আমি সেই চারুলতা পর্ব-৩৯+৪০

0
380

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
|৩৯|
_________________________

সোনাদীঘির পাড়ে বসে আছে চারু। ছোটবেলায় এই জায়গাটাকে ভয় পেয়ে কতবার এখান থেকে পিছিয়ে গেছে তার হিসেব নেই। কি বোকামো টাই না করেছে! দীঘির জলে পদ্মফুলেরা স্বগৌরবে ভাসমান আছে। কি আময়িক লাগছে দেখতে!
– চারুলতা!
নিজের নামের সম্মোধন শুনে পেছনে তাকালো চারুলতা। হিমেল দাঁড়িয়ে আছে সেখানে,
– বসতে পারি?
– দীঘিটা আমার নয় যে আমার অনুমতি চাইছেন।
হিমেল অন্যপাশে গিয়ে বসে পড়লো,
– তোমার কেইসটা লুকিয়ে রাখতে আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে জানো?
– কাঠখড় পোড়ালেই বুঝি কেইস লুকানো যায়? তাহলে তো সব অপরাধীরাই কাঠখড় পোড়াতে পারে।
– এইটা শুধু কথার কথা। তোমাকে কিছু কথা বলা প্রয়োজন, তাই ভাবলাম এখানেই বলি।
– বলুন।
– হুম বলবো। আগে বলো তুমি এখানে কি করছো? হামিদ কিন্তু অনেকক্ষণ যাবত তোমাকে খুজছে।
– এমনিই বসে আছি। ছোটবেলায় কত ভয় পেতাম এখানে আসতে।
– ভয় কেনো পেতে?
– এই দীঘি নিয়ে গ্রামে অনেক কথাই প্রচলিত ছিলো। এখানে নাকি একটা মেয়ে ডুবে গিয়েছিলো। বাঁচেনি আর। সেই মেয়ের অতৃপ্ত আত্মা নাকি এখানে ঘুরে বেড়ায়।
হিমেল কিছুটা ভড়কে গেলো। তার বেড়ে ওঠা গ্রামে। সময়ের সাথে সাথে শহরের সাথে মিলে গেলেও এইসব ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। ছোট থেকেই কিছুটা ভীতু ধরনের সে। তার এই ভয় পাওয়াটা চারুর চোখ এড়ায় না।
– ভয় পাচ্ছেন কেনো? তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আসলে ভূত তারা না ভুত হলাম আমরা।
– আমরা ভূত?
– হ্যাঁ আমরা ভূত। আপনি পরকালে বিশ্বাস করেন?
– হ্যাঁ করি।
– পরকালই হলো সত্যিকারের দুনিয়া আর এ দুনিয়া হলো খনিককালের মায়া। তাই যারা পরকালে থাকে তারাই হলো সত্যিকারের মানুষ আর আমরা যেহেতু সত্য জগতে নেই, মায়ার একটা জগতে আছি তাই আমরা ভূত।
হিমেল অবাক হলো। সত্যিই এই মেয়ের চিন্তাভাবনা লেভেল আলাদা। অদ্ভুতও!
– তুমি কি আমাদের উপর রেগে আছো চারুলতা?
– সেটা কি স্বাভাবিক নয়?
– খুবই স্বাভাবিক তবে আমাদের উপর রেগে থাকলেও হামিদের উপর রেগে থেকো না। ও সত্যিই তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি আমাদের কাছে আছো জেনেও তার চিন্তার শেষ ছিলো না। ধর্মের কাজ তাকে খুব কমই করতে দেখেছি আমি, কিন্তু তুমি যেদিন থেকে সারেন্ডার করলে সেদিন থেকে এক ওয়াক্ত নামাজ ও ছেড়েছে কি না সন্দেহ। ওর সকল চিন্তা সবসময় তোমাকে ঘিরে। নিজের স্ত্রী আর মেয়ের চেয়েও ও তোমার চিন্তা বেশি করে। আমরা আলাদা মায়েদের সন্তান হলেও আমাদের বাবা যেমন এক ঠিক তেমনি আমাদের উদ্দেশ্যও কিন্তু একই ছিলো। আমাদের সেই তথাকথিত পিতাকে হ*ত্যা করা। আমি হাজারবার সেটা করতে চেয়েও পারিনি কেনো জানো? আমি তোমাদের মতো এত সাহসী নই। আরেকটা বড় কারণ ছিলো সে আমার বাবা। তাকে যতই আমি ঘৃণা করি, কিন্তু তাও তাকে মারতে আমার হাত কাপতো। সে তোমার সাথে এত অন্যায় করার শর্তেও তাকে হ*ত্যার পর তোমার চোখ থেকে অশ্রু ঝড়েছে। সেই অশ্রুই প্রমান করে তুমি তাকে একটু হলেও ভালোবেসেছো। বাসবে না কেনো বলো? সে যতই খারাপ হোক, কয়েক মূহুর্তের জন্য হলেও হয়তো তার সাথে তোমার ভালো স্মৃতি ছিলো। সুন্দর স্মৃতি আমাদের ভালোবাসতে শেখায়। আর সেই ভালোবাসা থেকেই কষ্টটা তুমি উপলক্ষে করতে পেরেছো। কিন্তু তোমার ভেতরে প্রতিশোধের যে আগুন ছিলো সেইটা সেই সুখ স্মৃতিকেও ভষ্ম করে দিয়েছে তাই তুমি পেরেছো তাকে খু*ন করতে।
তুমি যেমন করিমপুর গ্রামে বড় হয়েছো আমি তেমনি সুন্দরপুরে বড় হয়েছি। নামের মতো গ্রামটাও ছবির মতো সুন্দর ছিলো। সেখানের সুন্দর প্রকৃতি সাক্ষি ছিলো আমাদের প্রতি হওয়া প্রতিটা অন্যায় ও বৈষম্যের। তার প্রতি আকাশস্পর্শী ঘৃণা থাকলেও খু*ন তাকে আমি করতে পারিনি। পালিয়ে গিয়েছিলাম মা-কে নিয়ে। আমাদের ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন ছিলো জানো! মায়ের আবার বিয়ে দেওয়া হয়। আগের ঘরে একটি ছেলে ছিলো কিন্তু ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গিয়েছিলো। সেই ভদ্রলোক আমাকে নিজের ছেলের পরিচয়ে মানুষ করেন। দুই ভাই আমরা একত্রে বেড়ে উঠি। যা আমার জন্মদাতা আমার জন্য করেননি তা ওই ভদ্রলোক করেছিলেন। তাকেই আমি মনে প্রানে নিজের বাবা মানি। তার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু আত্মার সম্পর্ক আছে। রক্তের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটলেও আত্মার সম্পর্কে কখনো বিচ্ছেদ ঘটেনা।
– আপনার মতো এতটা সৌভাগ্যবান আমি নই হিমেল। আপনাকে ভালোবাসার মানুষ আছে আর আমি সবসময় ভালোবাসার মানুষদের কাছে ঠকে এসেছি। হাজার কষ্ট পেয়েছি জীবনে। পাথরে পরিবর্তিত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই পাথরও ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছিলো সেদিন, যেদিন জানলাম আমার ভাই এতকিছু জেনেও আমার কাছে সব লুকিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি তাকে। আমি মনে করতাম পৃথিবী উল্টে গেলেও আমার ভাই আমাকে কখনো ঠকাবেনা। কখনো কিছু লুকাবেনা। যখন জানলাম আমার ধারণা ভুল আমি মেনে নিতে পারিনি। খু*ন করতে ইচ্ছে হয়েছিলো তাকে কিন্তু তাও পারিনি। সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করেছিলাম জীবনের কাছে হেরে গেছি আমি।
– জীবনে কেউ যদি তোমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে তবে সেটা হামিদ। হামিদকে অবিশ্বাস করোনা। বিশ্বাস করো, হামিদ যতটুকু করেছে তোমার যেনো কষ্ট না হয় তাই করেছে।
– তার হয়ে আমার কাছে ওকালতি করতে আসবেন না। আপনারা সবাই ধোকাবাজ। বিয়ের পর জানতে পারলাম, সাজিদ ভেবে যাকে বিয়ে করেছি সে আসলে সাজিদের জমজ ভাই সিফাত।
– স্যার কিন্তু সত্যিই তোমাকে পছন্দ করে। আগে করতো না তবে বিয়ের পর সত্যিই করে।
চারু উত্তর না দিয়ে উঠে যায় সেখান থেকে। একবার কবরস্থানে যাওয়া প্রয়োজন। মনোরমার কবরটা একবার দেখা উচিত। কবরস্থানে গিয়ে চারু দেখতে পেলো হামিদ আগে থেকেই সেখানে আছে। করবের উপর কিছু গাছ জন্মেছে। অবশ্য সেসব আগাছা বলেই গণ্য করা যায়। সেগুলোই পরিষ্কার করছে হামিদ। চারু নিজেও গিয়ে কিছু সাহায্য করলো। অল্প সময়ের মাঝেই পরিষ্কার হয়ে গেলো।
– অনেকক্ষণ যাবত তোরে খুজতাছিলাম। কই ছিলি তুই?
মায়ের ফুল অনেক পছন্দ ছিলো। কয়েকটা ফুলের বীজ আনলাম। আয়, দুজনে মিলা এইগুলা লাগাই দেই মায়ের কবরে।
চারু কিছু না বললেও হামিদকে সাহায্য করলো তার কাজে।
– বাসায় কারেন্টের লাইন নিছি কিন্তু শুনলাম সন্ধ্যার পর নাকি কারেন্ট থাকেনা। বাচ্চারা গরমে ঘুমাইবো ক্যামনে?
– হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে হবে।
– বাড়ির তো একটা হাতপাখা। হাট থেইকা আরো কিনে আনতে হইবো। তাছাড়া সিফাত ভাই আর হিমেলও মনে হয় গরমে ঘুমাইতে পারবো না। আমিও পারমু না।
– তিন ঘরের জন্য তিনটা কিনলেই হবে। গ্রামের সবকিছুর দাম কম। কিনে নিতে পারো।
– আয় আমরা দুইজন গিয়া প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনা নিয়া আসি।
– এইটা গ্রাম। কখনো কোনো মেয়েকে অতিরিক্ত প্রয়োজন ছাড়া বাজারে যেতে দেখেছো?
– তুই আবার লোকের পরোয়া করা শুরু করলি কবে থেইকা?
– তুমি কিনে আনো। আমি ওদিকে যাবোনা। আমার ভালো লাগছেনা।
– আচ্ছা। তুই কি কিছু খাবি? নিয়া আসমু?
– না আমি কিছু খাবোনা। সম্ভব হলে গরুর দুধ কিনে এনো। পুতুল দুধ না খেয়ে রাতে ঘুমাতে পারেনা।
হামিদ সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো বাজারের উদ্দেশ্যে। আর চারু নদীর পাড়ের দিকে গেলো। এই নদীর সাথেই কত স্মৃতি তার। কিশোরী বয়সের প্রথম আবেগ ছিলো শাওন। সে আবেগ অবশ্য ভালোবাসা ছিলোনা। শাওনকে এই নদীর পাড়েই প্রথমবার “ভালোবাসি” বলেছিলো চারুলতা। সে সবই এখন এক রূপকথার গল্পের মতো। চারু আবার সেই নিজের চিরচেনা গাছের নীচে গিয়ে বসলো। এখান থেকে বাড়িতে যেতে পাঁচ মিনিটের মতো সময় লাগবে৷ চারু ঠিক কতক্ষণ এখানে বসে স্মৃতিচারণ করছিলো তার মনে নেই তবে যখন তার ঘোর কাটলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। সিফাত পাশে এসে বসায় বাস্তব জগতে ফিরে এসেছে সে,
– এই নদীর পাড়টায় আমার এক বিভৎস স্মৃতি আছে জানেন বেলিফুল!
– বিভৎস স্মৃতি?
– হ্যাঁ। আমার স্ত্রী প্রথমবারের মতো সেদিন এখানে কাউকে বলেছিলো সে তাকে ভালোবাসে৷ ভালোবাসা স্বীকার করার প্রতিউত্তরে সামনে থাকা ব্যক্তিটিও তাকে প্রথম ঠোঁটের স্পর্শ একে দিয়েছিলো কপালে। আমি নিজ চোখে দেখেছিলাম। তখন অবশ্য কোনো কষ্ট হচ্ছিলো না আমার। আমি তখন জানতাম না, এই মেয়েটিই আমার বউ হতে চলেছে। পনেরো বছরের সেই কিশোরীর প্রতি আমার সেদিন অন্যরকম কোনো ভাবনা ছিলোনা। কিন্তু এখন মনে পড়তেই বুঝতে পারছি সেটি সত্যিই আমার জীবনের বিভৎস এক স্মৃতি, যা না দেখলেই বোধহয় আমি একজন সুখী মানুষ হতে পারতাম বেলিফুল।
চারু অবাক বিষ্ময়ে তাকায় সিফাতের দিকে। সিফাতের শূন্য দৃষ্টি নদীর উপর। সিফাত কিছুকাল গ্রামে ছিলো। কিন্তু চারু আর শাওনকে একসাথে এভাবে সে দেখেছে সেটা জানতো না চারু।
– আপনি সেদিন আমাদের দেখেছিলেন?
– হুম। অবশ্য সেটা দেখে আমি আর দাঁড়াইনি। আপনাদের স্পেস দিয়ে চলে গিয়েছিলাম। তখন যদি জানতাম এই মেয়েটা আমার বউ হবে তাহলে বোধহয় টেনে হিচড়ে হলেও আপনাকে আমার সাথেই নিয়ে চলে যেতাম। কারো হিংস্র থাবার শিকার হতে দিতাম না আপনাকে। না নাজিমুদ্দিনের আর না সেই তথাকথিত অজ্ঞাত বসের। আর না আপনাকে আমি শাওনের ভালোবাসা পেতে দিতাম।

★★★

– আমি না চারুর মোবাইলে দেখছিলাম দুইজন একসাথে ছবি তোলা যায়। আপনে আমার সাথে ছবি তুলবেন?
ফাতেমার অতিরিক্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলা কথাটায় প্রচন্ড বিরক্ত হলো হামিদ।
– দামি ফোনে ছবি তোলা যায়, নর্মাল ফোনে না। এমনি ছবি তুলতে হইলে ক্যামেরা লাগে। এই গ্রামে আমি ক্যামেরা কই পামু?
– চারুর মোবাইল দিয়া তুলি। চারু তো আমাগো মানা করবো না।
– তোমার চেহারাটা দেখছো আয়নায়? এমনেই কালা আবার ছবি তুলতে চায়। কি বাজে দেহা যাইবো ধারণা আছে তোমার?
ফাতেমার মুখ কালো হয়ে গেলো। হামিদের সাথে স্মৃতি স্বরূপ সে ছবি তুলতে চাইছিলো কিন্তু হামিদ আবারও অপমান করলো তাকে। হামিদকে সে জীবন দিয়ে ভালোবাসলেও হামিদ তাকে ভালোবাসেনা। আসলেই মেয়েদের গায়ের রঙ কালো মানেই সেটা মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ। ফাতেমা চলে গেলো রান্নাঘরে। হামিদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হলো না ফাতেমাকে এভাবে অপমান করায়। সে হরহামেশাই এমনটা করে থাকে। চারু একটু অসুস্থ বিধায় আজ ফাতেমা রান্না করেছে। সেই রান্না নিয়েও অনেক কথাই ফাতেমাকে শুনিয়ে দিলো হামিদ। এতদিন হওয়ার পরেও ঠিকঠাক মতো রান্না করতে পারেনা সে। এইসব কথা শুনেও ফাতেমা নিশ্চুপ রইলো। এ জীবনে বোধহয় সে হামিদের মনে জায়গা করে নিতে পারবেনা। তার দোষ একটাই, সে কালো!

অনেকদিন পর মাছ ধরতে এসেছে হামিদ। প্রায় পাঁচটা বছর কেটে গেছে পরিচিত এই নদীতে মাছ ধরা হয়না। গ্রামে ফিরে আর দেরি করেনি, মাছ ধরা হামিদের কতটা পছন্দের সেইটা শুধু হামিদই জানে। বেশ অনেকটাই মাছ ধরা হয়েছে। রান্নার জন্য এইগুলো বাসায় দিয়ে আসা প্রয়োজন তবে হামিদের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছেনা। হামিদ ইচ্ছে করেই বসে রইলো নদীর পাড়ে। কিছুক্ষণের মাঝেই অনুভব করলো কেউ তার পাশে এসে বসেছে। হামিদ সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলো বিন্দিয়াকে। বিষন্ন মুখে কিছুটা দূরে বসে আছে সে।
– কেমন আছেন হামিদ ভাই?
– ভালো আছি। তুমি এইখানে?
– এমনিই আসছিলাম। আপনেরে দেইখা ভাবলাম একটু কথা বইলা যাই।
– ওহ। তুমি কি এহন বাসায় যাইবা?
– হ্যাঁ। ক্যান?
– আমার একটা সাহায্য করতে পারবা?
– কি সাহায্য?
– এই মাছ গুলা চারুরে দিতে পারবা একটু? বলবা এইগুলা যেনো রান্না করে।
– আইচ্ছা।
– শোনো চারুরেই দিবা। তোমার ভাবি রে দিবা না।
– ক্যান?
– সে ভালো কইরা রান্না করতে পারেনা।
বিন্দিয়া অবাক হলো। হামিদ কি তবে ফাতেমাকে পছন্দ করেনা? পছন্দ করলে একটা বাইরের মানুষের কাছে স্ত্রী সম্পর্কে এমনই কথা কিভাবে বলে? অবশ্য পছন্দ করার কথাও নয়, হামিদের সাথে ফাতেমা কোনোদিক থেকেই মানানসই নয়।
– একটা প্রশ্ন করি?
– কী?
– ভাবির সাথে কি আপনার বিয়া জোর কইরা দিছে?
– না তো। আমারে কে জোর করবো? তবে বিয়ার আগে তারে দেখি নাই আমি।
– দেখলে নিশ্চিত বিয়াটা করতেন না।
– হুম দেখলে তো করতামই না।
হামিদের উত্তরে বেশ খুশি হলো বিন্দিয়া৷ আসলেই হামিদের পাশে ফাতেমাকে মানায় না। হামিদের পাশে তো বিন্দিয়াকেই মানায়। ফাতেমাকে গায়ের রঙ কালো, তার বয়স বেশি, লেখাপড়া করেনি, রান্না ভালো করতে পারেনা, অপরদিকে বিন্দিয়ার গায়ের রঙ ভালো, লেখাপড়াও করেছে, বয়সও ফাতেমাকে চেয়ে কম। রান্নার গুনগান সবাই করে। বিন্দিয়াই পার্ফেক্ট হামিদের জন্য। সেদিন যখন জানলো হামিদ বিয়ে করে নিয়েছে, বিন্দিয়ার পৃথিবী উল্টে যাচ্ছিলো। সেদিন থেকে রাতে সুন্দরমতো ঘুমাতে পারেনি। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছে কত হাজার বার। প্রতিটা স্বপ্নের মূল বিষয়বস্তু ছিলো সে হারিয়ে ফেলছে হামিদকে। হামিদ তো ফাতেমাকে পছন্দ করেনা, তবে কি হামিদ ফাতেমাকে ছেড়ে বিন্দিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
– বাড়ির সকলে বলে আমি নাকি অনেক ভালো রান্না করি, মাছগুলা যদি আমি রান্না করি তাইলে কি আপনে খাইবেন?
– তুমি আবার কষ্ট করতে যাইবা ক্যান?
– কষ্টের কি আছে? আপনেরা কতদিন পর গ্রামে আসলেন। আমি না-হয় একদিন রান্না কইরা খাওয়াই। আপনের কি অনেক বেশি সমস্যা হইবো আমি রান্না করলে?
– তোমার সমস্যা না হইলে আমার সমস্যা হইবো ক্যান?
– তাইলে আমি এইগুলা নিয়া যাই?
– যাও।
বিন্দিয়া চলে গেলো সেখান থেকে। সেদিন যে আশাটা মন থেকে মরে গিয়েছিলো আজ আবার তা ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। বাসায় যেতেই ফাতেমাকে উঠোনে বসা অবস্থায় দেখতে পাওয়া গেলো। অজ্ঞাত এক কারন বশত ফাতেমাকে ভালো লাগলো না বিন্দিয়ার। ফাতেমার জন্যই হামিদকে হারিয়েছে সে এমন মনোভাব নিয়েই বসে রইলো সে। ফাতেমা একবার দেখেই চিনতে পারলো বিন্দিয়াকে।
– তুমি চারুর বান্ধবী না?
বিন্দিয়া ভদ্রতাসূচক মাথা নাড়লো।
– আসো ভেতরে আইসা বসো।
– না বসমু না। হামিদ ভাই কিছু মাছ দিয়া বলছে আমি যেনো ওইগুলা রান্না করি।
ফাতেমা অবাক হলো। হামিদ বিন্দিয়াকে বলেছে মাছ রান্না করতে? ওর রান্না হামিদ পছন্দ করেনা ঠিকই কিন্তু চারুর রান্না তো করে। চারুকে রান্না করতে না বলে কি না বিন্দিয়াকে বললো!
– থাক! তোমার কষ্ট করতে হইবো না। তুমি বসো, আমি রান্না করি।
– না। হামিদ ভাই বইলা দিছে, আপনেরে যেনো রান্না করতে না দেই। আপনের রান্না খাইলে তার রূচি নষ্ট হইয়া যায়।
বিন্দিয়া কিছুটা বাড়িয়ে বললো। দরজা দিয়ে প্রবেশকালীন কথাটা চারুর কানে পৌছাতেই তার ভ্রু কুচকে গেলো। হামিদ বিন্দিয়াকে এখন এইসবও বলতে শুরু করেছে। চারুর প্রচন্ড রাগ হলো হামিদের উপর। রাগ হলো বিন্দিয়ার উপরও। হামিদ বিবাহিত জেনেও বিন্দিয়া কিভাবে তার পেছনে পড়ে আছে? কই আগে তো বিন্দিয়া এমন ছিলোনা।
– বিন্দিয়া!
চারুর সম্মোধনে তার দিকে ফিরে তাকালো বিন্দিয়া।
– হ্যাঁ বল।
– মাছগুলো রেখে এখানে আয়।
– ক্যান? রান্না করতে দেরি হইয়া যাইবো তো। হামিদ ভাই বলছে সে বাড়ি ফিরাই,,,,
– বিন্দিয়া আমি তোকে মাছগুলো রেখে এখানে আসতে বলছি। মাছ ভাবি রান্না করে নেবে। তার স্বামীর কথা তাকেই ভাবতে দে। তোর না ভাবলেও চলবে।
– কিন্তু হামিদ ভাই আমারে রান্না করতে বলছে।
– বিন্দিয়া তুই আমাদের বাড়ির মেহমান। মেহমানরা কাজ করেনা এখানে। তুই আমার সাথে রুমে আয়।
– কিন্তু চারু!
চারু আর কোনো কথা শুনলো না বিন্দিয়ার। বিন্দিয়াকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ঘরে আর ফাতেমাকে বললো মাছ রান্না করে ফেলতে।
– বিন্দিয়া তুই দূর থেকে এসেছিস, একগ্লাস পানি খেয়ে নে।
– খামু না পানি। চারু হামিদ ভাই কিন্তু সত্যিই তোর ভাবিরে রান্না করতে মানা করছে।
– রান্না করার দায় তোর না বিন্দিয়া।
– একদিন করলে কি হয়?
– দেখ, আমি সরাসরি বলছি, আমি জানি আমার ভাইকে তুই পছন্দ করিস। যেমন তেমন পছন্দ নয়, খুব বেশি পছন্দ করিস। কিন্তু সে এখন বিবাহিত। তার একটা মেয়ে আছে। মেয়েকে ভাইয়া তার জীবন দিয়ে ভালোবাসে। তার সুখের একটা সংসার আছে। তুই সেই সংসারটা নষ্ট করবিনা প্লিজ। তোর সুন্দর একটা জীবন আছে। তুই তো আমার বান্ধবী। আমি চিনি তোকে। তুই তো এমন নয় বিন্দিয়া। তবে এখন কেনো তুই অন্য একজনের সংসার ভাঙতে মরিয়া? একজনের সুখ নষ্ট করে কি আদেও সুখী হওয়া যায়? এক মেয়ের সংসার ভেঙে তার সংসারে জায়গা করে নিতে চাওয়ার মতো এতটা বিকৃত মস্তিষ্ক তো তোর নয় বিন্দিয়া। তবে কেনো করছিস এমন?
বিন্দিয়া হঠাৎই কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে অন্যায়ের উপলব্ধি করছে। কিন্তু সে-ই বা কি করতে পারে? এতটা বছর ধরে হামিদের জন্য অপেক্ষা সে করেছে। হামিদকে কেন্দ্র করে কত স্বপ্ন সে দেখেছে। এখন কিভাবে ভুলে যাবে হামিদকে?
– কান্না করছিস কেনো তুই?
– আমি তারে ছাড়া ক্যামনে থাকমু চারু? আমি তো সবসময় শুধু তারেই চাইছি। তারে ছাইড়া বাঁচা থাকা কি সম্ভব আমার পক্ষে? তোর ভাই ক্যান বিয়া কইরা নিলো?
– কেনো করবেনা? সে কি তোরে কথা দিয়েছিলো সে তোকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা?
– কিন্তু আমি তো তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
– সে দায় নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের নয়।
– তোর আমার জন্য কষ্ট হইতাছে না চারু?
– সত্যি বলতে হচ্ছেনা। তুই যেচে নিজের জীবন নষ্ট করেছিস। অবশ্য নষ্ট করিস নি। চাইলেই জীবনটা সাজিয়ে নিতে পারবি। কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথে জড়াতে চাইলে অনেকগুলো জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তুইও বাঁচতে পারবিনা। কারোর সুখ নষ্ট করে কখনো সুখী হওয়া যায়না।
– আমার এতদিনের অনুভূতির কোনো মূল্য নাই তোর কাছে? থাকবেই বা কিভাবে, শাওন ভাই এত ভালোবাসতো তোকে, তার জন্যই কহনো কষ্ট হয় নাই তোর আর আমি কে? তুই খুবই স্বার্থপর চারু। অনেক স্বার্থপর তুই। অন্যের অনুভূতি মূল্য দিতে জানস না তুই।
– আমি মানুষ বিন্দিয়া৷ কোনো ফেরেশতা নই আমি। মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। আমি না কখনো দুধে ধোয়া তুলসীপাতা ছিলাম আর না এখন আছি। আমার জন্য যেমন অনেকের জীবন নষ্ট হয়েছে তেমনি অনেকের জন্যই আমার জীবন নষ্ট হয়েছে। কিন্তু আফসোস, এইসবের মাঝখানে ফেসে গিয়েছিলো শাওন ভাই। তাকে আমি সম্মান করি ঠিকই তবে ভালোবাসতে পারিনি।
– তুই কখনো কাউরে ভালোবাসোস নাই চারু। তাই আমার অনুভূতি তুই বুঝিবি না।
বিন্দিয়া উঠে চলেই যাবে এমন সময় চোখ পড়লো দরজায়। ফাতেমা শুনে নিয়েছে সব। তার আখি অশ্রুজল পরিপূর্ণ। একটা মেয়ে তার স্বামীকে ভালোবাসে আর সেই মেয়েটা ঠিক তেমন যেমন মেয়ে তার স্বামী পছন্দ করে। এর চেয়ে ভয়ংকর বোধহয় আর কিছু নেই। নিজের স্বামীর পাশে অন্য মেয়েকে কল্পনা করলেও মেয়েদের আত্মা কেপে উঠে। ফাতেমা হাজার চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারছেনা। হামিদকে সে ভালোবাসে। কিভাবে হামিদকে অন্য কারোর সাথে দেখবে? নাহ! হামিদ কখনো এমন করবেনা। করতে পারেনা৷ হামিদ হয়তো ফাতেমাকে ভালোবাসেনা কিন্তু ফাতেমাকে সে ঠকাবেনা। কখনোই না।

★★★

– আমি যদি মইরা যাই তাইলে কি আপনে আবার বিয়া করবেন?
– করমু না ক্যান? আমার বয়স মাত্র ২৩, তাও পুরাপুরি হয় নাই এখনো। আমি কি সারাজীবন একা থাকমু?
– কয়দিন পর বিয়া করবেন?
– যতদিন না কবরের মাটি শুকায়। মাটি শুকাইলেই মাইয়া দেখা শুরু করমু। এইবার আর আগের মতো ভুল করমু না।
– আমি চারুরে বলমু যেনো প্রতিদিন আমার কবরে পানি দেয়। তাইলে আমার কবর কোনোদিন শুকাইবো না।
হামিদ অদ্ভুত দৃষ্টিতে ফাতেমার দিকে তাকালেও পরক্ষণেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো,
– তাই নাকি? তাইলে তো আমার আর বিয়া করাই হইবো না।
– হুম। আচ্ছা আমি বাঁইচা থাকতে কি আপনে আবার বিয়া করবেন?
– তুমি বাঁইচা থাকলে বিয়া করমু ক্যান?
– করবেন না তো?
– না।
– সত্যি?
– মেজাজ খারাপ করবা না আমার। আমার কোনো প্রেমিকা নাই যে বউ রাইখা বিয়া করতে যামু তারে। তাছাড়া আমার শরীরে নাজিমুদ্দিনের রক্ত থাকলেও আমার চরিত্র তার মতো না।
হামিদের উত্তরে ফাতেমা যেনো অনেকাংশে নিশ্চিন্ত হলো। হামিদ সচারাচর কখনো মিথ্যা বলেনা। হামিদ যেহেতু বলেছে, বিয়ে করবেনা তার মানে সত্যিই বিয়ে করবেনা।
– আমার একটা আবদার রাখবেন?
– কি আবদার?
– আমারে একটু জড়ায়া ধইরা ঘুমাইবেন?
– আমার শরীরে কারোর স্পর্শ লাগলে আমি ঘুমাইতে পারিনা।
– আমি ঘুমাইলে নাহয় সরায়া দিয়েন। এহন একটু ধরেন।
– কি হইছে তোমার?
– কিছু হয় নাই। আমার অনেক ভয় লাগে, মনে হয় আপনে একটু দূরে গেলেই আমি আপনেরে হারায়া ফেলমু। তাই সবসময় আপনের কাছে থাকতে ইচ্ছা হয়। আপনে আমারে ভালো না বাসলেও আমি আপনেরে সত্যিই অনেক ভালোবাসি। এহন বুঝবেন না কিন্তু যহন থাকমু না তহন বুঝবেন।
– কই যাইবা?
– হয়তো মইরা যামু। হায়াত মউতের কথা তো বলা যায়না। ভাবতেই কষ্ট লাগলে আমি মরলে আপনে আবার বিয়া করবেন। পরকালে কেউ আল্লাহর কাছে আপনের ভাগ চাইবো।
হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় হামিদ ফাতেমার দিকে তাকালো। চোখেমুখে নিদারুণ উদাসীনতা। মেয়েরা মৃ*ত্যুর পরেও স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে নারাজ। এই প্রথমবার ফাতেমার জন্য মায়া লাগলো হামিদের। ফাতেমার আবদার রাখতেই হামিদ একহাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ভালোবাসার মানুষটির সানিধ্য পেয়ে ফাতেমাও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো। ফাতেমা জানে হামিদ তাকে ভালোবাসনা কিন্তু তাও ভালোবাসার মানুষটির বুকে কতটা আরাম, কতটা প্রশান্তি!

বিঃদ্রঃ যারা বিজ্ঞানমনস্ক তারাই গল্পটা পড়ে মজা পাবেন। বাকিদের কাছে জগাখিচুরি লাগতে পারে।

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
|৪০|
_________________________

– শুনেন আপনে ওই মাইয়ার সাথে আর কথা বলবেন না।
– কোন মাইয়া?
– চারুর বান্ধবী বিন্দিয়া।
– ক্যান কি হইছে?
– ওই মাইয়া আপনেরে পছন্দ করে।
– তো কি হইছে? একজন মানুষ আরেকজন মানুষরে পছন্দ করবো সেইটাই স্বাভাবিক।
– ওই মাইয়া আপনেরে আমার কাছ থেইকা কাইড়া নিতে চায়। আপনেরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আপনে ওর সাথে আর কথা কইবেন না। আমারে ছাড়া যদি আপনে কোনো মাইয়ার দিকে তাকান, তাইলে যেনো আপনের চোখ অন্ধ হইয়া যায়। দরকার হইলে অন্ধ স্বামী নিয়া আমি সারাজীবন পার করমু।
– কিসব আজাইরা কথা বলতাছো? ও তো চারুর বান্ধবী।
– আমি জানি। সব জাইনাই বলতাছি।
হামিদ ভ্রু কুচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো। ফাতেমার কথায় ঠিক কতটা সত্যতা আছে?
– তোমার কোথাও ভুল হইতাছে না তো?
– দেহেন, এত কথা আমি কইতে পারমু না। আপনে আর ওর সাথে কথা কইবেন না।
– লতা ঘুম থেইকা উঠছে?
– কথা বদলাইতাছেন ক্যান?
– কই বদলাইলাম কথা? অনেকক্ষণ যাবত দেখতাছি না তাই দেখতে ইচ্ছা করতাছে।
– ও চারুর কাছে আছে। পুতুল আর লতাকে নাস্তা করাইতাছে।
– আমি দেইখা আসি।
হামিদ আর সেখানে দাঁড়ালো না। খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো এইসব শুনতে। বিন্দিয়াকে নিয়ে কখনো তার মনে আলাদা কোনো ভাবনা ছিলোনা। এখনো নেই। ফাতেমার সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না বিধায় এভাবে উঠে চলে এলো। লতা আর পুতুল মোটামুটি চারুর গলায় ঝুলে আছে, কিন্তু খেতে চাইছেনা। দুজনকেই চারু বকে বকে খাওয়াচ্ছে তবে চারুর ধমকে দুজনের একজনকেও ভয় পেতে দেখা গেলোনা।
– আমার আম্মাজান কি করে?
হামিদের আওয়াজ পেতে একলাফে লতা তার কোলে উঠে গেলো। হামিদও বুকে জড়িয়ে নিলো মেয়েকে।
– ফুপ্পি কি বকা দিচ্ছে মা?
লতা ঠোঁট ফুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। লতার এহেন আচরণে হামিদ এবং চারু দুজনেই হেসে উঠলো।
– তোমার মেয়েটা প্রচুর আহ্লাদী জানো? ওর নাম লতা না হয়ে আহ্লাদী হওয়া উচিত ছিলো।
– ইশশ রে! আকিকা দিয়া দিছি, নইলে ওর নাম আমি আহ্লাদীই দিতাম। সুন্দর নাম।
– আমি আর খা-বো-না মা।
পুতুল টেনে টেনে বললো কথাটা। প্রতিউত্তরে চারু ধমক দিয়ে আরেকটু খাওয়ালেও পুরোটা শেষ করাতে পারলো না। আজকাল পুতুল চারুকে একদমই ভয় পায়না। পুতুল দৌড়ে ছুটে গেলো ঘরে।
– আমি কহনো ভাবি নাই, তুই পুতুলরে এত সহজে মাইনা নিতে পারবি। বেশ চিন্তা করতাম এই মাইয়াটারে নিয়া।
– না মানার কি আছে?
– অনেক কিছুই আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার ও তোর নিজের মাইয়া না।
– সৎ মায়ের কষ্ট আমি জানি। আমি কখনো চাইনা কেউ আমাকে শেফালীর সাথে তুলনা করুক। ওর দায়িত্ব এখন আমার, আর আমি সর্বোচ্চ দিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করবো। আমি ওকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই।
– আর তোর ভবিষ্যৎ? সেই যে কবে এইচএসসি দিলি আর তো কোনো খবরই নাই তোর পড়াশোনার।
– মেডিকেলে এপ্লাই করবো ভাবছি।
– কোনোদিন একটা অক্ষরও তো পড়তে দেখলাম না। মেডিকেল পড়া এত সহজ না। সবাই চান্স পায়না।
– আমি না পারলে আমার মেয়ে পড়বে।
– বাহ! মেয়ের প্রতি অনেক ভালোবাসা জন্মাইছে দেখা যায়।
– সত্যি বলতে আগে ছিলোনা জানো! শুধুই কর্তব্যবোধ থেকে সবটা করেছি। একদিন প্রচুর ঝড় হচ্ছিলো, সাথে বজ্রপাত। পুতুল বজ্রপাতের শব্দে খুব ভয় পায় সেটা আমি জানতাম না। তাই ওকে ঘরে বসিয়ে আমি চলে গেলাম রান্নাঘর। এমন সময়েই খুব জোরে বজ্রপাত হতেই পুতুল মা মা বলে চিৎকার করে উঠলো। আমি দৌড়ে গেলাম ঘরের দিকে। আমাকে পেয়েই শক্ত করে সেদিন মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। সেদিন বুঝেছিলাম, এই মেয়েটার কাছে আমি সত্যিই একটা ভরসার জায়গা। মাকে তার সন্তান যতটা ভরসা করে এই মেয়েটাও আমাকে ঠিক ততটাই ভরসা করে। এরপর আর পারিনি তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে। স্কুলে যখন প্যারেন্টস মিটিং হলো, মেয়েটা অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস নিয়ে আমাকে সবার কাছে নিজের মা হিসেবে পরিচয় দিলো। সেদিন তার চোখেমুখে থাকা খুশি দেখেই বুঝেছিলাম আমাকে পেয়ে ঠিক কতটা খুশি সে। এরপরও তাকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। মেয়েটা আমাকে প্রচন্ড ভরসা করে আর একইসাথে ভালোও বাসে। কেনো আমি জানিনা। তার প্রতি এত অনুরাগ আমি দেখাইনি কিন্তু তার অনুরাগে আমি তাকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছি বলা চলে। মা মানেই একটা নিরাপত্তা। একটা নির্ভরযোগ্য আবাসস্থল। এই সময়ে একটা মেয়ের তার মাকে কতটা প্রয়োজন হয় আমি সেটা জানি। মায়ের মাধ্যমে আমার যে ঘাটতিটা পূরণ হয়নি আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি সে ঘাটতি যেনো পুতুলের মাঝে না আসে। এই বয়সেই মেয়েরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির স্বীকার হয় পুরুষ শাসিত সমাজে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা নিজের নিজের আপন মানুষের মানুষের দ্বারা। শুনতে ঘৃণার হলেও সত্য যে, বাবা, ভাই, মামা, কাকা, বাবার খুব ভালো বন্ধু এইধরণের আপন মানুষের কাছেই আজ মেয়েরা সুরক্ষিত নয়। তোমার মনে আছে, আমাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যেতে আমার অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। জামাল হোসেন ঠিকঠাকভাবে চিকিৎসা করায়নি আমার। তুমিই পরবর্তীতে ডক্টর দেখিয়েছিলে। সেখানে গাইনি চেম্বারে যাওয়ার পর আমি এক মেয়েকে দেখেছিলাম যে বাচ্চা নষ্ট করতে এসেছিলো। ভেবেছিলাম বাচ্চাটা তার বয়ফ্রেন্ডের। কিন্তু কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর জানতে পারলাম বাচ্চাটা তার নিজের বাবার। সেদিনই প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম, আমার যদি কখনো কোনো মেয়ে হয়, আমি তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবো। আমার মেয়ে যার কাছে যেতে অস্বস্তি বোধ করে তার কাছে কখনোই আমি আমার মেয়েকে যেতে দেবোনা। সেটা যদি তার নিজের বাবা হয় তাও না। আমার মেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হবো আমি যার সাথে সে নিঃসংশয়ে সব বলতে পারবে। মা আমাকে সবসময় বুঝলেও তার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কারণ সমাজ। মা প্রচন্ড সমাজরক্ষা করতে চাইতো, তাই সে সকলক্ষেত্রে আমাদেরই শাসন করতো। আমাদের দোষ না থাকলেও করতো। আমি এইসব সো কল্ড সমাজব্যবস্থা মানিনা। আমার মেয়ে যেখানে দোষ করেনি সেখানে এক বিন্দুও শাস্তি আমি তাকে দেবোনা। সে দোষ করলে অবশ্যই শাস্তি পাবে তবে নির্দোষ হলে তার জন্য নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে লড়াই করবো আমি। জানো, এখন আমার এক মূহুর্তের জন্যও মনে হয়না এই মেয়েটা আমার নিজের মেয়ে নয়। শেষ কয়েকটা দিন আমার মনে হয়েছিলো, স্বামী সন্তান নিয়ে আমি যথেষ্ট সুখী আছি। আমার আর কাউকে চাওয়ার নেই। কিচ্ছু চাওয়ার নেই। দুনিয়ার সর্বোচ্চ সুখ আমি আমার এই ছোট্ট সংসারেই পেয়ে গেছি।
– সেই সংসার নিয়াই ক্যান থাকলি না চারু? ক্যান এইভাবে জীবনডা বিপদে ফেলতাছস? তোর বা সিফাত ভাইয়ের কিছু হইলে এই মাইয়াডার কি হইবো একবার ভাবছস?
– কেনো তুমি আছো না? তুমি দেখবেনা আমার মেয়েটাকে?
– অবশ্যই আমি দেখমু। কিন্তু মা-বাপের অভাব কি আদেও কেউ পুরন করতে পারে?
– এই লড়াইয়ে আমার জীবন যাবে এমনটা কেনো ভাবছো তুমি? হতে পারে আমরা বেঁচে গেলাম আর এই নরপিশা*চরা শাস্তি পেয়ে গেলো।
– সেইটা হইলে তো ভালোই হয়। কিন্তু তারা তো আর সাধারণ মানুষ না। তাদের শা*স্তি দেওয়া কি এতটাই সহজ?
– বাদ দাও তাদের কথা। ভালো লাগছেনা। তোমরা তো কিছুই করলেনা, এখন যা করার আমাকেই করতে হবে।
– কি করবি?
– সেইটা নাহয় তুমি না-ই জানলে। ভাবিকে একবার গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখিয়ো তো। আমিই যেতাম কিন্তু সময় করতে পারছিনা।
– না আমি যামুনা। ওরে নিয়া যদি আমি রাস্তায় বের হই সবাই অবাক হইয়া তাকায়া থাকে। কেউ কেউ তো ওর গায়ের রঙ নিয়া কটু কথাও বলে। আমার খুব আত্মসম্মানে লাগে, আমার এমন কালো বউ।
– কালো কি আল্লাহ বানায় নি?
– বানাইবো না ক্যান? অবশ্যই আল্লাহ বানাইছে। সব মানুষের ভিন্ন রুচিবোধও আল্লাহই বানাইছে। আমার কালা পছন্দ না, এইটা তো আল্লাহরই দেওয়া।
– এইটা নিজের ব্যক্তিগত মনোভাব। যাক, সেসব বাদ দাও। তোমার মেয়েটা কিন্তু দারুণ মিষ্টি।
– হুম ঠিক বলছস। দেখলেই পরান জুরায়া যায়।
– এখন থেকেই রূপচর্চা করানো শুরু করে দাও। বড় হলে কিন্তু অনেক মেয়ে-ই কালো হয়ে যায়।
– রূপচর্চা করাইলে কি ন্যাচেরাল স্কিন থাকে নাকি?
– কালো হয়ে যায় যদি? তখন তো মেয়েকে তুমি ভালোবাসবে না। কালো মেয়ে কে ভালোবাসবে বলো?
– পাগল হইছস তুই?
– পাগল হওয়ার কি আছে? তোমার মেয়ে কালো হয়ে গেলে তোমার নিজেরও তার বিয়ে নিয়ে চিন্তা হবে। বিয়ের পর স্বামীর ভালোবাসা পাবেনা। বাবার বাড়ি এসে বাবার ভালোবাসা পাবেনা। এরচেয়ে ভালো এখন থেকেই রূপচর্চা শুরু করাও।
– মানে? কি কইতে চাইতাছস তুই? আমার মাইয়া কালো হইলে আমি তারে ভালোবাসমু না? ক্যান বাসমু না আজব! ও তো আমারই মাইয়া। গায়ের রঙের জন্য আমি আমার মাইয়ারে ফালাইয়া দিমু?
– ভাবিও তো তোমার বউ। তবে কালো রঙের জন্য তাকে কেনো অবহেলা করছো?
– তুই ওর সাথে আমার মাইয়ার তুলনা করতাছস?
– কেনো করবো না? তোমার মেয়ে যেমন তোমার কাছে আদরের, ভালোবাসার তেমনি ভাবিও তার বাবা-মায়ের কাছে আদরের।
– আরে ধুর, ওরে কেউই ভালোবাসেনা। বাপের বাড়ি গেলে দুইদিনও টিকতে পারেনা। ও থাকলেও কারোর কিছু যায় আসেনা, ও না থাকলেও কারোর কিছু যায় আসেনা।
– যায় আসে। ভাবি না থাকলে কারোর অনেক কিছু যাবে আসবে। এত ভেতরে যাচ্ছিনা আমি। তুমি নিজের মেয়েটাকে দেখো। মা ছাড়া একটা মেয়ে কতটা অসহায় তা তোমরা ছেলেরা কল্পনাও করতে পারবেনা। প্রতি পদে পদে সে বিপথে গেলেও তাকে ঠিক করার কেউ থাকবেনা।
– আমার মাইয়া আমারেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মা না থাকলেও ও অনায়াসে আমার কাছে কোনো সমস্যা ছাড়াই থাকতে পারবো।
– সম্পূর্ণ ভুল ধারণা নিয়ে থাকছো তুমি। তোমার স্ত্রীকে তোমার প্রয়োজন না হলেও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমার মেয়ের।
– আমার ব্যাপারটাও একবার দেখ। সব মানুষেরই নিজের বউরে নিয়া একটা এক্সপেকটেশন থাকে। আমারও ছিলো। আর স্বাভাবিক ভাবেই আমি সুন্দর বউ চাইছিলাম। হ্যাঁ, আমি যদি অসুন্দর হইতাম তাইলে হয়তো আমি এমন করতাম না। কিন্তু আমার তো কোনো দিক দিয়াই কম নাই, তবে আমি কি এমন কিছু ডিজার্ভ করি?
– সৃষ্টিকর্তাই উত্তর পরিকল্পনাকারী। তিনিই তোমার ভাগ্য ভাবির সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন। তুমি নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি বোঝোনা। হ্যাঁ এক্সপেকটেশন থাকতেই পারে। স্বাভাবিক, সবারই এক্সপেকটেশন থাকবে কিন্তু তাই বলে সে এক্সপেকটেশন যে পূরণ হবে তেমন তো কোনো কথা নেই। এই স্বাভাবিক বিষয়টা কেনো মানতে পারছো না তুমি?
– আমি তো চেষ্টা করতাছি। আমি কি কহনো কোনো কিছুতে তারে কষ্ট দিছি? ভালো খাইতে দেই, পড়তে দেই। সবই তো দেই।
– একটা মেয়ে তার স্বামীর কাছে শুধু খাওয়া পরার জন্য আসেনা। মানসিক শান্তিও চায়। ভালোবাসাও চায়। খাওয়া পরার অভাব হয়তো সে কষ্ট হলেও পূরণ করতে পারবে কিন্তু ভালোবাসার অভাব সে কখনোই পূরণ করতে পারবেনা। ভাবি হতে পারে কালো কিন্তু তার ভেতর যে স্বচ্ছ ভালোবাসাটা আছে, সেটা এই পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র ভালোবাসা। দুনিয়ার সব ভালোবাসা একত্রিত করেও তুমি সে ভালোবাসা কিনতে পারবেনা। অনেক সুন্দর মেয়ে তুমি বিয়ে করতে পারো কিন্তু তুমি যে ভালোবাসা পাবে তার নিঃশ্চয়তা নেই। এখন ভালোবাসা পাচ্ছো তাই অভাবটা অনুভব করতে পারছোনা। ভালোবাসা ছাড়া মানুষ কখনো বাঁচতে পারেনা।

★★★

সারা উঠোন জুড়ে পায়চারি করছে সিফাত। হাতে বেশ ভালো একটা মুঠোফোন তবে চোখেমুখে বিরক্তি। চারু অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ্য করে যাচ্ছে তাকে। একপর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে বলেই ফেললো,
– সমস্যা কি আপনার? সারা উঠোন জুড়ে এভাবে পায়চারি করছেন কেনো?
– পায়চারি কি সাধে করছি? নেটওয়ার্কের অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই। কারোর সাথে যোগাযোগ হচ্ছেনা আমার।
– সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? আপনি তো জানতেনই এখানে কোনোপ্রকার উন্নত প্রযুক্তি পৌছায়নি। উনিশ শতকের মতো গ্রাম।
– ছয় বছরেও এমন অবস্থা হবে সেটা ভাবিনি।
– গ্রামের উন্নতির চেষ্টাই করা হয়না, উন্নয়ন হবে কিভাবে?
– সবাই কোথায় বলুন তো। কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।
– ভাইয়া ভাবিকে আর লতাকে নিয়ে গেছে গ্রাম দেখাতে। আর পুতুলের বার্গার খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এই গ্রামের আশেপাশের কোনো গ্রামে বার্গার আছে কি না সন্দেহ। তাই হিমেল তাকে নিয়ে কোনো বার্গার স্টল খুজতে গেছে। হিমেল কতবার বলেছিলো, “তুমি বাচ্চা মেয়ে এতদুর যেতে হবেনা। তুমি এখানেই থাকো আমি নিয়ে আসবো।” কিন্তু মেয়ে তার কথা শুনলে তো। একপ্রকার কান্নাকাটি করে চলে গেলো।
– আজকাল মেয়েটা ভীষণ জেদি হয়েছে। এই রোদে কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে!
– আপনি কিছু খাবেন?
– জোর করে থাকছি সেটাই কত, আবার খাওয়া দাওয়া। রাগ করবেন না?
– জোর করে আসুন আর যেভাবেই আসুন, আপনি এখন আমাদের মেহমান। মেহমানকে ক্ষুদার্ত রাখার মনোভাব আমার অন্তত নেই।
আপনি কি আমার উপর খুব বেশি রেগে আছেন বেলিফুল? মাফ কি করা যায়না? একটিবারের জন্যও কি আবার আপন করে নেওয়া যায়না?
– না।
– একটা প্রশ্ন করি?
– কি?
– আপনি কি এখনো শিহাবকে ভালোবাসেন?
চারু উত্তর দেয়না। স্বামীকে বলা যায়না সে অন্য পুরুষকে ভালোবাসে। অবশ্য ভালোবাসে বললেও হয়তো এখন ভুল হবে। সাধারণ কিছুটা অনুভূতিই অবশিষ্ট আছে তার প্রতি। এই মানুষটাই বোধহয় নিঃস্বার্থভাবে চারুকে এতটা ভালোবেসেছিলো। শাওনের ভালোবাসায় খাদ থাকলেও শিহাবের ভালোবাসায় ছিলোনা। শাওন তো পাওয়ার জন্য ভালোবেসেছিল আর শিহাব পাবেনা জেনেও ভালোবেসেছিলো,
– বলুন না বেলিফুল! এখনো ভালোবাসেন তাকে?
– আমি যদি এখন আপনার মন রক্ষার্থে না বলি তবে সেটা মিথ্যা হবে। তবে এটাও সত্য যে তার প্রতি অনুভূতি খুবই সামান্য। এই সামান্য অনুভূতি থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে সিফাত? আমি আপনার জায়গা তাকে দেইনি কিংবা আপনাকেও তার জায়গা দেইনি। আপনারা দুজনেই আমার দু’রকম ভালোবাসা। আপনি আমার স্বামী, যার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। হাজারো বাধা বিপত্তি আসলেও তা আমি অস্বীকার করতে পারবোনা আর শিহাব আমার কাছে খুবই সম্মানের একটা জায়গা। দুজন কখনোই এক নয়। দুজনকে যদি আমি দুই জায়গা থেকে ভালোবাসি তবে কি আপনার খুব বেশি অসুবিধা হবে?
– না হবে না। আপনার মনে যে এখনো আমার জন্য জায়গা আছে তাতেই আমি খুশি। তবে শিহাব যদি আবার আপনার কাছে ফিরতে চায় তবে আবার আমাক্ব রেখে চলে যাবেন না যেনো। আমি পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবো। আপনি অন্য কারোর হতে পারেননা। আগে যা হবার হয়েছে এখন আপনার সবটুকু আমার। আমার বেলিফুলের এক বিন্দু ভাগও আমি কাউকে দেবো না।
– শিহাব অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। আমি তার যোগ্য নই। সে আবার আমাকে ফিরিয়ে নিতে চাইলেও আমি যাবোনা, যেতে পারবোনা। ব্যাস আমার এখন সুন্দর একটা সংসার আছে। একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। তাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার মতো দুঃসাহস আমি করবো না। আমার সংসারেই আমি বেশ আছি।
– স্বামীও কিন্তু আছে।
চারু উত্তর দেয়না। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই সাজিদ আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে ধরে,
– আর কতদিন আপনি রেগে থাকবেন আমার উপর? দুনিয়ার সবার ভালোবাসা আপনার চোখে পড়ে শুধু আমার ভালোবাসাটাই আপনার চোখে পড়েনা তাই না? আমি কিন্তু ভীষণ রকমের জেলাস নিজের জিনিসের প্রতি৷ আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন সেক্ষেত্রে আমি কিছু করতে পারবোনা। পারলে হয়তো আপনাকে তাকে ভালোবাসতে দিতাম না। এখন সেটা যেহেতু আমার হাতে নেই তাই আপনি আমাকে প্রচুর ভালোবাসবেন। এতটাই ভালোবাসবেন যেনো অন্যদের ভালোবাসা তার কাছে ফিকে হয়।
– ওমনি আমি জিনিস হয়ে গেলাম?
– হুম হয়ে গেলেন। আপনি আমার জিনিস। শুধুই আমার জিনিস।

★★★

– আপনি এইখানে? কেমন আছেন?
মিহি সুরেলা একটি নারীকণ্ঠ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালো হামিদ। হামিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিন্দিয়া। বিন্দিয়াকে দেখে কিছুটা রাগ হলো হামিদের। একটা মানুষ কতটা ব্যক্তিত্বহীন হলে বিবাহিত জেনেও একটা ছেলের পিছু এভাবে করতে পারে।
– ক্যান? আমার কি এইহানে আসা মানা?
– না মানা হইবো ক্যান? আমি তো এমনেই জিজ্ঞেস করতাছিলাম এইহানে কি করেন।
– আমি কই যামু, কি করমু তার অনুমতি নিশ্চয়ই আমি তোমার থেইকা নিমু না।
হামিদের এই কঠোর উত্তরে কিছুটা দমে যায় বিন্দিয়া। হামিদের এহেন আচরণের উদ্দেশ্য উদঘাটন করতে পারেনা সে।
– আপনি এমন করতাছেন ক্যান আমার সাথে?
– আমি তোমার সাথে কিছুই করি নাই। যেই কাজে আসছো সেই কাজ করে বাসায় যাও। যার তার আদিক্ষেতা আমার পছন্দ না।
– আমি অদিক্ষেতা করতাছি? আপনে বুঝেন না আমি এমন ক্যান করি?
– না বুঝিনা।
– ক্যান বুঝেন না? আপনেরা দুই ভাই-বোন এমন ক্যান? ক্যান আপনেরা অন্যের অনুভূতি বুঝেন না তার মূল্য দিতে পারেন না?
– তোমার অনুভূতির মানে থাকলে নিশ্চয়ই দাম দিতাম। দামহীন অনুভূতির মর্যাদা দিতে গেলে নিজেরেই ছোট হইতে হয়।
– আমি ভালোবাসি আপনেরে। নিজের সবটা দিয়া সবসময় ভালোবাসছি তয় ক্যান আপনে আমার অনুভূতির দাম দিবেন না?
– কারণ আমার বউ, বাচ্চা আছে।
– তো আপনের কালা বউরে ছাইড়া দেন। আর না ছাড়তে চাইলে না ছাড়েন একটা মানুষের কি দুই বউ থাকেনা?
– পাগল হইছো তুমি?
– পাগল হওনের কি আছে? ফাতেমা ভাবি তো এমনেই কত কালা। আপনেরও সুন্দর বউ পাওনের অধিকার আছে। তাছাড়া আমি তো তারে ছাইড়া দিতে কইতাছি না। আপনের পায়ের এক কোনায় আমারে দয়া কইরা ঠাই দেন।
– বাজে কথা কইবা না। এইটা কোনোদিনও সম্ভব না।
– ক্যান সম্ভব না? আমাগো ধর্মও তো পোলাগো চার বিয়ার সুযোগ দিছে। আপনে তো খালি দুইটা বিয়াই করবেন।

★★★

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বাইরের চৌকিটার একপাশে বসে আরাম করে বার্গার খাচ্ছে পুতুল। চারিদিকে হাওয়া বইছে। প্রকৃতি দেখলেই অনুমান করা যায় কিছুক্ষণ পর বড়সড় ঝড় হবে। চৌকির অপরপাশে বসে আছে হিমেল আর হিমেলের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে আছে চারু। হিমেলের হাতে একটি পুরোনো খাতা। খাতাটি দেখেই চারু বুঝতে পারলো এটি মাস্টারমশাইয়ের খাতা। ছোটবেলায় এই ধরনের খাতাতেই মাস্টারমশাই সকলের নাম, পরিচয় লিখে রাখতো কিন্তু এই খাতা হিমেলের কাছে কেনো?
চারুকে অবশ্য প্রশ্ন করতে হলোনা,
– তোমার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, এই পুরোনো খাতাটা আমার কাছে কেনো?
– প্রশ্নটা যখন জানেন তখন উত্তরটাও বলে দিন।
– স্কুলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছিলো। কোনো কাজ ছিলোনা বলে এমনিই এটা সেটা ঘাটাঘাটি করছিলাম, তার মধ্যে এই খাতাটায় আমি ভয়ানক একটা জিনিস জানতে পেরেছি চারুলতা।
– তথ্যটা পরে শুনবো আগে আপনি বলুন, আপনাকে এইগুলো ধরতে দেওয়ার কথা নয়। আপনি কিভাবে এসব এত সহজে ঘাটাঘাটি করলেন?
– মাস্টারমশাইকে তোমার কথা বলতেই তিনি আর কিছু বলেননি।
– ঠিক আছে। এখন বলুন কি জানলেন?
– আগে তুমি বলো শিহাবের নাম কি?
– মানে?
– মানে শিহাবের সম্পূর্ণ নাম কি?
– সেটা তো জানিনা।
– তাহলে তুমি এইটা দেখো।
চারু খাতাটা নিতেই গোটা গোটা অক্ষরে চোখ পড়লো একটা নামে, “শিহাব আজমীর অভি” পিতার নাম, আনন্দমোহন আজমীর রহিম।
চারু থমকে গেলো। এই গ্রামের জমিদারের নাম আনন্দমোহন আজমীর রহিম, আর তারই বড় ছেলে শিহাব। চারু স্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নামটির দিকে। এইটা কি শুধুই কাকতালীয়? চারুর মনে হচ্ছে প্রকৃতির ঝড়ের চেয়েও বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর বুকে।

বিঃদ্রঃ আমি বাসায় নেই। বাসার বাইরে অন্যকোথাও লেখালেখি করা কতটা কষ্টের সেটা এক লেখিকাই জানে। একেবারেই লেখার স্পেস পাইনি। রিচেকও হয়নি। কষ্ট করে লিখেছি, তাই যারা পড়ছেন সবাই প্লিজ রেসপন্স করবেন।😇

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া