#অতিরিক্ত_চেয়েছি_পূর্ণতায়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১২
ফারিজা মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছে ইশরাকের সামনে। সে মুগ্ধরুপে তার প্রেয়সীকে দেখছে। এতদিন যাকে মনপ্রান্তে একতরফা ভালোবেসে ছিল। সেই নারী স্বেচ্ছায় সামান্য ক্ষত দেখেই অস্থিরচিত্ত হয়ে ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ বলে অস্থির হচ্ছে। ভাবা যায় এই গম্ভীর মেয়েটিও অচেনার বেশে বন্ধুত্বের রুপে থেকেও ভালোবেসেছে। ইশরাক ‘কুশ কুশ’ করে কণ্ঠনালী কাশির মত করে কেশে দেয় শব্দ করে। ফারিজা উত্তেজিত হয়ে পানির বোতল থেকে ওয়ান টাইম গ্লাসে পানি ঢেলে ইশরাকের ঠোঁটের অন্দরে পুরে দেয়। প্রেয়সীর হাত থেকে পান করতে পেরে যেন চাঁদ হাতে পেল সে। তৃপ্তি সহকারে পান করে চোখ বুজে। অন্যত্রে ফারিজা আহত ইশরাকের শরীর দেখে অন্তরে ফুঁপাচ্ছে। শুধু চোখ বেয়ে জল পড়াটাই বুঝি তার বাকি আছে। মুচকি হেসে বলে,
‘কাঁদছিস কেন রে গাধী!’
‘তোর কষ্ট হচ্ছে দেখেই কাঁদছি সুখে তো আর কাঁদছি না খব্বিশ একটা!’
‘এই অসুস্থ অবস্থায় মানুষকে গা’লি দিতে নেই জানিস না।’
ফারিজার মাথায় চা’টি মে’রে বলল ইশরাক। তখনি হুট করে কেবিনের ভেতর চলে এলো একজন অপরিচিত ব্যক্তি। ইশরাক দেখে চিনলেও ফারিজা চিনতে পারেনি সামনে দাঁড়ানো সুদর্শন যুবকটিকে। ব্যক্তি মৃদু হেসে এগিয়ে এসে বলে,
‘কে করেছে তোর সাথে এসব!’
ইশরাকের মুখ মলিনতায় ছেয়ে গেল। সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির হাত ধরে বলে,
‘রাফু দোস্তকে আগলে রাখ ভাই। ইশিতার শয়তান স্বামী তার পিছু নেওয়া শুরু করেছে। জানি না কেনো করছে তবে এটুকু জানি অনেক বড় ষড়যন্ত্র করতেছে সে তোদের মাঝে দেওয়াল তৈরি করার জন্য।’
ফারিজা ভাবুক দৃষ্টিতে দুজনের কথোপকথন শুনছে। আশ্চর্যের ব্যাপার ইশরাক প্রশয় সহকারে রাফিয়ার নামে কথা বলছে। যা দেখে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে তার মনে। হাত মুঠোবদ্ধ করে বিড়বিড়ে বলে,
‘মেডিক্যালে অসুস্থ অবস্থায়ও ইশরাককে ছাড়ছে না বাল’খোড় মেয়েটা।’
রাফিয়ার নাম বারংবার ইশরাকের মুখে উচ্চারিত হতে শুনে নিজের জেদকে দমিয়ে রাখতে পারল না ফারিজা। ফোঁস করে ক্ষোভিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠে।
‘আপনারা কি নিয়ে কথা বলছেন! আর এখানে রাফিয়ার নাম কেনো নেওয়া হচ্ছে। ঐ বে**….।’
গা’লিপূর্ণ অশুদ্ধ শব্দটি বের করার পূর্বেই তার গালে জোরালো চ’ড় বসায় সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি। ইশরাকও অগ্নি দৃষ্টিতে ফারিজার দিকে তাকায়। ব্যক্তিটি আড়চোখে ইশরাকের দিকে চেয়ে পুনরায় ফারিজার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘চ’ড়টা যদি সেদিন মা’রতাম যেদিন আপনি আর আপনার ফ্রেন্ডসার্কেল রাফিয়াকে যা নয় তাই বলে অপমান করে ছিলেন তখন শিক্ষা হতো। কিন্তু কপাল ভালো ছিল আপনার যে বেঁচে গেলেন। না হলে এই রুজহানের প্রাণচঞ্চলোণী রাফিয়াকে অপমান করার সাধ্য কারো নেই। মাইন্ড ইট। সো ইশরাক বাকিটা তোর কাজ আসি আজ।’
ফারিজার দিকে তিক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে কেবিন থেকে প্রস্থান করে। ইশরাক পাল্টা প্রশ্নও করতে পারল না। কিন্তু চমকে গিয়ে ছিল রুজহানের কথায়। তার প্রেয়সী কাউকে অপমান করেছে তাও আবার অসহায় নিরব বান্ধবীকে! নিবিড় নেত্রজল নিয়ে ফারিজার উপর চাহনী নিক্ষেপ করে। শুকনো ওষ্ঠযুগল জিভ দ্বারা ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘তুই কি রাফুকে অপমান করেছিস!’
নিশ্চুপ সে। ইশরাক অবাক হলো ফারিজার মৌনতা দেখে। বিনিময়ে তাচ্ছিল্যের হেসে বলতে লাগল।
‘রাফুর সাথে দেখা করেছিলাম তোকে প্রপোজ করার কৌশল জানতে। সেখানে রাফু তোকে প্রপোজ করার জন্য গোলাপে সজ্জিত একটা ক্লাব বুক করার পরামর্শ দেয়, তোর হাতের সাইজের ডায়মন্ড রিং চয়েজ করে ক্লাবে সারপ্রাইজ দেয়। দেখবি বিয়ে পাক্কা!’
রাফিয়ার কথামত ইশরাকও সুবর্ণ সুযোগ পেল ফারিজাকে মনের কথা বলার। ফলে সে সময় নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ স্বরুপ কৃতজ্ঞতা জানাতে। রাফিয়া অবশ্য ব্যাপারটা ধন্যবাদের সুবাদে নিয়ে ছিল। কিন্তু তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যে কেউ তাদের দেখছিল সেটা বুঝেনি রাফিয়া বা ইশরাক। রাফিয়াকে দাঁড় করিয়ে ইশরাক দৌড়ে মার্কেটের দোকানে ঢুকে। একবক্স মিল্ক সেইক চকলেট বক্স কিনে ছুটে এলো রাফিয়ার নিকট। রাফিয়া হা করে তাকিয়ে রইল ইশরাকের দিকে। পাগলপ্রেমিকও বুঝি একে বলে! খুশির চটে কি দেবে বুঝতেই পারছে না ছেলেটা। ইশরাক হাঁপাতে থেকে চকলেট বক্সটা রাফিয়ার হাতে দিয়ে বলে,
‘নে বোন তুই উপকার করলি তোর ফাস্ট ট্রিট এটা।’
মৃদু হেসে রাফিয়াও ইশরাকের দেওয়া উপহার গ্রহণ করে বিদেয় নেয়। ইশরাক শান্ত মনে উল্লাসী মনভাব প্রকাশ করতে রোড পাড় হতে গেলে একটি ভ্যান সেখানে চলে আসে। কেনো যে ভ্যানে থাকা লোকেরা ইশরাককে ধরে মা’রতে লাগে। পাল্টা আক্রমণ করার সময়টুকু পায়নি ইশরাক। ইচ্ছেমত মা’র দেওয়ার পর সেই ভ্যানগাড়ির লোকেরা পালায়। রাস্তায় থাকা লোকেরা ইশরাককে তুলে মেডিক্যালে ভর্তি করায়। সাথে তার রিলেটিভদের জানায়। এরই মাঝে ইশরাক খেয়াল করেছিল ভ্যান গাড়িতে রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ইফতিয়াসের চোখজোড়া। সব না হলেও বুঝতে পেরে ছিল রাফিয়ার সঙ্গে তাকে দেখে ইফতিয়াসের মাথা খারাপ হয়েছে। তাই তো বউয়ের ভাইয়ের উপর আক্রমণ করেছে। তাও বিনা দোষে হাহ! সে বুঝতেছে এবার এর সত্যতা রুজহানের জানানো উচিৎ। ফলে আজ সে বলেই দিল।
নিজের কথ্য শেষ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল ইশরাক। অন্যত্রে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ফারিজা। সে ভাবেওনি এক নিরপরাধী মেয়েকে সে ভরা ভার্সিটির মধ্যে অপমান করল! ছিঃ ধীক্কার জানানো উচিৎ তার মত বান্ধবীর উপর। যে কিনা সময়ের সময়ে ছিল কিন্তু অসময়ে লা’থ মে’রে ফেলে দিল। বন্ধুত্বের সম্মান রক্ষার্থে মেয়েটা জবাবদিহিও করেনি। বরং অপদস্থ হয়ে নিশ্চুপে সহ্য করেছিল রাফিয়া। ভাবতেই ফারিজার ইচ্ছে করছে নিজেকে পঁচা নালায় ডুবিয়ে মর’তে। ইশরাক কিছু বলল না। মেয়েটা এমনিই রুজহানের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছে। তথাপি সেও যদি বলে সেটা হবে বাড়াবাড়ি।
নিঃস্বার্থভাবে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে ফারিজার মাথাটা আগলে নেয় ইশরাক। পরম আবেশে সেও প্রিয়তমের বুক ভাসিয়ে নিজের করা কর্মের অনুতপ্ততা প্রকাশ করছে।
______
সময়ের কালক্রমে দুসপ্তাহ কেটে গেছে। রাফিয়া বোবা থাকে প্রায়। চোখ দিয়ে খালি কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়। সেই আগের চঞ্চলতা নেই তার মাঝে! সামিয়া ও তার অনাগত সন্তানের মৃত্যুটা সে মেনে নিতে পারছে না কোনো মতেও। রুজহান ভেবে ছিল অভিমান করে সে নিজেই দূর দূর করে থাকবে। তবে রাফিয়ার মানসিক বিধ্বস্ততা দেখে সে থমকে গেল মাঝপথে। পারল না প্রেয়সীর বিধ্বস্ততা দেখে সহ্য করতে। তার বোবা প্রকৃতির হাবভাব মোটেও সহনশীল নহে তার পক্ষে। অতঃপর কাজের ফাঁকে চেষ্টা করে রাফিয়ার মনকষ্ট দূর করার।
অন্যদিকে নাবিল বসে আছে এক যুবকের সামনে। যার শরীর থেতলে প্রায় রক্তাক্ত করে দিয়েছে সে। রুজহানও বার দুয়েক দিন আগে ইচ্ছেমত কেলিয়ে ছিল। তবে সবসময় সম্ভব হয়নি কেলানোর। কারণ তার এক দায়িত্বও আছে তার প্রেয়সী। নাবিল যুবকের চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে। এতে যুবকের ব্যথা সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হতে লাগে মুখশ্রীতে। নাবিল শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
‘বল ইফতিরা কোথায়!’
শুনে যেন ঢোক গিলল যুবকটা। দু তিন সেকেন্ড হবার পরও যখন সে মুখ খুলল না ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়ে নাবিল। আপসোস মিশ্রিত গলায় বলে,
‘আজ শেষ চান্স ছিল তোর কথা বলার! কোথায় ওরা সেই তথ্য দেওয়ার। কিন্তু তোর কাছে যেহেতু জীবনটাই অপ্রিয় সেহেতু তোর মরণতাও হওয়া উচিৎ এক জঘন্য রুপে কি বলিস!’
নাবিলের কথায় চুপছে গেল যুবকটা। তবুও মৌন রইল। নাবিল জোরে ডাক দেয় তার কনস্টেবলকে। কনস্টেবল হাতে এক বক্স কেঁচো নিয়ে হাজির হই। যুবকের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে বিচ্ছিন্ন দৃষ্টিতে এপাশ ওপাশ ছুটাছুটি করার চেষ্টা করে। কিন্তু পেরে উঠল না। নাবিল বক্সের ঢাকনা খুলে নিসাড়পূর্ণ কণ্ঠে আওড়ায়।
‘এবার না বললে সব কেচোঁ তোর পেটে যাবে। এগুলোর অপকারিতা নিশ্চয় জানিস !’
যুবক চুপ থাকায় নাবিল অপেক্ষা করে না। তার মুখ খুলে হা করে রাখে। কেঁচোর বক্স থেকে একটা লম্বা বড় আকৃতির কেঁচো নিয়ে তার গালের ভেতর ফেলতে নিলে সে চিৎকার করে উঠে। মাথা নেড়ে ‘নাহ নাহ আমি বলছি থামেন!’ বলে হাঁপানোর মত দম ফেলতে লাগল।
নাবিলও যুবকের অগোচরে বাঁকা হেসে সচিষ্টে চেয়ারে বসল। ছেলেটা বলতে লাগে।
‘আমি রাফু,ইশু ও বাকি ফ্রেন্ডের মধ্যে সর্বনিম্ন বোকাসোকা ছেলে মিজবান। আমার সাথে সকলে প্রাঙ্ক করে। কিন্তু আমি যে কত বড় শয়তান সে বিষয়ে কেউ অবগত নয়। আমি অবশ্যই বাজে কাজে জড়ায় না। তবে বিগত দশমাস ধরে আমার মা কোমায় পড়ে ছিল। মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে অনেক কিছু করি। টাকা বেশি হলো না। তখন সহায়তার হাত বাড়িয়ে ছিল ইশিতা। এতে তাকে আমার মনেও ধরে বউ হিসেবে। সে কথা তখনো বলিনি তাকে। মায়ের চিকিৎসার টাকা সে দেবে বলছিল। যার ফলে সে টাকা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করল ঠিক। সময়ের প্রয়োজনে সে ব্যবহার করতে চাইলেই ব্যবহার করতে পারবে তেমন মনভাবও তৈরি করে রেখেছিল। আমি এর মাঝে ধন্যবাদ জানালে সে সহায়তা চাই তার সঙ্গে কাজ করতে। প্রথম প্রথম ক্ষুদ্র কাজে তৃপ্তি পেয়েছিলাম। হালাল টাকায় সব হচ্ছিল। একদিন ইশিতা রাগে বাসায় এলো। দিশাহীন তার রুমে এসে কাপড় চোপড় খুলে ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য করে। এমন তিমিররাত্রিতে এক মেয়ের নগ্ন শরীর দেখলে কারই না কামনা জাগে! সেও তো পুরুষ তারও তো চাহিদা আছেই। তার উপর মেয়েটা তার বান্ধবী ও তার হেল্পার। এসব ভেবে সে নিজেকে দমিয়ে নিয়ে বলে ছিল।
‘দোস্ত কাপড় খুলেছিস কেন! যাহ্ নিজের রুমে গিয়ে ঘুমা!’
‘দোস্ত প্লিজ রাগে মাথা গরম ঠান্ডা করতে এই ছাড়া উপায় নেই।’
এরকম বাজে ইঙ্গিতের দ্বারা মিজবানকে নিজের রুপের জালে রাত পার করতে বাধ্য করে ফেলে। সেই বাধ্যতা যে ভিডিওয়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে কে জানতো! ভিডিও করে সে তাকে প্রতিনিয়ত তার কাজ করতে ব্লেকমেইল করে। ইশিতাই বলে ছিল সব নষ্ট করতে, কলঙ্কিত বানাতে হবে রাফিয়াকে। মায়ের জীবন বাঁচাতে যে নারী সহায়তা করে ছিল তার কথার অবাধ্যতা হওয়ার সাধ্য ছিল না মিজবানের। ফলে সেও শর্ত মোতাবেক রাজি হয়ে ছিল। টাকা পেয়ে সেও মাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ থেকে চলে যেতো। তবে যাওয়া হয়নি পুলিশের কবলে পড়ায়।
পরিপূর্ণ কথা সমাপ্তির পর নাবিল বুঝতে সক্ষম হলো মিজবান আসলেই সত্য বলছে। সে দোষ করেনি কোনোভাবেও। নাবিল মুখ খুলার পূর্বেই রাফিয়া এসে এলোথেরাপি মা’ই’র দিতে লাগল।
চলবে……