তোর অনুরাগে পর্ব-১৬

0
434

#তোর অনুরাগে
#লেখনীতেঃতানজিলা_খাতুন_তানু
#পর্ব_১৬
__________

ডাক্তারের বলা কথাটা শুনে সকলেই এক এক করে ভেতরে চলে যায়। সকলের সুখ দুঃখের সাথী ছিলো,,সকল বিপদে সবসময় আগলে রেখেছে।

কিছুক্ষন আগে..

নিরব আদ্রির দিকে বন্দুক তাক করেছিলো। সকলেই নিরবকে বারবার বারন করছিলো যাতে গুলি না চালায়। নিরব গুলি চালাও নি,পেছন থেকে কেউ একজন গুলি করেছিলো,ভাগ্য ক্রমে গুলিটা সাগরের বুকে গিয়ে লাগে। সাগরের হাতের বন্দুক থেকেও একটা গুলি নিরবের মাথায় আঘাত করে।নিরব আর সাগর দুজনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সাগরকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়।

বর্তমান…

নিঝুম, মাহিয়া,মারিয়া,নীলি ও এসেছে খবর পেয়ে। ওরা কাঁদছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সাগর আলতো করে হেসে বললোঃ বনুরা কাঁদছিস কেন? আমিও কিন্তু তোদের সাথেই থাকবো। তোদের ছায়া হয়ে।

ওদের কান্নার বেগটা বেড়ে যায়।

সাগরঃ তোরা কাঁদিস না তাহলে আমার আরো কষ্ট হবে। আমার নিজের কোনো ভাই বোন ছিলো না তোদের কেই আমি ভাবতাম। আগলে রাখার চেষ্টা করতাম সবসময়। তোরা এইভাবেই একসাথে থাকিস সারাজীবন। কখনোই কোনো কিছু নিয়ে বন্ধুত্বের মাঝে ফাটল ধরতে দিস না। তোদের বন্ধুত্বই তোদের শক্তি কথাটা মনে রাখিস। তোরা বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করিস। আর এই অভিশপ্ত জীবন থেকে সরে যাস এই জীবন তোদের থেকে সুখ কেড়ে নেবে।

সাগরের কথাগুলো আটকে যাচ্ছে বারবার সকলেই খুব কাঁদছে।

সাগরঃ আঙ্কেল,, আমি আপনার দেওয়া দায়িত্ব রাখতে পেরেছি তো। আমি কথা দিয়েছিলাম আগলে রাখবো আদ্রিকে আগলে রেখেছি। অর্ক আদ্রিকে দেখে রাখিস। আর আহসান আমার আদ্রিকে কখনোই কষ্ট দিয়ো না। সবসময় হাসি মুখে আগলে রেখো। আদ্রি আসবি না আমার কাছে।

আদ্রি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। সাগর ওকে ডাকতেই আদ্রি সাগরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

সাগর উঠে বসতে চাইলো,, আদ্রি সাগরকে বসিয়ে দেয়। আদ্রির হাতদুটোকে নিজের হাতে বন্ধি করে সাগর একটা চুমু খেলো। সকলেই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

সাগরঃ জানিস আদ্রি তোকে কখনোই একটা কথা বলতে পারিনি। হয়তো আজকে না বললে কখনোই আর পারবো না। আমি জানি আমি আর বেশিক্ষন নেয়। তবে কথাগুলো না বলতে পারলে মরেও শান্তি পাবো না আমি।

আদ্রি সাগরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সাগরঃ যখন আমি তোকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই #তোর_অনুরাগে পড়েছিলাম।

আদ্রি বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চমকে উঠলো।

সাগরঃ পরে যখন আঙ্কেল তোর দায়িত্ব আমার হাতে দেয় তখন আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম কি খুশি হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না। তোর পাশে থাকতে থাকতে আমার মনটাই তোর কাছে দিয়ে দিলাম,,সবসময় চেষ্টা করতাম তোকে আগলে রাখার। কিন্তু আমার মনটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত বারবার কারন তুই আমাকে দাদার নজরে দেখতিস কখনোই অন্য কিছু ভাবিস নি। তোর যখন বিয়ের খবর পেলাম মনে হলো কেউ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলছে। আর আজকে যখন তোকে বন্দুকের সামনে দেখলাম নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। মেরে ফেললাম শয়তান টাকে। ভালো থাকিস আফসানকে নিয়ে সুখে থাকিস। আমি আকাশ থেকে তোকে ভালোবাসতে থাকবো। একটা ইচ্ছা পূরণ করবি আমার।

আদ্রিঃ কি?

সাগরঃ একবার জড়িয়ে ধরবি আমাকে।

সাগরের কন্ঠে আকুলতা। আদ্রি আহসানের দিকে তাকালো,আহসান আদ্রিকে নিজের চোখের ইশারায় সম্মতি জানালো।জিনিসটা সাগরের চোখ এড়ায়নি।

সাগর মনে মনে বললোঃ আহসানের জন্য তোর চোখে অগাধ ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি। দোয়া করি এইভাবেই যেন তোদের ভালোবাসা অটুট থাকে। কোনো খারাপ ছায়া তোদের জীবনে না আসে।

আদ্রি কাঁপা কাঁপা গলায় বললঃ হুম।

সাগর আদ্রিকে জড়িয়ে ধরলো।আদ্রি কাঁপা হাতে সাগরের পিঠটা স্পর্শ করলো। সাগর আদ্রির কানের কাছে ফিসফিস করে বললঃ ভালোবাসি।

আহসানের বুকেতে চিনচিনে ব্যাথা করছে। সাগর আর আদ্রিকে মেনে নিতে পারছে না‌। হয়তো এটা কেউ পারবে না। কিন্তু একজন মৃত্যু শয্যাসায়ী মানুষের শেষ ইচ্ছার কাছে নিজের জেলাস করা মানায় না। অমানুষ নয় আহসান।

আদ্রি চেঁচিয়ে উঠলো। সাগরের শরীর বরফ হয়ে আছে। ডক্টর এসে বললোঃ উনি আর বেঁচে নেয়।

আদ্রিকে আহসানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আহসানের চোখ যায় সাগরের ঠোঁটের দিকে। আহসানকে যেন কিছু বলছে সাগর হেসে হেসে।

কেটে যায় একটা মাস।

কিন্তু কোনো কিছুই স্বাভাবিক হয়ে উঠে না। আদ্রি সাগরের মৃত্যুর ট্রমা থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। রাতের বেলায় ঘুম থেকে উঠে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। আশেপাশে সাগরকে অনুভব করে।আহসান তার মায়াবতীর এইরকম অবস্থা সহ্য করতে পারছে না। আদ্রি সাগরের মৃত্যুর পর থেকে আহসানের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখেনি। আদ্রি নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে। বেশিরভাগ সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে। সবই খুব চিন্তিত এইসব নিয়ে।

কিছু কিছু সময়ে কিছু ঘটনা আমাদের জীবনে এতটাই দাগ কাটে। আমরা বাঁচতেই ভুলে যায়। জীবনের মানেটাই ভুলে যায়। আশেপাশে সবকিছুই অবাস্তব লাগে। ভয় ঘিরে ধরে।

আহসানের আর পারছে না সহ্য করতে। আহান তার প্রিয় বন্ধুটার এই অবস্থা থেকে থাকতে পারলো না।

আহানঃ আহসান আমি বলি কি। তুই আদ্রির সাথে দেখা কর।‌তারপরে কি হয় দ্যাখ।

আহসানঃ ও আমার সাথে দেখা করতে চাই না।

আহানঃ আহসান আদ্রি তোর স্ত্রী তোকেই ওকে ওর আগের জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতৈ হবে।

আহসানঃ হুম।

আহসনাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আহান চলে যেতে গেলে কেউ একজন ওকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে নিলো।

আহান রাগে গজগজ করতে করতে বললোঃ এসব কি সানা।

সানাঃ আপনি কি কিছুই বোঝেন না। না বুঝতে চান না।

আহানঃ কেন বুঝতে পারছো না এইসব হয় না‌,,তুমি আহসানের বোন হও।

সানাঃ তাতে কি হয়েছে। তাই বলে কি আমাকে বিয়ে করতে পারবেন না।

আহানঃ আমি চাই না আহসানের সাথে আমার বন্ধুত্বে ফাটল ধরুক। আর কখনোই আমাকে বিরক্ত করবে না। তাহলে কিন্তু আমি এই বাড়িতে আসা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেবো।

আহান রাগ নিয়ে চলে গেলো। সানা চোখের পানি ফেলে বললোঃ আমি তো আপনাকে ভালোবাসি। তাহলে কি আমি কখনোই আপনাকে পাবো না।

অর্ক ও নুপূরের বিয়ের কথা পরিবার তুললেও অর্ক বিয়ে করতে রাজি নয়। বোনের এইরকম অবস্থায় সে কখনোই বিয়ে করতে চাই না। নুপুর সবদিক থেকে অসহায় হয়ে পড়েছে। একদিকে পরিবারের সকলের চাপ আর অন্যদিকে প্রানপ্রিয় বন্ধু। সবকিছু অসহ্য লাগছে ওর কাছে। বিরক্ত লাগছে।

নীলি রোশানের ছেলেটাও অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে।‌ নীলি ভালোই আছে কিন্তু সত্যি কি ভালো আছে। প্রান প্রিয় বান্ধবীগুলোর জীবনটা এলোমেলো দেখে নিজে কি সত্যি ভালো থাকা যায়।

সাদ্দাম আর মাহিয়ার মাঝে আর ঝামেলা নেয়। ঝামেলা আর কিভাবেই বা করবে। এলোমেলো হয়ে আছে। মাহিয়া চেষ্টা করছে সবকিছুই ঠিক করা কিন্তু সবকিছু আগের মতো করা কি এতটাই সহজ। সহজ ছিলো একজনের কাছে আজ সেই কঠিন হয়ে উঠেছে। বাকিরা সব কিভাবে সহজ হবে।

মারিয়ার জন্য পাত্র ঠিক করেছে বাড়ি থেকে কিন্তু মারিয়া এই বিয়েতে অমত। সে কিছুতেই এই বিয়ে করবে না‌,এই নিয়ে বাড়ির সাথে ঝামেলা হচ্ছে।অন্যদিকে,মাহিরের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় সবকিছুর দায়িত্ব এসে পড়েছে মাহিরের কাঁধে,,সবকিছুই নিয়ে ব্যস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে জীবনটা।

অপর দিকে…
সারা হাসপাতাল জুড়ে হই হুল্লোড় হচ্ছে। একটা মানসিক রোগী সকলেই বিরক্ত করে মারছে।

নার্সঃ এই পেশেন্টটা খুব পাগলামি করছে আজকাল। স্যারের কাছে বলতেই হবে।

পেশেন্টটা আর কেউ নয় নিরব। সেদিন নিরবের মৃত্যু হয়নি। মাথায় গুলি লাগার কারনে পাগল হয়ে গেছে। ওর নামে পুলিশ কেস থাকার কারনে মানসিক হাসপাতালে ঠাঁই পেয়েছে নাহলে হয়তো রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। মৃত্যু টা হয়তো সবথেকে সহজ শাস্তি। প্রকৃতির দেওয়া শাস্তি কতটা কস্টকর সেটা হয়তো নিরবকে না দেখলে বোঝা যায়না। মৃত্যু হয়ে গেলে নিমিষেই সবকিছুর শেষ হয়ে যেতো কিন্তু নিরব প্রতিমুহূর্তে মরছে, ধুঁকে ধুঁকে পড়ছে। সবকিছুর জন্য এটাই হয়তো ওর প্রাপ্য ছিল।

কেউ কোথাও ভালো নেয়। সবাই সবার জীবন যুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। সবটা কি কখনোই আগের মতো হয়ে উঠবে না।

#চলবে….