এল এ ডেইস পর্ব-২৮+২৯

0
301

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ২৮
লেখনী মাহীরা ফারহীন

Cause there we are again in that little town street.
You almost ran the red cause you were looking over at me
Wind in my hair, i was there… টেইলর সুইফটের গান বেজে চলেছে কোথাও চাপা শব্দে। তবে চারিদিকের পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে দিয়ে শব্দটা অতি উচ্চ শোনাচ্ছে। এই শব্দ তীরের মতো ঘুমন্ত মানুষগুলোর কানে গিয়ে বিঁধছে। কারোও কারো ঘুম পাতলা সুতোর মতো ছিঁড়ে যায় অল্প শব্দেই। ঠিক যেমনটা জেনেটর সঙ্গে হলো। জেনেট ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘আরেহ আমি কখন টেইলরের কনসার্টে এলাম?’
মাহীন নিজের ফোনের রিংটোন চিনতে পেরে সজাগ হয়ে উঠলো। কোনো রকমে ঘুম জড়ানো চোখের পাতা টেনে খুললো। তারপর এদিক ওদিক হাতরে সেলফোনটা খুঁজতে লাগল। বলল,’জেন আমরা কোনো কনসার্টে যাইনি। এটা আমার ফোনের রিংটোন।’
জেনেট বিরক্তমাখা কন্ঠে বলল,’তাহলে ফোন ধরো না।’

‘খুঁজে পাচ্ছি না তো।’ বলতে বলতে ক্যারোলের ছড়িয়ে থাকা লাল চুলের নিচে পেলো ফোনটা। ক্যারোল মাঝে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ও একটু উশখুশ করে উঠল। মাহীন ফোনটা হাতে নিয়েই রিসিভ করে তারপর নামটা দেখলো। লেখা আছে ‘দ্যা স্ট্রেঞ্জ বয়’। ঘুমের ঘোর লাগা চোখে নামটা দেখেও মস্তিষ্কে কোনো সাড়া জাগলো না।
মাহীন ফোনটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে গাঢ় কন্ঠস্বর কানে এলো, ‘মাহীন আমি রায়েদ।’ কথাটা শুনতেই মাহীন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। তারপর ওর মনে পরলো রায়েদের নম্বর আসলে এই নামেই সেভ করেছে ও। যদিও রায়েদ ওকে একবার বলেছিল ওর নম্বর সেভ না করতে। তবে কে শোনে কার কথা? তাড়াতাড়ি তাবুর চেইন খুলে বাইরে বেরিয়ে আসল। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘তুমি এখান থেকেই এখানে ফোন দিচ্ছো কেন? এখানে এসেই তো আমাকে ডাকতে পারতে।’
ওপাশ থেকে বলল, ‘এই সময় তোমাকে ডাকতে আসলে সকলেই উঠে যেত। সেটা বোধহয় খুব একটা ভালো হতো না।’ মাহীন ওর কথাটা শুনে চারিদিকে একবার চোখ বুলালো। পূর্ব আকাশে সূর্যের আগমন এখনো ঘটেনি। । চারিদিক আবছা অন্ধকারের চাদরে ঢাকা। তবে অন্ধকার আকাশের চেহারা ফ্যাকাসে হতে শুরু করেছে। আকাশের এই ম্যারম্যারে রুপটাও মনে প্রশান্তি এনে দেয়। কত অচেনা গাছের ঝাঁকড়া ডাল পালার ফাঁকে ফাঁকে পাখিরাও ঘুমের পর্বে সমাপ্তি টেনে নতুন দিনের সূচনা করছে। কনকনে শীতল বাতাস শা শা শব্দে বয়ে চলেছে। ঠান্ডায় মাহীনের গায় কাটা দিয়ে উঠল। ফোনের অপর সংযোগ দাতার নিকট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘কিন্তু তোমার এই সময় কী এমন জরুরিকথা বলতে হবে আমায়?’

‘তুমি আমার ক্যাম্পের কাছাকাছি আসো তারপর বলছি। এখান থেকে এখানে ফোনে বলবো নাকি?’

মাহীন ভাবলো, এক মিনিট গতকাল যে ডেয়ারটা দিয়েছিল ওটা ব্যবহার করে যে আমাকে কি করতে বলবে আল্লাহই জানে। কি করতে যে ওর কাছে ডেয়ার নিয়েছিলাম।! এখনই ওটা খরচ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।’ মুখে বলল, ‘হুম আমি তো নাও আসতে পারি। তবে মনে আছে গতকাল তোমার ডেয়ারটা। আমি না আসলেও সেটা ব্যবহার করতে পারো।’
ফোনের ওপাশে রায়েদ নিঃশব্দে হাসল। বলল,
‘ওইটা এত সহজে তো খরচ করবো না। তুমি এখন এমনিই এখানে আসছো। সি ইউ।’ বলে মাহীনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিল। মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায়েদের ক্যাম্প যেদিকে সেদিকে দৃষ্টি ফেরাল। কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। মাহীন নিজের তাঁবুতে আবার প্রবেশ করল।
.
.
.
রায়েদ গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তবে এখন সেদিকে তাকিয়ে থেকেও কিছুই দেখছে না। বরং ও গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওকে। ভাবছে, কী একটা কাজ করলাম আমি?
মাহীনকে এই সাতসকালে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে তুললাম। কেন? সূর্যদয় দেখার জন্য। ব্যাপারটা একটু বেশিই অপ্রতুল হয়ে গেল না? ওফ আমিও কী আমার কমনসেন্স বাসায় ফেলে রেখে এসেছি নাকি? ও আসলে ওকে বলবোটা কী? কেন ওকেই ডাকলাম? এভাবেই বলে দেওয়া যায় নাকি? আমি তো নিজেও ঠিক বলতে পারবো না কেন সর্বপ্রথম ওর কথাই মনে পরলো? মেয়েটা আসলেই পাগল করে দিচ্ছে আমাকে। আজকাল দেখি কিছু কিছু ঘটনা এমন ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে পাই না।’
রায়েদের সামনে তুড়ি বাজাতেই ও চমকে উঠল। ভাবনার সুতোয় টান পরল। দেখলো মাহীন ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত ওর চুল খোলা থাকে বা ব্যান্ড দিয়ে ঢিলা করে বাঁধা থাকে। এখন ও চুল উঁচু করে পোনিটেইল করে এসেছে। চুখে মুখে এক স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। রায়েদ পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।
মাহীন গাঢ় কন্ঠে বলল, ‘হুম আমি জানতাম তুমি একটু বেশিই ওভারথিংক করো। তবে আজকাল তোমার আশেপাশে থাকতে থাকতে সেটা করতে দেখার সৌভাগ্যও হচ্ছে।’ তারপর থেমে আবার বলল,’আচ্ছা তো বলো এই ঠান্ডার মধ্যে জমতে ডাকসো কেন?’

‘তোমাকে জমতে ডাকিনি। একটা জায়গায় যাবো। এখান থেকে কাছাকাছি। তুমি চাইলে যেতে পারো আমার সাথে।’

‘ওহ তাই। কি ধরনের জায়গা?’ আগ্রহী কন্ঠে বলল মাহীন।

রায়েদ আমুদে গলায় বলল, ‘যেখান থেকে খুব সুন্দর সূর্যদয় দেখা যায়।’

মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আর তুমি সেই জায়গাটা কিভাবে চেনো?’

‘আমাদের বাস ড্রাইভার ওরফে গাইড এর আগেও এখানে অনেকবার এসেছেন। এবং তিনিই সেই জায়গাটার কথা আমাকে বলেছেন এবং কোন দিক দিয়ে যেতে হয় সেটাও।’

মাহীন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল, ‘গ্রেট! বাট এক্ষেত্রে আমার কথাই তোমার কেন মনে পরলো?’
রায়েদ জ্বিব কামড়াল। মনে মনে ভাবলো, এই যাহ। আমি জানতাম এই প্রশ্ন ও করবে। এখন কি বলবো? ভাবতে ভাবতেই আবার একটা কারণ দাঁড়িয়েও গেল। বলল, ‘কারণ একমাত্র তুমিই কি আমার সবচেয়ে ভালো ফ্রেন্ড না?’
কথাটা মাহীনের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতির সঞ্চার করল। মুখ টিপে হেসে সায় জানিয়ে মাথা ঝাকাল। বলল, ‘হুম যুক্তিসঙ্গত কথা।’ তারপর একটু থেমে বলল, কিন্তু যদি আমরা হারিয়ে যাই।’
কিছুটা উদ্বিগ্নতা মিশে আছে কন্ঠে। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি বিভিন্ন ক্যাম্পে গাইড হিসেবে কাজ করেছি। এখন হারিয়ে গেলে কিভাবে ফিরে আসতে হবে সেই অভিজ্ঞতা আমার আছে। তবুও আস্বস্ত থাকতে পারো আমরা হারাব না।’
মাহীন গাঢ় কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা তবুও একটু ভাবতে দাও।’
রায়েদ তীব্রভাবে বললো, ‘থাক আমি একাই যাচ্ছি।’

মাহীন তখনই তাড়াহুড়ো করে বলল, ‘এই এই না, না! একটু থামো। আমাকে ছাড়া তুমি যাবে না।’ রায়েদ ভ্রু উঁচু করে ভাবলো, ও যখন আমার সাথে যাওয়ার জন্যে এক পায় খাঁড়া তাহলে এত ভাবছে কী?’
মাহীনের মনে চলছে কিছু উদ্ভট চিন্তা ভাবনা, আচ্ছা ভাইয়ের সেখানো রুলস হচ্ছে কেউ কোথাও যাওয়ার প্রস্তাব দিলে যাওয়ার আগে এর চারটা কারণ বের করতে হবে। একটা কারণ হতে পারে,
রায়েদ আমার ফ্রেন্ড, দ্বিতীয়ত ও প্রস্তাবটা দিচ্ছে, তৃতীয়ত সূর্যদয় খুব সুন্দর হয়, এবং এবং আর কী? আর কী কারণ থাকতে পারে? ওফ!…আ, ওহ হ্যা! এবং আমি যেতে চাই। শেষ! চারটা কারণ দাঁড় করিয়েছি।’ মুখে উচ্ছাস ভরে উঠল এবার। প্রফুল্ল চিত্তে বলল,’হ্যা হ্যা ঠিক আছে আমি রাজি।’

রায়েদ মুচকি হেসে বলল, ‘এতক্ষণ যে কী ভাবলা আল্লাহই জানে। যাই হোক আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সূর্যদয় হওয়ার আগেই আমাদের যেতে হবে।’
তারপর তাঁবুগুলো পার করে বাম দিকে হেঁটে যেতে লাগল। মাহীন জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা তুমি আমাকে খুন করবা নাতো?’

রায়েদ হেসে উঠল। বলল, ‘নাহ খুনটুন আমি করতে পারি না বাবা।’

‘আর যদি আমাকে ফেলে রেখে আসো?’

রায়েদ হেসে বলল,’এখন তুমি ওভারথিংক করছো কিন্তু। আমি তোমাকে খুনও করবো না, ফেলেও রেখে আসবো না। তুমি ঠিকঠাক ভাবেই যাবা। ঠিকঠাক ভাবেই আসবা।’

মাহীন হাসল। হঠাৎ করে এমন সব অর্থহীন কথা বলতেই ভালো লাগছে। কেন জানে না। শীতে কবলিত ভোরে আরামের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না? নাকি প্রিয় মানুষটির সঙ্গে একান্তই সময় কাটানোর স্বর্গীয় আনন্দে? হ্যা হয়তো বলাই যায় প্রিয় মানুষ। মনে পরে না তো ওর, এর আগে কাউকে এই ছেলেটার মতো ভালো লেগেছিল কিনা। কাছাকাছি পর্যায়েরও হবে না।

ওরা দুজনই তাঁবুগুলো পার করে বাম দিকের বনের মধ্যে প্রবেশ করল। বনে প্রবেশ করার পূর্বে বড় টেবিল থেকে একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে নিল। রায়েদ হাঁটছে এবং মাহীন ওকে অনুসরণ করছে। এখানে কোনো মেঠোপথ নেই। কাজেই গাছের গোড়া, ঝোপঝাড় এড়িয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে। তাছাড়া এখনো অন্ধকার। ফ্ল্যাশলাইটের সাহায্যেই কাজ চালাতে হচ্ছে ওদের। কাছেপিঠে তীব্র ঝিঁঝি পোকাদের ডাক শোনা যায়। কখনো কখনো সামনে গাছের ডালপালা বেশি হেলে থাকতে দেখা যায়। কয়েকবার শিকড়বাকর মাহীনের পায়ে বাঁধল। ওর পায়ে এখনো বেশি দ্রুত হাঁটলে ব্যথা অনুভব হয় বিধায় ওরা সাধারণ গতিতে হাঁটছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে কোথায় যেন একটু পরপর কোন পাখি টিউ টিউ করে ডেকে উঠছে। অন্ধকারেও ফ্ল্যাসলাইটের আলোয় ঝোপঝাড়ের মাঝে ছোট ছোট বনফুল পাওয়া গেল। একটা ফুল দেখল মাহীন। হালকা হালকা নীল রঙের ছোট ছোট ফুলের মাঝে হলুদ বোটা। ভিষণ ভালো লাগল ফুলটা ওর। কয়েকটা হাতে তুলেও নিল।আরো বেশ কিছুক্ষণ পার হলো। হয়তোবা বিশ মিনিট পার হয়েছে। মাহীন এটাই ভেবে অবাক হচ্ছে যে এখনো সূর্যদয় হয়ে যায়নি কিভাবে। রায়েদকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা এখন কয়টা বাজে?’
রায়েদ নিজের হাতঘড়িতে আলো ফেলে বলল,’সাড়ে পাঁচটা। কেন?’
‘না এমনি ভাবছিলাম কখন না সূর্যদয় হয়ে যায়।’
‘চিন্তা করো না আমরা সূর্যদয় মিস করবো না।’
ওরা এগিয়ে গেল। আরো বেশ কিছুক্ষণ পর থেকে পথ খাঁড়া হতে লাগল। এখন মাহীনের হাঁটতে বেগ পেতে হচ্ছে। যেহেতু সামনের দিকে পথ খাঁড়া হয়ে এগিয়ে গিয়েছে। রায়েদ থেমে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার হাঁটতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’
‘নাহ ঠিক আছি।’
‘ঠিক আছে। তবে ব্যাথ্যা হলে বলিও।’
মাহীন হালকা হেসে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তবে আবছা অন্ধকারে সেটা রায়েদের চোখে পরল না।
আরো কিছুক্ষণ পর সামনে গাছের ফাঁকফোঁকর থেকে খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। বিবর্ণ সেই আকাশ। আর গাছপালা দেখা যাচ্ছে না। সেই পর্যন্ত পৌঁছতেই দেখা যায় সামনে আর পথ নেই। এটাকেই পর্বত চূড়া মনে হচ্ছে। যদিও আসলে পিনাকেল মাউন্টেইন এখান থেকে বেশ স্পষ্ট ভাবেই আরেকটু দূরে দেখা যাচ্ছে। এই পাহাড়ের তলদেশ দিয়ে দ্রুত বেগে মাউমেল নদী বয়ে চলেছে। নদীর ওপাশ থেকে আবারও ঘন বন। এই চূড়া থেকে নিচের নদী অন্তত ত্রিশ ফুট নিচু হবে। দূরের পিনাকেল পাহাড়ের পেছন থেকেই একটা হলদে-সোনালি আভার ডালপালা গজিয়ে উঠছে। ওরা যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখানে পাহাড়ের পাড়টা মোটামুটি এতটা চওড়া যে ঘাসের ওপর বসা যায়। মাহীন প্রসন্ন কন্ঠে বলল,’আহ! এখন যা দেখছি তাই তো বিশ্বাস করতে পারছি না। এমন দৃশ্য কখনো ছবি ভিন্ন বাস্তবে দেখবো সেটা কল্পনাও করিনি।’
রায়েদ মুখ টিপে হেসে বলল,’সূর্যদয় তো এখনো হলোই না তার আগেই যা খুশি তুমি, দেখো আবার লাফালাফি করতে গিয়ে পাহাড় থেকে পরে যেও না।’
মাহীন হাসি মুখে বলল,’পরবো না। আচ্ছা আমরা কী এইখানে একটু বসতে পারবো? এতক্ষণ হাঁটার পর আমার পায়ের ‘ব্যাটারি এবাউট টু ডায়।’
রায়েদ হেসে বলল, ‘অফ কর্স উই ক্যান সিট।’ মাহীন মুচকি হেসে ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে পরল। রায়েদ হঠাৎ অন্যদিকে দুটো গাছের মাঝে একটা ফুলের ঝাড় দেখে বসল না। সেদিকে একটু সরে গেল। এক গুচ্ছ হালকা বেগুনি ফুলগুলো তুললো। এসে মাহীনের পাশে ঘাসের ওপর বসল। মাহীন সেদিকে খেয়াল করে বলল,
‘ওউ কী অসাধারণ সুন্দর ফুলগুলো!’ কী ফুল এগুলো?’
রায়েদ মাহীনের ডান হাতটা ধরে ফুলগুলো ওর হাতের তালুতে রেখে বলল, ‘এগুলো ভারবেনা ফুল। স্যান্টা মনিকায় খুব একটা পাওয়া যায় না। গেলেও এই রঙটা পাওয়া যায় না।’
মাহীন ফুলগুলো হাতে নিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল। রায়েদ ওর দিকে মুগ্ধ মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রমত্ত কন্ঠে বলল, ‘গর্জিয়াস!’
মাহীন হাসল। জিজ্ঞেস করল,’তোমার প্রিয় ফুল কী?’

‘নির্দিষ্ট কোনো প্রিয় ফুল নেই। সব ফুলই ভালো লাগে। এই ফুলটা কীসের সিম্বল জানতে চাও?’

‘সিম্বল? তাই? কিসের সিম্বল এটা?’

‘এটা পবিত্রতা এবং হিলিংয়ের সিম্বল। ঠিক তোমার মতো। ঠিক যেমন তুমি সকলের দুঃখগুলো অদ্ভুত ভাবে ঘুচিয়ে দিতে জানো। এই ফুলটা বোধহয় তোমার প্রতীক।’
মাহীন লাজুক হাসল। অপ্রতিভ ভাবে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি তো দেখি ফ্লোরিওগ্রাফি পড়েছো।’
‘তা তো পড়েছিই। ভালো লাগে। যদিও এই ফুলের অর্থগুলো মানবসৃষ্ট।’
মাহীন বলল,’আমি ফ্লোরিওগ্রাফি পড়িনি ঠিকই। তাও বলতে পারবো ভালোবাসার সিম্বল নিশ্চয়ই লাল গোলাপ।’
‘ঠিক বলেছো। তবে গোলাপ খুব একটা বিশেষ মনে হয় না আমার। আসলে এটা এতোটাই কমন ফুল যে খুবই সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে।’
‘তা ঠিক। দুর্লভ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। আচ্ছা যেহেতু তোমার গোলাপ খুব একটা ভালো লাগে না। তাহলে ভালোবাসার প্রতীক তোমার কাছে কোনটা?’
‘উম এখন পর্যন্ত ঠিক নেই। ঠিক হয়ে গেলে তোমাকেই সবার আগে বলবো।’ পেছনের গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে ওরা। পেছনের গাছটায় চোখ পরল মাহীনের সেটা কোন গাছ বোঝার চেষ্টা করল, এটা কী গাছ হতে পারে। তবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা এটা কী গাছ?’
‘ওহ, এটা ওয়েস্টার্ন রেড সিডার।’ পেছনে তাকিয়ে বলল রায়েদ।
মাহীন হঠাৎ করেই গতকাল রাতে রায়েদের বলা সেই ছাব্বিশ আগস্টের কথা ভাবল। ছাব্বিশ আগস্টের কথাটা জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নিশ্চয়ই সেটা সেরকম কোনো দিন হবে যেটা এই মুহূর্তটাকেই নষ্ট করে দিতে পারে। তাই এখন কেন ওকে কখনোই এটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা যাবে না।’
মাহীন ভাবনায় ব্যস্ত এবং রায়েদ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো নিশ্চুপ ভাবে। আবিষ্টমনে। মাহীন হঠাৎ ওর দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই ব্যপারটা খেয়াল করল। বলল,
‘সামনের দৃশ্যটা আমার থেকেও বেশি সুন্দর ওটা দেখো।’
রায়েদ মুচকি হেসে প্রমত্ত কন্ঠে বলল,’আচ্ছা তুমি সাধারণত পনিটেইল করো না কেন?’
মাহীনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘পনিটেইল? উম কারণ আমার চুল এত সিল্কি, পনিটেইল করলে আধাঘন্টার মধ্যে ঢিলা হয়ে বাঁধন নিচে নেমে আসে। এবং পনিটেইল দুধ পানি হয়ে যায়।’
তারপর একটু থেমে আবার বলল,’কিন্তু কেন?’
রায়েদ ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি ঝুলিয়ে বলল,’কারণ তোমাকে পনিটেইল করলে কিন্তু আরেক রকম সুন্দর লাগে।’
মাহীন লাজুক হাসল। ওর গালে লালাভাব ফুটে উঠেছে। ততক্ষণাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
‘আরেহ আমাকে বাদ দাও। আগে দেখো সূর্যদয় হচ্ছে।’ রায়েদ সামনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। আসলেই পিনাকেল পাহাড়কে ঠেলে তার পেছন থেকে সোনালি আলোর গোলকটা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তার তীব্র আলোর কীরণে ধীরে ধীরে পিনাকেল পাহাড় ও সামনের জঙ্গল মেখে যাচ্ছে। সূর্যের প্রথম কীরণ ঠিক ধীর গতির ঢেউয়ের মতো এগিয়ে আসছে। এ কিরণ ঠিক তরল সোনাল মতো সোনালি। এ যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য। মাহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল,’এমন দৃশ্য দেখাটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
রায়েদ বলল, ‘তোমাকে স্পেশালি এখানে আনার আরেকটা কারণ আছে।’
মাহীন সামনের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আসলেই আমাকে খুন করতে চাও?’
রায়েদ হেসে বলল,’আরেহ না। কারণটা হলো আজকে যখন অন্যরা পিনাকেল পাহাড়ে উঠবে তুমি তো তখন যেতে পারবে না। পাহাড়ে এসে যদি পাহাড়েই ঘুরতে না পারো তাহলে তোমার যাত্রাটাই তো সফল হলো না। আমি হলফ করে বলতে পারি পাহাড়ে উঠে যেই দৃশ্য সকলে দেখতে পাবে তার চাইতেও সুন্দর দৃশ্য এটা।’
মাহীন প্রসন্ন হেসে বলল,’ইউ আর দ্যা গ্রেটেস্ট এভার! আমি এটা ভেবেই মন খারাপ করছিলাম যে আমি পাহাড়ে উঠতে পারবো না। কিন্তু আমার সব আফসোস দূর করে দিলা।’
রায়েদ বলল,’মাই প্লেজার।’
তরল সোনার ন্যায় সোনালি কিরণ ক্ষণকালের মধ্যে মাহীন ও রায়েদকে ছুঁয়ে গেল। সোনারঙা আলোয় স্নান করে সুমিষ্ট পবিত্র অনুভূতিতে ভাসতে লাগলো অন্তর।
মনে হলো অন্ধকার ভুবনটাই যেন আলোয় ভরে গেল। ভোরের পাখিরা আপন নিবাস ছেড়ে বেরিয়ে পরেছে। ওরা সমতল ভূমি হতে বেশ উপরে বসে আছে বলে, মনে হচ্ছে পাখিরা যেন ওদের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
পেলব সাদা মেঘভেলা গুলো ওদের ঢাক্কা দিয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ২৯
লেখনী মাহীরা ফারহীন

‘এসব কি? তোমরা কেউই জানো না ও কোথায়?’
উদ্বিগ্ন স্বরে বলল সাইলোহ। কপালে গভীর চিন্তার ছাপ। জেনেট উৎকন্ঠিত গলায় বলছে,’দেখো আমার এতটুকু মনে আছে মাহীনের একটা ফোন আসছিল। তখন কোন সময় জানি না। রাতের বেলাও হতে পারে। তারপরই মাহীন গায়েব হয়ে গিয়েছে।’
নায়েল শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আরেকটু অপেক্ষা করো। এমনো তো হতে পারে ও কোথাও হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছে। ফিরে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।’
সাইলোহ বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘বলেও তো যেতে পারতো কাউকে। সাড়ে ছয়টা বাজে। গড নোজ হোয়েন উইল শি রিটার্ন!’
লিও বলল, ‘এখনো ফোন আনরিচেবল আসছে। নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না।’
ক্যারোট বলল, ‘এত নেতিবাচক কথা না বলে একটু ইতিবাচক ভাবেও তো ভাবতে পারো। এসে পরবে।’
লিম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ‘তা এসেই পরবে। কিন্তু ওর পায়ের যে কি অবস্থা কে জানে।’
নিজেদের ক্যাম্পের সামনে বসে কথা বলছে সকলে। এতক্ষণে বেশির ভাগ ছেলে মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে পরেছে। তবুও কেউ কেউ হয়তো এখনো পরে পরে ঘুমচ্ছে। ভোরের আরামদায়ক রোদের আলোয় ঝলমল করছে গাছ পালা। ফুরফুরে অচেনা ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ মিশ্রিত বাতাস স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তুলেছে পরিবেশ। এসিসিয়া এতক্ষণে বলল, ‘ওকে যেহেতু কেউ ফোন দিয়েছিল এবং তারপরই ও গায়েব হয়ে গিয়েছে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় যে ফোন দিয়েছিল তার সাথেই কোথাও গিয়েছে।’
নায়েল বলল, ‘সিরিয়াসলি এখান থেকে এখানে কেউ ওকে ফোনই বা দিবে কেন?’
লিম বলল, ‘সেটাই তো। আর যে ফোন দিয়েছিল সে তো এখান থেকে নাও হতে পারে। হয়তো অন্য কোথাও থেকে কেউ ফোন দিয়েছিল।’
এসিসিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘র‌্যবিট কোথায়?’
লিম জু বলল, ‘কি জানি। ও বোধহয় এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।’
তখনই বিল সেখানে দাঁড়াল এসিসিয়ার পাশে। এবং বলল, ‘সিয়া হোয়াট হ্যাপেন্ড? হোয়াট আর ইউ গাইস ওয়ারিড আবাউট?’
এসিসিয়া পানসে গলায় বলল, ‘ওদের ধারণা মাহীন হারিয়ে গেছে।’
বিল চমকে উঠে, ‘কী? মাহীন হারিয়ে গেছে?’
কথাটা একটু উচ্চস্বরে বলায় লিও বলল, ‘হারিয়ে গেছে ঠিক তা বলা যায় না। মাহীনের একটা ফোন এসেছিল তারপর ও তাঁবু থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এরপর আর কেউ ওকে দেখেনি।’
বিল জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা তখন কোথায় ছিলা?’
ক্যারোট বলল, ‘ওটা আরো অনেকক্ষণ আগের কথা। আমরা তখন ঘুমিয়ে ছিলাম।’
তখনই দেখা গেল বামদিকের বন থেকে মাহীন ও রায়েদ হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে আসছে। ওরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। এসিসিয়া সবার আগে সেটা খেয়াল করে বলল,
‘ওহ ঐতো দেখো মাহীন ফিরে আসছে। আমি বলেছিলাম না অহেতুক চিন্তা না করতে।’
ওর কথায় সকলেই সেদিকে দৃষ্টি ফেরাল। জেনেট বলল,’ও ওয়াও রায়েদের সাথে কোথাও গিয়েছিল বোধহয়।’
লিম বলল, ‘আমাদের আগে এটা কেন মাথায় আসলো না।’
ওরা সকলে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেল। তবে এসিসিয়া এবং বিল দাঁড়িয়ে রইল। এসিসিয়া বলল,
‘ওহ ইট’স রিয়েলি আমেজিং তাই না? রায়েদ মাহীনের মতো একজন ফ্রেন্ড পেয়েছে।’
বিল বলল, ‘হুম আমেজিং। এতবছরে অবশেষে একজন ফ্রেন্ড পেয়েছে তাও আবার মাহীন। কোথাও যাওয়ার সময় তো ওর কথাই মনে পরবে।’
সিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বিলের দিকে। বলল, ‘তো কি সমস্যা তাতে? ইউ নো হোয়াট এখানে মাহীনের মোটামুটি সব ফ্রেন্ডরাই ওদের শীপ করে।’
বিল বাঁকা হেসে বলল, ‘ওদের শীপ করে হাউ ফানি! এমন কিছু হলে তো ভালোই রায়েদের জন্য।’
শেষ কথাটা তেজের সঙ্গে বলে হেঁটে অন্যদিকে এগিয়ে গেল। এসিসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল, ‘অবশ্যই ভালো।’

মাহীন হাঁটতে হাঁটতে যখন দেখলো ওদের থেকে আরেকটু সামনেই বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে তখন বলল,
‘রায়েদ আমার মনে হয় ওরা আমাকে নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছে। আফটার অল আমি তো কাউকে কিছু বলে যেতেই ভুলে গিয়েছি।’
‘না সমস্যা নেই। তুমি এখন গিয়ে ওদের সব কনফিউশন দূর করো।’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গেল। রায়েদ নিজের তাবুর দিকে এগিয়ে গেল। মাহীন ওদের কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই সাইলোহ টিটকারির সুরে বলল, ‘ওহ ওয়াও! আমাদের তো ভুলেই গিয়েছো তুমি।’
মাহীন বলল, ‘এখন পর্যন্ত তো না।’
জেনেট বলল, ‘ওসব ছাড়ো আগে এটা বল তখন কি রায়েদই তোমাকে ফোন দিয়েছিল?’
‘হ্যা। ওই দিয়েছিল।’ বলল মাহীন।
ওরা কথা বলতে বলতে আবার নিজেদের তাঁবুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্যারোট বলল,’কেন?’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘কারণ ও একটা জায়গায় যাচ্ছিল এন্ড আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তাই ফোন দিয়েছিল।’
লিও বলল, ‘বাট এই শেষ রাতের সময় ও কোথায় গিয়েছিল? এবং ও তোমাকে এসেও ডাকতে পারতো। এখান এখান থেকে এখানে ফোন দিলো কেন?’
মাহীন বলল, ‘কারণ ও আমাকে ডাকতে আসলে সকলের ঘুমে বিঘ্ন ঘটতো। তাছাড়া আমরা শেষ রাতে কোথাও গিয়েছিলাম কারণ আমরা সূর্যদয় দেখতে গিয়েছিলাম।’
লিম জু উল্লাস ভরা কন্ঠে বলল, ‘তাই! এখানে কোথাও সানরাইজ পয়েন্ট আছে নাকি? তো শেষ পর্যন্ত তোমরা সূর্যদয় দেখতে পেরেছিলা?’
‘অবশ্যই, আমার জীবনের দেখা সবচাইতে সুন্দর দৃশ্য ছিলো। এখান থেকে কিছুটা দূরে এই সমতল ভূমি গিয়ে শেষ হয়েছে। তার চূড়া থেকেই দেখা যায় যে পিনাকেল মাউন্টেইনের ওপাশ থেকে সূর্যদয় হচ্ছে।’
নায়েল হাসি মুখে বলল, ‘অসাধারণ। কিন্তু রায়েদের তোমার কথাই কেন মনে পরলো?’
‘কারণ পাহাড়ে আমি উঠতে পারবো না। এইজন্যে আমাকে এখানে নিয়ে গিয়েছিল। এখন আমার আর কোনো আফসোস থাকবে না।’
.
.
.
.
প্রায় সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ সকল ছেলে মেয়েদেরকে দুটো হাইকিং দলে ভাগ করা হলো। গ্রুপ এ এবং গ্রুপ বি। প্রথম গ্রুপ ইতোমধ্যে তিনজন টিচার সহ যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। পিনাকেল মাউন্টেইন বেয়ে একবার উঠে আবার নেমে আসতে অন্তত চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগবে। গ্রুপ এ ক্যাম্পে ফিরে আসার পর গ্রুপ বি যাবে। তবে গ্রুপ বি সরাসরি ক্যাম্পে না ফিরে বিকেল নাগাদ মাউমেল নদীর তীরে বোটিং স্পটে পৌঁছবে। মাহীনের সকল ফ্রেন্ডরাই গ্রুপ এ হিসেবে চলে গিয়েছে। তবে মাহীনের পক্ষে কোনো ভাবেই পাহাড়ে ওঠা সম্ভব না বিধায় বেচারি থেকে গিয়েছে। তবে বিকেলে বোটিং করতে ঠিকই যাবে। মাহীন একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং ফোনে মিসেস নাসরিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। মিসেস নাসরিন মূলত কনফার্ম হতে ফোন করেছেন যে মাহীন আসলে পাহাড়ে গিয়েছে কিনা। এদিকে আবার এসিসিয়াও বাকিদের সঙ্গে থেকে গিয়েছে। সে নাকি দ্বিতীয় দফায় যাবে। মাহীন কথা শেষ করে নিজের ক্যাম্পের আশেপাশে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, এখন পাহাড়ের কথা না ভেবে অন্য কিছু ভাবা উচিৎ। বিকালে যখন বোটিং করতে যাবো, রায়েদের সঙ্গে গেলে ভালো হয় না? রায়েদ যেমন আমাকে সূর্যদয় দেখাতে নিয়ে গেল তেমনি আমি ওকে আমার সাথে নৌকায় ওঠার প্রস্তাব দিবো। যদিও আমি নিজেই নৌকা বাইতে পারি না। কিন্তু রায়েদ তো ক্যাম্প গাইড হিসেবে কাজ করেছে। অবশ্যই ও নৌকা বাইতে পারে। হ্যা সেটা একদম পার্ফেক্ট হবে।’
‘কি এত ভাবছো?’ হঠাৎ এসিসিয়ার কথায় চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসল মাহীন। এসিসিয়া ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাহীন প্রতুত্তরে বলল,
‘তেমন কিছু না। এমনিই হাঁটছিলাম এক মনে।’
এসিসিয়া ঠোঁটের কোণে হালকা ফিচেল হাসি ঝুলিয়ে বলল,’ডেট কেমন গেলো?’
‘কোন ডেট?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মাহীন।
‘রায়েদের সাথে তোমার ডেট।’
মাহীন হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি কিন্তু অনেক ফানি। আমি কখনো রায়েদের সাথে ডেটে যাইনি। আর আজ সকালের কথা বললে বলবো, ওটা হ্যাঙ্গআউট ছিল। ডেট না।’
এসিসিয়া নির্বিকার চিত্তে বলল,’পার্থক্য টা কি?’
মাহীন বলল,’পার্থক্য হচ্ছে যখন কোনো ফ্রেন্ডরা একসাথে ঘুরতে যায় সেটাকে হ্যাঙ্গআউট বলে। এবং কোনো কাপল যদি ঘুরতে যায় সেটাকে ডেট বলে। সো আমরা কোনো কাপল না।’
রোদের আলোয় এসিসিয়ার সোনালী চুল চকচক করে উঠছে। সিয়া ভ্রু উঁচু করে বলল,’তুমি নিশ্চিত?’
‘অবশ্যই।’ আত্নবিশ্বাসের সঙ্গে বলল মাহীন।

বিকেলের মিষ্টি সোনালি রোদ গাছপালার ফাঁক গলে উঁকি দেয়। বেশ বাতাস হচ্ছে ফলে ঝলমল করে দুলছে গাছের ডালগুলো। মাউমেল নদীর সেদ্ধ জলপাই রঙের পানি ঢেউয়ের টানে বয়ে চলেছে আপন গতিতে। একদিকে কাঠের লম্বা তক্তার সঙ্গে সারি সারি অনেক গুলো কাঠের নৌকা ও কেনু বাঁধা রয়েছে। প্রবল ঢেউয়ের প্রভাবে স্থির নেই সেগুলো। প্রতিনিয়ত দুলছে। যারা মাত্র পিনাকেল মাউন্টেইন থেকে সরাসরি এখানে এসেছে তারা ক্লান্তিতে মিইয়ে গেছে। অন্যান্যরা উদ্যোমি। সেই নৌকা গুলোর কাছে এক মধ্য বয়সি লোক রয়েছে যে সারা দিনের ধরা মাছ গুলো একে একে আলাদা করে বাকেটে ভরছে। সেই লোক লিটল রক থেকে এখানে এসে মাছ ধরে এবং নৌকাগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে। তার কাছ থেকেই অনুমতি নিয়ে একেকজন নৌকাগুলো নিয়ে পানিতে ভেসে পরছে। মাহীন তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করছে, ‘মি.ববোফিট আপনি কি জানেন আশেপাশে কোথাও এমন কোনো জায়গা আছে যেখান থেকে সবচাইতে সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায় এবং অবশ্যই নৌকা করে যাওয়া যায়। মি.ববোফিট গোলমতো খাঁচা ওয়ালা জাল থেকে ছোট ছেট মাছগুলো একটা বাকেটে ঢালতে ঢালতে বললেন,
‘দেখো মা এখানে সব জায়গা থেকেই সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়।’
মাহীন বলল, ‘হ্যা তা ঠিক। কিন্তু নৌকা নিয়ে গেলে তো তা বনের মাঝখান দিয়ে নদীতে চলবে। তাহলে বনের জন্য তো সূর্যাস্ত দেখাই যাবে না।’
মি.ববোফিট কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘দেখো একটা জায়গা আছে। যেখানে মাউমেল নদী এবং আরকানসাস নদী মিলিত হয় সেখান থেকে খুব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা তো যায়। কিন্তু সেটা অনেক দূর।’
মাহীন নিরাশ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আর কোনো জায়গা?’
‘হুম আরেকটা জায়গা আছে কাছাকাছি যদিও সেটা একটু বিপদজনক। উত্তর মাউমেল নদী এবং দক্ষিণ মাউমেল নদীর মিলন স্থলের আশেপাশে। তবে সাবধানে ওখানে কিন্তু তীব্র স্রোত।’
মাহীন বলল, ‘চলবে। আপনি শুধু বলেন কোন দিকে যেতে হবে।’
মি.ববোফিট ওকে বুঝিয়ে বললেন যাওয়ার গতিপথ। জেনেট ও লিও একসাথে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পরেছে ইতোমধ্যে। নায়েল, লিম ও সাইলোহ একসাথে যাবে। যদিও ক্যারোল চাচ্ছিল ওদের সাথে চলে যেতে তবে মাঝখান দিয়ে রাবিত এসে বাঁধ সাধলো। ক্যারোলকে বোটিংয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় প্রথমে সে দোনোমোনো করছিলো বটে। পরে মাহীন জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে ওদের। নায়েল ও লিম দাঁড়িয়ে আছে এখনো। মাহীন গিয়ে ওদের কাছাকাছি দাঁড়াতেই লিম বলল, ‘মাহীন তুমি আদৌ মনে রাখতে পারবা কোন দিক থেকে যেতে হবে?’
মাহীন নিজের সেলফোনটা সামনে তুলে ধরে বলল,
‘বুম! আমি সব রেকর্ড করে আনসি। ইন কেস যদি আমার মনে না থাকে তাহলে এটা সাহায্য করবে।’নায়েল বলল, ‘অবিশ্বাস্য।’
মাহীন মুচকি হাসল। তারপর ওদের পার করে সামনে এগিয়ে গেল। এদিকে অনেকেই গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে বা বসে আছে। অনেকেই সামনাসামনিই নৌকা নিয়ে ভেসে রয়েছে। বেশি দূর যাচ্ছে না। মাহীন হাঁটতে হাঁটতে কোথাও রায়েদকে দেখতে পেল না। তবে ওর নিশ্চিত মনে আছে ও রায়েদকে এখানে আসতে দেখেছে। ও দাঁড়িয়ে চারিদিকটা পরখ করতে ব্যস্ত তখন বিল ওর পাশে এসে দাঁড়াল। মাহীন ওকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘আরেহ বিল তুমি এখনো বোটিং করতে যাওনি?’
বিল বলল, ‘না। সেজন্যেই তো এসেছি। আমি যাচ্ছি বোটিং করতে, তুমি আমার সাথে যাবা?’
হঠাৎ এমন প্রস্তাবে মাহীন থতমত খেয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, এই না। মাঝখান দিয়ে বিল আবার ঝামেলা করছে। আমার প্ল্যানটাই বানচাল হয়ে যাবে। এখন ওকে কাটাই কিভাবে?’
তখনই এসিসিয়া ওখানে এসে দাঁড়াল। এবং হাসি মুখে বলল,
‘হেই বিল তুমি কি ওকে বোটিং এর প্রস্তাব দিচ্ছো?’
সিয়ার কথায় মাহীন চমকে উঠল। সিয়া মাহীনের এক কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কিন্তু মাহীন তো মাত্র এখানে এসে পৌছলো। জায়গাটা তো কম দূর না। এবং ওর পায়ে ব্যথা। ওর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নেওয়া উচিৎ না?’
মাহীনের মুখে আরেকটু হলেই হাসি ফুটে উঠছিল। ও নিজেকে সংযত করে বলল,
‘হুম তোমার কথা খুব একটা ভুল নয়। আর..
‘কেন মাহীন? বোটিং এ তো পা চালানোর দরকারই নেই। তুমি তো জাস্ট নৌকায় বসে থাকবা।’ মাঝখান দিয়ে এসে বলল, সাইলোহ।
বিল আগ্রহী কন্ঠে বলল, ‘তো তুমি যেতে পারবে তো?’
সাইলোহ অপর পাশ থেকে মাহীনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে হাসি মুখে বলল,
‘অবশ্যই। ও জাস্ট লজ্জা পাচ্ছে।’
মাহীনের নিজের মাথা চাপড়াতে ইচ্ছা করল। সাইলোর ওপর এমন রাগ হলো তা আর বলার নয়। এসিসিয়া বলল, ‘সাইলোহ বিল মাহীনকে জিজ্ঞেস করেছে তোমাকে নয়। মাহীন কে বলতে দাও।’
মাহীন অতিষ্ঠ হয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা দুইজনই চুপ হও। আমি যাচ্ছি ওর সাথে।’
বিলের মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ও মাহীনকে আসতে বলে সামনে এগিয়ে গেল। মাহীন নিজের কাঁধ থেকে সিয়া ও সাইলোহ দুইজনের হাতই ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে পেছনে ঘুরে ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কঠোর গলায় বলল, ‘তোমরা দুইজন নিজের শত্রুতার মাঝে যদি আমাকে আরেকবার ফাঁসিয়েছ না! তাহলে বলছি আমি কাউকে শাস্তি কিভাবে দেই সেটা এখনো দেখোনি।’
বলেই পেছন ঘুরে গটগট করে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। মাহীনের প্রসন্ন মন মেজাজ মূহুর্তেই তিরিক্ষ হয়ে গিয়েছে। বিল নৌকার বাঁধন খুঁটি থেকে খুলছে তখন মাহীন গিয়ে সেখানে দাঁড়াল। নৌকা দুলছে বিধায় মাহীনের পা টলমলিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি নৌকায় বসে পরল। বিল একাই বৈঠা হাতে নৌকা বাইতে লাগল।
.
.
রায়েদ হাঁটতে হাঁটতে বনের ভেতর থেকে বাইরে নদীর পাড়ের দিকে আসছে। ও কিছুক্ষণ পূর্বে হাঁটতে হাঁটতে বনের দিকে গিয়েছিল। পাড়ের দিকে এসে দাঁড়ায়। দূরে নদীতে একটা নৌকায় মাহীনকে পেছন থেকে বসে থাকতে দেখা গেল। রায়েদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে বুঝতে পারল অপর পাশে বসে বিল নৌকা বাইছে। হঠাৎ মনটা কেমন তেঁতো হওয়া লেবুর রসে তলিয়ে গেল। দমকা হাওয়ার তোরে ফুরফুরে মেজাজটা নাড়া খেয়ে তিরিক্ষি হয়ে উঠল। আবার হাঁটতে হাঁটতে নানান ভাবনা চলতে থাকল মনে, ‘ওহ ওয়াও এত মানুষ থাকতে বিলের মাহীনকেই নিয়ে নৌকায় উঠতে হলো! মানে এমন একটা মানুষ কিভাবে হয়ে যেতে পারে ও? এক কালে তো আমারই ভাইয়ের মতো বন্ধু ছিলো। এন্ড নাও সি মাহীন আমার সবচাইতে ভালো ফ্রেন্ড বলে ওর পেছনে গিয়ে লেগেছে। আমার খুশি তো ওর সহ্য হয় না। ও নিজে বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন হয়ে স্কুলের পার্ফেক্ট বয় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আনন্দে। আর আমি যে এই সবকিছু থেকেই দূরে ছিলাম। বিচ্ছিন্ন ছিলাম সেটাই বোধহয় ওর মনপুত ছিলো। এখন আমার আবার সকলের সাথে মেলামেশা, পিকনিকে আসা কোনোটাই তার হজম হচ্ছে না। বিল তো স্কুলের ক্রাস পয়েন্ট। তাহলে? এতজন থাকতে, ইভেন ওর বেস্ট ফ্রেন্ড এসিসিয়া দিনরাত ওর পেছনে ঘুরেবেড়ানোর পরও মাহীনের পেছনে গিয়ে ভিরলো। কারণ ওর ধারণা আমি মাহীনকে পছন্দ করি? হ্যা এই সবকিছু মাহীনের জন্য হয়েছে। তাই বলে কী ওকেই আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে? কেন আমার কী বন্ধু থাকতে পারে না? আমি কাউকে পছন্দ করতে পারি না? আলবাত পারি। আর মাহীন কি ছিনিয়ে নেওয়ার জিনিস? ও মানুষ। ও নিজের ইচ্ছা মতো চলাফেরা করতে পারে। বিল চাইলেই তো আর সবকিছু নিজের ইচ্ছা মতো চালাতে পারবে না। ঠিক যেমন বেনু পাখিও উড়ে সাগর পার করে এসে দ্বীপে বসে এবং চিৎকার করে। বলা হয় সেই চিৎকারের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীতে কি থাকবে আর কী থাকবে না। কিন্তু এটা শুধুই একটা কল্পকথা যা কখনো বাস্তবে হবে না। তবে মাহীনও কী অদ্ভুত একটা মেয়ে। আজ সকালেই আমার সাথে সূর্যদয় দেখতে গেলো। তখন মনে হয়েছিল আসলেই বোধহয় মাহীন আমাকে বিশেষ ভাবেই দেখে। ওর সকল বন্ধুদের থেকেও বেশি কিছু আমি। নাহ বোধহয় আমি ভুল ছিলাম। এই এখন বোটিং এ আসার পর একবারও তো আমার সাথে কথা বললো না। বিলের সঙ্গে চলে গেলো বোটিংয়ে।’
এসিসিয়া রায়েদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে। ও কিছু না বলতেই রায়েদ নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসল। তারপর গম্ভীরমুখে বলল, ‘কি চাই?’
এসিসিয়া ভাবলেশহীন মুখে বললো, ‘কিছুই না। কে কী করল আর কে কী করল না তাতে আমার কোনো কাজ নেই।’ বলে একটু বিরতি দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘তুমি যখন মাহীনকে পছন্দ করো, বলে দাও না ওকে।’
রায়েদ এসিসিয়ার কথায় চমকে উঠল তবে তা প্রকাশ করলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর টিটকারির সুরে বলল, ‘হ্যা আমি মাহীনকে পছন্দ করি, তোমার স্বপ্নে। আমাকে এসব বলে তুমি আসলে কি করতে চাচ্ছো বলোতো?’
সিয়া বাঁকা হাসল। বলল, ‘মাহীন আসলে সবার পছন্দ হওয়ার মতোই মেয়ে। দেখো আবার কার কার মাহীনকে পছন্দ।’
রায়েদ বিদ্রুপ করে হাসল। বলল, ‘কার কার মাহীনকে পছন্দ সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমার সাথে কি হবে না হবে সেটা আমি বুঝে নেব। তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।’ বলে একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল,
‘দেখাই যায় বিল তো তোমার দিকে তাকিয়েও দেখে না। শুধু শুধু ওর পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছ এবং এখন এখানে এসে সময় নষ্ট করছ।’
এসিসিয়া বাঁকা হেসে বললো, ‘ইউ নোও হোয়াট? আমি না নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু পাল্টাতে চাই। কিন্তু একটা জিনিস পাল্টাতে চাই না। আর সেটা হলো আমি শুধু নিজের কথা ভাবি। এবং এখনো আমি যাই করছি সবই নিজের জন্য করছি, না তোমার জন্য, না মাহীনের জন্য।’ বলেই হাঁটা ধরল। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
.
.
.
মাহীন মাত্র মাটিতে পা ছোঁয়াল এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ওর মাথাও ঘুরছে কিছুটা। এবং কুর্তির এক হাতটা একটু ভিজে গিয়েছে। সাইলোহ, নায়েল বা লিম এখন আর আশেপাশে নেই। ওরা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তবে এসিসিয়া এখনো আশেপাশেই রয়েছে। ও এগিয়ে এসে অবাক স্বরে বলল, ‘ওমা মাহীন মাত্র বিশ মিনিটের মাথায় ফিরে আসলা যে?’
বিল নৌকা থেকে নামেনি তখনো। ও বলল,’মাহীনের মাথা ঘুরছিল।’
মাহীন ম্লান কন্ঠে বলল, ‘হ্যা আমার মাথা এখনো ঘুরছে। যাই হোক তুমি এখনো যাওনি কেন? বিল আবারও বোটিং করতে যাবে। তুমিও যাও ওর সাথে। আমার জন্যে তো পুরো সময়টাই নষ্ট হলো।’
বিল বলল, ‘না না। কোনো সমস্যা না। স্রোতে নৌকা এত দোলে অভ্যাস না থাকলে মাথা ঘুরতেই পারে।’
এসিসিয়া নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, ‘আচ্ছা মাহীন তুমি বিশ্রাম নাও।’
মাহীন ওদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে অন্য দিকে হাঁটা দিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা গাছে হেলান দিয়ে ঘাসের ওপর বসলো। বিরক্ত দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। নরম টিয়ে রঙের মখমলের কার্পেটের মতো ঘাস। একটা সিডার গাছের উঁচু ডালে বসে লম্বা লেজ ওয়ালা লাল কার্ডিনাল সুর তুলে গান ধরেছে। তবে সে বড় মন নাড়িয়ে দেওয়া সুর। মন কেমন করে উঠল মাহীনের। গাছের ডালপালার ফাঁক ফোকর হতে উপরের দিকে তাকিয়ে থেকে নীল আকাশের ছোট ছোট টুকরো দেখতে লাগল মাহীন।
মনে নানা ধরনের ভাবনা তালগোল পাকিয়ে উঠছে, ওফ আমার প্ল্যান প্রোগ্রাম সবই বানচাল করেছে ওরা।
সাইলোহর হঠাৎ কী হয়ে গিয়েছিল? কেন করল এমনটা? আশ্চর্য! আর আমিও কী এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নাকি? বাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই। খুব সুইট সুইট লাগে না আমাকে? কিন্তু আমার রাগ ওরা এখনো দেখেনি। যাই হোক এসিসিয়ার কল্যাণে অবশ্য আমি তখন বেঁচে যেতাম যদি না সাইলোহ মাঝখান দিয়ে ঝামেলা করত। তাই তো এসিসিয়াকে আবার বিলের সাথে যেতে সাহায্য করলাম। মনে হয় যেন কোনো দিকেই আমার চোখ কান খোলা নেই। এসিসিয়া যে বিলকে পছন্দ করে সেটা আমি অনেক আগেই বুঝেছি।’ ভেবে আবারও দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে।

ইনশাআল্লাহ চলবে।