষ ছিলেন।হাসনাতের মা ও ছিলেন একজন শান্ত মহিলা।
গাড়ি বাড়ি কিছুর ই অভাব নেই তাদের।তবে তাদের সাধারণ জীবনযাপন দেখে কেউ ই বলবে না তাদের এতকিছু আছে।
হাসনাত চাইলে ব্যবসায় জয়েন করতে পারতো।কিন্তু শিক্ষকতা তার কেন এত ভাল লাগে সে নিজেও জানেনা।
হাবিবা বিবাহিত,হাবিবার হাসবেন্ড একজন শিক্ষক তবে স্কুলের।হাসনাতের পাশাপাশি বাসায় থাকে।
কিছুদিন আগেই হাবিবার বিয়ে হয়ে যায়।এখন হাসনাত একদম একা হয়ে গেছে বলেই হাবিবা ভাবি খুঁজছে।হাবিবা প্রায় দেখেছে ভাইয়া রূপবতীর চেয়ে মায়াবতী আর সাধারণ,সাধাসিধা মেয়েই বেশি পছন্দ করে।রূপবতী আর মায়াবতী শব্দ দুইটির অনেক তফাৎ।তাইতো হাবিবা এমন ভাবি ই খুঁজে বেড়িয়েছে এতদিন।
.
.
সকালে বেলি ভার্সিটি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে মিতু এসে বলে,
‘আজকে না গেলে হয়না?’
‘কেন?’
‘তোর ভাই বলতেছে যে আজ নাকি আবার তোকে দেখতে আসবে।’
বেলি শান্ত হয়ে বলে,
‘মানা করে দাও।আমাকে এমনিতেও কেউ পছন্দ করবে না।আমি একা থাকতে পারব সমস্যা নেই।’
‘এমন করে বলিস না।একদিন না একদিন পছন্দ করবেই।আমার ননদ কে যারা অপছন্দ করছে আসলেই তাদের কপাল খারাপ।’
‘তাই বলে আমার বারে বারে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে মন চায়না ভাবি?’
বেলি মন খারাপ নিয়েই কথাগুলো বলে।কিন্তু মিতুর কিছুই বলার নাই।মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়।করে থাকতে হয়।মেনে নিতে পারলে ভালো,নইলে খারাপ।
শাহেদ পাত্রের বাবার সাথে কথা বলে,
‘শুনেন আমার বোন এর রঙ কালো।তবে অনেক ভাল একজন মেয়ে।যদি মনে হয় ভাল দেখে নিয়ে যাবেন তাহলেই দেখতে আসুন,আগেই গায়ের রঙ এর কথা সরাসরি বলছি।তবে আমার বোন আমার জন্য হিরার মতো।আশা করি বুঝতে পেরেছেন?’
পাত্রের বাবা জানায়,
‘কালো হলেও মেয়ে নিয়ে যাবো।’
.
বিকেলের দিকে শুধু পাত্রের বাবা মা আসেন বেলিকে দেখার জন্য।তারা মিষ্টি আর বিভিন্ন ফল ও নিয়ে আসেন।
শাহেদ তাদের সাথে কথা বলে,কথাবার্তায় মনে হলো তারা অনেক ভালো মানুষ।তবে পাত্র আসেনি।
প্রতিবারের মতো বেলি তাদের সামনে এসে সালাম দেয়।
পাত্রের মা নাম জিজ্ঞেস করে।বেলির ব্যবহার দেখে তাদের খুব ই পছন্দ হয়।সরাসরি ই বলেন যে,
‘মেয়ে আমাদের খুব ই পছন্দ হয়েছে।’
শাহেদ খুব খুশি হয়।পাত্রের বাবা শাহেদের উদ্দেশ্য বলে,
‘আমাদের ছেলে একটা কাজ থাকায় আসতে পারেনি, নেন ছবি দেখেন?’
একটা ছবি শাহেদের হাতে দেন।শাহেদ ছবি দেখে বলে,
‘মাশা আল্লাহ আপনার ছেলে তো অনেক সুন্দর।নাম কি?’
‘হামিম হোসেন।’
‘আচ্ছা নাম টাও তো সুন্দর।’
পাত্রের বাবা মা হাসে।
‘তাহলে আমরা বিয়ের দিন,তারিখ এর কথা এগিয়ে নিতে পারি?’
‘হ্যা নিশ্চয়।’
ঠিক হয় এক সপ্তাহ পরে পাকা কথা হবে।বেলিকে ছবিটা দেয়া হয়।বেলি ছবি দেখে কিছুই বলেনা,তবে মনে মনে দোয়া করে,
‘মানুষ টা আমার জন্য মঙ্গল হলে বিয়ে হোক,নইলে আজীবন একা থাকবো।’
অদ্ভুত সব দোয়া করে বেলি হাসে।
.
.
পরেরদিন সকালে হাবিবা,হাসনাত দুইভাইবোন গ্রামের পথ ধরে হাটছে।শহরে থাকতে থাকতে গ্রামের পথ সম্পর্কে প্রায় ভুলতে বসেছে।
তারা হাটতে হাটতে একটা নদী দেখতে পায়।
হাবিবা বলে,
‘ভাইয়া নদী।ইচ্ছে করছে ঝাপ দিই।’
‘সাতার পারিস নাকি?’
‘তুমি আছো না?’
‘তোর জামাইকে সহ সঙ্গে আনলে ভাল হতো।নিজের বউকে নিজেই উদ্ধার করতো।’
‘হুহ হিংসুটে।’
‘আমি উদ্ধার করবো আমার বউকে।’
‘বউপাগলা সিলভার মিয়া। ‘
দুইজনে নদীর ধারে বসে।হাবিবা বলে,
‘এদিকে মানুষজন তেমন থাকেনা মেবি,কেমন নিরিবিলি।আহা এমন জায়গায় এসে সারাদিন বসে থাকলেও আমি বোর হবো না।’
তারা ভাইবোন মিলে একটা ছোটখাট পিকনিক করে ফেলে।মানে তারা নুডলস ভেজে এনেছিল।ঘাসের মধ্যে বসে ভাইবোন দুজনে খেয়ে নেয়।আপাতত দুপুরে ভাত না খেলেও চলবে।
.
হাসনাত বলে,
‘হাটতে হাটতে দুপুর হয়ে গেলো।বাড়ি কোনটা?তুই তো চিনিস না?’
‘কারো থেকে জিজ্ঞেস করি?’
‘করবি?কর?’
হাবিবা গ্রামের একজন লোক দেখে বলল,
‘কাকা বেলিদের বাড়ি কোনটা?আমি বেলির বান্ধবি শহর থেকে এসেছি।বিয়ের দাওয়াত দিতেই এসেছিলাম।’
লোকটি হাবিবার দিকে তাকায় বোরকা পড়া মেয়ে।তারপর আবার হাসনাতের দিকে আগাগোড়া তাকায়।লম্বা ও না বেটে ও না,উজ্জ্বল শ্যমলার এক ছেলে।কালো প্যান্ট আর সাদা শার্ট কাধে ব্যাগ,চোখে চশমা।মাথা ভর্তি চুল,দুই একটা চুল কপালে ও এসে পড়েছে।রাজপুত্রের মতো দেখতে।
হাবিবা ও ভাইয়ের দিকে তাকায়।লোকটি কি এমন দেখছে হা করে।হাবিবা লোকটিকে বলে,
‘আমার ভাইয়া।’
লোকটি কি যেন ভেবে হাবিবার দিকে তাকিয়ে বাড়ি দেখিয়ে দেয়।তারপর চলে যায়।
হাসনাত বলে,
‘মিথ্যা বললি কেন?কিসের বিয়ে?’
‘নইলে সন্দেহ করতো।গ্রামের মানুষদের কানাঘুষা বেশি।’
‘আচ্ছা।’
বেলিরা দুপুরের ভাত খেয়ে সবে বারান্দায় বসেছে।মিতু আর বেলি পাশাপাশি বসে গল্প করছে।বেলির চোখ যায় আম গাছের দিকে।একটা আম হলদে হয়ে আছে।আম টা অনেক মজা হবে বুঝায় যাচ্ছে।
বেলি বলে,
‘ভাবি আমি গাছে উঠে আমটা পেড়ে নিই?’
‘পাগল হয়েছিস?এ ভরদুপুরে লোকজন দেখলে কি ভাববে?’
‘এখন গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে গেছে।আর এদিকদিয়ে কেউ আসেনা।’
‘না কদিন পর তোর বিয়ে, এতবড় মেয়ে গাছে উঠবে শোভা পায়না।’
ভাবির কথায় বেলি দমে যায়।একটা লম্বা লাঠি এনে আমটা নাড়া দেয়ার চেষ্টা করে।হাসনাত আর হাবিবা এসে ই আড়াল হয়।
হাবিবা বলে,
‘আম পাড়ার জন্য লাফাচ্ছে যে এটাই সেই মেয়ে।আমি সেদিন এই চোখ ই দেখেছিলাম।হুবহু একই চোখ।তাছাড়া ওর পরিবারে ভাই ভাবি ওই থাকে।এই সেই বেলি।’
হাসনাত অবাক হয়ে বেলির দিকে তাকিয়ে থাকে।এতবড় মেয়ে বাচ্চাদের মতো করছে তাও একটা আমের জন্য।
বেলি আমটা নাগালে না পেয়ে কেদে ফেলে, নিচে বসে বলল,
‘ভাবি আমটা ত পাড়তে পারিনা।’
মিতু কপালে হাত দিয়ে বলে,
‘তাই বলে তুই কেদে ফেলবি?উঠ।’
বেলি আবার চেষ্টা করতেই বাধাচুল খুলে যায়।বেলি তাড়াতাড়ি উড়না দিয়ে চুল ডাকে।বেলি চুল সাধারণত খুলে রাখেনা।চুল বেশি লম্বা হওয়ায় যেকারোর ই নজর পড়ে,বিশেষ করে গ্রামের মহিলাদের।
হাবিবা হা হয়ে বলে,
‘এত লম্বা চুল?’
‘চুপ কর তুই, বেশি কথা বললে আমাদের কেউ দেখে ফেলবে।’
শেষবারে বেলি আমটি পাড়তে সক্ষম হয়।বেলি বলে,
‘ভাবি কথায় বলেনা,একবার না পারিলে দেখো শতবার?’
‘হ্যা এজন্য কেঁদে দিয়েছিলি আরকি?’
বেলি খিলখিল করে আবার হেসে ফেলে।মিতু বেলির কানে ফিসফিস করে বলে,
‘হাসতে ও দেরি নাই, কাঁদতে ও দেরি নাই।কিভাবে যে হামিম তোকে সামলাবে?’
বেলি ভ্রু কুঁচকে তাকায়।আমটি হাতে নেয়ার পর দরজায় এক ভিক্ষুক মহিলা কড়া নাড়ে।
বেলিদের ঘরে প্রায় তিনি আসেন।কোনোদিন খালি হাতে ফেরেননি।বেলির মা যখন ছিল তখন ও কিছু না কিছু যেমন-চাল,ডাল,চিনি,মুড়ি বিস্কুট ইত্যাদি দিতো।বেলির মা কখনো না বলতনা।বেলির মা মারা যাওয়ার কথা শুনে মহিলা সেদিন খুব কেঁদে ছিলেন।তারপর বেলি ও মায়ের থেকে দেখে মহিলাকে খালি হাতে ফেরায় না।
বেলির হাতে আম দেখে মহিলাটি বলেন,
‘আম পেড়েছিস?আমায় একটা খেতে দিবি?’
বেলি নেড়েছেড়ে মনে মনে বলে,
‘একটায় পেড়েছি।উনাকে দিলে আমি কি খাব এত কষ্ট করে পাড়লাম।কিন্তু আমি ত অনেক খেয়েছি উনি ত খেতে ই পারেন না।’
বেলি হেসে মহিলাকে দিয়ে দেয়।মিতু অবাক হয়ে তাকায়।
মহিলা খুব খুশি হয়।
আড়াল থেকে আরো দুইভাইবোন অবাক হয়ে বেলির দিকে তাকায়।
হাসনাত বলে,
‘পেয়ে গেছি,এই হবে আমার বেলিফুল।শুধুই আমার।’
চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)
#তাহরীমা