এক বরষায় পর্ব-১৭+১৮

0
522

#এক_বরষায়[১৭]
লেখনীতে_জেরিন আক্তার নিপা

————-
ধারা ভেবে পাচ্ছে না সে কীভাবে মুনতাসীরকে রোজী আপার হলুদে যেতে বলবে! এই কাজটা তো নয়ন ভাইয়ের করা উচিত ছিল। ধারা মানছে নয়ন ভাই বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। তাই বলে তার উপর দায়িত্ব দিবে মানুষটাকে নিয়ে যাওয়ার! এটার কোন মানে হয়! ধারা কয়েকবার মুনতাসীরের ঘরের সামনে থেকে ঘুরে এসেছে। মানুষটা ঘরেই আছে। কিন্তু ডাকতে অস্বস্তি লাগছে। আর ডাকলেও কী বলবে এটাই ঠিক করে উঠতে পারছে না।

-এর থেকে ভালো আমিই যাব না। বাচ্চা গুলো আবার এলে ওদেরই বলতে বলব।”

ধারা মুনতাসীরের ঘরের সামনে পায়চারি করতে করতে কথাগুলো ভাবছিল। তখন মুনতাসীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলে দু’জন সামনাসামনি হয়ে যায়। মুনতাসীর ধারাকে দেখে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে ধারার দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করলেও সেই উপায় নেই। এভাবে কারো সামনে থেকে পালিয়ে যাওয়া যায় না। এটা ভদ্রতার মাঝে পড়ে না। মুনতাসীর ধারাকে দেখে বুঝে নিল ধারা কিছু বলতে চায়। সে নিজেই জিজ্ঞেস করল,

-কিছু বলবেন?”

ধারা প্রথমে দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে না করলেও পরক্ষণে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। জীবনে কারো সামনে এতটা অপ্রস্তুত হয় না সে যতটা এই লোকটার সামনে হয়। এই লোকের সামনে কেনই যেন তার সব আত্মবিশ্বাস কমে যায়। গলা দিয়ে শব্দ বের করতে পারে না। এরকমটা কেন হয় ধারা বুঝতে পারে না। তারপরও ধারা নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,

-নয়ন ভাই আপনাকে ওদের বাড়িতে যেতে বলেছে।”

মুনতাসীর একবার চোখ তুলে ধারাকে দেখে নিল। চোখাচোখি হয়ে গেলে ধারা মনে মনে খানিকটা মিইয়ে গেল যেন। মুনতাসীর ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

-আপনার কাছে বলেছে?”

ধারা আজ মুনতাসীরের কথা বলার ধরন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কথার স্বরে কেমন যেন রসিকতা আছে!

-বাচ্চাদের পাঠিয়েছিল। নয়ন ভাই নিজে আসতে পারেনি। ওর বোনের বিয়ে,অনেক কাজ আছে।”

ধারা নয়নের হয়ে কথা বলছে। মুনতাসীর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

-হুম।”

ধারা আবার প্রশ্ন করল,

-আপনি কি যাবেন না?”

-যাব।”
******

শাড়ি পরার কোন ইচ্ছে ছিল না ধারার। সে রেডি হতে হতে নয়ন ভাই আবার আতিফকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আতিফ এসে ওকে তাড়া দিচ্ছে।

-ধারা আপু, তুমি বাড়িতে এতক্ষণ কী করছো বলো তো? তোমার জন্য হলুদ দেওয়া শুরু হচ্ছে না।”

-সেকি! আমার জন্য হলুদ দেওয়া শুরু হবে না কেন?”

-সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি না গেলে কীভাবে শুরু হবে!”

-আমার জন্য অপেক্ষা করবে কেন? আমি তো…

-কথা বলে আর দেরি করো না তো। তাড়াতাড়ি চলো। আর তুমি এটা কী পরেছ! রোজী আপা তোমাকেও শাড়ি পরতে বলেছে।”

ধারা আঁতকে উঠে বলল,

-না না। আমি সালোয়ার কামিজেই ঠিক আছি। শাড়ি টাড়ি আমি পরব না।”

-রোজী আপা তোমাকে আবার পাঠাবে। তুমি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছো। মুনতাসীর ভাই কই? নয়ন ভাই উনাকেও যেতে বলেছেন।”

-ঘরেই আছে।”

-আচ্ছা তুমি জলদি করে শাড়ি পরে নাও। আমি মুনতাসীর ভাইকে বলে আসি।”

ধারা শুধু শাড়িটাই পরল। একটুও সাজলো না। মুখে একটু পাউডারও লাগালো না। ঠোঁট রাঙাবে তো অনেক দূরের কথা। তার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে কেউ হলুদ দিচ্ছে না, এই ঘটনার পর পাড়ায় তার আর নয়ন ভাইকে নিয়ে আরও কথা উঠবে। জেসমিন দাদীকে নিয়ে অনেক আগেই চলে গিয়েছিল। আতিফও তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলে চলে গেছে। ধারা ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে এলো। সে উঠানে নামতেই মুনতাসীরও ঘর থেকে বেরুলো। ধারাকে চোখের সামনে দেখে অনেকটা সময় ওভাবেই তাকিয়ে থাকল সে। কিছুক্ষণের জন্য সকল ভাবনাচিন্তা ভুলে গেল। এই প্রথম ধারাকে শাড়িতে দেখছে সে। কেউ ঠিকই বলেছিল, শাড়িতেই নারীর সৌন্দর্য। নিজের দিকে মানুষটার এই দৃষ্টি বুঝতে পেরে ধারা কঠিন হলো। তাড়াহুড়ো করে ওই স্থান ত্যাগ করতে চাইল। কিন্তু গেটের কাছে এসে বিপত্তি ঘটল। শাড়ির নিচের দিকটা গেটের ভাঙা লোহার সাথে আটকে গিয়ে ধারা পড়ে যেতে নিচ্ছিল। আর তখনই পেছন থেকে দু’টা হাত শক্ত করে তার কোমর ধরে ফেলল। যার কারণে অর্ধেক ঝুঁকে গিয়েও পুরোপুরি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েনি ধারা। যে পরিস্থিতি থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল এখন তার থেকেও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির স্বীকার হলো ধারা। হাত দু’টোর মালিক যে অন্য কেউ না তা ধারা খুব সহজেই বুঝে নিল। চোখ বুজে ফেলেছিল ও। সোজা হয়ে বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মেলে তাকাল। এই মুহূর্তে ধারার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। পড়ে গেলে পড়ে যেত সে। কেন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো লোকটা? সে কি উনার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। আজকের পরে কি ধারা কোনোদিনও লোকটার সামনে সহজ হতে পারবে?

-ধারা ত…’ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মুনতাসীর। ধারাকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে এসেছিল। সে নিজেও এতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে ধারাকে ধরার আগে ভাবেনি। পড়ে গেলে ব্যথা পেত ও। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর বুঝতে পারল সাহায্য করতে গিয়ে ধারার জন্য সবটা আরও কঠিন করে দিয়েছে ও। তবুও কিছু হয়নি এমন ভাব করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-আপনার কোথাও লাগেনি তো?”

থমথমে মুখে কঠিন গলায় ধারা বলল,

-আপনার কাছে আমি সাহায্য চেয়েছিলাম?”

-কিন্তু আপনাকে সাহায্য করা আমার জরুরি মনে হয়েছে।”

ধারা আর কিছু বলল না। নিজের পতন রোধ করতে ধারা কিছু একটা ধরে চেয়েছিল। গেটে ধরতে গিয়ে কিছু একটার সাথে লেগে হাত কেটে গেছে এটা এতক্ষণ খেয়াল করেনি। এখন জায়গাটা জ্বালা করছে দেখে হাতের দিকে চোখ গেল। কেটে গিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। মুনতাসীরের চোখও ধারার হাতের দিকে পড়ল। সে কিছু ভাবল না ঝট করে ধারার হাত ধরে ফেলে বলল,

-কিসের সাথে লেগেছে? অনেকটা কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে।”

ধারা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

-আমি দেখেছি রক্ত পড়ছে।”

মুনতাসীর কঠিন চোখে ধারাকে দেখল। হাতটা আবার মুঠোয় ধরে নিয়ে বলল,

-রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে।”

ধারা এবারও হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলে মুনতাসীর আরও শক্ত করে ধরল। ধারা অধৈর্য গলায় বলল,

-হাত ছাড়ুন।”

-আমি দেখছি।”

-আমি পারব। আমার হাত ছাড়ুন।”

ধারা হাত মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলে মুনতাসীর ধমকের স্বরে বলল,

-সবসময় এই অর্থহীন জেদ করা ভালো না। কথা কানে যায় না! আমি বলছি না, দেখছি আমি। হাতটা নিশ্চয় খেয়ে ফেলব না আমি।”

ওর ধমক খেয়ে ধারা চুপ হয়ে গেল। পরাজয় মেনে নিয়ে ছলছল চোখে মুনতাসীরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুনতাসীর ওর পকেট থেকে রুমাল বের করে ধারার হাতে বেঁধে দিয়েছে।
ধারা তখন তাকে দেখেই গেট দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরুতে গিয়েছিল। মুনতাসীর ধারার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

-পরের বার থেকে আমাকে দেখে পালানোর কোন দরকার নেই। আমি বাঘ ভাল্লুক না। মানুষ খাই না।”
*******

ধারাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনার পর শরীরের সমস্ত জোর হারিয়ে ফেলেছে সে। কোনরকমে ভারী পা দু’টোকে টেনে নিয়ে নয়ন ভাইদের বাড়িতে এসে পৌঁছুল। তার পেছন পেছনেই মুনতাসীর এসেছে। ধারাকে দেখে সবার হৈহল্লা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। জেসমিন কোথা থেকে ছুটে এসে বলল,

-এত দেরি করলে কেন? ঢঙ! তোমার জন্য এখনও হলুদ মাখাতে পারিনি।”

বলেই আবার চলে গেল। বোনের হাতের দিকে তাকানোর সময় পেল না সে। নয়ন ধারাকে দেখে এগিয়ে এলো। ধারা শাড়ি পরেছে! দিনদিন মেয়েটার মায়ায় আরও বেশি করে জড়িয়ে যাচ্ছে ও। কিন্তু ধারাকে সে পাবে না। এটা ধারা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে। মনটাকে শক্ত করতে চায় নয়ন। ধারার হাতের দিকে নয়নের চোখ গেলে মুহূর্তে ওর সব উলোটপালোট হয়ে গেল। অস্থির গলায় জানতে চাইল,

-তোর হাতে কী হয়েছে ধারা? কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছিস কেন? রক্ত বেরুচ্ছে নাকি!”

-কিছু হয়নি নয়ন ভাই।”

-কিছু হয়নি মানে কি? আমাকে তুই কানা মনে করিস? চোখ নেই আমার!”

-সামান্য কেটে গেছে। ও কিছু না।”

নয়ন ঝট করে ধারার হাত ধরে ফেলল। ধারা রাগ করতে পারে এই বোধবুদ্ধি এখন তার নেই।

-অনেকটা কেটেছে নাকি? কীভাবে কাটলো? তুই যে কী করিস না! এটা কী দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছিস। ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

মুনতাসীর ওদের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। পেছন থেকে এই দৃশ্যটা সবটুকু দেখল সে। নয়ন ওর বেঁধে দেওয়া রুমালটা খুলে ফেলেছে। ধারার হাত দেখে আঁতকে উঠে বলল,

-এটাকে একটু কেটে যাওয়া বলছিস তুই ধারা! তুই তো মানুষ না রে!”

ধারা হেসে ফেলল। বলল,

-তাহলে আমি কী?”

-তুই, তুই একটা… তোকে কিছু বলাই বেকার। আয় আমার সাথে এক্ষুনি হাসপাতালে যাব।”

-এই সামান্য ব্যাপারের জন্য আপনি এখন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন! হাসপাতালে যাওয়ার মতো কোন কারণ ঘটেছে কি?”

-তাহলে আয় আমিই ব্যান্ডেজ করে দিই। পরে ডাক্তারকে বলে ঔষধ এনে দেব।”

-এখন কিছুই করতে হবে না নয়ন ভাই। আমি চাই না আমার জন্য রোজী আপার এই বিশেষ দিনটা নষ্ট হোক। আপনি যদি আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন, তাহলে আমি এক্ষুনি বাড়ি চলে যাব।”

এই ঘাড় ত্যাড়া মেয়েকে নয়ন সোজা করতে পারবে না। তাই রাগ করেই আর কিছু বলল না সে। ধারা মুনতাসীরের রুমালটা নয়নের হাত থেকে নিয়ে বলল,

-এটা থেকে ইনফেকশন হবে না। আপনি চিন্তা করবেন না।”

নয়নের সামনেই পরম যত্নে ধারা রুমালটা হাতে পেঁচিয়ে নিল। মুনতাসীর নিঃশব্দে ওখান থেকে সরে গেল।

চলবে_

#এক_বরষায় [১৮]
#লেখনীতে_জেরিন আক্তার নিপা

———–
জেসমিন, আতিফ দু’জন পরপর কয়েকবার এসে ধারার মুখে হলুদ লাগানোর চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু ধারা প্রতি বারই ধমক দিয়ে ওদের আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে। ভয়ে কেউ আর ধারার মুখে হলুদ ছোঁয়াতে পারেনি। রোজী ধারাকে দেখে হাসছে। শেষে ধারা বিরক্ত হয়ে বলল,

-আমাকে দেখে ওভাবে হেসে না তো। কেমন আজব লাগে।”

রোজী হাসতে হাসতেই বলল,

-তুই এমন রাগী হয়েছিস কেন? তোর বাবা দাদা বোন কেউই তো তোর মতো রাগী না। তোর নাক সবসময় সাত আসমানে থাকে কেন।”

-জানি না।”

– বেচারা ছেলে মেয়ে দু’টোকে একটু হলুদ মাখাতে দিবি ,তা-ও দিলি না। উল্টো ধমক দিয়ে ওদের আনন্দটাই মাটি করে দিলি।”

-বিয়ে কি আমার? আমাকে হলুদ লাগাতে হবে কেন? আর তুমি যাদের বেচারা বলছো ওরা একেকটা শয়তানের নানা নানী।”

মুনতাসীর এসেছে দেখে নয়ন সত্যিই ভীষণ খুশি হয়েছে। সাউন্ড বক্সে কী যেন সমস্যা দিয়েছে। নয়ন তা ঠিক করতে গেছে। মুনতাসীর এখন একা দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে ধারাকে দেখছে সে। জেসমিন দু-হাত ভর্তি হলুদ নিয়ে হাত দু’টো পেছনে লুকিয়ে রেখে মুনতাসীরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুনতাসীর ওকে দেখে হাসল। জেসমিনও দাঁত বের করে হাসল।

-কি, কিছু বলবে?”

মুনতাসীর কথা শেষ করার সাথে সাথেই জেসমিন মুনতাসীরের চোখে মুখে হলুদ ডলে দিয়ে এক ছুটে পালিয়ে গেল। মুনতাসীর বেচারা ভাবতেই পারেনি এই শয়তান মেয়ে এমন কিছু করবে। কিছু বুঝে উঠার আগেই যা হবার হয়ে গেছে। দূর থেকে জেসমিন গলা উঁচিয়ে বলল,

-সরি মুনতাসীর ভাই। কিন্তু আজ সবাইকে হলুদ লাগাতে হবে।”

মুনতাসীর পকেটে হাত দিল। না, রুমালটা নেই। ওটা দিয়েই তো ধারার হাত বেঁধে দিয়েছিল। তার চোখে হলুদ চলে যাওয়ার তাকাতে পারছে না।
ধারা রোজী আপার সাথে বসে থেকে এই দৃশ্য দেখে ইচ্ছে করেছিল তার বোনটাকে কানের নিচে এক চড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেলে। রোজী জেসমিনের কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল। বলল,

-দেখ দেখ পাঁজিটা কী করল! বেচারা মেহমান! শার্টটাই নষ্ট করে দিয়েছে।”

রোজী আপার হাসি পেলেও ধারার রাগ উঠছে। সে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

-ওর এই কাজে তোমার হাসি পাচ্ছে? লোকটার চোখে হলুদ গেছে দেখছ না!”

রোজী তীক্ষ্ণ চোখে ধারাকে দেখল। ধারার হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারল না।

-চোখে গেছে, কিন্তু তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন? জেসু মজা করেছে।”

-এই কাজ কোন মজার মধ্যে পড়ে! আর যার তার সাথে মজা করলেই হলো!”

-আচ্ছা তুই এখন আবার জেসমিনকে বকাঝকা করে ওর মন নষ্ট করে দিস না। আমি দেখছি। এই রাকিব শোন…

রোজী কাউকে ডাকল। ছেলেটাকে বলল মুনতাসীরকে চোখ মুখ ধোয়ার জন্য পানি এনে দিতে। সাউন্ড বক্স ঠিক হয়ে গেছে। আবার গান বাজছে। ধারা রোজী আপার হাতে মেহেদি পরিয়ে দিল। অনেকক্ষণ ধরে বসেছিল সে। এবার একটু উঠে দাঁড়াল। ধারা স্টেজ থেকে নামতেই নয়ন এসে ওর সামনে হাজির। চোখ বাঁকিয়ে ধারাকে দেখে বলল,

-কিরে! সবাই হলুদ মাখিয়ে ভূত হয়ে আছে তোর মুখ সাদা কেন?”

-আমার ভূত হওয়ার ইচ্ছে নেই তাই।”

-উঁহু এই কথা বললে তো হবে না। আজকে সবাইকেই ভূত হতে হবে।”

-একদম না।”

-তুই না বললেই তো হবে না।” কথাটা বলে নয়ন আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগল। যা খুঁজছিল চোখের সামনে পেয়েও গেল। ধারা দেখল নয়ন ভাই বাটি থেকে হলুদ বাটা হাতে নিয়েছে। সে মানা করতে থাকলেও তার কথা শুনছে না।

-নয়ন ভাই আমি না করছি কিন্তু। নয়ন ভাই সত্যিই কিন্তু ভালো হবে না।” নয়ন তার কথা মানছে না দেখে ধারা ওর থেকে পালাতে লাগল। নয়নও ধারার পেছনে ছুটছে। পাড়ার মহিলা গুলো একজন আরেক জনকে ইশারা করে ওদেরকে দেখাচ্ছে। সাথে নানান মন্তব্য করছে।

-দেখছ কারবার! বোনের বিয়াতে নিজেরা লীলা কীর্তি লাগাই দিছে। লজ্জা শরমের বালাই নাই। ছি ছি!”

-নয়ন তো আগে থেইকাই ধারারে পছন্দ করে। কিন্তু নবাবের বেডি যা খেল দেখাইছে! এখন তো সবই চোখের সামনে। নয়নরে পছন্দ না তাইলে এত ডলাডলি কেন!”

মহিলা গুলোর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শুনে মুনতাসীর কিড়িমিড়ি খেয়ে চুপ রইল। চাইলেও এনাদের কিছু বলতে পারবে না ও। এই পাড়ার মানুষ গুলোর মন মানসিকতা এত নিচ!
নয়ন ধারাকে হলুদ লাগিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো। ধারা রাগ দেখালেও নয়ন পাত্তা দিল না।
কিন্তু ধারা যে সিরিয়াস রেগে গেছে এটা নয়ন বুঝতে পারেনি।

-এইজন্যই আমি আসতে চাচ্ছিলাম না। আপনার বাড়াবাড়ি আমার একদম ভালো লাগে না। একটা জিনিস না করলে সেটাই কেন করেন। আপনি চান আপনার সাথে আমি চিরতরে কথা বলা বন্ধ করে দেই?”

ধারা হাত দিয়ে গাল মুছতে মুছতে গজগজ করে চলে গেল। নয়নের মুখটা অমাবস্যা রাতের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল।
ধারা তখনই বাড়ি চলে আসতে নিচ্ছিল। তার এখানে আসাই ভুল হয়েছে। মানুষকে লাই দিলে মাথায় চড়ে বসে। ধারা লাইটিং করা জায়গাটা পেরিয়ে অন্ধকারে চলে এলে পেছন থেকে কেউ একজন তার হাত ধরে ফেলল। ধারা হঠাৎ হকচকিয়ে গেলেও চকিতে পেছন ফিরে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। অন্ধকারে মানুষটাকে দেখা না গেলেও এটা নয়ন ভাই-ই হবে ধরে নিয়ে ধারালো গলায় ধারা বলল,

-আপনার তো সাহস কম না! আমার হাত ধরার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে নয়ন ভাই? আমি কিছু বলছি না বলে আপনার যা ইচ্ছা তা করতে পারেন না।”

ধারা আরও চেঁচামেচি করে মানুষ জড়ো করে ফেলার আগে একটা হাত তার মুখ চেপে ধরল। ধারা ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মানুষটার সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। মানুষটা এক হাতে ধারার মুখ চেপে অন্য হাতে ওকে ঠেলে নিয়ে নিরিবিলি দিকটায় নিয়ে চলে এলো। এখানে কোন মানুষ নেই। মুনতাসীর ধারার মুখ থেকে হাত না সরিয়েই বলল,

-এটা আমি।”

কন্ঠটা কানে যেতে ধারা নিশ্চল হয়ে গেল। সে ভেবেছিল নয়ন ভাই। কিন্তু মানুষটা যে ইনি হবে তা কল্পনাও করেনি। ধারার সর্বশরীর কেমন একটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। গলায় জোর না থাকলেও তেজ নিয়ে বলল,

-আপনি!”

-হ্যাঁ আমি।”

-কী চান আপনি?”

-এখন আপাতত কিছু চাচ্ছি না।”

ধারার রাগ উঠে যাচ্ছে। সে মনে মনে কতটা ভয় পেয়েছে তা কি এই লোক বুঝবে! এক মুহূর্তের জন্য ধারা কত কী ভেবে নিয়েছিল। নয়ন ভাই তেমন মানুষ না। তবুও পুরুষ মানুষের রাগ, বলাও যায় না। ধারা এখনও কাঁপছে।

-এসবের মানে কি? কী করতে চাচ্ছিলেন আপনি!”

-কিছুই না। আপনি একা চলে যাচ্ছিলেন দেখেই আটকাতে চাচ্ছিলাম।”

-এটা আপনার আটকানোর নমুনা! আর আমি একা গেলেও আপনার অসুবিধা কী?”

-আমার অসুবিধা না। কিন্তু আপনি কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে যাবার এক মিনিট পরেই এখানের সবার অসুবিধা হতো।”

ধারার সব কথার উত্তর তৈরি আছে লোকটার কাছে। এটা দেখে ধারার আরও বেশি রাগ হলো।

-আপনি ওভাবে আমার মুখ চেপে ধরে এখানে নিয়ে এলেন কেন?”

-আপনার নাম ধরে ডাকলে অনেকেই শুনতে পেত। আমি শুধুমাত্র আপনার হাতটা ধরেছিলাম। আপনি যে চেঁচাচেচি শুরু করে দিয়েছিলেন তাতে এমনিতেই মানুষ জড়ো হয়ে যেত। সেই ভয়েই এখানে নিয়ে আসা।”

-আপনার কাছে বাহানার অভাব নেই দেখছি।”

-এখন যাবেন না। অনুষ্ঠানটা শেষ করে যান।”

-কেন? কেন যাব না আমি?”

-সেটা আমার থেকেও আপনি বেশি ভালো জানেন।”

ধারা থামল। বুক ভরে দম নিল সে। এতক্ষণ রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছিল। মুনতাসীরকে কিছু না বলে আবার রোজী আপাদের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। বাড়ি এসে দেখল ওকে দেখতে না পেয়ে এইটুকু সময়েই ধারার খোঁজ পড়ে গেছে। রোজী আপা জেরা করা গলায় জিজ্ঞেস করল,

-কোথায় গিয়েছিলি তুই? মাঝে মাঝে ভূতের মতো হাওয়ায় মিশে যাস!”

ধারা জোর করে মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে বলল,

-কোথাও যাইনি তো। এখানেই ছিলাম।”

-এভাবে ঘামছিস কেন তুই?”

ধারা কপালে হাত দিল। বলল,

-কই? গরম লাগছে মনে হয়।”

রোজী আর কথা বাড়াল না। সে চলে গেলে ধারা ছোট করে শ্বাস ফেলল। মুনতাসীর পেছন থেকে এসে ধারার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,

-এটা রাখুন। এত ঘেমেছেন কেন? নিজেকে এত সাহসী দেখান, এত ভয় পেলে চলবে?”

ধারা মটমট চোখে মুনতাসীরের দিকে তাকাল। লোকটা তার সাথে রসিকতা করছে! এই লোকের আচরণ দিনদিন পাল্টে যাচ্ছে। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ধারার পেছন পড়েছেন ইনি?
*****
আজ রোজী আপার বিয়ে। প্রতিটা মেয়ের জীবনেই এই দিনটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিয়ে নিয়ে কার স্বপ্ন না থাকে? সবারই থাকে। রোজী আপারও আছে নিশ্চয়। ধারার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে রোজী আপা কি তার প্রথম প্রেম ভুলতে পেরেছে? কিন্তু এই কথা সে জিজ্ঞেস করতে পারবে না। ধারাকে অন্যমনস্ক দেখে দাদী বললেন,

-ও ছেড়ি কার ভাবনায় ডুইবা আছোস?”

ধারা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দাদীর সামনে থেকে উঠে গিয়ে বলল,

-কারো না দাদী।”

-এই বুইড়া চোখরে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ না। নিজের বিয়ার কথা ভাবতাছিলি, না?”

ধারা হাসল। বলল,

-বিয়েই করব না তাহলে বিয়ের কথা ভাবব কেন?”

-বিয়া করবি না কইলেই তো হইবো না রে নাতি। আল্লাহ কপালে লেইখা রাখলে তুই না করার কেড? ভাগ্যে যে আছে সে তো আসবোই।”

ধারা বাইরের দিকে দেখল। আকাশে মেঘ করেছে। প্রকৃতি অন্ধকার হয়ে আসছে। আজ বৃষ্টি হলে রোজী আপার বিয়ের কী হবে? এত গুলো মেহমানদের কোথায় জায়গা দিবে!

-দাদী আজ কি বৃষ্টি হবে?”

-কেডা জানে, হইতেও পারে।”

-বৃষ্টি হলে কীভাবে হবে দাদী! আজ যেন বৃষ্টি না হয়।”

-বৃষ্টি হইতো না কেন? আল্লাহ খুশি হইলে বৃষ্টি হয়।”

দাদী আরও কী কী যেন বলছে। ওসব কোন কথাই আর ধারার কানে যাচ্ছে না। সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে একজনকে দেখছে। ডান হাতটা চোখের সামনে ধরে দেখল। রুমালটা কি ফিরিয়ে দিতে হবে? রক্ত লাগা রুমালটা ধুয়ে দিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছে সে।

চলবে