বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-৩১+৩২

0
839

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩১
চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে।পরিবেশ বেশ জমজমাট।ক্যামেরাম্যান একেরপর এক ছবি তুলছেন আর ভিডিও করছেন।বেশ কয়েক ফ্যামিলি ফটো তোলা শেষ।ইফতি জানালো এখন শুধু আরাবী আর জায়ানের কাপল ফটো তোলা হবে।সেই অনুযায়ী ইফতি আর নূর গিয়ে জায়ান আর আরাবীকে একসাথে দাড় করালো।দেখা গেলো ক্যামেরাম্যানকে আর পোস দেওয়ার কথা বলা লাগলো না।জায়ান নিজেই খুব সুন্দরভাবে সবটা সামলে নিয়ে একেক এঙ্গেলে পোস দিচ্ছে।এদিকে যে আরাবীর শরীরে কতো ড্রিগ্রি ঝড় উঠে গিয়েছে তা তো জায়ান বোধহয় জানলো না।জায়ানের শক্তপোক্ত হাতের একেকটা স্পর্শ যখন ওর শরীরে লাগছে তখন ভয়ানক ঝড়ে আরাবীর মন দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে।আরাবী দৃষ্টি নীবদ্ধ করলো জায়ানের দিক।লোকটা কেমন শক্তমুখ করে রেখেছে।একবারও ভালোভাবে তাকাচ্ছে না আরাবীর দিকে।আরাবীর দৃষ্টিতে কাতরতা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।এমন নিষ্ঠুর আর পাষাণ কেন লোকটা?আরাবী কি এমন বলেছে যে এইভাবে রাগ করে আছে ওর উপর? কিসের এতো জেদ তার?আরাবী তো ভুল কিছু বলেনি? মদ খাওয়া হারাম।সেখানে আরাবী বলেছে এটা ছেড়ে দিতে আর লোকটা ঘাড়ত্যাড়ামি করে বলে ছাড়বে না।তাই তো আরাবী বললো মদ না ছাড়তে পারলে ওকে ছেড়ে দিতে। মদের নেশা পৃথিবীতে জঘন্যতম নেশা এটা আরাবীর কাছে।এই নেশার কারনে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাদের জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায়।এই নেশার কারনে তারা আর কিছুর পরোয়া করে না। আপন মানুষদের কষ্ট দিতে থাকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত। তাই তো আরাবী ভয় পায় এটাকে।জায়ানের হাতে তখন ওই মদের বোতল দেখে আরাবীর ভীতরে কি অসহ্য পীড়া যে শুরু হয়েছিলো তা ও বলে বুঝাতে পারবে না। আরাবী চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো।অনেক হয়েছে আর এইভাবে চাতকপাখির ন্যায় জায়ানের কথা শোনার জন্যে আর ওর দিকে নিজেকে বারবার ঠ্যালা দেওয়া নেহাতই বোকামি।আরাবী জায়ানের কাছে নিশ্চিন্তে সরি বলতো।যদি ও ভুল কিছু বলতো।তবে আরাবী কোন ভুল করেনি।তাই মাফ চাওয়া বা আগ বাড়িয়ে কথা বলার মতো বোকামি ও করবে না।দোষ জায়ানের। তাই জায়ানই আগে নিজের ভুল স্বিকার করে ওর কাছে আসবে।আরাবী নিজেকে শক্ত করে রাখলো পুরোটা সময়। যতোক্ষন ফটোশেসন চললো।ছবি তোলা শেষ হতেই আরাবী স্টেজ থেকে নেমে গেলো দ্রুত।জায়ান ভ্রু-কুচকে একবার তাকিয়ে নিজেও নেমে পরে।নূর এইবার স্টেজে উঠলো।মাইক হাতে নিয়ে বলতে লাগলো,’ লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যানস। অনেক তো হলো কথাবার্তা,খাওয়া দাওয়া। এইবার একটু নাচ গান হয়ে যাক? কি বলেন?’

সবাই চিৎকার করে উঠলো।নূর মুচঁকি হেসে বলে, ‘ তো দেরি কিসের আমাদের এই পার্টির এই মধ্যমণি আমার ভাই আর ভাবির কাপল ড্যান্স দিয়ে শুরু করা যাক। সবাই তৈরি তো?’

আবারো সবাই চিৎকার করে উঠলো।এদিকে আরাবী বিষ্ময়ে হা হয়ে গিয়েছে।নূর যে এমন একটা কথা বলবে আচমকা বলে ফেলবে ভাবেনি ও।আরাবী তো নাচঁতে পারে না।কিভাবে কি করবে ও? শেষে না দেখা যাবে নিজের ইজ্জতের প্রেস্টিজ না উড়ে যায়।সাথে জায়ানও এতোগুলো মানুষের সামনে লজ্জায় পরে যাবে। আরাবী চিন্তায় কাচুমাচু হয়ে গিয়েছে।ঠিক তখন কেউ এসে ওর হাতটা টেনে ধরলো।আরাবী ভড়কে গিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে জায়ান ওর হাত ধরে আছে।দৃষ্টি এখনো সামনের দিক।জায়ান আরাবীর হাত টেনে ধরলেও আরাবীর কোন হেলদুল না দেখে গম্ভীর গলায় বলে, ‘ আসছো না কেন?কোলে নেওয়ার টাইম নেই আমার।’

জায়ানের এমন কথায় প্রচন্ড রাগ লাগলো আরাবীর।এমনভাবে বলছে যেন আরাবী জায়ানের কোলে উঠার জন্যে মরে যাচ্ছে।ও তো নাচতে পারেনা সেই চিন্তায় আগাচ্ছে না।আরাবী চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’ আপনার কোলে উঠার কোন শখ বা ইচ্ছা আমার কোনটাই নেই।বুঝেছেন আপনি?’

জায়ান বাঁকা হেসে বলে, ‘ সেটা আমার থেকে আর ভালো কে জানবে?ইনফেক্ট বিয়ের পর সবই দেখা যাবে। দিনে কতোবার যে উঠবে আর রাতের হিসাব….!’

আরাবী সাথে সাথে হাল্কা গলায় চেঁচালো, ‘ আপনার অসভ্য কথাবার্তা বন্ধ করুন।’

জায়ান ঠান্ডা কন্ঠে বললো, ‘ আসছো না কেন?’

আরাবী জায়ানের এই প্রশ্নে খানিক দমে গেলো।মিইয়ে যাওয়ার গলায় বললো, ‘ আস..আসলে আমি নাঁচতে পারি না।’

জায়ান আরাবীর কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না কোন।আরাবীকে টানতে টানতে নিজের সাথে নিয়ে যেতে যেতে ভাবলেশহীনভাবে বললো, ‘ তোমার পারতেও হবে না।’

আরাবী তো হা!
______________
Tumko Paya Hai To Jaise Khoya Hoon
Kehna Chahoon Bhi To Tumse Kya Kahon
Tumko Paya Hai To Jaise Khoya Hoon
Kehna Chahoon Bhi To Tumse Kya Kahon
Kisi Zabaon Mein Bhi Woh Labaz Hi Nahi
Ki Jeene Mein Tum Ho Kya Tumhein Mein Bata Sakun
Main Aagar Kahoon Tumsa Haseen
Kaynaat Mein Nai Hai Kahin
Tareef Yeh Bhi To Sach Hai Kuch Bhi Nahi
Tumko Paya Hai To Jaise Khoya Hoon..
গানের তালে তালে জায়ানের সাথে দুলছে আরাবী।জায়ান খুব দক্ষতার সাথে আরাবীকে সামলে নিচ্ছে ড্যান্সের প্রতিটা স্টেপে।আরাবী মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে।কি সুন্দর নাচঁতে পারে লোকটা।সাথে ওকেও কি সুন্দর সামলে নিচ্ছে।আসলে লোকটার সব কিছুই সুন্দর আর পার্ফেক্ট।শুধু রাগটাই বেশি।কথাগুলো ভেবেই আনমনে হাসলো আরাবী। জায়ান তা দেখে ভ্রু-কুচকে বললো, ‘ অযথা পাগলের মতো হাসছো কেন?’

সাথে সাথে আরাবীর হাসিমাখা মুখটা অন্ধকারে ঢেকে গেলো।চোখজোড়া নামিয়ে নিলো নিচে।এখন ও হাসলেও দোষ।আর সেটাকে পাগলের উপাধি দিয়ে দিলো লোকটা? পাষাণ,পাষাণ,পাষাণ লোক।আরাবী আর কথাই বলবে নাহ।

Shokhiyon Mein Dooobi Yeh Aadayein
Chehre Se Jhalki Hui Hain
Zulf Ki Ghani Ghani Ghatayein
Shaan Se Dhalki Hui Hain
Lehrata Aachal Hai Jaise Badal
Bhaahon Mein Bhari Hai Jaise Chandani
Roop Ki Chandni…

জায়ান আরাবী ঘুরিয়ে দূরে নিয়ে আবার কাছে টেনে আনলো।এইবার আরাবীর পিট জায়ানের বক্ষে ঠেকানো।জায়ানের গরম নিশ্বাসগুলো আরাবীর কাধে এসে বারি খাচ্ছে। আরাবী নিজের গাউন একহাতে খামছে ধরলো।শরীরটা কেঁপে উঠছে বাজেভাবে।

Main Agar Kahoon Yeh Dilkashi
Hai Nahi Kahin Na Hogi Kabhi
Tareef Yeh Bhi To Sach Hai Kuch Bhi Nahi
Tumko Paya Hai To Jaise Khoya Hoon..

নাচ শেষ হতেই সবাই করতালি দিয়ে উঠলো।প্রশংসা করছে সবাই।বেশ সুন্দরভাবে জায়ান আরাবীকে নিয়ে ড্যান্সটা কমপ্লিট করেছে।নাচ শেষ হতেই জায়ান আরাবীকে ফেলে রেখেই স্টেজ থেকে নেমে দাড়ালো।এমনটা করায় এইবার বেশ কষ্ট পেলো আরাবী। স্টেজে উঠতে বেশ কষ্ট হয় আরাবীর লং গাউন পরায়। চোখ ভরে উঠতে চাইলেও নিজেকে সামলে নেয় আরাবী।ইফতি স্টেজে এসে আরাবীকে নামতে সাহায্য করে।ইফতি চিন্তিত কন্ঠে আরাবীকে জিজ্ঞেস করলো,’ তোদের মাঝে সব ঠিক আছে তো আরাবী?কেমন যেন দুরুত্ব দেখতে পাচ্ছি আমি।’

আরাবী নিজের কষ্টগুলো চেপে রেখে বহু কষ্টে বললো, ‘ সব ঠিক আছে ভাইয়া।শুধু চিন্তা করছো তুমি।আচ্ছা তুমি থাকো।আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো।’

ইফতি বললো, ‘ একা যাস না।নূরকে ডাকছি ওকে সাথে নিয়ে যা।’

‘ আরে দূর ভাইয়া।ও বেচারি এঞ্জয় করছে।ওকে ডাকবে কেন শুধু শুধু।আমি এই যাবো আর আসবো।থাকো তুমি।’

ইফতিকে আর বলতে না দিয়ে আরাবী হাটা ধরলো ওর রুমে যাওয়ার জন্যে। এতোক্ষন ধরে রাখা জলটুকু আর বাধ মানলো না।গাল গড়িয়ে পরলো চোখ হতে নিসৃত একফোটা তপ্ত জল।আরাবী চোখ মুছতে বাড়ির ভীতরে চলে গেলো।রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো আরাবী।চোখে মুখে হালকাভাবে পানির ছিটা দিলো। ভালো লাগছে না কিছু।এতো এতো মিউজিকের আওয়াজে ওর মাথা ব্যাথা করছে।কিন্তু কিছু করার নেই।ওকে আবারও সেখানে যেতে হবে। এই বাড়ির বড় বউ হতে চলেছে সে।এতোটুকুতে হাঁপিয়ে গেলে চলবে?তাকে তো সব দিক সামলাতে হবে।আরাবী আরো কিছুক্ষন ওয়াশরুমে কাটিয়ে বের হয়ে আসলো।বের হতেই চমকে গেলো আরাবী।রুমের লাইট নিভানো।কিন্তু ওর তো স্পষ্ট মনে আছে। রুমে প্রবেশ করার সময় ও লাইট ওন করেই এসেছে।তাহলে লাইট ওফ হলো কিভাবে?আর ইলেক্ট্রিসিটি ও তো যায়নি।বাহিরে মিউজিক বাজছে।আর গেলেও তো অন্ধকার হওয়ার কথা না।পুরো বাড়িতে আইপিএস সিস্টেম চালু করা।ইলেক্টিসিটি চলে গেলেও কিছুক্ষন বাদে লাইট আপনা আপনি জ্বলে উঠবে। আরাবী অন্ধকারের মাঝে হাতরে হাতরে আগানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না কিছুই।হঠাৎ মনে হলো ওর পিছনে কেউ আছে।কেউ দাঁড়িয়ে ওর পিছনে।ভয়ে আরাবীর শিরদাড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।আস্তে করে পিছনে ফিরে দেখে আসলেই কেউ দাঁড়ানো।কারো কালো অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।আরাবী ভয়ে চিৎকার করে সরে যেতে নিতেই বিছানার পায়ার সাথে পা বেজে ফ্লোরে উপর হয়ে পরলো।যার ফলে পেটে প্রচন্ড ব্যাথা পায় আরাবী।জোড়ে আর্তনাদ করে উঠে। তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসে আরাবী।কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ কে ওখানে?কে আপনি?সামনে আসছেন না কেন?আর আমার রুমে কিভাবে আসলেন?’

কিন্তু কোন জবাব এলো না ওপাশ থেকে। আরাবীর ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছে। উঠে যে দৌড়ে বেড়িয়ে যাবে তারও উপায় নেই।চারদিকে অন্ধকার।ঝাপ্সা আলোতে হালকা কিছু দেখতে সক্ষম হচ্ছে তাও খুব কষ্টে।আরাবী উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু তার আগেই রুমের লাইট জ্বলে উঠলো।আর আলো জ্বালাতেই আরাবী সামনে যাকে দেখলো তাতে যেন আরাবী ভয়ে জমে গিয়েছে।কাঁপাকাঁপা গলায় আরাবী বলে,’ আপনি?’

লোকটা বাঁকা হাসলো।সে বেশ মজা পাচ্ছে আরাবীকে ভয় পেতে দেখে।আরাবী কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।এই লোকটা এখানে কিভাবে আসলো। বাড়িতে কেউ নেই সবাই গার্ডেনে।আরাবী চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। কারন লাউডস্পিকারে মিউজিক বাজছে।আর ও মেয়ে হয়ে একটা পুরুষ মানুষের সাথে কিভাবে পেরে উঠবে আরাবী? কি করবে আরাবী। না এইভাবে ভেঙ্গে পরলে চলবে না। ওকে এখান থেকে বের হতে হবে।যে করে হোক বের হতে হবে।একবার বের হতে পারলেই এই লোকটাকে দেখে নেওয়া যাবে তখন।আরাবী বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে লাগলো।ভয় পেলে চলবে না।

#চলবে____________

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩২
দমবন্ধকর পরিবেশ। কিভাবে এখান থেকে নিজেকে বাচাতে পারবে আরাবী তা ক্ষনে ক্ষনে ভেবে চলেছে।গলা শুকিয়ে আসছে।ভয়ে হৃৎপিন্ডটা জোড়ে জোড়ে লাফাচ্ছে।আরাবী নিজের ভয়টাকে দেখাতে চাচ্ছে না।তাই নিজেকে শক্ত করে।তেজি কন্ঠ বলে উঠে,’ কি সমস্যা আপনার?আর আপনি এখানে কি করছেন? পার্টি নিচে হচ্ছে।আপনি আমার রুমে কেনো এসেছেন?জায়ান জানতে পারলে আপনাকে আজ আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না।নেহাতই আপনি তার কাজিন হোন।তাই পার্টিতে আসতে পেরেছেন।নাহলে সে তো আপনাকে আমার ত্রি-সীমানায়ও আসতে বারণ করেছে।ভুলে গিয়েছেন?বেড়িয়ে যান এখান থেকে।’

আদি যেন আরাবীর কথায় বেশ মজা পেলো।পৈচাশিক হাসি দিয়ে বলে, ‘ খুকি তুমি? বুঝো না কিছু?কেন এসেছি একটুও বুঝোনি? সেদিনের রাস্তায় করা অপমানের কথা এতো সহজে ভুলে যাবো কিভাবে আমি?শোধ তুলতে হবে না?আর রইলো জায়ানের কথা? ও জানতে পারলে তো আমাকে কিছু করবে?তার আগে তুই শেষ।সেদিন পাবলিক প্লেস ছিলো বিধায় কিছু বলিনি।কিন্তু আজ কিভাবে তুই বাচঁবি বল?’

মুহূর্তেই রাগে ফুসতে ফুসতে আরাবীর কাছে চলে এলো।আরাবী দৌড়ে বারান্দার দিক যেতে নিতেই।আদি ওর হাত ধরে টেনে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দেয়।আরাবীর চোখ থেকে পানি পরছে।কিভাবে নিজেকে সামলাবে আরাবী?কিভাবে রক্ষা করবে এখান থেকে নিজেকে।একবার দরজার দিকে বা বারান্দায় যেতে পারলেও হতো।বারান্দায় গেলে সেখান থেকে জায়ানকে ডাকতে পারবে।বা কিছু একটা তো করতে পারবে।কিন্তু যাবে টা কিভাবে?আরাবী দুহাতে চোখ মুছে নিলো।যেই না বিছানা থেকে উঠতে যাবে।তার আগেই আদি এসে আরাবীর উপরে ঝাপিয়ে পরে।আরাবী চিৎকার করে উঠে।কিন্তু আফসোস কেউ তার চিৎকার শুনছে না। আরাবী দুহাতে ঠেলে সরাতে চাইছে আদিকে।কিন্তু একটা পুরুষের সাথে কি একটা মেয়ে কখনো পারে শক্তিতে।আরাবী নিজেকে শান্ত করলো। আরাবীকে হঠাৎ শান্ত হয়ে যেতে দেখে আদি বাঁকা হেসে তাকালো আরাবীর দিকে।বললো,’ কি সব তেজ শেষ? আমি বললাম তো পারবে না আমার সাথে।এর থেকে ভালো এঞ্জয় করো আমার সাথে।কেউ জানতে পারবে না।আমি সবটা সিক্রেট রাখবো প্রমিস।’

আরাবী হিংস্র চোখে তাকালো আদির দিকে।পারলে এক্ষুনি এই আদিকে আরাবী টুকরে টুকরে কেটে ফেলবে এমনভাবে রাগে ফুসছে ও।আরাবী নিজের গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজের হাটু দ্বারা আদির পেইন পয়েন্টে আঘাত করে দিলো।আদি চিৎকার করে সরে গেলো।ব্যাথা গোঙ্গাতে লাগলো আদি।এই সুযোগে আরাবী দ্রুত উঠে দাড়ালো বিছানা থেকে।রাগি গলায় বলে, ‘ আমাকে অবলা ভাবিস না।তোদের মতো জা*নোয়ারদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমি ভালো করে জানি।’

আরাবী কথাগুলো বলে যতোদ্রুত পারে রুমের লাইট ওন করলো।তারপর দরজা খুলতে গিয়ে ভীষন অবাক হলো আরাবী।দরজায় পেছন থেকে লক করা।কিভাবে কি করবে আরবী? এখন এখান থেকে বের হবে কিভাবে।আরাবী উপায় না পেয়ে দরজায় জোড়ে জোড়ে আঘাত করতে লাগলো।আর চিল্লাতে লাগলো, ‘ প্লিজ হেল্প।কেউ আছেন? প্লিজ দরজাটা খুলে দিন।জায়ান আপনি কোথায়?ইফতি ভাইয়া?নূর।’

কিন্তু না কারো আওয়াজ পাওয়া গেলো না।আরাবী না পারতে কেঁদে দিলো।এতোক্ষন নিজেকে শক্ত করে রাখলেও এখন আর পারলো না।ততোক্ষনে আদি ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসেছে। হাসঁতে হাসঁতে বললো, ‘ এতো কাচা খেলা আমি খেলি না।তোকে তো যে করেই হোক।আমার বেড পার্টনার বানাবোই।’

এমন কথায় চমকে উঠলো আরাবী।তাকিয়ে দেখে আদি উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করছে।ভয় পেলে আরাবী।চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিজেকে রক্ষা করার উপায় খুজতে লাগলো।বারান্দার দিকে নজর যেতেই একটু আশার আলো পেলো আরাবী।দ্রুত সেদিকে দৌড়ে নিতেই ততোক্ষনে আদি দাঁড়িয়ে গিয়ে।ওর চুল টেনে ধরে।ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে আরাবী।ঘারেও প্রচুর জ্বলছে।তারপরেও নিজের ব্যাথাটাকে তোয়াক্কা করলো না।পিছনে ঘুরে আদির নাক বরাবর ঘুশি মেরে দিলো।এক হাতে নাক ধরে চিৎকার করলো আদি।তাও আরাবীর চুল একহাতে ধরে রেখেছে।ছাড়ছে না।আরাবী দুহাতে আদির হাতে খামছাতে লাগলো নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে।অবশেষে আদি হাত ছেড়ে দিতেই দৌড়ে বারান্দায় চলে গেলো।দরজা আটকে দিলো আরাবী।রেলিং ধরে হাপাতে লাগলো। উপর থেকে চিল্লাতে লাগলো।সাহায্যের জন্যে।কিন্তু মিউজিকের আওয়াজে কেউ শুনছে না ওর আওয়াজ।এদিকে আদি এতো এতো ব্যাথা পেয়েও থেমে নেই।নিজেকে সামলে নিয়ে দরজায় জোড়েজোড়ে লাত্থি দিতে লাগলো।মূল পরিকল্পনা দরজা ভেঙ্গে ফেলা।এদিকে আরাবী কাঁদতে কাঁদতে জায়ানকে ডেকে চলেছে।পরক্ষনে দরজা ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে যায় আরাবী।কাদঁতে কাঁদতে বলতে লাগলো,’ আরে কেউ তো এদিকটায় তাকাও প্লিজ।’

______________
জায়ানের মনটা বড্ড অস্থির লাগছে।কেমন যেন লাগছে ওর।চারদিকে নজর ঘুরালো।নাহ মেয়েটার দেখা নেই।কোথায় গেলো?অনেকক্ষন যাবত দেখছে না আরাবীকে। জায়ান নূরের কাছে এগিয়ে গেলো জিজ্ঞেস করলো, ‘ আরাবী কোথায় নূর?’

জায়ান প্রশ্নে পাশে দাঁড়ানো ইফতি বললো, ‘ ও রুমে গিয়েছে ভাই।কিন্তু বুঝলাম না বললো একটু পরেই এসে যাবে।কিন্তু এখনো আসছে না কেন? অনেকক্ষন হয়ে গিয়েছে।’

জায়ানের মনটা কেমন ধ্বক করে উঠলো।ইফতির কথায় কপালে চিন্তার ভাজ পরলো।কি মনে করে যেন আরাবীর রুমের বারান্দার দিকে তাকালো।তাকাতেই যেন জায়ানের দুনিয়া ঘুরে উঠলো।এ কি অবস্থা তার আরাবীর। তার আরাবী কাঁদছে কেন?

এদিকে জায়ানকে তাকাতে দেখে যেন আরাবীর কলিজায় পানি আসলো।দ্রুত কাঁদতে কাঁদতে চেচাঁলো,’ আমাকে বাঁচান জায়ান।হেল্প মি। আদি আমার সাথে………!’

বাকিটা বলার আগেই ধরাম করে আওয়াজ হলো।হ্যা আদি দরজা ভেঙ্গে ফেলেছে। আরাবী চেঁচিয়ে উঠলো।কি করবে ও?এখান থেকে লাফ দিবে? সেটাই এখন একমাত্র রাস্তা বাকি। আরাবীর যেই না সেটা করতে যাবে তার আগেই আদি এসে আরাবীর চুল মুঠি ধরে লাগাতার চার পাঁচটা থাপ্পড় মেরে বসলো।আরাবী ছিটকে রেলিংয়ের উপর পড়ে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।

জায়ান সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো, ‘ আরাবী!!”

জায়ান সর্বোচ্চ গতিতে দৌড় লাগালো আরাবীর কাছে যাওয়ার জন্যে।এদিকে ইফতি আর নূর এসব দেখে হতবাক।ইফতি জলদি নূরকে বললো,’ মিউজিন বন্ধ করতে বল। আর সবাইকে জানা আব্বু আর বড়বাবাকে পুলিশে ইনফোর্ম করতে বল।আমি যাচ্ছি।’

নূর কথা মতো চলে গেলো।ইফতিও জায়ানের পিছন পিছন দৌড়।
————

আদি আরাবীকে টেনে হিচড়ে রুমে এনে ধাক্কা দিলো আরাবীকে।যেই না আরাবীর কাছে আসবে তার আগেই প্রচন্ড শব্দে দরজা খুলে ভীতরে ঢুকে জায়ান।ঢুকেই স্তব্ধ চোখে আরাবীর দিকে তাকিয়ে আছে ও? এ কি হাল হলো ওর কাঠগোলাপের।এদিকে আরাবী কাতর নয়নে তাকিয়ে জায়ানের দিকে।উঠে যে দাঁড়াবে সেই শক্তিটুকুও বিন্দু পরিমান নেই ওর মাঝে।মাথায় আঘাত লাগার কারনে চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসছে আরাবীর। জায়ান চোখ বন্ধ করে নিলো।সে সহ্য করতে পারছে না ওর কাঠগোলাপের এই অবস্থা। জায়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে।হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে ধপ করে তাকালো জায়ান।আদি সাথে সাথে ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে গেলো জায়ানের ওই রাগে লাল হয়ে আসা হিংস্র চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে।জায়ান হুংকার দিয়ে দিয়ে আদির কাছে গেলো।তারপর এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো আদিকে। বড় লম্বা একটা লোহার ফুলদানি সেটা হাতে তুলে নিয়ে পিটাতে লাগলো আদিকে। চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘ কুত্তা*র বাচ্চা।তোর সাহস কিভাবে হলো?ওর দিকে হাত বাড়ানোর।আজ তোকে আমি মেরে ফেলবো।তোকে জ্যান্ত মাটিতে পুতে দিবো আমি।আমার আরাবীকে যেই হাত দিয়ে ছুঁয়েছিস যেই হাত আমি ভেঙ্গে দিবো।’

বলতে বলতে জায়ান আদির ডানহাতে একেরপর এক আঘাত করতে লাগলো।মার খেয়ে আদি ফ্লোরে লুটিয়ে পরলো।তাও থেমে নেই জায়ান। একেরপর এক লাথি দিয়ে চলেছে আদিকে।মুখ দিয়ে, নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত পরছে আদির।জায়ান মারতেই আছে মারতেই আছে।
ইফতি এসেই হতবাক।জায়ানের এমন ভয়ানক হিংস্রতা ইফতি আজ প্রথম দেখলো।তবে থামালোনা জায়ানকে।ফ্লোরে নিস্তেজ শরীরে পরে থাকা আরাবীর কাছে গেলো নিজের গায়ের কোট খুলে আরাবীর গায়ে জড়িয়ে দিলো।কারন আরাবীর গাউনের অনেক জায়গাতেই ছিড়ে গিয়েছে।বোনের থেকে বেশি স্নেহ করা আরাবীকে এই অবস্থায় দেখে ইফতি ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।আরাবীকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত এই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।তারপর ইফতি ওকে নিজের রুমে গিয়ে সুইয়ে দিলো।ইফতি উঠে ঔষুধের বক্স আনতে নিতে গেলেই।আরাবী ইফতির হাত টেনে ধরে ওর দূর্বল হাত দিয়ে। দূর্বল গলায় বলে,’ উনাকে থামাও ভাইয়া।নাহলে উনি মেরে ফেলবেন ওই আদিকে।যাও ভাইয়া।’

‘ কিন্তু তুই…!’

‘ প্লিজ ভা…ভাইয়া!’

ইফতি আরাবীর কথা ফেলতে পারলো না।দ্রুত জায়ানের কাছে ছুটলো।কিন্তু গিয়ে দেখে নিহাদ সাহেব আর বাড়ির গার্ড্সরা জায়ানকে ধরে রেখেছে।তাও জায়ান বার বার রেগে বলছে, ‘ ছাড়ো আমায় তোমরা।ওকে আমি আজ টুকরো টুকরো করে ফেলবো।’

ইফতি জানে তার ভাই এখন এভাবে থামবে না।তাকে থামানোর একটাই উপায়।ইফতি যায় জায়ানের কাছে।গিয়ে বললো, ‘ ভাই থামো।ওকে আমরা দেখো নেবো।পুলিশ আসছে।তুমি আরাবীর কাছে যাও।ও কাঁদছে ভাইয়া।তোমাকে ডাকছে।আমার রুমে ও।’

আরাবীর কথা বলতে জায়ান শান্ত হয়ে গেলো।ওর আরাবী কাঁদছে,ওকে ডাকছে কথাটা শ্রবন হতেই।সবার থেকে ছটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বড়বড় পা ফেলে চলে গেলো। আরাবীর মা,নূর, সাথি,মিলি যেতে নিতেই ইফতি মানা করে দেয়।জায়ান আর আরাবীকে একা ছেড়ে দিতে।
_____________

হুরমুর করে ইফতির রুমে জায়ান প্রবেশ করে।আরাবী হঠাৎ এমন আওয়াজ হওয়ায়।ঝাপ্সা দৃষ্টিতে তাকায়। দরজার কাছে জায়ানকে দেখে। ফুপিঁয়ে কেঁদে উঠে আরাবী।জায়ান দ্রুত ছুটে যায় আরাবীর কাছে।ওর পাশে বসে আরাবীর বাহু ধরে জলদি ওকে নিজের বক্ষপিঞ্জারায় লুকিয়ে ফেলে।বহুক্ষন পর নিজের একমাত্র ভরসাযোগ্য ব্যাক্তির সান্নিধ্য পেয়ে।আরাবী আর নিজেকে সামলাতে পারে না আরাবী।দূর্বল হাতজোড়া দিয়ে জায়ানের পিট খামছে ধরে জায়ানের বক্ষে মুখ লুকিয়ে তীব্র চিৎকারে কান্না করতে লাগলো আরাবী। আর আরাবীর এমন কান্নায় যেন জায়ানের বুকে তীব্র ব্যাথার সৃষ্টি হচ্ছে।মনে হচ্ছে কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে ওর হৃদয়ে।

#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।