এক বরষায় পর্ব-১৫+১৬

0
611

#এক_বরষায় [১৫]
লেখনীতে_জেরিন আক্তার নিপা

——————
রাতে জেসমিন, আতিফ মুনতাসীরের ঘরে বসে পড়ছিল। আতিফ বরাবরই পড়াশোনায় ভালো। মনোযোগও আছে ওর। কিন্তু জেসমিন মহা ফাঁকিবাজি। ওকে কোন পড়া দিয়ে দিলে জীবনেও পড়বে না। গতকাল একটা অংক করতে দিয়েছিল। সেটা তো করেই নি উল্টো এখন আলাপ জুড়ে বসেছে।

-মুনতাসীর ভাই, আমার জানেন কী মনে হয়? আমার মনে হয় নয়ন ভাই আপুকে তাবিজ করেছে। জাদু টোনার প্রভাব না হলে আপু কোনদিন নয়ন ভাইয়ের সাথে কথা বলতো না। আমি একশো টাকা বাজি ধরে বলতে পারি আপু এখন যা করছে নিজের জ্ঞানে থেকে করছে না। সব জাদুর বলে করছে।’

আফিত জেসমিনের কথায় একমত হতে পারল না। সে প্রতিবাদ করে বলল,

-আমার মনে হয় না নয়ন ভাই ধারা আপুকে জাদু করে বিয়ে করতে চাইবে। জাদু তো বেশিদিন থাকবে না। এক বছর ছয় মাস পর কেটে যাবে। তখন তো ধারা আপু আবার চলেই আসবে।”

-আতিইফার বাচ্চা! তুই বেশি জানিস? জাদু না করলে আমার বোন নয়ন ভাইয়ের সাথে রাগারাগি না করে মিষ্টি করে কথা বলছে কেন?’

-নয়ন ভাই কিন্তু ততটাও খারাপ না। নয়ন ভাইকে আমার কাছে ভালোই লাগে। ধারা আপুরও মনে হয় একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করেছে।”

মুনতাসীর এতক্ষণ চুপ থেকে ওদের কথা শুনছিল। এবার সে কিছুটা ধমকের স্বরেই বলল,

-তোমরা কি আমার কাছে গল্প করতে এসেছ? নাকি পড়তে?”

ধমক খেয়ে আতিফ পড়ায় মনোযোগ দিলেও জেসমিন দিতে পারল না। সে এই ভাবনা থেকেই বেরুতে পারছে না।

-আপুর বিয়ে কি তাহলে নয়ন ভাইয়ের সাথে হবে?”

মুনতাসীর রেগে গিয়ে বলল,

-জেসমিন তোমার পড়তে ভালো না লাগলে এখন যাও।”

-সত্যিই আজকে আমার পড়তে ভালো লাগছে না।”

এই সময়ই গেট খোলার শব্দ হলো। জেসমিন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল কে এসেছে।
ধারা গেট খুলে দিয়ে নয়ন ভাই ও তার মা’কে সামনে দেখল। নয়নের মা কোন কালেই ধারাকে পছন্দ করতো না। এখনও করে না। তবুও ধারা উনাকে সালাম দিল। নয়নের মুখ হাসি হাসি। ধারা বুঝতে পারছে না এই অসময়ে নয়ন ভাই তার মা’কে নিয়ে তাদের বাড়িতে কী করতে এসেছে। নয়নের মা মুখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-তোমার বাবা বাড়িতে নেই?’

-না। বাবা তো এই সময় বাজারে থাকে।’

নয়নের মা বিড়বিড় করে বলল,

-এটাই তো তার মদ গেলার সময়। মাতাল একটা।’

-ঘরে এসে বসুন কাকী। দাদী ঘরেই আছে।’

নয়নের মা ঘরের দিকে এগোতে লাগল। ধারা ভেবে পাচ্ছে না নয়ন ভাইয়ের মা তাকে তার বাবাকে এত অপছন্দ করা স্বত্বেও আজ তাদের খবর নিতে এসেছে কেন? ধারা পেছন থেকে নিচু গলায় নয়নের কাছে জানতে চাইল,

-কী ব্যাপার নয়ন ভাই? কিছু কী হয়েছে?’

নয়ন রহস্য করে হাসল৷ কোন উত্তর দিল না। ধারা আবার বলল,

-কী হলো নয়ন ভাই! কথা বলছেন না কেন?’

-ঘরে গিয়েই জানতে পারবে। মা আজ একটা বিশেষ কারণে এসেছে।’

ধারার কপাল কুঁচকে গেল। বিশেষ কারণ! বিশেষ কারণটা কী হতে পারে? এক মুহূর্তের জন্য ধারার মনে অন্য একটা ভাবনা উঁকি দিল। সে যা ভাবছে তা যদি হয় তাহলে নয়ন ভাইকে ছেড়ে দিবে না সে। ধারা প্রথম দিনই নয়ন ভাইকে বলে দিয়েছিল ধারা নয়নকে পছন্দ করে না। আর না কোনোদিনও করবে। নয়ন ভাইকে সে ভালো করে বুঝিয়েছে। আবার কড়া কথায় বুঝিয়েছে। তারপরও নয়ন ভাই শুধরায়নি। নয়ন ভাইও মেনে নিয়েছিল ধারাকে কখনও সে পেতে চাইবে না। তাই তো ধারা এই কয়টা দিন নয়ন ভাইয়ের সাথে ভালো করে কথা বলেছে।

-নয়ন ভাই আমাদের বাড়িতে তার মা’কে নিয়ে এসেছে! আপুর বিয়ের কথা বলতে আসেনি তো? নয়ন ভাইয়ের মা আপুকে মেনে নিয়েছে!’

জেসমিন বইখাতা খোলা ফেলে রেখেই দৌড়ে বেরিয়ে এলো।

-মুনতাসীর ভাই, আমিও যাই? গিয়ে দেখে আসি সত্যিই আপুর বিয়ের কথা হচ্ছে নাকি?’

কথাটা বললেও মুনতাসীরের অনুমতির জন্য থামলো না আতিফ। মুনতাসীর কিছু বলার আগেই জেসমিনের পেছনে ছুটতে লাগল। নয়নের মা ধারার দাদীর সাথে কথা বলছে। ধারা রান্নাঘরে গেল। বাড়িতে মানুষ এসেছে, সেই মানুষটা যে-ই হোক। ভদ্রতা রক্ষার জন্যেও তো সামনে কিছু দিতে হয়।
জেসমিন হুড়মুড় করে রান্নাঘরে ঢুকে বলল,

-নয়ন ভাই তার মা’কে নিয়ে কেন এসেছে আপু?’

-আমি কী জানি? আমাকে বলে আসেনি।’

-বলে আসেনি? তুমি জানতে না আজ ওরা আসবে!’

ধারা বিরক্ত হয়ে বলল,

-আমি কীভাবে জানবো?’

-তোমাদের বিয়ের কথা বলতে এসেছে আর নয়ন ভাই তোমাকে বলে আসেনি?’

ধারার ইচ্ছে করল ঠাস করে এক চড় দিয়ে বোনের চাপার দাঁত খুলে ফেলে। কিন্তু সে আপাতত এই ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করল না। আগুন চোখে বোনকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নয়ন ভাই যদি তার ভালোমানুষির ভুল মানে ধরে এতটা বাড়াবাড়ি করে ফেলে তাহলে আজ নয়ন ভাইকে এমন কিছু কথা শোনাবে যাতে এই জীবনে আর ধারার সামনে না আসে সে। জেসমিন ঠিকই বলে। এই দুনিয়ায় ভালো মানুষের ভাত নেই। সে একটু ভালো করে কথা কি বলেছে নয়ন ভাই তো বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে।
দাদীও নয়নের মা’কে বিশেষ পছন্দ করে না। এই মহিলা সারা পাড়া জুড়ে তার নাতনির বদনাম করে বেড়ায়। ধারা উনাদের সামনে বিস্কুট, চানাচুর, শরবত রাখলে নয়নের মা চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখছে। আতিফও এই ঘরে আছে। নয়নের মা চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-এটাই কি তোমাদের ভাড়াটিয়া?’

দাদী উত্তর দিলেন,

-হ। এখন ও আমাদের ঘরের ছেলে।’

-আরেকজন ছেলেও না আপনাদের বাড়িতে থাকে। সে কোথায়?’

-ঘরেই আছে। ডাইকা দিমু? তার লগে কোন দরকার?’

-না না। আমি তো এমনি বললাম। পাড়ার অনেকে বলছিল। আমি কোনোদিন দেখিনি।’

দাদী জেসমিনকে ইশারা করে বলল,

-মুনতাসীররে এই ঘরে আইতে ক। তোর কাকী নাকি ওরে দেখে নাই।’

বলার সাথে সাথে জেসমিন মুনতাসীর ভাইকে ডাকার জন্য ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নয়ন মা’কে সবার সামনে কিছু বলতেও পারছে না। মা যে কাজে এসেছে তা না করে ওই লোককে নিয়ে কথা বলার কী দরকার ছিল! মুনতাসীর দরজা দিয়ে ঢুকলে দাদী বললেন,

-ওই তো আইসা পড়ছে। ও আমাগো আত্মীয়।’

নয়নের মা মুনতাসীরকে দেখতে দেখতে বলল,

-হু।’

মুনতাসীর ভেবে পাচ্ছে না এখানে তাকে ডাকা হয়েছে কেন? তার দরকার কী? নয়ন মা’কে চাপা গলায় কিছু বলল। এ ঘরে মুনতাসীরের উপস্থিতিতে ধারার চেহারা থেকে রক্ত সরে গেল। মুনতাসীর ধারার দিকে না দেখলেও ধারার চোখ ওর উপরেই। দাদীর কাজে সে মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্ত হয়। এই লোকের সামনে সে নয়ন ভাইকে অপমান করবে? এতে তো নয়ন ভাই বেশি কষ্ট পাবে। পাক, তার নিষেধ স্বত্বেও উলটাপালটা কাজ করলে কষ্ট পাওয়াই উচিত।

-রাইতের বেলা তোমরা কেন আইছো কইলা না তো।’

নয়নের মা এবার আসল কথা পারলেন। যে কারণে এসেছিলেন তিনি, কাঁধে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে বললেন,

-আল্লাহর রহমতে আপনাদের দোয়ায় আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবারে বিয়ে। ছেলে মালয়েশিয়া থাকে। নয়নই সব খোঁজ খবর নিয়ে বিয়ের কথা এগিয়েছে। আপনাদের পুরো পরিবারের দাওয়াত রইল। হলুদের দিনও যাবেন।”

ধারা সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল। মনে মনে কতকিছু ভেবে নিয়েছিল সে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। উল্টো ভালো একটা খুশির খবর শুনলো। তাহলে সেদিন যে ছেলেটা দেখতে এসেছিল তাকে রোজী আপার পছন্দ হয়েছে। বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। জেসমিনও নিজের ভুল বুঝতে পারল। রোজী আপার বিয়ের খবর শুনেই খুশি হয়ে উঠল সে।

-নয়ন ভাই ছেলের ছবি আছে? আমাদের তো ছেলেকে দেখালে না! একা একাই বিয়েও ঠিক করে ফেলেছ। এখন কার্ড নিয়ে দাওয়াত দিতে এসেছ। আমি কিন্তু রাগ করেছি নয়ন ভাই।”

নয়ন হাসল। হেসে আড়চোখে মুনতাসীরকে দেখে বলল,

-তুই তো আজকাল বিজি থাকিস। আমাদের বাড়ি যাওয়ার তোর সময় কই? গেলে না জানতে পারতি। আর ছেলের ছবি আমার মোবাইলেই আছে।’

-কই দেখাও। দেখাও না নয়ন ভাই।”

নয়নের মা দাদীর হাতে কার্ডটা দিয়ে বললেন,

-রোজীর অনেক ইচ্ছে ওর বিয়ের কয়টা দিন ধারা জেসমিন যেন আমাদের বাড়িতে থাকে। মেয়েটার তো আর বোন টোন নেই। ওরা কাছে থাকলে মন খারাপ হবে না। এই অনুরোধই আপনাকে করার ছিল। ওদেরকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েন।”

দাদী হুট করে না-ও বলতে পারল না। আবার হ্যাঁ-ও বলল না। উনি বললেন,

-ওগোর বাপেরে না জিগাইয়া আমি কিছুই কইতে পারমু না।”

জেসমিন খুশিতে চিংড়ি মাছের মতো লাফিয়ে বলল,

-আমি যাব। আমি রোজী আপার সাথে থাকব। বাবা না করবে না।”
*******

রোজী আপার বিয়ে উপলক্ষে জেসমিন ক’দিন ধরে কলেজে যাচ্ছে না। রাতে মুনতাসীরের কাছে পড়তেও আসছে না। অবশ্য বাড়িতে থাকলে তো পড়তে আসবে। ওকে এখন সারাদিনেও বাড়িতে পাওয়া যায় না। পুরোটা সময় নয়নদের বাড়িতে থাকে। সেদিন নয়ন তার মা’কে নিয়ে চলে যাওয়ার পরই জেসমিন তাকে বলেছে,

-মুনতাসীর ভাই রোজী আপার বিয়ের জন্য আমাকে অনেকদিন ছুটি দিবেন। আমি এক সপ্তাহ পড়ব না।’

-এতদিন ছুটি নিয়ে কী করবে? বিয়েটা তো তোমাদের বাড়িতে হচ্ছে না। তোমার নিজের বোনের বিয়ের সময় এক সপ্তাহ ছুটি নিও।”

-আমার বোনের বিয়ে হতে হতে আমি না-ও বাঁচতে পারি। আপু কোনদিন বিয়ে করবে বলে আমার মনে হয় না।”

-কেন?”

-জানি না। যেখান থেকেই আপুর বিয়ের জন্য আসে, আপু না করে দেয়। আপনি ওসব কথা ছাড়ুন তো। আমি এক সপ্তাহ কলেজ, প্রাইভেট কিছুই পড়ব না।”

সেই বলার পর থেকেই জেসমিনের টিকির লাগালও মুনতাসীর পাচ্ছে না। ওর সাথে পড়ে আতিফেরও পড়াশোনা লাটে উঠেছে।
ধারা অবশ্য সারাদিন বাড়িতেই থাকে। বিয়ে বাড়িতে ওকে যেতে দেখেনি মুনতাসীর। এখন যেহেতু জেসমিন, আতিফ বাড়ি থাকে না তাই খাওয়ার সময় ওরা দু’জনই থাকে। ধারা টেবিলে খাবার দিয়ে যত পারে দূরে দূরে থাকে। মুনতাসীরের সামনে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না সে।
সেদিন রাতে খাবার সময় মুনতাসীর প্রথম বার ধারার সাথে কথা বলল,

-জেসমিন, আতিফ এখনও ফিরেনি?’

অকস্মাৎ এই প্রশ্নে ধারা ঝট করে একবার মানুষটার দিকে তাকাল। সাথে সাথে চোখ সরিয়েও নিল। ধারার বুক ধুকপুক করছে। অথচ এই প্রশ্ন শুনে বুক ধুকপুক করার কোন কারণ নেই। সাথে সাথে কোন উত্তর দিতে পারল না ধারা। কিছুটা সময় নিয়ে ক্ষীণ গলায় উত্তর দিল,

-না।”

চলবে _

#এক_বরষায় [১৬]
লেখনীতে_ জেরিন আক্তার নিপা

————
নয়নদের বাড়ি সাজানো হচ্ছে। পুরো বাড়ি ঘিরে লাল নীল হলুদ মরিচ বাতি লাগানো হয়েছে। রাতের বেলা মরিচ বাতির ঝলমলে আলো রাস্তা থেকে দেখা যায়। বড় রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত যতগুলো আম, কাঁঠাল গাছ ছিল সব গুলোয় চুন দেওয়া হয়েছে। নয়নদের উঠানে এক স্টেজ বাঁধা হয়েছে। এটা হলুদের স্টেজ। আর দাওয়াতের মানুষ ও বরযাত্রী খাওয়ানোর প্যান্ডেল বড় করে বাড়ির পাশে খালি জায়গা টায় বাঁধা হয়েছে। উঠানের এক কোণে বড় বড় তিনটা সাউন্ড বক্স রাখা হয়েছে। এতে সারাদিনই হিন্দি বাংলা গান বাজছে। পাড়ার যত ছেলেমেয়ে আছে তারা নয়নদের বাড়ি থেকে নড়ছে না। ওদের থাকা খাওয়া রাতে ঘুমও এখানেই হয়। নিজের একমাত্র বড় বোনের বিয়েতে নয়ন কোন কমতি রাখতে চায় না। আশি হাজার টাকা করে এক লক্ষ ষাট হাজার টাকা দিয়ে বড় বড় দুইটা গরু কেনা হয়েছে। হলুদের রাতে গরু দুইটা জবাই করা হবে। এলাকার একটা মানুষকেও দাওয়াত দিতে বাকি রাখেনি। সব কিছুর মাঝে নয়ন একটু পরপর এসে তার বোনটাকে দেখে যাচ্ছে। আপা খুশি আছে তো? আপা খুশি থাকলেই সে-ও খুশি। রোজী খুশি কি-না তা সে জানে না। কিন্তু তার এই পাগল ভাই টার জন্য সারাক্ষণ মুখে একটা খুশির ঝলমলে হাসি ঝুলিয়ে রাখছে। ছেলেটা কয়টা দিন ধরে খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে তার বিয়ের আয়োজনে লেগেছে। তখন যদি তার মুখেই হাসি না থাকে তাহলে ওর ভাইয়ের সব কষ্ট বেকার যাবে।
ধারা রোজী আপার সাথে বসে আছে। সাইন্ড বক্সে হলুদ বাটো মেন্দি বাটো গান বাজছে। তাতেই ছেলে মেয়েরা যে যার মতো নাচছে। ধারা গলা উঁচিয়ে বলল,

-রোজী আপা, তুমি খুশি তো?’

রোজী বাচ্চাগুলোর আনন্দ দেখে নিজেও হাসছিল। ধারা কিছু বলছে বুঝতে পের ওর দিকে তাকালো। সে-ও চেঁচিয়ে বলল,

-কিছু বললি?’

-এই বিয়েতে তুমি খুশি তো?’

-কী বলছিস শুনতে পারছি না। ঘরে গিয়ে কথা বলি চল।’

ওরা বাইরে থেকে উঠে ঘরে চলে এলো। এখন গানের শব্দ কিছুটা কম শোনা যাচ্ছে। রোজীর মুখে হাসি লেগেই আছে। সে জিজ্ঞেস করল,

-কী বলছিলি বাইরে?’

ধারা কথাটা বলবে কি-না ইতস্তত করছে। রোজী আপাকে পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিতে চায় না সে। ধারা কিছু বলছে না দেখে রোজী আবার জিজ্ঞেস করল,

-কী বলবি বল।’

-এসবে তুমি খুশি তো রোজী আপা?”

-আমি? আমার তো দুঃখ পাওয়ার কোন কারণ নেই। আবার খুশি হওয়ারও কারণ নেই। আমি দুঃখ খুশির মাঝামাঝি কোন একটা জায়গায় ঝুলে আছি। তোদের সবার খুশি দেখে নিজেরও খুশি হতে ইচ্ছে করছে। আবার সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে খারাপও লাগছে।”

ধারা আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইল না। রোজী আপা তার খুব কাছের একজন মানুষকে হারিয়েছে। যার সাথে একটা সময় বাকিটা জীবন কাটানোর কথা ভেবেছিল। একসাথে কত স্বপ্ন দেখেছিল। সেই মানুষটাকে ছাড়া রোজী আপা ভালো নেই। সেই মানুষটাকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন ভুলিয়ে অন্য কারো বউ হওয়া সহজ কথা না। ধারা জানে রোজী আপা ভালো নেই। ও বাইরে থেকে ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ দু’জন চুপ করে থাকল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোজী বলল,

-ধারা তোকে আজ একটা কথা জিজ্ঞেস করি? এই বিষয়ে এর আগে আমি তোর সাথে কোনোদিনও কথা বলিনি। আজ বলছি বলে রাগ করিস না।”

-তোমার কোন কথাতে আমি রাগ করব না।”

-আমার ভাইটাকে তুই কেন পছন্দ করিস না? ওর মাঝে কী নেই? কেন পাগলটাকে কষ্ট দিস ধারা?”

ধারা রোজী আপার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। রোজী আপা সত্যিই আজকের আগে তার ভাইকে নিয়ে ধারার সাথে কোন কথা বলেনি। রোজী আপা শুরু থেকেই জানতো নয়ন ধারাকে পছন্দ করে। ধারা ওকে পাত্তা দেয় না এটাও জানতো সে।

-তুই কি রাগ করছিস ধারা? ভাবছিস না তো ভাইয়ের হয়ে কথা বলতে এসেছি আমি!”

-না। ভাইয়ের হয়ে কথা বলার হলে তুমি আরও আগেই বলতে।”

-নয়নকে কেন তোর এত অপছন্দ বলবি আমাকে?”

-অপছন্দ তো না। নয়ন ভাইকে একজন মানুষ হিসেবে আমি খুবই পছন্দ করি। প্রথম দিকে আমি ভাবতাম নয়ন ভাই বেকার বলে ওকে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পারলাম নয়ন ভাই বেকার হয়েও ও যা কাজ করে তা অন্য কেউ করতে পারতো না। আমি নয়ন ভাইকে অপছন্দ করি না। আবার সেভাবে বিশেষ অর্থে পছন্দও করি না। প্রেমিক হিসেবে নয়ন ভাইকে আমি কখনও ভাবতে পারি না। আমি স্বামী হিসেবে যাকে চাই সে মানুষটা নয়ন ভাই না। তুমি রাগ করছো না তো রোজী আপা? কিছু মানুষকে পছন্দ করা যায় কিন্তু কখনও ভালোবাসা যায় না। নয়ন ভাই আমার কাছে তেমনই একজন।”

রোজী ভাইয়ের কথা ভেবে মনে মনে কষ্ট পেলেও ধারাকে বুঝতে দিল না। ধারার অনুভূতির ওর মতামতের মূল্য আছে। ধারা না চাইলে নয়ন যতই চাক তাদের মাঝে কিছু হওয়া সম্ভব না। আর যা-ই হোক ভালোবাসা কোনোদিনও জোর করে হয় না।

-তুই নয়নকে ভালো না-ই বাসতে পারলি। কিন্তু ওর সাথে একটু ভালো করে কথা বলিস। তোর কাছ থেকে একটু ভালো আচরণ ছেলেটার দিনটা ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”

-আমি তো নয়ন ভাইয়ের সাথে কথা বলি। তুমি দেখোনি? উনাকে বলেছি আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি। কিন্তু প্রেমিক প্রেমিকা না। নয়ন ভাই আমার কথা মেনে নিয়েছেন। তিনি আমার সিদ্ধান্তের সম্মান দিবেন। আমিও তার অনুভূতিকে সম্মান করব।”

-যাক এটা ভালো করেছিস। ভালোবাসা জোর করে হয় না। আবার ভালোবাসা বলে কইয়েও হয় না। তোরা দু’জনই ভালো থাক আমি এটাই চাই।”
*****

বড় রাস্তায় বিয়ের গেট বাঁধা হচ্ছে। এই গেট দিয়ে বরের গাড়ি ঢুকবে। নয়ন একটা টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে হাতে থাকা তার গুলো উপরে বসা লোকটার হাতে দিচ্ছে। মুনতাসীর কলেজে যাচ্ছে। নয়ন দূর থেকে ওকে দেখে টেবিল থেকে নেমে দাঁড়াল। মুনতাসীর আসার অপেক্ষা করে একটা পিচ্চিকে কিছু বলে বাড়িতে পাঠাল। মুনতাসীর নয়নের কাছাকাছি চলে এলে নয়ন তাকে সালাম দিল। মুনতাসীর ঠিক বুঝতে পারল না নয়ন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। সে সালাম নিল। নয়ন বলল,

-আমি আপনার কাছে যেতাম। সেদিন ধারাদের বাড়িতে যাওয়ার সময় আপনার কথা খেয়াল ছিল না। আমার বোনের বিয়ে শুনেছেন নিশ্চয়। আপনিও একটা কার্ড পাবেন প্রফেসর সাহেব।”

পিচ্চি ছেলেটা দৌড়ে একটা কার্ড হাতে নিয়ে নয়নের কাছে এসে ওর হাতে দিয়ে চলে গেল। নয়ন লজ্জিত হেসে বলল,

-আপনি কিন্তু আসবেন। আপনার সাথে এর আগে আমার কখনও কথা হয়নি। একদিন সময় করে আপনার সাথে চেনা পরিচিত হবো।”

ছেলেটা অত্যন্ত আন্তরিক হয়ে ভদ্র ভাবে কথা বলছে। মুনতাসীর ওর সম্পর্কে টুকটাক অনেক কথা শুনেছে। কিন্তু ওসব কথার সাথে তার সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটার কোন মিল খুঁজে পেলো না। মানুষ কারো সম্পর্কে এতটা বাড়িয়ে কেন বলবে? নয়নকে তো ওর খারাপ মনে হচ্ছে না।

-আপনি তো কলেজে যাচ্ছেন। আমিও একটু ব্যস্ত। পরে অন্য কোনোদিন কথা হবে। আপনি কিন্তু আমার বোনের বিয়েতে আসবেন।”

মুনতাসীর হেসে বলল,

-ঠিক আছে আসব।”
*****

-আপু আমার শাড়িটা পরিয়ে দে না।’

-দাঁড়া একটু।’

-দাঁড়াতে পারব না। এক্ষুনি দে। দে না আগে একটু পরে অন্য কাজ কর। আপু দে। প্লিজ!”

ধারা বিরক্ত হয়ে হাতের কাজ ফেলে রেখে জেসমিনের দিকে ফিরল।

-এত অধৈর্য কেন তুই? মানুষের একটু তো ধৈর্য থাকে। তোর তো এক ফোঁটাও নেই। দেখছিস একটা কাজ করছি।’

-তোর কাজ তো পরেও করা যাবে। আর আজ হলুদ, তুই কি রোজী আপাদের বাড়িতে যাবি না?’

ধারা জেসমিনকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। জেসমিন নাড়াচাড়া করলে ধমকে উঠে বলল,

-চুপ করে দাঁড়া না। ছাগলের বাচ্চার মতো একরকম তিড়িংতিড়িং করছিস কেন!’

জেসমিন হাসতে হাসতে বলল,

-কাতুকুতু লাগে কী করব।’

ধারা কিছু বলল না। কিন্তু জেসমিন চুপ করে নেই। সে বলেই যাচ্ছে।

-তুই যাবি না?’

-যাব না বলেছি একবারো?’

-না। কিন্তু গেলে এরকম কামের বেডি সেজে আছিস কেন? এভাবে যাবি নাকি!”

-আমি কামের বেডি তাই এরকম সেজে আছি। তোর মতো বেকার রাজ্যের রাজকন্যা না আমি।”

-মুনতাসীর ভাইও কি যাবে?’

ধারা ঝুঁকে বসে শাড়ির কুঁচি ঠিক করছিল। ঝট করে একবার বোনের মুখের দিকে দেখল সে। কঠিন গলায় বলল,

-এই প্রশ্ন আমাকে করার মানে কি? আমি কীভাবে বলব কে যাবে আর কে যাবে না।”

-রেগে যাচ্ছিস কেন তুই! এক বাড়িতে থাকি এটুকু জানতেই পারিস।”

-আমার তোর মতো অন্যের সম্পর্কে জানার আগ্রহ ইচ্ছে আর ফালতু সময় কোনটাই নেই।”

-মুনতাসীর ভাইকে তুই দেখতে পারিস না কেন? ছোটবেলা তো একসাথে ছিলি। মানে পরিচিত একজন মানুষের সাথে ওরকম ব্যবহার করিস কেন। বেচারা তোকে চিনেও তোর সাথে ভয়ে কথা বলতে আসে না।”

-তোর হয়ে গেছে। যা এবার।”
*****

হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না ধারার। মানুষের ভীড় সোরগোল পছন্দ না তার। তার উপর পাড়ার সব কাকীরা আসবে। নয়ন ভাই তাকে পছন্দ করে এটা এ পাড়ার কারোরই অজানা না। সে ওখানে গেলে অনেকে অনেক কথা বানাবে। তাই ধারা যত পারে এরকম পরিবেশ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। দরকার কি কাউকে কথা শোনানোর সুযোগ করে দেওয়ার।
হৈ-হুল্লোড় জুড়ে দিয়ে পাড়ার কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে ধারাদের বাড়িতে এসে উঠল। বাইরে থেকেই ওরা ধারাকে ডাকছে।

-ধারা আপু, ও ধারা আপু। কই তুমি। নয়ন ভাই তোমাকে যেতে বলেছে। আমাদের পাঠিয়েছে তোমাকে নিতে।’

অন্য একজন বলল,

-রোজী আপাও তোমাকে যেতে বলেছে। তুমি না গেলে নাকি রোজী আপাও তোমার বিয়েতে আসবে না।”

-চলো চলো। কই তুমি? এখনও রেডি হও নি।”

এই ছেলেগুলো তাকে না নিয়ে যাবে না বুঝতে পেরে ধারা বলল,

-তোরা সবাই যা আমি রেডি হয়ে আসব। আমার সময় লাগবে। তোরা গিয়ে আনন্দ কর।”

-সত্যি আসবে তো?”

-হ্যাঁ।”

-দশ মিনিটের মধ্যে না গেলে আমরা কিন্তু আবার আসব।’

-আচ্ছা আসিস।”

-তোমাদের মেহমান কই? ঘরে? নয়ন ভাই উনাকেও যেতে বলেছে। তুমি উনাকেও নিয়ে এসো। আমরা যাই।”

বলেই ছেলেগুলো দৌড়ে চলে গেল। ধারা পড়ে গেল আরেক ঝামেলায়। মেহমানকে সে কীভাবে নিয়ে যাবে? তার উপর এই দায়িত্ব দেওয়ার মানে কী! লোকটা না গেলে সে কি জোর করে নিয়ে যাবে।

চলবে_